‘মার্ক্সের পুরনো ছুঁচোটি গভীরে রয়েছে’ : নোম চমস্কি

সম্পাদকীয় নোট: নোম চমস্কির সাক্ষাৎকারটি Marx’s Old Mole is Right Beneath the Surface শিরোনামে ০৮ এপ্রিল ২০২১ তারিখে বোস্টন রিভিউতে প্রকাশিত হয়। ডেভিড বারসেমিয়ান সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন। অনুবাদ করেছেন ইমন রায়। ইমন রায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রনিকস এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক সম্পন্ন করে বর্তমানে আর্মি ইন্সটিটিউট অফ বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনে এমবিএ অধ্যয়নরত৷

সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন রাজনীতি অতিমারী এবং বর্ণগত ন্যায়বিচারের প্রতিবাদ থেকে শুরু করে ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল বিক্ষোভের মত কেন্দ্রীভূত সংকট দ্বারা জর্জরিত। নতুন বাইডেন প্রশাসনের অধীনে প্রগতিশীল রাজনীতির সম্ভাবনা কী রকম? ২০২১ সালের ১৫ মার্চ অ্যারিজোনার ওরো ভ্যালিতে চমস্কি ও অলটারনেটিভ রেডিও-র উপস্থাপক ডেভিড বারসেমিয়ানের মধ্যকার এই রেডিও কথোপকথনের সম্পাদিত সংস্করণে নোয়াম চমস্কি জলবায়ু, বর্ণ, অভিবাসন এবং বিপ্লব নিয়ে কথা বলেছেন। ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত অল্টারনেটিভ রেডিও হলো একটি পুরস্কারজয়ী এক ঘণ্টার পাবলিক এফেয়ার্স অনুষ্ঠান যা পাবলিক রেডিও স্টেশনগুলোতে প্রচার করা হয়।    

ডেভিড বারসেমিয়ানঃ আপনার একটি নতুন বই বেরিয়েছে কনসিক্যুয়েন্সেস অফ ক্যাপিটালিজমঃ ম্যানুফ্যাকচারিং ডিসকন্টেন্ট এন্ড রেজিস্ট্যান্স,” যেটি আপনার অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী মার্ভ ওয়াটারস্টোনের সাথে যৌথভাবে রচনা করেছেন। “রাজনীতি কী?” শীর্ষক যে কোর্সটি আপনি যৌথভাবে নিয়েছেন তার ওপর ভিত্তি করে এটি লিখিত। এ সম্বন্ধে আমাদেরকে বলুন।

চমস্কি : বিগত পাঁচ বছর ধরে ছাত্র-ছাত্রী ও কমিউনিটির জন্য আমরা যেসব কোর্স পড়িয়েছি, এটি হচ্ছে মূলত সেগুলোর একটি বর্ধিত নথি। বক্তৃতাগুলোকে একটি সিরিজে ভাগ করা হয়েছে। আপনি যা জানেন ও বিশ্বাস করেন তার ভিত্তির প্রশ্ন নিয়ে আমরা শুরু করি। গ্রামসীয় আধিপত্যমূলক (hegemonic) কাণ্ডজ্ঞানকে কীভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়? ওয়াল্টার লিপম্যানের শব্দবন্ধ ধার করে বলতে হয়, কীভাবে সম্মতি উৎপাদিত হয়? তারপর আমরা নির্দিষ্ট বিষয়গুলোর দিকে যাই, বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো দিয়ে শুরু করি– সামরিকতন্ত্র ও আণবিক যুদ্ধ, পরিবেশগত ধ্বংস–এবং সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের দেশীয় ইস্যুর দিকে তাকাই : সামাজিক আন্দোলনগুলোর প্রতিবন্ধকতা, সেগুলো কী অর্জন করতে পারে, সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কীভাবে চেষ্টা করা হয়। আমরা প্রতি সপ্তাহে এক্টিভিস্ট আন্দোলন থেকে বক্তাদের নিয়ে আসি, তারা বর্ণনা করেন কী করছেন, কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন, কী ধরনের সুযোগ আছে। আর আমরা এসব বক্তৃতা প্রতি বছর হালনাগাদ করে তাদের কাছে নিয়ে আসি। এটি একটি খুব প্রাণবন্ত অভিজ্ঞতা।

ডেভিড বারসেমিয়ান : আপনি মুখবন্ধে লিখেছেন, “এ প্রজাতি কি টিকে থাকবে? সংগঠিত মানব জীবন কি টিকে থাকবে? এসব প্রশ্ন এড়িয়ে চলা যাবে না। দর্শক হয়ে থাকার কোনো উপায় নেই।”

চমস্কি : পছন্দ করুন কিংবা না করুন, এটিই সত্য। মানব সমাজ কোনো সংঘবদ্ধ আকারে বজায় থাকবে কিনা, অথবা আমরা অপরিবর্তনীয় খাদের কিনারে চলে গেছি কিনা এবং আমরা সম্পূর্ণ বিপর্যয়ে পতিত হয়েছি কিনা সে বিষয়ে এ প্রজন্মই সিদ্ধান্ত নেবে। আণবিক অস্ত্রের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির বেলায় একই প্রশ্নঃ এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অন্যান্য সমস্যা রয়েছে। ব্যাপক ও অহেতুক জীবনের মূল্য দিয়ে কোনো একভাবে অতিমারীকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, কিন্তু আরও কিছু অপেক্ষা করছে। আর সেগুলো আরও গুরুতর হতে পারে যদি আমরা সেগুলোর প্রস্তুতির জন্য– বিজ্ঞানভিত্তিক কাজ ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে– গুরুতর পদক্ষেপ না নেই। তারপর আসবে প্রজাতির টিকে থাকার অন্যান্য প্রধান ইস্যু– শুধুমাত্র মানব প্রজাতিই নয়। আমরা অবিশ্বাস্য মাত্রায় অন্যান্য প্রজাতিকে ধ্বংস করার দিকে ধাবিত হচ্ছি যা ৬.৫ কোটি বছর ধরে দেখা যায়নি। আর এখন এটি আগের চেয়ে অনেক দ্রুততার সঙ্গে ঘটছে। এটাকে পঞ্চম বিলুপ্তি বলা হতো। আমরা বর্তমানে ষষ্ঠ বিলুপ্তির মাঝে রয়েছি।

ডেভিড বারসেমিয়ান : আপনি বইতে যা আলোচনা করেছেন তার মধ্যে একটি হচ্ছে অষ্টাদশ শতকের এনলাইটেনমেন্ট দার্শনিক ডেভিড হিউম এবং বিংশ শতকের উল্লেখযোগ্য মার্ক্সবাদী চিন্তক আন্তোনিও গ্রামসির মধ্যকার সংযোগ। এই সংযোগটি কী?

চমস্কি : হিউম ছিলেন একজন মহান দার্শনিক। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছিলেন “অফ দ্য ফার্স্ট প্রিন্সিপালস্‌ অফ গভর্নমেন্ট” (১৭৪১), যা এখনকার রাজনৈতিক দর্শন কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ওপর লিখিত অন্যতম ধ্রুপদী রচনা। একটি প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে তিনি আলোচনা শুরু করেছেন। তিনি বলেন, লোকে যে “স্বাচ্ছন্দ্য” নিয়ে ক্ষমতা কাঠামোর নিকট নিজেদের সমর্পণ করে তা দেখে তিনি অবাক হয়েছেন। এটি একটি রহস্য, কারণ খোদ মানুষের হাতে সত্যিই ক্ষমতা আছে। তারা কেন মালিকদের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে? এর উত্তর হলো, তাঁর ভাষায়, অবশ্যই সম্মতিঃ আমরা এখন যেটিকে সম্মতি উৎপাদন বলি, সেখানেই মালিকরা সফল হয়েছেন। তারা জনগণকে এই বিশ্বাসে এক কাতারে নিয়ে আসেন যে তাদেরকে অবশ্যই ক্ষমতা কাঠামোর কাছে নিজেদেরকে সমর্পণ করতে হবে। আর তিনি বলেন, বর্বর কিংবা মুক্ত সমাজ নির্বিশেষে সকল সমাজে এই অদ্ভূত ব্যাপার ঘটেছে।

হিউম প্রথম গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরই লিখছিলেন, সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়কার ইংরেজ বিপ্লব, যা ব্রিটিশ সংবিধানের পথ দেখিয়েছিলো– আদতে, যার ফলে রাজা সংসদের অধীনস্ত হবেন। সে সময় সংসদ বলতে মূলত বেনিয়া ও উৎপাদকদের বুঝাতো। হিউমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অ্যাডাম স্মিথ বিপ্লবের ফলাফল নিয়ে লিখেছেন। তাঁর নিজের বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য ওয়েলথ অফ নেশনস্‌ (১৭৭৬)-এ তিনি দেখিয়েছেন, তখনকার সার্বভৌম “বেনিয়া ও উৎপাদক”রা হচ্ছেন সত্যিকারের “মানব জাতির মালিক।” তারা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তাদের নিজেদের স্বার্থ যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিত করতে তাদের ক্ষমতার ব্যবহার করেন, এর প্রভাব ইংল্যান্ডের জনগণের ওপর যতই “মর্মান্তিক” হোক না কেন– এবং যা আরও খারাপ তাদের জন্য, যারা তাঁর ভাষ্যমতে “ইউরোপীয়দের বর্বর অবিচারের” শিকার হয়েছেন, যার মাধ্যমে তিনি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। 

দ্য ওয়েলথ অফ নেশনস্‌  প্রকাশের আগের বছরে আমেরিকান বিপ্লব সংঘটিত হয়। প্রায় এক দশক পর আমেরিকান সংবিধান গঠিত হয়, অনেকটা প্রথম গণতান্ত্রিক বিদ্রোহের সময়ের মতন। সেটি রাজা ও সংসদের মধ্যকার একটি সংঘাত হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিলো। আর যেমনটা আমি বললাম, এটি শেষ হয়েছে সংসদ, উদীয়মান বেনিয়া এবং উৎপাদক শ্রেণীর নিকট রাজার অধীনস্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে।

তবে এটি পুরো গল্প নয়। সাধারণ জনগণও ছিলো যারা রাজা কিংবা সংসদ কারোর দ্বারাই শাসিত হতে চায়নি। এটি ছিলো একটি প্রাণবন্ত ইশতেহারের কাল। ভ্রাম্যমাণ শ্রমিক ও মন্ত্রীরা অধিকাংশ জনসাধারণের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন। নাইট ও ভদ্রলোকদের দ্বারা শাসিত হতে নয় যারা কেবল মানুষকে নির্যাতন করতে চান, তাঁদের ইশতেহারে ও আলোচনায় আহ্বান জানানো হয়েছিলো সহনাগরিকদের দ্বারা শাসিত হওয়ার জন্য, যারা মানুষের চাহিদার কথা জানেন। তাঁরা সর্বজনীন স্বাস্থ্য, সর্বজনীন শিক্ষা, এবং আরও অনেক কিছু চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা শেষ পর্যন্ত গুঁড়িয়ে গিয়েছিলো। হিউম ও স্মিথ দুজনেই ব্রিটেনে বেনিয়া ও উৎপাদকদের বিজয়ের পরে কেবল রাজাকে নিয়ে নয়, বরং জনসাধারণকে নিয়েও লিখেছিলেন।

এটি আমেরিকান সংবিধানে পুনরায় বিধিবদ্ধ করা হয়েছে, যেটি মাইকেল ক্লারম্যান তাঁর গ্রন্থ দ্য ফার্মার্স ক্যু  (২০১৬) তে লিপিবদ্ধ করেছেন। সাধারণ মানুষ গনতন্ত্র চেয়েছিলো। কৃষকরা– সম্পদশালী লোকেরা, যাদের প্রায় অর্ধেকই দাস মালিক– গণতন্ত্রের বিপদকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছেন, অনেকটা প্রথম গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় যারা নিজেদেরকে “শ্রেষ্ঠ গুণাবলী” সম্পন্ন মানুষ বলতেন তাঁদের মতন। স্মিথ যা উপলব্ধি করেছিলেন তা জেমস ম্যাডিসনের উপলব্ধি করতে কয়েক বছরের বেশি সময় লাগেনি। ১৭৯১ সালে তিনি তাঁর বন্ধু থমাস জেফারসনকে একটি চিঠি লিখেছিলেন যেখানে তিনি গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধ্বসে পড়াকে নিন্দা করেছেন যা তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বলে তিনি মনে করতেন– খুব বেশি গনতন্ত্র নয়, তবে অন্তত কিছুটা। ম্যাডিসন আক্ষেপ করেছিলেন স্টক-জবার– আমাদের সময়ে যাকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বুঝায়– এত বেশি ক্ষমতা গ্রাস করেছিলো যে তারা সরকারের “যন্ত্র ও স্বেচ্ছাচারী” হয়ে উঠেছিলো। নিজেদের স্বার্থের জন্য কাজ করার মধ্য দিয়ে তারা সরকারের জন্য কাজ করতো কিন্তু তারা সরকারকে নিয়ন্ত্রণও করতো।

একই রকম সমস্যাগুলোর অনেক কিছু আজও রয়ে গেছে। গ্রামসীয় সংস্করণটি আধুনিক পরিভাষায় একই নীতিগুলোর বিবরণ দেয়। আর একই রকম অনেকগুলো ইস্যু উঠে আসে। তাই হ্যাঁ, সংযোগ রয়েছে।

ডেভিড বারসেমিয়ান :বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে কথা বলা যাক, গ্রামসির পরিভাষায় “জৈবিক” ও “ঐতিহ্যিক” উভয়ই। ঐতিহ্যিক অনেক সময় ক্ষমতার শ্রুতিলেখক হিসেবে নিন্দিত করা হয়। এখানে “দায়িত্বশীল বুদ্ধিজীবী”দের ধারণা রয়েছে। গ্রামসি তাঁদেরকে বলতেন “বৈধকরণের কাজে বিশেষজ্ঞ।” আর তারপর, অবশ্যই, হেনরি কিসিঞ্জার যা যোগ করেছেন সেটি রয়েছে দীর্ঘায়িত সংজ্ঞায়।

চমস্কি : “দায়িত্বশীল” বুদ্ধিজীবীদের ধারণাটি আধুনিক গণতন্ত্রের প্রধান উদারনৈতিক তাত্ত্বিকদের কাছ থেকে এসেছে– যেমন ওয়াল্টার লিপম্যান (অনেক সময় আধুনিক সাংবাদিকতার জনক হিসেবে পরিচিত), হ্যারল্ড ল্যাসওয়েল (আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা), এডওয়ার্ড বার্নেইস (জনসংযোগ ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা), নাইবার (উদারনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ধর্মতত্ত্ববিদ হিসেবে বিবেচিত, অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়)। গণতন্ত্র কীভাবে কাজ করা উচিত সেটি নিয়ে তাঁরা সকলেই লিখেছেন। তাঁরা বলেছেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের– শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের– ক্ষমতা বহাল রাখা উচিত।

তাঁদের মতে, জনসাধারণ হলো নির্বোধ ও অজ্ঞ; জনগণকে তাদের নিজেদের বিষয় চালাতে দেওয়া যাবে না। নাইবারের ভাষায় “প্রয়োজনীয় বিভ্রম” এবং “সংবেদনশীল কার্যকর অতিসরলীকরণ” দিয়ে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনগণের একটা স্থান আছে, লিপম্যান যেমন বলেছেন। তারা “দর্শক”, “অংশগ্রহণকারী” নয়, কিন্তু তাদের একটি ভূমিকা আছে। প্রতি চার বছর পর তারা হাজির হবে এবং তাদেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দায়িত্বশীল লোকদের মধ্য থেকে একজন অথবা অন্য কাউকে বেছে নিবে, এবং তারপর তারা তাদের কাজে ফিরে যাবে এবং আমাদেরকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না। দায়িত্বশীল লোকেরা “হতভম্ব ঝাকের পদদলন ও হুংকার” থেকে মুক্ত। জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া, তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য কাজ করার সামর্থ্যের ব্যাপারে, ল্যাসওয়েলের ভাষায়, আমাদের “গণতান্ত্রিক গোঁড়ামি” দ্বারা অভিভূত হলে চলবে না। কেনেডির আমলে, আপনি মনে করতে পারবেন যে আমাদেরকে টেকনোক্র্যাট ও পলিসিভিত্তিক এলিটদের প্রতি নত হওয়ার কথা ছিলো। ডেভিড হ্যালবারস্টেম যাদেরকে বলতেন “শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে দ্যুতিময়।”

তারপর ছিলেন খারাপ লোকেরাঃ মূল্যবোধভিত্তিক বুদ্ধিজীবীরা, অধিকার ও ন্যায়বিচার নিয়ে ভাবিত লোকেরা। কেনেডি ও জনসনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রাক্তন হার্ভার্ড ডীন ম্যাকজর্জ বান্ডি যাদেরকে বলতেন “ডানাযুক্ত জংলী মানুষ।” যেসব মানুষ শুধু এলিটদের কৌশলকে নয়, বরং তাদের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছিলেন তাদের সমালোচনা করতে গিয়ে ১৯৬৭ সালে বান্ডি এই উক্তি করেছিলেন। বান্ডি মনে করতেন যেসব মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন এবং মূল্যবোধভিত্তিক বুদ্ধিজীবীরা যাদেরকে উসকে দিচ্ছিলেন, আমাদেরকে তাদের থেকে মুক্ত হতে হবে।

ইতিহাসজুড়ে এই প্রভেদ চলে আসছে। “বুদ্ধিজীবী” শব্দটি তার আধুনিক বোধ অনুযায়ী সত্যিকার অর্থে  ঊনিশ শতকের শেষ দিকের ফ্রান্সে ড্রাইফাস এফেয়ার্সের বছরগুলোতে বিকশিত হয়েছিলো, এমিল জোলা এবং অন্যান্য লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা আলফ্রেড ড্রাইফাসের প্রতি ঘৃণ্য দুর্ব্যবহার– বানোয়াট অভিযোগে তাঁর দণ্ডাদেশের সমালোচনা করছিলেন। তাঁরা সামরিক বাহিনী ও রাষ্ট্রের সমালোচনা করছিলেন। এসব মহান প্রতিষ্ঠানসমূহের সমালোচনা করার দুঃসাহস দেখানোর জন্য ফরাসী একাডেমির অমরদের দ্বারা তাঁরা রূঢ়ভাবে নিন্দিত হয়েছেন। তাঁরা ছিলেন ডানাযুক্ত জংলী মানুষ। আক্রমণ এড়ানোর জন্য জোলাকে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে এবং অন্যরা কারাগারে গিয়েছেন। এটাই ইতিহাস। আপনি যদি ডানাযুক্ত জংলী মানুষ হন এবং ক্ষমতাবানদের প্রতি আনুগত্যের ঊর্ধ্বে যেতে দুঃসাহস দেখান, তাহলে আপনাকে সম্ভবত একভাবে বা অন্যভাবে ভোগান্তি পোহাতে হবে।

সুতরাং ডানাযুক্ত জংলী মানুষ আছেন এবং তারপর ক্ষমতার শ্রুতিলেখকরা আছেন। এই কায়দার গুরু খোদ কিসিঞ্জার নিজেকে ভালোভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের “ঐকমত্য”কে “প্রসারিত ও সংজ্ঞায়িত” করার মাধ্যমে তাদের ভাবনাকে প্রকাশ করাই পলিসি বুদ্ধিজীবীর কাজ। তাঁরা যদি একে ঠিকমত তুলে না ধরেন তাহলে আমরা তাঁদের জন্য সঠিকভাবে এটি প্রকাশ করবো। এটি হচ্ছে সিরিয়াস বুদ্ধিজীবীর কাজ। আর এভাবেই আপনি একজন সম্মানিত, দায়িত্বশীল বুদ্ধিজীবী হবেন।

ডেভিড বারসেমিয়ান : বই থেকে খবরের দিকে আসা যাক। লাল গ্রহ থেকে পারসিভিয়ারেন্স রোভারটি ছবি পাঠাচ্ছে। অনেক বছর আগে আপনি বলেছিলেন মঙ্গলে থাকা এক সাংবাদিকের কথা। সে কীভাবে অতিমারী ও ভ্যাক্সিনের সূচনা নিয়ে খবর করবে?

চমস্কি : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিরাট সংখ্যক মানুষ ভ্যাক্সিন নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। তারা ব্যাপক আকারে রিপাবলিকান এবং তারা অনেক ব্যাখ্যাই দেনঃ সরকারের প্রতি অবিশ্বাস, বিজ্ঞানের প্রতি অবিশ্বাস। তবে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ নয়। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্সে কেবল ৪০ শতাংশ মানুষ এটি নিতে চায়। যদি আমরা এই মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাই তাহলে ভ্যাক্সিন গ্রহণের গুরুত্ব নিয়ে প্রচুর প্রমাণাদি আছে কিন্তু সরকার, বিজ্ঞান ও কর্তৃপক্ষের প্রতি ভীতি ও বিরাগ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে লোকে যা করা উচিত তা এড়ানোর জন্য খুবই বিপজ্জনক পদক্ষেপ নিচ্ছে।

এর সাথে অন্যান্য দেশের তুলনা করুন। অস্ট্রেলিয়া খুব দ্রুত এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। একটি প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের একটি খুবই কার্যকরী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আছে যা লোকে ভরসা করে। তারা একে অপরের জন্য সমষ্টিগত দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক। তারা কঠোর লকডাউন মেনে নিয়েছে যা খুবই সফল ছিল এবং রোগটি মূলত নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছিলো। একই ঘটনা ঘটেছে নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অন্যান্য দেশগুলোতে। তবে অনেক জায়গায় অসন্তোষ ও অবিশ্বাস এতই বেশি যে বিরাট সংখ্যক মানুষ রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ ও দমন করার জন্য সমষ্টিগত প্রচেষ্টায় অংশ নিতে একদমই অপারগ।

ডেভিড বারসেমিয়ান : আপনি আপনার ভ্যাক্সিন পেয়েছেন?

চমস্কি : আমি দুই দিন আগে দ্বিতীয়টি পেয়েছি। আমার হাত একটু কালশিটে হয়ে আছে।

ডেভিড বারসেমিয়ান : ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে আক্রমণের মধ্য দিয়ে অসন্তোষ একটি নাটকীয় মোড় নিলো। সেখানে যা ঘটেছে সে বিষয়ে আপনার বোঝাপড়া কী?

চমস্কি : সবার প্রথমে, এটি ছিলো স্পষ্টভাবে একটি অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা। তারা নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে চেষ্টা করছিলোঃ এটি একটি অভ্যুত্থান। যারা অংশ নিয়েছিলো, একটি প্রকট বৈশিষ্ট্য হচ্ছে– ছবিগুলোর দিকে দেখুন– কম সংখ্যক তরুণরা জড়িত ছিলো। এটি বেশ অস্বাভাবিক; রাজনৈতিক ঘটনা ও মিছিলগুলোয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে তরুণরাই বেশি থাকে। এখানে ছিলো মধ্যবয়সী ও বৃদ্ধ লোকেরা; আর তারা সবাই উৎসাহী ট্রাম্প সমর্থক। তিনি তাদেরকে এই কাজ করতে প্ররোচিত করছিলেন।

তারা সবাই আদতে প্রবলভাবে বিশ্বাস করে নির্বাচন লুট হয়েছে; তারা বিশ্বাস করে তাদের দেশকে অশুভ শক্তির মাধ্যমে তাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। মনে রাখবেন, প্রায় অর্ধেক রিপাবলিকান ভোটার মনে করেন যে ডেমোক্রেটিক শিশুকামী থেকে সংখ্যালঘু থেকে অন্যান্য যারা চিরাচরিত খ্রিস্টীয় জীবনধারার ক্ষতি করছে ও ধ্বংস করছে, সেসব দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে এ দেশকে মুক্ত করার জন্য ট্রাম্প ঈশ্বরের দ্বারা প্রেরিত হয়েছেন। সেখানে অধিক সহিংস মিলিশিয়ার উপাদান ছিলো, যেমন প্রাউড বয়েজ। এটি ছিলো একটি অত্যন্ত সহিংস কর্মকাণ্ড। পাঁচজন মানুষ মারা গেছেন; এটি আরও খারাপ হতে পারতো। এটি ছিলো উন্মত্ত মানুষের দ্বারা সংঘটিত একটি উন্মত্ত কর্মকাণ্ড। আমরা সেই সত্যকে অগ্রাহ্য করতে পারি না। আর দেশের একটি বড় অংশ এটি সমর্থন করেছে।

৬ জানুয়ারির পর রিপাবলিকান পার্টিতে যা ঘটেছে তা আগ্রহোদ্দীপক। যারা আদতে দেশের মালিক– স্মিথের মানব জাতির মালিকেরা, পার্টির অর্থায়ন করে যে দাতা শ্রেণী– তারা ট্রাম্পকে সহ্য করছিলো; তারা তাকে পছন্দ করে না। প্রাণবন্ত দয়ালু মানুষ হিসেবে তাদের নিজস্ব প্রতিচ্ছবিতে, তাদের বার্তা যে আপনি আমাদের ভরসা করতে পারেন, সেখানে তিনি বাগড়া দিচ্ছেন। তারা তার অশ্লীলতাকে, তার পাগলামিকে পছন্দ করেনি, কিন্তু তারা তাকে সহ্য করেছে কারণ তিনি তাদের পকেট ভরিয়েছেন। অতি ধনীদের পকেটে টাকা ভরানোর জন্য, কর্পোরেশনগুলোকে সুবিধা দেওয়ার জন্য, এবং মানুষকে রক্ষা করে কিন্তু মুনাফায় হস্তক্ষেপ করে এমন সব প্রবিধানকে বাতিল করার জন্য তার সমগ্র আইন প্রণয়নকারী কর্মসূচি তৈরি করা হয়েছিলো। তিনি যতক্ষণ সেটি করছিলেন ততক্ষণ তারা তাকে সহ্য করতে ইচ্ছুক ছিলো। তবে ৬ জানুয়ারি ছিলো যাচ্ছেতাই। আর প্রায় তৎক্ষণাৎ, অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রধান কেন্দ্রসমূহ– চেম্বার অফ কমার্স, বিজনেস রাউন্ডটেবল, প্রধান কর্পোরেট নির্বাহীবৃন্দ– খুব জলদি পদক্ষেপ নিলো এবং ট্রাম্পকে সরাসরি বললো, যথেষ্ট হয়েছেঃ এখন যাও।

আচ্ছা, ট্রাম্প বিমানে করে গেলেন মার-এ-লাগো। রিপাবলিকান পার্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মিচ ম্যাককনেল দাতাদের কথা শুনলেন এবং ট্রাম্পকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করতে শুরু করলেন; তিনি এবং অন্যান্য রিপাবলিকান সিনেটররা অচলাবস্থা নিরসনের দিকে এগোতে শুরু করলেন। তবে তারা খুব বেশি দূর গেলেন নাঃ ট্রাম্প যে বিক্ষুদ্ধ জনতাকে জড়ো করেছেন তারা তাদের মুখোমুখি হচ্ছেন। রিপাবলিকান পার্টি এভাবে থমকে গেলো। তারা কি দাতা শ্রেণীর কথা শুনবেন এবং ট্রাম্পবাদের একটি অধিকতর সুশীল সংস্করণের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন? নাকি তারা ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণে থাকা সেই শক্তির কাছে ভেসে যাবেন?

ম্যাককনেল ও ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে একে অন্যকে সহ্য করতে পারেন না, কিন্তু তাদের একটি সমস্বার্থ আছেঃ এটি নিশ্চিত করা যে দেশটি শাসনযোগ্য নয়, বাইডেন যেন কিছু অর্জন করতে না পারেন। এটি গোপন কিছু নয়– বারাক ওবামা যখন পুনঃনির্বাচিত হন তখন ম্যাককনেল স্পষ্টভাবে ও খোলাখুলিভাবে তা ঘোষণা করেছিলেন। সে সময় কংগ্রেস ম্যাককনেলের দখলে ছিলো না। তিনি বলেন ওবামা যেন কোনো কিছু করতে সফল না হন তা নিশ্চিত করাই হচ্ছে কাজ। তাই যে প্রণোদনা দরকার ছিলো তা তিনি হ্রাস করে দিলেন এবং অন্য উপায়ে দেশ পরিচালনা ও দেশের সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করার প্রচেষ্টায় বিঘ্ন ঘটালেন। তিনি এখন যে একই কাজ করবেন সেটা ধারণা করার সকল কারণ রয়েছে।

ট্রাম্প ভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে একই জিনিস চান। দেশ যাতে শাসনযোগ্য না থাকে, যাতে জনগণ যথাসম্ভব দুর্ভোগে থাকেন, সেটি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টায় তারা দুজনেই ঐক্যবদ্ধ এই আশায় যে তখন ডেমোক্রেটদের দোষারোপ করা যাবে এবং পূর্ণ শক্তি নিয়ে তারা ২০২২ ও ২০২৪ সালে ফিরে আসতে পারবেন। এটি আমরা সদ্য পাশ হওয়া প্রণোদনা বিলের ক্ষেত্রে দেখতে পেলাম। এখনকার রিপাবলিকান ডানপন্থীরা কিছুটা পুরনো কমিউনিস্ট পার্টির মত। তারা সেই নীতি মেনে চলছেন যাকে লেনিনবাদীরা বলে থাকেন গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। পার্টির একটি নীতি আছে। এটি উপর থেকে নির্দেশিত হয়, এবং সবাইকে সমানভাবে তা মানতেই হবে। কোনো বিচ্যুতি সহ্য করা হয় না। তাই কোনো কোনো রিপাবলিকান সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান যদি প্রণোদনার দিকগুলো সমর্থন করেও থাকেন এবং তারা এটাও জানেন যে তাদের নির্বাচকরা এটি সমর্থন করেন, তারপরও তাদেরকে এর বিপক্ষে ভোট দিতে হবে। আমরা বর্তমানে এই পরিস্থিতিতে আছি।

আমার অবশ্যই বলতে হবে যে বাইডেন এখন পর্যন্ত যা করেছেন সেটা আমার কাছে বরং একটি সুখকর বিস্ময়। আমি যা প্রত্যাশা করতে পারতাম এটি তার চেয়েও ভালো। দেশীয় নীতিমালায় ত্রুটি ও বর্জনের জন্য বামেরা তাঁকে বেশ তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছে। আমার দৃষ্টিতে এসব সমালোচনা সঠিক কিন্তু একটু অন্যায্য। আপনি যাই বলুন, অর্ধেক সিনেট যদি শতভাগ বিপক্ষে অবস্থান নেয় তখন আপনি কেবল এটুকুই করতে পারেন। আর যখন সেখানে ডেমোক্রেটরা তাদের সাথে থাকবেন তখন এটি আপনার অর্জনকে সীমিত করে দেবে। পররাষ্ট্র নীতি একটি ভিন্ন ইস্যু। 

ডেভিড বারসেমিয়ান : আপনি কি ফিলিবাস্টার বাতিল করার পক্ষে, যেটাকে বারাক ওবামা বলেছিলেন “একটি জিম ক্রো ধ্বংসাবশেষ?”

চমস্কি : সবার আগে আমি সন্দিহান এটি করা যাবে কিনা। তাই এটি মূলত কোনো ইস্যু নয়; এটি করা উচিত  কিনা সেটি অন্য প্রশ্ন।     

ফিলিবাস্টারকে খুব ধ্বংসাত্মক উপায়ে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে অতীতে বর্ণবাদী আইন ঠেকানোর জন্যও এটি ব্যবহার করা হয়েছে। আরও বেশি মৌলিক ইস্যু হচ্ছে দুটো রাজনৈতিক দল কেন আছে, যাদের উভয়ই সম্পদ ও ক্ষমতার একই সংকীর্ণ শ্রেণী– মূলত, দাতা শ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল। এদের মধ্যে একটি এতই উগ্র যে তারা সংসদীয় রাজনীতি একেবারেই বর্জন করেছে। এটি এখন নিজেকে একটি সংখ্যালঘু পার্টি হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ লড়ছে। এই সময়ে চলমান অনেক প্রধান লড়াইয়ের সাথে প্রণোদনার কোনো সম্পর্ক না থাকলেও হাউজে গৃহীত আইনের সাথে এগুলোর সম্পর্ক রয়েছে।

এইচ.আর.১, ডেমোক্রেটিক হাউজে পাশ হওয়া প্রথম বিল, খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এটি মূলত ভোটের অধিকারকে সংহত করেঃ এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভোটের অধিকারের ওপর রিপাবলিকানদের বড় আঘাত আছে। সংখ্যালঘু ও দরিদ্র মানুষকে একদমই ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য দেশজুড়ে আক্ষরিক অর্থে শত শত আইনি প্রস্তাব রয়েছে– রিপাবলিকানরা যেসব রাজ্যের আইনসভা নিয়ন্ত্রণে আছে– যাতে রিপাবলিকানরা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে পারে। তারা একটি সংখ্যালঘু দল; তারা প্রায় সবসময় নির্বাচনে পরাজিত হয়; কিন্তু তারা বিভিন্ন উপায়ে ক্ষমতা রক্ষা করে। আর এটি আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে। এই লড়াইয়ের ফলাফল ভবিষ্যতের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে।

নির্বাচনে রিপাবলিকানদের এক ধরনের কাঠামোগত সুবিধা আছে কারণ ডেমোক্রেটিক ভোটারদের অধিকাংশই শহরগুলোতে কেন্দ্রীভূত। তার মানে আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রদত্ত ভোটের একটি বড় অংশ একদমই হারিয়ে যায়। একজন প্রার্থীকে প্রদত্ত ভোটের ৮০ শতাংশ যদি এক জায়গা থেকেই আসে তাহলে তার মধ্যে ৩০ শতাংশ অপরিহার্যভাবে হারিয়ে যায়। রিপাবলিকান ভোট, বিপরীত ক্রমে, গ্রামীণ কাউন্টি ও ছোট রাজ্যগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যাদের প্রতিনিধিত্ব তাদের জনসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি। এ সবকিছুই রিপাবলিকানদের একটি কাঠামোগত সুবিধা দেয়ঃ তারা যদি ৪ অথবা ৫ শতাংশ ভোট হারায়, তারপরও নির্বাচনে জিততে পারে। তাদের বর্তমান প্রচেষ্টা হচ্ছে তাদের ভোট যদি অনেক কম থাকে তারপরও এই কাঠামোগত সুবিধাকে শক্তিশালী করা, যার ফলে তারা ক্ষমতা রক্ষা করতে পারবে।

এর সাথে রয়েছে ম্যাককনেলের বড় প্রকল্প যখন তিনি ক্ষমতায় আছেনঃ প্রতিটি স্তরে, কম বয়সী, অতি ডানপন্থী আইনজীবীদের দিয়ে বিচার বিভাগকে প্যাক  করার চেষ্টা করা। সামনের বছরগুলোতে জনগণ যা-ই চান না কেন, এক প্রজন্ম ধরে তারা প্রগতিশীল আইন প্রণয়ণকে আটকে দেওয়ার অবস্থানে থাকবেন। এসকল সংগ্রাম আমাদের অত্যধিক পশ্চাৎপদ রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ যা, এমনকি সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও, একটি সাংবিধানিক সংকটের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটি অন্তর্নিহিতঃ সংবিধানের গণতন্ত্র-বিরোধী বিধানসমূহের অধীনে আপনি একটি গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকতে পারেন না। অবশ্যই, সবচেয়ে চরম ব্যাপার হচ্ছে, সিনেট যেটি প্রতি রাজ্যে দুটি ভোটের মান্যতা দেয়। তার অর্থ হচ্ছে ওয়াইওমিং প্রায় ৬ লাখ মানুষ নিয়ে, ৪ কোটি মানুষের ক্যালিফোর্নিয়ার সমান প্রতিনিধিত্ব পায়। তারপর আছে ইলেকটোরাল কলেজ।

পুরো সাংবিধানিক ব্যবস্থার এসব এবং অন্য অনেক গভীর সমস্যাকে সংশোধনী (amendment) দিয়ে ঠিক করা যাবে নাঃ ছোট রাজ্যগুলো তা হতে দেবে না। সত্যিকারের অস্তিত্বমূলক সমস্যাগুলোর পাশাপাশি আমরা এসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। কিন্তু আমরা যদি আসন্ন পরিবেশগত বিপর্যয়, আণবিক যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি, নতুন অতিমারীর গুরুতর ঝুঁকি নিয়ে মোকাবেলা না করি তাহলে অন্য কিছুর মূল্য নেই।

ডেভিড বারসেমিয়ান : প্রকৃতপক্ষে, শেষ আটটি প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনের মধ্যে রিপাবলিকানরা কেবল একবার পপুলার ভোটে জিতেছে। কিন্তু ৬ জানুয়ারির কথা চিন্তা করলে নির্বাচন চুরি হয়ে যাওয়ার গুজব কতখানি শক্তিশালী? আমি প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির কথা ভাবিঃ পিঠে ছুড়ি মারার তত্ত্ব যা নাৎসিরা বেশ কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছিলো। ওরা বলতো,  আমরা যুদ্ধে জিতেছি, কিন্তু কমিউনিস্টরা, সমাজতন্ত্রীরা ও ইহুদীরা আমাদের সাথে কূটচাল করেছে এবং আমাদেরকে বিক্রি করেছে। আমরা কি আজ সেটির পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি?

চমস্কি : আমি ট্রাম্পের সম্বন্ধে জানি না, কিন্তু তাঁর ব্যাকুল অনুরক্ত সমর্থকরা স্পষ্টতই তা বিশ্বাস করেন। তারা বিশ্বাস করেন নির্বাচন চুরি হয়ে গেছে, তাদের দেশকে তাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে, তাদের চিরাচরিত খ্রিস্টান, শ্বেতাঙ্গ কমিউনিটিকে তাদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর পক্ষে তাদের কিছু ভিত্তি আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি মফস্বল শহরে যান এবং আপনি যা দেখবেন তা হচ্ছে বিক্রয়যোগ্য বাড়ি, লাটে ওঠা ব্যবসা, খালি প্রধান সড়ক, বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যাংক। একটি গির্জা হয়ত থাকতেও পারে, কিন্তু প্রাক্তন শিল্পগুলো নেই, কম বয়সীরা চলে যাচ্ছে। এটি আর শ্বেতাঙ্গ খ্রিস্টান কমিউনিটি নেই, যেখানে অন্য মানুষেরা জানতো যে ওটা তাদের জায়গা।

এটি সত্য। নির্বাচন চুরি হয়ে গেছে এমন সব গল্প বিশ্বাস করার জন্য এটি একটি ভিত্তি, যদিও আদতে, ভোটের দমনে, ভোটদান প্রতিরোধ করতে, আফ্রিকান আমেরিকানদের ভোটদানকে কঠিন করে তোলার কাজে রিপাবলিকানরা অনেক এগিয়ে ছিলো। কিন্তু তারা দৃঢ়ভাবে তা বিশ্বাস করে। তাই আমি মনে করি না যে আমাদের এটিকে দ্বিচারিতা (hypocrisy) বলা উচিত। এটি তার চেয়েও ভয়ানক কিছু। এটি একটি বর্বর বিশ্বাস, যার ভিত্তি আছে বাস্তবতার উপকরণে। আর এ ধরনের বিশ্বাস অত্যন্ত ভয়াবহ, কিন্তু তা প্রতিশ্রুতি দেয়, কারণ আপনি তখনই এর মধ্যকার বাস্তবতার উপকরণ মোকাবেলা করতে পারেন এবং বিশ্বাসটি ধ্বসিয়ে দিতে পারেন যখন আপনি বাস্তবতার সেসব উপকরণ থেকে মুক্ত হতে পারবেন যার ওপর ভিত্তি করে তা দাঁড়িয়ে আছে। এটি সত্য যে, গ্রামীণ আমেরিকা নব্যউদারনৈতিক বিশ্বায়নের দ্বারা ধ্বংস হয়েছে। এটি একটি সত্য।

এটি হতে হবে এমন নয়। আপনি ওসব সত্যকে ছাপিয়ে যেতে পারেন। আর এর সাথে সাথে, বিশ্বাসের কাঠামোটি ক্ষয়ে যেতে শুরু করবে। সবগুলো নয়, যেগুলোর ভিত্তি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যে, যেগুলোর ভিত্তি চিরাচরিত খ্রিস্টান ও খ্রিস্টীয় জাতীয়তাবাদে। ওসব গভীরভাবে প্রোথিত। ওগুলো গভীর সাংস্কৃতিক সমস্যা। আমরা এই সত্যকে জলদি সামাল দিতে পারবো না যেখানে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী তাদের জীবদ্দশায় পুনরুত্থানের প্রত্যাশা করে। আপনি অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করার মাধ্যমে এটি মোকাবেলা করতে পারবেন না। তবে আমাদের সক্ষমতার মধ্যে থাকা ব্যাপারগুলোকে মোকাবেলা করার মাধ্যমে– যেমন গ্রামীণ কমিউনিটির অর্থনৈতিক ভিত্তির ধ্বস, গরীব কৃষকের বিনাশ, কৃষিব্যবসার দখল– খুব ভয়ঙ্কর বিশ্বাস কাঠামোর ভিত্তিতে ক্ষয় ধরানোর মাধ্যমে আমরা অগ্রসর হতে পারি। সামনে এগোনোর অন্য কোনো পথ নেই। আর আপনাকে আশা করতে হবে যে এটি কাজ করবে।

ডেভিড বারসেমিয়ান : এর মধ্যে জলবায়ু সংকট দ্রুত গতিতে বিরাজ করছে। ফেব্রুয়ারির শুরুতে, হিমালয়ের গলে যাওয়া হিমবাহ থেকে বন্যা হয়েছে ও বাঁধ বিধ্বস্ত হয়েছে, ফলে নিচের দিকে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে মৃত্যু ও ধ্বংসলীলা দেখা গেছে। মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর অ্যান্টার্কটিকার ব্রান্ট আইস শেলফ থেকে একটি বিশাল বরফখণ্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ৪৯০ বর্গমাইল ক্ষেত্রফলের বরফখণ্ডটি নিউ ইয়র্ক সিটির চেয়ে ৬২ গুণ বড়। জলবায়ু বিশৃঙ্খলার মোকাবেলায় আমরা কী করতে পারি?      

চমস্কি : আমরা এসব সমস্যার কথা বলতে পারি। যারা বৈজ্ঞানিক জার্নাল পড়েন তারা জানেন যে আপনি নিয়মিতভাবে আসন্ন আরও খারাপ সমস্যার আবিষ্কার দেখেন। আমরা পছন্দ করি বা না করি, এগুলো সংঘটিত হবে। বায়ুমণ্ডলে এরই মধ্যে থাকা কার্বন ডাই অক্সাইডের কারণে এটি হয়েছে। প্রতি দশ লক্ষে কণার সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে একটি বাস্তবিক বিপজ্জনক বলয়ের দিকে যাচ্ছে, আমরা ইতোমধ্যে যে ক্ষতি সাধন করেছি শুধুমাত্র তার কারণে এটি অব্যাহত থাকবে। আমরা যা জিজ্ঞেস করতে পারি তা হচ্ছে ঝুঁকি প্রশমনে ও সমস্যার অবদমনে কি আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি? উত্তর হচ্ছে, হ্যাঁ।

বব পলিন ও আমি কয়েক মাস আগে ক্লাইমেট ক্রাইসিস এন্ড গ্লোবাল গ্রীন নিউ ডিল  নামে একটি নতুন বই নিয়ে এসেছি। এর মূলে আছে প্রধানত জলবায়ু বিপর্যয়ের মোকাবেলায় তাঁর অত্যন্ত বিস্তারিত ও চমৎকার কাজ। একটি সম্ভাব্য উপায়ে সংকট মোকাবেলার জন্য কার্যকরভাবে যেসব ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে তার রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, হিসাব-নিকাশগুলো মোটামুটিভাবে ইঙ্গিত দেয় যে সংকট নিয়ন্ত্রণের জন্য এবং একটি উন্নত ভবিষ্যতের পথে চলতে যে ভিত্তি দরকার তা গড়ে তোলার জন্য জিডিপির ২ থেকে ৩ শতাংশই যথেষ্ট হবে। এটি ক্ষতি নয়ঃ এটি আমাদের সবার জন্য একটি উন্নত পৃথিবী। কম দূষণ, উন্নত চাকরি, উন্নত সুযোগ, উন্নত জীবনযাত্রা– এসব কিছুই জিডিপির একটি শতাংশ দিয়ে সম্ভব যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার খরচের অনেক কম। 

অবশ্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে বেঁচে থাকার যুদ্ধ হিসেবে দাবি করা হয়। তবে এটি আরও বড় যুদ্ধ। পৃথিবী যদি একটি জার্মান-নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব ও একটি আমেরিকান-নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে বিভক্ত থাকতো তখনও আমেরিকা টিকে যেতে পারতো, যেটি আমেরিকার পরিকল্পনাকারীরা আদতে যুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতে অনুমান করেছিলেন। এটি খুবই কুৎসিত পৃথিবী হতো, কিন্তু তা টিকে যেতো। কিন্তু আমরা যদি এটি মোকাবেলা করতে না পারি তাহলে টিকে থাকা যাবে না।

এখন, ট্রাম্প যদি আরও চার বছর ক্ষমতায় থাকতেন, আমরা হয়ত আক্ষরিক অর্থে অপরিবর্তনীয় প্রান্ত বিন্দুতে অথবা তার কাছাকাছি পৌঁছে যেতাম। তাঁর প্রধান নীতিমালা কর্মসূচি ছিলো ইন্ডাস্ট্রি, জীবাশ্ম জ্বালানি ও অন্যান্য খাতে স্বল্প-মেয়াদী মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যত দ্রুত সম্ভব পরিবেশকে ধ্বংস করা, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করা, এবং নিয়ন্ত্রক যন্ত্রকে অপসারণ করা যা কোনো একভাবে সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মানব ইতিহাসে এটি সবচেয়ে জঘন্য কার্যক্রম। এটি সামান্যই আলোচিত হয়; ট্রাম্পকে এ কারণে সমালোচনা করা হয় না। তবে তিনি অন্য যা যা করেছেন সেগুলো এর তুলনায় সম্পূর্ণ তাৎপর্যহীনতায় ম্লান হয়ে যায়। আরও চার বছর, এবং আমরা হয়ত শেষ প্রান্তের নিকটে থাকতাম।

আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা রেহাই পেয়েছি, যদিও দুই বা চার বছরে এটি ফিরে আসতে পারে। ম্যাককনেল-ট্রাম্প কার্যক্রম সফল হতে পারে, সে ক্ষেত্রে আমরা একটি মরণপণ পরিস্থিতিতে থাকবো। যদি এসব নীতিমালা নবায়িত হয়, আপনি পরিণতি অনুমান করতে পারবেন না। এখন আমাদের হাতে এটি নিয়ে কিছু চেষ্টা করার সময় আছে। তবে আমি মনে করি এখন বাইডেনের কার্যক্রমকে কেবল সংরক্ষণ করা হবে নাকি সামনে এগিয়ে নেওয়া হবে তা নিয়ে একটি সত্যিকারের যুদ্ধ হতে চলেছে। আর আমরা যদি টিকে থাকতে চাই তাহলে অবশ্যই একে এগিয়ে নিতে হবে। এটাই প্রত্যাশা।

অন্যান্য ইস্যুর ক্ষেত্রেও তা সত্য। প্রণোদনার কথা ধরুন, যেখানে শিশু দারিদ্র্য, দরিদ্রদের আয় বৃদ্ধি ও আরো কিছু ভালো জিনিস রয়েছে। তবে এগুলো ক্ষণস্থায়ী। এগুলোর যদি সম্প্রসারণ করা না হয় তাহলে খুব বেশি কিছু হবে না। তাইলে এগুলো সম্প্রসারিত করা এবং এগুলো এখন যা দিচ্ছে তার ঊর্ধ্বে যাওয়ার ব্যাপারে একটি লড়াই হতে চলেছে।

এখন এসব বড় লড়াই আসন্ন। রিপাবলিকানরা আদতে সবকিছু রুখে দেয়ার চেষ্টা করবে। হয়ত ভোটাধিকার হ্রাস করা ও অন্য পন্থার মাধ্যমে দেশকে অশাসনযোগ্য হিসেবে সাব্যস্ত করা এবং কোনোমতে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার প্রচেষ্টা থেকে এদের কাউকে বিচ্যুত করা দুরশা। একে একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তির মত দেখায়। তবে ডেমোক্রেটদের মধ্যে অনেক কিছু করা যেতে পারে এবং সেটি করতে হবে। আমরা সকলেই স্মরণ করতে পারি যখন ওবামা ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন তিনি এক দল তরুণ স্বেচ্ছাসেবীর প্রচুর সহায়তায় এসেছিলেন যারা তাঁকে নির্বাচিত করতে অনেক পরিশ্রম করেছিলেন। তিনি হোয়াইট হাউজে আসার সাথে সাথে মূলত তাদের বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। ধন্যবাদ। বিদায়। সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে; আপনাদের কাজ শেষ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁরা বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। তার অর্থ হচ্ছে তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে পারেন– যা তিনি করেছেন, এবং দুই বছরের মধ্যে তিনি কংগ্রেস হারালেন।

আপনি যদি আজ একই ভুল করেন তাহলে সেটাই ঘটবে। আপনি বাইডেনকে যা-ই মনে করুন, তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির রক্ষণশীল শিবির এবং ক্লিনটনীয় নব্যউদারনৈতিক ওয়াল স্ট্রিট-ভিত্তিক শিবিরের চাপের মধ্যে থাকবেন। তারা প্রগতিশীল কার্যক্রমসমূকে বাধা দেবে, যা দেশের জন্য খারাপ হবে কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের বেলায় হবে বিপর্যয়কর।

ডেভিড বারসেমিয়ান : গত বছরের সংকটজুড়ে কমিউনিটির প্রচেষ্টা, পারস্পরিক সাহায্য এবং সংহতি আরও গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় হয়েছে– ফুড ব্যাংক ও প্যান্ট্রি, জামা-কাপড়, সমবায়। সমবায় কী করতে পারে? স্পেনের বাস্ক অঞ্চলের মনড্রাগনকে প্রায়শই একটি সফল মডেল হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

চমস্কি : এটি একটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন স্থান ঘটেছে– মানুষ একে অপরকে সাহায্য করার জন্য একটি কমিউনিটিতে একত্রিত হচ্ছে। যদি কোনো বৃদ্ধ লোক বাইরে যেতে না পারেন তাহলে তার জন্য খাবার নিয়ে আসি। যদি পর্যাপ্ত পানি না থাকে তাহলে মানুষের কাছে পানি নিয়ে আসি। অনেক সময় এটি ঘটেছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পন্থায়।

সবচেয়ে অসাধারণ দৃষ্টান্তগুলোর একটি ছিলো রিও ডি জেনিরোর অত্যন্ত দরিদ্র এলাকাগুলোয়– ফাভেলা, যেগুলো হচ্ছে আদতে গ্যাংদের দ্বারা পরিচালিত দুর্দশাগ্রস্ত এলাকা যেখানে রয়েছে একটার ওপর আরেকটা স্তূপীকৃত ভয়ানক জীর্ণ বসতি। মানুষের কাছে পানি নেই। তাদের কাছে দূরত্বের কোনো পথ নেই। তাদের স্বাস্থ্য সেবা নেই। তবে তারা সংঘবদ্ধ হয়েছিলো– গ্যাংদের মাধ্যমে, যারা এমন অসম্ভব পরিবেশে মানুষকে টিকে থাকতে সাহায্য করার চেষ্টা করেছে। এটি সকল দরিদ্র এলাকায় ঘটেছে।

পারস্পরিক সাহায্য ও সংহতির প্রতি এমন স্বাভাবিক অঙ্গীকার বিবিধ পন্থায় নিজেকে প্রকাশিত করে। এমনকি অতিমারীর পূর্বে ইতোমধ্যে কৃষিতে শ্রমিকদের মালিকানাধীন শিল্প, সমবায় ও সমিতি এবং স্থানীয়তার বিকাশের সূত্রপাত হয়েছে। নব্যউদারনৈতিক বিশ্বায়ন নীতিমালা যেগুলো প্রায় সর্বত্র জনসাধারণের ওপর একটি সত্যিকারের ভয়াবহ প্রভাব বিস্তার করেছে, সেগুলোর চরম ক্ষতিকর প্রভাবসমূহ মোকাবেলা করার জন্য এমন অনেক প্রয়াস রয়েছে। তবে একে মোকাবেলা করার জন্য প্রচেষ্টা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাস্ট বেল্ট এলাকায়, যেখানে নিউ ইয়র্ক ও শিকাগোর ব্যাংকাররা ইস্পাত শিল্পকে চীনে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেখানে শ্রমিকরা সহজে হাল ছেড়ে দেয়নি। তারা ইস্পাত শিল্পকে কিনে নিতে চেয়েছিলো কিন্তু মালিকরা এতে রাজি হয়নি। তারা আরও মুনাফা চেয়েছিলো এবং তারা শ্রমিকদের মালিকানাধীন শিল্পের ধারণাকে পছন্দ করেনিঃ এটি বিপজ্জনক। এর পরিবর্তে যা ঘটেছে তা হলো সেবামূলক অর্থনীতি, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়োজিত শ্রমিকদের মালিকাধীন ব্যবসায়ের বিস্তৃতি।

গার আলপেরোভিৎজ এ সম্বন্ধে অনেক লিখেছেন এবং নেক্সট সিস্টেম প্রজেক্ট-এর অধিকাংশ কাজের প্রবর্তনে নিয়োজিত হয়েছেন। এসব অনেক কিছু ঘটছে। কয়েকটি ইউনিয়ন– আমি জানি না তা কতদূর যাবে– যেমন ইস্পাত শ্রমিকরা, মূলত স্পেনের, বাস্ক কান্ট্রির, মনড্রাগনের কতিপয় অত্যন্ত সফল শ্রমিক-মালিকানাধীন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সমঝোতায় যাওয়ার ব্যাপারে চেষ্টা করছে, এখানে এরকম কিছু গড়ে তোলা যায় কিনা তা দেখার জন্য। এসমস্ত কিছুই খুব গুরুত্বপূর্ণ– কেবল তাদের ক্ষেত্রে নয়, বরং সমাজ কোন পথে আরও বেশি সমষ্টিগত দায়বদ্ধতার দিকে, আরও অধিক অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের দিকে এগিয়ে যায় তার দিকনির্দেশের জন্যও, যদি আমরা এসব সংকট থেকে বের হয়ে কোনো ধরনের মার্জিত সমাজে যেতে চাই। এসব কিছুই ঘটছে। আর অতিমারীর প্রতিক্রিয়ায় আপনি যে পারস্পরিক সাহায্যের কথা উল্লেখ করেছেন সেটা হচ্ছে তার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ডেভিড বারসেমিয়ান : দক্ষিণের সীমান্ত ও অভিবাসন নিয়ে কথা বলা যাক। আপনি মেক্সিকো সীমান্ত থেকে মাত্র ৬০ মাইল দূরে বসে আছেন, যেখানে হাজার হাজার নিঃসঙ্গ শিশুদের বন্দী করা হচ্ছে। একটি সুষ্ঠু ও ন্যায্য অভিবাসন নীতি কেমন হতে পারে?

চমস্কি : মানুষ যে পরিবেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে সেটি দূর করাই কর্মপন্থার প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত। এসব মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে চান না; তাঁরা ঘরে থাকতে চান। কিন্তু ঘরটি বাসযোগ্য নয়– তাঁরা পালাতে বাধ্য হয়েছেন। এটি যে বাসযোগ্য নয় তার জন্য আমাদের একটি বড় দায় আছে। রিগ্যানের আমলে মধ্য আমেরিকার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আঘাত তীব্রভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিলো। লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। নির্যাতন। ধ্বংস। মধ্য আমেরিকায় রিগ্যানের যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ থেকে মানুষ আজও পালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক আছে, আমরা সেই ধ্বংসাবশেষ মোকাবেলা করতে পারি।

আপনি হয়ত মনে করতে পারবেন চার-পাঁচ বছর আগে হন্ডুরাস ছিলো উদ্বাস্তুদের প্রধান উৎস। কেন হন্ডুরাস? কারণ একটি সামরিক অভ্যুত্থান মৃদু সংস্কারপন্থী জেলায়া সরকারকে উৎখাত করেছিলো, একটি সামরিক একনায়কতন্ত্র বহাল করেছিলো, অতি-ধনী অভিজাততন্ত্রের হাতে ফের ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলো এবং দেশটিকে বিশ্বের অন্যতম নরহত্যাকারী রাজধানীতে পরিণত করেছিলো। মানুষ পালাতে শুরু করেছিলো। সেখান থেকে কাফেলা এসেছিলো।

আমরা কি একে থামাতে পারতাম? কাফেলা সমস্যা ছিলো না। কেন তা ঘটছিলো সেটি ছিলো সমস্যা। গোলার্ধের অন্যান্যরা যখন অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়েছে তখন ওবামা ও তাঁর স্টেট সেক্রেটারি হিলারি ক্লিনটন এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবে অভিহিত করেননি– কারণ তাঁরা যদি তা করতেন তাহলে তাঁদেরকে সামরিক শাসকদের কাছে সামরিক সাহায্য পাঠানো বন্ধ করতে হতো। ভয়ঙ্কর প্রকোষ্ঠ চাপিয়ে দেওয়া হলে মানুষ পালিয়ে যায়।

সুতরাং অভিবাসন নীতির পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে মানুষের পালানোর কারণগুলোকে অপসারণ করা। এটি একদিনে করা যাবে না, কিন্তু আপনি এর জন্য পদক্ষেপ নিতে পারেন। এটিই সূচনা।

দ্বিতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে মধ্য আমেরিকা থেকে আমাদের সীমান্তে মানুষের পালিয়ে আসাকে ঠেকানোর জন্য মেক্সিকোকে তালিকাভুক্ত করার অপরাধমূলক নীতিকে বন্ধ করা। এ সম্বন্ধে আপনি একমাত্র যে ভালো কথাটি বলতে পারেন তা হচ্ছে ইউরোপে এর চেয়েও খারাপ, অধিকতর নির্মম এবং বিকৃতমনস্ক নীতি রয়েছে যা আফ্রিকা, নাইজার ও অন্যান্য জায়গার গহীন থেকে মানুষের পলায়নকে বন্ধ করতে চেষ্টা করে। ইউরোপের ভূখণ্ডে আসার পথে তাদেরকে তুরস্কে বাধা দেয়। আর বলাই বাহুল্য, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে ইউরোপের বেশ জঘন্য রেকর্ড আছে। আমাদের এটি পুনরালোচনা করার দরকার নেই। হ্যাঁ তাই, সেগুলো এমনকি আরও খারাপ, কিন্তু সেটি আমাদের দায়মুক্ত করে না। আমাদেরকে সেই নীতির যবনিকা টানতে হবে।

পরবর্তী করণীয় হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক শর্তগুলো মেনে চলা– পালিয়ে আসা মানুষের জন্য সম্মানজনক পরিবেশ এবং সাধারণ ক্ষমা ও প্রবেশাধিকারের আবেদনের জন্য তাদেরকে ন্যায়সঙ্গত সুবিধাদি প্রদান করা। এসব কিছুই করা যেতে পারে। এর পরিবর্তে আমাদের যা আছে তা হচ্ছেঃ আমাদের ঠিক দক্ষিণে, আপনি যেমনটি বললেন, হাজার হাজার মানুষ মরুভূমিতে প্রাণ হারাচ্ছেন, আক্ষরিক অর্থেই মরুভূমিতে প্রাণ হারাচ্ছেন। সেই ভূখণ্ড খুবই নির্দয়। আর গ্রীষ্মের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রির বেশি। সেখানে কোনো পানি নেই।

ক্লিনটনের সময় থেকে নীতিমালা দিয়ে মানুষকে সবচেয়ে বেশি প্রতিকূল এলাকায় তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যেখানে মোটামুটিভাবে সহজ ট্রানজিট আছে সেসব এলাকা বন্ধ করে দিন– একটি মানবীয় আশ্রয় নীতির মাধ্যমে তাদেরকে তুলে আনা যাবে– এবং তাদেরকে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এলাকায় নিয়ে যান যেখানে তারা মরুভূমিকে ঘুরে বেড়াবে এবং অনাহারে মারা যাবে। এরই মধ্যে, তাদের উপর দিয়ে বর্ডার পেট্রল হেলিকপ্টার ওড়ানোর কৌশল ব্যবহার করুন– তাই একটি দল যদি একসাথে থাকে, তারা তখন ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে, হারিয়ে যাবে এবং প্রাণ হারাবে। টাকসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ প্রচেষ্টা আছে– দারুণ, অসাধারণ সব গ্রুপ। প্রধান গ্রুপ, নো মোর ডেথ, ছোট ছোট শিবির স্থাপন করার জন্য মরুভূমিতে লোক পাঠানোর চেষ্টা করে, যেখানে তারা কিছু চিকিৎসা সহায়তা দিতে পারে যদি মানুষ সেখানে পৌঁছুতে পারে। তৃষ্ণায় মারা যাচ্ছে এমন মানুষের জন্য তারা মরুভূমিতে পানির বোতল রেখে দেয়। বর্ডার পেট্রল ক্যাম্পগুলোতে ঢুকে পড়ে, পানির বোতল ভেঙ্গে দেয় এবং আরও অনেক কিছু করে। ট্রাম্পের আগে এক রকম মৌন সমঝোতা ছিলো যে তারা একে অপরের কাজে বাধা দেবে না। তবে এটি আরও খারাপের দিকে গেছে।

এসমস্ত ভয়ানক গল্প হতে হবে তা নয়। যে কয়টি স্তরে নীতিমালা তৈরি করতে হবে তা সম্পূর্ণরূপে সম্ভব।

ডেভিড বারসেমিয়ান: জর্জ ফ্লয়েডের হত্যা সর্বব্যাপী প্রতিবাদের স্ফূরণ ঘটিয়েছে। বলা হয় যে এটি হচ্ছে বর্ণগত অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণের সময়। “শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য,” “শ্বেতাঙ্গ সুবিধা,” এবং “পদ্ধতিগত বর্ণবাদ”-এর মত শব্দবন্ধগুলো পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি দৃশ্যমান। বর্ণগত ন্যায়বিচারের আন্দোলন কোন দিকে যাচ্ছে বলে আপনি মনে করেন?

চমস্কি: জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরের ক্ষোভ ছিলো হৃদয়স্পর্শী। এটি আচমকা ঘটেনি। এটি অনেক বছরের সংগঠন, শিক্ষা, সক্রিয়তার ফল, যা একটি ভিত্তি তৈরি করেছিলো যাতে স্ফূলিঙ্গ তৈরি করে আগুন জ্বলতে পারে। আর এটি ছিলো একটি বিস্ময়কর বিদ্রোহ। সংহতি। কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ সকলের। এর পক্ষে ব্যাপক জনপ্রিয় সমর্থন ছিলো– প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনপ্রিয় সমর্থন, যা একটি সামাজিক আন্দোলনের জন্য অজানা। মার্টিন লুথার কিং এমনকি তাঁর জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকার সময়ও কখনো এর ধারেকাছে আসতে পারেননি।

প্রচুর উদ্যম বজায় রাখা হয়েছে। কিছুটা ফুরিয়ে গেছে, কিছুটা কৌশলগত ভুলের দরুণ, এক বা অন্য রকম ব্যর্থতাসমূহের দরুণ যেগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া উচিত। “ডিফান্ড দ্য পুলিস” স্লোগানটি অনেক দ্রুত বিখ্যাত হয়েছে। এটি একটি বিচক্ষণ ধারণা, এবং এর একটি অত্যন্ত বোধসম্পন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। এটি দিয়েছে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার সংগঠকরা, আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ ও অন্যান্যরা। এটি হচ্ছে পুলিশ যেসব কার্যক্রমের সাথে অংশীদার নয় সেগুলো থেকে তাদেরকে সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান। দেশীয় দ্বন্দ্ব, অত্যধিক মাদকগ্রহণ, আত্মহত্যা প্রচেষ্টা ইত্যাদি বিষয়ে পুলিশের ভূমিকা নেই। এসব ইস্যুতে কমিউনিটি সেবাদান সংস্থাগুলোর নিয়োজিত হওয়া উচিত; পুলিশকে শুধু পুলিশের কাজ করতে দিন। গত বছর ওকাসিও-কর্টেজকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, “আমেরিকায় পুলিশের ওপর থেকে অর্থায়ন তুলে নেওয়া হলে সেটি আপনার কাছে কেমন মনে হবে?” তাঁর উত্তরটি ছিলোঃ “ভালো খবর হচ্ছে এটি করতে আদতে অনেক কল্পনার দরকার পড়ে না। এটি শহরতলীর মত মনে হয়। সমৃদ্ধিশালী শ্বেতাঙ্গ কমিউনিটিগুলো পুলিশের ওপর অর্থায়ন করার চেয়ে যুব, স্বাস্থ্য, আবাসন ইত্যাদিতে অধিক অর্থায়ন করতে চায়।” একটি বাচ্চা যদি জানালা ভেঙ্গে চুরি করার কারণে ধরা পড়ে তাহলে আপনি তাকে ত্রিশ বছরের জেল দেবেন না। আপনি এর কারণ খুঁজে বের করে সেটাকে মোকাবেলা করবেন।

তবে ডানপন্থীরা স্লোগানটি ছিনতাই করেছে। এটি একটি প্রোপাগান্ডা কাহিনীতে পরিণত হয়েছেঃ এসব পাগলাটে বিকারগ্রস্তদের দিকে তাকান। তারা কমিউনিটি থেকে সব পুলিশ সরিয়ে নিতে চায় যাতে আপনি সন্ত্রাসী, অপরাধী ও ধর্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন। ঠিক আছে, কেউ তা চায় না। এটি ছিলো ডানপন্থী ও ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের একটি বড় আলোচনার বিষয়। এখানে একটি শিক্ষণীয় বিষয় আছে। আমি এটাই বুঝাতে চাই– এই কথাটি বলার জন্য অর্থপূর্ণ শিক্ষামূলক, প্রাতিষ্ঠানিক, সক্রিয়তা কার্যক্রম দিয়ে প্রস্তাবনা তৈরিতে আমাদের যত্নবান হতে হবে। এটি একটি ভালো ধারণা। এটি আপনার জন্য ভালো; আপনার এটি সমর্থন করা উচিত। যে প্রোপাগান্ডা চলছে তার ফাঁদে পা দেবেন না।

তবে আদতে, এটি একটি বড় পদক্ষেপ। আর আমি মনে করি আপনি এটি গড়ে তুলতে পারেন। এটি একমাত্র উদাহরণ নয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ১৬১৯ প্রকল্প ছিলো আরেকটি অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীপক পদক্ষেপ। অবশ্যই, এটি পেশাদার ঐতিহাসিকদের দ্বারা নিগৃহীত হচ্ছেঃ আপনি এই বর্ণনাটি ভুল ভেবেছেন, আপনি ওটা বলতে ভুলে গেছেন এবং আরও অনেক কিছু। এটি কোনো ব্যাপার নয়। আফ্রিকান আমেরিকানদের কাছে ৪০০ বছরের মর্মান্তিক আচরণের অর্থ কী এবং এটি কী পরম্পরা রেখে গেছে এটি হচ্ছে তার একটি স্বীকৃতি। এটি একটি সত্যিকারের সাফল্য। এর কয়েকবছর আগে, এমন কিছুই হয়নি। এসমস্ত কিছুই সামনে এগিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ।

ডেভিড বারসেমিয়ান : আপনিকনসিক্যুয়েন্সেস অফ ক্যাপিটালিজম-এ সামাজিক পরিবর্তনের অধ্যায়টি শেষ করেছেন কার্ল মার্ক্সের পুরনো ছুঁচোর কথা বলে। “আমরা আমাদের পুরনো বন্ধুকে, আমাদের পুরনো ছুঁচোকে চিনি,” তিনি লিখেছিলেন, “যে ভালো করে জানে কীভাবে আত্নগোপন করে কাজ করতে হয়, হঠাৎ করে আবির্ভূত হতে হয় : বিপ্লব।”

চমস্কি : মার্ক্সের বৈপ্লবিক চেতনার এই প্রতিমূর্তিটি রয়েছে গভীরে। হিউমের সূত্র ধরে বলতে হয়, সম্মতি আছে এবং ক্ষমতার মূলে আছে সম্মতি– কিন্তু সেই সম্মতির নেপথ্যে একটি কথা চালু আছে, আমি সত্যিই এটি চাই না। আমি কোনো মালিক দ্বারা শাসিত হতে চাই না। আর একে ভাঙতে খুব বেশি কিছুর দরকার হয় না। আর যখন সেটি ভেঙ্গে যায় তখন সেই ধরনের পরিবর্তনই আসে যা সত্যিকার অর্থে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

সুতরাং পুরনো ছুঁচোটি সেখানে গর্ত তৈরি করছে এবং সেটি নানান দিকে যেতে পারে। ঊনবিংশ শতাব্দী ও শিল্প বিপ্লবের প্রারম্ভের মধ্য দিয়ে শ্রম আন্দোলনের শুরুর দিকের ইতিহাস খেয়াল করুন। শ্রম আন্দোলনের প্রধান প্রতিপাদ্য ছিলো একটি চাকরি থাকা আপনার ব্যক্তিগত অধিকার ও মর্যাদার ওপর একটি কঠিন আঘাত। একটি চাকরির দিকে আপনি চেয়ে থাকেন না। এটি এমন কিছু যাতে হয়ত আপনাকে বাধ্য করা হয়েছে, কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে আপনার মর্যাদার ওপর, একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে আপনার অধিকারের ওপর এটি একটি নিদারুণ আঘাত। একটি চাকরি পাওয়ার দিকে আপনি তাকিয়ে থাকেন না। একটি চাকরি থাকার অর্থ হচ্ছে আপনার জ্ঞাত জীবনের সিংহভাগ একজন মালিকের আদেশের অধীনে বেঁচে থাকতে বাধ্য হওয়া। এতে দারুণ কিছু নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকের দক্ষ শ্রমিকদের খুব প্রাণবন্ত একটি শ্রমজীবী শ্রেণীর সংবাদপত্র ছিলো। তাঁরা আশা প্রকাশ করেছিলেন যে সময়ের পরিক্রমায় লোকে তাদের অধিকারের ওপর আঘাতে পর্যুদস্ত হবে না– একজন প্রভুর অধীনে তাদের থাকতে হবে এমন ধারণাকে তারা স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করবেন না। যদি সেই দিনটি আসে, তবে তারা আশা করেছিলো হয়তো সেটি খুব দূরে থাকবে।

ঠিক আছে, সেই দিন চলে এসেছে। মানুষ মনে করে একটি চাকরি পাওয়াই হচ্ছে জীবনে সবচেয়ে বড় ব্যাপার। তবে আমি মনে করি মার্ক্সের পুরনো ছুঁচোটি গভীরে রয়েছে। যদি এটি নিয়ে চিন্তা করার, আপনাকে কোনো মালিকের অধীনে থাকতে হবে না এমন সম্ভাব্যতাকে স্বীকার করার সুযোগ থাকে তাহলে আপনি আপনার নিজের জীবনকে চালিত করতে পারেন, আপনি আপনার ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন, সেটি দৃশ্যপটের কাছে আসতে থাকে। মহামন্দার সময়ে আমার শৈশবকালের অবস্থান ধর্মঘটগুলো সেই কথাটি বলার দিকে এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছিলোঃ আমাদের বস দরকার নেই, আমরা এই জায়গাটি দখল করে নিজেরাই চালাতে পারি– যেটি সত্য।

তখনই মনোভাবে পরিবর্তন এসেছিলো এবং নিউ ডিল ব্যবস্থার প্রতি জনগণের সমর্থন সত্যিই বৃদ্ধি পেয়েছিলো। যখন পুঁজির ক্ষেত্র বললো, দেখো, আমাদের এসব উদীয়মান বিকাশের মধ্যে নিজেদের জায়গা করে নিতে হবে, নইলে আমরা সত্যি সত্যি বিপদে পড়বো, তখনই সুপ্রিম কোর্ট প্রতিটি নিউ ডিল পদক্ষেপকে রুখে দেওয়া বন্ধ করে দিলো। আর আমি মনে করি এটিই বেরিয়ে আসছে। আপনি যে নিজের ব্যবসা নিজে চালাতে পারেন তা বলার মাধ্যমে নেক্সট প্রজেক্ট সিস্টেম সেই পথে এগোচ্ছে, যে কথা আমি উল্লেখ করেছি। এই ব্যবসা চীনে চলে যাবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য নিউ ইয়র্কের ব্যাংকারদের দরকার নেই। আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেনঃ আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কীভাবে এটি পরিচালিত করতে চান।

চীন ও মেক্সিকোর শ্রমিকদের সাথে সংহতি প্রকাশের মধ্য দিয়ে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আপনাদের সমস্বার্থ আছেঃ আপনাদের সকলের জীবনকে আরো উন্নত করা। অনেক ইউনিয়নের নামের মধ্যে “আন্তর্জাতিক” শব্দটি আছে। নাম দিয়ে সাধারণত বেশি কিছু বুঝায় না, কিন্তু এটি অনেক কিছু বুঝাতে পারে এবং একে সামনে আনা যেতে পারে। আর এটি এই মুহূর্তে বেশ লক্ষণীয়। আমরা এমন এক সময়ে আছি যখন আন্তর্জাতিকতাবাদ সামনে চলে এসেছে। অতিমারী মোকাবেলা করা, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন মোকাবেলা করাঃ এসব হচ্ছে আন্তর্জাতিক ইস্যু, আমাদের একসাথে এগুলো সমাধান করতে হবে। আপনি এক জায়গায় তা করতে পারবেন না। আপনি কেবল পাশ্চাত্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বন্ধ করতে পারবেন না, তা অন্যত্রও চলছে। অতিমারীর কোনো সীমানা নেই। শ্রম অধিকারের কোনো সীমানা নেই। আমরা এটি নিয়ে একসাথে কাজ করতে পারি। জিনিসগুলোর এই অভিমুখে চলা উচিত।      

____________________________________________________________________________

টীকা :

১। ফিলিবাস্টার : এটি একটি সংসদীয় প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আইনসভা অথবা কংগ্রেসের এক বা একাধিক সদস্য একটি প্রস্তাবিত আইনকে বিলম্বিত করার জন্য কিংবা প্রস্তাবনার ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করার জন্য বিতর্কে লিপ্ত হন। একে অনেক সময় “মৃত্যু পর্যন্ত বিল নিয়ে আলোচনা” হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং আইনসভা অথবা অন্য সিদ্ধান্ত-গ্রহণকারী পরিষদে এক ধরনের প্রতিবন্ধক হিসেবে চিত্রিত করা হয়। একটি সফল ফিলিবাস্টারের জন্য প্রায়শই এত দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয় যে অনেক বক্তা তখন মূল বিষয়ের বাইরে অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য রাখতে শুরু করেন।

২। জিম ক্রো : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে জিম ক্রো আইনসমূহের মাধ্যমে ১৮৭৭ সালে পুনর্গঠন থেকে শুরু করে ১৯৫০ এর দশকে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রারম্ভ পর্যন্ত আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলে বর্ণগত বিভাজন আরোপ করা হতো। জিম ক্রো কেবল একগুচ্ছ কৃষ্ণাঙ্গ-বিরোধী আইনই ছিলো না, বরং এর মাধ্যমে আফ্রিকান আমেরিকানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো।

৩। প্যাক : কোর্ট প্যাকিং হচ্ছে একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও মতাদর্শকে বেশি সুবিধা দেওয়া জন্য আদালতের বিচারকদের সংখ্যা অথবা গঠনকে পরিবর্তন করা হয়। সাধারণত এর মাধ্যমে আদালতের বিচারকদের আসন সংখ্যাকে বর্ধিত করা হয়।       

নেক্সট প্রজেক্ট সিস্টেম : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সময়ে ও ভবিষ্যতে যেসকল পদ্ধতিগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলোকে নির্দেশ করার জন্য দৃঢ় চিন্তা-ভাবনা ও কার্যকলাপের উদ্দেশ্য নিয়েদ্য ডেমোক্রেসি কোলাবোরেটিভ এর একটি উদ্যোগ হচ্ছে নেক্সট প্রজেক্ট সিস্টেম। অতীত ও বর্তমানের ব্যর্থ ব্যবস্থা থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন একটি “নতুন ব্যবস্থা” তৈরি করার লক্ষ্যে একদল গবেষক, তাত্ত্বিক ও সক্রিয়তা কর্মী সম্মিলিতভাবে একদিকে সবচেয়ে ভালো গবেষণা, বোঝাপড়া ও কৌশলগত চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে এবং অন্য দিকে দর্শন, মডেল ও কর্মপন্থাকে প্রচার করার জন্য মাঠ পর্যায়ের সংগঠন ও উন্নয়ন অভিজ্ঞতাকে প্রয়োগ মাধ্যমে উন্নততর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বাস্তুসংক্রান্ত ফলাফল আনার জন্য কাজ করছে।

৫। নিউ ডিল : ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের শাসনামলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক নিরাপত্তাসহ অনেকগুলো কার্যক্রম চালু করা হয়েছিলো। ‘নিউ ডিল’ নামে অভিহিত এই কার্যক্রমের অধীনে মার্কিন কংগ্রেসে কয়েকটি আইন পাশ করা হয়েছিলো। এছাড়া প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তাঁর নির্বাহী ক্ষমতার প্রয়োগের মাধ্যমে আরো কিছু আইন প্রণয়ন করেছিলেন। ১৯৩০ এর দশকে মহামন্দার সময়ে বেকার ও দরিদ্রদের সহায়তা প্রদান, অর্থনীতির স্বাভাবিক পুনরুদ্ধার এবং পুনরায় মন্দা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কারের উদ্দেশ্যে ‘নিউ ডিল’ নামক কার্যক্রমটি গৃহীত হয়েছিলো।


  • ইমন রায়: অনুবাদক। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রনিকস এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক সম্পন্ন করেছেন । বর্তমানে আর্মি ইন্সটিটিউট অফ বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনে এমবিএ অধ্যয়নরত৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *