আমি যে এলাকাতে থাকি, সেই এলাকার মূল রোড ধরে আপনি যতদূর হাঁটবেন, প্রায় প্রত্যেক গলির মোড়ে ১০-১২ জন ছেলের গ্রুপ বসে থাকতে দেখবেন।
এরা স্কুল-কলেজের ছাত্র। এরা গলির মোড়ে এমনভাবে বসে থাকে এবং কোন অপরিচিত লোকের দিকে এমনভাবে ‘লুক’ দেয় যেটার মুখোমুখি হলে আপনার মধ্যে যুগপৎ অস্বস্তি ও ভীতি কাজ করতে বাধ্য।
অপরিচিত মানুষ তো বটেই, এমনকি এলাকার পরিচিত লোকজনও এদের ‘ঘাঁটায় না’। এরা সবাই কি অনেক বড় বড় সন্ত্রাসী? না। কিন্তু এদের প্রত্যেকেরই ‘ভাই’ কানেকশন আছে।
কিছুটা সময় নিয়ে যদি আপনি এদের কথাবার্তা খেয়াল করতে পারেন, তাহলে দেখবেন কোন ‘ভাই’ কবে কাকে ফোন দিয়েছে, কে কোন ‘ভাই’ এর কত ক্লোজ, কার একটা মাত্র ফোনে মুহূর্তের মধ্যেই শ’খানেক ছেলেপেলে জড়ো হয়ে যাবে এইসব নিয়ে আলাপ হচ্ছে।
‘ভাই’দের সাথে কোন না কোন কানেকশন না থাকলে এই উঠতি বয়সের ছেলেপেলেরা নিজেদের বেওয়ারিশ মনে করে। যেটা একইসাথে প্রেস্টিজ সংকট ও নানাবিধ প্রতিপক্ষ গ্যাং এর কাছে নিজেদের গ্যাংকে দুর্বল হিশেবে উপস্থাপনের সামিল। গ্যাং কালচারে আপনার ‘ভাই’ শেল্টার নাই মানে আপনার কিছুই নাই। ইউ সিম্পলি ডোন্ট ম্যাটার।
একটা পরিস্থিতি কল্পনা করছিলাম। আমাদের এলাকায় বড় একটা স্কুল কাম কলেজ আছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সারাদিন প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-অভিভাবকের আনাগোনা থাকে। কোনভাবে যদি স্কুলের সামনে ছেলেধরার গুজব ছড়ায়, তাহলে পরিস্থিতিটা কোনদিকে গড়াবে?
দীর্ঘদিন একই এলাকায় থাকার কারণে এবং এলাকার কালচার, প্রত্যেক গলির নাড়িনক্ষত্র সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকার কারণে নিজেরই কল্পিত পরিস্থিতির সম্ভাব্য যে বাস্তব প্রতিকল্প হাজির হলো আমার চিন্তায়, সেটা এক কথায় হরিবল। বীভৎসতম।
এরকম একটা গুজব ছড়িয়ে পড়লে, প্রত্যেক গলির মুখে বসে থাকা উঠতি বয়সের ছেলেদের প্রাত্যহিক নিরুত্তেজ জীবনে একটা নজিরবিহীন ‘গতি’ আসবে। তারা সবাই মুহূর্তের মধ্যে ‘স্পটে’ হাজির হবে এবং একটা ভয়ংকর ইনসেইন মবে পরিণত হবে।
পাশাপাশি এইসব ক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা দেখানোর ক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম বাদে, এলাকার শিক্ষিত-অশিক্ষিত আবালবৃদ্ধবনিতার মধ্যে বিরল ঐক্যমত্য আছে। চোর-পকেটমার-ছেলেধরা পেয়েছ মানে পিটিয়ে মেরে ফেল।
তো এইরকম একটা সামাজিক খুনে পরিস্থিতির মধ্যে, একটা স্কুল কলেজের ছেলে, যার আসলে অত নিখুঁত ধারণা নাই কেন সে গ্যাং কালচার মেইনটেইন করে ; সে নিজেকে একজন খুনি হিশেবে আবিষ্কার করে।
নিরানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে ওই উঠতি কিশোর/তরুণ এরকম একটা নৃশংস ঘটনা ঘটার আগে জানেইনা, তার মধ্যে এত নির্মমতা-নৃশংসতা-সহিংসতা ঘাপটি মেরে ছিল। বীজ ফুঁড়ে কখন যে আস্ত একটা বিষবৃক্ষ গজিয়েছে সেটা কেউ টের পায়নাই।
একটা চূড়ান্ত ভায়োলেন্ট সামাজিক-রাষ্ট্রীয় পরিসরে, যেখানে সবাই সম্ভাব্য খুনি, সবাই সম্ভাব্য ভিক্টিম ; জানার কথাও না। সহিংসতাই এরকম সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় একমাত্র ‘বৈধ’ ভাষা।
‘মাইরের উপ্রে ওষুধ নাই’ এই নীতিতে পরিচালিত হয় সেই রাষ্ট্রীয়-সমাজের পরিবার-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত। বাংলাদেশ এরকম একটা রাষ্ট্রীয় সমাজের পার্ফেক্ট এক্সাম্পল।
এসব ভাবতে ভাবতে একটা গলি ধরে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। সেখানে এরকম একটা গ্রুপের সামনে দিয়ে পার হতে হতে দেখলাম, কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের একটা গ্যাং। এলোমেলোভাবে পুরো রাস্তা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে।
চেহারার মধ্যেই যেন একটা ‘ধইরা লামু, মাইরা লামু,খায়া লামু’ ভাব ফুটে ওঠে সেটা নিশ্চিত করতে প্রত্যেকেই মরিয়া। কয়েকজনের হাতে ৩০ সেন্টিমিটারের স্টিলের স্কেল। এমনভাবে ধরে আছে যেন এটা পড়ালেখার কোন সরঞ্জামাদি না, দেশীয় ধারালো ছোটখাটো কোন অস্ত্র।
গণপিটুনি হঠাৎ করে ঘটতে থাকা কোন নৃশংস ঘটনা না। বাংলাদেশ কোন নুকুপুশু ‘নিপাট ভদ্রলোক’ মার্কা রাষ্ট্র-সমাজ না যে হঠাৎ করে কিছু ‘অশুভ’ লোক/শক্তি বাংলাদেশের সমাজকে তছনছ করে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের সমস্ত ‘বৈধ’, ‘অবৈধ’ সহিংসতা শক্তিশালী ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই গ্যাং কালচার বাংলাদেশের শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত জালের মত বিস্তৃত হয়ে গেছে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রত্যক্ষ মদদে।
গণপিটুনি এই গভীর সহিংস সামাজিক-রাষ্ট্রনৈতিক বিকারের একটা মাত্র উপসর্গ। একমাত্র নয়। আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে হলে, এই সহিংসতার বীজগণিতকে উন্মোচন করার কোন বিকল্প নাই।
ক্রসফায়ার ও গণপিটুনি একই সহিংস পরিস্থিতির অভিন্ন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস-বোঝাপড়া-সহমর্মিতা বিলুপ্ত যে সমাজে, সেই সমাজে ভায়োলেন্সই একমাত্র বিকল্প।
মানুষ যখন দেখে একজন খুনিকে ধরে ক্রসফায়ারের মাধ্যমে মেরে ফেলা হচ্ছে এবং বুদ্ধিজীবী ও মিডিয়াবাহিত কনসেন্ট মোটাদাগে এরকম নির্মম রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডকে ‘বিচার’ হিশেবে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত থাকে, পাবলিক তখন ফিউরিয়াস মবে পরিণত হয়।
সুতরাং ভায়োলেন্ট মব ফিউরি আইন-বিচারবিভাগ-আমলাতন্ত্র-পুলিশ সহ সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে গভীর অনাস্থার উপজাত এবং সামাজিক সংহতিশূন্য সমাজের অনিবার্য পরিণতি মাত্র।
‘বৈধ’ ভায়োলেন্সের পক্ষে থেকে, সংঘবদ্ধ প্রতিহিংসাকে ‘ন্যায়বিচার’ মনে করে, কালেক্টিভ পাবলিক ইনস্যানিটি নিয়ে আপাত দুশ্চিন্তা কোন কাজে আসবে না।
উই নিড টু কল আ স্পেড আ স্পেড। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ব্যাপারে নিঃসংশয় থাকলে এই সন্ত্রাসের নানাবিধ সামাজিক উপসর্গ আমাদের নিরাপদ তন্দ্রা ব্যাহত করবেই।