- আ-আল মামুন
[সম্পাদকীয় মন্তব্য: আ-আল মামুন ‘মগজে কারফিউ : কোনটাকে বলি সংবাদ?’ শীর্ষক প্রবন্ধটি ২০০৪ সালে লিখেছিলেন। পরবর্তীতে ফাহমিদুল হক ও আ-আল মামুন সম্পাদিত ‘মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি’ (২০১৩) গ্রন্থে এটি সঙ্কলিত হয়েছিল। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে প্রবন্ধটি রাষ্ট্রচিন্তা ব্লগে প্রকাশিত হলো। ব্লগে প্রকাশ করার অনুমতি দেয়ার জন্য লেখকের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।]
বিদ্যায়তনিক শাস্ত্রগুলোতে১ সংবাদ, সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা ও সংবাদের উপাদান সম্পর্কে ‘ঈশ্বরের প্রত্যাদেশতুল্য’ যে বয়ান প্রবল প্রতাপে হাজির আছে – এবং যে বয়ান সাংবাদিকতার শিক্ষার্থী ও তাদের ‘বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ’ গুরুমণ্ডলী প্রশ্নাতীত আনুগত্যে অহর্নিশ জপ করেন – তার একটি সমালোচনাত্নক বিশ্লেষণ খাড়া করা নাতিদীর্ঘ এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। আরেকটা, অবশ্য পরোক্ষ, লক্ষ্য, সংবাদকে সরলরৈখিক মনে সম্পর্কনিরপেক্ষ দৈব ‘চিজ’ হিসেবে না-দেখে সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রতাপশালী সম্পর্কের ‘উদ্দেশ্যমূলক উৎপাদন’ হিসেবে দেখার ইশারা দেয়া, যেভাবে দেখার চল এদেশে নেহাতই নগন্য।
সাংবাদিকতা ও সংবাদ-সম্পাদনা নিয়ে ইংরেজী ভাষায় লেখা (বিশেষত মার্কিনি) ঢাউস ঢাউস সব পুস্তক আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগে। এই মুহূর্তে হাতের কাছে পাওয়া এমন কয়েকটি পুস্তকের নাম উল্লেখ করি: জুডিথ এল. বার্কার এর ইন্ট্রোডাকশান টু রিপোর্টিং, ইউনিভার্সিটি অব মিসৌরী’র ব্রায়ান এস. ব্রুকস ও অন্যান্যদের নিউজ রিপোর্টিং এন্ড রাইটিং, স্ট্যানলি জনসন ও জুলিয়ান হ্যারিস এর দ্যা কমপ্লিট রিপোর্টার, এভারেট এম. ড্যানিস ও আরন্লড এইচ. স্মাজ এর রিপোর্টিং প্রসেস এন্ড প্রাকটিসেস: নিউজ রাইটিং ফর টুডেইজ রিডার্স, এল. আর ক্যাম্পবেল ও আর. ই. ওলসলি’র হাউ টু রিপোর্ট এন্ড রাইট দ্যা নিউজ, কার্টিস ডি. ম্যাকডুগাল এর ইন্টারপ্রিটেটিভ রিপোর্টিং ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সকল পুস্তক নকল করে, জোড়াতালি দিয়ে আবার বাংলা ভাষায় পুনরুৎপাদন করা হয়েছে। সুধাংশু শেখর রায় লিখেছেন রিপোর্টিং, খ. আলী আর রাজী, মঞ্জুরুল ইসলাম, নাইমুল ইসলাম খান লিখেছেন সাংবাদিকতা: প্রথম পাঠ, মীর মাশরুর জামান ও জগদীশ সানা সম্পাদনা করেছেন তৃণমূল সাংবাদিকতা: ধারণা ও কলাকৌশল, খোন্দকার আলী আশরাফ লিখেছেন সংবাদ সম্পাদনা ইত্যাদি।
এই সব শাস্ত্র ‘মুক্তবাজার’ সাংবাদিকতার যে মতাদর্শের ছাপ্পর মেরে আমাদের ‘হৃদয় ও কর্ণ মোহর করিয়া দিয়াছেন’ তা হলো: ঘটনাময় পৃথিবীতে অহরহ অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে, সেসব কিছুর মধ্যে সংবাদ সেগুলোই যা ভাল একজন সাংবাদিক দেখলেই চিনে নিতে পারেন; কিছু ঘটনা এমন মূল্য ধারণ করে যে-কারণে তা নিজগুণেই সংবাদ হয়ে ওঠে, সব ঘটনা সংবাদ হয় না; সাংবাদিক তার পৃথিবীকে বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং রিপোর্ট করতে পারেন; সাংবাদিকের দায়িত্ব সত্য উদ্ঘাটন করা ও জনগণকে সেই সত্য জানানো।
তাদের মতে, সংবাদকে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়, তাই সংবাদের প্রকৃতি বুঝাতে তারা যেসব কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছেন পুস্তকগুলোতে সেখান থেকে এলোপাথাড়ি কয়েকটা সংকলন করি:
সংবাদ হলো কোনো ঘটনা, তথ্য বা মতামতের বর্ণনা যা জনগণকে আগ্রহী করে।
ঘটনা নয়, ঘটনার রিপোর্টই সংবাদ।
নিজের সমাজ, রাষ্ট্র ও বহির্বিশ্ব সম্পর্কে জনগণের যা জানা প্রয়োজন ও জানা উচিত তাই সংবাদ।
অনেক মানুষ জানতে চায় এমন যেকোনো কিছুই সংবাদ, কিন্তু শর্ত থাকে যে, তা সুরুচির সীমানা এবং অবমাননা আইন লংঘন করবে না।
সংবাদ হলো এমন যেকোনো কিছু, যা নিয়ে মানুষ কথা বলবে। এটা যতো বেশি আলোচনার জন্ম দেবে এটার সংবাদমূল্য ততো বেশি।
সংবাদ হচ্ছে যেকোনো কিছু যা সমাজের বিশাল অংশকে আগ্রহী করে তোলে এবং যা ইতোপূর্বে তাদের গোচরীভূত হয়নি।
একজন নগর সম্পাদক যখন সংবাদকে সংক্ষিপ্তাকারে সংজ্ঞায়িত করেন তখন তা সীমিত হয়ে পড়ে তিনটি শব্দে ‘অর্থ, কাম ও অপরাধ’।
আমাদের বাংলা ভাষায় লিখিত কয়েকটি গ্রন্থে সংবাদ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তারও একটু নমুনা দেখা যাক। মীর মাসরুর জামান ও জগদীশ সানার (সম্পা.) তৃণমূল সাংবাদিকতা: ধারণা এবং কলাকৌশল গ্রন্থে বলা হচ্ছে,
পাঠকের জানার আগ্রহ আছে এমন কোনো ঘটনার সময়োচিত, সংক্ষিপ্ত ও সঠিক বিবরণীকে সংবাদ বলতে পারি। (২০০০: ৭৮)
খ. আলী আর রাজী, মঞ্জুরুল ইসলাম ও নাইমুল ইসলাম খান সাংবাদিকতা: প্রথম পাঠ গ্রন্থে বলছেন,
কোনো ঘটনার সংবাদ হয়ে উঠতে হলে কোনো না কোনো ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত সে ঘটনার মধ্যে থাকতেই হবে। … সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে জানতে হবে, এই যে অসংখ্য পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে বা পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে কোনটির মাত্রা কেমন। পাঠক সেইটিই বা সেগুলোই জানতে চাইবেন যে ঘটনায় বা ঘটনাগুলোয় পরিবর্তনের মাত্রা অন্যগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। (১৯৯৭: ১৫০)
সুধাংশু শেখর রায় রিপোর্টিং গ্রন্থে লিখছেন,
এ হচ্ছে এমন কোন সংবাদ উপযোগী (সত্য) ঘটনার একটি বিবরণী যা জনগণের কাছে প্রকাশযোগ্য এবং কোন গণমাধ্যমের দ্বারাই তা প্রকাশ বা প্রচারযোগ্য। (১৯৯৫: ৩২)
সাংবাদিকতার পণ্ডিতদের মতে, সংবাদ হচ্ছে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান এবং তা সাধারণ জনগণের সাধারণ জ্ঞানের সাথে সেই বিশেষ জ্ঞানের সংযোজন মাত্র। (১৯৯৫: ৩৩)
এতোগুলো উদ্ধৃতি ব্যবহার করার পরও কি স্পষ্ট হলো সংবাদ কী? ‘জনগণের জানা প্রয়োজন’ ‘জানা উচিত’ ‘জানার আগ্রহ আছে’ ‘পরিবর্তনের সূচনা করে’ কিংবা ‘অর্থ-কাম-অপরাধ’ খুবই খণ্ডিতভাবে ও বিভ্রান্তিকরভাবে সংবাদের প্রকৃতিকে বর্ণনা করে। যে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কোনো ঘটনা গণমাধ্যমের সংবাদ হয়ে ওঠে কিংবা হতে পারে না তার ছিটেফোঁটাও স্পষ্ট হয় না। কার্ল মার্কস যেমন হেগেলের ‘হেঁটমস্তক’ দ্বান্দ্বিকতার দর্শনকে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা যুক্ত করে পায়ের ওপর খাড়া করে দিয়েছিলেন, (এঙ্গেলস, ১৯৯৮: ৪৪) দর্শনকে অধিবিদ্যার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন, তেমনই সংবাদ সম্পর্কে আকাশচারী ধারণাসকলকে খোদ মাটিতে নামিয়ে আনা ছাড়া গণমাধ্যম সংবাদের প্রকৃতি বোঝা যাবে না।
জলজ্যান্ত একটি সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সাংবাদিক সিদ্ধান্ত নেন কোন্টা সংবাদ, আর কোন্টা নয়। তিনি কীভাবে কোন্ তথ্য সংগ্রহ করবেন, কীভাবে কাঁচামাল থেকে সংবাদ তৈরি করবেন তার ওপর সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাবকগুলো প্রভাব ফেলে ও সীমানা টেনে দেয়। আমরা দেখি, এই প্রক্রিয়ার আওতাধীন সাংবাদিকের লিখিত শব্দাবলী সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনের পর্দায় সংবাদকাহিনী হিসেবে হাজির হয়। সংবাদ কোনো সরকারী কর্মচারীর বয়ান নয়, কোনো সাংস্কৃতিক শক্তির অভিপ্রকাশ নয় কিংবা ‘বাস্তবতা’ আপনাআপনি অলৌকিকভাবে বর্ণমালায় সজ্জিত হয় না, আক্ষরিক অর্থেই রক্তমাংসের সাংবাদিক বিক্রির উদ্দেশ্যে কাহিনী লেখেন, যাকে আমরা বলি সংবাদ। ফলত, সংবাদ অনিবার্যভাবেই অর্থনৈতিক কাঠামো ও রাজনৈতিক কাঠামো এবং এগুলো থেকে উপজাত একটি নির্দিষ্ট গণমাধ্যম কাঠামোর উৎপাদন।
গণমাধ্যম বাহিত প্রতীকসমূহকে – সংবাদ, পপুলার মিউজিক, চলচ্চিত্র, টিভি-অনুষ্ঠানমালা ইত্যাদি – বিশ্লেষণের সরলতম স্তরে, আমরা বলতে পারি, মিডিয়া পেশাজীবী কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজ, কিন্তু বিশ্লেষণের অন্যতর স্তরে এগুলো জটিল একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন। আবার, বিশ্লেষণের আরও উর্ধ্বতন স্তরে এগুলো মিডিয়া-ইন্ডস্ট্রি ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিন্যাসের ফল। সুতরাং, ‘সাংবাদিকতার’ অন্তর্নিহীত আর্থ-সাংস্কৃতিক নিয়ম ও বিধানগুলোকে বিচারে না নিয়ে বায়বীয় শব্দাবলী দিয়ে ‘সংবাদ’ নামক বস্তুটির প্রকৃতি বর্ণন সম্ভব নয়। গণমাধ্যমের ‘সংবাদ’ বিচারের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কয়েকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করছি;
সংবাদ একটা পণ্য
আমাদের মানতে কষ্ট হলেও এটাই ঠিক যে টুথপেস্ট, সাবান, পারফিউম কিংবা কামানের মতো প্রথমত এবং প্রধানত সংবাদও একটা পণ্য। সংবাদ-কারখানায় এই পণ্য প্রতিদিন উৎপাদন করা হয়, যার উদ্দেশ্য মুখ্যত, মুনাফা। ফলে, আকর্ষণীয় করে তোলা, চমৎকার মোড়কে উপস্থাপন করা, বিনোদন জোগানো সকল বৈশিষ্ট্যই সংবাদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। এই কারণেই আমরা দেখি যৌনতা কিংবা অভিনবত্ব অত্যন্ত প্রভাবশালী সংবাদ-উপাদান হয়। সংবাদের ভাষা হয় হালকা-চটুল, সামাজিক প্রভাবক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের কথা মাথায় রেখে সংবাদ ছাপতে হয়।
একদিক থেকে সংবাদকে যদি ‘বাস্তবতার’ সামাজিক নির্মাণ হিসেবে দেখা হয়। তবে অন্যদিক থেকে, সংবাদকে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উৎপাদিত সামাজিক পণ্য হিসেবে দেখতে হবে, যা অন্য প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত অন্যান্য পণ্যের মতো করেই বিশ্লেষণযোগ্য। … সেজন্য পণ্যের প্রকৃতি অনুধাবন করতে হলে- এক্ষেত্রে পণ্য হলো সংবাদ- আমাদেরকে প্রতিষ্ঠানকে বুঝতে হবে, ব্যক্তি নয়। (১৯৯৭: ১৫) কারণ, প্রতিষ্ঠানের প্রাত্যহিকতা ও মূল্যবোধের মধ্যমে দ্রুতই কর্মরত ব্যক্তির সামাজিকীকরণ ঘটে যায় অনেকখানি।
অন্যান্য ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে বড় কারখানা যেমন বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে তেমনই সংবাদ উৎপাদনেও বড় প্রতিষ্ঠানের প্রাধান্য লক্ষণীয়। আজকের যুগে বিশাল পুঁজি ছাড়া এই ব্যবসায় টিকে থাকা অসম্ভব। এডওয়ার্ড এস. হারম্যান ও নোম চমস্কি মার্কিন কর্পোরেট মিডিয়া সম্পর্কে তাদের গড়ে তোলা প্রভাবশালী ‘প্রচারণা মডেল’২ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “আধিপত্যশীল মিডিয়া-সংস্থাগুলো অনেক বড় আকারের ব্যবসা; খুবই ধনী ব্যক্তিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় কিংবা ব্যবস্থাপকরা নিয়ন্ত্রণ করে, যারা আবার মালিক ও অন্যান্য বাজার-মুনাফাকেন্দ্রীক শক্তিগুলোর চাপের মুখে কাজ করে। এই মিডিয়াগুলো ঘনিষ্ঠভাবে আন্তঃসম্পর্কিত এবং অন্যান্য প্রধান কর্পোরেশন, ব্যাংক ও সরকারের সাথে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সমস্বার্থগত সম্পর্ক রয়েছে।” (১৯৯৪: ১৪) এই স্বার্থ প্রবলভাবে নিধারণ করে দেয় মিডিয়াতে কোন্টা সংবাদ হবে আর কোন্টা হবে না।
যেহেতু আজকের সংবাদ মাধ্যমের মূল লক্ষ্য, কর্পোরেশনের অন্যন্য ব্যবসার মতোই, মুনাফা তাই সংবাদ পণ্য-চরিত্র পেতে বাধ্য। সংবাদ-প্রতিষ্ঠান মুনাফা বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে কম খরচে সংবাদ-পণ্য উৎপাদন করতে চায়। ফলে তারা বড়লোক, সরকার কিংবা কর্পোরেশনগুলোর ওপর নির্ভর করে নিয়মিত সংবাদ পেতে। হারম্যান ও চমস্কি বলছেন, “অর্থনৈতিক চাহিদা এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণে গণমাধ্যম তথ্যের শক্তিশালী উৎসগুলোর সাথে মিথোজীবিতামূলক সম্পর্কে আবদ্ধ। মিডিয়ার প্রয়োজন সংবাদ-কাঁচামালের নিয়মিত ও নির্ভরযোগ্য প্রবাহ। তাদের প্রতিদিনের সংবাদচাহিদা রয়েছে এবং অপরিহার্য সংবাদসূচি রয়েছে যেগুলো অবশ্য-পূরণীয়। গুরুত্বপূর্ণ সংবাদযোগ্য ঘটনা ঘটার মতো সম্ভাব্য সকল স্থানে সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান পাঠানোর সামর্থ্য তাদের নেই। অর্থনৈতিক চাপে পড়ে তারা সেইসব জায়গায় শক্তি-সম্পদ জড়ো করে, যেখানে সংবাদযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো সচরাচর ঘটে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ গোপন বিষয় ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটে ও গুজব ছড়ায় এবং প্রত্যহ যেখানে সাংবাদিক সম্মেলন ঘটে। … স্থানীয় ক্ষেত্রে নগর ভবন ও পুলিশ বিভাগ হলো সাংবাদিকদের কাছে প্রাত্যহিক সংবাদক্ষেত্র। ব্যবসায়ী কর্পোরেশন ও বণিক গোষ্ঠীগুলোও সংবাদ-উপযোগী বিবেচিত ঘটনার প্রাত্যহিক ও বিশ্বাসযোগ্য সরবরাহকারী। এসব আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপুল পরিমাণে সংবাদ-কাঁচামালের বিস্তার ঘটায় যা সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নির্ভরযোগ্য, নির্দিষ্ট সংবাদ-সূচির নিয়মিত কাঁচামাল-চাহিদা পূরণ করে। মার্ক ফিশম্যান এটাকে বলেছেন ‘আমলাতান্ত্রিক ঐক্যের নীতি: কেবল অন্য কোনো আমলাতন্ত্রই পারে সংবাদ-আমলাতন্ত্রকে কাঁচামাল সরবরাহ করে তৃপ্ত করতে’। (১৯৯৪: ১৮) “কার্যত ক্ষমতাশালীদের বৃহদায়তনিক আমলাতন্ত্র মিডিয়াগুলোকে অর্থ সাহায্য করে এবং সংবাদ-কাঁচামাল সংগ্রহ ও সংবাদ প্রণয়নে সহায়তা করে মিডিয়াগুলোর ব্যয় হ্রাস করার মাধ্যমে বিশেষ অভিগম্যতা লাভ করে। যেসব বৃহদায়তনিক সংস্থা অর্থ সাহায্য করে সেসব সংস্থা ‘নিয়মিত’ সংবাদসূত্রে পরিণত হয় এবং সংবাদ-যোগ্যতার ধাপগুলো অতিক্রম করার বিশেষ অধিকার ভোগ করে। অনিয়মিত সূত্রগুলোকে মিডিয়া-অভিগম্যতা লাভ করার জন্য অবশ্য অবশ্যই আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয় এবং দ্বাররক্ষীদের (গেটকিপার) স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের কারণে তাদেরকে উপেক্ষিতও হতে হয়”। (১৯৯৪: ২২) বেন বাগডিকিয়েন দুটো জরিপের কথা উল্লেখ করে জানাচ্ছেন, “সংবাদপত্র সম্পাদকদের ওপর ১৯৯২ সালে মারকুট্টি বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক জরিপে সম্পাদকদের ৯৩ শতাংশ বলেন যে বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের সংবাদকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। …সাম্প্রতিক নিলসেন জরিপে দেখা যায়, ৮০ শতাংশ টেলিভিশন ডাইরেক্টর বলেন, তারা ‘প্রতি মাসে কয়েকবার করে’ কর্পোরেশনগুলোর জনসংযোগ ফিল্মকে সংবাদ হিসেবে সম্প্রচার করেন।” (১৯৯৭: xx) এমনকি, বাগডিকিয়েন আরও বলছেন, “আজকাল বড় বড় মিডিয়ার কর্তারা তাদের সাংবাদিকদেরকে বিজ্ঞাপনদাতা ও মালিকদের অন্যান্য অসাংবাদিকীয় স্বার্থের প্রতি নজর রেখে সংবাদ বানাতে বলেন। নিউজ পেপার্স এসাসিয়েশন অব আমেরিকার ১৯৯৫ সালের সম্মেলনে একজন বড় বিজ্ঞাপনদাতা রিপোর্টারদেরকে সমালোচনা করেন বিনোদনের অংশ হিসেবে সংবাদকে পুনঃসংজ্ঞায়িত না-করার জন্য। (১৯৯৭: xii)
উদ্ধৃতিগুলোতে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে বলা হয়েছে কেন আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘটনারাজী বা কর্মকাণ্ডগুলো ‘সংবাদ’ খেতাব পায়, অন্য ঘটনাবলী কেন ‘সংবাদ’ হওয়ার সম্মান পায় না। পাঠ্যপুস্তকে সংবাদের যে সংজ্ঞা আছে তার বিচারে এগুলোই ‘সংবাদমূল্য’ সম্পন্ন জিনিস, এগুলোতেই পাঠকের ‘আগ্রহ আছে’ বলে সংবাদ হয়!
সংবাদপণ্যের বাজার দুটো। প্রথমত সংবাদমিডিয়া অডিয়েন্সের কাছে সংবাদ বিক্রি করে; দ্বিতীয়ত, এই অডিসন্সকে আবার বিক্রি করে দেয় বিজ্ঞাপনদাতা ও নানামুখী স্বাথগোষ্ঠীগুলোর কাছে। ফলে, সংবাদ বিক্রির মাধ্যমে এমন শ্রেণীর অডিয়েন্সকে ধরতে হয়, ক্ষেত্রবিশেষে তৈরি করতে হয়, যাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য বিজ্ঞাপনদাতা ও স্বার্থগোষ্ঠীগুলো আগ্রহী হবে। আর এর ফলে, সোজা কথায়, পণ্যর, মানে সংবাদের, প্রকৃতিও প্রভাবিত হয়। বাজারের নিয়ম-রীতিমাফিক সংবাদ-পণ্য ও অন্যান্য কর্পেরেটীয় পণের মাঝে নিবিড় অন্তরঙ্গতা আছে। বাগডিকিয়েনের উদ্ধৃতিতে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট। ইঙ্গিতটা হলো যে, মালিকদের মর্জি মেতাবেক মিডিয়াকে ক্রয়মনষ্ক একটা ‘মুক্তবাজার’ ভোক্তাশ্রেণী গড়ে তুলতে হয়। সংবাদ-পণ্যকে মিডিয়া এই উদ্দেশ্য হাসিলে হামেশা ব্যবহার করে।
সংবাদ একটা আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন
মানব ক্রিয়াকর্ম মূল্যায়নে শ্রমবিভাজনের রাজনীতি স্পষ্ট হওয়া দরকার। ইতিহাস বলে, আদি সমাজে মানুষ দুইভাগ হয়ে সামাজিক উৎপাদন কর্মযজ্ঞে লিপ্ত হয়েছিল। একদল চিন্তা করা, পরিকল্পনা করা, তথ্য সংগ্রহ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের দায়িত্ব নেয়। আরেক দল এই প্রথম দলের অনুগামী হয়ে চিন্তা-পরিকল্পনাকে শরীর খাটিয়ে কাজে পরিণত করার তৎপরতায় লিপ্ত হয়। পরস্পর পরস্পরের কাজকে সমান মূল্য দিত এবং এভাবে যে উৎপাদন হতো তা সকলে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতো। কিন্তু প্রথম দল তাদের মানসিক শ্রমকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ দাবী করে বসলো। আর এখান থেকেই সমাজে শ্রেণীবৈষম্যের সূত্রপাত, বিদ্যাজীবীদের আধিপত্যের কাল শুরু। শরীরজীরীদের কাজকে অসম্মান করা হতে থাকল। কার্ল মার্কস বলেন, ‘সমাজে সত্যিকার অর্থেই শ্রমবিভাজন ঘটে তখনই যখন মানসিক শ্রম ও শারীরিক শ্রমের মধ্যে বিভাজন টানা হয়’ (১৯৬১: ১০৬-১০৭) আধুনিক কালখণ্ডে মানসিক উৎপাদনের জন্য- শিক্ষা, তথ্য, প্রযুক্তি, সংবাদ, সাহিত্য, নাটক, সংগীত- বাজারের নিয়মেই বড় বড় প্রতিষ্ঠান তৈরী হয়েছে। সাংবাদিকতা এরকম অত্যন্ত অধিপত্যশালী একটা প্রতিষ্ঠান, যাকে সাংবাদিকতার কারখানাও বলা চলে।
বিনোদন প্রতিষ্ঠান বা অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মতোই সাংবাদ-মাধ্যম সাফল্যের সাথে ও কম খরচে তথ্য সংগ্রহ, সংবাদ-কাহিনী নির্মাণ ও প্রকাশের জন্য সাংগঠনিক কাঠামো ও প্রক্রিয়া গড়ে তোলে। ফলে, সংবাদ-প্রতিষ্ঠান আমলাতান্ত্রিক চরিত্র পায়। আর সংবাদ হয়ে ওঠে প্রাত্যহিক আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ফল। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে কাজ নিয়ে আলোচনা বিশেষত হয় না। তথ্য সংগ্রহ, তথ্যকে সংবাদ আকারে সাজানো কিংবা সংবাদ বাছাই করার কাজগুলো প্রতিদিনের রুটিন মাফিক সাধারণত প্রতিষ্ঠানের নিম্নস্তরের কর্মীরা একঘেঁয়েভাবে করে যান। রুটিনের ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে কিংবা প্রত্যক্ষভাবে প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকলেই কেবল তা ক্রমতন্ত্রের উচ্চপর্যায়ে আলোচিত হয়। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কাজ নিয়ে এই প্রকার সীমিত আলাপ-আলোচনাই প্রতিষ্ঠানটির রুটিন নির্ভরতা স্পষ্ট করে তোলে। সাদা চোখে দেখা যায়, তথ্য সংগ্রহ, কোন্ তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হবে, কোন্ বিষয়টি কাভার করা হবে এসব নিয়ে সংবাদপ্রতিষ্ঠানে সবসময় অনিশ্চয়তা বিরাজ করে। তবে, এই অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করা হয় সবকিছুকে রুটিনের কাঠামোয় ফেলে দিয়ে- সংবাদকে নানান ভাগে ভাগ করা হয়, রুটিনমাফিক নির্দিষ্ট কিছু সূত্রের ওপর নির্ভর করা হয়, কিছু কিছু স্থানে সবসময় রিপোর্টার রাখা হয় নিয়মিত সংবাদ সংগ্রহের জন্য। এভাবে সংবাদ-উৎপাদনকে রুটিনবদ্ধ করায় আমরা একই ধরনের সংবাদ নিয়মিত পেতে থাকি। কোন্টা সংবাদ আর কোন্টা সংবাদ নয় এইরূপ সংজ্ঞা গড়ে ওঠে। অবশ্য, ভাবা হয়ে থাকে যে, কোন্ ঘটনা সংবাদ হবে আর কোন্টা হবে না তা নির্ভর করে ব্যক্তি রিপোর্টারের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। কিন্তু দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের কাঠামো এবং রুটিন ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ওপর আরোপিত হয়।
সংবাদ আমলাতন্ত্র আবার তথ্যের জন্য বিশেষত অন্য আমলাতন্ত্রগুলোর ওপর নিভর করে। মার্ক ফিসম্যান ক্যালির্ফোনিয়ার একটি সংবাদপত্রের ওপর গবেষণা করে জানাচ্ছেন, সাংবাদিকরা সরকারের আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে নিবিড় সখ্য পাতায় এবং ‘সাংবাদিকের বিশ্ব আমলাতান্ত্রিকভাবে সাজানো’। (১৯৮০: ৫১) সাংবাদিকদের ‘বিটগুলো’ এমনভাবে সাজানো যে তারা সংবাদের বেশিরভাগটাই পায় সরকারের অফিসিয়াল সূত্র মারফত। “সমাজকে আমলাতান্ত্রিকভাবে সাজানো দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গিই সাংবাদিকের ‘সংবাদযোগ্য ঘটনাবলী’ শনাক্ত করতে পারার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে”। (১৯৮০: ৫১) সাংবাদিকদের জন্য আমলাতন্ত্রগুলোর সাথে সম্পৃক্ত থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ‘আমলাতন্ত্রগুলো নিয়মিত সংবাদ-ঘটনা সরবরাহ করে’। (১৯৮০: ৫২) তাই, সংবাদ সম্পর্কে এধরনের ভাষ্য অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য যে, মূলত সমাজিক ঘটনাবলী সম্পর্কে অন্য আমলাতন্ত্রগুলো প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে মিডিয়া-আমলাতন্ত্রের নির্মিত ভাষ্যই হলো সংবাদ।
বস্তুনিষ্ঠতার মূল্যবোধ সংবাদকে ‘স্মার্ট’ পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে
সাংবাদিকতার একেবারে কেন্দ্রীয় একটা মূল্যবোধ হলো বস্তুনিষ্ঠতা। এই মূল্যবোধ অনুযায়ী, সাংবাদিকরা তাদের পৃথিবীকে বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন ও রিপোর্ট করতে পারেন। কিন্তু এপ্রসঙ্গে বলা হয় না যে সাংবাদিকরা তাদের নির্মিত সংবাদকাহিনী থেকে নিজস্ব মূল্যবোধকে বিচ্ছিন্ন করতে অক্ষম। কোনো ব্যক্তির পক্ষেই তার কর্ম থেকে মূল্যবোধকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। সংবাদকে যদি আমরা সামাজিক প্রক্রিয়ার ফল বলি তাহলে এটাও বলতে হবে যে সাংবাদিক কিছুতেই সমাজ সম্পর্কে অর্জিত তার বিশ্বাস-সংস্কারকে এড়াতে পারেন না। ফলে, সংবাদ কখনোই মূল্যবোধ মূক্ত হয় না। কারণ, প্রতিদিনের সকল কর্মতৎপরতার মধ্যেই সামাজিক মূল্যবোধ সক্রিয় থাকে।
আমরা যদি বস্তুনিষ্ঠতার রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিচার করি তাহলে দেখা যাবে, গণযোগাযোগের উপায়গুলোর পুঁজিবাদী মালিকানা ও প্রাত্যহিক সাংবাদিকতা চর্চার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করে “বস্তুনিষ্ঠতার সংস্কৃতি” যাকে জেমস ক্যারে ‘সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক অভিপ্রায়’ হিসেবে সমালোচনা করেছেন। জেমস ক্যারে ‘বস্তুনিষ্ঠতা’র আবির্ভাবকে সুনজরে দেখেননি। তিনি এ-সম্পর্কে বলেন,
উনবিংশ শতকের শেষ দিকে ‘বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিংয়ের’ আবির্ভাবে সাংবাদিক এমন একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে থাকেন যাকে অবশ্যই ‘মানের নিম্নগমন’ হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে, এ এমন এক প্রক্রিয়া যাতে তার ভূমিকার অবুদ্ধিবৃত্তিকীকরণ ও যান্ত্রীকীকরণ ঘটে। … এই ভূমিকায় সে আর সমালোচক, ব্যাখ্যাকার ও সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক হিসেবে তার বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা খাটায় না বরং সরকারের, বিজ্ঞানের, শিল্পকলার, চিকিৎসাবিদ্যার এবং বাণিজ্যের বিশেষায়িত ভাষা ও উদ্দেশ্যকে বৃহত্তর অজানা-অচেনা ও মূলত স্বল্পশিক্ষিত অডিয়েন্সের জন্য সহজ ভাষায় অনুবাদ ও লেখার কৌশলগত দক্ষতাকে কাজে লাগায়। (১৯৬৯: ৩২)
বস্তুনিষ্ঠতার সংস্কৃতি মিডিয়াকে স্বাধীনতা পাওয়ার, বরং বলা ভাল, স্বাধীনতা দ্বারা পুরস্কৃত হবার সুযোগ করে দেয়- বড় কর্পোরেশন ও সরকারি কর্তৃপক্ষের সাথে মিডিয়াপ্রতিষ্ঠানের মাঝেমধ্যে সংঘাতের ঘটনা থেকেই সেটা বোঝা যায়। বস্তুনিষ্ঠতার মূল্যবোধের সুফল হলো যে এর মাধ্যমে পুরনো দিনের দলগত পক্ষপাত ব্যাপক মাত্রায় কমে আসে (যদিও আমাদের দেশের দিনকাল, ইনকিলাব এখনও সেই যুগেই পড়ে আছে)। কিন্তু ‘বস্তুনিষ্ঠতার নিজস্ব পক্ষপাত আছে- যতোটা না সংবাদকাহিনীর ভিতরে পক্ষপাত তার চেয়ে অধিক পরিমাণে খোদ সংবাদকাহিনীরই পক্ষপাত।’ (১৯৯৭: ৩৪) বস্তুনিষ্ঠতার মূল্যবোধ সংবাদকাহিনীকে খেলার ধারভাষ্যের মতো করে তোলে। রিপোর্টার সকলপক্ষের মধ্যে ‘ব্যালান্স’ করতে গিয়ে মূল সমস্যাটা আর গভীরভাবে অনুসন্ধান করতে পারেন না। আবার ‘বস্তুনিষ্ঠতা’র মূল্যবোধের কারণে, সাংবাদিকরা তথ্যের জন্য সবসময় সমাজের অধিপতি-ক্ষমতাবান-অফিসিয়াল সূত্রগুলোর ওপর নির্ভর করেন, তাদের মুখের বাণীর মালা গেঁথে ঘটনার ধারাভাষ্য দেন। আর ‘আনঅফিসিয়াল’ দরিদ্র-ক্ষমতাহীন-অনাকাঙ্খিতরা প্রত্যক্ষভাবে ঘটনার সাথে জড়িত থাকলেও, ঘটনার ভূক্তভোগী হলেও ‘বস্তুনিষ্ঠতা’ রক্ষা করতে যেয়ে সংবাদকাহিনী থেকে হারিয়ে যায়।
মূলকথা, ঘটনা সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ হওয়া সম্ভব নয় এবং ‘বস্তুনিষ্ঠতা’ উদ্দেশ্যমূলক। ‘বস্তুনিষ্ঠতার মূল্যবোধ একটি সাংগঠনিক রুটিন বা প্রথা যা দক্ষভাবে উৎপাদিত পণ্য হিসেবে সংবাদকে তুলে ধরার কর্পোরেটীয় আকাঙ্খাকে তৃপ্ত করে।’ (১৯৯৭: ৪৩)
এবার দেখা যাক, বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে বাংলা ভাষায় আমরা কী ‘বস্তু’ পাই:
মীর মাসরুর জামান ও জগদীশ সানা (সম্পা.) তৃণমূল সাংবাদিকতা: ধারণা এবং কলাকৌশল গ্রন্থে বলা হচ্ছে,
সংবাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর বস্তুনিষ্ঠতা। সংবাদকে পক্ষপাতহীন হতে হয়। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বা নিজের ধারণা থেকে না লিখে সততার সাথে সংবাদ প্রকাশ করাই এর বস্তুনিষ্ঠতা। (২০০০: ৮০)
সুধাংশু শেখর রায় তার রিপোর্টিং গ্রন্থে পুরো একটা অধ্যায়জুড়ে বস্তুনিষ্ঠতা প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন। সে আলোচনায় আমাদের কতোটুকু জ্ঞান বৃদ্ধি হয়েছে দেখা যাক। তিনি বলছেন,
বস্তুনিষ্ঠতা মানে ঘটনা যেভাবে ঘটেছে হুবহু সেভাবেই তার বর্ণনা দেয়া। বস্তুনিষ্ঠতার মানে কোন ব্যক্তিগত পক্ষপাত বা বাইরের প্রভাবমুক্ত কোন সংবাদ। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমই স্বীকার করেন যে সংবাদকে অবশ্যই পবিত্র বা পঙ্কিলতামুক্ত হতে হবে। (১৯৯৫: ৭৭)
পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়া ও তার নিয়ন্ত্রকদের ‘পবিত্র’ বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি তার অন্ধবিশ্বাস এতই প্রবল যে আরও বলছেন,
বস্তুনিষ্ঠতা হচ্ছে সাংবাদিকের জন্য একটি গর্বিত লক্ষ্য। … আমেরিকা ইংল্যান্ডের সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠতার এই চ্যালেঞ্জকে দারুনভাবে গ্রহণ করেছেন এবং এই চ্যালেঞ্জ ভালভাবে মোকাবিলা করে তারা সিদ্ধিলাভ করেছেন। (১৯৯৫: ৭৮)
তারা কেমন সিদ্ধিলাভ করেছেন তা ‘মহান’ বিবিসি এবং সিএনএন দেখলেই বোঝা যায়। ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত চলমান নির্জ্জলা আগ্রসনকে তারা কিছুতেই আগ্রাসন বলেন না, বলেন ‘ইরাকিদের মুক্তির জন্য যুদ্ধ’। বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে সৈন্য প্রেরণ করেছে ‘গণতন্ত্র পুনপ্রতিষ্ঠা করতে’। যদিও সাধারণ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো লোকই জানেন গণতন্ত্র নয়, হাজার হাজার নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা করে দখলদারিত্ব কায়েম করতে ও সম্পদ লুট করতেই হামলা চালানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সেসব কাহিনী বিবিসি-সিএনএন দেখায় না। কিন্তু তারপরও পশ্চিমা মুক্ত মিডিয়ার মিথ সিন্দাবাদের ভুতের মতো আমাদের ঘাড়ে চেপে আছে। পশ্চিমা সাংবাদিকতার প্রকৃত ইতিহাসের সাথে তার বোঝাপড়া থাকলে এমন গুরুতর মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতেন।
বস্তুনিষ্ঠতা আলোচনায় তিনি সেল্ফসেন্সরশিপ ও গেটকিপিং প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। এদুটো প্রসঙ্গেও তিনি কতো ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছেন ও সাংবাদিকতা অধ্যয়ন করতে আসা পাঠককে বিভ্রান্ত করছেন তার নমুনা দেখুন,
তিনি (সাংবাদিক) যদি কারো চাপের মুখে সত্য প্রকাশে বিরত থাকেন তাহলে ধরে নেয়া হবে ওই রিপোর্টার খবরের বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা করছেন না। কোন সত্যঘটনাকে প্রকাশে নিজের কাছে নিজেই (এই) রুদ্ধ হয়ে যাওয়াটাকে ইংরেজি পরিভাষায় সেল্ফসেন্সর বলা হয়। অর্থাৎ নিজের বিরুদ্ধে নিজেই সেন্সর আরোপ করলেন। (১৯৯৫: ৮০)
এতো সদর্থক অর্থে তিনি সেল্ফসেন্সরকে দেখছেন যেনবা সাংবাদিক সবসময় সকল পরিস্থিতিতে সত্য প্রকাশেই সচেষ্ট থাকেন। তবে, কখনো কখনো সাংবাদিক চাপের মুখে সত্য প্রকাশে বিরত থাকতে বাধ্য হন- যাকে তিনি বলছেন সেল্ফসেন্সরশিপ। কিন্তু সংবাদ উৎপাদনকে তার উৎপাদন-সম্পর্কগুলোর আলোকে দেখলে সেল্ফসেন্সরশিপ সম্পর্কে আমরা ভিন্ন ধারণা পাই। কোন্ বিষয়ে রিপোর্ট করলে, কীভাবে রিপোর্ট করলে সংবাদ-প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করবে এই পূর্বধারণা থেকেই মূলত সাংবাদিকরা সেল্ফসেন্সর করেন। তাছাড়া কোন্ ঘটনার ‘সংবাদমূল্য’ আছে আর কোন্টার নেই এই প্রতাপশালী প্রাতিষ্ঠানিক দীক্ষা তার আগেই হয়ে যায়। ফলে, আপনা থেকেই সে অনেক প্রসঙ্গ সেন্সর করতে থাকে।
কুর্ট লিউইনের প্রচলিত ‘গেটকিপিং’ ধারণা নিয়ে যে বিপুল পরিমাণ গবেষণা হয়েছে এবং সংবাদ নির্বাচনে খোদ গেটকিপিং ধারণাটিই প্রতিরুদ্ধ হয়েছে সেসব সম্পর্কে একটুও তার জানা নেই। গেটকিপিং সম্পর্কে তার ধারণা হলো:
গৃহে যেমন দ্বাররক্ষী থাকে এবং তারা অচেনা অজানা লোকের গৃহপ্রবেশের পথ রোধ করে দাঁড়ায়, কিংবা যথাযথ পরিচয় পেলে তাহলে গৃহে প্রবেশের অনুমতি দেয়, ঠিক একইভাবে সংবাদের নির্বিচার প্রবাহ কিংবা অন্য কথায় বলা যায়, খবর অখবরের নির্বিচার প্রবেশকে রোধ করার জন্যই এই গেটকিপিং। (১৯৯৫: ৮০-৮১)
গেটকিপার ‘খবর-অখবরের নির্বিচার প্রবেশ’ রোধ করেন নাকি অনেক সংবাদকাহিনী তার স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তেরও শিকার হয়? ডেভিড ম্যানিং হোয়াইট মধ্যবয়সী একজন তারবার্তা সম্পাদকের সিদ্ধান্তে ‘এক সপ্তাহে সংবাদপত্রে ছাপা ও ছাপার অযোগ্য ঘোষণা করা’ তারবার্তা কপিগুলো একজায়গায় জড়ো করে এগুলো সম্পর্কে তার সিদ্ধান্তের যুক্তিযুক্ত কারণ লিখতে বলেছিলেন। এর ভিত্তিতে হোয়াইট উপসংহার টানেন যে, গেটকিপারের সিদ্ধান্ত ছিল অত্যন্ত ব্যক্তিনির্ভর। তার নিজস্ব মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা, পছন্দ অপছন্দ নির্ধারণ করে কোন্ কপিগুলো সংবাদপত্রে সংবাদ হবে। (১৯৯৭: ৮-৯) হোয়াইটের এই সিদ্ধান্ত অবশ্য প্রতিরুদ্ধ হয়েছে। কারণ, সংবাদ-বাছাই কেবল ব্যক্তিক মূল্যবোধের ওপর নির্ভরশীল নয়। গেটকিপার নিয়ে পরবর্তী গবেষণাগুলোতে দেখা যায়, সংবাদ আইটেম কেবল নির্বাচনের বিষয় নয়, নির্মাণের বিষয়ও। তদুপরি, গেটকিপার ধারণা ব্যক্তিকরণের মাধ্যমে একটা আমলাতান্ত্রিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াকে আড়াল করে। আরও কথা থাকে যে, গেটকিপার কেবল ‘খবর-অখবরের নির্বিচার প্রবেশ’ নিয়ন্ত্রণ করেন না। তিনি প্রতিষ্ঠানের এবং আধিপত্যশীলদের মতাদর্শিক অবস্থানের পাহারাদার হিসেবেও সক্রিয় থাকেন। সাংবাদিকতা সংস্কৃতির দীক্ষায়ন ব্যবস্থা তাকে এমন শিক্ষা দেয় যে আধিপত্যশীল ধারার চেয়ে ভিন্নতর দৃষ্টিভঙ্গি যতোই গুরুত্ববহ হোক না কেন, তার কাছে একেবারেই সংবাদযোগ্যতা অর্জন করে না।
খ. আলী আর রাজী, মঞ্জুরুল ইসলাম ও নাইমুল ইসলাম খানের সাংবাদিকতা: প্রথম পাঠ গ্রন্থে বরং বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে একটু ভিন্ন ধারণা পাওয়া যায়। তারা বলছেন,
বস্তুনিষ্ঠতা অর্জন করা খুব কঠিন একটি কাজ। প্রতিটি স্টোরির বস্তুনিষ্ঠতা কোনো না কোনোভাবে ক্ষুন্ন হবেই- এটাই নিয়তি। একটি স্টোরির বস্তুনিষ্ঠতা প্রথম ক্ষুন্ন হয় যখন প্রতিবেদক নিজের বুদ্ধি মতো তথ্য খুঁজে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন শুরু করেন। দ্বিতীয় বার বস্তুনিষ্ঠতা ক্ষুন্ন হয় যখন প্রতিবেদক একেবারেই নিজের বিবেচনামত কিছু নির্বাচিত তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন নির্মাণ করেন। … কিন্তু সত্য হচ্ছে সংবাদ সংগ্রহ থেকে উপস্থাপনার প্রক্রিয়াটিই ক্ষুন্ন করে বস্তুনিষ্ঠতা। (১৯৯৭: ১৬৯)
বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি একধরনের টান থাকলেও সেই মহার্ঘ চিজটা যে আদপে রক্ষা করতে পারা যায় না সেটা তারা বুঝেছেন এবং আলোচনা করেছেন। যদিও ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সাংবাদিকতার একটা কেন্দ্রীয় মূল্যবোধ বস্তুনিষ্ঠতাকে দেখার এবং তার উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ ছিল।
ঘটনার সংবাদমূল্য খোদ ঘটনাটির ওপরই নির্ভর করে না
মীর মাসরুর জামান ও জগদীশ সানার (সম্পা.) তৃণমূল সাংবাদিকতা: ধারণা এবং কলাকৌশল গ্রন্থে বলা হচ্ছে,
কোনো ঘটনা সংবাদ হতে হলে কিছু বাড়তি গুণের প্রয়োজন হয়। … কোনো ঘটনাকে সংবাদ হতে হলে কতগুলো বিশেষত্ব বা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হয়। এই বিশেষত্ব বা বৈশিষ্ট্যগুলো না থাকলে কোনো ঘটনা সংবাদ হবার যোগ্যতা লাভ করে না। (২০০০: ৭৮-৭৯)
খ. আলী আর রাজী, মঞ্জুরুল ইসলাম ও নাইমুল ইসলাম খানের সাংবাদিকতা: প্রথম পাঠ গ্রন্থে সংবাদমূল্য সম্পর্কে বলা হয়েছে,
শেষ বিচারে পঠকের আগ্রহই হচ্ছে কোনো একটি ঘটনার সংবাদপত্রে স্থান পাওয়ার একমাত্র মানদণ্ড। … একটি ঘটনার সংবাদ হিশেবে খবরের কাগজে স্থান পাওয়ার যোগ্যতা অর্থাৎ সংবাদযোগ্যতা নির্ভর করে ঘটনাটি কতো বড় পরিবর্তন আনলো বা আনতে পারে তার ওপর। (১৯৯৭: ১৬২)
বাংলা পুস্তক দুটিতে সংবাদমূল্য সম্পর্কে যে ধারণা দেয়া হয়েছে, পূর্বোল্লেখিত অন্য ভিনদেশী পুস্তকগুলোতেও এর বিপরীত কোনো ধারণা পাওয়া যাবে না। সংবাদমূল্যকে অন্য কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টাও একদম নেই। ওপরের উদ্ধৃতি দুটো থেকে দুইটি প্রস্তাব ছেঁকে নেয়া সম্ভব- ক. পাঠকের আগ্রহ ঘটনার সংবাদ হওয়ার চূড়ান্ত মানদণ্ড; খ. সংবাদ হতে হলে ঘটনাকে কিছু গুণের অধিকারী হতে হয়। আমার বিবেচনায় দুটি প্রস্তাবের বিচার এরকম:
ক. ‘পাঠকের আগ্রহ’ ধারণাটি অস্পষ্টতাদুষ্ট। পাঠকের আগ্রহের কারণে সংবাদ-প্রতিষ্ঠান কোনো ঘটনাকে সংবাদের মর্যাদা দেয় নাকি পাঠকের আগ্রহের কথা বলাটা নিজেদের পছন্দ-অপছন্দকে পাঠকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার উছিলা? অনেক গবেষণাতেই দেখা গেছে, পাঠকের আগ্রহের ব্যপারটি আসলে সাংবাদিকরা ‘কল্পনা’ করেন, তাদের প্রকৃত অডিয়েন্সকে তারা চেনেন না। হার্বাট জেনস সংবাদ-ম্যাগাজিন ও টেলিভিশন নেটওয়ার্কের সাংবাদিকদের ওপর পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা করে জানাচ্ছেন,
কীভাবে সাংবাদিকরা তাদের অডিয়েন্সকে বিবেচনা করেন ও সম্পর্কিত থাকেন সেটা দেখার জন্য গভীর মনোযোগ দিয়েছিলাম। আমি বিস্মিত হয়েছি এটা দেখে যে, প্রকৃত অডিয়েন্স সম্পর্কে সাংবাদিকদের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত এবং অডিয়েন্সের পক্ষ থেকে আসা ফিডব্যাক তারা হামেশাই প্রত্যাখ্যান করেন। অডিয়েন্স সম্পর্কে যদিও তাদের একটা অস্পষ্ট ধারণা থাকে, তবু সেই ধারণাকেও তারা খুব একটা পাত্তা দেন না। বরং, তাদের উপরওয়ালা ও নিজেদের জন্যই তারা ভিডিও করে এবং লেখে … আর ধরে নেয় যে তাদের নিজেদেরকে যা আগ্রহী করেছে, তাদের অডিয়েন্সকেও সেটা আগ্রহী করবে। (১৯৭৯: ২৩০)
তাহলে এটা স্পষ্ট যে, ঘটনার ‘সংবাদমূল্য’ নির্ধারণে পাঠকের আগ্রহ কোনো গুরুত্ব বহন করে না। কখনো কখনো আগ্রহ নির্মাণও করা হয়। সাংবাদিকতা মূলত একটা সিস্টেম, একটা সংস্কৃতি, একটা মতাদর্শিক কাঠামো, যার নিজস্ব উৎপাদন-রীতি আছে, বিধান আছে, যে বিধান অনুযায়ী সাংবাদিকের জগতের সবকিছু নির্ধারিত হয়।
খ. প্রথমেই বলি, ঘটনার সংবাদমূল্য আরোপিত। স্বাভাবিকভাবেই কিছু ঘটনা সংবাদমূল্য ধারণ করে, আর কিছু ঘটনার সংবাদমূল্য থাকে না- এমন সরল নয় ব্যাপারটি। মানবিক তৎপরতায় ও স্বার্থে আমরা ঘটনাকে খুপরিবদ্ধ (ডি-লিমিট অর্থে) করি, শ্রেণীকরণ করি, নামকরণ করি, গুরুত্বারোপ করি- ঠিক যেমনটি আমরা সময়ের প্রবাহকে আমাদের স্বার্থে ঘণ্টা-দিন-মাস-বছরে ভাগ করি। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সংবাদমূল্য একটি মানবিক নির্মাণ, যা সাংবাদিক ও সমাজের অন্যান্যদের পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে বিকশিত হয়।
সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা শেখানো পণ্ডিতরা ‘সংবাদমূল্য’ বা ‘সংবাদবোধ’ নিয়ে আলোচনায় প্রচুর সময় ব্যায় করেন। যদিও একে সংজ্ঞায়িত তারা করতে পারেননি। তাহলে, কীভাবে একজন সাংবাদিক কোনো ঘটনার মধ্যে সংবাদমূল্য দেখতে পান? স্টুয়ার্ট হল এ-সম্পর্কে বলেছেন,
আধুনিক সমাজে ‘সংবাদমূল্য’ একটি অন্যতম দুর্বোধ্য অর্থ-কাঠামো। ধরে নেয়া হয় যে সকল ‘সত্যিকারের সাংবাদিক’ সংবাদমূল্য বোঝার গুণসম্পন্ন হবেন, যদিও তাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যকই এটাকে শনাক্ত বা সজ্ঞায়িত করতে চেষ্টা করেছেন। সাংবাদিকরা ‘সংবাদ’ সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলেন যেন ঘটনা নিজে নিজেই সংবাদ হিসেবে নির্বাচিত হয়। তাছাড়াও তারা এমনভাবেও কথা বলেন যেন কোন্টা ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ সংবাদকাহিনী আর কোন্ ‘সংবাদ-এ্যংগেল’ সবচেয়ে ভাল তা দৈবভাবে নির্ধারিত হয়। পৃথিবীতে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ঘটনা ঘটে, কিন্তু তার খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ ‘সম্ভাব্য সংবাদ-কাহিনী’ হিসেবে দৃশ্যমান হয় এবং এগুলো থেকেও আরও ক্ষুদ্রতর একটা অংশকে সেদিনের ‘সংবাদ’ হিসেবে সংবাদমাধ্যম উৎপাদন করে। তাহলে এটাই দাঁড়াচ্ছে যে, আমরা একটা ‘গভীর কাঠামো’র মুখোমুখি হই, সংবাদ নির্বাচনে যার তৎপরতা এমনকি পেশাদারীত্বের সাথে এই ক্ষেত্রে যারা কাজ করেন তাদের কাছেও অস্পষ্ট। (১৯৭৩: ১৮১)
সংবাদমূল্য বা সংবাদবোধকে, বরং, প্রতাপশালী ব্যবস্থার একটা ‘মতাদর্শ’ বা ‘আপ্ত ধারণা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে, যা সাংবাদিকদের একটা গুপ্ত বিদ্যা এবং যার দ্বারা সে নিজেকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র দাবী করে।
সংবাদমূল্যের একটা অর্থনৈতিক দিকও আছে, সংবাদ-শিল্পে সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে তথ্য সংগ্রহে দক্ষতা বাড়াতে হয়। এক্ষেত্রে সংবাদমূল্যের ধারণা ‘সংবাদযোগ্য’ ঘটনা চেনা সহজ করে এবং অনেক ব্যয় হ্রাস করে দেয়। তাই বাণিজ্যিকভাবে সফল সংবাদশিল্পগুলো যেখানে সবচেয়ে বেশি ‘সংবাদ’ পাওয়া যায়- সাধারণত বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতে- সেসব জায়গায়ই বেশি বেশি রিপোর্টার খরচ করে। “টেলিভিশন সংবাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় এক ধরনের ভৌগোলিক পক্ষপাত কাজ করে। যেসব জায়গার তথ্য সংগ্রহ ও সম্প্রচার করতে খরচ কম হয় সেসব জায়গার ঘটনাগুলোর ‘সংবাদযোগ্য’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে বা টেলিভিশন সেই ঘটনাকে ‘সংবাদ’ হিসেবে সম্প্রচার করে।” (১৯৯৭: ৩৫)
তাহলে দেখা যাচ্ছে, সংবাদ-প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব স্বার্থগত বিবেচনা এবং এই প্রতিষ্ঠানের সাথে মিথোজীবিতামূলক সম্পর্কে আবদ্ধ ক্ষমতার অন্যান্য ভরকেন্দ্রগুলো ‘সংবাদমূল্য’ নিধারণে অত্যন্ত প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে।
উপসংহারের বদলে
প্রতিনিয়ত সংবাদ একধরনের বাস্তবতা নির্মাণ করে চলেছে এবং রাজনৈতিক বিচারে এই নির্মাণ সচরাচর অধিপতি মতাদর্শের অনুগামী। যে উপাদান-প্রকরণে আমরা সংবাদকে চিনি, আমাদের সচরাচর পঠিত কেতাবগুলো যেভাবে সংবাদকে ব্যাখ্যা করেন তা সংবাদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক মাত্রাগুলো স্পষ্ট করে না। বরং, ‘সংবাদ হয়ে ওঠার’ প্রক্রিয়াটিকে আড়াল করে। সংবাদ কিছু ঘটনাকে জনসম্মুখে হাজির করে, আর বহু ঘটনা হারিয়ে যায়। এটা এমন এক ক্ষমতার চর্চা যার মাধ্যমে অন্যদের যাবতীয় অভিজ্ঞতা নির্ধারিত হয়ে একটা নির্দিষ্ট ধরনের অস্তিত্ব লাভ করে। সংবাদ শিল্পের নিজস্ব কাঠামো ও স্বর্থগুলো সদা সক্রিয় থেকে নিধারণ করে দেয় সংবাদ কী আর সংবাদ কী নয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লেখা জমা দেয়ার চাপের কারণে সংবাদের প্রকৃতি বিশ্লেষণে খামতি থেকে গেছে। বিশেষত, সংবাদের প্রাতিষ্ঠানিক মাত্রাগুলো বিশ্লেষণ করতে যেয়ে সংবাদ নির্বাচন ও নির্মাণে ব্যক্তির সৃজনশীল ভূমিকা এই প্রবন্ধে একেবারেই অনালোকিত থেকেছে। মোটকথা কীভাবে ঘটনা ‘সংবাদ’ হয়ে ওঠে, কোন্ উদ্দেশ্য পূরণ করে তা নিয়ে কেবল কিছু বিক্ষিপ্ত আলোকপাত করা গেছে এই প্রবন্ধে। তাই কোনো উপসংহার টানা যাচ্ছে না আপাতত। তবে, সংবাদের প্রকৃতি সম্পর্কে ফকির লালন শাহ’র জবানে অন্তত এটুকু বলা যেতে পারে:
সবাই কেনে পিতল দানা/জহরের মূল্য হোলো না
লালন বলে গেল জানা/চটকে জগত মেত্যেছে।
টীকা:
১. শাস্ত্র কেবল নিরীহ জ্ঞানভাণ্ডার নয়, আধিপত্য কায়েম করার হাতিয়ারও। জ্ঞান ক্ষমতাকেন্দ্রীক। প্রথমে নৃবিজ্ঞানী-পাদ্রী-কবি-উপন্যাসিক-মিডিয়া আসে, তার পেছনে আসে দখলদার-তেলকোম্পানী-কোকাকোলা-পর্ণোগ্রাফী-নির্মাণফার্ম-সাম্রাজ্যবাদ। বাংলা অভিধানে তাই শাস্ত্র শব্দের অর্থ দেয়া আছে ‘যা দ্বারা শাসন করা হয়’, ‘অনুশাসন গ্রন্থ’। এই মোতাবেক, সাংবাদিকতার পুস্তকগুলো দক্ষতার সাথে অধিপতি-অনুকূল সাংবাদিকতার জন্য একটা নির্দিষ্ট কর্মীশ্রেণী তৈরি করে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের খয়রাতী পুস্তক পেয়ে আমরা দাতাদের ‘দানশীলতায়’ বিগলিত হই, দানের মাজেজা বুঝি না।
২. তাঁরা বলছেন, প্রচারণা মডেল সেই পথের অনুসন্ধান করে যে-পথে অর্থ ও ক্ষমতা ছাপাযোগ্য সংবাদগুলোকে ছেঁকে ফেলে দিতে ও ভিন্নমতকে কোণঠাসা করে ফেলতে সক্ষম হয় এবং সরকার ও প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠীগুলোকে তাদের নিজস্ব বার্তা নিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। তাঁদের এই মডেলে পাঁচটা ফিল্টারের কথা বলা হয়েছে। কোনো ঘটনাকে সংবাদ হতে হলে অনিবার্যভাবেই এই ফিল্টারগুলো পার হয়ে আসতে হয়।
তথসূত্র
সুধাংশু শেখর রায় (১৯৯৫), রিপোর্টিং, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।
মীর মাসরুর জামান ও জগদীশ সানা (সম্পা.: ২০০০), তৃণমূল সাংবাদিকতা: ধারণা এবং কলাকৌশল, ম্যাসলাইন মিডিয়া সেন্টার, ঢাকা।
খ. আলী আর রাজী, মঞ্জুরুল ইসলাম ও নাইমুল ইসলাম খান (১৯৯৭), সাংবাদিকতা: প্রথম পাঠ, বিসিডিজেসি, ঢাকা।
Stanly Johnson and Julian Harriss (1942), The Complete Reporter, Macmillan Company, New York.
T. B. Bottomore and Maximilien Rubel (Ed. 1961), Karl marx: Selected writings in Sociology and Social Philosophy, Peguin Books, England.
Edward s. Herman and Noam Chomsky (2002), Manufacturing Consent: The Political Economy of the Mass Media, Random House, New York.
Ben H. Bagdikian (1997), The Media Monopoly, Beacon Press, Boston.
Frederick Engels (1998), Ludwig Feuerbach and the End of Classical German Philosophy, ElecBook, London.
M. Fishman (1980), Manufacturing of News, Austin: University of Texas Press, Quoted in Michael Schudson, “Sociology of News Production”, in Dan Berkowiz (Ed. 1997), Social Meaning of News, Sage Publications, London.
Michael Schudson, “Sociology of News Production”, in Dan Berkowiz (Ed. 1997), Social Meaning of News, Sage Publications, London.
James S. Ettema, D. Charles Whitney and Daniel B. Wakman, “Professional Mass Communicators”, in Dan Berkowiz (Ed. 1997), Social Meaning of News, Sage Publications, London.
J. W Carey (1969) The Communication Revulution and the Professional Mass Communicators, quoted in James S. Ettema, D. Charles Whitney and Daniel B. Wakman, “Professional Mass Communicators”, in Dan Berkowiz (Ed. 1997), Social Meaning of News, (p.44), Sage Publications, London.
S. Hall (1973), “The Determination of News Photographs”, quoted in, Michael Schudson, “Sociology of News Production”, in Dan Berkowiz (Ed. 1997), Social Meaning of News, P. 18, Sage Publications, London.
H. J. Genes (1979), Deciding What’s News, Pantheon, New York, quoted in James S. Ettema, D. Charles Whitney and Daniel B. Wakman, “Professional Mass Communicators”, in Dan Berkowiz (Ed. 1997), Social Meaning of News, (p.40), Sage Publications, London.
- লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়