- পারভেজ আলম
![](https://rashtrochinta.net/wp-content/uploads/2021/06/Desktop-size-70-1024x576.png)
জালিম ও মজলুম শব্দ দুইটাকে ভাসানী ব্যবহার করেছেন মার্ক্সবাদে বহুল ব্যবহৃত অপ্রেসর ও অপ্রেসড শব্দ দুইটার প্রতিশব্দ হিসাবে। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো শুরুই হয়েছে মানব সভ্যতার ইতিহাসকে অপ্রেসর ও অপ্রেসডের মধ্যে দ্বন্দ্বের ইতিহাস হিসাবে। মার্ক্সিস্টডটঅর্গে মেনিফেস্টোর বাংলা অনুবাদে ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাচারী ও অত্যাচারিত শব্দ দুইটা। এই মুহূর্তে হাতের কাছে আর কোন বাংলা কপি নাই। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে আমাদের ক্লাসিকাল রুশপন্থী বামেদের মধ্যে শোষক ও শোষিত শব্দ দুইটা কোন কারনে জনপ্রিয় হয়েছে। যদিও আমার মনে হয় যে এই দুই শব্দে মেনিফেস্টোর মূল অর্থ ধরা যায় না। জালিম ও মজলুম সেই তুলনায় অনেক ভাল প্রতিশব্দ। আমিও তাই এই শব্দ দুইটা ব্যবহার করি।
কিন্তু ভাসানী এই শব্দ দুইটাকে কেবলি মার্ক্সবাদী পরিভাষা হিসাবেই ব্যবহার করেছেন, তা মনে হয় না। আবার আরবী দুইটা শব্দ ব্যবহার করেছেন তিনি কেবলি তার বামপন্থায় একটা মুসলমানি আমেজ দেয়ার উদ্দেশ্যে, তাও মনে হয় না। আজকাল অনেকে আরবী ফারসি শব্দ ব্যবহার করেন এইরকম বাহ্যিক অলঙ্কার হিসাবে, বা নিজেদেরকে ইসলামঘনিষ্ঠ হিসাবে দেখাইতে। ভাসানীর ক্ষেত্রে তা বলা যায় না। প্রথমত, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে অবিচ্ছিন্ন দ্বন্দ্বের দৃশ্য হাজির করেছে, ইসলামের ইতিহাসতো তার থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। বরং ইসলামের গোড়ার ইতিহাস মানব সভ্যতার এই ইতিহাস বোঝার জন্যে এক অমূল্য সম্পদ। জালিম-মজলুমের যেই ডিকোটমি ইসলামের ইতিহাসের একেবারে গোড়ার বিষয়, মার্ক্স পরবর্তি দুনিয়ায় (অন্তত বাংলাদেশে) ভাসানী তা আবারো জীবন্ত ও প্রাসঙ্গিক করেছেন। ভাসানীর আল্লাহ একান্তই মজলুমের আল্লাহ্। কোরান-হাদিসে এমন আল্লাহর ধারণা পাওয়া যায়। কোরানে যেমন আছে যে আল্লাহ্ কখনো জুলুম করেন না, বরং মানুষই মানুষের উপরে জুলুম করে। হাদিসে যেমন আছে যে আল্লাহ্ এমনকি নিজের জন্যেও জুলুম নিষিদ্ধ করেছেন। এই আল্লাহর ধারণা জীবন্ত ছিল অন্ততপক্ষে আব্বাসি বিপ্লবের সময় পর্যন্ত, এবং তারপরেও। এই কারনেই, আল্লাহ জুলুম করতে পারেন, এমন ধারণা ইসলামের শুরুর দিকের ধর্মতাত্ত্বিকরা (যেমন কাদারি ও মুতাজিলারা) সম্পূর্ণ রূপে অস্বীকার করতো। উমাইয়া খলিফা আবদুল মালেক ইবনে মারওয়ান যখন নিজের জুলুমকে আল্লাহর ইচ্ছা বলে প্রচার করেছিলেন, তখন দরবেশ হাসান আল বসরী ঘোষণা দিয়েছিলেন – আল্লাহর দুশমন মিথ্যা কথা বলছে।
![](https://rashtrochinta.net/wp-content/uploads/2020/11/125205593_10157946213291317_3373823287368849416_n.jpg)
যে আল্লাহ্ কোনভাবেই অবিচার করেন না, যিনি নিজের জন্যে জুলুম নিষিদ্ধ করেছেন, যেই আল্লাহর ধারণা অবশ্য পরবর্তিতে প্রান্তিক হয়ে গেছে। সুন্নিদের মধ্যে পরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে আশারি ধর্মতত্ত্ব এবং এমনকি ধর্মতত্ত্বেরই বিরোধিতা, যে ধরণের ঐতিহ্যে এমন আল্লাহর ধারণাকে সীমাবদ্ধ মনে করা হতো। মানব জাতির একটা ট্রাজেডি হলো যে প্রাচীনকালের সব বৈপ্লবিক ধর্মীয় ঐতিহ্যই রাজ্য বা সাম্রাজ্য বিস্তার ও টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হয়ে ওঠার পর তার মধ্যকার বিপ্লবী শক্তিকেও নিঃশেষ করে ফেলা হয়েছে, জন্ম দেয়া হয়েছে এমন বিভিন্ন ধরণের ধর্মতত্ত্ব যা জালিম শাসকদের বৈধতা দিতে পারে। আর এসবের পাহারাদার হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে পুরোহিত শ্রেণী। একটা বিপ্লবী ঐতিহ্যকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলার জন্যে শাসক শ্রেণী ও পুরোহিতরা সাধারণত নানানরকম পবিত্রতা-অপবিত্রতার ধারণাকে ঐ ঐতিহ্যের কেন্দ্রীয় ও প্রধান বিষয় করে তোলে। পবিত্রতা আরোপ করার পর নিজেদের দাবি করে সেই পবিত্রতার খাদেম ও রক্ষক হিসাবে। যার ফলে জনসাধারণের পক্ষে আর স্বাধীনভাবে ঐ ঐতিহ্যে প্রবেশ ও তার ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এরফলে প্রচন্ড বিপ্লবী ঐতিহ্যও পরিণত হয়ে যেতে পারে অর্থহীন কিছু আচার অনুষ্ঠানে। ইসলামের ইতিহাসেও একি ঘটনা ঘটেছে। ফলে জালিম-বনাম মজলুমের ডিকোটমি ইসলামের কেন্দ্র থেকে চলে গিয়েছিল প্রান্তে, হারিয়ে ফেলেছিল এর বৈপ্লবিক সম্ভাবনা। পবিত্রতার নেকাবে ঢাকা, পুরোহিতদের পাহারায় থাকা বিপ্লবী পরিভাষা অর্থহীন। মওলানা ভাসানী জালিম-মজলুমের ডিকোটমিকে এই অর্থহীনতা থেকে রক্ষা করেছেন। আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। সেইসাথে তিনি এই ডিকোটমি ব্যবহারের মাধ্যমে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর ইতিহাস চেতনাকেও মুক্ত করেছেন সোভিয়েতপন্থী পুরোহিতদের হাত থেকে, তুলে দিয়েছেন বাংলাদেশের জনগণের হাতে। তিনি যথার্থই হাসান আল বসরি, আমর ইবনে ওবায়েদ ও ওয়াসিল ইবনে আতার উত্তরসূরী।
![](https://rashtrochinta.net/wp-content/uploads/2020/11/maolana_bhasani_deshrupantor.jpg)
জর্জো আগামবেনের পরিভাষা যদি ব্যবহার করি, তবে ভাসানীর এই কাজ একধরণের প্রফেনেশন। আগামবেন এই ধারণাটি গড়ে তুলেছেন ওয়াল্টার বেনিয়ামিনের কাজ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। ভাসানীর মতোই বেনিয়ামিনের লেখালেখির মধ্যেও মার্ক্সবাদ ও ইব্রাহিমি ঐতিহ্যের মিশেল উল্লেখ করার মতো। অনেকেই এই কারনে বেনিয়ামিনকে আধ্যাত্ম্যবাদী মার্ক্সিস্ট বলে মনে করেন। কিন্তু আগামবেন আমাদের বলছেন যে বেনিয়ামিন যা করেছেন তাহলো প্রফেনেশন। কী জিনিস এই প্রফেনেশন? যা একসময় স্যাক্রেড ছিল, যা একসময় ছিল শাসক শ্রেণী ও পুরোহিতদের দখলে, তাকে মুক্ত করে জনগণের অধিকারে ফেরত আনাই প্রফেনেশন। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাসানী নিঃসন্দেহে একজন সফল প্রফেশনেশনকারী চরিত্র, তার ব্যবহার করা জালিম-মজলুমের ডিকোটমির বর্তমান জনপ্রিয়তাই তার প্রমাণ। কিন্তু ভাসানীর কাছ থেকে আমাদের নেয়ার আছে আরো অনেক কিছুই। ভাসানীতো তিনি, যিনি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন প্রবল সম্ভাবনাময় রুবুবিয়াতের রাজনৈতিক দর্শন, আজকের দুনিয়ায় যার গুরুত্ব বেড়েছে, কমে নাই। শাসনবাদের বিপরীতে পালনবাদের চর্চার যে ঐতিহ্য তিনি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন, এখন সময় এসেছে তা জনপ্রিয় করে তোলার। শাসনবাদতো আইন আর শাসনের ভেদ করেনা, আইনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় শুদ্ধ শাসন বা জুলুম। পালনবাদ অন্যদিকে শুধু মানুষ না, বরং সকল জীব এবং জরবস্তুর পরিচর্যার, এবং সকল সত্তার জন্যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মতবাদ। সাত শতকের মজলুম জননেতা ইমাম আলী একদা বলেছিলেন যে তিনি হাশরের ময়দানে আল্লাহ্ ও তার নবীর সামনে একজন জালেম হিসাবে হাজির হতে চান না, এবং তাকে যদি পুরা দুনিয়ার শাসনভারও তুলে দেয়া হয় তাহলেও এমনকি একটা পিপড়ার অধিকারে থাকা শষ্য দানাও তিনি কেড়ে নেবেন না। আমাদের মজলুম জননেতা ভাসানী পালনবাদ ও জুলুম বিরোধিতার সেই ঐতিহ্যই আমাদের জন্যে জীবন্ত করে দিয়ে গেছেন।
![](https://rashtrochinta.net/wp-content/uploads/2020/11/11029510_435726906588763_3951697562382909330_n.jpg)
ভাসানী কেন সত্তরের নির্বাচনে অংশ নেন নাই, নিলে কী হইত, তা নিয়ে অনেক তর্ক আছে। আমি ঐ তর্কে ঢুকবোনা। তবে শুধু বলতে চাই যে, সবাই যখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত, তিনি তখন এই বাঙলায় দেখেছিলেন, তার ভাষায় – এক মহাপ্রলয়। পল ক্লির আঁকা ছবি এঞ্জেলাস নোভাস, বেনিয়ামিন যার নাম দিয়েছিলেন ইতিহাসের ফেরেশতা, যিনি মানব জাতির ইতিহাসকে এক অবিচ্ছিন্ন মহাপ্রলয় হিসাবে দেখেন, সেই ফেরেশতার দৃষ্টিভঙ্গীতেই যেনবা ভাসানী তাকিয়েছিলেন বাঙলার জনগণের ইতিহাস ও অস্তিত্বের দিকে। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় পার্শচরিত্রে পরিণত হয়ে গিয়েও তিনি মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন করতে দ্বিধা করেন নাই, কারন তা ছিল জালিম বনাম মজলুমের লড়াই। আজকে আমাদের জন্যে সৌভাগ্য যে তিনি ক্ষমতা পান নাই, তাই শেখ মুজিবের মতো জালিমদের নেতাতে পরিণত হওয়ার ভাগ্যও বরণ করেন নাই। আলীর মতো থেকে গেছেন মজলুম জননেতা, আজ অবধি।
আমরা মুক্তিযুদ্ধে জিতেছি, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু মহাপ্রলয়তো শেষ হয় নাই। ভাসানীও তাই আমাদের জন্যে জীবন্ত হয়ে উঠলেন।
- পারভেজ আলম: লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী