বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের মিথ: প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র, রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন ও গুণ্ডাতন্ত্র

ব্যাকগ্রাউণ্ডের ছবি নেয়া হয়েছে কার্টুন মুভমেন্ট থেকে। ছবির নাম ‘কাইট’। শিল্পী: নৌরি জাফরি।
  • লেখক: খোইরোম রুধির

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন এক মিথ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাষ্ট্র-সরকার তাদের শুঁড় শুরু থেকেই ঢুকিয়ে রেখেছে, নতুন করে ঢুকানোর দরকার নেই। আপাতদৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সর্বোচ্চ উপরওয়ালা’ বলে আমরা যাকে জ্ঞান করি সেই উপাচার্যের উপর আরেক ‘উপরওয়ালা’ আছেন যাকে আমরা ‘আচার্য’ বলে সম্বোধন করি। এই আচার্যের পদে যিনি আসীন তিনি হচ্ছেন আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান/রাষ্ট্রপতি। আবার যে রাষ্ট্রপ্রধানকে আমরা রাষ্ট্রের ‘সর্বোচ্চ উপরওয়ালা’ হিসেবে জ্ঞান করি উনিও সাংবিধানিক মারপ্যাঁচে সরকারপ্রধানের অধীন। মানে আপাতদৃষ্টিতে যাকে আমরা রাষ্ট্রের ‘সর্বোচ্চ উপরওয়ালা’ বলে জ্ঞান করি তার উপরও আরেক ‘সর্বশক্তিমান উপরওয়ালা’ আছেন। আর উনি হচ্ছেন আমাদের সরকারপ্রধান/প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যে রাষ্ট্র-সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা আছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। বর্তমান বাস্তবতায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক প্রকার সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ ধারণ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য যেসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছে সেই আইনের হাত ধরেই ‘স্বায়ত্তশাসিত’ থেকে ‘সরকারি’ তকমা জুটেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কপালে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান করার বিপদ আছে। জনগণের টাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয় চলে তাকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তকমা দেয়া একদিক থেকে জনগণের হকের সাথে বেঈমানি, অন্যদিকে সরকারের অন্যায্য কর্তৃত্বের বৈধতা প্রদান ।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালগুলোতে যে প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র প্রকট আকার ধারণ করেছে এর গোড়া কোথায়? এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য প্রণীত আইনগুলোর দিকে চোখ বুলালে। স্বায়ত্তশাসনের কথা উঠলেই যে ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের কথা উঠে সেই অধ্যাদেশও প্রকৃতপক্ষে স্বায়ত্তশাসনের কোনো ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি। বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একটি হায়ারার্কিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। আরিফ রেজা মাহমুদ এই অধ্যাদেশের তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন, সেগুলো হচ্ছে-

ক) আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ।

খ) বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে উপাচার্যের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এবং প্রশাসনিক কাঠামোতে কর্তৃত্ব-ক্রমতন্ত্র।

গ) সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় কাঠামোগতভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসনের জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রের অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। সাম্প্রতিককালে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুশেমুরবিপ্রবি) ঘটনাগুলি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?’ এই প্রশ্ন করার জন্য জিনিয়া নামে এক শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করা হয়। ঠিক তার কয়েকদিন আগে ইইই বিভাগের একটি কক্ষের পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত ফেইসবুক পোস্টের জন্য ইইই বিভাগের ৬ জন শিক্ষার্থীকে বহিস্কার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিংবা তার মদতপুষ্ট কারো বিপক্ষে কথা বললে কী পরিণতির শিকার হতে হয় তার নমুনা এই ঘটনাগুলো। আর এই ক্ষমতা কাঠামোর কেন্দ্রে বসে আছেন রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য।

রাষ্ট্র-সরকার তার দমনমূলক হাতিয়ারের সাহয্যে রাষ্ট্রীয় পরিসরে যে ভায়োলেন্স জারি রেখেছে তা সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের (এবং অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের) হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে প্রবেশ করেছে। এই ভায়োলেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য বিস্তার ও দখলবাজি কায়েম করার হাতিয়ার। নিজেদের একছত্র আধিপত্য বিস্তার ও দখলবাজি কায়েম করার স্বার্থে ছাত্র সংগঠনগুলো গুণ্ডাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের এই গুণ্ডাতন্ত্রের পাহাড়াদার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মদতেই তারা তাদের গুণ্ডাতন্ত্রের মহড়া দিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়া প্রশাসনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেও দেখা যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানকে উল্টো খবরদারি করে। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, টর্চার সেল ইত্যাদি নতুন কোনো ঘটনা নয়। এগুলো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে ছাত্র সংগঠনের নামটা পরিবর্তন হয়ে যায় মাত্র কিন্তু বাকিসব একই থাকে। যেমন ধরুন, সম্প্রতি আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে ছাত্রলীগের যে শত শত টর্চার সেলের হদিস সংবাদমাধ্যমগুলো তুলে ধরেছে তা নতুন কিছু নয়। হলগুলোতে অবস্থিত টর্চার সেলগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল, এটা ওপেন সিক্রেট। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগের এইসব কীর্তিকলাপ সম্পর্কে খুব ভালো করেই জানে। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো এর দায় এড়াতে পারে না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান করুণ দশার প্রধানতম কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের উপর রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন। এই রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন বাস্তবায়িত হয় প্রধানত দুইভাবে: প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র ও গুণ্ডাতন্ত্র। প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়কে এই অবস্থায় রাখা যাবে না এটা রাষ্ট্র ভাল করেই বোঝে। গুণ্ডাতন্ত্র ছাড়া প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র, রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ বাস্তবায়ন করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি ছাত্র সংগঠনের গুণ্ডাতন্ত্রটাই দৃশ্যমান; অথচ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে স্বৈরাচারী আমলাতন্ত্র তথা প্রশাসন আছে সেটার ফাংশনালিটিও দেখতে পারা দরকার। অর্থাৎ, আমরা বলতে পারি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা-সৃজনশীলতা সমেত মুক্ত স্বায়ত্তশাসিত পরিস্থিতি বিরাজ না করুক এটাই চলমান রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের উদ্দেশ্য। প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র ও গুণ্ডাতন্ত্র এই আগ্রাসী পরিস্থিতি টিকিয়ে রাখার মোক্ষম অস্ত্র।

যে দল ক্ষমতায় আসে সে দলের অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-কর্মকর্তারা প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারাও সবসময় সজাগ থাকেন তথাকথিত ‘সরকারবিরোধী’ কিংবা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ কিংবা ‘বিশ্ববিদ্যালয়বিরোধী’ কিংবা ‘উন্নয়নবিরোধী’ কর্মকাণ্ড দমনের। সুতরাং সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন যখন ‘জামাত-শিবির’, ‘সরকার বিরোধী’, ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে বিরুদ্ধ মত দমন করে তখন প্রশাসনগুলো কোনো দোষ খুঁজে পান না। বরং এইসব বিরুদ্ধ মত দমনের ক্ষেত্রে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোকে পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে থাকে। গত মে মাসে ধানের ন্যায্য মূল্য না পাবার প্রতিবাদে ধানের ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে  প্রতিবাদ জানিয়েছিল টাঙ্গাইলের এক কৃষক। সে ধারাবাহিকতায় সারা বাংলাদেশ জুড়েই প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। বুশেরবিপ্রবির শিক্ষার্থীরাও সেই প্রতিবাদে শামিল হয়েছিল। কিন্তু বুশেরবিপ্রবি প্রশাসন ‘সরকার ও প্রশাসন বিরোধী প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন বহন এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদানের’ অভিযোগে ১৪ জন শিক্ষার্থীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল। ‘কৃষকের করের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় চলে’, ‘কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার ব্যবস্থা করো’ এর মতো আপাদমস্তক সত্য ও নিরীহ স্লোগান দেয়া ও প্ল্যাকার্ড বহন করার জন্য যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের ‘সরকারবিরোধী’, ‘বিশ্ববিদ্যালয়বিরোধী’ তকমা দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় তারা যে বিশ্ববিদ্যালয়য়ে সরকারের এজেন্ট হিশেবে ভূমিকা পাল্পন করে এতে কোন সন্দেহ নাই। খেটে-খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের পক্ষে কথা বললেই যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ‘বিশ্ববিদ্যালয়-সরকার-রাষ্ট্র ইত্যাদি নানাবিধ ‘অনুভূতি’ আঘাতপ্রাপ্ত হয় সেই প্রশাসন যে কতটা অকৃতজ্ঞ ও নির্মম তার ব্যায়-ভার বহনকারীদের প্রতি তা স্পষ্ট। এটা শুধু বুশেমুরবিপ্রবি প্রশাসনের চিত্র নয় বরং বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চিত্র। এটা শুধুমাত্র উপাচার্য নাসিরের স্বৈরতন্ত্রের নমুনা নয় অল্পবিস্তর সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের স্বৈরতন্ত্রের নমুনা। বছরদুয়েক আগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা বিষয়ক এক সেমিনার আয়োজনের অনুমতি চাইতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক প্রকার হুমকি দিয়ে আয়োজক শিক্ষার্থীদের জানিয়ে দিয়েছিল ,সেমিনারে ‘সরকারবিরোধী’ কোন আলোচনা হলে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাদের হাতে শিক্ষার্থীদের তুলে দেয়া হবে ।

জাবির দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যথার্থই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরাচারী ক্ষমতার সর্বোচ্চ চূড়া উপাচার্যকে ‘স্বৈরাচার্য’ বলে অভিহিত করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র কায়েমের জন্য প্রধানত প্রয়োজন হয় ভিন্নমত দমনের। ‘বিশ্ববিদ্যালয় সবসময়ই একটি সামষ্টিক বিষয়। ফলে কাঠামোগতভাবেই স্বার্থের ঐক্য এবং একই সঙ্গে ভিন্নমতের চর্চা এখানে খুবই স্বাভাবিক বিষয়। ভিন্নমত চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতারই প্রতীক। কিন্তু এই স্বাধীনতাবোধ প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে  বসতে পারে। ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু এই ভিন্নমতের চর্চা দমন হয় কি করে? দাপুটে ক্ষমতার মাৎস্যন্যায় নীতির ধারক-বাহক ছাত্র সংগঠনগুলোর দ্বারা’। কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের হাতুড়ি-হেলমেট বাহিনীর ভূমিকার কথা আমরা জানি। ঢাবির নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময়ও ছাত্রলীগের নৃশংস হামলার শিকার হয়েছিল আন্দোলনকারীরা। ভিন্নমত দমনের বেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন-ছাত্রলীগ যে হাতে হাত মেলায় তারও অসংখ্য উদাহরণ আছে। ঢাবির ডাকসু নির্বাচনের সময় ছাত্রলীগকে জেতানোর জন্য ঢাবি প্রশাসনের নির্লজ্জ ভূমিকা সম্পর্কেও সবাই অবগত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে সমঝোতা করে চলে। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বরাদ্দ বাজেট থেকে  ক্ষমতাসীন ছাত্র নেতাদের উপঢৌকন দেয়ার নজিরও আছে। সম্প্রতি জাবির উপাচার্য কর্তৃক ছাত্রলীগের নেতাদের দুই কোটি টাকা ‘ঈদ সেলামি’ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এই ভাগ-বাটোয়ারা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের টেন্ডারবাজিও নতুন কোনো ঘটনা নয়।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্রলীগের যৌথ উদ্যোগে আন্দোলন দমন করার নজিরও আছে। শাবিপ্রবির যে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কর্মীরা তখন আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তাদেরকে ডেকে সংগঠন বন্ধ করে দেয়ার হুমকি-ধামকিও দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য আইন জারি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু যে প্রক্টরিয়াল বডি নিরাপত্তার কথা বলছে তাদের গাড়িতে করেই নিপীড়কদের আসা-যাওয়া করার নজির আছে।

ভিন্নমত চর্চার স্বাধীনতা না থাকলে এবং ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের গুণ্ডাতন্ত্র কায়েম হলে কী পরিণতি হয় তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত বুয়েটের আবরার হত্যাকাণ্ড। কিন্তু এটি প্রথম কিংবা শেষ ঘটনা নয়। এর আগেও ঢাবির আবু বকর হত্যা, বুয়েটের সনি হত্যা ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে। আবরার হত্যায় অভিযুক্ত আসামী অমিত সাহা মন্তব্য করেছেন ‘উপরের অর্ডার আসলে তা মানা ছাড়া উপায় নাই’। এই অমিত সাহাদেরও ‘উপরওয়ালা’ আছে। সেই উপরওয়ালারা আবার অন্য উপরওয়ালাদের উপর নির্ভরশীল। পুরো সিস্টেমটাই ‘উপরওয়ালা নির্ভর’। কিন্তু সকল উপরওয়ালাই ‘সর্বশক্তিমান উপরওয়ালা’র অনুগত দাস। বিশ্ববিদ্যালয়  ও রাষ্ট্রের এইসব বড়-মেজো-ছোট ‘উপরঅয়ালারা’ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাঠামোগত সহিংসতা টিকিয়ে রেখেছে । উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকী বিদ্রোহ , স্বাধীন অস্তিত্ব ও মুক্ত পরিসর দমন করা ।

 এই ‘সর্বশক্তিমান উপরওয়ালা’র উপর আস্থা কিংবা বিশ্বাস হারানো কিংবা তার মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করা কিংবা তার বিরোধীতা করা ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ এবং সেজন্য সেই ‘অপরাধী’কে পিটিয়ে মেরা ফেলা, গুম করা, খুন করা, ক্রসফায়ারে দেয়া ইত্যাদি এই সিস্টেমে ‘জায়েজ’। সে কাজের জন্য সবসময় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দরকার হয়না। কেউ যদি ‘সর্বশক্তিমান উপরওয়ালা’র অনুগত দাস হয় এবং সে যদি মনে করে ‘সর্বশক্তিমান উপরওয়ালা’র শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা করার দায়িত্ব তার উপর বর্তায় তবে সে নিজেই এই শাস্তি প্রদান করতে পারে। সেজন্য তার (ব্যতিক্রম ছাড়া) কোনো জবাবদিহির দরকার পড়বে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক স্বৈরতন্ত্র ও গুণ্ডাতন্ত্র জারি থাকার মাশুল শুধু শিক্ষার্থীদেরই নয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরও দিতে হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইদুল ইসলামকে জেল-জরিমানার শিকার হতে হয়েছে সামান্য এক ফেইসবুক পোস্টের জন্য। চবির আর রাজী কিংবা ঢাবির রুশাদ ফরিদীকেও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্তের শিকার হতে হয়েছে। সম্প্রতি ঢাবির অধ্যাপক ফারুকের উদাহরণ টানা যেতে পারে। এই ঘটনা জানান দেয় যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বাধীন জ্ঞান চর্চারও অধিকার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই করুণ দশা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পরেও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচাতে হলে প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র , রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ও গুন্ডাতন্ত্র সমেত বিরাজমান কাঠামোগত সহিংসতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণপূর্বক মুক্তিপরায়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপকল্প হাজির করা সময়ের প্রয়োজন ।

দোহাই:
১) ‘প্রশাসনিক স্বৈরতান্ত্রিক’ – এই নামটা সেলিম রেজা নিউটনের একটা লেখা থেকে নেয়া হয়েছে। বিস্তারিত পাবেন: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্রের বিপজ্জনক পথ
২) রাষ্ট্রীয় বা সরকারী ‘শুঁড়’ – এটাও ধার করেছি সেলিম রেজা নিউটনের লেখা থেকে। বিস্তারিত পাবেন: আইনে শাসন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ

তথ্যসূত্র:

১) অভিনু কিবরিয়া ইসলাম স্বায়ত্তশাসিত’ থেকে ‘সরকারি’: বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় আইনগুলোর পশ্চাৎমুখী বিবর্তন’, বিডিনিউজ২৪.কম, ১৩ মে ২০১৯।

২) আরিফ রেজা মাহমুদ, ‘বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন অর্থায়ন। রাষ্ট্র-বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্ক পাঠ: মুক্তিপরায়ন রূপকল্প’, অরাজ

৩) প্রাগুক্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *