বাহাত্তরের সংবিধান দিয়ে কি নাগরিকের ভোটাধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব?

  • রাখাল রাহা

স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত যে সংবিধানের অধীনে দেশ পরিচালিত হচ্ছে তা মূলত বাহাত্তরের সংবিধান। রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ আইনী ডক্যুমেণ্ট হিসাবে প্রত্যেক নাগরিকের তার সংবিধান বুঝে নেওয়ার অধিকার ও প্রয়োজন রয়েছে। এই সংবিধানের আওতায় মানুষের ভোটাধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব কিনা, বা সম্ভব হলে তা কিভাবে—এই লেখায় তা আমরা দেখার-বোঝার চেষ্টা করবো।

১. নির্বাচন

প্রথমেই নির্বাচন প্রসঙ্গে আসা যাক। বাংলাদেশের সংবিধানের সপ্তম ভাগের শিরোনাম ‘নির্বাচন’। এই ভাগের ৯টি আর্টিকেল এবং প্রাসঙ্গিক অন্য ভাগের আর্টিকেল মিলিয়ে আমরা প্রথমে দেখার চেষ্টা করবো এর আওতায় একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব কিনা।
প্রথমেই দেখি:

১। “…রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন” [১১৮(১)]

খুব সুন্দর কথা। কিন্তু:

২। “…প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন;…” [৪৮ (৩)]

অর্থাৎ বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ ছাড়া রাষ্ট্রপতির এই কাজ করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু সংবিধানের বর্তমান রূপ অনুযায়ী:

৩। “…কেবল প্রধানমন্ত্রী ও …প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্টপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন,…” [৪৮ (৩)]

তাতেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতেই হচ্ছে। শুধু এটাই নয়, সেখানে নাগরিককে সতর্ক করা আছে এভাবে:

৪। “…প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।” [৪৮ (৩)]

সুতরাং নাগরিক হিসাবে আমাদের জানার সুযোগ নেই প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে কোন বিষয়ে কি পরামর্শ দিচ্ছেন।

বর্তমান ধরে নিলাম প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতি ফেয়ার ইলেকশনের জন্য নিজ উদ্যোগে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেন। তখন? এবার দেখি:

৫। “শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইতে পারিবে;…” [৫৩ (১)]

এর জন্য কি কি লাগবে দেখা যাক:

৬। “…সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষর…” [৫৩ (১)] + “…স্পীকার সংসদের অধিবেশন আহ্বান করিবেন এবং একটি চিকিৎসা-পর্ষদ গঠনের প্রস্তাব আহ্বান করিবেন…” [৫৩ (২)] + “…দশ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি যেন পর্ষদের নিকট পরীক্ষিত হইবার জন্য উপস্থিত হন।” [৫৩ (২)] + “…রাষ্ট্রপতি পর্ষদের দ্বারা পরীক্ষিত হইবার জন্য উপস্থিত না হইয়া থাকিলে প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়া যাইতে পারিবে…” [৫৩ (৫)]

এবং এই প্রস্তাব ভোটে পাশ হবে। কেন হবে? দেখা যাক:

৭। “কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি…সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে,…” [৭০]

সুতরাং সদস্যপদ হারানোর ঝুঁকি নিয়ে কেউ রাষ্ট্রপতিকে ভালো বলতে চাইবেন এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।

এবার নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা কতখানি দেখা যাক:

৮। “নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।” [১১৮ (৪)]

অর্থাৎ স্বাধীন, কিন্তু এই সংবিধান ও আইনের অধীন। কেমন অধীনতা দেখা যাক:

৯। “সংসদ কর্তৃক প্রণীত যে কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশনারদের কর্মের শর্তাবলী রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করিবেন সেইরূপ হইবে;” [(১১৮ (৫)]

সংসদে আইন কার ইচ্ছায় প্রণীত হবে এবং রাষ্ট্রপতি সকল আদেশ কার পরামর্শে দিবেন? আগেই আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রী। [৭০ এবং ৪৮ (৩)]। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছের বাইরে নির্বাচন কমিশনারদের যাওয়ার সুযোগ নেই।

এবং প্রধানমন্ত্রী কতক্ষণ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকবেন? দেখা যাক:

১০। “প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না।” [৫৭ (৩)]

আর সংসদ-সদস্যগণ কতক্ষণ সদস্য হিসাবে বহাল থাকবেন? দেখা যাক:

১১। “রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে;…” [৭২(৩)]

বর্তমান এই ব্যতিক্রমী রাতের ভোটের মাধ্যমে গঠিত সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল কবে? সম্ভবত ৩০শে জানুয়ারী ২০১৯। সুতরাং সেই নির্বাচনের প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ না দিলে এবং সংসদ না ভাঙলে সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৯শে জানুয়ারী ২০২৪ সাল পর্যন্ত বতর্মান সদস্যরা সংসদ-সদস্য। সুতরাং সে-সময় পর্যন্ত তারা আইন অনুযায়ী সকল সুবিধা ভোগের ও কর্তৃত্বের অধিকারী। আর এই সময়ের মধ্যেই যদি নির্বাচনের বিধান থাকে তাহলে তাদের এসব সুবিধা ও কর্তৃত্ব হাতছাড়া হচ্ছে না। দেখুন তার ব্যবস্থা:

১২। “সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে
(ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং
(খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে:
তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।” [১২৩(৩)]

তার মানে (ক) এবং “তবে শর্ত থাকে যে’ মিলিয়ে যেটা দাঁড়াচ্ছে তা হলো, সংসদ্ ভাঙার আগেই সংসদ-সদস্য থেকে সকল সুবিধা-ক্ষমতা-প্রটোকল নিয়েই তারা নির্বাচন করতে পারবেন। সুতরাং কোনোভাবেই দুটো-চারটে ওসি-ডিসি-এসপি এসব পরিবর্তন করে “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড” নামের সুশীল মাঠ আনা যাবে না।

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে রাষ্ট্রপতি, নির্বাচন কমিশন, সংসদ সকলই শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্বে। এখন এমন একক কর্তৃত্বের অধিকারী হয়েও তিনি যদি চান যে ফেয়ার ইলেকশন হোক, এবং তার দল হারলে হারুক, তো হওয়া সম্ভব, নইলে নয়।

সে-কারণে আমরা দেখি বাহাত্তর সালের পর থেকে এই সংবিধানের অধীনে নির্বাচন করে কোনো ক্ষমতাসীন দল আজ পর্যন্ত পরাজিত হয়নি, একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল ছাড়া। কারণ তখন নির্বাচন বিষয়ক এসব সাংবিধানিক বিধানকে আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছিল, যেটা উচ্চ আদালতের এক বিতর্কিত ও খণ্ডিত রায়ের মাধ্যমে ক’বছর আগে বাতিল করানো হয়েছে।

ধরে নিলাম সবাই মিলে চাপ দিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন আমরা গঠন করাতে সক্ষম হলাম এবং একটি ফেয়ার ইলেকশন হলো, তাতেই কি পরবর্তী সময়ে নাগরিকেরা তাদের ভোটাধিকার ফিরে পাবে? এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। নিশ্চয়তা যে নেই তার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ ১৯৯১ সালের নির্বাচন কমিশন। যে নির্বাচন কমিশন ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন করতে পেরেছিল, সেই নির্বাচন কমিশনই এক বছর পর বিএনপি সরকারের অধীনে মাগুরায় এমন একটা উপ-নির্বাচন করলো, সেটার নামই হয়ে গেল ‘নির্বাচন মাগুরা মডেল’।

বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা অংশ

২. ন্যায়বিচার

সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের শিরোনাম ‘বিচার বিভাগ’। এই ভাগের ৩টি চ্যাপ্টার রয়েছে। সেখান থেকে প্রথমেই দেখা যাক উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারকদের স্বাধীনতার বিষয়টি:

১। “…প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারক বিচারকার্যপালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।” [৯৪(৪)]

খুব সুন্দর কথা। কিন্তু এর শুরুতেই রয়েছে এক ফ্যাঁকড়া: “এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে” তাহারা স্বাধীন থাকিবেন। তো সংবিধানের বিধানাবলী কি?

২। “প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।” [৯৫(১)]

কিন্তু রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি হিসাবে কাহাকে নির্বাচন করিবেন? দেখা যাক:

৩। “…প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন;…” [৪৮(৩)]

এমনটাই ছিল বাহাত্তরের সংবিধানে। সুতরাং কি দাঁড়ালো? রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন এবং প্রধান বিচারপতির সাথে পরামর্শ করে তিনি অন্যান্য বিচারক নিয়োগ করবেন। আর এই সকল কাজ তিনি করবেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে এবং যে পরামর্শ বিষয়ে জানার সুযোগ সাংবিধানিভাবেই বন্ধ করে দেওয়া আছে। সুতরাং স্পষ্ট যে প্রধানমন্ত্রীর গুডবুকে যদি কারো নাম না থাকে তার পক্ষে বিচারক বা প্রধান বিচারপতি হওয়া জিন্দেগীতে সম্ভব নয়।

এখনকার সংবিধানে কি করা হয়েছে? দেখা যাক:

৪। “…কেবল প্রধানমন্ত্রী ও …প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্টপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন,…” [৪৮ (৩)]

ধরা যাক প্রধানমন্ত্রী চান না, এমন একজনকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করলেন। তখন? আমরা আগেই দেখেছি:

৫। “শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইতে পারিবে;…” [৫৩ (১)]

সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন হয়ে তিনি নিশ্চিতভাবে পাগল হতে চাইবেন না। কারণ তাকে পাগল বা অসুস্থ বানানোর জন্য সেখানে সকল ব্যবস্থা করা আছে।

এরপরও ধরা যাক, বিচারক হওয়ার পর কেউ স্বাধীনভাবে কাজ করতে গেলেন এবং প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন হলেন। তখন? চমৎকার ব্যবস্থা আছে এক্ষেত্রে:

৬। “…সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোন বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।” [৯৬(২)]

তার মানে যে কোনো বিচারককে প্রধানমন্ত্রী অপসারণ করতে পারেন যদি সংসদে দুই-তৃতীংয়াশ আসন থাকে এবং রাষ্ট্রপতি আদেশ দেন।

এই সংসদে ক্ষমতাসীন দলের দুই-তৃতীয়াংশ আসন রয়েছে এবং বিগত দুই সংসদেও ক্ষমতাসীন দলের দুই-তৃতীয়াংশ আসন ছিল। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী চাইলেই যে কোনো বিচারককে অপসারণ করতে পারেন।
কিন্তু সংসদ-সদস্যরা কেন বিচারক অপসারণের প্রস্তাব সমর্থন করবে? কারণ আমরা আগেই দেখেছি:

৭। “কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি…সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে,…” [৭০]

সুতরাং হ্যাঁ জয়যুক্ত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু হ্যাঁ জয়যুক্ত হলেই রাষ্ট্রপতি কেন সেটা মানবেন? মানবেন, এর কারণও আমরা আগেই দেখেছি: “…রাষ্ট্রপতি তাঁহার সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন;…” [৪৮(৩)]

এ তো গেল রাষ্ট্রপতির বিষয়। কিন্তু এসব জেনেও যদি প্রধান বিচারপতি “বিচারকার্যপালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন” থাকেন? তাহলে কি হবে? সমস্যা নেই, সংবিধানে সব ব্যবস্থা আছে দেখা যাচ্ছে:

৮। “…কোন কারণে প্রধান বিচারপতি তাঁহার দায়িত্বপালনে অসমর্থ বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে…” [৯৭]

সুতরাং আর কিছু বলিবার প্রয়োজন নেই। বিচারপতি এস কে সিনহার কথা আমাদের সবার নিশ্চয়ই মনে আছে?

কিন্তু যদি ধরে নিই রাষ্ট্রপতির কাছে উহা “সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান” হইল না, তখন? তখন সেই একই ফরমুলা এখানেও প্রযোজ্য করা যাচ্ছে :

৯। “শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইতে পারিবে;…” [৫৩ (১)]

আর রাষ্ট্রপতির অপসারণের জন্য আমাদের সংবিধানে সম্পূর্ণ একটা আর্টিকেল রচনা করা হয়েছে, যার রয়েছে সাত-সাতটি উপধারা। বাংলাদেশের সংবিধানে আর কোনো আর্টিকেলের এতো সংখ্যক উপধারা আমরা খুঁজে পাইনি। দুনিয়ার আর কোনো সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে পাগল প্রমাণের জন্য এমন ব্যবস্থা আছে কিনা আমাদের জানা নাই।

এ তো গেল উচ্চআদালত। নিম্নআদালতের বিষয়টা দেখা যাক, সেখানে “বিচারবিভাগীয় পদে বা বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনকারী ম্যাজিস্ট্রেট পদে” [১১৫(১)] কিভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে আমরা দেখি:

১০। “জেলা বিচারকের ক্ষেত্রে সুপ্রীম কোর্টের সুপারিশক্রমে…রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন।” [১১৫(১)(ক)]

এবং

১১। “অন্য কোন ব্যক্তির ক্ষেত্রে উপযুক্ত সরকারী কর্ম কমিশন ও সুপ্রীম কোর্টের সহিত পরামর্শক্রমে…রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করিবেন।” [১১৫(১)(খ)]

এবং রয়েছে

১২। “বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচারবিভাগীয় দায়িত্বপালনে রত ম্যাজিষ্ট্রেটদের নিয়ন্ত্র (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতিদান ও ছুটিমঞ্জুরীসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রীম কোর্টের উপর ন্যস্ত থাকিবে।
সুতরাং রাষ্ট্রপতি এগুলো “প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন” [৪৮(৩)] এবং সুপ্রীম কোর্ট নিয়ন্ত্রণ করিবেন।

ধরা যাক, এতো কিছুর পরও কেউ মনে করলেন যে তিনি ন্যায়বিচার পেয়েছেন। কিন্তু তাতে লাভ নাও হতে পারে। কারণ সেই ন্যায়বিচার সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে এভাবে:

১২। “…যে কোন দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোন দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।” [৪৯]

এবং এগুলোও সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করবেন।[৪৮(৩)]

সেকারণেই আমরা দেখি ফাঁসির মঞ্চ থেকে অপরাধীর বেকসুর খালাস পেয়ে ফিরে আসতে বা বিদেশ গমন করতে। সুতরাং আমরা আবারো স্পষ্ট যে, সব নদী যেমন সাগরে মেশে, তেমনি এই সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের ক্ষমতার সকল ডালপালাও গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে মিশেছে। তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী নাগরিকের ন্যায়বিচার পাওয়া-না-পাওয়া নির্ভর করছে।

Judgment by the tyrannical authorities, Ahmed Rahma, Cartoon Movement

৩. প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহির ব্যবস্থা

সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে যিনি যখন বসবেন তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর যে পুরো নির্বাচন ও বিচারব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে তা আমরা উপরে দেখেছি। কিন্তু যদি তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছা থেকে রাষ্ট্রের বা সমাজের বা নাগরিকের বা প্রতিষ্ঠানের কোনো অনিষ্ট হয়? তখন কি হবে? তিনি কি এজন্য জবাবদিহি করবেন? তাকে কি অপসারণের কোনো সুযোগ আছে? তাকে কি রাষ্ট্রপতি বা প্রধান বিচারপতির মতো ‘পাগল’ বানিয়ে সরিয়ে দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা কি আছে সেখানে?

দেখা যাক সংবিধানের চতুর্থ ভাগ। এই ভাগের শিরোনাম নির্বাহী বিভাগ। এর দ্বিতীয় চ্যাপ্টারের শিরোনাম ‘প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা’। খুব ছোট্ট চ্যাপ্টার, মাত্র ৪টি আর্টিকেল। সেখানে কি আছে:

১। “প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাঁহার কর্তৃত্বে এই সংবিধান-অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হইবে।” [৫৫(২)]

কোনো ভানভনিতা নেই। এবং তিনি যা করবেন সকলই রাষ্ট্রপতির নামে প্রণীত হবে। আরো যা বলা আছে:

২। “রাষ্ট্রপতির নামে প্রণীত…কোন আদেশ বা চুক্তিপত্র যথাযথভাবে প্রণীত বা সম্পাদিত হয় নাই বলিয়া তাহার বৈধতা সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।” [৫৫(৫)]

শুধু তাই নয়, তাঁকে এই নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে যে:

৩। “প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী কর্তৃত্বে…চুক্তি বা দলিল প্রণয়ন বা সম্পাদন করিবার জন্য রাষ্ট্রপতি কিংবা অন্য কোন ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হইবেন না…।” [১৪৫(২)]

তাহলে কি প্রধানমন্ত্রীর কোনোই জবাবদিহিতার ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানে নেই? আছে। কি সেটা? দেখা যাক:

৪। “মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকিবেন।” [৫৫(৩)]

প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্বে যেহেতু মন্ত্রীসভা গঠিত হবে সুতরাং তিনিও সংসদের কাছে দায়ী থাকবেন। সংসদ চাইলে তাঁকে জবাবদিহিতার মুখে ফেলতে পারে। কিন্তু আসলেই কি পারে? সংসদ কার একক কর্তৃত্বে? আমরা আগেই দেখেছি ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর।

প্রধানমন্ত্রী তাহলে সরবে কিভাবে? ৩ ভাবে:

৫। “যদি (ক) তিনি কোন সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন; অথবা (খ) তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন। [৫৭(১)]

এবং

“সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারাইলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করিবেন…।” [৫৭(২)]

কিন্তু কোনো প্রধানমন্ত্রীকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন হারিয়ে পদত্যাগ করতে হবে না ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে। আর কেউ যদি দুই তৃতীয়াংশ আসন পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হন তবে এই সংবিধান দিয়ে তিনি যা-ইচ্ছে তা-ই করতে পারবেন। সুতরাং একবার কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারলে তার আর পাগল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

Power forever, Alex Falcó Chan, Cartoon Movement

৪. তাহলে করণীয় কি?

আমরা দেখলাম, বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী দেশ চলবে সংবিধান অনুযায়ী আর সংবিধান চলবে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী। এবং শুধু নির্বাচন বা বিচারব্যবস্থা নয়, রাষ্ট্রের নাগরিকদের কথায় ভুলিয়ে আর আইনের প্যাঁচে ফেলে যতরকমভাবে অধীনস্ত করে রাখা যায় এবং একইসাথে প্রধান নির্বাহীকে সকল রকম জবাবদিহিতার উপরে তোলা যায়, এই সংবিধান তারই এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে।

এভাবেই স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পার হতে চলেছে। আজ এটাকে সংস্কার করা ছাড়া আমাদের মুক্তি নেই। কিন্তু এখনও ফেয়ার ইলেকশনের দাবী যারা করেন, তারা এটা এমনভাবে করেন যেন, এবারের মতো আমাদের কোনমতে ক্ষমতায় আসার পথ করে দাও, তাহলেই হবে। আমরা গিয়ে তোমাদের জন্য একেবারে স্বর্গের নহর বইয়ে দেবো!

বস্তুত ফেয়ার ইলেকশন দরকার, কিন্তু একটা ফেয়ার ইলেকশন কোনো সমাধান নয়। এই রাষ্ট্র আজ এমন অবস্থায় এসেছে যে, এর একব্যক্তিকেন্দ্রিক জবাবদিহিহীন ক্ষমতাকাঠামো সংস্কার না করে, এর নিপীড়নমূলক আইনকানুন সংস্কার না করে আর কোনো সমাধানেই মানুষের ন্যূনতম নিরাপত্তা ফিরে আসবে না। এটাই রাষ্ট্র সংস্কার। এর জন্য প্রয়োজন গণপরিষদ বা সংবিধানসভার নির্বাচন, যেমনটা ১৯৪৬ ও ১৯৭০ সালে এই ভূখণ্ডে হয়েছিল। তার জন্যই এই প্রজন্মের ভাষা নির্মিত হচ্ছে। ওরা তৈরী হচ্ছে। “আর ওদের দাবিয়ে রাখবার পারবা না!”

  • (রাখাল রাহা, লেখক-সম্পাদক; আহ্বায়ক, শিক্ষা ও শিশু রক্ষা আন্দোলন; সদস্য, রাষ্ট্রচিন্তা; sompadona@gmail.com)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *