বাজেট নিয়ে ‘অপ্রয়োজনীয় কথা’

  • আলী রীয়াজ

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের প্রস্তাবিত বাজেটের যতটুকু গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে তা্ পড়বার সময়টি আমার ভালো কেটেছে। খুঁটিনাটি পড়তে সময় লেগেছে, ফলে ভালো লাগার রেশও থেকেছে অনেকটা সময়। কেননা এই সব পড়তে পড়তে আমার মনেই হয়নি যে সারা বিশ্ব একশো বছরেও ঘটেনি এমন একটা জনস্বাস্থ্য সংকটে আছে, সেই সংকটে এখন নতুন আক্রান্তের হিসেবে বাংলাদেশ শীর্ষ দশে এসে পৌঁছেছে; স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এমন দশা হয়েছে যে নাগরিকরা সাধারণ চিকিৎসা পাচ্ছেননা, তাঁদের আহাজারি শোনা যাচ্ছে; কত জন প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন তার কোনো নির্ভরযোগ্য হিসেব নেই।

বাজেটের বর্ণনা পড়তে গিয়ে এ কথা প্রায় বিস্মৃত হয়েছিলাম যে, পৃথিবীতে একটা বড় মন্দার সূচনা হয়েছে এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যে একটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মানুষের জন্যে এমন ব্যবস্থা করা যা তাঁদের টিকিয়ে রাখতে পারে, বাঁচিয়ে রাখতে পারে। ষোল কোটি মানুষের দেশে যে দরিদ্রের সংখ্যা ছয় কোটিতে গিয়ে ঠেকেছে, কারো কারো হিসেবে দারিদ্র এখন ৩৫ শতাংশ। তাঁদের জন্যে সরকারের যে দায় আছে সেই সব মনেই হয়নি। মনে হচ্ছিল, এই বাজেট যেন ২০১৮ সালের, নিদেনপক্ষে ২০১৯ সালের। করোনাভাইরাস বলে কিছু আসলে নেই। কিংবা ‘করোনাভাইরাস দেশে আসবে না’।

গল্পের মত ঠাস বুননে যে সব কথা বলা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে – প্রবৃদ্ধি হচ্ছে মোক্ষ, নির্বাণ; সব কিছুর আরাধ্য হচ্ছে প্রবৃদ্ধি। কার জন্যে প্রবৃদ্ধি সেটা বড় কথা নয়। এমনও মনে হয়েছে আপনি যদি আটবার ‘প্রবৃদ্ধি’’ শব্দটা বলেন তবেই আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। পরিসংখ্যানের কারুকাজে আগে যেমন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছিলও, কিন্তু এখন যার অন্তসারশূন্যতা প্রকাশিত হয়েছে সেই প্রবৃদ্ধির দিকেই এই বাজেটের মুখ। আগামীতেও পরিসংখ্যানের কারুকাজে আমরা সেই সব শুনবো। কিন্তু এখন যে বাজেট – যা দেখে চারপাশের বাস্তবতা বোঝা ভার, সিনেমা হলের আড়াই ঘণ্টার আনন্দ দেয় যে বাজেট সেটির দিকে তাকানো যেতে পারে।

ধনীদের জন্যে বড় ধরণের ব্যবস্থা হয়েছে – আপনার যদি ‘কালো টাকা’ থাকে তবে আপনার টাকা ‘সাদা’ করতে বেগ পেতে হবেনা। টাকা আসলে কালো বা সাদা হয়না, এই নামকরণের বর্ণবাদী দিক বাদ দিন। অবৈধ টাকা বলুন, লুটের টাকা বলুন। সেই টাকা বৈধ করার উপায় তৈরি হয়েছে। আগেও ছিলো, এখন তার ব্যাপ্তি বেড়েছে; চাইলেই ধনীরা তাঁদের এই অর্থ বৈধ করতে পারবেন। অতীতে সেই সব সুবিধা কতজন নিয়েছেন সেটা একটি প্রশ্ন। আপনি যদি টাকা দেশের বাইরে পাচার করতে পারেন তবে কেন আর দেশে রাখবেন, তাও কর দিয়ে? আয়করের নতুন ধাপ ভিত্তিক যে ব্যবস্থা তাতে আপাতদৃষ্টে একেবারে নীচের দিকে যারা তাঁরা ছাড় পাবেন। কিন্তু সব মিলে কী দাঁড়াচ্ছে? সেই হিসেব দিয়েছেন সিপিডির গবেষক ফাহমিদা খাতুন, “যার মাসিক করযোগ্য আয় ২৫ হাজার টাকা, তিনি বছর শেষে ৫ হাজার টাকার একটি ছাড় পাবেন। মাসিক ৩৩ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা করযোগ্য আয়ে বছরে কর ১০ হাজার টাকার মতো ছাড় পাওয়া যাবে। উচ্চ বেতনধারী বা আয় করা করা মানুষের ক্ষেত্রে ছাড় আরও বেশি। সিপিডির হিসাব বলছে, নতুন কাঠামোয় ৫ লাখ টাকা মাসিক করযোগ্য আয়ে বছরে কর ছাড় মিলবে ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে ১০ লাখ টাকা আয়ে কর ছাড় ৩ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা। আর যিনি অতিধনী, যার মাসিক করযোগ্য আয় ৪ কোটি, তিনি বছর শেষে ছাড় পাবেন প্রায় ২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা” (প্রথম আলো, ১২ জুন ২০২০)।

জনস্বাস্থ্য এখন বড় সংকটে, কিন্তু বরাদ্দ বেড়েছে আগের বছরের চেয়ে মাত্র ১৩ দশমিক.৬৩ শতাংশ, জিডিপি’র হিসেবে কত ভাগ? মাত্র ১.৩%। মোট বরাদ্দ ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা; পরিচালন ব্যয়ে যাবে ১৬ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা৷ বাকিটা ব্যয় হবে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে৷ কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জরুরি চাহিদা মেটাতে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। থোক বরাদ্দের বিপদ অনেক। এগুলো শেষ পর্যন্ত কিভাবে ব্যয় হবে তা বলা মুশকিল। ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি মহামারির সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে।

ছবি কৃতজ্ঞতা: ডেইলি স্টার

সামাজিক সুরক্ষার জন্যে বরাদ্দ বেড়েছে, কিন্তু বিপদের যে মাত্রা তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা; প্রস্তাবিত বাজেটে তা দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। ১৩ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা। বাজেটের ১৬.৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩.০১ শতাংশ। অকস্মাৎ যখন এক ধাক্কায় ৬ কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছেন সেখানে জিডিপির ৩ শতাংশ যথেষ্ট? এই যে বরাদ্দ সেই সময়ে জানা যাচ্ছে যে সরকার ইতিমধ্যেই ত্রাণ তৎপরতা পঞ্চাশ ভাগ হ্রাস করেছে (বণিক বার্তা, ১২ জুন ২০২০)।

সামনে বিশ্বে খাদ্য সংকটের আশংকা করছে জাতিসংঘ। গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট হবে এমন আশংকা। সৌভাগ্য বাংলাদেশের কৃষি ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু এ যাবত নেয়া ব্যবস্থা ছোট এবং বর্গা চাষীদের সাহায্য করেছে এমন দাবি করা যাবেনা। কিন্তু কৃষি খাতে বরাদ্দ মাত্র ৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের শঙ্কা মনে করা দরকার, “যেসব দেশে প্রচুর খাদ্যশস্য আছে সেখানেও খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলা ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।”

প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ বেড়েছে কোথায়? জনপ্রশাসন খাতে। মোট বাজেটের ১৯ দশমিক ৯ ভাগ বরাদ্দ হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরেই তাই হয়, সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ হয় এই খাতে। এইবার যে ভিন্ন পরিস্থিতি তা বাজেট দেখে বলা মুশকিল। প্রশাসনে সাশ্রয়ের ব্যবস্থা নেয়ার কোনও উপায় ছিলো না? দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত প্রস্তাবিত বাজেটে ২৬ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে, এর একটা বড় অংশই যাবে ব্যক্তিখাতের ভর্তুকিতে। গত ১০ বছর ধরে তাই হচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন, ‘গত ১০ বছরে সরকার বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিয়েছে ৫২ হাজার ২৬০ কোটি টাকা।’ গত বছর ৭ ডিসেম্বর ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই বেসরকারি কোম্পানিগুলো গত ১০ বছরে উঠিয়ে নিয়েছে ৫১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা।

এই টাকা কোথা থেকে আসবে তা বাজেটে সরকারের ঋণ নেয়ার হিসেব দেখেলেই বুঝবেন। তাঁর সঙ্গে দেখুন রাজস্ব বাড়ানোর নির্ধারিত মাত্রা। এই সব অর্থ আসবে আপনার কাছ থেকেই। এই হচ্ছে বাজেট।

এই বাজেটে মোবাইল এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যয় বেড়েছে – কারণ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এই নিয়ে বাজেট-উত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেছেন, “বর্তমানে কথা বলার খরচ অনেক কম। তাই অপ্রয়োজনীয় কথা বলার প্রবণতা বেড়ে গেছে”। এখন বুঝতে পারছি অনেক ‘অপ্রয়োজনীয় কথা’ বলা হয়ে গেছে।


বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামালের প্রস্তাবিত বাজেটের যতটুকু গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত…

Posted by Ali Riaz on Friday, June 12, 2020
আলী রীয়াজ, ফেসবুক পোস্ট: ১২ জুন ২০২০
  • লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *