লেখক:হাসনাত কাইয়ূম
আলাপের পরিপ্রেক্ষিত
বাংলাদেশের রাষ্ট্রনৈতিক সংকট একটি নতুন স্তরে প্রবেশ করেছে – ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচন সবচেয়ে ভয়াবহ এই দুঃসংবাদটি বাংলাদেশকে দিয়েছে। সেই নির্বাচনের পর থেকে সংকট গভীরতর হচ্ছে। রাষ্ট্রের সকল সংস্থা, ডাকসাইটে ব্যুরোক্রাট, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, গ্রামের স্কুলের শিক্ষক কিংবা সরকার এবং সরকারীদলের সাথে যুক্ত সকল ধরণের প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি এবং মিডিয়াসহ সকলপ্রকার শক্তিকে যুক্ত করে নির্বাচন নামের যে ‘ভয়াবহ প্রহসন’টি ৩০ তারিখ দেশের মানুষের সামনে সম্পন্ন করা হয়েছিল এবং তার বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ঘটনা-পরম্পরা, তা এক কথায় ছিল নজিরবিহীন। বিশেষত ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং ভোটাধিকার সুরক্ষার জন্য সংবিধান সংশোধন করে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ প্রতিষ্ঠা এবং ভুল-ত্রুটিসমেত তিন মেয়াদে তার চর্চার পরবর্তী বাংলাদেশে এটা ছিল অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়।
এ নির্বাচন কোন উপায়ে হয়েছে বা কারা, কোন পথে, কাদের ভোট, কাদের বাক্সে তুলে দিয়েছে – এসব নিয়ে তেমন বিশ্লেষণ বা সংবাদ বাজারে আসার মতো অবস্থা না থাকলেও কিংবা ‘অধিক শোকে পাথর’-এর মতো গোটা দেশ নিস্তব্ধ হয়ে থাকলেও প্রকৃত সত্যটা দেশের সব মানুষেরই জানা হয়ে গেছে। তাই নির্বাচনের নামে কি ঘটেছে তা নতুন করে মানুষকে জানানোর অতোটা প্রয়োজন আর নেই। প্রয়োজন হলো, এদেশে, এ সময়ে, এমন একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান করা কেমন করে সম্ভব হলো তার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করা। আর সামগ্রিকভাবে এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার আর কোনো পথ আদৌ অবশিষ্ট আছে কিনা, বা থাকলে কেমন হতে পারে সে পথ, তার অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করা।
ধ্বংসের পথে হাঁটা যেখান থেকে শুরু
বাংলাদেশ আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে আসার একটি দীর্ঘ ইতিহাস ও পথপরিক্রমা আছে। এই পরিক্রমাটিকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখলে এর স্বরূপ নির্ণয় করা সম্ভব নয় সেটা করতে সামান্য একটু ইতিহাস আমাদেরও ঘাটতে হবে।
বর্তমান বাংলাদেশে যে ধরণের সরকার, আইন-আদালত, নির্বাচন, সংসদ, পুলিশ-মিলিটারি, অফিস-অফিসার-কর্মচারী, স্থানীয় সরকার, সংবিধান, রাষ্ট্র ও রাজনীতি জারি আছে অর্থাৎ এক কথায় যে রাষ্ট্রব্যবস্থাটি আমরা মোকাবিলা করি, ব্রিটিশরা এদেশে আসার পূর্বে এর রূপ এমন ছিল না। বিদ্যমান প্রায় সবকিছুর গোড়াপত্তন হয়েছে ব্রিটিশদের মাধ্যমে। আমরা জানি, ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের দুইটি পর্যায় আছে: একটি কোম্পানীর আমল (১৭৫৭-১৮৫৭), আর অন্যটি ব্রিটিশ সরকারের আমল (১৮৫৮- ১৯৪৭)। কোম্পানী যদিও শুরু করেছিল ব্যবসা দিয়ে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তারা বুঝতে পেরেছিল যে, এখানে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হলো খাজনা আদায়। আর খাজনা আদায়ের ব্যবসা করার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রক্ষমতা। ফলে তারা সম্রাটের কাছ থেকে প্রথমেই খাজনা আদায়ের ক্ষমতাটি নিজেদের হস্তগত করতে মনোযোগী হয় এবং এটা পাওয়ার পর ক্রমশ তারাই হয়ে উঠে এখানকার শাসক। কোম্পানীর শাসন আমলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, ভারতবর্ষ তখন শাসিত হয়েছে কোম্পানীর কর্মকর্তাদের দ্বারা। তার মানে কোম্পানী আমলে জনপ্রতিনিধিদের শাসনের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। কোম্পানী আমলের অনিয়ন্ত্রিত খাজনা আদায় এবং দুর্নীতির চাপে বিধ্বস্ত ভারতে ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ ঘটে এবং এরপর ব্রিটিশ সরকার ভারতের মতো বৃহৎ কলোনী হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে শাসনের দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেয়।
১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেণ্টে ‘ভারত শাসন আইন’ পাশ হয়। তারপর থেকে এদেশ শাসিত হয় ব্রিটিশ সরকারের নিয়োজিত কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই। এরই নানা পর্যায়ে তারা ধাপে ধাপে এখানকার স্থানীয়দের মধ্য থেকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করিয়ে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করার প্রক্রিয়া চালু করে এবং তা অব্যাহত রাখে।
এই সময়কালে ব্রিটিশদের ২টি আইন রাষ্ট্রগঠন ও পরিচালনায় নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমটা হচ্ছে, ভারত শাসন আইন, ১৮৫৮। এটা ছিল মূলত উপনিবেশিক ভারতের সংবিধান এবং যেটা সংশোধিত হতে হতে এর সর্বশেষ সংশোধন হয় ১৯৩৫ সালে। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে, ভারতীয় কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৮৬১। এটার ভিত্তিতে ধাপে ধাপে ভারতের আইনসভা বা পার্লামেন্ট গঠন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন, ভারতের আইনসভায় ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্তিকরণ, ভোটের ব্যবস্থা, নির্বাচনের ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দল গঠন, ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
কিন্তু আইনসভায় ভারতীয়দের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও জনপ্রতিনিধিরা নয়, ব্রিটিশ কর্মকর্তারাই এদেশ পরিচালনা করেছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল কর্মকর্তাদের প্রধান, গভর্নর জেনারেলের হাতেই। ব্রিটিশ আমলে এখানে কোনোদিনই কর্মকর্তারা জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হয়নি। বরং সীমিত জনপ্রতিনিধিত্ব যখন যতদূর পর্যন্ত এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা হয়েছে এই শাসকদের অনুমতি-সাপেক্ষে এবং তার চর্চা হয়েছে তাদের মনোনীত কর্মকর্তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেই। ফলে ভারতবর্ষের উপনিবেশিক-যুগের ক্ষমতাচর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা একব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকা আর জনপ্রতিনিধিদের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের অধীনস্থ থাকা। শোষণের মূল প্রক্রিয়া ছিল জনগণের কাছ থেকে খাজনার নামে সম্পদ সংগ্রহ করা এবং ‘রাষ্ট্র পরিচালনার আইন-কানুন’ ছিল এইসব সম্পদ নিজ দেশে নিরাপদে জবাবদিহিহীনভাবে নিয়ে যাওয়ার পথের যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করার ব্যবস্থামাত্র। বলাই বাহুল্য তাদের সৃষ্ট পুলিশ, মিলিটারী, আমলা-কামলা, শিক্ষক-বিচারক-বুদ্ধিজীবী, আইন-কানুন সব কিছু তৈরীই করা হয়েছিল তাদের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য।
এখানে একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, দখল করা আর উপনিবেশ বানানো এক নয়। ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল। দখলদারদেরকে দখলীকৃতরা ভেতর থেকে মেনে নেয় না, কিন্ত উপনিবেশের মানুষ ঔপনিবেশিক শক্তিকে মূলত উদ্ধারকারী বা ত্রাতা মনে করে। তাদের নীতি, নৈতিকতা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচি সকল কিছুকে উচ্চতর ও উন্নত মনে করে তাদের মতো হওয়ার চেষ্টা করে। নিজেদের ভালোমন্দের সাথে তাদের ভালোমন্দের তুলনামূলক বিশ্লেষণ না করে তারা মুগ্ধ গুণগ্রাহীতে পরিণত হয়। ব্রিটিশরা ভারতের ভেতরে এসে, ভেতরে থেকেই ভারতীয়দেরকে তাদের বশ্যতা মেনে নিতে প্ররোচিত ও বাধ্য করেছিল। ফলে এ দেশের রাজনীতিকরা তাদের অনুসরণ করতে গিয়ে রাজনীতিকে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা এবং রাষ্ট্রক্ষমতাকে সেই ব্যবসা নির্বিঘ্নে করার সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে বুঝেছে। এবং সেই সাথে দেশের সম্পদ বিদেশে পাঠানোকেই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করার সবচেয়ে কার্যকর পথ মনে করেছে।
ভারত শাসন দীর্ঘায়িত করার ক্ষেত্রে যে নীতিটি এখানে সবচেয়ে সফলভাবে তারা প্রয়োগ করছিল তা ‘ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি’ বা ‘বিভক্ত করো এবং শাসন করো’ হিসেবে সকলের কাছেই পরিচিত। ভারতীয়দের বিভক্ত করার অজস্র পথ-পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে বিস্তৃত, নিকৃষ্ট এবং হিংস্রটি ছিল এখানকার ধর্মীয় পার্থক্য ও বিরোধকে রাজনৈতিক বিরোধ এবং বিদ্বেষে উন্নীত করা। ধর্মে ধর্মে পার্থক্য এবং বিরোধ চিরাচরিত। এদেশের মানুষ সে পার্থক্য বজায় রেখেও কিভাবে একসাথে চলা যায়, সে চর্চায় অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী হিন্দু-মুসলিমের এই বিরোধকে হিংস্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে রূপান্তরিত করার জন্য রাষ্ট্র-পরিচালনার আইন-কানুন, তথা রাজনীতিতে এটাকে অতি ধূর্ততার সাথে প্রোথিত এবং ব্যবহার করেছিল। ভারতের রাজনীতিতে ব্রিটিশ ধারার নির্বাচন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, নির্বাচনকে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনে ভোটারের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে হিন্দু, মুসলমান, জাতপাত ইত্যাদি পরিচয়ে মানুষকে বিভক্ত করে ফেলার আইনী বিধানটি জারি করা হয়েছিল ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অ্যাক্ট, ১৮৬১ এর মাধ্যমে। ইহজাগতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক নিদান উত্তরণের ক্ষেত্রে তার পারলৌকিক বিশ্বাসের আকর যে ধর্ম, তাকেই করে তোলা হয় রাজনীতির বড় নিয়ামক। ফলে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিরোধ শক্তিশালী পদ্ধতি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন জাত-পাতের বিভক্তিতে অনেক আগে থেকেই ভুগছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর কার্ল মার্কস তার একটি ছোট্ট লেখায় হিসাব করে দেখিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতের ২০ কোটি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতো যে ২ লক্ষ সেনা তার মধ্যে মাত্র ৪০ হাজার ছিল ব্রিটিশ, ৬০ হাজার ছিল ভারতীয় উচ্চবর্ণের হিন্দু আর ১ লক্ষ ছিল নিম্নবর্গের ভারতীয়। অর্থাৎ একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে শাসন এবং লুণ্ঠন করেছে গুটিকয়েক বিদেশী, আমাদের জনসাধারণকে বিভক্ত করার কৌশলকে কাজে লাগিয়ে।
ব্রিটিশদের ভারত-শাসনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে, তাদের লক্ষ্য ছিল সম্পদ আহরণ এবং নিরাপদে নিজ দেশে প্রেরণ। এ কাজের সুবিধার্থে তারা রাষ্ট্র, সরকার, আইন, আদালত, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতি গড়ে তুলেছে। দীর্ঘদিন ধরে শাসন করার জন্য তারা এখানকার জনগণের এক অংশকে সুবিধাভোগী দালাল বানিয়েছে, অপর অংশকে দমন-পীড়ন করেছে। আর এ কাজ সহজে সুচারুরূপে চালানোর সুবিধার্থে জনগণকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করেছে, পরস্পরের প্রতিপক্ষ বানিয়ে এক অংশকে অপর অংশের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েছে। আর সেই সাথে অতি অল্পলোক দিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীকে শাসন করার মতো এককেন্দ্রীক ও ঊর্ধ্বমুখী শাসন কাঠামো বানিয়েছে।
দুই-দুই বার দেশ স্বাধীন করা হয়েছে, স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ার কথা ভাবাই হয়নি
গত ৭৫ বছরের মধ্যে এ দেশ দুইবার স্বাধীনতার জন্য লড়েছে এবং তা অর্জন করেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর দিকে যাত্রাই শুরু করতে পারেনি, বরং দিনকে-দিন আরো পেছনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। কেন আমরা যাত্রা শুরু করতে পারিনি তা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ অন্যত্র করা যাবে, তবে অতি সংক্ষেপে এখানে এইটুকু বলা যায়: আমরা অনেকেই স্বাধীন দেশ এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের মধ্যকার পার্থক্য নিরূপণ করতে পারিনি। অথবা আমরা ধরে নিয়েছিলাম দেশ স্বাধীন করার পর স্বাধীন রাষ্ট্র বানানোর ভার যাদের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে, তারা সে দায়িত্ব সুচারুরূপেই সম্পন্ন করবেন। স্বাধীন দেশের মানুষের উপযোগী রাষ্ট্র বানানোর প্রাথমিক কাজ যে স্বাধীন নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিত করার মতো একটি শাসনতন্ত্র বা সংবিধান বানানোর মধ্যে নিহিত, আমরা তা বিবেচনায় নিইনি। পাকিস্তান আমলে এ আলাপ যতটুকু-বা হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে এ আলাপ আর করা যায়নি। বরং যারা এ বিষয়ে সামান্য আলাপ তুলতে চেয়েছে তারা এদেশের পত্র-পত্রিকা-টেলিভিশনসহ অপরাপর মিডিয়া, এখানকার বুদ্ধিজীবী-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মী, লেখক-শিক্ষক-আইনজীবীসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক কর্মীদের প্রচারণার কাছে খড়কুটোর মতো উড়ে গেছে। স্বাধীন দেশের উপযোগী একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকাঠামো বা জনগণের অধীন রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় আলাপটাই এখানে শুরু করা যায়নি। এখানে সকলে ধরেই নিয়েছে যে, স্বাধীনতার সংগ্রামে বিজয়ী হয়ে দেশ স্বাধীন করার মাধ্যমেই রাষ্ট্র স্বাধীন করার কাজ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে! এখন প্রয়োজন শুধু স্বাধীন দেশের উপযোগী রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুশীলন করা!
স্বাধীন রাষ্ট্র বানানো যায়নি, তাই লুটপাট-পাচারও বন্ধ হয়নি
ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ থেকে কত সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে তার হিসাব আছে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের এ ভূখণ্ডের মানুষের সাথে কিরকম বৈষম্য করেছে, তার হিসাব আমাদের অর্থনীতিবিদগণ গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকেই জাতির সামনে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক সত্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিগত প্রায় ৫০ বছরে আমাদের দেশের কি পরিমাণ সম্পদ লুটপাট এবং পাচার হয়েছে এবং সেই লুটপাট-পাচারে কারা জড়িত, তার খুব সুস্পষ্ট হিসাব আমাদের কাছে এখনো নাই।
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত গবেষণা থেকে আমাদের তরুণ গবেষকদের কয়েকজন মিলে বিগত ১০ বছরে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন, পাচার ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্র ৭টি খাতের একটি হিসাব তুলে এনেছেন এবং তারা এই ক্ষয়ক্ষতিটা বাংলাদেশের ৮৪ হাজার গ্রামে ভাগ করে দেখিয়েছেন যে গ্রাম-প্রতি এই ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৩ কোটি টাকা। তারা হিসাব করে এটাও দেখিয়েছেন যে, প্রচলিত ব্যাংকঋণের সুবিধা পেলে এ টাকায় প্রতিটা গ্রামে বিনিয়োগ হতে পারতো প্রায় ১০০ কোটি টাকা!
অথচ আমাদের গ্রামের মেয়েরা মধ্যপ্রাচ্যে যায় ‘হাউজ এইড’ হিসেবে, ব্যবহৃত হয় যৌনদাসী হিসেবে, এবং প্রতিমাসে গড়ে তাদের তিনজনের লাশ আসে দেশে! আমাদের অসীম সাহসী ছেলেমেয়েরা গত ৪০টা বছর ধরে, নিজেদের জীবন-যৌবন-ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারা দুনিয়ার সীমান্ত পেরিয়ে ও এড়িয়ে, অজানা-অচেনা দেশের সকল আইনী-বেআইনী প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর কোনায় কোনায়, কেবল মা-বাবা-ভাই-বোন-স্ত্রী-পরিবারের ন্যূনতম স্বচ্ছল জীবনের আশায়! আমাদের কৃষক-ক্ষেতমজুরদের কিশোরী কন্যারা, আধ-পেটা খেয়ে না-খেয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৮-১৯ ঘণ্টা পরিশ্রম করে সারা দুনিয়ার মধ্যে গার্মেন্টস সেক্টরে বাংলাদেশকে ১ নম্বর অবস্থানে তুলে এনেছে কি বিপুল ত্যাগে! আমাদের কৃষকেরা কি অসম্ভবটাই না সম্ভব করে চলেছে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে! এই যে মানুষের বিপুল কর্মোদ্দীপনা, এই যে কিশোরীদের স্থির-নিষ্ঠা, এই যে কৃষকদের অসম্ভব সৃজনশীলতা, এরা সহ এ দেশের ব্যবসায়ী, উৎপাদক ও অমানুষিক পরিশ্রম করা মানুষেরা গত ৪৮ বছরে যে সম্পদ উৎপাদন আর অর্জন করেছে, তার সিংহভাগ যে লুণ্ঠন আর পাচার হয়ে যাচ্ছে, তা জানা সত্তেও এ লুণ্ঠন ও পাচারের বিষয়টা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো অন্যতম এজেন্ডা হতে পারেনি কেন? আমাদের কোটি কোটি যুবক-যুবতী বেকার থাকা সত্ত্বেও বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে এদেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করতে দিচ্ছি কেন? কিভাবে এবং কোন পথে এরা আমাদেরকে এসব মৌলিক বিষয় ভুলিয়ে রাখতে পারে? আমাদের রাজনীতিবিদরা, আমাদের বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, শিল্পী-সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, জজ-ব্যারিষ্টার, পত্রিকা-টেলিভিশন, সোশাল মিডিয়া, আমাদের দেশপ্রেমিক-প্রগতিশীল পণ্ডিতেরা কিসে আমাদের ব্যস্ত রাখেন? আমাদেরকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখতে পারার ক্ষেত্রে তাদের এ সফলতার পেছনের রহস্যটাই-বা কি? অথবা আমরা এমন একটি অন্ধকার ও হতাশাচ্ছন্ন অবস্থায় কিভাবে উপনীত হলাম?
এ প্রশ্নের একটু বিস্তৃত আলাপ যদি আমরা করতে চাই তাহলে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের রাজনীতিকে মূলত নিয়ন্ত্রণ করে, করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে, এমন কয়েকটি দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে।
প্রথমত, মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে বুঝতে হবে
আমাদের রাষ্ট্রনৈতিক সংকটকে বুঝতে হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা এবং উপধারাসমূহকে চিনতে হবে, এইসব ধারা-উপধারাসমূহের আন্তঃসম্পর্ক এবং বিভেদের কারণ ও রূপসমূহ আমাদের বুঝতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম ধারণা আছে তারাও জানেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা মোটাদাগে বেশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথমেই বলা যেতে পারে বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধা আর আওয়ামীপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের বিভক্তির কথা। সিরাজ শিকদারকে ব্যতিক্রম ধরলে, বামপন্থীরা নিজেরা আবার মোটাদাগে কমপক্ষে দুইভাগে বিভক্ত ছিল: রুশপন্থী ও চীনপন্থী। এদের মধ্যে প্রথম অংশ বিলম্বে হলেও ভারতের ট্রেনিংপ্রাপ্ত, আর দ্বিতীয় অংশ দেশের ভেতরেই ট্রেনিংপ্রাপ্ত ও স্বশিক্ষিত।
আওয়ামীপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা আবার মোটা দাগে আরো দুইভাগে বিভক্ত ছিল: একপক্ষ অর্থাৎ প্রধান অংশটি ছিল তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রবাসী সরকারের প্রতি আস্থাশীল, যুদ্ধকালীন রাজনৈতিক বিভেদ সম্পর্কে অতোটা ওয়াকিবহাল না, সাধারণ মানুষের সন্তান, অল্পশিক্ষিত এবং যাদের বেশীরভাগই আবার গ্রামের অক্ষরজ্ঞানবিহীন কৃষক-শ্রমিকের সন্তান। এরা মুক্তিবাহিনী হিসেবে পরিচিত।
আর একপক্ষ অপেক্ষাকৃত ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ, তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতা, নেতৃস্থানীয় কর্মীবৃন্দ, আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক বিরোধ সম্পর্কে সচেতন এবং তাজউদ্দিনের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল নয়, কিন্তু ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার প্রিয়ভাজন, অত্যাধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত এবং উন্নত ট্রেনিংপ্রাপ্ত, যারা নিজেদেরকে ‘মুজিব বাহিনী’ হিসেবে পরিচয় দিতে অধিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন এবং রণাঙ্গনের বাইরেই বিচরণ করতে পছন্দ করতেন।
এ কয়েকটি ভাগ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের অন্য একটি বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী আর-একভাবে ভাগ করা যায়: সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মুক্তিযোদ্ধা, যারা মূলত নিয়মিত বাহিনীর সদস্য এবং সাধারণ মুক্তিযোদ্ধা। সশস্ত্র বাহিনীর নিজেদের মধ্যেও ভাগাভাগি ছিল, কেউ কেউ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, কেউ কেউ এখানেই ছিলেন। তবে সবচেয়ে সাধারণ সত্যটা হলো, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ থাকলেও চীনপন্থী বামদের বাইরের পরস্পরবিরোধী সকল পক্ষকেই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছে ভারত।
মনে রাখতে হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মোটাদাগে এইসব বিভক্তি থাকলেও তাদের মধ্যে ঐক্যের দিকটাই ছিল প্রধান। আর সর্বজনস্বীকৃত সত্য হলো, সামান্য ব্যতিক্রম বাদ দিলে, প্রত্যেক পক্ষই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরঙ্কুশ নেতৃত্বের প্রশ্নে ছিল দৃঢ় আস্থাসম্পন্ন। যুদ্ধের সময় এদের নিজেদের মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট-বড়ো কিছু বিরোধের ঘটনা ঘটলেও আশা করা যাচ্ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে আসলে সেগুলোর সমাপ্তি ঘটবে। আশা ছিল দলমত নির্বিশেষে এদেশের সকল মানুষের আদরে, ভালোবাসায়, আরাধনা ও কান্নায়, রক্তে ও শ্রদ্ধায় গড়ে ওঠা নেতা হিসেবে তিনি দেশকে সকল বিভেদের, সকল সঙ্কীর্ণতার, সকল ক্ষুদ্রতার উর্ধ্বে একটি আলোকোজ্জ্বল সম্ভাবনার পথে নিয়ে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে তিনি ঐক্যের প্রতীক হয়ে ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধের পরে স্বাধীন দেশে তিনি সর্বজনের নেতার বদলে আওয়ামী লীগের একাংশের নেতায় রূপান্তরিত হয়ে গেলেন। ফলে যুদ্ধের কুশীলবদের নিজেদের মধ্যে যেসব বিরোধ ও ক্ষোভের ঘটনা ঘটেছিল তা প্রশমিত হওয়ার পথ না পেয়ে প্রথমে মারাত্মক হতাশা এবং পরে হিংস্র ক্রোধে পর্যবসিত হলো। ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এর প্রভাব এতো ভয়াবহ আর সুদূরপ্রসারী হয়েছে, যা থেকে আজ পর্যন্ত মুক্ত করা যায়নি এদেশের রাজনীতিকে।
দ্বিতীয়ত, সংবিধানের বৈপরীত্য এবং লুকিয়ে থাকা হিংস্রতার বীজমন্ত্রকে চিহ্নিত করতে পারতে হবে
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জিত হয়েছিল অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। কিন্তু তার চেয়ে দ্রুততায় সম্পন্ন হয়েছিল সংবিধান প্রণয়নের কাজ। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসেন ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী। যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রেসিডেন্সিয়াল কাঠামো বদলে প্রধানমন্ত্রী শাসিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয় এর পরদিনই ১১ই জানুয়ারীতে। ২৩শে মার্চে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব সদস্যপদ (খারিজ) আদেশ’ আইনটি জারী করা হয়। এই আইনটিতে মূলত বলা হয়, গণপ্রতিনিধিদের যারা যে-দলের মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদেরকে সে-দল যদি বহিষ্কার করে, তবে তিনি দল থেকে যেমন বহিষ্কৃত হবেন তেমনি তার গণপ্রতিনিধি পদও খারিজ হয়ে যাবে। আর এ আদেশের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো মামলা দায়ের করা যাবে না। ’৭২ এর সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের মাতৃ-আইন ছিল এটি। এই আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গণপ্রতিনিধিরাই ৭২ সালে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন।
এই আইনের মাধ্যমে গণপ্রতিনিধিদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত করার ব্যবস্থা গ্রহণের পর ১১ই এপ্রিল বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ৩৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি মাত্র ৬০ দিনের মাথায় ১০ই জুন একটি খসড়া সংবিধান গণপরিষদে আলোচনার জন্য পেশ করে। আর ১১ই অক্টোবরে খসড়াটি চূড়ান্ত হয়। নভেম্বরের ৪ তারিখেই সংবিধান বিল পাশ হয়। এরপর ১৪ই ডিসেম্বর গণপরিষদের সদস্যরা এতে স্বাক্ষর করেন এবং ১৬ই ডিসেম্বরকে সংবিধান প্রবর্তন দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যেই সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন ভারতের এবং ইংল্যান্ডের সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতামতও গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের সংবিধান বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান আছে এমন যে-কেউ জানেন যে, এই সংবিধানের প্রধান প্রধান কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের একটি হলো: সংবিধানে বর্ণিত ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ অংশ আর তা ‘বাস্তবায়ন’ অংশ পরস্পরবিরোধী। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার (প্রথম অধ্যায় থেকে তৃতীয় অধ্যায় পর্যন্ত) আর রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতাকাঠামো এবং শাসন-প্রণালী (৪র্থ অধ্যায় থেকে শেষ পর্যন্ত) একেবারে বিপরীতমূখী। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অংশে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ‘গণতন্ত্রে’র কথা ঘোষণা করা হলেও, ক্ষমতাবিন্যাস অংশে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে একব্যক্তির হাতে। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীকে স্থাপন করা হয়েছে সকল প্রকার জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে এবং সংবিধানকে করা হয়েছে তার ইচ্ছার অধীন। দ্বিতীয় বিষয় হলো, ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসকশ্রেণীর নিজেদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় বাংলাদেশের সংবিধানে সে পথটি রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যবস্থাটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে ক্ষমতাসীনদেরকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানো না যায়।
একদিকে জবাবদিহিতাহীন অপরিসীম অবাধ ক্ষমতা এবং অপরদিকে ক্ষমতাসীনদেরকে ক্ষমতা থেকে সরানোর বা রাষ্ট্রক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয়ার ফলে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের জন্য কোনো না কোনো প্রকারের বলপ্রয়োগ ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকেনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেসব অগণতান্ত্রিক বলপ্রয়োগ ও হিংস্র বর্বরতার ঘটনা ঘটেছে এবং বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির মূলধারা হিসেবে সন্ত্রাসের গ্রহণযোগ্যতা যেভাবে তৈরী হয়েছে তার মূলে রয়েছে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে অপসারণের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বাধাসম্বলিত এই নির্বাচনী ব্যবস্থাটি।
তৃতীয়ত, এই সংবিধানে রাষ্ট্র এবং সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্যরেখা নির্ধারণ করা হয়নি। এখানে রাষ্ট্র ও সরকারকে একাকার করে ফেলা হয়েছে এবং এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই সরকারীদল এবং রাষ্ট্রের মধ্যেও কোনো পার্থক্য থাকেনি। ফলে এখানে সরকারের এবং সরকারী দলের কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের কাছ থেকে নাগরিকদের প্রতিকার পাওয়ার পথও সাংবিধানিকভাবেই রুদ্ধ হয়ে গেছে।
সংবিধানের এই অবস্থা কি অজ্ঞতাপ্রসূত? দূরদৃষ্টির অভাবজনিত? নাকি পরিকল্পিত? তৎকালীন গণপরিষদ কি জেনে-বুঝেই এ ব্যবস্থাটি জারি করেছিল, নাকি এটি জারি হয়েছিল কারো অঙ্গুলি হেলনে? নাকি তোষামোদকারীরা সফল হয়েছিল ব্রিটিশ-পাকিস্তানী কলোনিয়াল ব্যবস্থার চাইতেও নিকৃষ্ট ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায়? এটা আমাদের নিজেদের আবিষ্কার, নাকি আমরা ভারতের আর ইংল্যান্ডের যে বন্ধুদের পরামর্শ নিয়েছিলাম তারা আমাদেরকে এটা গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা গেলে ভালো হতো। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, যারা এর প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিলেন তারা কখনোই এসব বিষয়ে মুখ খোলেননি। কিন্তু কেউ মুখ খুলুক বা না-খুলুক, এটি পরিকল্পিত হোক বা অজ্ঞতা বা অবিবেচনা প্রসূত হোক – যেভাবেই এই ক্ষমতাকাঠামো আরোপিত হয়ে থাক না কেন, বিগত প্রায় ৫০ বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝতে পারছি যে, এই বিষবৃক্ষ যে ভয়াবহ ফল দিয়ে যাচ্ছে সেই ফল তাদের স্বার্থেই যাচ্ছে, যারা আমাদের অনৈক্য ও অশান্তিতে লিপ্ত রাখতে পারলেই, বিভাজিত করতে পারলেই, এক অংশকে অপর অংশের নির্মূলে উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই লাভবান হয়।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশে বিভক্তির রাজনীতিকে চিহ্নিত করতে পারতে হবে
বাংলাদেশের গত প্রায় ৫০ বছরের যে রাজনীতি, তা আবর্তিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ এবং সংবিধানকে কেন্দ্র করেই। আর এই দুইটি হাতিয়ারকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের সম্পদ লুণ্ঠনকারী-পাচারকারী গোষ্ঠী এই রাষ্ট্র ও এখানকার রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি ৭২-৭৫ পর্ব:
১৯৭০-৭১-এ এই দেশের মানুষ যেভাবে যতোটা জমাট বেঁধেছিল, ঐক্য শব্দটা দিয়ে সেটাকে আসলে বোঝানো সম্ভব নয়। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ, অন্য কোনো দেশের মানুষ, রাজনৈতিক কোনো সিদ্ধান্তের প্রশ্নে এতোটা জমাটবদ্ধ হতে পারার কথা ভাবতেও পারেনা। ১৯৫২ সাল থেকে যার শুরু, ১৯৬৬ সাল থেকে যে ঐক্য দানা বাঁধতে বাঁধতে ৭০-৭১-এ এসে চূড়ান্ত রূপ নিলো, ৭১-৭২ সালেই তাতে ভাঙনের আওয়াজ শুরু হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের নীতিনির্ধারক ছিলেন, এমন লেখকদের লেখা থেকে বের হয়ে এসেছে, যে যোদ্ধাদের দৃশ্যত তৈরী করা হয়েছিল বামপন্থীদের মোকাবেলা করার লক্ষ্য নিয়ে ‘মুজিব বাহিনী’ নামে – সিআইএ এবং মোসাদের প্রণোদনায়, ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে, প্রবাসী সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রেখে – স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে তাদের নিজেদের মধ্যেই নেতৃত্বের প্রশ্নে বিরোধ দেখা দেয়। যদিও তাদের উভয় পক্ষেরই আনুগত্য ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি, কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করেন এক অংশকে এবং কাছে টেনে নেন সেই পক্ষটিকে, যেটির নেতৃত্বে ছিলেন তাঁরই এক নিকটাত্মীয়। এই বিরোধ শুধু ছাত্র রাজনীতির পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকলো না, অচিরেই বাংলাদেশে তাঁর নেতৃত্বকে চ্যালেজ্ঞ করে যে-তারুণ্য জাসদের নামে রাজনীতির মাঠে এসে উঠে দাঁড়ালো তারা সবই মুক্তিযোদ্ধা অথবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি।
বামপন্থীদের একাংশের সাথে আগে থেকেই চলে আসা বিরোধ, সাথে মুজিব বাহিনীর ঔরসজাত জাসদের তীব্র সরকার-বিরোধীতা, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে উপনিবেশিক কাঠামোর সাথে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার বিরোধ, মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করে পাকিস্তানী কাঠামোর আমলাতন্ত্র ও পুলিশ বাহিনীর হাতে দেশের নিয়ন্ত্রণভার তুলে দেওয়া, রক্ষীবাহিনী নামক প্যারামিলিটারী ধরণের সশস্ত্র রাজনৈতিক বাহিনী গঠন, বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে গঠিত বিভিন্ন প্রাইভেট বাহিনীর মাধ্যমে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর হিংস্র-নৃশংস-ভয়াবহ দমন-পীড়ন চালানো এবং দলের অভ্যন্তরে নেতৃত্বে থাকা সুবিধাবাদী, মুনাফাখোর, চোরাকারবারীদের একচেটিয়া লুটপাট, খুন, ধর্ষণ, পরিত্যক্ত ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের আত্মসাৎ ইত্যাদি মিলে দেশে এমন এক অরাজক অবস্থা তৈরী করে যা বর্ণনাতীত। একদিকে রাষ্ট্রীয় মদতে লুটপাট, মজুতদারি ও দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে সংঘটিত দুর্ভিক্ষে স্রেফ খাদ্যের অভাবে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া, অপরদিকে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি গ্রাস, দখল ও লুণ্ঠন করে সরকারী ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া নেতাদের সীমাহীন ভোগ ও বেপরোয়া জীবনযাপন জনগণের মধ্যে তীব্র হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়।
এরপর সংবিধান গ্রহণের অব্যবহিত পরেই ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য বিরোধী প্রার্থীদের গুম, খুন, প্রার্থী হতে বাধা দেওয়া, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসায় প্রতিবন্ধকতা তৈরী করা, কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স ছিনতাই এবং নিশ্চিত বিজয়ী প্রার্থীদের ব্যালটবাক্স এলাকা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা এবং ফলাফল পাল্টে দেওয়া ইত্যাদি নানা উপায়ে বিরোধী প্রার্থীদের পরাজিত করার মাধ্যমে সুস্থ ও প্রতিযোগিতামূলক গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়। জাতীয় রাজনীতির ধারাবাহিকতায় ডাকসু নির্বাচনেও ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে জাসদ-ছাত্রলীগের সম্ভাব্য বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়। সারা দেশে গোপন ও সশস্ত্র রাজনীতির বিস্তার ঘটে। হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী গুম-খুনের শিকার হয়, ভাগ্যবানেরা কারাবন্দী হয়ে বেঁচে যান। অবস্থা এমন হয় যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজাকারদের চেয়েও ক্ষমতাসীনদের প্রতি অধিকতর ঘৃণা তৈরী হয়। বিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতাকে গণতান্ত্রিকভাবে মোকাবিলায় অপারগতা, নিজ দলের সুবিধাবাদী লুণ্ঠনকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা, দুর্ভিক্ষে দেশের মানুষের খাদ্য সংকট মোকাবেলার ব্যর্থতা এবং মস্কোপন্থী বামদের পরামর্শে শেখ মুজিব তাঁর সারা জীবনের আদর্শের পরিপন্থী কমিউনিষ্টদের উপর ভর করে উদ্ধার পাওয়ার আশায় একদলীয় বাকশাল কায়েম করে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ভুলপথে যাত্রা করেন। এ পথ তাঁকে প্রকৃত কমিউনিষ্ট এবং প্রকৃত গণতন্ত্রী উভয় পক্ষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
তাঁর নিজ দলের একটি চরম সুবিধাবাদী ও ক্ষমতালোভী অংশের প্ররোচনায় একটি একব্যক্তিকেন্দ্রিক, একদলীয় শাসনতন্ত্রের কথিত সকল ক্ষমতার দায়ভার একা কাঁধে নিয়ে চরম নিঃসঙ্গ ট্র্যাজেডীর নায়ক বঙ্গবন্ধু যখন রাজনৈতিকভাবে প্রায় শূন্য, তখন তাঁর পরিবারের ২ জন ছাড়া বাকী সকল সদস্যসহ তিনি ইতিহাসের এক নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে বিদায় নেন।
৭৫ থেকে ৮২ সেনাবাহিনীর প্রথম পর্ব:
১৯৭৫-এর মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের পরে সরাসরি ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের সেই অংশটা, শেখ মুজিবের জীবিতকালে যারা তাঁর প্রকৃত মিত্রদের তাঁর কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরা মিত্র সেজে বসেছিল। কিন্তু ক্ষমতা অচিরেই তাদের হাত গলিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। ক্ষমতার মঞ্চে জিয়াউর রহমানের আরোহন এবং কর্ণেল তাহেরের ফাঁসির হাত ধরে এতোদিন রাজনীতির মাঠে যে গোপন ও সশস্ত্র রাজনীতির চর্চাটা হয়ে আসছিল সেটার পাকাপাকি স্থান হয় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে। সেনাবাহিনীর মধ্যে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এমন অংশের মধ্যে বিরোধ, ক্যু, পাল্টা ক্যু, বাহিনীর অভ্যন্তরে গোপন হত্যা, বিচার নামক প্রহসনের ভিতর দিয়ে বিরোধীপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করা – এইসবের মধ্য দিয়ে এমন একটি পরিস্থিতির জন্ম হয় যার হাত ধরে সেনাবাহিনীর এবং সেনা-রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ মুক্তিযোদ্ধাদের হাত গলিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ না-নেওয়া কিংবা ৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনীর দোসর হয়ে এদেশের মানুষের বিপক্ষে যুদ্ধ করা সৈনিকদের নেতা এরশাদের হাতে চলে যায়। জিয়াউর রহমান থেকে এরশাদের ক্ষমতা দখল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সেনাবাহিনীর ভিতরে প্রচণ্ড অস্থিরতা থাকলেও মাঠের রাজনীতিতে এক ধরণের স্বস্তি ফেরত আসে। জিয়াউর রহমান বহুদলীয় রাজনীতি চালু করার নামে আওয়ামী শাসনকালে নির্যাতিত হয়েছে এমন পক্ষসমূহকে টার্গেট করে তার কাছাকাছি টানার প্রক্রিয়া চালু করেন। রাজনীতিতে ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এর আগে যা ছিল রক্তাক্ত, প্রতিরোধের বা প্রতিবাদের, জিয়াউর রহমান সেখানে শঠতা, লোভ, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও দুর্নীতিকে প্রতিস্থাপন করেন আর তরুণদের চরিত্র নষ্ট করার প্রকল্প নিজ হাতে বাস্তবায়ন শুরু করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে জিয়াউর রহমানও একটি আপাত ব্যর্থ সামরিক ক্যুর নৃশংস শিকার হয়ে বিদায় নেন। বিদায় নেন জেনারেল মঞ্জুরও।
সেনাশাসনের বিরোধিতা:
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসানো হয় বিচারপতি সাত্তারকে এবং ক্ষমতায় বসানোর কয়েকদিনের মধ্যেই তার বিরুদ্ধে ব্যর্থতা, দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে দেশের শাসনক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সামরিক বাহিনীর প্রধান হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। এরশাদের ক্ষমতা দখল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আরোহণের মতো মসৃণ ছিল না। জিয়াউর রহমানের আপতকালীন ক্ষমতা দখল ও পরবর্তীতে তার রাজনৈতিক দল গঠন, রাজনীতিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে বিপর্যস্ত বামদের সম্মিলন ঘটানো ও নিজের ব্যক্তিগত আপাত সৎ ইমেজ গঠন এবং বিপরীতে সকল রাজনৈতিক নেতাদের পরিকল্পিতভাবে অসৎ, দালাল ও সুবিধাবাদী হিসাবে অধঃপতিত করার মাধ্যমে নিজেকে তাদের চেয়ে সেরা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা ও ছাত্র-তরুণদের নিজ হাতে নষ্টামীর পথে ঠেলে দেয়ার কারণে সামরিক শাসকদের রাজনৈতিক প্রবণতা সম্পর্কে যতটুকু ক্ষোভ তৈরী হয়েছিল তা সামরিক শাসক এরশাদকে তার অভিঘাতের মোকাবেলা করতে হয়। প্রথমেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের প্রতিবাদের মুখে পড়তে হয় তাকে। আর এর হাত ধরেই সারাদেশে সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা বিস্তৃত হতে থাকে। ছাত্র-শিক্ষক-সাংস্কৃতিককর্মী-পেশাজীবী আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবীটি ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার ফলে এরশাদের পক্ষে আর ক্ষমতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীও তার উপর থেকে সমর্থন তুলে নেয় এবং ১৯৯০সালের ৬ই ডিসেম্বর তার সরকারের পতন হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ও ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রসঙ্গ
এরশাদের পতনোত্তর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯১ সালের নির্বাচনই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে কম-বিতর্কিত নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপির সরকারের অধীনে উপনির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে আওয়ামীলীগ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলন শুরু করে এবং সংবিধান সংশোধন করিয়ে তা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকেও কিভাবে দলীয় বিচারপতিদের অধীনে আনা যায় তার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এবং শেষ পর্যায়ে ব্যবস্থাটির ত্রুটি-বিচ্যুতি সংশোধনের মাধ্যমে তাকে আরো কার্যকর করার বদলে উচ্চ-আদালতের একটি বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে ২০১১ সালে তা বাতিল করানো হয়। ফলে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম, জীবনদান, সংবিধান সংশোধন ও তিক্ত অভিজ্ঞতার বিনিময়ে অর্জিত নির্বাচন ব্যবস্থায় ন্যূনতম ভোটাধিকার প্রয়োগের যে সুযোগটি সৃষ্টি হয়েছিল তা স্থায়ীভাবে নষ্ট করে পুনরায় ৭২ সালের সংবিধানিক অবস্থাটি ফেরত আনা হয়, যেটা আসলে ক্ষমতাসীনদেরকে শান্তিপূর্ণ পথে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার একটি অসম্ভব প্রকল্প। ফলে দেশে শান্তিপূর্ণ পথে সরকার বদলের যে রাজনীতির সূচনা হয়েছিল ২০১১ সালে তার মৃত্যু ঘটে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিংবা নানাবিধ স্থানীয় সরকার নির্বাচন যে এইরকম নিষ্ঠুর প্রহসনে পরিণত হলো তার দায় নির্বাচন কমিশন কিংবা তাহাজ্জুতের নামাজের আগে ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে না-পারার বিষয় নয়, এর বীজমন্ত্র ৭২-এর সংবিধানের ১২৩(৩)-এর সাথে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর নিকট জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সাংবিধানিক আয়োজনের মধ্যে লুক্কায়িত।
সমস্যা, যতটুকু দেখা যায় তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি আরো গভীরে?
উপরে আলোচনায় কিছু দিক স্পষ্ট করা গেলেও সমস্যার এমন অনেকগুলো দিক রয়েছে যা স্পষ্ট নয়, এবং স্পষ্ট নয় বলেই স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরে এসেও আমরা আমাদের প্রকৃত সমস্যাকে চিহ্নিত করতে পারিনি এবং সমাধানের পথও খুঁজে পাইনি। উদাহরণ হিসেবে সংক্ষেপে কয়েকটা নমুনা দেয়া যেতে পারে:
(১) দেশ আর রাষ্ট্র যে এক নয়, এবং দেশ স্বাধীন করা আর স্বাধীন দেশের উপযোগী স্বাধীন মানুষের মর্যাদা রক্ষার জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন যে এক নয়, এটাই আজ পর্যন্ত অনেকের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। আর বিগত প্রায় অর্ধ-শতাব্দী ধরে ভৌগোলিকভাবে স্বাধীন একটি দেশের কাছ থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রের আচরণ না পেয়ে, তারা শুধু হতাশাই ব্যক্ত করে গেছেন, কিন্তু স্বাধীন দেশকে কিভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা যাবে তা নিয়ে আলাপই শুরু করা হয়নি।
(২) স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পর রাষ্ট্রগঠনের আলোচনা যাতে শুরু না করা যায়, সেজন্য একদম শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্যে বিভেদ, বিরোধ, অন্তর্কলহ, দ্বন্দ্ব, সংঘাত এবং এক অংশ দ্বারা অপর অংশকে নির্মূলে লিপ্ত করানো হয়। আর এ প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ ভয়াবহ ঘটনায় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এমন নৃশংস কায়দায় খুন করানো হয়। এই নৃশংস খুনের সবচাইতে বড় যে ক্ষতি তা হলো, এই ভয়াবহতার অভিঘাত থেকে, বিভক্তি থেকে, বাংলাদেশ কখন পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। মূলত দেশকে স্বাধীন করার লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে যে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব এখানে গড়ে উঠেছিল, তাদের প্রায় সবাইকে, কোনো না কোনোভাবে পরস্পরের হাতে নিহত হতে হয়েছে।
(৩) রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল বা সরকারের পালাবদলের যে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় থাকে, বাহাত্তরের সংবিধানের মাধ্যমে সে নির্বাচন-পদ্ধতিকে এইখানে সাংবিধানিকভাবে অকার্যকর করে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড জনিত রেষারেষি এবং রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের শান্তিপূর্ণ পথ সাংবিধানিকভাবে অকার্যকর রাখার ফলে এখানে সংঘাত বা সহিংসতা পরিচালনার সক্ষমতা আর রাজনৈতিক তৎপরতা সমার্থক হয়ে গেছে। যে দল বা গোষ্ঠী যতবেশী সন্ত্রাস-সহিংসতা করার ক্ষমতা রাখে রাজনৈতিকভাবে সে দলকেই ততটা শক্তিশালী আর সংগঠিত মনে করা হয়। আর রাজনীতি যখন সংঘাত-সহিংসতা বা হিংস্রতা ছড়ায় তখন শুধু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কিংবা ভালোকথা বা ভালো আহ্বান দিয়ে তাকে প্রতিহত করা যায় না। আবার সহিংসতার বিরুদ্ধে সহিংসতা ছড়ায়েও সমাজ থেকে সহিংসতা নির্মূল করা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ এক্ষেত্রে সত্যিকারের উভয় সংকট বা শাখের করাত যাকে বলে, তার নীচে পড়েছে।
(৪) রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা যেহেতু একপদে বা একব্যক্তির কাছে সাংবিধানিকভাবেই কেন্দ্রীভূত, সেজন্য বাংলাদেশে যেসব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতা চর্চা করার সুযোগ পেয়েছে বা যারাই নিজেদেরকে সে সুযোগ পাওয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলতে চায়, তেমন সকল রাজনৈতিক দলই তাদের দলের সর্বময় ক্ষমতাও একপদে বা একব্যক্তির কাছে, চেতনে বা অবচেতনে কেন্দ্রীভূত করেছে। এইসব রাজনৈতিক দল আর কোনোভাবেই ‘পলিটিক্যাল পার্টি’ বলতে যা বোঝায় সে-অর্থে পার্টি বা দল নয়, বরং ক্রমে এইসব প্রতিষ্ঠান একজন ব্যক্তি বা পরিবার বা বড়জোর গোষ্ঠী মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। তারা প্রকাশ্যে যে আদর্শ বা লক্ষ্যের কথাই বলুক না কেন, তাদের মূল লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামো দখল করে যথেচ্ছভাবে সম্পদের মালিক হওয়া এবং এর বড় অংশটি বিদেশে পাচার করা। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী পাকিস্তান আমলে, এমনকি ব্রিটিশ আমলেও ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যেসব রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যেও নেতৃত্ব নির্বাচন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে যতটুকু যৌথতার চর্চা ছিল, কিংবা ঘোষিত আদর্শের প্রতি যতটুকু নিষ্ঠা দেখা যেতো, এখন তার কণামাত্রও আর অবশিষ্ট নেই। এর প্রধান কারণগুলির একটা হলো, তখনকার দলগুলি সেইসব বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছিল, যাদের তারা অগণতান্ত্রিক বলে চিহ্নিত করেছিল। ফলে যারা লড়ছিল তাদের নিজেদের মধ্যে এক ধরণের গণতান্ত্রিকতার চর্চা চালু ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এবং বাংলাদেশের সংবিধানকে একটি স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক সংবিধান হিসেবে মেনে নেওয়ার পর, রাষ্ট্রের মতো দলের বেলাতেও, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকেই গণতান্ত্রিকতা হিসেবে সবাই মেনে নিয়েছে।
(৫) রাজনৈতিক ভিন্নমত থাকা আর ভিন্নমতকে ‘সঠিক মত’ দিয়ে পরাস্ত করা, এটা একটা স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। একটি বহুদলীয় স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ভিন্নমত যেমন থাকে, প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেমন থাকে, তেমনি নানা বিষয়ে ঐকমত্যও থাকে। কোনো কোনো সমস্যায় এক দল অপর দলের পক্ষেও দাঁড়ায়। কিন্তু দুটি দল যদি যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন এটা সম্ভব নয়। শান্তির সময়ের নৈতিকতা আর যুদ্ধের সময়ের নৈতিকতা এক নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভিন্নমতকে এখন বিরোধ থেকে এমন বিদ্বেষের পর্যায়ে নামানো গেছে, যার ফলে এখানে বিদ্বিষ্টদের নিমূল করাকেই রাজনৈতিক কর্তব্য হিসাবে নির্ধারণ করা গেছে। ফলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রুজ্ঞান করে তাকে ধ্বংস করার জন্য তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা, কুৎসা ছড়ানোর মাধ্যমে তাকে প্রথমে ঘৃণিত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা, তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে রাজী আছে এমন যাবতীয় শক্তিকে একত্রিত করা ও সমন্বয় ঘটানোর জন্য নীতি-নৈতিকতার ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া ও মানুষের অধিকারকে খর্ব করা ইত্যাদিকে আপতকালীন রাজনৈতিক প্রয়োজন মেটানোর তত্ত্ব দিয়ে যুক্তিযুক্ত করা এবং এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য অধঃপতিত হওয়াকে রাজনৈতিক দক্ষতা হিসাবে দেখানো খুব সহজেই সম্ভব হয়েছে।
(৬) এখানকার শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক দলকে যেভাবে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে ঠিক একই কায়দায় তারা নিজেদের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, দুঃখ, কষ্ট, হিংসা-বিদ্বেষকে দলীয় দ্বন্দ্ব ও হিংসা-বিদ্ধেষে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলে দলের দ্বন্দ্ব-হিংসা-বিদ্বেষই রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব-হিংসা-বিদ্বেষে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। দলের নেতা-নেত্রীর রাগ-ক্ষোভ পূরণের জন্য দলীয় কর্মীরা যেমন ন্যায়-অন্যায় যে কোনো উপায়ে তাদের জীবন দানে পিছপা হয় না, একইভাবে দলের কর্মী-সমর্থক বৃন্দ নিজেরাও নিজেদের রাগ-ক্ষোভ প্রশমনের জন্য যখন ‘একটু-আধটু’ অন্যায়-অবিচার করে তখন দলের মালিককেও তার নিজ গুণে তাদেরকে উদ্ধার করতে হয়। তাই আজ বাংলাদেশে যাদেরকে বিভিন্ন দলের রাজনীতিতে সক্রিয় দেখা যায়, তার একটা বড় অংশ আসে তাদের প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে, অথবা প্রতিপক্ষের আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ; আর কিছু আসে ক্ষমতার স্বাদ নিতে ও টাকা বানাতে। ফলে রাজনীতিতে আদর্শের বিরোধ বলে এখন আর কোনো বিরোধ নাই, যা আছে তার সবই কোনো না কোনো একটা মোড়কে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। ফলে এ প্রক্রিয়ায় সারাদেশের আনাচে-কানাচে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের আবরণে স্বার্থের দ্বন্দ্ব মারাত্মকভাবে বিস্তৃত হয়েছে এবং সমাজে হিংস্রতা, খুন, ধর্ষণ, বিকৃতি, বীভৎসতা নজীরবিহীনভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
(৭) রাষ্ট্রের সবচেয়ে ‘নিরপেক্ষ’ এবং নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত উচ্চ-আদালতকে জনগণের রক্ত ও জীবনদানের মাধ্যমে অর্জিত অধিকার কেড়ে নেয়ার প্রতিষ্ঠান হিসাবে অপব্যবহার করার মাধ্যমে জনগণকে অসহায় করে ফেলা হয়েছে। উচ্চ আদালতের এক বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটিকে নির্বাসনে পাঠানোর পর গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থাটাই ধ্বংস হওয়ার পথে যাত্রা করেছে এবং ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর এটা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে।
(৮) এই ভয়াবহ ব্যবস্থাটি রুখে দেওয়ার জন্য সাধারণভাবে যাদের এগিয়ে আসার কথা সেই শিক্ষিত-বুদ্ধিজীবী অংশটি এই কাজে না এসে বরং সোৎসাহে সেই নির্মূলের উৎসবে নিজেদের নাম লেখাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। এতে একদিকে তারা ও তাদের নিকটবর্তীরা বস্তুগত লাভের পরিমাণ যেমন বাড়াতে পেরেছেন, তেমনি আর একদিকে ব্যাপক মানসিক প্রশান্তিও আয়ত্ত্ব করতে পেরেছেন। স্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থায় মধ্যবিত্তদের এই গোষ্ঠীটির দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বার্থে যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়ার দায় বহন করতে হয়, তা আর এখন করতে হচ্ছে না। যখন রাজনৈতিক দলগুলো সমাজে যুদ্ধাবস্থার মনস্তত্ত্ব জারি করতে পারে তখন এই মধ্যবিত্ত শিক্ষিত-বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীটি অতি সহজে কোনো না কোনো একটি পক্ষে হেলে পড়তে পারে এবং সেক্ষেত্রে তারা অপরপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য রাষ্ট্রক্ষমতাকে দ্বিধাহীনভাবে ব্যবহারের উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে যায়। এরকম অবস্থা এদেরকে দলীয় কর্মীদের তুলনায় অধিকতর সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে যায়। ক্ষমতার অপব্যবহার, রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ ও সরকারের পক্ষে নির্লজ্জ অবস্থানকে জেহাদী উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারার যে সুখ, তা তাদেরকে একদিকে লুটপাটের আনন্দ এবং অপরদিকে মোসাহেবীপনা, দালাল-চাটুকার হওয়ার গ্লানি থেকে শুধু রক্ষাই করে না, বরং বিকৃত এবং নষ্ট আনন্দে আপ্লুত থাকতে সহায়তা করে। ফলে তারা নিজেদের স্বার্থেই মানুষদেরকে বিভক্ত করার, বিভক্তদের বিদ্বিষ্ট রাখার, বিদ্বিষ্টদের একে অপরকে নির্মূল করতে উসকানি দেয়ার জন্য তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান-পড়াশুনা-ভাষা-শিক্ষা-দক্ষতা সকল কিছুকে নিয়োজিত করে। তারা তিলকে তাল করে, আর তালকে অদৃশ্য করে, এবং এ কাজে দলীয় কর্মীদেরকে টেক্কা দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করে। ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখের নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে যে কারো কাছেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। বাংলাদেশে যে ভয়াবহ অরাজকতা নজীরবিহীন উচ্চতায় পৌঁছাতে পারলো, সেক্ষেত্রে এইসব শিক্ষিত বর্বরদের অবদান সবচেয়ে বেশী।
এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার কি কোনো পথ আসলেই আছে?
(এক) এ অবস্থা থেকে বের হতে হলে প্রথমেই রাষ্ট্র প্রযোজিত এইসব বিভাজন প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এবং এখানে রাষ্ট্র বলতে রাষ্ট্র, সরকার ও সরকারী দল ছাড়াও প্রচলিত অপরাপর বিরোধী দল, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, লেখক-শিল্পী, সাংবাদিক, পন্ডিতসহ শিক্ষিত-শ্রেণীর যারা-যারা এইসব বিভাজনে কোনো-না-কোনো পক্ষের হয়ে অপরপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করার পক্ষে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে উকালতি করে বা যুক্তি হাজির করে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে বুঝতে হবে।
(দুই) এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে মানুষকে দেখাতে হবে যে, তাদেরকে যেভাবে বিভাজিত করা হয়েছে এবং এক পক্ষ দিয়ে আরেক পক্ষকে নির্মূল বা নিশ্চিহ্ন করার মন্ত্রে দীক্ষিত করা হয়েছে নিকট ভবিষ্যতে তার কোনোটাই ঘটার কোনো সম্ভাবনা নাই। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ, আস্তিক-নাস্তিক, আদিবাসী-বাঙ্গালী, পাহাড়ী-সমতলী, ভারতপন্থী-পাকিস্তানপন্থী, ওয়াহাবী-সুন্নী, তাবলিগী-জিহাদী, বাউল-মোল্লা, কাদিয়ানী-অকাদিয়ানী ইত্যাদি যতো দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বর্গে মানুষকে বিভাজিত করা হয়েছে এর কোনো বর্গই একপক্ষ আরেকপক্ষকে সমূলে নিশ্চিহ্ন করার ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু সম্ভাব্য সমাধান নেই সেটা জেনেই তাদের এই অসাধ্য সাধনের যুদ্ধে লিপ্ত করানো হয়েছে। আর রাষ্ট্র, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে এদের প্রত্যেক পক্ষকেই কোনো না কোনো প্রকার মদত দিয়ে যাচ্ছে।
(৩) এটা খুব স্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে যে, আমাদের মানুষেরা এইসব কম প্রয়োজনীয় বিরোধকে যখন প্রধান বিরোধ হিসাবে আঁকড়ে ধরে, একপক্ষ যখন অপরপক্ষকে নিশ্চিহ্ন বা নির্মূল করা ছাড়া আর কোনো সমাধান দেখতে পায়না, তখন এখানকার শাসকগোষ্ঠী কমপক্ষে দুই ধরণের সুবিধা ভোগ করে; এক হচ্ছে, তাদের শাসন-নিপীড়ন-লুটপাট-পাচারের বিরুদ্ধে কোনো ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সমাজে আর অবশিষ্ট থাকে না, এবং দুই হচ্ছে, এই অক্ষমতার বোধ থেকে মানুষেরা মানসিকভাবে হিংস্র, বর্বর, বিকৃত ও প্রতিশোধ-পরায়ণ হয়ে উঠে এবং বিকৃতভাবে হিংস্রতার পূজারী হয়ে ওঠে। এরকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র যখন-যাকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়োজন মনে করে তাকে কোনো একটা অভিযোগের নীচে ফেলে নিশ্চিহ্ন করে ফেললেও বিভাজিত মানুষদের কোনো না কোনো পক্ষ সেই নৃশংসতার মধ্যেও প্রয়োজনীয়তার যুক্তি খুঁজে পায়। আর এ মনস্তত্ত্বের উপর বলিয়ান হয়ে রাষ্ট্র ক্রমশ তার সকল ধরণের কার্যকর বিরোধীতার উপরই সন্ত্রাসী থাবা বিস্তার করার অবাধ সুযোগ পায়।
(৪) আমাদের এখানকার রাজনৈতিক দলসমূহকে যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করা গেছে, তেমনি বিভিন্ন আদর্শকেও ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ও প্রাপ্তি বাড়ানোর উপায় হিসেবে ব্যবহার করার কৌশল এইসব নেতা-নেত্রীদের কুক্ষিগত করা হয়ে গেছে। তাই কথিত নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়ার প্রচলিত অভ্যাস কাঠামো থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। এর জন্য আদর্শের বদলে সেইসব আদর্শ বাস্তবায়িত হলে মানুষের বাস্তব জীবনের যেইসব সমস্যার যেমন সমাধান হবে বলে এইসব ‘আদর্শবাদীরা’ দাবী করেন, প্রথমে তাদেরকে সেইসব সমাধানের রূপরেখা সহজবোধ্য ভাষায় মানুষের সামনে উত্থাপন করতে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। অর্থাৎ রাজনীতিকে আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের লড়াইয়ে সঙ্কুচিত ও সীমাবদ্ধ না করে আদর্শকে সমস্যার সমাধানমুখী করে উপস্থাপন করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অপরদিকে মানুষকে এইসব সমস্যার সমাধান আসলেই কিভাবে পাওয়া সম্ভব তা বুঝে নেওয়ার জন্য সক্ষম করে তোলায় মনোনিবেশ করতে হবে।
(৫) এখনকার রাজনৈতিক দলসমূহের কর্মকাণ্ড, ঘোষিত নীতি-আদর্শ ও কর্মপদ্ধতির দিকে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে যে প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল আদর্শকে কাট-ছাট করে এমন ছোট এবং বিকৃত করেছে, যার মধ্যে কোনো সুস্থ সম্পূর্ণ মানুষের মননশীলতাকে পরিপূর্ণভাবে ধারণ করা সম্ভব নয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, এইখানে এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণ করা হয়েছে যে, যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করে অতি অবশ্যম্ভাবীভাবে তাদের আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগের মিত্র দলসমূহের কোনো না কোনো একটির সদস্য বা অনুসারী হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ধারণ করেই যে একজন আওয়ামীলীগ-বিরোধী হতে পারে, বা ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ ধারণার সাথে একমত হয়েও যে কেউ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, বা একজন প্রগতিশীল মানুষ যে শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের ধারণার বিপরীতে থেকেও সাম্যের ধারণাকে ধারণ করতে পারে বা একজন মানবতাবাদী মানুষ ধার্মিক হয়েও যে ধর্ম-পরিচয়ে রাজনৈতিক দল করার বিরোধী হতে পারে, সে বাস্তবতার অনুমোদন এ রাষ্ট্র বন্ধ করে দিয়েছে। এইসব খোপ থেকে বের হয়ে কিভাবে সম্পূর্ণ মানুষকে এবং একই সাথে অধিকাংশ মানুষকে ধারণ করার মতো দল বা সংগঠন গড়ে তোলা যায়, সেই দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।
(৬) বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গৌরবকে ধারণ করে; ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালনের অধিকার বজায় রাখ হোক ও ধর্মকে রাজনৈতিক মুনাফা অর্জনের হাতিয়ার না-বানানো হোক – এমন মনোভাব পোষণ করে। বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হোক ও সকল মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করা হোক এবং সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে এমন রাষ্ট্রনৈতিক সংগঠন গড়ে উঠুক ও সেটা শক্তিশালী হোক – এমন মনোভাব পোষণ করে। এমন সংগঠন গড়ে উঠলে তাতে যুক্ত হওয়ার বা তাকে সমর্থন করার আকাঙ্ক্ষাও তারা পোষণ করে। কিন্তু তেমন রাজনৈতিক দল বা সংগঠন গড়ে ওঠার পরিস্থিতি এখানে নাই। এখানকার মানুষদের বিভক্ত করলে যারা লাভবান হয়, তারা প্রত্যেকটি দলকেই কোনো না কোনোভাবে খন্ডিত এবং বিকৃত মানুষদের সংগঠনে পরিণত করতে পেরেছে, এবং মানুষকে বাস্তব সমস্যার চাপের মধ্যে ফেলে তাদের যার যার বিবেচনায় কম ক্ষতিকর একটি দলকে বেছে নিতে বাধ্য করেছে। বাংলাদেশকে বিদ্যমান সংকট, বিভাজন ও সংঘর্ষ থেকে রক্ষা করতে হলে মানুষ যেন সর্বাংশে সকল সত্তাসহ তার পছন্দের যে কোনো একটি দলে যুক্ত হতে পারে, বা যুক্ত না হয়েও এমন একটি রাজনীতিকে পছন্দ করতে পারে, তেমন একটি রাজনীতি, তেমন একটি দল গড়ে ওঠার উপযোগী মনস্তত্ত্ব ও অভ্যাস গড়ে তোলায় মনোযোগ দিতে হবে।
(৭) এই সকল করণীয় সম্পাদন করার জন্য প্রয়োজন এমন একটি কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং উত্থাপন করা, যা মোটিভেটেড লুটপাট-পাচারকারী গোষ্ঠী ছাড়া, প্রকৃতপক্ষে এদেশের প্রচলিত রাজনীতি দ্বারা বিভক্ত ও বিভাজিত সকল মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যই প্রয়োজনীয় এবং গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এটা হতে পারে মোটা দাগে পাচারের বিপক্ষে দাঁড়ানোর মাধ্যমে। কারণ দেশের সম্পদ পাচার বন্ধ করার পক্ষে দাঁড়ানো মানে এখানে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের পক্ষে দাঁড়ানো, উৎপাদনের পক্ষে দাঁড়ানো মানে বেকারত্ব দূর করার জন্য কর্মসংস্থানের পক্ষে দাঁড়ানো। পাচারের বিপক্ষে দাঁড়ানো মানে দুর্নীতি ও লুটপাট বন্ধ করার পক্ষে দাঁড়ানো। দুর্নীতি বন্ধ করার পক্ষে দাঁড়ানো মানে এককেন্দ্রিক ও জবাবদিহিহীন রাষ্ট্র ক্ষমতার বিপরীতে জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার পক্ষে দাঁড়ানো, রাষ্ট্র-ক্ষমতার উপর জনগণের প্রকৃত মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে দাঁড়ানো। জবাবদিহির পক্ষে দাঁড়ানো মানে নিরাপদ বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়ানো, রাষ্ট্রক্ষমতার উপর জনগণের মালিকানা অর্থাৎ গণক্ষমতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে দাঁড়ানো। গণক্ষমতাতান্ত্রিক রাষ্ট্র-কাঠামোর পক্ষে দাঁড়ানো মানে বিদ্যমান সংবিধানের এককেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামোকে সংশোধনের পক্ষে দাঁড়ানো।
মনে রাখতে হবে, একটি দাঁড়ানোর কর্মপরিকল্পনা উত্থাপনই যথেষ্ট নয়, সে কর্মপরিকল্পনাটি বাস্তবায়নযোগ্য কিনা, বাস্তবায়নযোগ্য হলে তা বাস্তবায়নের দিক-নির্দেশনা এবং কর্মপরিকল্পনাটা কি ও কেমন – মানুষের সামনে তাও তুলে ধরতে হবে।
এইসব দাঁড়ানো, এইসব কর্মপরিকল্পনা আর লড়াই আমাদের সকলের অস্তিত্বের জন্যই, আমাদের সন্তান-সন্তুতির ন্যূনতম সুস্থ-স্বাভাবিক-নিরাপদ জীবনের জন্যই, আমাদের প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা, আমাদের মানবিক বোধ-বিশ্বাস-ভালোবাসার সুরক্ষা, আমাদের সকলের মানবিক মর্যাদাপূর্ণ ন্যায়ভিত্তিক জীবনের জন্যই অবশ্য করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই করণীয় সম্পাদনে আমরা যাতে আর ব্যর্থ না হই, আমাদের শহীদদের কাছ থেকে পাওয়া ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের শিক্ষাটা যেন আর ভুলে না যাই, বাংলাদেশের নতুন সংকট আমাদেরকে সে তাগাদাটাই দিয়ে যাচ্ছে।
*প্রবন্ধটি রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালের পঞ্চম সংখ্যায় (ফেব্রুয়ারি ২০২০) প্রকাশিত