প্রগতিশীলতা বনাম মৌলবাদ: বাংলাদেশের ‘বাইনারি’ রাজনীতি

  • দিলশানা পারুল

বাজি ধরে বলতে পারি, এই লেখাটার শিরোনাম দেখেই বিরাট একটা অংশের মানুষ রিলাকটেন্ট হয়ে যাবে এই সন্দেহে যে এটি আসলে কাদের পক্ষে লেখা হয়েছে? প্রগতিশীলদের পক্ষ নিয়ে না র্ধমীয় মৌলবাদীদের পক্ষ নিয়ে? মানে আপনাকে কোনো না কোনো পক্ষে হাজিরা দিতেই হবে, যেন এই চিন্তার কোনো মধ্যপন্থা নাই। এই যে দেখেন ‘হাজিরা’ শব্দটা ব্যবহার করলাম এইখান থেকেও একদল সিদ্ধান্ত টানবে এইটা ইসলামপন্থীদের পক্ষ নিয়ে আসলে লেখা হয়েছে। তার মানে এই পোলারাইজেশনটা এমন একটা অবস্থায় দাড়িয়েছে যে ব্যক্তির শব্দ চয়ন থেকেও একদল মানুষ এই সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই লেখা বা প্রস্তাবনা কাদের পক্ষে যায় বা যাচ্ছে। মানে শব্দেরও হিন্দুয়ানী, মুসলমানী এই ধরনের চরিত্রায়ন করেছি আমরা। অথচ যে কোনো জনগোষ্ঠীর ভাষা হচ্ছে প্রবাহমান, এইটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে কথিত ভাষার বিভিন্ন ফর্মে এডাপটেশন ঘটে। তারই অংশ হিসেবেই একটি জাতিগোষ্ঠী ভাষার মধ্যে বিভিন্ন গোত্রের বা এথনিক গ্রুপের ভাষার মিশ্রন ঘটতে থাকে। এর অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। ইন-অরগানিকভাবে বা জোরপূর্বক যদি কোন শব্দ আমদানিও করা হয় সেই শব্দ জাতিগোষ্ঠী নিজের করে না নিলে, সেই শব্দ ওই জনপদে টিকেও না, হারিয়ে যায়। কিন্তু ভাষা কেন্দ্রিক এই আলোচনায় না যেয়ে আমরা সরাসরি সিদ্ধান্তে চলে যাই এইটা হিন্দুয়ানি শব্দ না মুসলিম শব্দ। মানে চিন্তা করে দেখেন চিন্তা করার পদ্ধতিকে আমরা কি পরিমান সংকীর্ণ করে ফেলেছি যে শব্দ চয়ন দিয়ে বুঝতে চাই এর লেখা আমার পক্ষে যাবে না বিপক্ষে। তার মানে এই বাইনারি চিন্তা পদ্ধতি প্রথম যে কাজটি করে এবং করেছে সেইটা হচ্ছে ব্যক্তির চিন্তাকে সংকীর্ণ করে ফেলে। চিন্তাকে ন্যারোডাউন করে দুই পাড়-ওয়ালা নালার মধ্যে দিয়ে পরিচালিত করে। তারপর চিন্তা বাধ্য হয় নালা যেদিকে গেছে সেই দিকেই যেতে। এর আর অন্য কোনো গত্যান্তর থাকে না।

এখন এই বাইনারি চিন্তা পদ্ধতিটা আসলে কি?

এইটা আসলে আমরা জানি। বাই মানে দুই। মানে কম্পিউটার সফটওয়ার প্রগ্রামিং এর জন্য বেসিক যে ০ এবং ১ এই দু্ইটা ডিজিট ব্যাবহার করা হয় এইটাকে বলে বাইনারি কোড, কারন দু্ইটামাত্র ডিজিট ব্যাবহার করে এই কোডিং করা হয় তাই এইটাকে বাইনারি কোড বলে। তারপর আপনি যত জটিল, যত ডিটেইল প্রগ্রামিংই করেন না কেন এই দু্ইটা নাম্বার ব্যাবহার করেই করবেন। এবং এই বেসিক কোডে ০ এবং ১ এর পরে কোনদিনও ২ আসবে না। তৃতীয় কোনো কোড বানাতে হলে আপনাকে ১১ বা ০০ বা ০১ এইভাবেই বানাতে হবে। বাইনারী চিন্তা-পদ্ধতিও তাই। বাইনারী চিন্তা পদ্ধতি হচ্ছে একটা শর্তযুক্ত চিন্তা পদ্ধতি যেখানে আপনার চিন্তাকে এমনভাবে শর্তযুক্ত করা হয় যে আপনি দু্ইটা অপশনের বাইরে আর কিছু দেখবেন না। সাদা বা কালো, ভালো বা মন্দ, ডান বা বাম, নাস্তিকতা বা আস্তিকতা, লীগ বা বিএনপি, ফুটবল বা ক্রিকেট, আবাহনী বা মোহামেডান, আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিল এই রকম করে প্রতিনিয়ত আপনাকে এমন একটি চিন্তা পদ্ধতিতে অভ্যস্ত্য করা হয় যেইটাতে অভ্যস্ত হলে আপনি ‘হয় এইটা নয় ওইটা’ এইভাবেই ভাববেন। বাইনারী চিন্তা পদ্ধতি বিপদ যে ঘটায় যেটা শুরুতেই বলেছি, চিন্তার শুরুতে এবং শেষে একটা ব্র্যাকেট টেনে দেয় মানে ওই যে দু্ই পাড়-ওয়ালা নালার কথা বললাম তাই। আপনার চিন্তাকে বাইনারি চিন্তা-পদ্ধতি গাইড করে নিয়ে যেয়ে ঠিক নালার সেই যায়গাতেই ফেলবে যেই যায়গায় নালার সীমানা নির্ধারন করা আছে। চাইলেও আপনি শর্তযুক্ত চিন্তা পদ্ধতির কারনে অন্য কিছু ভাবতে পারবেন না।  

প্রগতিশীলতা বলতে আসল আমরা কি বুঝি এবং কি চর্চা করি?

আমাদের প্রচলিত ধারনায় প্রগতিশীল বলতে বুঝি এরা গানবাজনা করে, শিল্প সাহিত্য চর্চা করে আর প্রতিক্রিয়াশীল বলতে আমরা হাজির করি পায়জামা পাঞ্জাবি পরা (আমরা তাচ্ছিল্য করে থ্রী পিছ বলতাম!) দাড়ি টুপি ওয়ালা ইমেজ। ভাবনার যায়গাটা এমন দাড়িয়ে গেছে যে যারা ধর্ম চর্চা করে তার প্রতিক্রিয়াশীল, বিশেষ ভাবে ইসলাম ধর্ম; আর যারা শিল্প-সাহিত্য করে এরা প্রগতিশীল। মানে আপনে যে কোনো ভাবে শিল্প সাহিত্যের সাথে অথবা বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকলেই হলো, আপনি অলিখিত প্রগতিশীল সার্টফিকেট পেয়ে যাবেন। ব্যক্তি কীভাবে চিন্তা করছে এইটা কোনো গননার বিষয়ই না এইখানে। আবার ধর্ম পালন করলে আপনি প্রগতিশীল হতে পারবেন না। পারবেন না মানে পারবনে-ই না। আবার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকা মানুষ যেন প্রতিক্রিয়াশীল হতেই পারে না। খেয়াল করেন বাইনারি চিন্তা-পদ্ধতি কীভাবে শর্ত যুক্ত করে ফেলছে। আমরা এমন এক শর্তযুক্ত চিন্তা পদ্ধতি চর্চা করছি যেখানে ধার্মিক মানে প্রতিক্রিয়াশীল এবং সংস্কৃতিমনা মানেই প্রগতিশীল। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে আমরা এরকম খবর হরে দরে দেখেছি নাট্যকর্মী বাসায় বউ পিটায়। মাদ্রাসায় শুধু ধর্ষণ এর ঘটনা ঘটে না থিয়েটারেও ধর্ষণ এর মতো ঘটনা ঘটেছে। তাহলে ব্যক্তি প্রগতিশীল চিন্তা রাখে কিনা সেইটা কি আসলে সে ধর্ম পালন করে না সংস্কৃতিমনা এইটা দিয়ে বোঝা যায়?     

তাহলে আসলে এই প্রগতিশীল চিন্তা কি? প্রগতিশীল মানে প্র-গতি, গতির সামনের দিকে, মানে যেই চিন্তা মানুষের সভ্যতা এবং সংস্কৃতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে সেইটাই প্রগতিশীল চিন্তা। এখন এই চিন্তা পদ্ধতি যদি আপনাকে সামনের দিকে পথ না দেখায় তাহলে এইটা প্রগতিশীল চিন্তা না। আপাত অর্থে আমাদের মনে হয় এই ব্যক্তি সংস্কৃতিচর্চার সাথে যুক্ত আছেন মানে উনার চিন্তা তুলনামূলক আগানো হবে, মৌলবাদী বা কট্টর হবে না। আবার ধর্মচর্চা করে বলে আমরা ধরেই নেই যে, এর চিন্তা মৌলবাদী বা কূপমন্ডুক হতে বাধ্য। কিন্তু বাস্তব জীবনে আপনি কথা বলতে যেয়ে এইরকম অসংখ্য শিল্প সাহিত্যিক পাবেন যাদের রাষ্ট্র, রাজনীতি, মানুষ, সমাজ-সংস্কৃতি সমস্ত কিছু নিয়ে অত পরিষ্কার ধারনা নেই বা তারা খুব বেশি হয়ত ভাবছেনও না। আবার দাড়ি টুপি পরা অসংখ্য মুসল্লী পাবেন যারা রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি সমস্ত কিছু নিয়ে অনেক গভীর পর্যন্ত ভাবছেন, ভাবতে পারছেন।

এখন আসি বাংলাদেশের রাজনীতি এই ধর্ম বনাম প্রগতিশীলতা এই বাইনারি কেনো আসলো? কিভাবেই বা এই বাইনারি কাজ করছে? এবং এই বাইনারি বিদ্যমান থাকলে সমস্যাই বা কি?

সমাজ উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যখন হাতে নেয়া হয় তখন প্রবলেম ট্রি এনালাইসিস (Problem tree analysis) বা সমস্যাবৃক্ষ বিশ্লেষণ বলে একটা ম্যাথোড ফলো করা হয়। মানে বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় প্রধান সমস্যা কি? এইটা ধরে সেই সমস্যার মূল কারন খোঁজা হয়। বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থায় আপনি প্রধান সমস্যা যা চিহ্নিত করবেন সেই সমস্যা সমাধানেইতো প্রেসক্রিপ দেবেন তাই না? রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও তাই সমস্যা চিহ্নিতকরন মেথড একইভাবে কাজ করে। মানে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক দল প্রধান সমস্যা হিসেবে যা চিহ্নিত করে সেই সমস্যা সমাধানেই তাদের দল কাজ করে এবং সেই মতই তাদের রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করে। সমস্যা বৃক্ষের নীচের দিকে থাকে কারন আর উপরের দিকে থাকে সেই সমস্যার ফলাফল। এখন কোনো রাজনৈতিক দল যদি ধরে নেয় বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা ‘ধর্মীয় মৌলবাদ’ তাহলে সে সেই কারনগুলো চিহ্নিত করবে এবং র্ধমীয় মৌলবাদ নিরসনের জন্য কাজ করবে এবং তাদের রাজনৈতিক বয়ান সম্পূর্ণ এই আঙ্গিকে তৈরি করবে। আর কোনো রাজনৈতিক দল যদি প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করে ‘বৈষম্য’ তাহলে সে বৈষম্য এর পিছনের কারনগুলো চিহ্নিত করবে এবং তার রাজনৈতিক বয়ানগুলো সেই ভাবেই তৈরি করবে। আমি উদাহরন দিয়ে বিষয়টা একটু বোঝানোর চেষ্টা করি।

চার্ট-১

ধর্মীয় মৌলবাদের পিছনে আরো কারন থাকেত পারে। আমি কেবল প্রধান চারটি কারনকে উদাহরণ হিসেবে নিলাম। দেখুন, আপনি যখন রাজনৈতিকভাবে মনে করছেন ধর্মীয় মৌলবাদ হচ্ছে প্রধান সমস্যা তখন আপনি এই সমস্যা থেকে পরিত্রান চাইবেন। এই সমস্যা থেকে পরিত্রানের উপায় হিসেবে এই ধর্মীয় মৌলবাদ বিস্তারের পিছনে যে কারনগুলো আছে আপনি সে কারণগুলোকে চিহ্নত করবেন, সে কারনগুলোকে মোকাবিলা করার জন্যই রাজনৈতিক প্রস্তাবনা পেশ করবেন এবং আপনার সমস্ত রণকৌশল আপনি সাজাবেন সেই মোতাবেকই। কারন আপনি তো আপনার প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ধর্মীয় মৌলবাদকে।

এবার আসেন আমি প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নত করলাম বিদ্যমান বৈষম্যকে। তাহলে আমার প্রবলেম-ট্রির চেহারা কেমন দাঁড়াচ্ছে একটু দেখি।

চার্ট -২

সমস্যা হিসেবে বৈষম্যের ব্যপ্তি এবং শেকড় এত গভীরে যে এর কারন সুনির্দিষ্ট করতে থাকলে আসলে আরো কয়েক স্তর নীচে যাবে। এখন মোদ্দা কথায় আসি। মানে আমি যখন বিদ্যমান সমস্যা হিসেবে বৈষম্যকে চিহ্নিত করলাম তখন আমি তার কারনগুলো র্নিমূল করার চেষ্টা করব। আমার রাজনৈতিক বয়ান তখন সব ধরনের বৈষম্যের পিছনে কারনগুলোকে চিহ্নিত করে তাকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করবে। আমার রাজনৈতিক বযানও ওইভাবে সাজানো হবে।

এখানে একটু যোগ করে নেই যে, রাজনৈতিক বয়ান বলতে আমি বুঝি একটা দেশের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের উপায় কি হওয়া উচিত সেইটার একটি রাজনৈতিক প্রস্তবনা।  

এখন খুব সরল একটা প্রশ্ন করি। আপনি যখন ধর্মীয় মৌলবাদকে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করছেন এবং তখন সেই সমস্যা নির্মূল করার জন্য যে রাজনৈতিক বয়ান হাজির করছেন সেই রাজনৈতিক বয়ান বিদ্যমান সকল ধরনের বৈষম্য র্নিমূল করতে পারবে কি? তাহলে যে রাজনৈতিক দল বৈষম্য র্নিমূল করতে চায় তারা প্রধান সমস্যা হিসেবে ধর্মীয় মৌলবাদ চিহ্নিত করতে পারে কি না?

যে রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান সমস্যা হিসেবে ধর্মীয় মৌলবাদকে চিহ্নিত করছে তারাই এই সমস্যাকে মোকাবিলা করার জন্য কাউন্টার-থট হিসেবে প্রগতিশীল চিন্তাকে হাজির করছে। এখন এই বাইনারিতে থাকলে সমস্যা কি? সমস্যা অন্য কিছুই না। সমস্যাটা ওপরে দেখিয়েছি। ধর্মীয় মৌলবাদ প্রধান সমস্যা হলে আপনি মৌলবাদকে ফাইট দিতে পারবেন, কিন্তু তাতে অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য কিংবা লৈঙ্গিক বৈষম্য র্নিমূলের কোনো কাজ হবে না, কোনো পথ বাতলানো হবে না। এই জন্য যে কোনো রাজনৈতিক বয়ান তৈরির আগে প্রধান সমস্যা কোনটা তা চিহ্নত করা সবচেয়ে জরুরী। কারন সমস্যা যা চিহ্নিত করবেন আপনি সমাধানও ঠিক সেই মোতাবেকই প্রস্তাব করবেন, তাই না?           

  • দিলশানা পারুল, লেখক ও এক্টিভিস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *