‘পাটশিল্প বাঁচানোর শ্লোগানের চাইতে পাটশ্রমিকদের বাঁচানোর শ্লোগানটা জরুরী’

  • অনুপম সৈকত শান্ত

পাটশিল্প আসলে ধ্বংস হবে না। ফলে পাটশিল্পকে বাঁচানোর আহবানের দরকার নেই। পরিবেশ বান্ধব পাটের চাহিদা গোটা দুনিয়াতেই দিন দিন বাড়ছে, ফলে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাংলাদেশে প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। এমনকি এই করোনা মহামারীতে যেখানে বাংলাদেশে প্রতিটা পণ্যের রপ্তানি আয় কমেছে, সেখানে একমাত্র এই পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানিই বেড়েছে। অতএব, পাটশিল্প নিয়ে দুশ্চিন্তার কোন কারণ দেখি না।

ভাবতে পারেন, পাটশিল্পের যেখানে এইরকম রমরমা অবস্থা, তখন রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫ টি জুটমিল বন্ধের সিদ্ধান্ত কেন নিচ্ছে! ব্যাপারটা খুব ফকফকা। ২৫ টা রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিল বন্ধ করার প্রধান কারণ হচ্ছে- পাটশিল্পের এখন রমরমা অবস্থা, এই মুহুর্তে পাটশিল্পের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। হ্যাঁ, পাটশিল্পের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল বলেই এই জুটমিলগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না? গোলমেলে মনে হচ্ছে? ঠিক আছে খোলাশা করি …

পাটশিল্পে এখন রমরমা, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল মানেই হচ্ছে, এই সেক্টরে বিনিয়োগে, ব্যাপক মুনাফার সম্ভাবনা। আর সে কারণেই আমাদের পুজিপতিদের লোভের দৃষ্টি এখানে পড়েছে। যেই মুহুর্তে রাষ্ট্রায়ত্ত পাট কারখানাগুলো বন্ধ করা হচ্ছে, সেই মুহুর্তে ২০০টি বেসরকারি পাটকল ধুমায় ব্যবসা করছে, রপ্তানি আয়ে দেশকে “উজ্জ্বল” করছে, এগুলোর মালিক ফুলে ফেপে উঠছে। তাদেরই দৃষ্টি হচ্ছে এই রাষ্টায়ত্ত জুটমিলগুলোতে। নতুন জুটমিল স্থাপন করা, চালু করা- সেটার যে আয়োজন, খরচ ও ঝামেলা- তার চাইতে রেডিমেড এসব কারখানায় যে জায়গা জমি, কারখানার অবকাঠামো, গোডাউন, যন্ত্রপাতি আছে – সেটার দিকে লোভ অনেকেরই। অন্য কিছুই না, কেবল এই জুটমিলগুলো বন্ধ করার একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে- এগুলোকে প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেয়া!

বিশ্বাস যদি না হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা বন্ধ করার সিদ্ধান্তের পরপরই টিভি মিডিয়ায় দেয়া আমাদের পাটমন্ত্রীর সাক্ষাৎকারটা দেখুন, শুনুন। তিনি পরিস্কারভাবে বলেছেন, এই কারখানাগুলো অচিরেই চালু হবে। পিপিপি এর মাধ্যমে দক্ষ, অভিজ্ঞ পার্টনারের হাতে তুলে দেয়া হবে! ব্যক্তিগত জীবনে প্লাস্টিক ব্যবসায়ী, আমাদের পাটমন্ত্রীর কথায় এতটুকু অস্পষ্টতা ছিল না।

তাহলে, প্রশ্ন করতেই পারেন- এমনই যদি প্লান করে থাকে, তাহলে রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিলগুলো বন্ধ করা হলো কেন, সরাসরি বেসরকারিকরণ করলেই তো হতো, শ্রমিক সহ পুরো কারখানা প্রাইভেটাইজেশন করতো, মালিকানা চেঞ্জ হতো বা পিপিপি করলে তো আরো ভালো, শ্রমিকদের দায়িত্বটা সরকার আরো ভালোভাবে দেখতে পারতো। মিল বন্ধ করে এমনভাবে শ্রমিকদের পথে বসানোর উদ্দেশ্য বা কারণ কি?

এখানেও – যে প্রাইভেট মালিকানা আসতে যাচ্ছে, তাদের স্বার্থটা দেখা হয়েছে। সবকিছু রেডিমেড পাবে কিন্তু, অনেক বছরের দক্ষ স্থায়ী শ্রমিকের বেশি বেতনের বোঝাটা নিতে হবে না। অসংখ্য শ্রমিক কাজ হারিয়ে যখন বেকার থাকবে, তখন নতুন জুটমিল ফ্রেশ শ্রমিক হিসেবে কম মজুরিতে নিয়োগ দিতে পারবে, যাদের ইচ্ছে – দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগ দিবে। যন্ত্রপাতির কিছু আধুনিকায়ন করবে, তার মাধ্যমে শ্রমিকের সংখ্যা কমানো যাবে, আর এখনকার দুই তিনজন শ্রমিকের কাজ একজনের ঘাড়ে চাপিয়ে- ব্যাপক পরিশ্রম করিয়েও শ্রমিকের সংখ্যা ব্যাপক কমানো সম্ভব। ফলে, এক ধাক্কায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাবদ খরচ কমিয়ে ফেলতে পারবে অনেক।

আর, পিপিপি করার লাভ-ক্ষতিই বা কি? পিপিপি করার সবচাইতে বড় সুবিধা হচ্ছে, সরকারি সম্পদ আরামসে, মানে বিনা পয়সায় ব্যবহার করে ব্যবসা করার সুবিধা। এইযে বিশাল সম্পত্তি- সেটা নিলামে তুলে নির্দিষ্ট বছরের জন্যে লিজ দিয়ে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে- যে খরচ গুনতে হতো, সেই খরচের হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে। কোনরকম বাড়তি খরচ ছাড়াই- এই জমি ও অবকাঠামো ব্যবহার করে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিতেই পিপিপি এর কথা বলা হয়েছে। ফলে, পাটশিল্প ঠিকই চলবে, আরো ফুলে ফেপে উঠবে। ইচ্ছাকৃতভাবে এই রাষ্ট্রয়ত্ত জুটমিলগুলো যেরকম ক্ষতি গুনে গিয়েছে বছরের পর বছর, সেখানে প্রাইভেট মালিকানায় আসলে দেখা যাবে, রাতারাতি এগুলো লাভের মুখ দেখছে। শ্রমিকদের ইচ্ছেমত শোষণ করে, সরকারের টাকায় ও সম্পত্তিতে প্রাইভেট মুনাফাখোরদের পকেট ফুলে ফেপে উঠবে!

শ্রমিকদের নাকি গোল্ডেন হ্যাণ্ডশেক বাবদ অনেক টাকা দেয়া হবে! সেই টাকাটা পাওয়ার পরে যদি প্রাইভেটে জুটমিলে তারা কাজ পায়- সেটায় তাদের ক্ষতি নাই, উল্টো লাভ- এমনটা মনে করছেন? এখানেও বড় ফাঁকি হচ্ছে, স্থায়ী-অস্থায়ী শ্রমিকদের বড় অংশই আসলে নতুন জুটমিলে কাজ পাবে না, আর দৈনিক ভিত্তিতে যে শ্রমিকরা কাজ করে- তাদের কারোর এই গোল্ডেন হ্যাণ্ডশেকের টাকা পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই! দ্বিতীয়ত, যে ৫ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকার মূলা দেখানো হচ্ছে, সেটা শ্রমিক বিক্ষোভ ঠেকানোর উদ্দেশ্যে হচ্ছে- বেশিরভাগ স্থায়ী শ্রমিকও এই পরিমাণ টাকাটা পাবে না; সরকার যদি এরকম বরাদ্দ দেয়ও (প্রাইভেট মালিকদের কোন লস নাই)- তার বড় একটা অংশ লুটপাটই হবে। আদমজী বন্ধের ক্ষেত্রেও গোল্ডেন হ্যাণ্ডশেক এর টাকা পেতে অসংখ্য জায়গায় ঘুষ দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ এসেছিলো। ফলে, শ্রমিকদের নাম করে আরেকটা লুটপাটের ব্যবস্থাই করা হচ্ছে।

পাটশিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ দেখি না। তাই, পাটশিল্প বাঁচানোর শ্লোগানের চাইতে পাটশ্রমিকদের বাঁচানোর শ্লোগানটা জরুরী। রাষ্ট্রের টাকা, রাষ্ট্রের সম্পদ- মানে জনগণের টাকা, জনগণের সম্পদ। জনগণের পকেট কাঁটার এই আয়োজন বন্ধের দাবি তোলা খুব জরুরী!

লেখক: প্রকৌশলী ও গবেষক

পাটশিল্প আসলে ধ্বংস হবে না। ফলে পাটশিল্পকে বাঁচানোর আহবানের দরকার নেই। পরিবেশ বান্ধব পাটের চাহিদা গোটা দুনিয়াতেই দিন দিন…

Posted by Anupam Shaikat Shanto on Saturday, June 27, 2020

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *