৩০শে এপ্রিল ২০২০
আজ ৩০শে এপ্রিল বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার কিছু মানুষ, যারা বিভিন্ন সময়ে মানুষের নানা সংকট ও দুর্যোগে কথা বলেন ও পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন, তারা মিলে “দুর্যোগ সহায়তা মনিটরিং কমিটি” নামের একটি কমিটি গঠন করেছেন। পাশাপাশি প্রথম অনলাইন সংবাদ সম্মেলন উপলক্ষে তারা সরকারী ত্রাণ বরাদ্দ ও বণ্টনের জেলাভিত্তিক চিত্র তথ্য-উপাত্তসহ তুলে ধরে এর নানা অসঙ্গতি নির্দেশ করেছেন।
প্রাথমিকভাবে ব্যারিষ্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া সমন্বয়ক এবং লেখক রাখাল রাহা সদস্য সচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এই উদ্যোগের সাথে মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, হাসনাত কাইয়ূমসহ আরো অনেকে যুক্ত আছেন। যারা যুক্ত হয়েছেন তাদের বাইরেও সবার মতামতের ভিত্তিতে এই কমিটির সদস্যগণ যুক্ত হবেন।এই কমিটি করোনা দুর্যোগ অব্যাহত থাকা পর্যন্ত কাজ করবে।
এই কমিটি মনে করে করোনা এমন এক মহামারি, যাতে উন্নত-অনুন্নত সকল দেশই আজ ভয়াবহরকমভাবে বিপর্যস্ত। তবে আমাদের সাথে তাদের পার্থক্য হচ্ছে আমাদের মানুষ করোনার চেয়েও বেশী বিপর্যস্ত ক্ষুধা নিবারণে। আমরা জানি, রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ এমন একটা দেশ, যে সাধারণ একটা দুর্ঘটনা মোকাবেলাতেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। আর আমাদের দুর্যোগ মোকাবেলায় যেটুকু সাফল্যের কথা বলা হয়, তা রাষ্ট্রের নয়, এখানকার মানবিক মানুষের, যারা প্রয়োজন হলে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মানুষের পাশে ছুটে যায়। এই করোনাকালেও সেই মানুষেরাই এগিয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু করোনা এমন এক ব্যতিক্রমী বৈশ্বিক দুর্যোগ, যার মোকাবেলা প্রচলিত পথে করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রম যথাযথভাবে সুরক্ষা এবং নির্দেশিত নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত না হলে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
এমন একটি জঠিল পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য রাষ্ট্র এবং সরকারকেই প্রশিক্ষিত লোকবলের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ও চিকিৎসাকে গৃহবন্দী মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ইতিমধ্যে সরকারের দিক থেকে যেটুকু করার চেষ্টা হয়েছে তাতে ভয়াবহ অনিয়ম, দুর্নীতি ও পক্ষপাতমূলক আচরণের খবর আসছে। এর প্রতিবাদে মানুষ বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামছে, নিগৃহীত ও হামলা-মামলা শিকার হচ্ছে। শুধু তারাই নয়, এসব খবর সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে গিয়ে সংবাদকর্মীরা পর্যন্ত হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন।
তাই প্রকৃত দুস্থ্ ও অসহায় মানুষের জন্য বরাদ্দ যাতে বাড়ানো হয়, বরাদ্দকৃত সহায়তা ও প্রণোদনা যেন মানুষের কাছে পৌঁছায় সে জন্যে আজ বাংলাদেশে সরকারী তদারকির পাশাপাশি জনমানুষের দিক থেকেও তদারকি দরকার। সে লক্ষ্যেই আমরা জরুরী ভিত্তিতে সারাদেশের ত্রাণ কার্যক্রম মনিটরিং করার প্রয়োজন মনে করছি।
কমিটি তাদের কার্যপরিধি নির্ধারণ করেছে এভাবে:
১। সরকার কাদের জন্য, কতটুকু ত্রাণ বরাদ্দ করছে তার খোঁজ-খবর রাখা এবং সেটা পর্যাপ্ত কিনা বা প্রয়োজনের তীব্রতার ভিত্তিতে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বরাদ্দবণ্টন করা হচ্ছে কিনা তা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা।
২. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা মনিটর করা। তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী ত্রাণ বিষয়ক তথ্য পেতে মানুষকে সহযোগিতা করা। ত্রাণের অনিয়ম নিয়ে যারা প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, কথা বলছে তাদের নানাসূত্রে হয়রানির বিরুদ্ধে আইনী সহায়তা দেওয়া।
৩। সমতল, পাহাড়, জলাঞ্চল, বনাঞ্চল, ভাসমান, ছিন্নমূল, বস্তিবাসী, কর্মহীন, নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, শহরাঞ্চল, গ্রামাঞ্চল ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রেখে ত্রাণ বরাদ্দ ও বরাদ্দ-বণ্টন পরিকল্পনা করা হচ্ছে কিনা তা মনিটর করা এবং এ বিষয়ে সুপারিশ করা।
৪। ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ও প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা।
৫। স্থানীয়ভাবে সারাদেশে যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে বিভিন্ন নামে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, তাদের মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টা করা এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা।
৬। ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও তছরুফের তথ্য সংগ্রহ করা, এগুলো দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের জানানো এবং থামানোর জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে অনুরোধ করা।
৭। ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও তছরুফ থামাতে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের আইনী ও অন্যান্য পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা।
৮। স্থানীয়ভাবে সারাদেশে এই কমিটির অনুরূপ কমিটি গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করা এবং কোথাও অনুরূপ কমিটি গড়ে উঠলে তাদের সাথে নিয়মিত বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ রক্ষা করা।
৯। যে কোনো উপায়ে মানবিক বিপর্যয় বা দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি প্রতিরোধে যা করণীয় তা করা।
জেলাভিত্তিক সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত যতটুকু চাল, নগদ অর্থ ও শিশুখাদ্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তার তথ্য বিশ্লেষণ করে কমিটি বলছে যে জেলায় দরিদ্র মানুষের হার যতো বেশী সেই জেলায় সরকারের চাল ও অর্থ বরাদ্দ ততো কম। তাদের অনুসিদ্ধান্তগুলো হলো:
১. এখন পর্যন্ত সরকারের বরাদ্দ আদেশ অনুযায়ী (২৩শে এপ্রিল ২০২০) সারাদেশের ৬৪টি জেলায় মোট ৯৪ হাজার ৬শো ৬৭ মেট্রিক টন চাল, ৩৯ কোটি ৪১ লক্ষ ৭২ হাজার ২ শো ৬৪ নগদ টাকা এবং শিশুখাদ্য ক্রয় বাবদ ৭ কোটি ৯৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
২. সরকারের চাল ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী ৩৬ টাকা কেজি ধরলে ২৩ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার জন্য সর্বমোট চাল, অর্থ ও শিশুখাদ্য বাবদ ত্রাণ বরাদ্দ মাত্র ৩৮৮ কোটি ১৫ লক্ষ ৮৪ হাজার ২ শো ৬৪ টাকা।
৩. ২০১৬ সালে কয়েক শত কোটি টাকা খরচ করে যে খানা জরিপ করা হয়েছিল তাতে যে জেলাওয়ারী দরিদ্র ও চরম দরিদ্র মানুষের হার পাওয়া গিয়েছিল তা ত্রাণ ও অর্থ বরাদ্দের সময় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। যে জেলায় দরিদ্র মানুষের হার যতো বেশী সেই জেলায় চাল ও অর্থ বরাদ্দ ততো কম। যেমন বর্তমানে দরিদ্র মানুষের হার সবচেয়ে বেশী কুড়িগ্রাম জেলায় এবং সবচেয়ে কম নারায়ণগঞ্জ জেলায়। কিন্তু কুড়িগ্রামে মোট দরিদ্র জনসংখ্যার মাথাপিছু চাল বরাদ্দ ৮৭৪ গ্রাম এবং মাথাপিছু অর্থ বরাদ্দ ৩ টাকা ৮৫ পয়সা। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জে দরিদ্র জনসংখ্যার মাথাপিছু চাল বরাদ্দ ২২ কেজি ৫৫৫ গ্রাম এবং মাথাপিছু অর্থ বরাদ্দ ৮৮ টাকা ১৭ পয়সা।
কুড়িগ্রামের পর দরিদ্র হার বেশী দিনাজপুর জেলায়। সেখানে দরিদ্রদের মাথাপিছু চাল ও টাকা বরাদ্দের পরিমাণ যথাক্রমে ৬৭২ গ্রাম ও ৩ টাক। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের পর দরিদ্রহারে কম হচ্ছে মুন্সীগঞ্জ জেলায়। সেখানে দরিদ্রদের মাথাপিছু চাল ওটাকা বরাদ্দের পরিমাণ যথাক্রমে ২১ কেজি ৫১৭ গ্রাম ও ৯৫ টাকা ৮৩ পয়সা।
৪. রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে যেসব অঞ্চলের মানুষের প্রাধান্য রয়েছে এর সাথে বাংলাদেশের জেলাগুলোর দরিদ্রহার কম-বেশী থাকার একটা সম্পর্ক অল্প-বিস্তর আছে। ত্রাণ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও এটার ছাপ স্পষ্ট, যা দুর্যোগকে আরো বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে।
এসব অনুসিদধান্তকে বিবেচনা করে কমিটি এই মুহূর্তে ৫টি সুপারিশ করছে। এগুলো হলো:
১. সকল বরাদ্দ হতে হবে প্রান্তিক জনসংখ্যার ভিত্তিতে। শারীরিক দূরত্ব, দুর্নীতিরোধ, প্রয়োজন ইত্যাদি মাথায় রেখে বিবিএস-এর খানা জরিপের ভিত্তিতে দরিদ্র এবং কর্মহীন প্রতিটি পরিবারকে একবারে ৩০ কেজি চাল এবং নগদ ১০ হাজার টাকা মোবাইলের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে হবে। যতদিন দুর্যোগ থাকবে প্রত্যেক মাসে এটা অব্যাহত রাখতে হবে। এর জন্য খাদ্য গুদামের চাল দ্রুত বণ্টন করে চলমান বোরো মৌসুমে ৫০ লাখ মেট্রিক টন ধান ও ২৫ লক্ষ মেট্রিক টন চাল ক্রয় করতে হবে। স্কুল-কলেজের মিলনায়তনগুলোকে গুদাম হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। বার্ষিক উন্নয়ন খাতে জরুরী নয় এমন সকল বরাদ্দ ও ছাড় স্থগিত করতে হবে।
২. প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ভাসমান মানুষ, উপকূলীয় জনগোষ্ঠী, যাদের অনেকেরই জাতীয় পরিচয়পত্র নাই, যাদের তথ্য খানাজরিপেও নাই, তাদের কথা বিশেষভাবে ভাবতে হবে। লকডাউনের কারণে নতুন করে যারা দারিদ্র্যসীমার নীচে নেমে এসেছেন তাদের হিসাব করতে হবে।
৩. ত্রাণ সহায়তা বিতরণে সকল রকমের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি দূর করতে হবে। এর জন্য মিডিয়া ও সোসাল মিডিয়ার উপর থেকে অন্যায় খবরদারী প্রত্যাহার করতে হবে, যাতে করে যে কোনো ধরণের অনিয়মের চিত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত পেতে পারেন।
৪. এসময় ধান, সবজি ও ফলের মৌসুম। এগুলোর উত্তোলন ও সরবরাহ চ্যানেল সম্পূর্ণ নির্বিঘ্ন ও হয়রানি মুক্ত করতে হবে। দুধ-ডিম-পোলট্রির উৎপাদন ও সরবরাহ চ্যানেল স্বাভাবিক করতে হবে।
৫. মানুষের মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। তার মৌলিক, মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।
জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, সমন্বয়ক
রাখাল রাহা, সদস্য সচিব
আজকের অনলাইন সংবাদ সম্মেলন ও ত্রাণ প্রতিবেদন উপস্থাপন আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন:
হাসনাত কাইয়ূম
প্রফেসর সাঈদ ফেরদৌস
শহীদুল আলম
হাসিবউদ্দিন হোসেন
কাজী জাহেদ ইকবাল
প্রফেসর নাসির আহমেদ
জাকির হোসেন
গওহার নঈম ওয়ারা
মোহাম্মদ তানজিমউদ্দিন খান
দীপক কুমার গোস্বামী
মাহা মির্জা
আর রাজী
নুরুলহক নুর
আখতার হোসেন
বাকী বিল্লাহ
দিদারুল ভূঁইয়া
চারু হক