- রোকন রকি
ক্ষমতাকাঠামো যে রূপেই থাক সে প্রশ্নাতীত থাকতে চায়, সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকতে চায়। সে তার কর্তৃত্বের বৈধতা নিয়ে আত্ম-বিশ্বাসহীনতায় ভোগে। সে জন্যই সমালোচনাকে, প্রশ্নকে সে ভয় পায়। নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে। এই কারণে এরকম কিছু চিন্তা-চেতনার উৎপাদন করতে হয় যে, পরিবারের কর্তা পিতার সমালোচনা করা খারাপ, সমাজে মুরুব্বিয়ানার বা মুরুব্বিদের সমালোচনা করা বেয়াদবি, ধর্মকে প্রশ্ন করলে পাপ হয়, আর রাষ্ট্রের সমালোচনায় হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতা।
কিন্তু সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে, উন্নততর সমাজ কাঠামো নির্মাণের স্বার্থে বিদ্যমান অবস্থার সমস্যা ও অসঙ্গতিকে চিহ্নিত করার কোন বিকল্প নেই। সমালোচনা ঠিক এই কাজটাই করে। এতে বিদ্যমান কাঠামোর অনেক অসঙ্গতি বেরিয়ে পড়ে, জনস্বার্থ বিরোধিতা ফাঁস হয়ে যায়। সেসব কিছুর সঙ্গতি নিশ্চিত করে, জনস্বার্থ-বান্ধব করে তুলে এবং অপ্রয়োজনীয় হলে তার বিলোপ করার মাধ্যমেই সমাজ এগিয়ে যায়। এটাই সামাজিক সজীবতা। সামাজিক সজীবতার প্রথম শর্ত সমালোচনা করার পরিবেশ নিশ্চিত করা। অথচ সকল সামাজিক উন্নয়নের দায়িত্ব নিজ ঘাড়ে নেওয়া রাষ্ট্রকে এর বিপরীত ভূমিকাতেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
চলমান করোনা পরিস্থিতিতে আর সবকিছুর মতো রাষ্ট্রের এই অসহনশীল চরিত্রটাও স্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে। জনগণ যখন প্রত্যক্ষ সঙ্কটের মুখে পড়েছে, যখন রাষ্ট্র প্রতিশ্রুত দায়িত্ব পালন করছে না, তখন ভুক্তভোগী জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতার সমালোচনা করা খুবই স্বাভাবিক এবং সেটা তার অধিকার। রাষ্ট্র নাগরিক মৌলিক অধিকার পূরণে অসমর্থ হলেও তার সামগ্রিক অব্যবস্থাপনাকে আড়াল করতে এ নিয়ে করা যাবতীয় সমালোচনাকে দমন করছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮’কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। সমালোচনাকে অভিযুক্ত করছে রাষ্ট্রের ‘ভাবমূর্তি’ বিরোধী ও রাষ্ট্রীয় পদের ‘মানসম্মান’ বিরোধী হিসেবে। রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা ও ভাবাদর্শের খুবই স্থূল রূপ ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ও ’মানহানি’। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে এই প্রপঞ্চকেই করা হয়েছে সহিসং। রাষ্ট্র আশ্রয় নিয়েছে লাঠিয়াল বাহিনীর পেশির জোরের কাছে।
রাষ্ট্র ও তার প্রতিনিধিরা যখন সমালোচনাকে দমন করার জন্য ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’– এর মতো মানুষের শ্বাসরোধী একটা আইন প্রণয়ন করে তখন আসলে তার জীবন ও মানবতা বিরোধী চরিত্রটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রকে প্রশ্নাতীত ও সমালোচনার ঊর্ধ্বে একটা পবিত্র সংস্থা হিসেবে হাজির করার মাধ্যমে পূর্বের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতিচ্ছবিকে দৃশ্যমান করে। এই আইনের বিধান গুলো কোন রকম রাখঢাক ছাড়াই এই উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট ভাবে আমাদের সামনে হাজির করে।
এই আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, যদি অন্য কোন আইনের সাথে এই আইনের কোন বিধান বা তার অংশ অসমঞ্জস হয় তাহলে সে অংশের ক্ষেত্রে এই আইনের বিধান কার্যকর থাকবে। অর্থাৎ শুরুতেই এই আইনকে আর সব আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান দিয়েছে। শুরুতেই বলে দিয়েছে অন্য কোন আইনে যদি কোন ধরনের অধিকার রাষ্ট্র নাগরিককে দিয়েও থাকে তাহলেও এই আইনে সেগুলো লঙ্ঘনের বিধান থাকলে সে সব অধিকার এই আইন বলে লঙ্ঘিত হতে পারে। ব্যতিক্রম শুধু তথ্য অধিকার আইন।
রাষ্ট্র যেহেতু জনগণের জন্য কাজ করার কথা বলে সেহেতু রাষ্ট্রের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য জানার অধিকার জনগণের আছে। কিন্তু এই আইনের ১৫ ধারা মোতাবেক রাষ্ট্র কোন কম্পিউটার সিস্টেম, নেটওয়ার্ক বা তথ্য কাঠামোকে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ হিসেবে ঘোষণার করতে পারবে। একই সঙ্গে এসব পরিকাঠামোতে প্রবেশকে বেআইনি এবং দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে। আইনে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে এভাবে: বাহ্যিক বা ভার্চুয়াল তথ্য পরিকাঠামো যা কোনো তথ্য-উপাত্ত বা কোনো ইলেকট্রনিক তথ্য নিয়ন্ত্রণ, প্রক্রিয়াকরণ, সঞ্চারণ বা সংরক্ষণ করে এবং যা ক্ষতিগ্রস্ত বা সংকটাপন্ন হলে জননিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বা জনস্বাস্থ্য, জাতীয় নিরাপত্তা বা রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বা সার্বভৌমত্বের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।
আপাত দৃষ্টিতে এই সংজ্ঞায়নে গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো বলতে সামরিক বা প্রতিরক্ষামূলক বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কিন্তু আদতে পুরোটা তা নয়। ‘জননিরাপত্তা’ ‘রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা’ বা ‘সার্বভৌমত্ব’ শব্দসমূহের প্রয়োগ অসামরিকও। আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র তার যাবতীয় গণবিরোধী তৎপরতাকে আড়াল করতে আসলে এসব শব্দরই ব্যবহার করেছে। ন্যায্য আন্দোলন-বিক্ষোভ প্রদর্শন ইত্যাদিকে রাষ্ট্র জননিরাপত্তা বিরোধী হিসেবে দেখে। কোন জাতিসত্তার আত্মপরিচয় বা স্বায়ত্তশাসন দাবিকে অখণ্ডতা বিরোধী হিসেবে দেখে। আবার দেশের অভ্যন্তরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য সংগ্রহ এবং এসব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা ফোরামে তুলে ধরাকে অতীতে সার্বভৌমত্ব বিরোধী হিসেবে গণ্য করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলাও হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’ হিসেবে ঘোষণা করে বিভিন্ন গণবিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং নীতিসমূহকে আড়াল করার সুযোগ অবারিত করা হয়েছে। আদতে এটা রাষ্ট্রের সিক্রেসি কালচারকেই অনেক বেশি নিরঙ্কুশ করবে।
এর পরে ২১ ধারার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোন ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক সমালোচনাকেও অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। প্রথমে একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই বিষয়গুলোকে জনমানসে অত্যধিক সংবেদনশীলভাবে চিত্রায়ন এবং পরবর্তীতে আইন করে এগুলো নিয়ে কোন ধরনের ভিন্ন মতামত ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা, সমালোচনার পথকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা সর্বজন স্বীকৃত যে, বিদ্যায়তনিক চর্চায় কোন কিছুকেই সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখা যায় না, যে কোন কিছুই সমালোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলার মানুষের ইতিহাসে একটা ঐতিহাসিক কালপর্ব। সেই সময়ের প্রকৃত ঘটনা জানতে ইতিহাস পাঠে ও রচনায় সর্বদা নির্মোহ থাকার বিকল্প নেই। আবার মুক্তিযুদ্ধের মতো কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ঐতিহাসিক পুনর্মূল্যায়ন শতাধিক বছর পরেও প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়নে, পাঠে ও রচনায় অনেক সময়ই একাধিক দৃশ্যকল্প, বয়ান ও বাস্তবতা এসে হাজির হয়। শাসকের ব্যাখ্যার খাপে না আঁটলে তাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার সুযোগ এই আইনে আছে। সুতরাং এই বিধান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও রাষ্ট্রের নির্ধারিত বিষয় না। মুক্তিকামী জনতা কোন মুক্তির চেতনা থেকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তা সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভের বাইরে জনগণের মাঝে বিচার, বিশ্লেষণ ও মতামত থাকা খুবই স্বাভাবিক। কোন ন্যারেটিভকে কনক্লুসিভ ভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা সত্য উদ্ঘাটনের ও উপস্থাপনের পথকে বাধা দেয়।
যেকোনো ঐতিহাসিক চরিত্রর ঐতিহাসিক ভূমিকার পুনর্মূল্যায়ন, পাঠ ও রচনা হতে পারে এবং এক্ষেত্রে ভিন্নমতকে আইন কানুন দণ্ডবিধি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা অর্থডক্সির মতই এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যতার পরিচয়। ‘জাতিরজনক’ ধারণাটির সঙ্গে বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধ আছে। জাতিবাদ/জাতিরাষ্ট্র ধারণার পাটাতনে দাঁড়িয়েই এই বিরোধ। যিনি জাতিরাষ্ট্র মানেন না তিনি জাতির জনক ধারণাটা মানবেন কেন? ফলে শেখ মুজিবকে জাতির জনক হিসেবে মানা না মানার তর্ক এটি নয়। আদতে কোন সমাজতান্ত্রিক দেশেই ‘জাতির পিতা’ ধারণাটি নেই।
বিদ্যায়তনিক আলোচনায় খোদ জাতির পিতা ধারণা ও একে আশ্রয় করে কাল্ট নির্মাণের সমালোচনা বহুল প্রচলিত। অনেকটা একই ধরনের সমালোচনা জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা নিয়েও আছে। ঈশ্বর কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থায় শাসকের অস্তিত্বের পেছনে প্রশ্নাতীত ঈশ্বরকে মূর্ত করার প্রয়োজন পড়তো। ঠিক একই ভাবে জাতিরাষ্ট্রে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের পেছনে প্রশ্নাতীত জাতীয় ঐতিহ্যের প্রয়োজন পড়ে। এই ঐতিহ্যগুলোকে জনমানসে জাতীয় শ্রেষ্ঠত্বের ভাবাবেগ উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। এগুলো সম্পর্কে সংবেদনশীল করে তোলা হয় যাতে তা প্রশ্নাতীত অবস্থায় থাকে। এভাবে প্রশ্নাতীত করা মানেই বরং রাষ্ট্রীয় সর্বাত্মক স্বৈরতন্ত্রকে নিরঙ্কুশ করা।
ধারা ২৫’এ দেখা যায় রাষ্ট্র তার ভাবমূর্তি ও সুনামের সুরক্ষা নিয়ে খুবই চিন্তিত। অথচ রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি জিনিসটা কী সে বিষয়ে কোন পরিষ্কার ধারণা আইনে দেওয়া হয়নি। একটা অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য শব্দকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে করা সমালোচনাকে দমনে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের তরফ থেকে এই ভাবমূর্তির কোন স্পষ্ট সংজ্ঞায়ন না থাকলেও এ যে অত্যন্ত ভঙ্গুর তা বোঝা যায়। দুই কথার ফেসবুক পোস্টেই এই ভাবমূর্তি আঘাতপ্রাপ্ত হতে এবং এই বিধানের প্রয়োগ হতে দেখা যায়। যা রাষ্ট্রের অসহনশীল চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। আর সুনাম জিনিসটাই অপরের মতামত সাপেক্ষ। নিজের সুনাম রক্ষায় অপরের মতামত নির্মাণে তার কাছে সু হিসেবে প্রতীয়মান হতে হয়, খুব বেশি হলে প্রভাবিত করা যায়। কিন্তু জোর জবরদস্তি করে মতামত আদায় করা যায় না। যে সুনাম রক্ষা করতে আইন লাগে, দণ্ডাদেশের ভয় দেখাতে হয় সে সুনামের মাহাত্ম্য নাই। ২৭ ধারায় তো সরাসরি ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তার’ কথা উল্লেখই করে ফেলেছে। রাষ্ট্র তার নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব নিয়ে যে ভয়ে আছে তা এই দুইটা ধারা থেকে বোঝা যায়। তার লেজিটিমেসির দৈন্যতা জনগণের কাছে ফাঁস হওয়ার ভয়ে সে দিশেহারা।
রাষ্ট্রীয় পদের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ রাষ্ট্রেরই অংশ। রাষ্ট্রের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হিসেবে তারা কাজ করেন। ফলে তাদের ও তাদের কর্মকাণ্ডকে নিরাপত্তা দেওয়াও রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই জন্য ২৯ ধারার মানহানির বিধানের বহুল ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার দায়ে দায়ী রাষ্ট্রীয় পদধারী ব্যক্তিদের সম্পর্কে সমালোচনা হতে পারে। রাষ্ট্র নিজেকে সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাহির করে, রাষ্ট্রের পদ সমূহে অধিষ্ঠান ও তার কার্যাবলী সম্পাদনকে জনসেবা নামে প্রচার করে। উল্লেখ্য যে, এই সেবা মিনি-মাঙনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় না। এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে। অর্থাৎ এই সেবা জনগণকে কিনে নিতে হবে এই তার বক্তব্য। কিন্তু জনগণ যার বিনিময় মূল্য হিসেবে পয়সা দিচ্ছে তা যখন না পায় তখন তার সমালোচনা করে, ভৎসনা করে। এর বেশি কিছু করার মেকানিজম যেহেতু এই রাষ্ট্রে তৈরি হয়নি সেহেতু জনগণের এটুকুই করার থাকে। এটাতেও যখন মানহানির নামে বাধা দেয় তখন এই রাষ্ট্রের জনগণের স্বার্থ-বিরোধী চরিত্র প্রকাশ পায়। সুনামের মতোই মানও কোন আইনের ভয়ে দেখিয়ে রক্ষা করার জিনিস না। মান রক্ষা পায় কর্মে। কর্মের সততাই মান সম্মানের রক্ষক।
একটা কালো আইন ভিত্তি করে বিধান করা আইনও কালো আইন হয়। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, ১৯২৩ একটা আগাগোড়া কালো আইন যার উপর ভিত্তি করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা রচিত। এর বিধান গুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে রচিত। জনবিরোধী ব্রিটিশ সরকার এই আইনের মাধ্যমে ডিজিটাল মাধ্যমের ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কাঠামো’র মতো ‘নিষিদ্ধ স্থান’ নির্ধারণ করে সে জায়গার কার্যক্রম জনসম্মুখে আনাকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছে; বিদেশি এজেন্টের মাধ্যমে খরব সংগ্রহ করাকে অবৈধ করেছে; গোপনে প্রাপ্ত কোন সংবাদ প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে নির্ধারণ করেছে এবং এই সব কিছুর জন্য প্রতিবেদক, সম্পাদক, মুদ্রাকর এবং প্রকাশকে অপরাধী করা হবে বলে হুমকি দিয়েছে। সেই কুখ্যাত ব্রিটিশ সরকার এবং আজকের মহান বাংলাদেশ সরকার কোন তথ্য প্রকাশে ভয় পায়? তারা জনগণের কাছ থেকে কোন তথ্য গোপন করতে চায়? কেন চায়?
শুধু এই ধারাই নয়। উপরে উল্লেখিত প্রত্যেকটি ধারাই সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে, স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। এর উদ্দেশ্যও খুব স্পষ্ট। এই সরকার-কাঠামোতে জনগণের হাতে রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার কোন ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সেবা বিক্রয়ের প্রতিশ্রুতিতে গড়ে ওঠা একটা সংগঠন বিক্রয় মূল্য নিয়ে তার সেবা দায়িত্ব কার্যক্রম কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় কতটুকু পালন করছে তার অনুসন্ধান করার উন্নত এবং অনেকাংশেই প্রধান মাধ্যম স্বাধীন সাংবাদিকতা। স্বাধীন সাংবাদিকতাই পারে রাষ্ট্রকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে। খোদ রাষ্ট্রই যখন সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে হরণ করতে চায় তখন সে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুসারেই জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে উঠতে চায়। সাংবাদিকতায়, সমালোচনায় সীমা নির্ধারণের মাধ্যমে সীমাহীন হঠকারী হয়ে উঠতে চায়।
এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে মানুষের প্রাইভেসির অধিকারকে পর্যন্ত হরণ করার ক্ষমতা দিয়েছে। এই আইনের ৪১ ধারার মাধ্যমে তদন্তকারী কর্মকর্তা যে কোন কম্পিউটার বা ডিজিটাল ডিভাইস অথবা ডিজিটাল ফরমেটে সংরক্ষিত কোন তথ্য উপাত্ত চাইলেই নিজ অধিকারে নিতে পারে। শুধু তাই নয় কোন ব্যক্তি বা সংস্থার অর্থাৎ কোন সিম কোম্পানি, ফেসবুক, গুগোল বা অন্য যে কোন অনলাইন সেবাদানকরি সংস্থার থেকে আইনত ভাবে তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এখন এই ডিজিটালাইজড সময়ে মানুষের ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ও তথ্য আদান প্রদানের একটা বড় অংশই ঘটে ডিজিটাল ওয়েতে। আইন করে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এইসব কিছু দখলে নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির প্রাইভেসির অধিকার লঙ্ঘন হয়। প্রাইভেসি মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার এবং আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত অধিকার। ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটসের আর্টিকেল ১২ এবং ইন্টারন্যাশনাল কোভেনেন্ট অন সিভিল এন্ড পলিটিক্যাল রাইটসের আর্টিকেল ১৭ এই প্রাইভেসির অধিকারকে স্বীকার করে এবং নিশ্চিত করার কথা বলে। রাষ্ট্রের এই ধরনের নজরদারি আন্তর্জাতিক আইন বিরুদ্ধ এবং নৈতিকতা বিরুদ্ধ।
এই আইন পুলিশ অফিসারকে এমন ক্ষমতা দিয়েছে যে কোন অপরাধ হয়েছে বা হচ্ছে এমনটা যদি পুলিশ অফিসার ‘বিশ্বাস করেন’ অথবা কোন অপরাধ হতে পারে বলে ‘বিশ্বাস করেন’ তাহলে পরোয়ানাসহ বা পরোয়ানা ছড়াই যে কোন ডিজিটাল ডিভাইস জব্দ করতে পারবে বা কোন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যেমন সিম কোম্পানি, ফেসবুক, গুগল, ইনিস্টাগ্রামের তথ্য হস্তগত করতে পারবেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪২ ও ৪৩ ধারায় এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটা উপরের আলোচিত প্রাইভেসির অধিকারকে তো লঙ্ঘন করছেই তার চাইতে ভয়ঙ্কর কথা শুধুমাত্র অপরাধ হতে পারে এই ‘বিশ্বাস’ থেকে প্রাইভেসি লঙ্ঘনের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। এবং এরকম কোন বিশ্বাসের মাধ্যমে যদি কারো প্রাইভেসি লঙ্ঘন করে এবং যদি দেখা যায় বিশ্বাসটা ভুল ছিল তাহলে দায়িত্বপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তার বিশ্বাসটাকে সরল বিশ্বাস হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। এই আইনের ৫৭ ধারার বিধান এই কথাই বলছে। এই ধারা মতে এরকম বিশ্বাসের ফলে যদি কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোন দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোন আইনগত কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না। এর অর্থ প্রতিটা মানুষ, প্রত্যেকেই এমন ভালনারেবল অবস্থায় আছে যে তার ব্যক্তিগত ব্যবহার্য কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ফোনের মাধ্যমে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোন ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য আদান প্রদান বা ব্যক্তিগত কথাবার্তা সব কিছুর দখল নেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের আছে।
৪৬ ধারায় বলছে কোন ব্যক্তি বা কোন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের (সিম কোম্পানি, ফেসবুক, গুগল, ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি) কাছে তদন্ত কর্মকর্তা তথ্য চাইলে সেটা প্রদান করতে সেই ব্যক্তি বা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাধ্য থাকবে। এর পরের ধারা ৪৭-এ বলছে এভাবে তথ্য সরবরাহ করার জন্য কোন ব্যক্তি বা সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না এবং তেমন কোন উদ্যোগ নিলে তা অপরাধ হবে ও তার জন্য দণ্ডের ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও বলছে এই যে, নজরদারিটা তারা করবে, আপনার আমার সব ধরনের তথ্য তারা নিবে এই কার্যক্রমে কে, কোন জায়গা থেকে, কি কি তথ্য নিচ্ছে তাও গোপন রাখতে হবে। অর্থাৎ আমাদের সবার তথ্য যে রাষ্ট্র নিবে এ নিয়ে রাষ্ট্র তো আমাদের জানাবেই না, যার কাছ থেকে নিচ্ছে সেও জানাতে পারবে না এবং কোন ধরনের তথ্য নেওয়া হচ্ছে তাও জনগণকে জানতে দেওয়া যাবে না। এই নির্দেশ লঙ্ঘন করলে তা অপরাধ হবে এবং দণ্ড ভোগ করতে হবে। আইন করে এই ধরনের গোপন নজরদারির ব্যবস্থা রাষ্ট্রের যাবতীয় ভালো মানুষীর মুখোশকে আলগা করে দেয়। রাষ্ট্রের নিপীড়ক রূপ উন্মোচিত হয়ে পড়ে।
সমালোচনাকে দমন করতে, বিরুদ্ধ মতকে দমন করতে, রাষ্ট্রের জবাবদিহি পরিস্থিতিকে নষ্ট করতে, ভাবমূর্তি ও মান সম্মান ধরে রাখতে, নিজের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করতে, প্রাইভেসি লঙ্ঘন করতে যে সমস্ত কাজ গুলোকে অপরাধ হিসেবে এই আইনে চিহ্নিত করেছে তার দুই একটা বাদে অধিকাংশই আমলযোগ্য এবং অ-জামিনযোগ্য অপরাধ হিসেবে নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ কাউকে যদি এই অনৈতিক কালো আইনের এই কালো বিধান গুলোতে অভিযুক্ত করা যায় তাহলে কোন পুলিশ কর্মকর্তা কোন ধরনের পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারবে এবং কোন বিশেষ কারণ ছাড়া তার জামিন হবে না। রাষ্ট্র যদি সত্যই জনবান্ধব হতো তাহলে তার নিজের নাগরিকের বিপরীতে নিজের নিরাপত্তা জন্য এইসব বিধান করার প্রয়োজন পড়তো না।
একটা রাষ্ট্র যখন তার নিজের নাগরিকের কাছে নিজেকে অনিরাপদ মনে করে, নাগরিকদের সমালোচনা, কথাবার্তা নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে তখন সেই রাষ্ট্র টিকে থাকার সব ধরনের গ্রহণযোগ্যতা হারায়। মুখোশের আড়ালে ভালো মানুষীর ছদ্মবেশে বা ছেলে ভোলানো গানেও যখন নাগরিককে নিজের প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝাতে পারার মতো পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র থাকে না তখন তার অস্তিত্ব রক্ষায়, নিজের নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালা কানুন প্রণয়নের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এই দমন- নিপীড়ন দিয়ে শেষ রক্ষা হয় না। রাষ্ট্র যত তার হিংস্র রূপ নিয়ে হাজির হয়, মানুষ তত তার প্রতিরোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ক্ষেত্রেও তেমনটাই দেখা যাচ্ছে। করোনা-কালীন রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার উন্মোচনে সমালোচনায় সরব মানুষজনের এই আইনের সাহায্যে যত মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করছে ততই এই আইনের লঙ্ঘনে মানুষ মেতে উঠছে। এটাই প্রতিবাদের ভাষা। অনৈতিক এই কালো আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মানুষ তার সমালোচনা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ জারি রাখছে। আজ শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ এই আইনের বিরোধিতা করছে। এই গণবিরোধী রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্র এই গণ-জোয়ারকে এড়িয়ে যেতে পারবে না।
- রোকন রকি: লেখক ও অনুবাদক। পড়াশোনা করেছেন আইন বিষয়ে। সম্পাদনা করেছেন ‘পার্টি অফিস’ নামক একটি ছোট কাগজ।
[প্রবন্ধটি পূর্বে ‘অরাজ‘-এ প্রকাশিত হয়েছিল]