রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ থেকে আমরা প্রথমেই বলতে চাই, মানুষের কথা বলার অধিকার রাষ্ট্র সৃষ্টি করে নাই, রাষ্ট্র তা কাড়তেও পারেনা। বরং মানুষ রাষ্ট্র সৃষ্টি করে এইসব অধিকার নির্বিঘ্নে ভোগ করার জন্য।
সম্প্রতি এই অধিকার কেড়ে নিয়ে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজাম মুনিরাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার, কারাগারে প্রেরণ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহির চৌধুরীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জি কে সাদিককে ফেসবুক পোস্টের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক বহিষ্কার এবং সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদুর রহমানের নামে একই আইনে মামলা দিয়ে গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার থেকে গ্রেফতারের যে ঘটনা সরকার ও তার অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঘটিয়েছে তাতে রাষ্ট্রচিন্তা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ।
চারটি ঘটনার ক্ষেত্রেই আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকার ও সরকারি ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য দেখাতে এতটাই মরিয়া যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাধীন মতপ্রকাশ, চিন্তা করবার স্বাধীনতা এবং সমালোচনার ন্যায্য অধিকারের স্বীকৃতি দিতে নারাজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা নিঃসঙ্কোচ মতপ্রকাশ এবং প্রয়োজনে সরকার ও রাষ্ট্রের ভুল, বিপজ্জনক নীতি, দুর্নীতির সমালোচনা করার সমস্ত অধিকার সংরক্ষণ করেন। তাদের এই জ্ঞানগত ও রাজনৈতিক অধিকারের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
কিন্তু আমরা অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি, তথাকথিত ‘মানহানী’, ‘কটূক্তি’র ঠুনকো অভিযোগ এনে উল্লেখিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক মামলা দায়ের করছে, জেলে প্রেরণ করছে এবং বহিষ্কার করছে।
রাষ্ট্রচিন্তা মনে করে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সাংবিধানিকভাবে যে একব্যক্তিকেন্দ্রীক ও জবাবদিহিহীন ক্ষমতাকাঠামো বিরাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানগত ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন আজ তারই বলি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেও সেই একব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতারই উলঙ্গ আস্ফালন চলছে অনেক বছর ধরে।
ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জ্ঞান উৎপাদন ও চর্চার মুক্তাঞ্চল হওয়ার পরিবর্তে অনেক বছর ধরেই এগুলো সরকার অনুগত প্রশাসন ও সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নিপীড়নের কারখানা। সাম্প্রতিক সময়ে এই নির্যাতন-নিপীড়ন এমন স্তরে পৌঁছেছে যার নজির আমাদের ইতিহাসে নেই।
রাষ্ট্রচিন্তা মনে করে, করোনা মহামারির কালে বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় বিপর্যয়ের সম্মুখীন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও সেই একই কারণে তাদের জ্ঞানগত-রাজনৈতিক ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দার্শনিক ও বৌদ্ধিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি দায়বদ্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঘুরে দাঁড়ানো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বাত্মক গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নাই।
রাষ্ট্রচিন্তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বেগম রোকেয়া ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজাম মুনিরা, কাজী জাহিদুর রহমান এবং শাবিপ্রবির শিক্ষার্থী মাহিরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জি কে সাদিককে বহিষ্কারের মতো নজিরবিহীন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায় এবং এহেন প্রশাসনিক স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোকে গণক্ষমতাতন্ত্রে রূপান্তরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের লড়াইয়ের প্রতি দ্ব্যর্থহীন সংহতি প্রকাশ করে নিমোক্ত দাবিদাওয়া সহ আগামী ২২শে জুন সারাদেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি আহ্বান করছে :
• অবিলম্বে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজাম মুনিরা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী জাহিদুর রহমান এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহির চৌধুরীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে।
• ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জি কে সাদিকের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করতে হবে।
• ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে।
• ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সারা দেশে দায়েরকৃত সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। এই আইনে আটক দিদার-কিশোর-কাজল-মোস্তাক সহ সকল বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে।
• গণবিরোধী ও স্বৈরতান্ত্রিক আইন বানানোর সাংবিধানিক ক্ষমতা পাল্টাতে হবে।
রাষ্ট্রচিন্তা