জাতীয় সঙ্গীত বা রবীন্দ্র প্রব্লেম

  • লেখক: বখতিয়ার আহমেদ

বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ইজ ওয়ান অফ দ্য বেস্ট ইন দ্য ওয়র্ল্ড।

নিম্নে লিখিত প্রধান পাঁচটি কারণে:

১) বানীর ভাবে এই গান আমাদের দেশ বা জাতি কল্পনাকে প্রকৃতি-আশ্রয়ী করে তোলে।
উদাহারণ:
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস…/ ও মা ফাগুণে তোর আমের বনে ঘ্রাণে…/ অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে… শোভা কী ছায়া গো…/ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে…

২) এইটা দেশকে অ্যাফিমিনেট করে, মানে দেশকে নারী কল্পনা করে মাতৃভাবে ভজে।
উদাহারণ:
কী স্নেহ, কী মায়া গো–/ কী আঁচল বিছায়েছ…/ মা, তোর মুখের বাণী…
প্রথম ১০ চরণেই ‘মা’ আছে পাঁচ বার, পরের ১৫ চরণ মিলিয়ে মোট দশবার। পুরা গানটাই শৈশব-কৈশোরের সূকোমল মা কল্পনার কথকতায় বোনা।

৩) এইটা ভূপ্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করে কৃষিজ কল্পনা দিয়ে, যা এখনো আমাদের স্মৃতিবোধ বা ইতিহাস কল্পনার সাথে মেলে।
উদাহারণ:
মুখস্ত দশ লাইনের সাথে পরের পনের লাইন মিলিয়ে দেখলে এইটাসহ আগের দুইটা কারণও আরো স্পষ্ট হয়:
“তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিল রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে, মরি হায়, হায় রে
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি।
ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবারখেয়াঘাটে,
সারাদিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,
মরি হায়, হায় রে
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, তোমার রাখাল তোমার চাষি।
ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে
দে গো তোর পায়ের ধূলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।
ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,
মরি হায়, হায় রে
আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ বলে গলার ফাঁসি।”

৪) গানের সুরটি বাউলাঙ্গের, বাংলার ভূমিজ দর্শনের দৈন্যভাব আর মরমী মেলাঙ্কলির হাহাকারটা রবীন্দ্রনাথের আধুনিক বাংলার বাণীতে এসেও অনেক খানি অটুট আছে।
বিশ্লেষণমূলক উদাহারণ:
সুর নিয়ে কথা বাড়াইতে আর সাহস পাচ্ছি না, কারণ আমি মিউজিক্যালি ইল্লিটারেট, মানে সঙ্গীত শাস্ত্রে নিরক্ষর। গান গাওয়ার বেলায় অসূর ও বেসুর। তবে গগণ হরকরার যে গানটির ধাঁচে রবীন্দ্রনাথ এই গানটি রচেছিলেন, সেই গানটির লিরিক্স নিয়ে কয়েকটা কথা পরে বলতে চাই।

৫) এই গানে ম্যাস্কুলিনিটি বা মর্দানি, যুদ্ধ বা মাস্তানি, রাষ্ট্র বা তার সোভ্রেইন, ধর্ম বা জাতিবাদী ভেদবুদ্ধি, কিম্বা প্রাণ-প্রকৃতি-বিনাশী ভোগ-লিপ্সার লেশমাত্র নাই, যা ম্যালা দেশেরই জাতীয় সঙ্গীতে সিনাজুরি করতেছে।
তুলনামূলক উদাহারণ:
একই ইতিহাসের গর্ত থেকে উদ্গত জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে ভারত, শ্রীলংকা, আর পাকিস্থানের উদাহারণ দেয়াটাই সবচে সহজ। পরে অন্য উদ্দেশ্য এই গর্ত খোড়া জাতি হিসেবে ব্রিটেনের জাতীয় সঙ্গীত নিয়াও একটা কথা বলব। আপাতত ভারত দিয়ে শুরু।

ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে রাষ্ট্র কল্পনা বিধাতা/বিধায়ক/ত্রাতা/কান্ডারী বলে অভিহিত এক পুরুষ সোভ্রেইন পাওয়ারের বন্দনায় ভরপুর, প্রজারা দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠলে পরে যার মধ্য একটু মাতৃভাব জাগ্রত হয়। রাত পেরিয়ে সকাল হলেই কনফিডেন্স ফিরে পাওয়া পাব্লিককে আবার সেই অধিনায়কের পায়ে নিশ্চিন্তে মাথা গুঁজে দিতে প্ররোচিত করে এই গানের বানী। এই অধিনায়ক “পঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ/ বিন্ধ্য হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ” সবখানে সকাল-বিকেল তাঁর জয়গাঁথা গাওয়াইতে চায়। এই ভাগ্য-বিধাতা “হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী” সবাইকে নিজের সিংহাসনের চারপাশে দাঁড় করিয়ে পারস্প্রিক প্রেম জাগাইতে চায়। ভারত সাম্রাজ্যের নয়া এক কেয়ারিং সুপ্রিম কমান্ডার কল্পনা আর তার জয় প্রার্থনার এই গীত রণ-সঙ্গীত হিসেবেও খারাপ না। একারণেই বোধহয় জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার আগে গানটি আজাদ হিন্দ ফৌজেই জনপ্রিয় ছিল বেশি।

এদিকে আমাদের রণ-সঙ্গীতটাই বরং ঠিকমত যুদ্ধ করতে চায় না, চেইন অব কমান্ডের চেয়ে এইটা যেন তরুণদের দিয়ে বিপ্লব করানোতেই বেশি উৎসাহী। অনায়াসেই এইটা আমাদের জাতীয় যুব-সঙ্গীতও হইতে পারতো। এই গানে হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামের উচ্ছল কবিস্বত্তা সৈনিকের সুশৃঙ্খল কুচকাওয়াজের ছন্দকেও যে আনন্দে আত্মসাৎ করে তার মধ্যে যুদ্ধের উম্মাদনার রেশমাত্র আমি পাই না। তাছাড়া এই টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিতে যুদ্ধের উম্মাদনা ছড়ানোর জন্য মিউজিক লাগে না, ন্যাশনালিস্ট মিডিয়া যুদ্ধের এই আরো গুরুতর হয়ে যাওয়া দায়িত্ব নিরলসভাবে পালন করে যাচ্ছে অনেকদন ধরেই।

শ্রীলংকারটা আরো ইন্টারেস্টিং! কথিত আছে শান্তি নিকেতনের সিংহলি শিষ্য আনন্দ সামারাকুন, আর গুরু রবীন্দ্রনাথের যৌথ প্রযোজনায় রচিত হয়ে ছিল এই গানের আদি সংস্করণ, খানিকটা প্রথম জনের ফরমায়েসেই। সেখানে দেশ কল্পনায় মাতৃভাব প্রবল হলেও প্রকৃতি যেন শুধু ভোগ আর সম্পদের আধার। ভূমির উপর সোভ্রেইন কায়েমের সেই দখলদারিটাও খানিক উঁকি দেয়। মায়ের কাছ থেকে সকল কল্যাণ নিলেও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা শেষমেষ শক্তিশালি রাষ্ট্র কল্পনাতেই আশ্রয় নেয়। এইটা খানিকটা যেন ‘বাবুর মায়ে’র কাছে বাবুর নয়, ‘বাবুর বাপে’র চাওয়া পাওয়া। ১৯৫০ এর দশকে পর পর দুই নারী রাষ্ট্র-প্রধানের মৃত্যুর কারণে এই বাপেরা গানটার উপরেই খেপলেন। ১৯৬১ সালে প্রথম লাইনের নমস্কার থেকে ‘মাতা’কে হটিয়ে ‘শ্রীলংকা’কে আগে বসিয়ে দিলেন সরকার। সেই রাগে-দুঃখেই নাকি আনন্দ সামারাকুন পরের বছর আত্মহত্যাই করে বসলেন।

পাকিস্থানের জাতীয় সঙ্গীতে মা নিয়ে কোন হিপোক্রেসি নাই। এইটা জাস্ট রাষ্ট্রের বর্ডার আর ভূমি সুরক্ষিত রেখে আনন্দে থাকার সংকল্প ব্যক্ত করে, ব্রাদারহুড আর ডিসিপ্লিন দিয়া শক্ত রাষ্ট্র গড়তে চায়, উন্নয়ন আর উৎকর্ষ চায়, অত্যুত্তম পরমেশ্বরের ছায়ায় প্রাচূর্য্যর মধ্যে আরামে থাকতে চায়। পাকিস্থানের সামরিক এলিটতন্ত্রকে এই আরামে রাখতে না রাখতে চাওয়াও একাত্তরে এমন মূল্যই আমাদের চুকাইতে হইল যে ‘পাক-সার-জমিন-সাদ-বাদে’র ভূত এখনো আমাদের সহজ-সরল প্রথাবিরোধী বুদ্ধিজীবিদের তাড়া করে ফেরে।

তো, র‍্যাংকিং সিস্টেম না থাকায় আমাদের জাতীয় সঙ্গীত সাকিব আল-হাসানের মতন বিশ্বসেরা কিনা সেটা নিশ্চিত না হলেও অন্তত; দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে যে সেরা এই বিষয়ে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। এমনকি উপরের চারটা রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতের কমপক্ষে আড়াইটা একই লোক, মানে রবীন্দ্র-রচিত হওয়া স্বত্ত্বেও। রবীন্দ্রনাথকে আপনার অপছন্দ হইতেই পারে, তার কল্পনা পশ্চিমা হইতে পারে, জমিদারের কল্পনা হইতে পারে, তাঁর ইসলাম ইগ্নোর করার কারণেও আপনি ক্ষেপতে পারেন, আজকের কলকাতা নিবাসী বাংলাভাষী বুদ্ধিবৃত্তি বা তাঁর এপারের সেবকদের উপর ক্ষেপেও আপনি উনাকে গালি দিতে পারেন, তাঁর নাম কুঞ্চিত করে লিখে বিদ্রুপ বা বিদ্বেষ দেখাতে পারেন, তার সুরের জাতীয় সঙ্গীত কানে ঢুকলে নাক বা ভুরু কুঁচকাইতে পারেন। কিন্তু তুলনামূলক বিচারে যে ‘আমার সোনার বাংলা’ই সেরা, সেইটা আপনাকে মানতেই হবে। কারণ ‘দেশ’ শব্দটা সবচে সহজ ও সেন্সিবল অর্থে মানুষের সাথে তার ভূ-প্রকৃতি আর প্রতিবেশের তাবৎ সম্পর্ককে এক নামে প্রকাশ করে।

যা হোক, রবীন্দ্রনাথ বা তাঁর রচা জাতীয় সঙ্গীত নিয়া খানিক প্রব্লেম আমারো আছে। সেইটাও একটু বলি:

১) আমার প্রথম প্রব্লেম হচ্ছে জাতীয় সঙ্গীত কেন একটা হবে? কেন আমাদের জাতি বা রাষ্ট্র কল্পনাকে শুধু একটা করে ফল-ফুল-পাখি-মাছ-কবি-অধ্যাপক কিংবা চিড়িয়াখানাকে প্রতীক বানিয়ে বেঁধে রাখতে হবে? কেন আমাদের জাতিবোধ শুধু একটি গানের সুর-বানী-ছন্দ মত্থিত ভাবাবেগে সীমিত থাকবে? জাতির মতন এত বড়, বিচিত্র আর জটিল একটা কল্পিত যৌথস্বত্তা কীভাবে আদিম কৌম সমাজের আদলে টোটেমিক কল্পনায় বিভোর থাকবে? কেন এই প্রতীকগুলো আইন দিয়ে বলবৎ করতে হবে? কেন এই সিম্বলিক মনোপলি? রাষ্ট্র কল্পনার নামে কেন এই একেশ্বরবাদের মতন জাতিবাদ তৈরী হয়? ধর্ম তো সমাজের আত্মিক মুক্তি আর সংহতি সাধণের বিশ্বাসী পথ। রাষ্ট্রের মতন দুনিয়াবি বন্দোবস্ত কেন এই নিশানগুলান ব্যবহার করবে?

২) করবে বা করে কারণ জাতিবাদী কল্পনা খুব একটা বৈচিত্র-বান্ধব না। ভৌগলিক সীমানার মতই সাংস্কৃতিক ভেদবুদ্ধি ছাড়া জাতি কল্পনা সরকার বা রাষ্ট্রের যুৎ মতন দাঁড়ায় না। শাসন-প্রকৌশলের জন্যও বৈচিত্র জিনিসটা খুব প্রব্লেমটিক। কাজেই রাষ্ট্র মাত্রই সবকিছুর স্ট্যান্ডার্ড বা মান-রূপ তৈরী করে, তারপর তাঁর আদলে বাদ-বাকীদের ‘মেইনস্ট্রিম’ করবার চেষ্টা করে। খাজনা আদায় থেকে শুরু করে শাস্তি বা শিক্ষা দেয়ার পর্যন্ত সবখানেই রাষ্ট্রের একটা মানরূপ বা মানচিত্র লাগে। সেইটা না থাকলে জোগাড় করে নিতে হয়, আমাদের পহেলা বৈশাখ কিম্বা শ্রীলংকার জাতীয় সঙ্গীতের মতন।

৩) কাজেই জাতীয় সঙ্গীতের জন্য রবীন্দ্রনাথকে দোষানোতে আরাম যত আছে যুক্তি তত নাই, এমনকি সেটা বঙ্গভঙ্গের সাথে ‘আমার সোনার বাংলা’র ঐতিহাসিক রেফারেন্সে করলেও। তিনটা দেশ যে লোকের কাছে জাতীয় সঙ্গীত নিতে পারে সে লোকের পক্ষে জাতিবাদী হওয়া কঠিন। কিন্তু প্রশ্ন করা যেতেই পারে তিনটা হবু বা শিশু রাষ্ট্রকে যখন জাতিভাবের প্রধাণতম প্রতীকের জন্য একই লোকের শরণাপন্ন হতে হয় তখন এই জাতি হইতে চাওয়া জাতিগুলার কল্পনার শক্তি বা দৌড় কতদুর সেটা পরিষ্কার দেখা যায়। ফলে তাদের একাংশ তিনি মরার পরে তার গান ‘জাতীয়’ বানিয়ে তাঁকে মাথায় তুলে নাচে, আরেকাংশ এই নাচনে অতীষ্ট হয়ে তাঁকেই গালি দিয়ে একই অক্ষমতার খেদ মিটায়।

৪) এই ধরণের জাতিবাদী গালাগালি বা গোলাগুলির প্রথম ভিকটিম গণতন্ত্র বা ন্যায়বিচার। মনপোলিক জাতিবাদের জিগিরে চাপা পড়ে এসব। জাতিবাদ জোরদার হলে গণতন্ত্র কমজোর হয়, গণতন্ত্র গুম করার ক্ষয়ক্ষতি সরকারেরা আরো জোরদার জাতিবাদ দিয়া পোষাইতে চায়। তখন জাতিবাদের বেদীগুলান তার পুরোহিত আর পুজারিদের কাছে পবিত্র থেকে পবিত্রতর হইতে থাকে, আর আরো বেশি প্রফেন বা নাপাকের ভয়ে তটস্থ থাকে। এক খ্যাপাটে রকস্টার রবীন্দ্রনাথের গান সুর বদলে গাইলে একদল গেল গেল রব তোলে। সদ্য পাওয়া স্টারডোমে খেই হারিয়ে এক সদ্য তরুণ জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে অস্পষ্ট কি একটা বলতেই এইসব কাঁচের বেদীতে চিড় ধরে যায়, সেবকেরা সব রিখটার স্কেলে তার প্রতিক্রিয়া করেন।

৫) আবার কোথাও গণতন্ত্র আর ন্যায়-বিচার জোরদার হলে জাতিবাদ চিপায় পড়ে। প্রকাশ্য ট্রলের শিকার হইলেও মিন মিন করা ছাড়া কিছু করার থাকে না। যেমন, শেষ উদাহারণঃ ব্রিটেনের জাতীয় সঙ্গীত, ‘গড সেভ দ্য কুইন’ এর সার্কাস্টিক সংস্করণ করল এক বেয়াদপ রক ব্যান্ড ‘সেক্স পিস্তল’। তারা গাইলো, ‘গড সেইভ দি কুইন, দ্য ফ্যাসিস্ট রেজিম’:
God save the queen/ The fascist regime/
They made you a moron/ A potential H bomb
God save the queen/ She’s not a human being
and There’s no future/ And England’s dreaming
Don’t be told what you want/ Don’t be told what you need
There’s no future/ No future
No future for you/ God save the queen
We mean it man/ We love our queen
God saves/ God save the queen
‘Cause tourists are money/ And our figurehead
Is not what she seems/ Oh God save history
God save your mad parade/ Oh Lord God have mercy
All crimes are paid/ Oh when there’s no future
How can there be sin/ We’re the flowers
In the dustbin/ We’re the poison
In your human machine/ We’re the…

অদ্ভূত ব্যাপার হচ্ছে রানী এলিজাবেথের রাজত্বের রজত জয়ন্তীতে রিলিজড হইলেও প্রথমে এই গানের দায়ে তারা জেলও খাটেন নাই, মামলাও খান নাই, মাইরও খান নাই। শুধু ১৯৭৭ সালের ৭ জুন জয়ন্তী উৎসবের মাঝেই টেমস নদীতে এলিজাবেথ নামে জাহাজে চড়ে ওয়েবমিনিস্টার প্রাসাদের সামনে এই গান গাইতে গেলে পুলিশ গ্রেপ্তার করছিল, সংক্ষিপ্ত হাজতবাস ঘটছিল ১১ জনের। গানটা বিবিসি’র মত কিছু বনেদি মিডিয়া স্বপ্রণোদিত হয়ে নিষিদ্ধ করলেও ব্রিটিশ সরকার করেনি। টপ চার্টে ছিল অনেক দিন, রক ইতিহাসে অমরত্বও পেয়ে গেছে এই গান, ২০০২ এ রি-রিলিজডও হইছে। ইউ টিউবেও পাবেন অজস্র কাভারসহ।

অদ্ভূত না?

৬) আসলে এই একের ফের থেকে পরিত্রাণ দরকার রাষ্ট্র নামের এই বিরাট বিরাট ইমাজিনারি কম্যূনিটিগুলার লোকদের কালেক্টিভ আর ইন্ডিভিজুয়াল ইমাজিনেশনের। এই কল্পনার মনোপলি থেকে পরিত্রাণ দরকার। শুধু একটি ফল-ফুল-পাখি-মাছ-কবি-অধ্যাপক কিংবা চিড়িয়াখানাকে ‘জাতীয়’ করার ভেদবুদ্ধি থেকে মাথা বাঁচানো দরকার। আমাদের সব গাছ-ফুল-ফল-পাখি-মাছ-পতঙ্গ-প্রজাতিই জাতীয় হবে, এদের মধ্যে যাদের অস্তিত যত বেশি বিপন্ন তারা তত বেশি ‘জাতীয়’ হবে। দেশের প্রতিটা স্বতন্ত্র সংস্কৃতির মানুষদের ক্ষেত্রেও তাই, তাদের ভাষার ক্ষেত্রেও তাই, ভূ-প্রকৃতিতে তাদের অধিকারেরর ক্ষেত্রেও তাই হবে। জাতীয় সঙ্গীত শুধূ আমার সোনার বাংলা কেন, আমরা ভুলে যেতে চাই না এমন সব গানই ‘জাতীয়’ হবে। শুধু নজরুল কেন, সাথে রবীন্দ্রনাথও আমাদের জাতীয় কবি হইলে সমস্যা কী? সাথে নির্মলেন্দু গুণও হলে সমস্যা কী? মৃত একজনকে জাতীয় করে রেখে জীবিতদের প্রতিযোগিতামূলক আনুগত্য সাপেক্ষে সংবর্ধন করে প্রকারান্তরে রাজসভার কবি করে রাখা তো সেই জাতিবাদী ভেদ-বুদ্ধিরই আরেক প্রয়োগ মাত্র।

৬) জাতীয়তাবাদকে যদি যৌথ আত্মস্বত্তা নির্মাণের পথ ভাবেন, সাথে এও জেনে রাখা ভাল যে আত্মস্বত্তা মাত্রই, সে যৌথই হোক কি ব্যাক্তিক, সম্ভব হয়ে উঠে শত-সহস্র ‘অপর’ স্বত্ত্বার সাথে সম্পর্কের সন্ধিসূত্রে, পারস্পরিক সমঝোতার সূত্রে। শত্রুতার সূত্রে না, ঘৃণা-বিদ্বেষের সূত্রে না। দ্বেষ দিয়ে দেশ গড়া যায় না।

এইসব সত্য না জেনেই আমরা সনাতন সমাজধর্ম নাশ করছি কিন্তু পরিপূরক কোন নতুন সোশাল কন্ট্রাক্ট দাঁড়াচ্ছে না, নতুন কৌমসূত্র দাঁড়াচ্ছে না, কম্যূনিটি দাঁড়াচ্ছে না। আমাদের পৌরজীবনের কল্পলোক যেন ১০কে ৩ দিয়ে ভাগ করতে গিয়ে ১ এর এক অসীম পৌনঃপূণিকতায় আটকে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *