চমস্কি, মার্কস ও মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্র নিয়ে একটি ঝটিকা সফর

  • সেলিম রেজা নিউটন

এই রচনাটুকু নোম চমস্কির ভবিষ্যতের সরকার শীর্ষক বাংলা অনুবাদ-গ্রন্থের ভুমিকা থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি ছিল “ভূমিকা”র ১.১৪ অংশ। সেখানে এই অংশটুকুর উপশিরোনাম ছিল “নোম চমস্কির সমাজতন্ত্র: নৈরাজ্য থেকে র‌্যডিক্যাল মার্কস”। বইটির “ভুমিকা, ভাষান্তর ও সম্পাদনা” রচনা করেছেন সেলিম রেজা নিউটন। এটি প্রকাশ করেছিল ঢাকার পেন্ডুলাম পাবলিশার্স। এটি অনলাইনে রকমারি ডট কমে কিনতে পাওয়া যায়।  ইন্টারনেট আর্কাইভ থেকে বর্তমান রচনাটির সুসজ্জিত পিডিএফ ডাউনলোড করা যায়।

মূল রচনা

অনবহিত মহলে বামপন্থা বলতে প্রধানত মস্কোপন্থী ও চীনপন্থী নানা ধরনের ‘সরকারি বামপন্থা’কে বোঝায়। এগুলো ‘স্টেট স্পন্সরড বামপন্থা’। এগুলোকে ‘মার্কসবাদ–লেনিনবাদ’ নামে ডাকা হলেও আসলে তা ‘লেনিনবাদ’ মাত্র। এগুলো হচ্ছে বলশেভিক রুশ–সাম্রাজ্যের লেনিনবাদী মার্কসবাদ। এই দুঃখেই রোজা লুক্সেমবার্গ তাঁর রচনার নাম দিয়েছিলেন “লেনিনবাদ, না মার্কসবাদ?”।

বামধারার মার্কসবাদ’ নামক জিনিসটার সাথে বাংলাদেশের বলশেভিকদেরও স্বাভাবিকভাবেই পরিচয় নাই বললেই চলে। মস্কো থেকে, পিকিং থেকে মাঙনায় আসা সরকারি পুথিপত্র ছাড়া আর কোনোদিকে তাকানোর অভ্যাস আমাদের ছিল না। নিজেদের গোঁড়া বিশ্বাসের বাইরে আর–কিছুর যদি আমরা নাম শুনেও থাকি তো সেসবকে স্রেফ প্রতিপক্ষের প্রচারণা বলে উড়িয়ে দিয়ে ‘জিন্দাবাদ’ ‘জিন্দাবাদ’ জারি রাখার মধ্য দিয়ে নিজেদের নিষ্ক্রিয় মস্তিষ্কের সুস্থতা বজায় রেখেছি আমরা। কিন্তু নোম চমস্কির ‘ভবিষ্যতের সরকার’ অনুধাবন করার জন্য আমাদেরকে চিন্তার এই সরকারি বৃত্তের বাইরে আসতে হবে। তাকাতে হবে বাম–অভিমুখীন মার্কসবাদ, বামধারার মার্কসবাদ, র‌্যাডিক্যাল মার্কসবাদ, বৈপ্লবিক মার্কসবাদ, পশ্চিমা মার্কসবাদ, লেফট কমিউনিজম, লেফট উইং কমিউনিজম ইত্যাদি নামে পরিচিত মার্কসবাদের অ–লেনিনবাদী ধারার দিকে। মার্ক্সিস্টস্‌ ইন্টারনেট আর্কাইভ এই ধারার রচনাদির জন্য বামধারার, বলশেভিকবিরোধী এবং কাউন্সিল কমিউনিজম নামে একটা আলাদা জায়গা বরাদ্দ রেখেছে। কিন্তু তা আমাদের চোখে পড়ে না। মতান্ধতা আমাদের সর্বপ্রকার ‘বলশেভিক’দের প্রাণভোমরা বটে। খোদ বলশেভিক পার্টির মধ্যে, স্বয়ং লেনিনের জীবদ্দশায়, আলেকজান্দ্রা কোলোন্তাই প্রমুখের নেতৃত্বে ১৯২১ সালে গড়ে ওঠা ‘ওয়ার্কার্স অপোজিশন’ তথা পার্টি–রাষ্ট্রীয় বুরোক্রেসির বিরুদ্ধে সাক্ষাৎ শ্রমিকদের বিরোধী ধারা গঠন এবং তার ওপর রাষ্ট্রীয় কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণের ঘটনা বিপ্লবের নামে জবরদস্তির বিভীষিকার কথা ভুলতে দেবে না।

জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া এবং খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নের শ্রমজীবীদের আন্দোলন–সংগ্রাম–সৃজনের গুঁড়া গুঁড়া রঙে আঁকা হয়ে ওঠা এই বামধারার মার্কসবাদ কোনো তত্ত্ববিলাস নয়। বৈপ্লবিক সংগঠন, সংগ্রাম, স্বাধীন ব্যক্তিত্ব এবং তাদের অজস্র রচনায় উপচানো এই ধারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ও অর্থ–নৈতিক কেন্দ্রীভবনের হাত থেকে আপামর শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির লড়াইয়ের ইতিহাসের এক বৃহৎ অধ্যায়। ইতিহাস আমাদের সামনে মেলে রেখেছে জার্মানির কার্ল কর্শ ও রোজা লুক্সেমবার্গ, হাঙ্গেরির জর্জ লুকাচ,  নেদারল্যান্ডসের অ্যান্টন প্যানেকোয়েকহারম্যান গোর্টার, জার্মান–মার্কিন পল ম্যাটিকদের কাউন্সিল কমিউনিজম ও বলশেভিকতন্ত্রবিরোধী কমিউনিজম–এর (Mattick, 1978) কথা–কাজের ধারা।

আর্ট্ওয়ার্ক: দ্য পা্ওয়ার অব ট্রুথ সিরিজ
সূত্র: চাইনা ডেইলি

কার্ল মার্কসের তত্ত্বজগতের চর্চায় বিকশিত এই মুক্তিমুখী মার্কসবাদ–এর ধারা–প্রবণতাকে চমস্কি মেলাতে চান নৈরাজ্যের অনুশীলনের সাথে। তাই, মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্র বলতে চমস্কি বোঝেন এই “বাম–অভিমুখীন মার্কসবাদ থেকে শুরু করে নৈরাজ্যবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত চিন্তাধারা”র পরিসরটিকে। বামধারার মার্কসবাদের সাথে নৈরাজ্যবাদের এই যোগসূত্র খুঁজে পান চমস্কি তিন দিক থেকে।[এক] যে আলোকায়ন (বা ধ্রুপদি উদারনীতিবাদকে) তিনি নৈরাজ্য–ধারণার দার্শনিক পূর্বসূরি বলে গণ্য করেন, গোড়ার দিককার মার্কসকে তিনি সেই “আলোকায়নের শেষ ভাগের একজন ব্যক্তিত্ব” হিসেবে দেখেন:

যে প্রতিবেশ-পরিমণ্ডলে জীবনযাপন করতেন, সেখান থেকে ব্যাপকভাবে নিয়েছেন গোড়ার দিককার মার্কস। এই মার্কসের সাথে ধ্রুপদি উদারনীতিবাদ, আলোকায়নের কিছু দিক, এবং ফরাসি ও জার্মান রোমান্টিকতাবাদের অনেক মিল দেখা যায়। … আমার ধারণা … গোড়ার দিককার মার্কস আলোকায়নের শেষ ভাগের একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন রীতিমতো। (Chomsky, 1996)

অন্য দিকে, পরের দিককার মার্কসকে তিনি দেখেন “অতিশয় কর্তৃত্বপরায়ণ অ্যাক্টিভিস্ট” হিসেবে:

পরের দিককার মার্কস ছিলেন অতিশয় কর্তৃত্ববাদী অ্যাক্টিভিস্ট, ছিলেন পুঁজিবাদের বিচারমূলক বিশ্লেষক, যাঁর সমাজতান্ত্রিক বিকল্প নিয়ে তেমন বলার ছিল না। (Chomsky, 1996)

এই পার্থক্য মনে রাখা চমস্কির জন্য জরুরি, আবার তাঁর কাছে গোড়ার দিককার স্বাধীনতাপ্রিয় মার্কসকে চিনে নেওয়াটাও জরুরি, যাঁর সাথে মানুষের প্রজাতিসত্তাগত স্বাধীনতার প্রশ্নে, এমনকি বিচ্ছিন্ন শ্রমের তত্ত্বের প্রশ্নে, ধ্রুপদি উদারনীতিবাদী হামবোল্টের মিল দেখতে পান।

[দুই] মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্রের ধারণা চমস্কির মানসপ্রসূত নয়। খোদ ইউরোপীয় শ্রমিক–আন্দোলনে বামধারার যে মার্কসবাদ আগাগোড়া প্রবাহিত থেকেছে তার মধ্যে নৈরাজ্যবাদের ছায়া দেখতে পান তিনি। এটা মার্কসবাদের অ–লেনিনবাদী ধারা। র‌্যাডিক্যাল, মুক্তিপরায়ণ, বৈপ্লবিক ধারা। জার্মানির কমিউনিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদক রোজা লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডে কাউন্সিল কমিউনিজমের মার্কসীয় তাত্ত্বিক অ্যান্টন প্যানেকোয়েক, বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম পল প্রমুখ এ ধারার উজ্জ্বল প্রতিনিধি। সমাজতন্ত্র বলতে এই ধারা সবসময়ই স্বাধীনতাশীল সমাজতন্ত্রকে বুঝিয়েছে। নিজেদেরকে মুক্তিপরায়ণ হিসেবে অভিহিত করেছে। কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে শ্রমজীবী উৎপাদকদের নিয়ন্ত্রণ ও সামাজিক মালিকানাকে এরা সমাজতন্ত্র মনে করেছে। নৈরাজ্যবাদের সাথে এদের প্রকৃত কোনো পার্থক্য নাই।

মিখাইল বাকুনিন (১৯১৪-১৮৭৬)

[তিন] ঊনবিংশ শতাব্দী জুড়ে মার্কসবাদী ও নৈরাজ্যবাদীদের মধ্যে যা নিয়ে ছিল বৈরিতা, সেই রাষ্ট্র–বিলুপ্তির প্রশ্নে মার্কস–বাকুনিনের  মতপার্থক্যকে অতিক্রম করে যেতে চান তিনি। এই প্রশ্নে তাঁদের মতপার্থক্যকে মূলনীতিগত পার্থক্য হিসেবে না দেখে কৌশলগত পার্থক্য হিসেবে দেখেন তিনি। তাঁর মতে, “ঊনবিংশ শতকে রাষ্ট্র প্রশ্নে তাঁদের পার্থক্য ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু এক অর্থে সেটা ছিল কৌশলগত।” উভয়েই যে মনেপ্রাণে রাষ্ট্রীয় জবরদস্তির অবসান চান তাতে কোনো সন্দেহ করতে পারেন না চমস্কি। বরং তাঁর ধারণা, জবরদস্তিমূলক পুরাতন রাষ্ট্রযন্ত্র বিলোপের কৌশলপদ্ধতি নিয়েই তাঁদের আসল পার্থক্য। চমস্কি মনে করেন প্যারি কমিউনের বিপ্লবে প্যারিসে শ্রমজীবীদের দুই মাসের যে কমিউন–রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার অভিজ্ঞতা মার্কসকে দিয়ে রাষ্ট্রবিলুপ্তির প্রশ্নে এমন কিছু ‘নতুন’ উপলব্ধি অর্জনে করিয়ে নিয়েছিল যা তাঁকে তত্ত্বধারণার দিক কমিউনিস্ট ইশতেহার থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল এবং নৈরাজ্যবাদের নিকটবর্তী করে তুলেছিল। প্রথম আন্তর্জাতিকের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পড়ার জন্য ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ নামে যে ভাষণ লিখেছিলেন তিনি, তাতে মার্কসের এই ‘নতুন’ উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছিল। মার্কসের এই ‘নতুন’ উপলব্ধি এত দূর গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তাঁর কাছে যে, বিপ্লব–পরবর্তী রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে তিনি ইশতেহার–এর অবস্থান বদলানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন কেননা তা “সেকেলে” হয়ে পড়েছিল।

ইশতেহার–এ মার্কস–এঙ্গেলসের ধারণা ছিল শ্রমজীবী সর্বহারার বিপ্লব সম্পন্ন হবে দুই ধাপে। প্রথম ধাপে পুরাতন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিতে হবে এবং সেটাকে শ্রমজীবী জনসাধারণের রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের কাজে লাগাতে হবে। সর্বহারার এই নতুন রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে হবে উৎপাদনের সকল হাতিয়ারপাতি, পরিবহনের সমস্ত উপায় এবং সকল আর্থিক উপায়–পদ্ধতি। এই রাষ্ট্র এমনসব নীতিপদ্ধতিতে চলবে যে, দীর্ঘদিন যাবত ধীরে ধীরে শ্রেণিবৈষম্য কমে আসতে আসতে এক পর্যায়ে আর থাকবে না। তখন রাষ্ট্রের আর প্রয়োজনও থাকবে না। সেটা তার রাজনৈতিক চরিত্র হারাবে এবং তার বিলুপ্তি ঘটবে। এই দ্বিতীয় ধাপে এসে উৎপাদনের সকল উপায়পদ্ধতি তখন চলে যাবে রাষ্ট্রের বদলে স্বাধীন ব্যক্তিবর্গের মুক্তিপরায়ণ স্বেচ্ছাসমিতিসমূহের হাতে। সূচিত হবে শ্রেণিহীন, রাষ্ট্রহীন মুক্ত–সমাজের চলা।

কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩)

কার্ল মার্কসের এই রাষ্ট্রবাদী চিন্তাধারার মুশকিলগুলো নিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিকের ভেতরে মুক্তিপরায়ণরা আগাগোড়াই সমালোচনা করে এসেছেন। প্রুঁধো–বাকুনিনরা তো চিরদিনই মনে করেছেন, বিদ্যমান জবরদস্তিমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রই আপামর মেহনতি মানুষের মুক্তির পথে প্রধান অন্তরায়, সুতরাং বিপ্লবের সাথেসাথেই, একদম প্রথম সুযোগেই, এই রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে সমূলে উচ্ছেদ করে ফেলতে হবে, এবং তার জায়গায় শ্রমজীবীদের স্বেচ্ছাসমিতিসমূহের ফেডারেল সংস্থা গঠনের মাধ্যমে সমাজ ও উৎপাদন পরিচালনার কাজে হাত দিতে হবে। প্যারিস কমিউন ছিল ঠিক এইরকম প্রতিষ্ঠানেরই বাস্তব দৃষ্টান্ত। তো, প্যারিস কমিউনের পর্যালোচনায় এই প্রতিষ্ঠানকেই মার্কস যখন তাঁর ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ রচনায় “শ্রমজীবীদের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্ন ফয়সালা করার রাজনৈতিক কাঠামো” হিসেবে (Marx and Engels, 1978: 634–635), এবং এঙ্গেলস সেই রচনার ভূমিকায় “প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্রের দৃষ্টান্ত” হিসেবে (Marx and Engels, 1978: 629) উপলব্ধি করলেন তখন কিন্তু বিপ্লব–পরবর্তী রাষ্ট্র–বিলুপ্তির প্রশ্নে এবং তার জায়গায় শ্রমজীবী জন–সাধারণের কমিউন গঠনের প্রশ্নে প্রুধোঁ–বাকুনিনদের সঙ্গে মূলগত–ভাবে মার্কস–এঙ্গেলসের আর ফারাক রইল না। ইশতেহার–এর ১৮৭২ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় তাঁরা বলেন, “কমিউন বিশেষ করে একটা কথা প্রমাণ করেছে যে, রেডিমেড রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে স্রেফ দখল করে নিয়ে তাকে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করাটা শ্রমিকশ্রেণির কাজ নয়” (Marx and Engels, 1978: 470)। কথাটা কিন্তু মার্কসের ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ রচনারই একটা উদ্ধৃতি বটে (Marx and Engels, 1978: 629) যেখানে মার্কস বললেন, “শ্রমজীবীদের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্ন ফয়সালা করার যে রাজনৈতিক কাঠামো অবশেষে আবিষ্কৃত হয়েছে” সেটা হলো কমিউন— “শ্রমিকশ্রেণির সরকার” (Marx and Engels, 1978: 634-635)। মার্কসীয় ধারণায় এতদিন যা ছিল রাষ্ট্রের এক–নায়কত্ব, এবার সেটা রূপান্তরিত হলো পুরাতন রাষ্ট্রকাঠামোবর্জিত কমিউনের একনায়কত্বে।

মার্কসবাদ ও নৈরাজ্যবাদের সাদৃশ্য ও ঐক্যের এই পাটাতনটিকে সামনে তুলে আনা ‘ভবিষ্যতের সরকার’–এ চমস্কির বিশেষ অবদান। তাঁর এই মার্কস–নৈরাজ্য–ব্লেন্ডিং রাষ্ট্রপ্রশ্নে যে ফয়সালা দাঁড় করালো তাতে মার্কসবাদ এখন বিপ্লবের পরে সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র গড়ে তোলার বদলে কমিউন গড়ে তুলতে চায়। আর অন্যদিকে, নৈরাজ্যবাদ এখন বিপ্লবের পর রাষ্ট্রকে ‘নাই’ করে দেওয়ার বদলে একটা মুক্তিপরায়ণ আর্থসামাজিক রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করতে চায়। ফ্রান্সে ১৮৪৮–এর ফেব্রুয়ারি–বিপ্লব যে ‘সোশাল রিপাবলিক’–এর আওয়াজ তুলেছিল, ১৮৭১ সালের কমিউনের মধ্যে মার্কস যার সফল বাস্তবায়ন দেখেছিলেন, তার সাথে এই মুক্তিপরায়ণ আর্থসামাজিক রাষ্ট্রের প্রকৃত ফারাক নাই। মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের সাথে নৈরাজ্যের বিভেদ ঘুচিয়ে তাহলে আমরা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একটা কমিউন–রাষ্ট্র বা পঞ্চায়েত–রাষ্ট্র বা কওমি–রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি যার কাজ হবে “যাবতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করে দিয়ে শুধু … উৎপাদন আর ভোগের চাহিদা বিষয়ক কাজে নিজেকে সীমাবদ্ধ” রাখা। এই ফেডারেল রাষ্ট্র হবে কমিউনসমূহের কমিউন, পঞ্চায়েতসমূহের পঞ্চায়েত। (প্রসঙ্গত, আমার আন্দাজ, একক ‘চেইন অফ কমান্ড’ ভিত্তিক কেন্দ্রীভূত সেনাবাহিনীর বদলে বন্দুকের বিকেন্দ্রায়ন ঘটানোর মধ্য দিয়ে প্রয়োজনে এ রাষ্ট্র কর্তৃত্বক্রম–তন্ত্রহীন, আনুভূমিক, স্বশাসিত পঞ্চায়েত–প্রতিরক্ষা–বাহিনী গঠন করবে বৈকি। এর স্থানীয় পঞ্চায়েত–ইউনিটগুলো জবাবদিহি করবে নিজ নিজ স্থানীয় পঞ্চায়েতের কাছে।)

নোম চমস্কি

এ ছাড়া নোম চমস্কির যুক্তিপ্রণালী অনুসরণ করলে বোঝা যায় যে, নৈরাজ্যবাদ ছাড়া রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রী বা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ধারার অন্য কোনো রাষ্ট্রচিন্তাই মানুষের স্বাধীনতাশীলতাকে, তথা তার প্রজাতি–ধর্মকে, তথা খোদ মানবিকতাকে রাষ্ট্র–পরিচালনাগত নীতি হিসেবে আদৌ বিবেচনায় নেয় না। এ কারণেই সেসবের হাত ধরে আধুনিক রাষ্ট্রের যে চেহারা দাঁড়িয়েছে তাতে করে রাষ্ট্র হয়ে পড়েছে গভীরভাবে মানবতাবিরোধী একটা প্রতিষ্ঠান। (মনে পড়ে যায়, এই কারণেই গান্ধী মনে করতেন রাষ্ট্র একটা আত্মাবিহীন মেশিন।) আর সমস্ত কিছুর কথা বাদ দিলেও শুধু এই কারণেই আজকের দিনের রাষ্ট্রচিন্তা যেসব রাজনীতি–তৎপর মানুষকে গভীরভাবে ভাবায়, তাঁদের পক্ষে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধানতম মূলনীতি হিসেবে নৈরাজ্যবাদকে (তথা মুক্তিপরায়ণ সমাজতন্ত্রকে, কিংবা উনিশ শতকীয় রাজনৈতিক পরিভাষার অতীতমুখী ঝামেলাকে এড়িয়ে গিয়ে বলা চলে, মনুষ্য–স্বাধীনতাকে) বিবেচনায় না নিয়ে কোনো উপায় থাকে না।

এমনিতে ‘নৈরাজ্য’ শব্দটার ঝামেলা প্রচুর। ‘নৈরাজ্যবাদ’ নামটার ঝামেলা আরো বেশি। এর জন্য নৈরাজ্যওয়ালাদের কোনো দায় নাই তা নয় কিন্তু তার চেয়ে বেশি দায় মনুষ্য–স্বাধীনতাবিরোধী মালিক–মাতব্বর–পক্ষের বিপুল মাত্রায় পয়সা–খরচ–করা দীর্ঘমেয়াদী ও সর্বগ্রাসী প্রচারণা। দায় এমনকি আমাদের শিক্ষিত এলিট–মহাজন–দের জিজ্ঞাসাহীন, অনুসন্ধানহীন, চিন্তাদাসসুলভ মূর্খতারও বৈকি! কিন্তু ঝামেলা যতই থাক নৈরাজ্যের বা নৈরাজ্যবাদের, সমাজ–রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উভয় অর্থেই, মনুষ্য–স্বাধীনতাকে প্রধানতম বিবেচনায় না নিয়ে চললে রাষ্ট্র জিনিসটা যে রাক্ষসে পরিণত হয়, সেই মহা জরুরি কথাটা রাষ্ট্রচিন্তার প্রধান পরিসরে নৈরাজ্যওয়ালারা ছাড়া আর কেউ কোনোদিন এমন লাগাতারভাবে, এমন জোরের সাথে, সামনে আনেন নি। সুতরাং নৈরাজ্যবাদ নামক উনিশ শতকের চিন্তা–পরিভাষাকে অতিক্রম করে যাওয়ার জন্য হলেও আপনাকে নৈরাজ্যবাদ নিয়ে বোঝাপড়া করতে হবে বৈকি।

মনুষ্য–স্বাধীনতার প্রকৃতিপ্রদত্ত স্পৃহা যার অনুভূতি ও চিন্তনে স্বভাবত ক্রিয়াশীল নয়, তার জন্য ‘নৈরাজ্যবাদ’ ইতিহাস বইয়ের একটা নাম মাত্র। এই ধরনের মানুষদের একটা বিরাট অংশ নৈরাজ্যের নাম শুনলে বিরক্তিতে বমি করার উদ্যোগ নেন, আরেকটা বিরাট অংশ নৈরাজ্যের নাম শুনলেই আনন্দে গদগদ হয়ে ওঠেন যেন সারাক্ষণ ‘নৈরাজ্য’ ‘নৈরাজ্য’ করলেই সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর স্বাধীনতা ও সাম্যের বৃষ্টিধারা নেমে আসবে অঝোরে।

আসলে, স্বাধীনতা নামক প্রজাতিসত্তা যার রক্তে ও মস্তিষ্কে স্বভাবতই কাজ করে, তিনি কিন্তু নৈরাজ্য বা অন্য কোনো একক নামের অধীনে  নিজেকে অনুগত করে তুলতে চান না। নিজের খাসলতের কারণেই তিনি সেটা পারেন না। তার কাছে ‘নৈরাজ্য’ নাম–ধারণাটার চেয়েও অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজের স্বাধীনতার জন্য কাজ করে যাওয়া— ব্যক্তিগত পরিসরে এবং সমষ্টিগত পরিসরে। তার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সমাজ এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন পরিসরে পরিচালনাগত মূলনীতি হিসেবে স্বাধীনতাশীলতার চর্চা করতে থাকা। মুখে এবং কাজে। পরিবারে, কর্মস্থলে, আত্মীয়সভায় এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক–সামাজিক পরিসরে বিরতিহীনভাবে তিনি নৈরাজ্যের ধারণাগুলো তুলে ধরতে থাকেন এবং নিজের আচরণ ও তৎপরতার মধ্য দিয়ে সেই ধারণার প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠার সাধনায় নিমগ্ন হয়ে থাকেন— সম্ভব হলে সমমনা বন্ধুদেরকে সাথে নিয়ে, সম্ভব না হলে একা; নিঃসঙ্গভাবে এবং নির্ভীকভাবে। ভয় তার একটাই— দাসত্বের ভয়। তাই বলে নৈরাজ্য শব্দটাকে তিনি ভুলে যান না, অপছন্দও করেন না। মানুষের ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত মুক্তিস্পৃহার সামাজিক রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ের চিরায়ত লড়াইয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর এবং বিংশ শতাব্দীর নৈরাজ্য–ধারণার এবং নৈরাজ্যিক তৎপরতার ইতিহাস তিনি জানেন। সেই ইতিহাসের অসাধারণ সব অর্জন এবং মারাত্মক সব সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও তিনি জানেন। কিন্তু তিনি তো আর গত সহস্রাব্দে বাস করেন না। তাই, একবিংশ শতাব্দীতে, অর্থাৎ নতুন এ মিলেনিয়ামে, নৈরাজ্য শব্দটাকে ব্যবহার করার অথবা না করার পক্ষে কোনো ফতোয়া জারি করার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। আমার অ্যানার্কি ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীকে পেরিয়ে, এমনকি আমার অন্যতম প্রিয়তম শিক্ষক নোম চমস্কিকেও অতিক্রম করে শতদিকে ধায়। শতনামে, শতফুলে প্রস্ফুটিত হয়।

পাদটীকা

১. দ্রষ্টব্য: Luxemburg, 1904-a; Luxemburg, 1904-b; Luxemburg, 1961।

২. ১৯২১ সালের গোড়ায় প্রাভদা-য় শ্লিয়াপ্‌নিকফের লেখা ওয়ার্কার্স অপোজিশনের থিসিস, কোলোন্তাইয়ের লেখা দ্য ওয়ার্কার্স অপোজিশন, ১৯২২ সালে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের কমরেডদের কাছে “২২ জনের আবেদন”, Kollontai, 1978 এবং Clements, 1975 দ্রষ্টব্য।

৩. Kellner, 1977

৪. Luxemburg, 1925; Luxemburg, 1961; Luxemburg, 1970; Luxemburg, 1981; Luxemburg, 2004; Luxemburg, 2008; Luxemburg, 2013; Gietinger, 2019.

৫. Lukacs, 1962; Lukacs, 1970; Lukacs, 1971; Lukacs, 2014

৬. Pannekoek, 2003; Smart, 1978

৭. Gorter, 1921; Smart, 1978৮. এই কথাটুকু অবশ্য এঙ্গেলসের। ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ রচনারই ভূমিকায় বলা।

বইপত্রের হদিস

Chomsky, Noam (1996), “Anarchism, Marxism and Hope for the Future”, An interview with Noam Chomsky conducted in May 1995 by Kevin Doyle, First published in 1996 in Red & Black Revolution, No 2.

Clements, Barbara Evans (1975), “Kollontai’s Contribution to the Workers’ Opposition”, Russian History, Vol. 2, No. 2, pp. 191-206. Downloaded from Jstor.

Gietinger, Klaus (2019). The Murder of Rosa Luxemburg. Translated by Loren Balhorn. Kondon: verso.

Gorter, Herman (1921), “Open Letter to Comrade Lenin”, First published as: Open letter to comrade Lenin, A reply to “‘Left-wing’ communism, an infantile disorder,” in Workers’ Dreadnought, London, 12 March-11 June 1921; Published: Wildcat pamphlet, London, 1989. Available at Marxists Internet Arcive.

Kellner, Douglas (1977). Karl Korsch: Revolutionary Theories. Austin: University of Texas Press.

Kollontai, Alexandra (1978). Selected Writings of Alexandra Kollontai. Translated with an introduction and commentaries by Alix Holt. Westport, Conn.: Lawrence Hill.

Lukacs, Georg (1962). The Destruction of Reason. Atlantic Highlands, N.J.: Humanities Press Inc.

Lukacs, Georg (1970). Writer and Critic and Other Essays. New York: The Universal Library.

Lukacs, Georg (1971). History and Class Consciousness. Cambridge, Massachusetts: MIT Press.

Lukacs, Georg (2014). Tactics and Ethics 1919-1929. London: Verso.

Luxemburg, Rosa (1904-a). Leninism or Marxism. Glasgow: Anti-Parliamentary Communist Federation. (This edition was published in 1935. Available online as a PDF file at the Internet Archivearchive.org/details/Leninism_or_Marxism_R
osa_Luxemburg
) [The first English translation of the pamphlet appeared in the Council Correspondence, theoretical organ of the United Workers Party of America. Written: 1904. First Published: 1904 in Iskra and Neue Zeit. Online: Marxists Internet Archive.]

Luxemburg, Rosa (1904-b). Leninism or Marxism. Calicut: Amibooks. (This edition was published in 2017. Available online as a PDF file at the Internet Archive)

Luxemburg, Rosa (1925). The Mass Strike, the Political Party and the Trade Unions. Written and first published: 1906. Translated: Patrick Lavin. Publisher: Marxist Educational Society of Detroit.

Luxemburg, Rosa (1961). The Russian Revolution and Leninism or Marxism. Introduction by Bertram D. Wolfe. Ann Arbor Paperback. The University of Michigan. [The Russian Revolution was written in 1918. First published in Le Populaire by Paul Levi in 1922.]

Luxemburg, Rosa (1970). Rosa Luxemburg Speaks. Edited with an Introduction by Mary-Alice Waters. New York: Pathfinder Press.

Luxemburg, Rosa (1981). Comrade and Lover: Rosa Luxemburg’s Letters to Leo Jogiches. Edited and translated by Elzbieta Ettinger. London: Pluto Press.

Luxemburg, Rosa (2004). The Rosa Luxemburg Reader. New York: Monthly Review Press.

Luxemburg, Rosa (2008). The Essential Rosa Luxemburg: Reform or Revolution & The Mass Strike. Edited by Helen Scott. Chicago: Haymarket Books.

Luxemburg, Rosa (2013). The Complete Works of Rosa Luxemburg. Volume 1, Economic Writings 1. London: Verso.

Marx, Karl and Friedrich Engels (1978). The Marx-Engels Reader. Edited by Tucker, Robert C. 2nd edition. New York: W. W. Norton.

Mattick, Paul (1978). Anti-Bolshevik Communism. Reprinted in 2007. Wales: Merlin Press.

Paneoek, Anton (2003). Workers’ Councils. First published in 1946. Oakland, CA: AK Press. Available at Marxists Internet Archive.

Smart, D. A. (1978). Pannekoek and Gorter’s Marxism. London: Pluto Press.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *