- লেখক: আলতাফ পারভেজ
প্রশ্ন তোলা ও উত্তর খোঁজার চেষ্টাকে কেন টার্গেট করা হয়
যার যার সামাজিক পরিসরে দেশ-বিদেশ নিয়ে ভাবনা, মতামত বিনিময় এবং তার অনুশীলনই রাজনীতি। দুনিয়ায় কেউই এই রাজনীতির বাইরে নেই। তারই একটা রূপ ‘ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি।’
বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি নিয়ন্ত্রণের একটা অভিলাষ ধাপে ধাপে এগোচ্ছে। আরও এগোবে।
বুয়েটকে বাংলাদেশের অগ্রসর বিদ্যাপীঠ গণ্য করার রেওয়াজ আছে। বুয়েটের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ইঙ্গিত দিচ্ছে, শিক্ষাঙ্গনে ধীরে ধীরে দেশভাবনা বন্ধের আয়োজন চলবে।
ক্যাম্পাস গণতন্ত্রের চর্চা নিষিদ্ধ করতে অজুহাত হিসেবে টেনে আনা হচ্ছে সন্ত্রাসী ঘটনাকে। গণতন্ত্রের চর্চাকে সন্ত্রাসের পোশাক পরিয়ে জবাই দিতে চাওয়া হচ্ছে আসলে মানবিক ভাবনা-চিন্তা-চর্চার স্বাভাবিকতাকে। আরও স্পষ্ট করে বললে তরুণ-তরুণীদের প্রশ্ন তোলা ও উত্তর খোঁজার চেষ্টাকে টার্গেট করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা আবরার হত্যার আগে-পরে শিক্ষাঙ্গনে দুর্নীতি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছিল, প্রতিবাদ জানাচ্ছিলো। বিপুল সামাজিক সংহতিও পায় সেই প্রতিবাদ। ঐ সামাজিক সমর্থন এখন অস্ত্র হিসেবে নিপীড়নবিরোধীদের স্তব্ধ করার কাজে লাগছে! বেশ কৌশলী প্রচেষ্টা এটা—যখন দেখা যাচ্ছে, তরুণ-তরুণীদের খাঁচায় পোরার কাজে আবরার হত্যার মতো ঘটনাবলীকে ঢাল হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে।
এরকম আয়োজনের কারণটি পরিষ্কার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় আকারের খাঁচায় রূপান্তরের কাঠামোগত ‘কাজ’টি রাজনৈতিক-অর্থনীতির জন্য খুব জরুরি। ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি বন্ধের আয়োজন তাই এ কালে একটি অগ্রাধিকারমূলক প্রকল্প না হয়ে পারে না এবং তাই হয়েছে। তরুণদের গণতন্ত্রের চর্চা বন্ধের কাজটি প্রয়োজন মূলত সকল ক্ষমতাবানদের জন্য। কর্তৃত্বশালীদের জন্য।
সমাজের পরতে পরতে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের যে ভরকেন্দ্রগুলো আছে– সেগুলো বিশ্বজুড়েই তরুণ-তরুণীদের সামনে ন্যায্যতা নিয়ে থাকতে পারছে না আর। তরুণরা ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের জায়গাগুলোর অন্যায্যতা ও অযৌক্তিকতা চিনে ফেলছে। দুর্নীতিকে শনাক্ত করছে। সেগুলো চ্যালেঞ্জ করছে, কথা বলছে, গান করছে, কবিতা লিখছে, গ্রাফিথি আঁকছে, প্রশ্ন তুলছে, উত্তর খুঁজছে এবং গণতন্ত্র চাইছে– যে গণতন্ত্র সকলকে মতামত প্রকাশের সুযোগ দেয়। কিন্তু অনেকের জন্য এ পরিস্থিতি মেনে নেয়া, মানিয়ে নেয়া কষ্টকর। ফলে এসব আঁটকানো চাই। সন্ত্রাসের আবরণে আটকানোর কাজটা সহজ হয়।
পাশের দেশ ভারতে একই কাজ করতে চাওয়া হচ্ছে–প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের ‘এন্টি-ন্যাশনাল’ মোহর দিয়ে। পাকিস্তানেও কোথাও কোথাও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ গালি দিয়ে।
বহু আগে থেকে দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রীদের ইউনিয়ন নির্বাচন বন্ধ একই অভিযোগে। ‘ইউনিয়ন থাকলে সন্ত্রাস হয়, মারামারি হয়’– এই যুক্তিতে ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসির ঐ রূপটি অকার্যকর করে রাখা আছে। আসল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের মতমত গঠনের প্রক্রিয়া বন্ধ করা, সমাজের নীচ থেকে নেতৃত্ব তৈরির পথ রুদ্ধ করা এবং বিশেষভাবে শিক্ষাখাতের বিশাল তহবিলটির উপর প্রশ্নহীন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
এভাবে উপনিবেশিক আমালেও যা হয়নি– স্বাধীনতার আমলে তাই সম্ভব হচ্ছে– শিক্ষার্থীদের দেশভাবনাকে গড়ে ‘অপরাধ’ ও ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে সাব্যস্ত করা যাচ্ছে। কিন্তু আড়ালে থাকছে শিক্ষাঙ্গন ও জ্ঞান-অর্থনীতির প্রকৃত প্রতিপক্ষরা।
ছাত্ররা উপলক্ষ্য– দীর্ঘমেয়াদে লক্ষ্য কিন্তু ‘সবাই’
যেকোন জ্ঞানপীঠে মেধা ও যোগ্যতার বদলে রাজনৈতিক আনুগত্যকে যদি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিয়োগের মানদন্ড করা হয়– তাহলে সেটাই ঐ প্রতিষ্ঠানের পরিবেশের জন্য বড় সন্ত্রাস হয়ে উঠে।
এরকম অভিজ্ঞতাগুলো আড়াল করেই– গত কয়েক দশক ধরে ক্যাম্পাসগুলোর সকল সহিংসতার দায়ভার চাপানো হচ্ছে ছাত্র সংগঠনগুলোর উপর এবং ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও ঐতিহ্যের উপর। আরও সরাসরি বললে ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসির উপর।
কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের ইউনিয়ন বন্ধ হওয়ায় মোটেই সন্ত্রাস কমে নি। প্রত্যেক কালে ক্ষমতাবানরা সন্ত্রাস করতো, এখনও একইভাবে ক্ষমতাবানরাই সন্ত্রাস করে। আগামীতেও করবে হয়তো। ইউনিয়ন না থাকলে ক্ষমতাবানদের বাড়তি সুবিধা এটুকু, শিক্ষার্থীদের অনায়াসে পেটানো যায়।
গত প্রায় ত্রিশ বছর দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত ইউনিয়ন নেই। কিন্তু গুন্ডাবাহিনীগুলো বাধাহীনভাবেই কাজ করছে। কেউই এমন তথ্য-উপাত্ত দেখাতে পারবে না, ইউনিয়ন থাকার সময়ের চেয়ে না-থাকার সময়ে শিক্ষার পরিবেশ ও মান বেড়েছে, সন্ত্রাস কমেছে কিংবা শিক্ষার্থীদের সন্তুষ্টি বেড়েছে। এই ত্রিশ বছরে শিক্ষকরা ঠিক ঠিক জাতীয় রাজনীতি করে গেছেন। অফিসার-কর্মচারীরাও করেছেন। বহু শিক্ষক বড় ‘নেতা’ হয়েছেন। সেই ‘নেতা’দের সহায়তায় বহু ছাত্র কোটিপতি হয়েছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ-বদলি-পদায়ন যে রাজনৈতিক বিবেচনায় হচ্ছে সেটা সকলে জানেন। সকলে অভ্যস্ত এতে। এসব অনায়াসে চলতে পারছে। চলতে পারবে। কেবল চলতে পারবে না এসবের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ। কোন কিছুতে আপত্তি তোলা, প্রশ্ন উত্থাপন, উত্তর অন্বেষণ বিপজ্জনক। সেসব তাই নিষিদ্ধ থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নের জায়গা নয়– একে গড়ে তোলা হবে আনুগত্যের জায়গা হিসেবে! ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি না থাকলে ব্যাপারটা সহজ হয়!!
কিন্তু প্রতিনিধি বাছাই, সংগঠিত হওয়ার অধিকার কিংবা ইউনিয়ন না থাকার পরও তরুণ-তরুণীদের সচেতনতায়ন কমে নি। কমছে না। এত নষ্ট একটা সমাজে সেটা সম্ভব নয়। যে ছোট একটা গোষ্ঠী সমাজের প্রায় সবকিছু দখল করে রাখে– শিক্ষাঙ্গনের ক্ষুদ্র চত্বরগুলো তাদের কাছে নতজানু হয় না দেখে স্বাভাবিকভাবেই ক্রোধ হতে পারে তাদের। এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাও বটে।
এটা রাজনৈতিক-অর্থনীতির জন্য, কর্পোরেটদের জন্য, ভূমিদস্যু, পরিবহন মাফিয়া, নদীখেকো, ক্যাসিনো মালিক, মিডিয়া ব্যবসায়ীদের জন্যও অসহনীয় হতে পারে। তাই বিগত কয়েক মাস ধরে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের খাঁচায় পোরার বহু ধরনের প্রয়াস চলছে। কোথাও এটা ‘সান্ধ্য আইন’-এর নামে। কোথায় ফি বাড়ানোর নামে। কোথাও ফেসবুকে লেখার কারণে। কোথাও প্রশাসনের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদের কারণে। কোথাও বিশেষ বিশেষ পোশাক পরা কিংবা না পরার কারণে…হরেক উছিলায় তরুণ-তরুণীদের উপর নিয়ন্ত্রণ-নিপীড়ন-নির্যাতনের খড়গ নেমে আসছে। সর্বশেষ একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধুমপানের কারণেও শিক্ষার্থীদের ‘সীট বাতিল’-এর ঘটনা ঘটেছে। এরকম সকল আয়োজনের চূড়ান্ত প্রকাশই হলো ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি নিষিদ্ধের আয়োজন।
শিক্ষার্থীদের মুখ বন্ধ করা আসলে ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের কথা বলা বন্ধ করা, পরিবার ও সমাজে নারীর কথা বলা নিষিদ্ধ করা, ব্রাহ্মণের সামনে দলিতের কথা বলা কমানো, প্রশাসনের সামনে করদাতার কথা বলার সুযোগ না রাখা, ১% এর সামনে ৯৯% এর কথা বলা নিষিদ্ধের থেকে আলাদা কিছু নয়। শিক্ষার্থীদের মতামতের বাধাহীন প্রকাশ নিষিদ্ধ করা কার্যত সামগ্রিক সামাজিক বিভাজনকেই উদোম করা মাত্র।
শিক্ষার্থী, শ্রমিক, নারী, মজলুমসহ সকলকে কথা বলতে দিয়ে একালে আর ক্ষমতার ভরকেন্দ্রগুলো নিজের ন্যায্যত টিকাতে পারে না। আপাতত ‘ছাত্র’রা উপলক্ষ্য। দীর্ঘমেয়াদে লক্ষ্য কিন্তু ‘সবাই’। যদিও সবাই সেটা চট করে বোঝে না। বোঝে না রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে; কখনো আবার মনোজগতে উপনিবেশের কারণে।
‘রাজনীতিমুক্ত’ শিক্ষাঙ্গনগুলোর মান বেড়েছে কী?
পুরো সমাজ থেকে, বিশ্ব থেকেও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। আবার সেগুলো, নিজে এক-একটা খুদে ‘রাষ্ট্র’ও বটে। ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি নিষিদ্ধের সাথে দেশ গঠনমূলক রাজনীতি নিষিদ্ধের ফারাক ও দূরত্ব তাই সামান্য। এটা মানবসত্তার বিরুদ্ধে সরাসরি এক আঘাত মাত্র। সেই আঘাত নয়াদিল্লীতে যেমন, তেহরানে যেমন, পেশোয়ার এবং ঢাকায়ও তেমন।
যে সমাজে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান রাজনীতির খবরদারিত্বে রয়েছে– যেখানে ব্যক্তির জীবনের সবকিছু, এমনকি তার খাবার, পোশাক, সংস্কৃতিতেও লেপটে থাকে রাজনীতি–যেখানে পাঠ্যবইয়ের গল্প-কবিতা নিয়েও গভীর রাজনীতি চলে, বিবাদ হয়– সেখানে কেবল বেছে বেছে তরুণদের রাজনীতিমুক্ত জীবন যাপন করতে হবে কেন?
কারণ, তার প্রতিবন্ধিত্বের বিপরীতেই কেবল গুটিকয়েকের কন্ঠ– উচ্চকন্ঠ হয়ে উঠতে পারে। এটা একটা বোবাযুদ্ধ। নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির কালে এটা এক শ্রেণীযুদ্ধও বটে। বুয়েটের বার্তা তাই ভালোভাবেই আমলে নিতে হবে সকলকে।
আগামীতে আবরারের মতো কেউ খুন হলে–আশা করা যায়, বুয়েট পরিবার নিশ্চুপ থাকবে। ‘রাজনীতি’ করতে যাবেন না তাঁরা। সেই কপটতা বড্ড বেমানান লাগবে। কিন্তু সকল ক্যাম্পাসে নিপীড়ন, নির্যাতন, খুনের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ করবেন কী সবাই?
ইদানিং দেখা যাচ্ছে, ‘শিক্ষার পরিবেশের স্বার্থে’ ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসিকে ‘অপরাধতুল্য’ বলে ন্যায্যতা দেয়া হচ্ছে। অনেক ‘বুদ্ধিজীবী’ এরকম দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ‘উন্নত শিক্ষা’ ও ‘শান্তিপূর্ণ’ পরিবেশের স্বার্থে সকল বিদ্যাপীঠকে ‘রাজনীতিমুক্ত’ করার সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। হ্যা, ‘সিস্টেম’-এর জন্য ‘শান্তি’ খুব দরকার।
কিন্তু ‘উন্নত শিক্ষা’র সঙ্গে তথাকথিত ‘রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন’-এর কোনই সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। এমন দেখা যায়নি, ডাকসু-রাকসু-ইকসু না থাকায় ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক সূচক এগিয়েছে কিংবা সেসব জায়গায় শিক্ষার্থীদের পেটানো, টেন্ডারবাজি কিংবা হলদখল কমেছে। বরং প্রবল রাজনৈতিক কলরব ধারণ করেই জেএনইউ কিংবা যাদবপুরের মতো বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বৈশ্বিক মানদন্ডে বহু ধাপ এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ-ভারতের সামান্য দূরত্বের মাঝে আমরা এই ভিন্ন দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি।
দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে ‘ছাত্র রাজনীতি’ বন্ধ বা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। এরূপ নিয়ন্ত্রণের নামে আসলে যা রুদ্ধ– তাহলো ক্যাম্পাসে গণতন্ত্রের চর্চা। কিন্তু সেখানকার শিক্ষার পরিবেশ ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ নয়– এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে উন্নত এমনটি দেখা যাচ্ছে না। গবেষণায়, জ্ঞানচর্চা, আবিষ্কারে– সেসব প্রতিষ্ঠান এগিয়েছে এমন শোনা যায় না। হ্যা, কোথাও কোথাও ‘কবরের শান্তি’ বিরাজ করছে। কারণ চরম বিপন্নতার মাঝেও সেখানে শিক্ষার্থীরা কথা বলতে পারে না। এরকম ‘কবরের শান্তি’ এবং ‘শিক্ষার উন্নত পরিবেশ’– নিশ্চিতভাবেই আলাদা কিছু। যেমন আলাদা কিছু কারা প্রাচীরের দুই দিকের পরিসর।
বাস্তবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জ্ঞানচর্চার ভয়হীন পরিবেশের জন্য দরকার গণতন্ত্র তাড়ানো নয়– বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সত্যিকারের স্বশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেই স্বশাসনের আকাঙ্খাই ছিল মুক্তিযুদ্ধে তরুণদের স্বপ্নের জায়গা। কিন্তু কৌশলে সেই স্বশাসনের আকাঙ্খাকে আজ রূপান্তর করে নেয়া হয়েছে গুটিকয়েক সিদ্ধান্তগ্রহণকারীর শাসনে।
‘স্বায়ত্তশাসন’ ও ‘গুটিকয়েকের শাসন’ মোটেই এক বিষয় নয়। স্বায়ত্তশাসনের নামে কোন ‘কর্তৃপক্ষ’ শিক্ষার্থীদের বলা ও চিন্তার স্বাধীনতাকে ছিনতাই করতে পারে না। বাংলাদেশ সংবিধান অন্তত সেটা সমর্থন করে না।
গণতন্ত্রহীন পরিবেশে তরুণদের আত্মহত্যা বাড়ে
আজকাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললেই একরাশ অভাব-অভিযোগের কথা শুনতে হয়।
গণতান্ত্রিক আবহ না থাকা এবং ইউনিয়ন না থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা বসবাস ও অধ্যয়ন-অনুশীলনের জন্য ন্যূনতম জরুরি সুবিধাগলো থেকে বঞ্চিত। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গার সংকট, স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের সুবিধা নেই, বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায় না, বিনোদনের কিছু নেই, ভালো পরিবহন নেই, লাইব্রেরি নেই, গবেষণা তহবিল নেই, গুণগতভাবে উন্নত শিক্ষা নেই, কবে পরীক্ষা হবে আর কবে ফল পাওয়া যাবে সেসব নিয়েও অনিশ্চয়তায় থাকতে হয়। শিক্ষকরা অন্যায় করলে কথা বলা যায় না। কর্মচারিদের অবহেলায় চুপ থাকতে হয়।
অথচ টিউশন ফি বাড়ছে ক্রমাগত। সঙ্গে, ভর্তিকালীন বিস্তর আয় আছে। নৈশকালীন কোর্সের ব্যবসা চলছে। উপরন্তু সরকারের তরফ থেকে শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে। ক্যাম্পাসে নতুন নতুন ভবন উঠছে।
জনগণের করের টাকাতেই এসব হয়। শিক্ষার্থীদের দেখিয়েই শিক্ষাখাতের যাবতীয় ব্যয় বৃদ্ধি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা অসন্তুষ্ট। তারা অসুখী। তারা বঞ্চিত। অনেক স্থানে তারা যৌন হয়রানি ও নিরাপত্তাহীনতারও শিকার। সন্ধ্যা হলে হলগুলোতে ক্যাডারদের সামনে হাজিরা দিতে হয়। মিছিলে খাটতে যেতে হয় দিনের বেলায়। এই অসন্তোষ ও অসুখী জীবনের কথা, নিরাপত্তাহীনতা ও বঞ্চনার কথা প্রকাশের নিয়মতান্ত্রিক সুযোগ রাখা হচ্ছে না। বলা হচ্ছে এটা ‘রাজনীতি’। এটা নিষিদ্ধ থাকবে।
দেশজুড়ে সকল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমবেশি একই রকম দৃশ্য এখন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই ছাত্রদের অধিকারভাবনাকে ‘রাজনীতি’র তকমা দিয়ে নিষিদ্ধ করে রেখেছে। এর ফল এত ভয়াবহ যে, মাঝে মাঝেই শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা করতে দেখছি আমরা। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ বছরে প্রায় ২৫ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এটা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র-ছাত্রী সংসদ না থাকার কাল। কেবল ২০১৮ সালে এখানে সাতজন পড়ুয়া নিজেকে নিজে হত্যা করেছে।
এসব মৃত্যুর কারণ কেউ খোঁজেনি। এই মেধাবীদের নিশ্চয়ই কিছু বলার ছিল। কিন্তু তাদের সতীর্থরা কার কাছে জবাবদিহিতা চাইবে? এরকম জবাবদিহিতা চাওয়াও যে ‘রাজনীতি’!
ইউনিয়ন ও গণতন্ত্রহীন পরিবেশে শিক্ষার্থীরা কীভাবে আছে– আত্মহত্যার ঘটনাবলী অবশ্যই তার বড় এক মানদন্ড। অনুসন্ধান হলে হয়তো দেখা যেতো, এসব আত্মহত্যা একধরনের পদ্ধতিগত হত্যা মাত্র। কিন্তু এখন, চারিদিকের চলতি প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানের পর প্রতিষ্ঠানে যদি কথাবার্তা বলায় নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে তাহলে শিক্ষার্থীদের আত্মহননের প্রবণতা আরও বাড়বে বৈকি।
যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের অর্থে চলছে, যেহেতু মেধাবী প্রজন্ম একটা দেশের ভবিষ্যতের জন্য বড় ভরসার ধন– সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে জনগণের সন্তানরা কীভাবে থাকবে ও কেন আত্মহত্যা করছে সেই বিষয়টি কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাকারী গুটিকয়েকের বিষয় হয়ে থাকতে পারে না। এ নিয়ে বৃহত্তর পরিসরে আলাপ-আলোচনা-পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে।
শিক্ষার্থীরা যদি দেশের ভবিষ্যত হয়– তাহলে তাদের আত্মহত্যার পরিবেশ থেকে বাঁচাতেই হবে। হাজার হাজার তরুণ-তরুণীকে আত্মহত্যা কিংবা বিষন্নতার দিকে ঠেলে দেয়া কোন বিকল্প হতে পারে না। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল ভয়মুক্ত পরিবেশে একটা নতুন প্রজন্মের আত্মপ্রকাশের জন্য– সেই প্রথম সত্য এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।