- লেখক: বীথি সপ্তর্ষি
১৪ দিন অফিস যাওয়া আর বাকি ১৪ দিন বাসা থেকে কাজ করার নিয়ম করা হয়েছে। সপ্তাহখানেক ধরে ঘরবন্দী সময় কাটাচ্ছি। মাঝেমাঝে বিকেলবেলা মগভর্তি চা নিয়ে ছাদে যাই। ৭ তলার ছাদ থেকে আকাশ দেখি, কী টলটলে-সুনসান! ছাদ থেকে নিচের নির্জন পৃথিবী দেখি, কী নিভৃতি! যেন পথ-ঘাট, সুউচ্চ ভবন, থেমে থাকা দানব বাস-ট্রাকগুলো দুপুরে পেটপুরে খেয়ে ভাতঘুম দিচ্ছে।
বছর বিশেক আগে দেখেছি, বৈশাখের এই কটা দিন কৃষিজীবীরা আয়েশ করে। ধান কাটা শেষ করে, খড়ের গাদা বেঁধেছেদে, গোলায় ছত্রিশ, স্বর্ণা, কালিজিরা ধান তুলে নতুন চালের ঘ্রাণে গ্রামের আকাশ-বাতাস সুবাসিত করে ঢেঁকুর তুলে তারা ঘুমাতে যায়। ভুলে যায়, চৈত্র্যের ক’টা দিন অনাহারে কেটেছে, জল-হাওয়ায় পেট ভরতে হয়েছে। ঘুমন্ত দুপুরে গাছের তলায় রাখালের জটলা, গাছেগাছে কোকিল-বৌ কথা কউ ছাড়া আর কেউ নেই।
ছাদ থেকে নিচের পৃথিবী দেখলে ইদানিং মনে হয়, সারা শহর অনিশ্চিত ভাতঘুমে আছে। কেউ জানে না, ঘুম থেকে কখনো ওঠা হবে কীনা। প্রিয় মানুষের গায়ের ঘ্রান নেয়া হবে কীনা, দূর-পরবাসে একা ডর্মে থাকা সন্তানের সাথে কোনদিন দেখা হবে কীনা, হার্টের বাইপাস করে শহর থেকে গ্রামে যাওয়া বাবার হাতের তালু কোনদিন ছোঁয়া যাবে কীনা!
খবরে দেখলাম বেলজিয়াম, জাপান, নেপালসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভূ-তাত্ত্বিকরা বলছেন পৃথিবীর ভূ-কম্পন উল্লেখযোগ্যহারে কমে গেছে। ক’দিন ধরে বিভিন্ন ভিডিও, ছবিতে দেখে যাচ্ছি বন্যপ্রাণীরা নির্জনতা দেখে মানুষের সভ্যতা, পিচঢালা পথ, ট্রাফিক ক্রসিং, সমুদ্র-সৈকত দেখতে আসছে। যেখানে সারাজীবন মানুষই জঙ্গল-পাহাড়, মরুভূমি দেখতে গিয়েছে সেখানে এ যেন প্রকৃতির নিষ্ঠুর প্রতিশোধ। যুদ্ধ চলছে মানুষে-প্রকৃতিতে। অমোঘ যুদ্ধ, একে এড়ানোর উপায় মানুষের নেই। তারপর সংবাদপত্রের কলাম, টক-শো’র বক্তৃতা, গবেষণা দেখে মনে মনে ভেবেছিলাম করোনা পরবর্তী পৃথিবীটা অন্যরকম হবে। জীবন মানে সেখানে মানুষের জীবন নয়, বিপ্লব মানে শ্রেণী-সংগ্রাম নয়, উন্নয়ন মানেও কেবল বড় বড় ইমারত-ফ্লাইওভার নয়। প্রতিটি উদ্ভিদ-প্রাণী, প্রাকৃতিক সন্নিবেশ, পাখি-কাঠবিড়ালী রক্ষা করাটাও সমগ্র সৃষ্টির ওপর প্রভুত্ব বিস্তারকারী মানুষের দায়িত্ব হিসেবে বর্তাবে।
আশায় বুক বেঁধেছিলাম করোনা-সাভাইভাররা নতুন পৃথিবী বানাবে। যেখানে কেউ কারো মালিক হবে না। মানুষ, বাঘ, কুকুর, গাছ, নদী সবাই মিলে এক বিস্তৃত পরিবার হবে। পরিবারে ঝগড়াঝাঁটি, মন কষাকষি হবে। তারপর মান ভাঙাতে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরবে, লৌকিক-অলৌকিক সম্মিলনে সুস্থ সম্পর্ক বিরাজ করবে। ভেবেছিলাম সেই পৃথিবীতে মানুষ নিজের আত্মসম্মান, মানবিক মর্যাদা বন্ধক রেখে বেতের ঘা খাওয়ার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান বানিয়ে চেয়ারের ওপর চাবুক দেখাশোনার ভার অর্পণ করবে না। কার হাতের বন্দুক থেকে বুলেট খাবে সেই পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার থাকবে না। ঘন জঙ্গল, ঝোপ-ঝাড়, নদী-খাল উজাড় করার মতো কোন ব্যক্তি-সংগঠন থাকবে না। রাষ্ট্র থাকলেও সুন্দরবন বা অ্যামাজন, তিস্তা বা রাইন ধ্বংস করে কেউ কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প, পারমানবিক বিস্ফোরক গবেষণাগার, যুদ্ধজাহাজ, হাতিয়ার বানানোর মতো প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করার হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবে না।
কিন্তু সংকটের মাঝখানে বসে টের পাচ্ছি, এইসব ভাবনা ফ্যান্টাসি মাত্র। ঘনঘোর বিপর্যয়ের মাঝখানে বসেও যখন কোন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান-সংগঠন কেবল মুনাফাকেই প্রাধান্য দেয় তখন বোঝাই যায় আর কোন আশা নেই। এবং সেই মুনাফাগন্ধী আচরণের ছায়ায় দাঁড়িয়ে কোটি কোটি মানুষ স্বগতোক্তি জানাতে থাকে তখন ধ্বংসই অনিবার্য। মানুষকে সৃষ্টির সেরাজীব হিসেবে গণ্য করা মানুষ যখন মানুষকে পেটানোর সমর্থন যোগায়, পায়ে-বুকে গুলি করার বন্দুক খোঁজে তখন বুঝে নিতে হয় এই সৃষ্টির হাতে প্রকৃতির কোন উপাদানই নিরাপদ নয়। এরা কেবল ধ্বংস জানে। সহ-মানবের জন্যই যারা সুস্থ পৃথিবী, মানবিক রাষ্ট্র, সহমর্মিতার সমাজ গঠন করার কথা বলে না তারা আর যাই হোক বৃক্ষের সজীবতা, আকাশের নীলিমা, দিগন্তের মায়া বুঝবে না।
করোনার আগেও বহু মহামারি এসে চলে গেছে। লাখে-কোটিতে মানুষ মরে পঁচে গেছে, পৃথিবীর বুক তবু ক্ষত-বিক্ষত করে নিজের ভোগ-বিলাসিতা কমানোর কথা কখনোই সভ্য মানুষের মনে হয়নি। হারানোর মাপজোক সংখ্যা দিয়ে করে কখনোই পৃথিবীর কীসে ভাল ভাবেনি। তবু বিশ্বাস করতে চাই, করোনা কাটিয়ে ওঠা মানুষ পার্থিব ভোগ-বিলাস, অপ্রয়োজনীয় বিভাজন-সংঘাত, পারস্পারিক প্রতারণা-দখলদারিত্বের মনোভাব বিলোপ করে নতুন করে ভাবতে শিখুক।
এই মহামারিতে আমরা যারা বেঁচে যাব অভূত-ভবিষ্যতের জন্য তারা চারপাশের প্রতিবেশের যত্ন নিই। লাল মাটি, সবুজ অরণ্য, নীল সমুদ্রের একটা ঝকঝকে রঙিন দুনিয়া নির্মাণ করুক। আমরা যারা মাটিতে মিশে যাব, তারা নতুন চারার গোড়ায় জৈবসার হয়ে রয়ে যাব।
বীথি সপ্তর্ষি: লেখক ও সাংবাদিক