- লেখক: ফরিদুল হক
আজ ভোরে সিলেট মেডিকেলের একজন সহকারী অধ্যাপক করোনায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন হয়ে মারা গেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। উনার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। যতদুর জানা যায় তিনি সিলেট মেডিকেলের করোনা বিভাগেই কর্মরত থাকা অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হন এবং সনাক্ত হওয়ার পরে প্রথমে তাকে নিজ বাসায় কোয়ারেন্টিনে রাখা হয় পরে অবস্থা খারাপ হলে হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু তাঁর অবস্থা যখন আরও খারাপ হয়ে ভেন্টিলেটর এর প্রয়োজন হয় তখন ‘রাষ্ট্রীয়’ কোন সহযোগিতা না পেয়ে ‘ব্যক্তিগত’ উদ্যোগেই এ্যাম্বুলেন্স যোগাড় করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। আর ঢাকার একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই আজ ভোরে উনি মৃত্যুবরণ করেন।
স্বাভাবিকভাবেই উনার মৃত্যুর খবরে সবার মাঝেই শোক-ক্ষোভ-হতাশা বিরাজ করছে। উনার জন্য মোটামুটি সবাই শোক প্রকাশ করছেন এবং উনার পরিবারকে সমবেদনা জানাচ্ছেন। অল্প হলেও কিছু মানুষের মাঝে রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার জন্য ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে। আর সবকিছু মিলিয়ে একটা চরম হতাশাজনক অবস্থা আগে থেকেই ছিলো সেটা আরও গাড় হলো এই ঘটনায়। তবে এতোকিছুর মাঝেও ‘করোনাযুদ্ধ’, ‘প্রথম শহীদ’, ‘ফ্রন্টলাইনার’ এই কথাগুলোও দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি! অনেকেই মোটাদাগে করোনা মোকাবেলাকে ‘করোনাযুদ্ধ’, ডাঃ মইনকে করোনাযুদ্ধের ‘প্রথম শহীদ’ ও ডাক্তারদের ‘ফ্রন্টলাইনার যোদ্ধা’ বানিয়ে ফেলেছেন। পশ্চিমা নেতা-মিডিয়ার ‘যৌথ প্রযোজনা’য় সৃষ্ট করোনাবস্থা কে খুব কায়দা করে যে ‘যুদ্ধাবস্থা’ হিসেবে আমাদের মগজে ‘সেট করা’ গেছে সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে।
সেদিনই একটা খবর (ওটা এই লেখার খোরাকও বটে) পড়ছিলাম কিভাবে পশ্চিমারা করোনাকে অদৃশ্য ‘শত্রু’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে আর করোনা মোকাবেলাকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে ঘোষণা করছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় ভালোই তো, ‘বিশ্বনেতারা’ ও ‘বিশ্বমিডিয়া’ করোনা মোকাবেলাকে যুদ্ধাবস্থার মতো ‘সিরিয়াস’লি দেখছেন। কিন্তু আমরা যদি অন্য এঙ্গেল থেকে দেখি তাহলে কেমন দেখি?, করোনা মোকাবেলায় কি কি করনীয় সেটা জানা থাকার পরেও গুরুতর আক্রান্তের শিকার অনেক দেশই সময়মতো প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিটুকুই নেয়নি। কিন্তু দুনিয়ায় এইরকম ‘দুনিয়াব্যপী’ মহামারী এবারই প্রথম নয়। এর আগেও বুহু মহামারী দুনিয়া যেমন দেখেছে তেমনি সেগুলোকে মোকাবেলা করেই দুনিয়া এগিয়েছে ও টিকে আছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই মহামারী মোকাবেলা করার যথেষ্ট জ্ঞান মানুষের কাছে মজুত আছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চার্লস রোসেনবার্গের ১৯৮৯ সালের বিখ্যাত রিসার্চ আর্টিকেল ‘হোয়াট ইজ় অ্যান এপিডেমিক? এইডস ইন হিস্টোরিক্যাল পার্সপেক্টিভ’ পড়ে যেকোনো রোগতত্ত্ব পলিসি নির্ধারকদের খুব সহজেই করোনা প্রতিরোধের পথ বের করতে পারার কথা। গবেষণাপত্রটিতে মহামারির ঐতিহাসিক উদাহরণ ও ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণাদি সহযোগে স্পষ্ট ব্যাখ্যা আছে কীভাবে মহামারি এপিসেন্টার হতে সারা দুনিয়ায় ছড়ায়। বিভিন্ন পর্যায়ে সামাজিক প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, সেটিও উল্লেখ করা আছে। প্রতিরোধ-প্রস্তুতি অতীতে কোন পর্যায়ে কী রকম হয়েছিল, এখনো কেমন হয় এবং আসলে কীরকম হওয়া দরকার ছিল সেইসব ইংগিতও সেখানে দেয়া আছে।
তাহলে কেন প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি না নিয়েই পরিস্থিতিকে ‘যুদ্ধাবস্থা’র সাথে তুলনা করতে সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া! সর্বস্ব বলার কারণ কয়েকজন ‘বিশ্ব’ নেতার বাণী ও কিছু ‘বিশ্ব’ মিডিয়ার শিরোনামেই স্পষ্ট হয়। এপ্রিলের ৫ তারিখ ইংল্যান্ডের রানী ২য় এলিজাবেথ তাঁর এক বক্তৃতায় বলছেন “we will meet again”। যেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ের একটা বিখ্যাত আহ্ববান মূলক ‘যুদ্ধসংগীত’। মার্চের ৯ তারিখ ইতালির প্রধানমন্ত্রী গোন্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আহ্বান জানান ইংল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ভাষায় “darkest hour” ঘোষণা দিয়ে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্পতো স্বভাবতই আরও একধাপ এগিয়ে নিজেই নিজেকে “war-time president” ঘোষণা দিয়ে বসেছেন। জাতসংঘের মহাসচিব গুতারেস জি-২০’র ভার্চুয়াল সামিটে ‘কোভিড-১৯’ নিয়ে বলেন, “We are at war with a virus – and not winning it. …This war needs a war-time plan to fight it” বিশ্ব মিডিয়াগুলোও পিছিয়ে নেই তাদের খবরের ‘শিরোনাম’ তৈরিতে যেমন গ্লোব এন্ড মেইল এর শিরোনাম হচ্ছে, “We are at war with COVID-19. We need to fight it like a war”।
করোনা মোকাবেলাকে একটা ‘যুদ্ধে’র সাথে তুলনা করা ট্রাম্প-জনসন-মোদী’দের মতো ‘ডানপন্থী’ ও ‘জাতীয়তাবাদী’ নেতাদের জন্য যে কতটা জরুরী সেটাই বোঝার ব্যাপার। কারণ কেবল ‘যুদ্ধাবস্থা’তেই ‘এভ্রিথিং ইজ ফেয়ার’ হয়। এই নেতাদের নিজেদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে অন্তত তিনটি প্রধান জিনিসের দরকার হয়, নিজের ‘মতাদর্শিক যৌক্তিকতা’ পুঃনপুঃন হাজির করা, ক্ষমতার ‘কর্তৃত্ব সুসংহতকরণ’ ও নিজের প্রয়োজনীয় ‘পুজিপতিদের’ বিভিন্ন উছিলায় ‘সুবিধা’ দেয়া। আর সেকারণেই আমরা দেখতে পাই, ইন্ডিয়ায় ‘অদৃশ্য শত্রু’ করোনার জন্য ‘মুসলিম’দের দায়ী করা হয়। ট্রাম্প করোনাকে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ হিসেবে ঘোষণা দেন এবং ‘খতম’ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশেও কিছু ‘জাতীয়তাবাদী’ ঝান্ডাধারীদের মুখে করোনাকে ‘পাকিস্তানী ভাইরাস’ হিসেবে খতমের ঘোষণাও দিতে দেখা যায়। দুনিয়াব্যপীই ‘জরুরী অবস্থা’ ও ‘বিশেষ বিল’ তৈরীর মাধ্যমে দেশে দেশে এইসব ডানপন্থীদের পরিস্থিতির ‘সদ্বব্যবহার’ করে নিজেদের ক্ষমতাকে আরও সংহত করতে ও বাড়িয়ে নিতে দেখা যায়। এরপরেই আসে ‘শক ডট্রিন’ ফর্মুলায় দুনিয়াব্যাপী বিশেষ বিশেষ আর্থিক ‘প্রনোদনা’, সেটা ট্রাম্পের ২ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে হাসিনার ৭২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যপ্ত। সেসব ‘প্রনোদনা’য় বেশ স্পষ্ট করেই দেখা যায় মানুষ বাঁচানোর অজুহাতে কিভাবে তারা নিজদের লোকের আখের গোছাতে ব্যস্ত।
এই পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা এখন এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, প্রতিনিয়ত ‘ছদ্ম চাহিদা’ উৎপাদন ছাড়া এই ব্যবস্থা আর একদিনও আরামসে টিকে থাকতে পারবেনা। তাই এই ব্যবস্থার সবথেকে ‘লাভজনক’ যে পন্য সেই ‘যুদ্ধ’কেই বারবার সামনে আনা এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে আরও অনেক অনেক দিন মানুষসহ পুরো প্রকৃতিকে শাসন-শোষণ করার ক্ষেত্র প্রস্তুতেই এরা মশগুল। অথচ আমাদের আলাপ করা দরকার শাসকরা কিভাবে এই মহামারী মোকাবেলার সহজ পথ রেখে সংকট ইচ্ছাকৃত কিছুটা বাড়তে দিয়ে মহামারীকে তাঁর মতাদর্শিক, কর্তৃত্ব ও পুঁজিবাদী স্বার্থে ব্যবহার করছে। সেইসাথে আমাদের আলাপ আরও করা দরকার, কিভাবে পুঁজিবাদের নির্মম থাবায় দুনিয়া করোনার মতো মহামারী দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার বাস্তবাতা তৈরি হয়। কারণ ইতোমধ্যে আমরা জানি করোনা আমাদের সামনে হঠাৎ করে চলে আসা কোন ঘটনা নয়। প্রকৃতির প্রতি দীর্ঘদিনের নির্মমতার ফল হচ্ছে এই করোনা। যে নির্মমতা আমাদের শিখিয়েছে মানুষ হচ্ছে প্রকৃতির মধ্যে ‘শ্রেষ্ঠ’। মানুষের সাপেক্ষে প্রকৃতি, প্রকৃতির সাপেক্ষে মানুষ নয়। এই ‘শ্রেষ্ঠ’ হবার মূলাই আমাদের সামনে ঝুলিয়ে গুটিকয়েক মানুষ তাদের স্বার্থ হাসিলে ক্রমাগত প্রকৃতির উপর এই নির্মমতা চালিয়ে গেছে। কিন্তু আসলেতো মানুষ এই প্রকৃতিরই একটা অংশ প্রকৃতির সাপেক্ষেই মানুষ। তবে প্রকৃতির অন্যসব স্পিসিসের তুলনায় কিছুটা হয়তো অগ্রসর। আর তাই মানুষের উপরই দায়িত্ব বর্তায় এই প্রকৃতি টিকিয়ে রেখেই নিজেকে টিকিয়ে রাখার পথ খুঁজে বের করা।
শাসকদের অতি পছন্দের ‘যুদ্ধ’ মেটাফোর যতবেশি সামনে আসে তাদের ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতা ততবেশি আড়ালে চলে যায়। কারণ ‘যুদ্ধাবস্থায়’ আপনি নিশ্চয়ই আগে চাইবেন যুদ্ধে জিততে! আপনার সামনে যে ব্যর্থ শাসক আছেন তাকে ভুলে গিয়ে আপনি ব্যস্ত থাকবেন ‘অদৃশ্য শত্রু’ নিয়ে। লক্ষ্য রাখুন শাসকগণ ও তাদের দোসর মিডিয়া কিভাবে বারবার করোনা মহামারীকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে ঘোষণা করে। কিভাবে ‘যুদ্ধাবস্থা’ হাজির করে আপনারই টাকায় চলা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কল-কজ্বা আপনার বিরুদ্ধেই ব্যবহারের ‘সম্মতি আদায়’ করতে থাকে প্রতিনিয়ত। করোনা অবশ্যই চলে যাবে, কিন্তু যে গভীর ক্ষত করোনা দিয়ে যাচ্ছে সেগুলো মোকাবেলা করে আমরাদের লড়াই যদি আমরা জারি রাখতে চাই তাহলে আমাদের প্রতিনিয়ত যেমন এইসব শাসকদের ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতার মুখোশ টেনে খুলতে হবে তেমনি মানুষে মানুষে ‘সামাজিক সংহতি’ বাড়ানোর পদ্ধতিও আরো জোরালো করতে হবে। এই সামাজিক সংহতিই আমাদেরকে যেমন বর্তমান সংকট থেকে মোকাবেলায় পথ দেখাবে তেমনি খুঁজে বের করতে সাহায্য করবে করোনার মতো মহামারী যাতে ভবিষ্যতে আমাদের সামনে আবার হাজির হতে না পারে।