এই সময়ে যারা উপনিবেশবাদ ও উত্তর-উপনিবেশবাদ নিয়ে লেখালেখি করেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আফ্রিকান বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো। নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো কেনীয় ঔপন্যাসিক, কবি ও উত্তর-উপনিবেশিক তাত্ত্বিক। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায় “ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্য” পড়ান। ইংরেজি ও গিকুয়ু ভাষায় লিখেন। তাঁর Decolonising the Mind (১৯৮৬) বইটি উত্তর-উপনিবেশিক তত্ত্বচর্চায় ক্লাসিকের সম্মান পেয়ে আসছে। এই বইটি একাডেমিক জগতের পণ্ডিতদের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মীদের জন্যও ভীষণ কাজের বলে বিবেচিত। গত ২৬শে সেপ্টেম্বরে অর্জুন চতুর্বেদি’র(Arjun Chaturvedi) সাথে থিয়োঙ্গোর একটি কথোপকথন ‘JACOBIN’ ওয়েবপোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে। এই সাক্ষাৎকারে তিনি আলাপ করেছেন চলমান ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের রাজনীতির সাথে তাঁর লেখালেখির সম্পর্ক নিয়ে। কেনিয়ার বর্ণবাদ ও সহিংসতার অভিজ্ঞতার সাথে তাঁর রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক কাজকারবার এবং বর্তমান জমানার নাগরিক অসন্তোষকে মিলিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন কীভাবে উপনিবেশিক উত্তরাধিকার কেনিয়ার রাজনীতিকে আকার-প্রকার দিচ্ছে এবং কেন ভাষা এখনো রাজনৈতিক যুদ্ধের ময়দান হিসেবে রয়ে গিয়েছে। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন সহুল আহমদ; অনুবাদটি পূর্বে বোধিচিত্তে প্রকাশিত হয়েছে।
উপন্যাস, থিয়েটার থেকে শুরু করে উত্তর-উপনিবেশবাদী তত্ত্ব পর্যন্ত বহু ঘরানায় আপনার কর্মকান্ড বিস্তৃত। এমন বিভিন্ন ঘরানা জুড়ে লেখালেখি করার অনুপ্রেরণা কি?
আমি গল্প শুনে শুনে ও পরবর্তীতে পড়ে পড়েই বেড়ে উঠেছি, এবং পরে আমি গল্পগুলো বলতে চেয়েছি। লেখালেখি এটা করতে সাহায্য করেছে। ফিকশন আমার সত্যিকারের ভালোবাসা। আমার প্রথম উপন্যাস Weep Not, Child এবং দ্বিতীয় উপন্যাস The River Between বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকে পড়ার সময়ে লিখেছি। আমি বিশ্বাস করি কলেজ থাকাকালীন লেখা এই বই এবং নাটকগুলো আমাকে আমার বুদ্ধিবৃত্তিক সাধনায় সাহায্য করেছে। সুতরাং, উপন্যাস, গল্প বলা এবং লেখালেখিটাই আমার আগ্রহের জায়গা।
কিন্তু আমি থিয়েটারের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলাম। আপনি জানেন, কমিউনিটি থিয়েটারের সাথে আমার সম্পৃক্ততার কারণে কেনিয়ার সরকার আমাকে ১৯৭৭-৭৮ সালে কারাগারে প্রেরণ করেছিল। আমি ইংরেজি ভাষান্তরে I Will Marry When I Want নামক একটি নাটক লিখতে সাহায্য করেছিলাম, কিন্তু আমি সেটা গিকুয়ু ভাষায় লিখে ফেলি। আপনি বলতে পারেন ফিকশন আমার প্রথম প্রেম, কিন্তু থিয়েটার আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে, কারণ থিয়েটার আমাকে সর্বোচ্চ-সুরক্ষিত কারাগারে প্রেরণ করেছিল।
সেইসাথে কারাগারে বসেই সিদ্ধান্ত নেই যে আমি মাতৃভাষায় লেখা শুরু করবো; আমার প্রথম তিনটা উপন্যাস ও নাটক ইংরেজি ভাষায় লেখা। মাতৃভাষায় লেখার দরুন আমাকে গারদে ভরার পর আমি আর কখনো ইংরেজিতে ফিকশন, নাটক এবং কবিতা না লেখার সিদ্ধান্ত নেই। মাতৃভাষায় প্রথম যে উপন্যাস লিখি সেটার নাম হচ্ছে [ইংরেজিতে] Devil on the Cross।
কেনিয়ায় ভাষার রাজনীতি নিয়ে আরো কিছু বলবেন?
আমি ব্যাখ্যা করেই বলি। কেনিয়াতে অনেকগুলো আফ্রিকান ভাষা রয়েছে, আমার মনে হয় প্রায় চল্লিশটার মতন। অর্থাৎ, কেনিয়ার বিভিন্ন মানুষের নিজস্ব মাতৃভাষা রয়েছে, এমনকি কেনীয়-এশীয় সম্প্রদায়েরও। আমাদের এশীয় ভাষাও রয়েছে। কিন্তু প্রভাবশালী ভাষা ও কেনিয়ার সরকারি ভাষা ছিল ইংরেজি, এখনো আছে। এটি ক্ষমতার ভাষা। এটি সংখ্যালঘুদের ভাষা, মানে যদিও কেনিয়াজুড়ে এই ভাষায় কথা বলা হয় তবু কেনিয়ার জনগণের মাত্র ১০-১৫ শতাংশ লোক এই ভাষায় কথা বলে। বাকিরা নিজস্ব মাতৃভাষায় কথা বলে অথবা সোয়াহিলি ভাষায়। সুতরাং কেনিয়ায় জনগণ তিনটা ভাষায় কথা বলে: প্রথমে মাতৃভাষা, তারপর সোয়াহিলি, এবং এরপর ইংরেজি।
আপনি যখন ইংরেজি থেকে গিকুয়ু ভাষার দিকে সরে গেলেন তখন আপনার লেখা কীভাবে বদলে গেলো?
এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সর্বাগ্রে আমি কেন গিকুয়ু’তে লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম? আগেই যা বলছিলাম, আমি এই সিদ্ধান্ত নেই যখন একটি আফ্রিকান ভাষায় লেখার জন্য কেনিয়ার সরকার আমাকে গ্রেফতার করেছিল এবং গারদে ভরেছিল। খুবই অদ্ভুত! এটি আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল। আমি নিজেকেই জিজ্ঞাসা করি। আমি ইংরেজিতে নিরপেক্ষভাবে রাজনৈতিক জিনিসপাতি লিখতে পারি, এতে কিছুই হয় না। কিন্তু যে মুহুর্তে সমান জিনিস মাতৃভাষায় লিখি তখনই আমাকে গারদে ভরা হলো?
তখনই আমি কেনিয়াসহ ভারত, ইউরোপ, আমেরিকা ও পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের উপনিবেশ প্রক্রিয়ায় ভাষার রাজনীতির বিষয়ে চিন্তা করা শুরু করি। আমি এই বিষয়ে চিন্তা করা শুরু করলাম: এটা কীভাবে হলো? আমার ষোল নাম্বার সেলে বসেই আমি সিদ্ধান্ত নেই যে ফিকশন, নাটক, কবিতা সব আমার মাতৃভাষাতেই লেখা হবে।
আমি আপনাকে বলতে পারি, ১৯৭৮ সাল থেকে আমার সকল উপন্যস, নাটক এবং কবিতা গিকুয়ু ভাষায় লেখা। কেবল একাডেমিক বা স্মৃতিচারণগুলোই আমি ইংরেজিতে লিখেছি। আফ্রিকান ভাষায় লেখার সিদ্ধান্ত নেয়া আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাকবদল ছিল, কারণ এটা আমার কেনিয়ার পরিবেশের সাথে সম্পৃক্ততা তৈরি করেছিল। এটা আমার নিজস্ব আলোকায়নের মুহূর্ত ছিল। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, আবেগের দিক থেকে এবং মানসিকভাবে সকল দিক থেকে এটা ছিল আমার ব্যক্তিগত মুক্তির মুহূর্ত।
ফিকশনের পাশাপাশি আপনি বহু তত্ত্বীয় কাজ করেছেন। বিশেষত আমি Decolonising the Mind-এর কথা ভাবছি। একটু খোলাসা করে কী বলবেন কীভাবে বিউপনিবেশায়নের ধারণাগুলো চলমান ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত?
এটা একটু জটিল, কিন্তু এতো জটিল না কারণ আমি সাদা-শাসিত কেনিয়াতে বড় হয়েছি। ১৮৮৫ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত কেনিয়া ছিল সাদা সেটেলারদের উপনিবেশ। সম্পর্কের কাঠামো ক্ষমতার বর্ণগত ক্রমাধিকারতন্ত্রের বা হায়ারার্কির উপর ভিত্তি করে ছিল, শীর্ষে সাদা সংখ্যালঘু, এরপর মধ্যে এশীয় সম্প্রদায় এবং নীচে আফ্রিকানরা।
আমি আমার স্মৃতিকথায় স্কুলে যাওয়ার কথা বলেছি, তখন এমনকি ট্রেনগুলোও পৃথক ছিল। প্রথম শ্রেণি ছিল কেবল সাদাদের জন্য, এবং লেখাও থাকতো ‘শুধু সাদাদের জন্য’। দ্বিতীয় শ্রেণি ছিল কেবল এশীয়দের জন্য। তৃতীয় শ্রেণি ছিল আফ্রিকানদের জন্য; কিন্তু এ ক্ষেত্রে তাঁরা ‘শুধু’ শব্দটাও ব্যবহার করত না, কারণ ধরেই নেয়া হতো তৃতীয় শ্রেণিটা কালো আফ্রিকানদের জন্য।
আমি এমন ব্যবস্থার মধ্যে বেড়ে উঠেছি যেখানে কালোরা, তা তাঁদের সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, তাঁরা সর্বদাই দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতো, বিপরীতে শীর্ষে সাদারা। নানা উপায়ে আমি ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের পুরো ধারণাটা বুঝতে পারি এবং এর সাথে সম্পর্কিত করতে পারি। আমি বলছি যে সাধারণত আপনি যখন বলেন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’, এর অর্থ এই না যে অন্যান্য জীবন ম্যাটার করে না বা গুরুত্ববহন করে না। আইনি ব্যবস্থায় সাদাদের জীবন সবসময়ই ম্যাটার করতো।
কিন্তু ঔপনিবেশিক স্মৃতির বিউপনিবেশায়নের পুরো ধারণার প্রতিও আমি আগ্রহী। এর দ্বারা আমি বিনির্মাণ (deconstruction) বোঝাচ্ছি। আমাদের বোঝা দরকার উপনিবেশিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেসকল ব্যবস্থা গিয়েছে, তা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আফ্রিকা বা এশিয়া যাই হোক না কেন, সবগুলোকেই মনের বিউপনিবেশায়নের মধ্য দিয়ে যাওয়া দরকার। এটা উপলদ্ধি করা খুব বেশি জরুরি যে, উপনিবেশিক ব্যবস্থা প্রায় সবাইকে বিভিন্ন উপায়ে আক্রান্ত করে।
আপনি যদি স্মৃতিস্তম্ভগুলো দেখেন, তাঁরা আমাদের ইতিহাস উদযাপন করে। কিছু কিছু স্মৃতিস্তম্ভ দাসত্বের ইতিহাস উদযাপন করে, অথবা যারা দাসত্ব ও নিপীড়ন থেকে ফায়দা লুটেছেন তাঁদের গুণকীর্তন করা হয়েছে। আমরা যেটাকে স্বাভাবিক বলি সেটাকে এটি আক্রান্ত করতে পারে। অস্বাভাবিকতাই স্বাভাবিকতায় পরিণত হতে পারে। আমাদের বলতে হবে না না না! এটা স্বাভাবিক না যে কালো লোকদের গ্রেফতার করে মেরে ফেলা হবে এমনকি যখন তাঁরা ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’ (I cannot breathe) বলে চিৎকার করছে তখনও। এগুলো স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড নয়, এইসব কর্মকাণ্ডকে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনা।
এটা কি বিউপনিবেশায়নের একটি রূপ?
আমার কাছে, মনের বিউপনিবেশায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আনন্দিত যে, ১৯৮৪ সালে যা লিখেছিলাম সেটা বর্তমানে সাধারণ দাবিতে পরিণত হচ্ছে: মনের বিউপনিবেশায়ন এবং প্রতিষ্ঠানের বিউপনিবেশায়ন। Something Torn and New শিরোনামে আমার আরেকটা বই আছে। সেখানে আমি স্মৃতির রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছি। যখন কোনো একটা স্থানকে উপনিবেশ করা হয় তখন পুরনো স্মৃতিকে কবর দিয়ে নতুন স্মৃতিকে রোপন করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ নিউইয়র্কের কথা বলা যাক। সেখানে ইউরোপীয়রা বসতি গড়ার পূর্বে দেশীয় আমেরিকানরা বসবাস করতো। তাঁদের কাছে এই জায়গার একটা নাম ছিল, কিন্তু যখন ডাচরা আসলো তখন বললো, না না, এটাকে নিউ আমস্টার্ডাম নামেই ডাকা উচিৎ। কিন্তু যখন ইংরেজরা আসলো, তাঁরা বললো, ‘না না, এটা নিউ আমস্টার্ডাম নয়, আগে যা ছিল এটা তা নয়। এখন থেকে এটা নিউইয়র্ক।’ নতুন নাম পুরোনো নামের সাথে জড়িত স্মৃতিকে কবর দিয়ে দেয়।
আমাদের বোঝা জরুরি যে, এমনকি মূর্তি এবং অন্যান্য জিনিস আসলে স্মৃতি বহন করে এবং স্থানের পুরনো স্মৃতিকে কবর দেয়। আমি আনন্দিত যে, মনের বিউপনিবেশায়ন এবং প্রতিষ্ঠানের বিউপনিবেশায়নের প্রশ্নটা সারা দুনিয়াজুড়েই উচ্চারিত হচ্ছে।
ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের আন্দোলনের পিছনে বর্ণবাদকে সমালোচনা করার লম্বা ইতিহাস আছে। এই ইতিহাস কিভাবে আপনার লেখালেখিকে প্রভাবিত করছে?
আমার মনে হয় এটা Dreams in a Time of War-তে আছে যেখানে আমি সেই দিনের কথা বর্ণনা করেছি যেদিন আমি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি এবং উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে যাচ্ছিলাম। সেদিন টহলরত ব্রিটিশ সেনাদের মুখোমুখি হই। একজন ব্রিটিশ সেনা আমার মুখে আঘাত করে এবং আমি পড়ে যাই। আমি শারীরিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারিনি। আপনি ভেতরে ভেতরে ক্রোধান্বিত হবেন, কিন্তু কিছুই করতে পারবেন না। সেনাটি আপাদমস্তক অস্ত্রসজ্জিত ছিল এবং তাঁর সাথে আরো সৈনিক ছিল। আমি তখন কেবলমাত্র প্রাথমিক স্কুল থেকে মাধ্যমিক স্কুলে উত্তীর্ণ হয়েছি এবং ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলাম।
ফলে আমি সেদিনের আঘাতটাকে মনে রেখেছি, কারণ আমার কান্না পাচ্ছিল কিন্তু নিজেকে বোঝাচ্ছিলাম আমি কাদবো না। আমি জোর করে কান্না আটকে রেখেছিলাম এবং আমি যতই কান্না আটকাচ্ছিলাম সে ততই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল। ঔপনিবেশিক সমাজের যেকোন বাসিন্দাই ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের সাথে নিজেকে সম্পর্কিত করতে পারবেন এবং পারাটাও উচিৎ বটে।
___________
২৬শে সেপ্টেম্বর, ২০২০