এডোয়ার্ড সাইদ ও পশ্চিমের প্রাচ্য দর্শন

  • বখতিয়ার আহমেদ

সম্পাদকীয় মন্তব্য: নৃবিজ্ঞানী বখতিয়ার আহমেদের এই নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে, দৈনিক যুগান্তরে। ২০১৪ সালে একটি ছোট ভূমিকাসমেত তিনি তার ফেসবুক নোটে লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করেন। বর্তমান লেখাটি ফেসবুক নোট থেকেই নেয়া হয়েছে। বেনজীন খান সম্পাদিত ‘এডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ : আবিশ্ব বিবেকের কণ্ঠস্বর’-তে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল।

[লেখকের মন্তব্য: ২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিকেলে আমি কুষ্টিয়া জেলা সদর থেকে কুমারখালি থানায় যাচ্ছিলাম একটা গবেষণার কাজে। গড়াই ফেরিঘাটে পৌঁছে খেয়া নৌকার অপেক্ষায় ছিলাম। হঠাৎই দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার তৎকালীন সাহিত্য সম্পাদক বন্ধু শহীদুল ইসলাম রিপনের ফোন। ‘বাদল, একটা দুঃসংবাদ আছে, এডোয়ার্ড সাইদ মারা গেছেন’। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের টুইন টাওয়ারে হামলা আমাদের জীবৎকালের সবচেয়ে বড় ঘটনা। সেই স্মৃতি তখনো তরতাজা। নাইন ইলেভেনের পরে আমূল বদলে যাওয়া বিশ্ব-বাস্তবতা বুঝতে আমাদের তখন প্রধান দুই সহায় চমস্কি আর সাইদ। একদমই প্রস্তুত ছিলাম না ইনাদের কাউকে বিদায় জানাতে। মনে পড়ে গেল সাইদ এর বাংলাদেশী বন্ধু, নাট্যকার সাইদ আহমেদের বাসায় রিপনের সাথে গিয়ে বসে বসে শুনেছি সাইদকে নিয়ে আরেক সাইদের স্মৃতিচারণ। মৃত্যুর ঝাঁকিটাই বুঝিয়ে দিল কখন যেন এই মানুষটি অনেক দুরের হয়েও কত কাছের কেউ হয়ে উঠেছিলেন। রিপনের অনুরোধ, একটা অবিচুয়ারি লিখে দিতে হবে তাঁর সাহিত্য পাতার জন্য।

আমার আর গড়াই পার হওয়া হয় না। সেই রাতেই রাজশাহীতে ফিরে এসে এই লেখাটা লিখতে বসি সাইদকে নিয়ে। পরদিন পাঠিয়ে দিই। সে সপ্তাহের যুগান্তর সাহিত্য পাতা প্রচ্ছদ রচনা হিসেবে ছেপেছিল লেখাটা। আজকে ফিরে পড়তে গেলে টের পাই কত কাঁচা একটা লেখা ছিল। কিন্তু তারপরও লেখাটার প্রতি আমার একটা গভীর মমত্ববোধ কাজ করে। আমার চিন্তার পাটাতন অনেকখানিই সাজিয়ে দিয়েছে সাইদের লেখালেখি। যত অকিঞ্চিৎকরই হোক না কেন, লেখাটা সাইদের প্রতি আমার অকপট প্রণতির স্মারক হয়ে আছে। আজ সাইদের ত্রয়োদশ মৃত্যুবার্ষিকী। ভাবলাম লেখাটা অনলাইন হোক আজ।]

এডোয়ার্ড সাইদ আর নেই। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নিউইয়র্ক শহরের এক হাসপাতালে দুনিয়ার মুক্তিমুখীন প্রতিরোধ আন্দোলনের এই লড়াকু সৈনিক ৬৭ বছর বয়সে এসে হার মানলেন লিউকেমিয়ার কাছে। তাও খুব সহজে নয়, গোটা একটি দশক ধরে এই মরণব্যধিকে প্রাণপণ প্রতিরোধ করেই। আমরা যারা পৃথিবীর আরেক প্রান্তে ইন্টারনেট মারফত আল-আহরাম উইকলি, আল হায়াত, কাউন্টার পাঞ্চ বা জেট নেটের বদৌলতে তার নিয়মিত কলামগুলো অনিয়মিত পড়তাম, এই নিঃশব্দ লড়াইয়ের পুরো খোঁজ তাদেরও জানা ছিল না। নিজ সামাজিক পরিচয়ের পুরা পরিসর জুড়ে তৎপর একজন শাস্ত্রবিদ হিসেবে, মধ্য-ষাটের দশক থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রতিটি ধাপে ক্ষুরধার বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়ে জগত শাসন ও জগত বিচারের পশ্চিমা তরিকার স্বরূপ উন্মোচনের অগ্রণী চিন্তুক হিসেবে, এমনকি ১১ সেপ্টেম্বরের টুইন টাওয়ারে হামলা এবং তার অব্যবহিতকালে আফগানিস্তান ও ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন ও গণহত্যার মধ্য দিয়ে সূচিত হওয়া তীব্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অপরায়নের ডামাডোলেও সাইদের কলম আমাদের সচকিত করেছে পদে পদে। একই সময় থেকে তার তৎপর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রথম প্রতিধারণাগত রূপায়ন “প্রাচ্যবাদ” আলোড়িত করেছে তুলনামূলক সাহিত্য থেকে নৃতত্ত্ব পর্যন্ত জ্ঞানকাণ্ডের অনেকগুলো শাখাকেই। পাশাপাশি নিজ জন্মভূমি প্যালেস্টাইন প্রশ্নে একাধারে মোকাবেলা করেছেন গোটা পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক জগতকে। অন্যদিকে পূব-পশ্চিমের সম্ভাব্য প্রতিটি বুদ্ধিবৃত্তিক আয়োজনে সোচ্চার কণ্ঠে উত্থাপন করেছেন প্যালেস্টাইনি স্বাধিকার আন্দোলনের দাবি। কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন নিউইয়র্কে, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন ১৯৬৩ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। তারপরেও গোটা পশ্চিমা জগতে তার পরিচিতি ‘ভয়েস অফ প্যালেস্টাইন’ হিসেবেই।

তার কর্মজীবনের আরেকটু বিস্তারিত হদিস করতে গেলে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে তুলনামূলক সাহিত্যের অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৯৭৯’তে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং মাঝখানে ১৯৭৫-৬ সাল কাটিয়েছেন স্ট্যানফোর্ডের সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজ ইন বিহেভিওরাল সাইন্সে গবেষক হিসেবে। সম্পাদনা করেছেন ‘আরব স্টাডিজ কোয়াটারলি’ নামে একটি পত্রিকা। সর্বাধিক পঠিত ও আলোচিত অরিয়েন্টালিজম ছাড়াও উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে আছে জোসেফ কনরাড এন্ড দ্য ফিকশন অফ অটোবায়োগ্রাফি, বিগিনিংস: ইনটেনশন এন্ড মেথড, দ্য কোয়েশ্চেন অফ প্যালেস্টাইন, লিটারেচার এন্ড সোসাইটি, কাভারিং ইসলাম, আফটার দ্য লাস্ট স্কাই, ব্লেমিং দ্য ভিকটিমস, মিউজিক্যাল ইলাবোরেশনস, কালচার এন্ড ইম্পেরিয়ালিজম, রিপ্রেজেন্টেশন অফ ইন্টেলেকচুয়াল, আউট অফ প্লেস, দা এন্ড অফ পিস প্রসেস, অসলো এন্ড আফটার, পিস এন্ড ইটস ডিসকন্টেন্টস। কাছের জনদের ধারণায় তিনি একজন গুণী পিয়ানো বাদক, দূরবর্তী পাঠকেরা তার কিছুটা আঁচ পাবেন তার সঙ্গীত বিষয়ক লেখালেখি থেকে। কাজেই তার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ তৎপরতার এই সুবিশাল ক্যানভাস বরাবরই আড়াল করেছে ঘাতক ক্যান্সারের সাথে যুগব্যাপী লড়াই ও বসবাসের ইতিবৃত্ত। ফলে জেনিন, নাবলুস, জাফা, আক্রা, গাজা, জেরুজালেম, বাগদাদ, তিকরি, উম্মে কসর, কারবালা, কাবুল, মাজার-ই-শরিফ, কান্দাহারসহ পৃথিবীর তাবৎ করদ নগরীর অবিশ্রান্ত রক্তপাত থামবার আগেই তার এই মৃত্যু বড় আকস্মিক ঠেকে, বিহব্বল করে।

সাইদের জন্ম ১৯৩৫ সালে জেরুজালেম নগরীতে, প্যালেস্টাইনি ঐতিহ্যের এক খ্রীস্টান পরিবারে। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এই ব্যবসায়ী পরিবারটি চলে আসে কায়রোতে। শৈশব ও স্কুল জীবনের একাংশ কেটেছে কায়রোর ভিক্টোরিয়া কলেজে এবং আরেক অংশ ম্যাসেচুসেটস এর মাউন্ট হারমনে। নিজের এই শৈশবে পশ্চিমা শিক্ষা কাঠামোর সাথে প্রাচ্য সংস্কৃতির সংশ্লেষণের ঠিকুজি তালাস করেছেন আত্মজীবনীমূলক রচনা আউট অফ প্লেস এবং নট কোয়াইট রাইট’ এ। ১৯৬৪ সালে হাভার্ডে পিএইচডি শেষ করবার আগে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায় শেষ করেন ১৯৫৭ সালে। এর মাঝেই যোগ দেন প্যালেস্টাইনি স্বাধিকার আন্দোলনে এবং ১৯৭৭ সালে প্রবাসী প্যালেস্টাইন পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন এবং তার পরের এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ইয়াসির আরাফাতের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন পিএলও তথা প্যালেস্টাইনি স্বাধীনতা আন্দোলনকে। ১৯৯১ সালে অসলো চুক্তি নিয়ে রাজনৈতিক মতান্তর ঘটে ইয়াসির আরাফাতের সাথে, অনেকটা নিঃশব্দেই সরে আসেন সাইদ। কিন্তু আরাফাতের সাথে যুগব্যাপী এই সংগ্রামী বন্ধুত্বের অবসান প্রসঙ্গে নিজের দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করেছেন মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে দুই রচনা অসলো এন্ড আফটার এবং পিস এন্ড ইটস ডিসকন্টেন্টস’এ। পিএলও এবং ইজরাইলের মধ্যে সম্পাদিত অসলো শান্তিচুক্তিকে সাইদ মুল্যায়ন করেন “প্যালেস্টাইনি আত্মসমর্পণের দলিল” হিসেবে যা পুরো আরব জনগোষ্ঠীর উপর সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পুরোন ইজরাইলি নীতির সম্প্রসারণ মাত্র। সাইদের বিচারে এই প্রহসনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা “অসৎ দালালে”র যে তার মক্কেল ইজরাইলকে আগাগোড়া মদদ দিয়ে এসেছে।

১৯৯১ সালে পি এল ও’র রাজনীতি থেকে সরে আসার পরপরই তাঁর লিউকোমিয়া ধরা পড়ে। ১৯৯২ সালে এক সাক্ষাৎকারে সাইদ নিজের ক্যান্সার নিয়ে কথা বলেন, জানান জটিল পদ্ধতির চিকিৎসা এবং নিজের কাজের মাঝে সমন্বয়ের চেষ্টা করছেন। সেই সমন্বয়ের ফলাফল হচ্ছে এই যে, পরের ১১ বছরে শুধু তার একাডেমিক লেকচারের তালিকাতেই এসে যায় ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম। এ সময়েই বিবিসি রেডিও, কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং রেডিও, অস্ট্রেলিয়ান রেডিওতে নিয়মিত উপস্থিতি তাকে অচিরেই শীর্ষ স্থানীয় মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের অধিকার আদায়ের আমৃত্যু সংগ্রাম এবার নতুন মাত্রা পায়। প্যালেস্টাইনি উদ্বাস্তু হয়ে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেও সাইদ মধ্যপ্রাচ্য তথা দুনিয়া জুড়ে ইজরাইল-ইঙ্গো-মার্কিন নীতির কঠোর সমালোচকদের অন্যতম একজন হয়ে উঠেন। মুস্তফা বারঘাওতির সাথে গড়ে তোলেন প্যালেস্টাইনের গণতান্ত্রিক মুক্তিকামী সংগঠন প্যালেস্টাইনিয়ান ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভস। ১৯৯৮ সালে বিবিসি টেলিভিশন ইজরাইল রাষ্ট্রের ৫০বছর পূর্তি উপলক্ষে প্যালেস্টাইনি দৃষ্টিকোণ থেকে ইহুদি রাষ্ট্র ইজরাইলের ইতিহাস সম্বলিত তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য সাইদকে মনোনীত করে। ইজরাইল, বেশ কয়েকটি আরব দেশ এবং ব্রিটেনে ঘুরে ঘুরে অজস্র সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাইদ এই তথ্যচিত্রে প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডের দাবিকে কেন্দ্র করে ইহুদিবাদী জ্ঞানতত্ত্ব যে “আরব মুখ” পরিবেশন করে তাকে চ্যালেঞ্জ করেন। প্রবল আধিপত্যশীল মিডিয়া এবং তার রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর থেকে সাইদের এই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধের পথ সব সময় কুসুমাস্তির্ণ ছিল না। ৯০ দশকের শুরুতে ইজরাইলি মিডিয়ায় সাইদের বিরুদ্ধে বিষোদগারের ধরন জানা যায় দুটি ঘটনা থেকে, একবার ইজরায়লি মিডিয়া লিখল যে সাইদ আদৌ কোন প্যালেস্টাইনি উদ্বাস্তু নন, কাজেই তিনি রাজনৈতিক যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার যোগ্য নন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকুরী তো নয়ই। আরেকবার বৈরুতে ইজরাইল সীমান্তবর্তী ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শনে গিয়ে উদ্বাস্তুদের ইজরাইলি ভূখণ্ডের প্রতি পাথর নিক্ষেপের প্রতীকী অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ব্যস, পরদিন পশ্চিমা মিডিয়া ফলাও করে “ইহুদি বিদ্বেষী” সাইদের পাথর ছুড়ে মারার ছবি ছাপায়।

কিন্তু তবু বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিঠিয়ে থাকা পঞ্চাশ লক্ষ প্যালেস্টাইনি উদ্বাস্তু এখন শোক, শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছে সাইদকে। গাজা, পশ্চিম তীরে ইজরাইলি কর্তৃপক্ষ এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরো কয়েকটি আরব সরকার তার একাধিক বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, কিন্তু সাইদের কণ্ঠ তাতে রোধ করা যায়নি। ১৯৯৩ সালে পিএলও তথা আরাফাতের সাথে বিচ্ছেদের পরে তিনি আরো উচ্চকিত হয়েছেন ইজরাইলি আগ্রাসনের বিরোধিতার পাশাপাশি আরব সমাজ তথা আরব নেতৃত্বের রাজনৈতিক পশ্চাৎপদতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, প্রায় অচল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং উৎপাদন বিমুখ অর্থনৈতিক নীতির সমালোচনায়। কায়রোর আল আহরাম এবং লন্ডন ভিত্তিক আরবি দৈনিক আল হায়াতে প্রকাশিত ধারাবাহিক রাজনৈতিক নিবন্ধগুলো হাজার হাজার আরব তরুণকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্পেষিত একটি জনগোষ্ঠীর বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের ভার ইতিহাস সাইদকে দিয়েছে, আমৃত্যু তিনি তাতে পিছু হটেননি এক পাও।

এই সুদীর্ঘ প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সক্রিয়তার পাশাপাশি এডওয়ার্ড সাইদ পশ্চিমের তুলনামূলক সাহিত্য তথা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় উত্তর-উপনিবেশিক ধারার শীর্ষ স্থানীয় বোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৬০’র দশকের মাঝামাঝি তুলনামূলক সাহিত্যে তার প্রথম গবেষণা ছিল জোসেফ কনরাডের উপন্যাস নিয়ে। ১৯৭০ এর দশকের শুরুতেই তিনি আকৃষ্ট হন ইউরোপীয়, বিশেষত ফরাসী কাঠামোবাদের দিকে। ১৯৭৫ সালে ফরাসী কাঠামোবাদের অন্যতম দুই পুরোধা জাঁক দেরিদার অবিনির্মাণ এবং মিশেল ফুকোর ক্ষমতাতত্ত্বের আলোচনায় আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন ‘বিগিনিংস:ইনটেনশন এন্ড মেথড’ শিরোনামের বইটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। নিজের অনুকল্প প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐতিহাসিক আন্ত:সম্পর্কের স্বরূপ উন্মোচনের ক্ষেত্রে তিনি ফুকোর ক্ষমতা ও জ্ঞানের গভীর কাঠামোগত আন্ত:সম্পর্কের ধারণা প্রয়োগ করেন। প্রবল ক্ষমতাতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সত্য বলবার জন্য প্রয়োজনীয় সাহসের স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন তার সবচেয়ে আলোচিত রচনা, ১৯৭৫-৭৬ সালে স্ট্যানফোর্ডের সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজ ইন বিহেভিওরাল সাইন্সে গবেষক হিসেবে কাজ করবার সময় লেখা ‘অরিয়েন্টালিজম’এ।

শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, রাজনীতি তথা সমসাময়িক বুদ্ধিবৃত্তির প্রতিটি প্রত্যঙ্গকে আলোড়িত করেছে তার এই প্রাচ্যবাদ বিচার যার আওতায় সাইদ আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তি যে বহুমাত্রিক প্রক্রিয়ায় নিজের ঐতিহাসিক ‘অপর’ হিসেবে প্রাচ্যের সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্মাণ করে তার সাথে উপনিবেশিক তথা সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য ও শোষণের যোগসূত্র বিশ্লেষণ করেন। এক্ষেত্রে তিনি আগ্রহী প্রাচ্য-প্রতীচ্যের আন্ত:সম্পর্কের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান-জাগতিক প্রক্রিয়াগুলোর স্বরূপ অনুধাবনে। তার বিবেচনায় ‘প্রাচ্য’ একটি পশ্চিমা জ্ঞান জাগতিক নির্মাণ যার সাথে জড়িয়ে আছে উপনিবেশ যুগের প্রথম দিকে পৃথিবীর এই আধা-কল্পিত রহস্যময় ভূমিতে ইউরোপিয়ান অভিযাত্রীদের অভিনব রোমাঞ্চকর অভিযান ও অভিজ্ঞতার স্মৃতি। ফলে আধুনিক পশ্চিমের যাবতীয় জ্ঞান জাগতিক প্রতিভাসে এই ‘প্রাচ্য’ ‘পরিবেশিত/উপস্থাপিত’ হয়েছে প্রান্তিক অপর হিসেবে। প্রস্তাবের সমর্থনে সাইদ চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন একাধারে পশ্চিমের দেশগুলোর ক্রুসেড থেকে সমসাময়িক কাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রনীতি, শেক্সপিয়ার থেকে কিপলিং পর্যন্ত সাহিত্য, ভ্রমণ বৃত্তান্ত, ইতিহাস ও ইতিহাসতত্ত্ব, রাজনীতি, শিল্প-কলা, ব্রিটিশ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নৃতাত্ত্বিক মাঠ গবেষণা, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কর্তৃত্ববাদী শাস্ত্রচর্চা এমনকি আরব-ইজরাইল উত্তেজনা নিরসনে হেনরি কিসিঞ্জারের মতামত পর্যন্ত।

প্রত্যয় হিসেবে ‘প্রাচ্যতন্ত্র/প্রাচ্যবাদ/প্রাচ্যবিদ্যা’র একাধিক অর্থ বা পরিবেশনজনিত, আন্ত-নির্ভরশীল দ্যোতনা আছে। সবচেয়ে বেশি প্রচলিত অর্থে এটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় প্রাচ্যবিদ্যার যে কোন ধরনের চর্চাকে বোঝায়। চর্চাকারী প্রাথমিক পরিচয়ে নৃবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী বা ভাষাবিজ্ঞানী যাই হোন না কেন, তার প্রাচ্য সম্পর্কিত যে কোন জ্ঞান জাগতিক তৎপরতাই বিশেষ বা সাধারণ অর্থে তাকে প্রাচ্যবিদ বলার জন্য যথেষ্ট এবং এক্ষেত্রে তিনি যা করেন তাকে ‘প্রাচ্যবাদ’ বলা চলে।

অন্যদিকে এই শাস্ত্রীয় ঐতিহ্যের নিরীক্ষে, যে জনগোষ্ঠীগুলোর ঐতিহাসিক রাজনৈতিক নিয়তি, বিচ্ছিন্নতা ও অভিবাসন, স্বাতন্ত্র্য ও বিকাশ প্রাচ্যবিদ্যার গোঁড়ার বিষয়বস্তু, আরো সাধারণতর অর্থে প্রাচ্যবাদ ঐ জনগোষ্ঠীগুলোর সাংস্কৃতিক পরিচয়কে ক্ষমতা সম্পর্কের পরিপূরক রূপে বিন্যস্ত ও পরিবেশন করে। এক্ষেত্রে প্রাচ্যবাদ হয়ে যায় ‘প্রাচ্য’ ও ‘প্রতীচ্যে’র মধ্যে সত্তাগত বা চৈতন্য পর্যায়ের সুনির্দিষ্ট বিভাজন নির্ভর একটি চিন্তন পদ্ধতি। তখন এই পদ্ধতির প্রকরণগত আওতায় চলে আসে আধুনিক ইতিহাসের অসংখ্য লেখক, কবি, উপন্যাসিক, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ আরো অনেকে যারা প্রাচ্য-প্রতীচীর এই বিভাজনকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে, প্রাচ্যের মানুষের চিন্তা, জীবন ও সংস্কৃতিকে নিজের কাজের বিষয় বা ক্ষেত্র হিসেবে নির্ধারণ করেন। প্রাচ্যবিদ্যার এই সংজ্ঞায়ন একাইলাস ও ভিক্টর হুগো বা দান্তে ও কার্ল মার্ক্সের রচনার তুলনামূলক পাঠ ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্র তৈরি করে শাস্ত্রীয় প্রকরণ হিসেবে প্রাচ্যবিদ্যার শক্তিমত্তার প্রমাণ দেয়।

অষ্টাদশ শতকের শেষভাগকে প্রাচ্যবিদ্যার আবির্ভাব কাল ধরলে, বিগত একশ-দেড়শ বছর বয়সী প্রাচ্যবিদ্যার চেহারা দাঁড়ায় আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্রের মতই। আবির্ভাবের কিছুদিনের মধ্যেই এটি একটি মতাদর্শিক সংহতি সংঘের রূপ নেয় এবং এর মধ্য দিয়ে এনলাইটেনমেন্ট যোগ রেঁনেসা যোগ উপনিবেশবাদ যোগ শিল্প বিপ্লব যোগ ফরাসী বিপ্লব যোগ রুশ বিপ্লবের উত্তরাধিকার নিয়ে ‘আধুনিক’ পশ্চিম মুখোমুখি হয় ‘প্রাক-আধুনিক’ প্রাচ্যের। এই প্রাচ্যবিদ্যা তখন নিজেকে উপনিবেশিক সম্প্রসারণবাদী ক্ষমতাতন্ত্রের পরিপূরক মতাদর্শ তৈরির কাজে লাগায়। এই প্রাচ্যবিদ্যাই তখন প্রাচ্যের মানুষ ও সমাজের বিবরণ লেখে, তাদেরকে দেখবার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে, তাদের কাছে সভ্যতার আলো পৌঁছে দেয়, শিক্ষা দেয় এবং সর্বোপরি শাসন করে। মোদ্দা কথা হচ্ছে এই বিচারে প্রাচ্যবিদ্যা হচ্ছে প্রাচ্যের উপর পশ্চিমা কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি সুসংহত তরিকামাত্র। ফুকোর অনুগামী হিসেবে সাইদ এই তরিকাটিকে বিবেচনা করেন ‘ডিসকোর্স’ হিসেবে, যার কল্যাণে ইউরোপীয় সংস্কৃতি ‘প্রাচ্য’কে রাজনৈতিক, সামাজিক, সামরিক, মতাদর্শিক, বৈজ্ঞানিক এমনকি কাল্পনিকভাবেও নিয়ন্ত্রণ ও পুনরুৎপাদন করে।

সাইদের মতে প্রাচ্য-প্রতীচ্য কোন প্রাকৃতিক বিভাজন নয়, এমনকি এটা কোন ভৌগলিক বিভাজনকেও নির্দেশ করেনা। ‘প্রাচ্য’ একটি ধারণা মাত্র যা পশ্চিমের একটি ঐতিহাসিক চিন্তন প্রক্রিয়ার ধারবাহিকতা, একটি কল্পিত ভৌগলিক সীমানা, কিছু আধা-কল্পিত সাংস্কৃতিক পরিচয়, বিচ্ছিন্ন কিছু চিত্রকল্প এবং ভাষার সমন্বয়ে ঐ ধারণার একটি বাস্তব প্রতিরূপ সৃষ্টি করে। একইভাবে ‘প্রতীচ্য’ও একটি ধারণা যা একই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় ‘অপর’ ‘প্রাচ্যে’র বিপরীতে ‘অহম’ হিসেবে ‘প্রতীচ্য’কে উপস্থাপন/নির্মাণ করে মানবিক চিন্তন প্রক্রিয়ার দ্বৈত বিপরীত কাঠামো পূর্ণ করে। সাইদের তাত্ত্বিক পরিগঠনে ফরাসী কাঠামো ও উত্তর-কাঠামোবাদী নৃবিজ্ঞানের প্রভাব ছাড়াও প্রাচ্য-প্রতীচ্যের সম্পর্ক বিচারে তিনি শরণ নিয়েছেন নব্য মন:সমীক্ষণবাদী তাত্ত্বিক জাঁক লাঁকা’র। লাঁকার মতে ব্যক্তি মানুষ কেবলমাত্র নিজের বিপরীতে ‘অপরে’র অস্তিত্বের সাপেক্ষেই নিজের ভেতর ‘আমি’র অস্তিত্ব নির্মাণ করতে পারে। সাইদ এই একই যুক্তি প্রয়োগ করে দেখান যে, আধিপত্যশীল পাশ্চাত্য সংস্কৃতি প্রাচ্য সংস্কৃতির অপরায়নের মধ্য দিয়েই নিজের পরিচয় নির্মাণ করেছে।

এই ঐতিহাসিক চিন্তন প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতাকে সাইদ যুক্ত করেন উপনিবেশিক ক্ষমতাতন্ত্র এবং আধিপত্যবাদী ভৌগলিক সম্প্রসারণের সাথে। ১৯৯৮ সালের ক্যামব্রিজ এক্সপিডিশন এবং তার পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ক্রিয়াবাদী নৃবিজ্ঞানের মাঠকর্মলব্ধ জ্ঞান উপনিবেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন, বিদ্রোহ ইত্যাদি মোকাবেলায় উপনিবেশিক প্রশাসনিকতাকে শক্তিশালী করেছে। তখনও কিন্তু প্রাচ্যবিদ্যা চর্চা বর্বর অপাশ্চাত্য সমাজগুলোকে ‘সুসমাচার’ শুনিয়ে সভ্য বানানোর জন্য পশ্চিমা সভ্যতার মহান মিশন হিসেবেই উপস্থাপিত। কিন্তু সাইদ একে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন প্রাচ্যের উপর ইউরো-আটলান্টিক ক্ষমতাতন্ত্রের জারি রাখা আধিপত্যের প্রতীক হিসেবে, তার আচার, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের বিচারমূলক বয়ান হিসেবে। পরিবেশন ও উপস্থাপনের গুনে এই বয়ান এমনকি, একাধারে জৈবিক এবং সাংস্কৃতিক বর্ণবাদের জন্ম দিতে সক্ষম। তার এই সক্ষমতার পেছনে আছে জ্ঞান ও ক্ষমতার অন্তর্লীন সম্পর্কের বুনিয়াদ যা প্রাচ্যবিদ্যার বয়ানগুলোর কর্তৃত্বের উৎসও বটে। সাইদ প্রাচ্যের এহেন বাঙময় বাস্তবতাকে শুধুমাত্র পশ্চিমা কল্পনার জাল হিসেবেই বিবেচনা করেন না, তার বস্তুগত অস্তিত্বকেও আমলে নেন। প্রাচ্যবিদ্যা তাই চুড়ান্ত বিচারে পশ্চিমের বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠানের সমর্থনপুষ্ট মতাদর্শিক কথকতার প্রকাশ এবং তার প্রতিনিধিত্ব করে।

১৯৭৮ সালে ‘অরিয়েন্টালিজম’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাইদের কলম যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, গোটা পশ্চিমা দুনিয়াকে বিগত একশ বছরে এত বড় আর কোন বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়নি। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় এই কলম যখন চিরদিনের মত স্থির হল, তার আগের প্রায় তিন যুগে তা থেকে নিঃসৃত শব্দমালা আরো বহু যুগ হাজারো কলমকে ব্যতিব্যস্ত রাখবে জ্ঞান, ক্ষমতা ও সংস্কৃতির আন্ত:সম্পর্কের নিবিড় অনুধাবনে, শক্তি জোগাবে আসন্ন সব ইন্তিফাদাকে।

জুবেরি ভবন, রা. বি। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৩।

প্রথম প্রকাশ: দৈনিক যুগান্তর। ৩ অক্টোবর, ২০০৩। ঢাকা।

ফেসবুক নোট, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *