উপস্থাপনায় সার্বভৌমত্ব : বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী চলচ্চিত্র

  • কবিতা চাকমা, ভাষান্তর: ডালিয়া চাকমা

অনুবাদকের মন্তব্য: ‘Sovereignty Over Representation: Indigenous Cinema in the Chittagong Hill Tracts of Bangladesh’ প্রবন্ধটি Katya Gracia-Anton সম্পাদিত Sovereign Words, Indigenous Art, Curation and Criticism গ্রন্থে, Office for Contemporary Art Norway/ Valiz, Amsterdam কর্তৃক প্রথম প্রকাশ হয়। প্রকাশকের সাথে মতবিনিময় করে এ প্রবন্ধটি ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ ব্লগের জন্য অনুবাদ করা হয়েছে।

আদিবাসী চলচ্চিত্র আন্দোলন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফোর্থ সিনেমা নামে পরিচিত। এই প্রবন্ধ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রেক্ষাপটে আদিবাসী চলচ্চিত্রের উত্থানকে অনুধাবন করে ফোর্থ সিনেমা ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করেছে। সেই সাথে, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী চলচ্চিত্রকে বৃহৎ পরিসরের উপস্থাপনা (রিপ্রেজেন্টেশন) বয়ানে যুক্ত করে আদিবাসী কর্তাসত্বা (সাবজেক্ট) মূলধারার বাংলাদেশ সিনেমায় কিভাবে ‘অপর’ হিসেবে চিত্রিত হয়েছে, এবং সেই উপস্থাপনাকে ক্রিটিক্যালি প্রশ্নবিদ্ধ আলোচনায় এনে, এই নিবন্ধ আদিবাসী চলচ্চিত্রের উপস্থাপনায় যা চিত্রায়ন হয়েছে তা সার্বভৌমত্ব হিসেবে বিবেচিত হতে পারে বলে জ্ঞায়মান করেছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সিনেমা প্রোডাকশন এবং পাহাড়ি আদিবাসীদের উপস্থাপন:

১৯৫৭ সালে বৃটিশ উপনিবেশ শেষ হওয়ার এক দশক পরে রাজধানী ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান “পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন” (The East Pakistan Film Development Corporation) স্থাপিত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির নাম পাল্টে বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (BFDC) করা হয়। চলচ্চিত্র শিল্পের একেবারে শুরু থেকেই সিনেমা নির্মাণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামকে দুইটি কারণে আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রথমত, বাংলাদেশের বিশাল ব-দ্বীপ অন্তর্গত সমতটের বিপরীতে এখানকার পাহাড় ও বন সমৃদ্ধ অনন্য প্রাকৃতিক ভূ-দৃশ্যের জন্য। দ্বিতীয়ত, ১৯৬০ সালে কাপ্তাইয়ে হাইড্রো ইলেক্ট্রিক বাঁধ নির্মানের ফলে ৬৮৮ বর্গ কিমি জুড়ে তৈরি হওয়া কৃত্রিম কাপ্তাই লেকের জন্য, যার শান্ত নির্মল রূপ বহু দ্বীপপুঞ্জকে ঘিরে এক অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্য তৈরি করেছে। যদিও ছবির মত সুন্দর এই মানব সৃষ্ট লেক বিপুল সংখ্যক অবাঙালি আদিবাসীদের পরিবার, ঘর, জীবন-যাত্রা ধ্বংস ও বিপর্যস্ত করে দেয়।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ও নতুন বাংলাদেশ সরকারের জন্য এই কাপ্তাই হাইড্রো ইলেক্ট্রিক প্রজেক্টটি ছিলো প্রযুক্তিগত কৃতিত্ব ও রাষ্ট্রের মডার্নিটিতে প্রবেশের একটি গুরুত্বপূর্ন নির্দেশক। সেই সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের নতুন জাতিরাষ্ট্র পরিদর্শনে অনিবার্য কাপ্তাই ভ্রমণের সাথে ভিজ্যুয়াল ডকুমেন্টেশনও করা হতো। ১৯৭৮ সালে বিশ্বসেরা ভারোত্তোলক চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলীর রাষ্ট্রীয় সফরকালীন কাপ্তাই প্রকল্প পরিদর্শন ‘Bangladesh I Love You’ (বাংলাদেশ, আমি তোমাকে ভালোবাসি) নামক ডকুমেন্টারি ফিল্মে দৃশ্যবদ্ধ করা হয়।

নতুন অর্জিত এই মডার্নিটি তথা আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ায়, ঢাকার বর্ণনামূলক চলচিত্রে (Narrative Film) পার্বত্য চট্টগ্রাম ও এর আদিবাসীদেরকে এক্সোটিক ‘অপর’ হিসেবে বিনির্মাণ করা হয়। নৃতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদরা লক্ষ্য করেন যে, ‘জাতীয়ভাবে দর্শকদের কাছে আবেদন তৈরির প্রয়াসে নির্মাতারা জনপ্রিয় সিনেমায় ‘ট্রাইবাল সুন্দরীরা’ [পার্বত্য চট্টগ্রামের] পাহাড়ের ঢালে বসবাস করে, এ ধরণের সৌন্দর্য উপাদান (picturesque element) প্রতিনিয়ত দৃশ্যায়ন করেন।’ বাঙালি পরিচালক জহির রায়হানের উর্দু ভাষায় নির্মিত ও প্রশংসিত প্রথম রঙিন পাকিস্তানি, বক্স অফিস হিট ফিল্ম ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪) সিনেমায়ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে এ রীতিতে উপস্থাপন করা হয়। চলচ্চিত্র নির্মাণের এই সময়টিতে আদিবাসীদের কর্তাসত্বা চিত্রায়নে তাদেরকে বাঙালিদের তুলনায় ‘আদিম’, ‘পিছিয়ে পড়া’, ‘নেতিবাচক’ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন করে দেখানো হয়।

কবিতা চাকমা

চলচ্চিত্র নির্মাতারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বহুজাতির আদিবাসীদেরকে একটিমাত্র শব্দ ‘পাহাড়ি’ হিসেবে প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাদের বৈচিত্র্যতাকে একীভুত করে ফেলেন। নিজেদের কল্পনাপ্রসূত আইডিয়ার সাথে আদিবাসীদেরকে মিলিয়ে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা কেবল বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটেই নয়, পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের প্রেক্ষাপটেই বাস্তবতা বর্জিত। শুরুর দিককার চলচ্চিত্রগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা নিয়ে কোনো ধারণাই উঠে আসতো না, বরং এই জায়গা ও এখানকার আদিবাসীদেরকে একধরণের মামুলি এক্সোটিক পশ্চাদ দৃশ্য-অংশ (exotic backdrop), প্রাকৃতিক দৃশ্য-বিবরণী-বিধান (scenography) রূপে দেখানো হতো। ১৯৭৬ সালের সুপার হিট সিনেমা ‘যখন বৃষ্টি এলো’-তেও এরকম দৃশ্যায়ন দেখা যায়, যার অনেকাংশের শ্যুটিং পার্বত্য চট্টগ্রামেই করা হয়। বাঙালি অভিনেত্রী অলিভিয়া গোমেজ এর মূল চরিত্রে অভিনয় করেন। এতে তিনি ‘পাহাড়ি সৌন্দর্যের প্রতিরূপ’ হিসেবে যে পোশাক ও সাজে অভিনয় করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো জাতির সাথেই তার মিল নেই। এতে দেখানো হয়, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বেড়াতে আসা, ঢাকার বাঙালি এলিট ওয়াসিমের প্রেমে পড়েন। সিনেমায় এই ‘পাহাড়ি সুন্দরী’ এবং তার পিতাকে তাদের বাঙালি সমকক্ষদের তুলনায় ঊন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, দেখা যায় তারা নায়ককে ‘বাবু’ উপাধিতে সম্বোধন করছেন। বাংলাদেশী সিনেমা ও নাটকে এভাবে হরহামেশাই পাহাড়িদেরকে ‘বাঙালি বাবু’ নামক ক্ষমতাশালী চরিত্রের অধস্তন হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে।

তবে শুরুর দিককার সিনেমা ‘মেঘের অনেক রঙ’-এ পার্বত্য চট্টগ্রাম ও এর অধিবাসীদের দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পরিলক্ষন করা যায়। এটি ১৯৭৬ সালের হারুনুর রশিদের শিল্প সমৃদ্ধ ছবি যা শ্রেষ্ঠ সিনেমা, শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ শিশু অভিনয়শিল্পী, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র দৃশ্যায়ন এবং শ্রেষ্ঠ গান পরিচালনা- এই পাঁচটি ক্যাটাগরিতে জাতীয় পুরস্কার পায়। সম্ভবত এই ছবিই প্রথম বাণিজ্যিক সিনেমা যেখানে একজন অ-আদিবাসী চলচ্চিত্র নির্মাতা পার্বত্য চট্টগ্রাম ও এর পাহাড়িদেরকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছেন। ফিল্মের প্রধান চরিত্র, ডাক্তার এলাহী (ওমর এলাহী কর্তৃক অভিনীত) যিনি একজন বাঙালি চিকিৎসক, তাঁর স্ত্রী রুমা (অভিনয়ে ডাক্তার রওশন আরা) এবং তাদের শিশু আদনান (অভিনয়ে মাষ্টার আদনান) এ চরিত্রগুলোকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সহিংসতার প্রেক্ষাপটে তুলে ধরা হয়। যুদ্ধের সেই তালমাতাল সময়ে ওমর তাঁর স্ত্রী ও সন্তানের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। পাকিস্তানি সেনারা রুমাকে গণধর্ষন করে এবং প্রায় মৃতপ্রায় অবস্থায় তাঁকে তাঁর সন্তানসহ ফেলে রেখে যায়। ডাক্তার ধরেই নেন যে তাঁর পরিবারের সকলকেই মেরে ফেলা হয়েছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে তিনি মাথিন (অভিনয়ে রিনা সারকি) নামের একজন পাহাড়ি নার্সের সাথে নতুন করে বৈবাহিক জীবন শুরু করেন। এদিকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত রুমা আরোগ্য লাভের জন্য তাঁর সন্তানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত হন। পুনর্বাসন কেন্দ্রে তিনি তাঁর ডাক্তার স্বামীকে দেখা মাত্র চিনতে পারেন, কিন্তু ধর্ষিত হওয়ার কারনে লজ্জায় স্বামীর মুখোমুখি হন না। এর পরিবর্তে তিনি বেনামে তাঁর সন্তানকে ডাক্তার ও তাঁর স্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেন এবং নিজে আত্মহত্যা করেন।

মেঘের অনেক রঙ, ১৯৭৬

অন্যান্য বর্ণনামূলক বাংলা সিনোগ্রাফিক সিনেমার চেয়ে ভিন্ন এই সিনেমাটিতে দৃশ্যায়নের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক দৃশ্য ও সেখানকার ঐতিহ্যবাহী জীবনযাপন ধারণে অকৃত্রিমতা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে জুম চাষ, মারমাদের প্রধান বোমাং রাজার বৌদ্ধ মন্দিরে গমনের আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রার দৃশ্য দেখানো হয়।

মাথিন চরিত্রে অভিনয়কারী রিনা সারকি পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী যিনি মায়ের দিকে ত্রিপুরা এবং বাবার দিকে নেপালি বংশোদ্ভুত। পাহাড়ি চরিত্রে বাঙালি শিল্পী অভিনয়ের প্রথা থেকে সরে গিয়ে এরকম চরিত্র রূপায়ন এই সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এই ফিল্মে পাহাড়ি চরিত্রগুলোকে অধীনস্ত বা মামুলি হিসেবে নয় বরং সম্মানজনকভাবে দেখানো হয়েছে এবং মূল পাহাড়ি চরিত্রগুলোকে আধুনিক ও উচ্চশিক্ষিত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সিনেমায় দেখা যায়, মাথিন বাঙালি ও পশ্চিমা কেতাদুরস্ত পোশাক পড়েন, শিক্ষিত অভিজাতদের উচ্চারনে বাংলা কথা বলেন, টাইম ম্যাগাজিন পড়েন। তিনি ও তাঁর স্বামী দুজনের মধ্যে প্রায়শ চপল, সরস বাক্যবিনিময় হয় এবং কোনো পক্ষকেই অপরের অধীনস্ত হিসেবে চিত্রিত করা হয়নি।

তারপরও আদিবাসী প্রেক্ষাপটে এই সিনেমার কিছু কিছু ব্যাপার সমস্যাজনক। এই সিনেমাটি নতুন রাষ্ট্রে কে থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং রাষ্ট্রের প্রতি পাহাড়িদের আনুগত্যকে সংশয়ের দৃষ্টিতে উপস্থাপন করে। সিনেমার একটি অংশে দেখা যায় নতুন রাষ্ট্রের প্রতি স্পষ্টত দায়বদ্ধ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবারত মাথিন ব্যাখ্যা করছেন কেনো তিনি তাঁর দেশের জন্য লড়াই করবেন। প্রত্যুত্তরে ডাক্তার ওমর মাথিনের কথাকে ‘borrowed ideas’ (ধার করা আইডিয়া) হিসেবে দাবী করে শ্লেষাত্মক স্বরে প্রশ্ন করেন, “এই মুক্তিযুদ্ধ কি আপনারও?” যার অন্তর্নিহিত অর্থ দাঁড়ায়, অবাঙালিদের ক্ষেত্রে নতুন রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধ করার আসলে কোনো প্রকৃত কারণ নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাহাড়িদের অবদানের এই অস্বীকৃতি দেশের জাতীয় বয়ানের সাথে মিলে যায়, যা মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অবদান ও ত্যাগকে প্রত্যাখ্যান করে।

ডাক্তার ওমর রাষ্ট্রের বা দেশের প্রতি মাথিনের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্ন করলে মাথিন বলেন, ‘জানি, আপনারা আমাকে বাঙালি বলে স্বীকার করতে চান না, বাট আই বিলং টু দিজ ল্যান্ড’। মাথিনকে এই ডায়লগ নিয়ে উপস্থাপন করাকে বলা যেতে পারে তাঁর শিক্ষা, সমৃদ্ধি ও আধুনিকতায় পাহাড়ি মর্যাদার উপরেও তাঁর চূড়ান্ত অনুসন্ধান হচ্ছে বাঙালি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া। এই ব্যাখ্যাটি আরো জোরালো হয় যদি আমরা তৎকালীন উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য দেখি, যারা পাহাড়িদেরকে নিজস্ব সংস্কৃতি ছেড়ে বাঙালি সংস্কৃতিতে একীভূত হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে হওয়া এক বৈঠকে রহমান লারমাকে বলেন, “তোরা সব বাঙালি হইয়া যা”। এই বাঙালি কর্তৃত্ববাদ (Hegemony) ১৯৭২ এর সংবিধানেও পরিস্কারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে যেখানে বাংলাদেশকে একটি মাত্র ভাষা (বাংলা) ও একটি মাত্র জাতির (বাঙালি) দেশ হিসেবে কাঠামোগত আকৃতি দেয়া হয়েছে। ডাক্তার ওমর ও মাথিনের কথোপকথন রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে মূর্ত করে এবং আদিবাসীদের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে যদি না তারা এক জাতির কাঠামোয় অংশগ্রহণ না করে।

মেঘের অনেক রঙ’ সিনেমার মধ্য দিয়ে স্বল্পকালীন কর্মজীবন সমাপ্ত করা অভিনেত্রী মাথিন বাদে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সিনেমাতে একমাত্র পেশাদার আদিবাসী অভিনেতা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের যুগান্তর চাকমার নাম উল্লেখযোগ্য, পর্দায় যার নাম ‘চাইনিজ’।১০ বাংলা অ্যাকশন মুভিতে চাইনিজ সাধারণত সহকারী অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করেন। মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক বেল্টধারী হিসেবে তিনি বহু অ্যাকশন মুভির ফাইট ডিরেক্টর ছিলেন। ১৯৮৪ সালে বাংলা সিনেমা ‘ইন্সপেক্টর’-এ একজন স্মাগলার হিসেবে পর্দায় তাঁর প্রথম আবির্ভাব ঘটে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৪০০ সিনেমায় অভিনয় করেন, যার সবগুলোতেই তাঁর পাহাড়ি পরিচয় একেবারেই উপেক্ষিত ছিলো। তাঁর চরিত্রগুলো ছিলো সাধারণত নেতিবাচক ঘরানার- কখনো স্মাগলার, কখনো বিদেশী, কখনো ভিলেনের সহকারী। মাহতাব হোসেন, একজন বিনোদন প্রতিবেদক, এজন্যই বাংলা সিনেমার ‘চাই্নিজ’ ভিলেন হিসেবে যুগান্তর চাকমার বর্ণনা দেন।১১

জাতীয় চলচ্চিত্রে এভাবেই আদিবাসীদের কর্তাসত্বাকে (সাবজেক্টিভিটি) ঊন বা লঘু করে নির্মাণ করা হয়েছে, – হয় বাঙালিদের অধস্তন হিসেবে, না হয় বিদেশী হিসেবে, নতুবা ভিলেন, অথবা খুব বেশি হলে বাঙালি হতে চাওয়া একজন আদিবাসী হিসেবে।

ফটোগ্রাফার: ডেনিম চাকমা

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সিনেমাঃ

ঝিমিত ঝিমিত চাকমা রচিত ও পরিচালিত চাকমা ভাষার মঞ্চ নাটক ‘আন্দলত পহর’ (আঁধারে আলো) ১৯৯৬ সালে ঢাকার আরণ্যক নাট্যদলের সহযোগীতায় মঞ্চের বাইরে শ্যুট করে পুনরায় নির্মিত হয়, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ফিল্ম হিসেবে গণ্য। এর এক দশক পরে ২০০৬ সালে একটি আদিবাসী লোককাহিনী নির্ভর চাকমা ভাষার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ডুলু কুমুরি’ মুক্তি পায়। এটাই প্রথম সিনেমা যার স্ক্রিপ্ট, প্রযোজনা, পরিচালনা ও পরিবেশনা সবই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা করেন।১২ ২০০৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই ১২ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী চলচ্চিত্র নির্মাতারা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রায় পঞ্চাশের অধিক ফিল্ম নির্মাণ করেছেন। এর মধ্যে স্বল্প থেকে পূর্ণদৈর্ঘ্য নানান ধরণের সিনেমা আছে, যার মধ্যে সামাজিক সাংস্কৃতিক ও ইকোলোজি সংক্রান্ত স্বল্প দৈর্ঘ্যের পরীক্ষামূলক ফিল্ম যেমন আছে, তেমনি পূর্ণদৈর্ঘ্যের এক্টিভিস্ট ডকুমেন্টারিও আছে, আরও আছে স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্যের বৈশিষ্ট্যমূলক নানান ঘরানার ছবি। এই ফিল্মগুলো তাদের বিষয়বস্তুর ধরণ অনুযায়ী গুণগতমানে ও কর্তাসত্বা নির্মাণে একে অপর থেকে ভিন্ন, এবং সেই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রেও তাদের মধ্যে কোনো মিল নেই। থিমগুলো শহর থেকে গ্রাম এবং গল্পগুলো কাল্পনিক থেকে বাস্তব ঘটনা কেন্দ্র করে বিস্তৃত বৈশিষ্ট্যের। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, আদিবাসী সমাজের বা মানুষের ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যতার (হেটেরোজেনাস) মতোই তাদের ফিল্মগুলোও নানান বৈশিষ্ট্যের।

রাষ্ট্র কিংবা সিনেমা পৃষ্ঠপোষক ব্যক্তি বর্গের সহায়তা ছাড়া নির্মিত পার্বত্য চট্টগ্রামের ফিল্মগুলো সাধারণত ‘নো বাজেট’ ফিল্ম, যেখানে অভিনয়কারী ও টেকনিশিয়ানরা স্বেচ্ছাশ্রম বা নামমাত্র মূল্যে কাজ করে থাকেন। আবার, পার্বত্য চট্টগ্রামের সিনেমাগুলোর নির্মাণকাজ ও গ্রহণযোগ্যতা কেবল এই অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে, সিনেমাগুলো ‘অলাভজনক’ও বটে। তারপরও এই সব সিনেমা কখনো কখনো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অডিয়েন্সের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। আবার কিছু কিছু সিনেমা স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভেলে প্রশংসিতও হয়েছে।

১৯৯০ সালে মাওরি চলচ্চিত্রবোদ্ধা ও নির্মাতা বেরি বার্কলে (Barry Barclay) বড় হাতের ‘I’ সম্বলিত ‘Indigenous Cinema’ (আদিবাসী সিনেমা) পরিভাষাটির প্রচলন করেন।১৩ ফার্নান্দো সোলানস ও অক্টাভিয়ো গেটিনো (Fernando Solanas and Octavio Gettino) প্রবর্তিত ফার্স্ট, সেকন্ড ও থার্ড সিনেমার ফ্রেমওয়ার্কের সাথে আদিবাসী সিনেমাকে ‘ফোর্থ সিনেমা’ হিসেবে যুক্ত করার মধ্য দিয়ে বার্কলে একে চলচ্চিত্র শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করেন। ফার্স্ট সিনেমা বলতে সাধারণত হলিউডের সিনেমাগুলোকে বোঝানো হয়। সেকেন্ড সিনেমা হচ্ছে ইউরোপীয় আর্ট ফিল্মগুলো, যা হলিউডি সিনেমার রীতিনীতিকে বর্জন করে নিজস্ব ঘরানায় উপস্থাপন করে। আর থার্ড সিনেমা হচ্ছে উত্তর উপনিবেশিক দেশগুলোর সিনেমা (যেমন, সোলানস ও গেটিনোর দেশ লাতিন আমেরিকা) যেগুলোতে সেখানকার অধিবাসীদের উপনিবেশিত সাংস্কৃতিক মানসিকতাকে নির্যাতিতের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নির্মাণ হয়।১৪  আর ফোর্থ সিনেমার সংজ্ঞায়নে বার্কলে বলছেন যে, আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের যে সাংস্কৃতিক লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষা আছে তার সাথে এই সিনেমার আইডিওলজিক্যাল মিল নেই। বলা যেতে পারে এক্ষেত্রে পুরানো ‘ফোর্থ ওয়ার্ল্ড’ কনসেপ্টের সাথে ‘ফোর্থ সিনেমা’র সূত্রায়ন আছে। বিংশ শতকের শেষ দিকে আন্তর্জাতিকভাবে আদিবাসী এক্টিভিজমের১৫ অংশ হিসেবে এই ‘ফোর্থ ওয়ার্ল্ড’ পরিভাষার প্রচলন ঘটে যার জোয়ার পার্বত্য চট্টগ্রামেও এসে পড়ে।

ফটোগ্রাফার: ডেনিম চাকমা

অদ্যাবধি পার্বত্য চট্টগ্রামের যতগুলো চলচ্চিত্র নির্মিত হলো তন্মধ্যে ২০১৪ সালে অং রাখাইনের ‘ম’ ঠেংগাড়ি’ (My Bicycle) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যার মধ্যে বার্কলের আদিবাসী বা ফোর্থ সিনেমার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত হয়। ‘ম’ ঠেংগাড়ি’ পুরোপুরি চাকমা ভাষায় নির্মিত প্রথম মূলধারার সিনেমা যার পরিচালনা ও স্ক্রিপ্ট উভয়ই অং রাখাইন নিজে করেছেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে সংযুক্ত জেলা কক্সবাজারের একজন আদিবাসী চলচ্চিত্র নির্মাতা। ২০১৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৩ তম ‘International Short and Independent Film Festival’ -এ ‘ম’ ঠেংগাড়ি’র প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে আরও প্রায় ২০ টি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে এটি প্রদর্শিত হয়। ২০১৫ সালের ‘Silver Akbuzat International Festival of National and Ethnic Cinema’-য় মূল ক্যাটাগরির প্রতিযোগীতায় এটি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের পুরস্কার পায়।

’ম’ ঠেংগাড়ি’র গল্প পার্বত্য চট্টগ্রামের একজন আদিবাসী বেকার তরুণ কমলকে (কমল মণি চাকমা এর নাম চরিত্রে অভিনয় করেন) ঘিরে গড়ে উঠে, যার জীবন তার প্রিয় বাইসাইকেলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। শহরে চাকরি পাওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কমল তার বাইসাইকেল নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে। প্রযুক্তি থেকে দূরস্থিত এই গ্রামটিতে কমলের সাইকেল একটা অভিনব জিনিস হিসেবে গৃহীত হয়। কমল তার সাইকেলের মাধ্যমে লোকজন ও মালামাল ফেরী করে অর্থ উপার্জনের চিন্তাভাবনা করতে থাকে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন করা মিলিটারী, ও এলাকার ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের মধ্যে সংঘটিত হওয়া নিজেদের কোন্দলে কমলের প্রচেষ্টা অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। ঘটনাক্রমে একদিন কমলের সাইকেল চুরি হয়ে যায় এবং কমল পরবর্তীতে ভাঙাচুরা অবস্থায় এটিকে খুঁজে পায় – যা কমলের ভেঙে যাওয়া স্বপ্নেরই প্রতীকী রূপ। সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, কাপ্তাই লেকের এক দাঁড় বিশিষ্ট নৌকার প্যাসেঞ্জার সিটে বসে কমল তার ভাঙ্গাচোরা সাইকেল নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়ছে, ঠিক যেভাবে সে একদিন নৌকায় নতুন সাইকেল নিয়ে গ্রামে ফিরেছিলো। তার নৌকা যখন লেকের মাঝখানে, দেখা যায় অপরদিক থেকে আরও আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন টেলিভিশন ও মোটরসাইকেল নিয়ে এক দাঁড়ের কিছু নৌকা গ্রাম অভিমুখে চলছে।

এভাবেই ‘ম’ ঠেংগাড়ি’ সিনেমাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত সংঘটিত অমীমাংসিত সংঘর্ষ-রক্তপাত এবং পরিবর্তিত সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত পটভূমির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিদিনকার সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে। তবে সিনেমায় দেখানো হয়, প্রাথমিক হুমকিটি মূলত নিরাপত্তা বাহিনীর থেকে নয়, বরং অপরাধ কর্মকাণ্ডে যুক্ত সহগ্রামবাসীদের কাছ থেকেই আসে। এছাড়া মিলিটারিদের উপস্থিতির ভয়াবহতাকে এখানে পরোক্ষভাবে দেখানো হয়েছে, তাদের উপস্থিতি যেন দুর্লভ – এভাবেই মিলিটারিরা ছবিতে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘ম’ ঠেংগাড়ি’ বার্কলের আদিবাসী সিনেমার ধারণাকে প্রতিনিধিত্ব করে যা আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন। সিনেমাবোদ্ধা জাকির হোসেন রাজু বাংলাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রকে ‘বাঙালি-মুসলিম’ সিনেমা হিসেবে অভিহিত করেছেন।১৬ সংবিধানে উল্লেখিত যে জাতীয় বয়ান (ন্যারেটিভ) অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ কেবল একটি জাতি, একটি সংস্কৃতি ও একটি ভাষার দেশ’ সেই বয়ানকেই এই ‘বাঙালি-মুসলিম’ সিনেমা প্রতিধ্বনিত করে। অপরদিকে চাকমা ভাষায় নির্মিত ‘ম ঠেংগাড়ি’ সিনেমাটি বাংলাদেশের উপরোক্ত হোমোজেনিটির বয়ানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এই সিনেমাটি বাংলাদেশেরই একটি গল্প বলে, যেখানে আদিবাসীরা এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। অন্যভাবে বলা যায়, আদিবাসীরা আর এক্সোটিক ‘অপর’ নয়, তাদের উপস্থাপনে যে একক বাঙালি সংস্কৃতির হেজেমোনি চালু আছে, এই সিনেমা সেটাকে আঘাত করে। সেই সাথে, এটি কোনো বাঙালির দৃষ্টিকোণ থেকে বলা আদিবাসীদের গল্পও নয়।

মূলধারার সিনেমায় দেখানো এক্সোটিক পাহাড়ি, নেতিবাচক পাহাড়ি, কিংবা বাঙালি আইডেন্টিটি অর্জন করতে চাওয়া পাহাড়ির মতো নয়, বরং এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে কীভাবে আদিবাসীরা সাধারন স্বাভাবিক জীবন যাপন করে, যাদের মধ্যে ভালো আছে, মন্দও আছে, যাদের স্বপ্ন আছে, সেই স্বপ্নের ভাঙনও আছে। প্রযুক্তি যেভাবে সবখানেই প্রবেশ করেছে, তেমনি আদিবাসীদের জীবনেও প্রভাব ফেলেছে। সেটা হোক কাপ্তাই হাইড্রো ইলেক্ট্রিক বাঁধ কিংবা হোক একটি বাইসাইকেল- এর প্রভাব তাদের জীবনেও পড়েছে। আদিবাসী জীবন পরিবর্তনহীন কিংবা একটি কল্পিত এক্সোটিক অতীতে আবদ্ধ- এই ভ্রান্ত ধারনা থেকে সিনেমাটি আমাদের অবমুক্ত করে।

আন্তর্জাতিকভাবে ‘ম’ ঠেংগাড়ি’ সফলতার মুখ দেখলেও সিনেমাটির বাংলাদেশে বাণিজ্যিক মুক্তি (রিলিজ) হয়নি। এই সিনেমায় বাংলাদেশ সরকার ও এর নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে অবমাননাকর দৃশ্য ও সংলাপ আছে- এই অভিযোগে এক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল লিখিত আবেদন করলে, বাংলাদেশ সেন্সর বোর্ড কোন জাতীয় চলচ্চিত্র থিয়েটারে এর প্রদর্শনের অনুমোদন দেয়নি।১৭

ফটোগ্রাফার: ডেনিম চাকমা

ভিজুয়াল সার্বভৌমত্ব (Visual Sovereignty)

১৯৯৫ সালে টাসকারোরা (Tuscarora) স্কলার, আর্টিস্ট ও কিউরেটর জোলেন রিকার্ড নর্থ আমেরিকান আদিবাসীদের আর্টওয়ার্ক ও সিনেমার পরিপ্রেক্ষিতে এই ‘ভিজুয়াল সোভারিনটি’ বা ‘দৃষ্টিভঙ্গী-বিধায়ক সার্বভৌমত্ব’ টার্মটির উদ্ভাবন করেন। ১৯১১ সালে একটি প্রবন্ধে তিনি এর নান্দনিক মান বিশ্লেষণ করেন যা সার্বভৌমত্বের প্রচলিত স্বীকৃত পশ্চিমা ধারণার সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করে।১৮  তখন থেকেই টার্মটি আদিবাসী শিল্প ও সিনেমা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়।১৯  বিগত দুই দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সিনেমার উত্থানের মধ্য দিয়ে এর নির্মাতারা নিজেদের উপস্থাপনায় সার্বভৌমত্ব প্রয়োগ করা শুরু করেছেন।২০  অন্যদের দ্বারা আরোপিত পরিমিত বা লঘু উপস্থাপনাকে গ্রহণ না করে, তারা নিজেদের বৈচিত্র্যময় ও মিশ্র কর্তাসত্ত্বাকে (Subjectivity) নির্মাণ করছেন। এই সিনেমাগুলো তাদের নিজেদের মনে করিয়ে দেয় যে, তারা অন্য একটি হোমোজেনাস কালচারের প্রবলে সৃষ্ট প্রান্তিকতায় বেমানান কিছু নন- সেই সাথে এটাও মনে করিয়ে দেয় যে, তারা এই দেশেই বাস করেন, যেকথা ‘মেঘের অনেক রঙ’ সিনেমাতে মাথিনকেও বলতে দেখা যায়। বাংলাদেশের ফোর্থ সিনেমাকে প্রতিনিধিত্ব করা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সিনেমা সবাইকেই মনে করিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশের সমৃদ্ধ যে বৈচিত্র্যতা তা উদযাপন ন্যায়-সমর্থ।

টীকা:

১/ অখন্ডিত ভারতে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের সমাপ্তি ঘটে।

২/ সিনেমার ইতিহাস অনুধাবন করলে দেখা যায় অবিভক্ত ব্রিটিশ বাংলায় বেশ কিছু প্রাইভেট সিনেমা প্রতিষ্ঠান ছিলো, যখন বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল পূর্ব বাংলা হিসেবে পরিচিত ছিলো। যেমন, ১৮৯৮ সালে পূর্ব বাংলায় জন্মগ্রহণ করা হীরালাল সেন কলকাতায় ‘রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণ এশিয়ায় এটাই ছিলো প্রথম চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান। ১৯২৯ সালের দিকে ঢাকা নবাব পরিবারের কয়েকজন বনেদী মিলে ‘ঢাকা ইস্ট বেঙ্গল সিনেমাটোগ্রাফ সোসাইটি’ গড়ে তোলেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ১৯৫৪ সালে আব্দুল জব্বার খান, মো. মোদাব্বের এবং মি. মহিউদ্দীন মিলে ‘ইকবাল ফিল্ম’ প্রতিষ্ঠা করেন।

৩/ কাপ্তাই লেক সৃষ্টির কারনে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ৪০% আবাদযোগ্য ভূমি পানিতে তলিয়ে যায়। লেকের কারনে পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় শহর রাঙামাটি সহ অসংখ্য গ্রাম শহরতলি পানিতে হারিয়ে যায়, সেই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমগ্র জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ উচ্ছেদ হন যার মধ্যে অধিকাংশই চাকমা। হারিয়ে যাওয়া ভূমির মাত্র এক তৃতীয়াংশ সরকারীভাবে ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিশোধ করা হয়। এর ফলে অনেকেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন, যার মধ্যে অনেকেই এখনো রাষ্ট্রহীন জীবন যাপন করছেন। কাপ্তাই বাঁধে উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ৫% এরও কম পার্বত্য চট্টগ্রামে সরবরাহ করা হয়।

৪/ Willem Van Schendel, Wolfgang Mey, and Aditya Dewan, The Chittagong Hill Tracts: Living in a Borderland (Bangkok: White Lotus, 2000), p. 268

৫/ ঔপনিবেশিক ও ‘উপনিবেশ উত্তর’ পিরিয়ডে (যদিও বাংলাদেশকে উপনিবেশমুক্ত রাষ্ট্র বলা হয়, কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম উপনিবেশমুক্ত নয়। এই অঞ্চল অদ্যাবধি রাষ্ট্রের সামরিকায়ন, উচ্ছেদ, দেশান্তর প্রক্রিয়া এবং পক্ষপাতদুষ্ট সিভিল প্রশাসনের অধীনে শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত।) বাংলাদেশের বহু আমলা, লেখক ও স্কলার পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদেরকে ‘আদিবাসী’ বলার পরিবর্তে মর্যাদাহানিকর যেসকল পরিভাষায় সম্বোধন করেন তন্মধ্যে ‘পাহাড়ি’ নামটিই অপেক্ষাকৃত নিরপেক্ষ। অন্যান্য অসম্মানজনক নামের মধ্যে আছে ‘উপজাতি’ (sub-nation যা ইংরেজী Tribal এর ভুল বাংলা পরিভাষা) এবং সাম্প্রতিক সময়ে ২০১১ সালে উদ্ভাবিত অন্যান্য ‘কাউকে ছোট করা’ নাম, ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা (small races/nations/peoples), ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী (small ethnic groups/sects), ও ক্ষুদ্র সম্প্রদায় (small communities) যার সবগুলোই বাংলাদেশের আদিবাসীরা বর্জন করেছে।

৬/ এস এম শফি পরিচালিত এই সিনেমাটিই ছিলো স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম রঙিন পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা যা ছেচল্লিশটি দেশে রিলিজ করা হয়।

৭/ সিনেমার শুরুর দৃশ্যে আকাশে যে রংধনু দেখানো হয় তার সাথে মিলিয়ে ‘মেঘের অনেক রঙ’ সিনেমার দুইটি ইংরেজী অনুবাদ ‘Many Colors of Cloud’ অথবা ‘Many Colors of the Sky’ এ প্রবন্ধে নেওয়া হয়েছে।

৮/ যুদ্ধে বেঁচে যাওয়া ধর্ষিত নারীদের অবশ্যই মৃত্যু হতে হবে- এই সচরাচর উপস্থাপনার জাতীয় সিনেমার প্রবণতাকে বাংলাদেশী নারীবাদী স্কলার কাবেরী গায়েন তাঁর ‘Women, War and Cinema: Construction of Women in the Liberation War Films of Bangladesh’ প্রবন্ধে সমালোচনা করেন যা ২০১৫ সালে French Journal For Media Research, 3 -এ প্রকাশিত হয়। https://frenchjournalformediaresearch.com/lodel-1.0/main/index.php?id=478

৯/ Kabita Chakma and Bina D’Costa, ‘The Chittagong Hill Tracts: Diminishing Violence or Violent Peace?’ in Edward Aspinall et al. (eds.), Diminishing Conflicts in Asia and Pacific: why Some Subsides and Other’s Don’t (London: Routledge, 2013), p, 139.

১০/ কিছু আদিবাসী মাঝে মাঝে কিছু ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যেমন, অনন্ত জলিল অভিনীত ও পরিচালিত একটি সিনেমায় কিছু চাকমা তরুণ ভিলেনের সহকারী হিসেবে অভিনয় করেছেন। এছাড়া, ইমতিয়াজ বিজন আহমেদের ‘মাটির প্রজার দেশে’ (২০১৫) সিনেমায় প্রশান্ত ত্রিপুরা, এবং আকা রেজা গালিবের ‘কালের পুতুল’ (২০১৭) সিনেমায় কমল চাকমা অভিনয় করেন।

১১) মাহতাব হোসেন, বাংলা চলচ্চিত্রের ‘চাইনিজ’ যুগান্তর চাকমার কথা https://www.kalerkantho.com/online/entertainment/2017/07/17/520428

১২) Jum Aesthetic Council-এর আয়োজিত ‘পার্বত্য আদিবাসী সংস্কৃতি মেলা ২০০৬’ এর মধ্য এপ্রিলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী নববর্ষ উপলক্ষ্যে ‘ডুলু কুমুরি’ ছবিটি প্রথম প্রদর্শিত হয়। সিনেমাটির উপর বিস্তারিত পাওয়া যাবে নাঈম মোহায়মেনের ‘Between Ashes and Hope: Chittagong Hill Tracts in the Blind Spot of Bangladesh Nationalism’ বইয়ের কবিতা চাকমা ও গ্লেন হিল লিখিত ‘Dulu Kumari and Post-National Histories’ অংশে। (Dhaka Drishtipat Writer’s Collective, 2010)

১৩) Barry Barclay, Our Own Image (Auckland: Longman Paul, 1990)। ২০০২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর অকল্যান্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম ও মিডিয়া স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টে ফোর্থ সিনেমার উপর একটি লেকচারে বার্কলে ব্যাখ্যা করেন কেন তিনি এই টার্মটি উদ্ভাবন করেন। লেকচারটি পরবর্তীতে ২০০৩ সালে নিউজিল্যান্ডে ‘Celebrating Fourth Cinema’-তে পাবলিশ করা হয়।

১৪/  Fernando Solanas and Octavio Gettino, ‘Towards a Third Cinema: Notes and Experiences for the Development of a Cinema of Liberation in the Third World’, Afterimage 3 (Summer 1971): pp. 16–30.

১৫/  George Manuel and Michael Posluns ১৯৭৪ সালে ‘ফোর্থ ওয়ার্ল্ড’ পরিভাষাটি চালু করেন। Pamela Wilson and Michelle Stuart (eds.), Global Indigenous Media: Cultures, Poetics and Politics (Durham, NC: Duke University Press, 2008), p. 9.

১৬/ Zakir Hossain Raju, Bangladesh Cinema and National Identity: In Search of the Modern? (London: Routledge, 2015).

১৭/ বাংলাদেশ সেন্সর বোর্ড থেকে সিনেমা নির্মাতা অং রাখাইনের চিঠির ক্রমিক নং10(9)/ 2014/1011, 29 June 2015.

১৮/ Jolene Richard, ‘Visualizing Sovereignty in the Time of Biometric Sensors’, South Atlantic Quarterly 110, no. 2 (Spring 2011): pp. 465–86.

১৯/ উদাহরণ স্বরূপ, Michelle Raheja, ‘Reading Nanook’s Smile: Visual Sovereignty, Indigenous Revisions and Ethnography, and Atanarjuat (The Fast Runner)’, American Quarterly 59, no. 4 (December 2007): pp. 1159–85; Michelle Raheja, Reservation Reelism: Redfacing, Visual Sovereignty, and Representation of Native Americans in Film (Lincoln: University of Nebraska Press, 2011); Faye Ginsburg, ‘Televisual Sovereignty in Contemporary Australian Indigenous Media: A History of Cultural Futures’, in Tufte & O. Hemer (eds.), Voice and Matter: Contemporary Challenges in Communication for Development (Goteborg: Nordic Press, 2016), pp. 173–88.

২০/ পার্বত্য চট্টগ্রামের সিনেমা নির্মাতা ও তাদের সিনেমার জন্য দেখুন(ফেলিমঃ সিনেমা, গ্লোবালাইজেশন, সেলফ-আইডেন্টিটি এবং আমাদের সামাজিক সংস্কৃতি) Felim: Cinema, Globalisation, Self- Identity and Our Social Culture’, Jum Journal, available at: https://bn.jumjournal.com/2017/04/06/film-globalization-self-identity-and-our-social-culture/ Accessed 27 April 2017। আরও দেখুন, Felim: Cinema for Identity, A Story of Film and Film Makers of CHT, Bangladesh (2017), পরিচালনায় Turin Tanchangya   Adit Dewan, https://www.youtube.com/watch?v=R870EWqdRLw.

  • কবিতা চাকমা: আর্কিটেক্ট, লেখক ও ফ্রিল্যান্স গবেষক’; ডালিয়া চাকমা: সদস্য, রাষ্ট্রচিন্তা; ডেনিম চাকমা: হিল পলিটিকাল এক্টিভিস্ট, ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *