- মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান
এখানে ব্যদুর্নিবেশবাদ = ব্যক্তিস্বার্থ+ব্যক্তিগত হিসেব-নিকেশ+একক ব্যক্তির নেতৃত্ব এবং আধিপত্যে বিকশিত দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে উপনিবেশিক রাজনৈতিক অর্থনীতির চর্চা
উপনিবেশিক শাসনব্যবস্থাকে বুঝার জন্য ইংরেজি ভাষায় প্রচলিত হয়েছে কলোনিয়ালিজম, যা বাংলা ভাষায় উপনিবেশবাদ হিসেবে অনূদিত হয়েছে। উপনিবেশবাদ বলতে মোটা দাগে এক অঞ্চলের জনগোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে অন্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে অধীনস্ত বা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আধিপত্য চর্চার শাসন প্রক্রিয়া বা নীতিকে বুঝানো হয়। এই আধিপত্যের চর্চার মাধ্যমে উপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী অধিকৃত উপনিবেশের সম্পদ/অর্থ নিজ অঞ্চলে পাচার এবং উপনিবেশের অধিবাসীকে হত্যা করে বা বল প্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তুচ্যুত করে নিজেরাই বসতি স্থাপন করে। এশিয়া, উত্তর আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগালের মত উপনিবেশিক শক্তিগুলো তাই করেছিলো।
তবে ভারতবর্ষে একটা ক্ষেত্রে উপনিবেশিক ব্রিটেন ব্যতিক্রম ছিলো। তারা এই অঞ্চলে কোনও স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেনি। তবে সম্পদ পাচার করেছে, উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইরত মুক্তিকামীদের হত্যাকরাসহ সকল অন্যায়-অবিচার করেছে প্রশাসনিক ছত্রচ্ছায়ায়! সেজন্য ভাইসরয়/লর্ডমন্ডিত ব্যক্তিনির্ভর রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় জবাবদিহিবিহীন প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রের একদম উপরের তলায় বা শ্রেণিতে ছিলো ৩০,০০০ শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ আমলা। একই রকম অবস্থা বিরাজ করতো পুলিশ, সামরিক বাহিনী আর বিচারালয়ে। এই ধারাতেই আইনি ব্যবস্থার বিকাশ ঘটানো হয়েছিলো ভাইসরয়/লর্ড এবং তাদের এই সব সাঙ্গপাঙ্গদেরকে রক্ষা এবং তাদের সর্বোচ্চ সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সুবিধাদি নিশ্চিত করার জন্য। ভারতবর্ষের অধিবাসী তো আর তাদের নিজেদের নাগরিক নয়! তাই আমলাতন্ত্র, পুলিশবাহিনী, সামরিকবাহিনী, বিচারালয়ের নীচের পদগুলোতে বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাপনায় কাজ করতো এই অঞ্চলের অধিবাসীদের একটা অংশ।
১৯৪৭ সালের পরে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হলে তৈরি হলো উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক বৈষম্যমূলক কাঠামোর ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আর ভারত নামের দুটি রাষ্ট্র। উপনিবেশোত্তর কালে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠলো পশ্চিম পাকিস্তানের আইনগত এবং ধর্মপরিচয়ে বৈধ উপনিবেশ, অন্তত বৈষম্যনির্ভর আইনি-ব্যবস্থা এবং আমলাতান্ত্রিক শাসন কাঠামো বিবেচনায়! এতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার শুরু হলো ব্রিটেনের পরিবর্তে। নতুন শাসকদের অনাচার, নিপীড়নের ধারাবাহিকতায়ও কোন ছেদ পড়লোনা! সবকিছুই আগের মতই রইলো। শুধু পরিবর্তন এলো শাসকগোষ্ঠীর ধর্ম-পরিচয়,গায়ের বর্ণ এবং ভাষায় আগের উপনিবেশ আমল বিবেচনায় । তবে মুসলমানদের পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তান জনমানুষের রাষ্ট্র হয়ে উঠলোনা আর!
যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কেউ কেউ সদ্য স্বাধীন হওয়া উপনিবেশগুলোর বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনা, উপনিবেশিক শক্তিগুলোর সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ, বৈষম্যমূলক বিশ্বায়ন বিশ্লেষণ করে এই বিশ্বব্যবস্থাকে নয়া-উপনিবেশবাদ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জঁ পল সার্ত্রে সম্ভবত প্রথম এই শব্দটির প্রচলন করেন ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত একটা লেখায়। এরপর আফ্রিকার নেতা কোয়ামে নকরুমা এটা ব্যবহার করেন। এটা দাবী করলে খুব অত্যুক্তি হবেনা যে, এই সময়কালে বৈষম্যমূলক বিশ্বব্যবস্থাকে ব্যাখ্যা করার জন্য নয়া-উপনিবেশবাদের ধারণাকে অনেক বেশী জনপ্রিয় করেছেন নোয়াম চমস্কি।
বৈষম্য, বঞ্চনা থেকে মুক্তি নিশ্চিত করার প্রতিজ্ঞায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান নামের উপনিবেশ বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে গিয়ে বাংলাদেশ আবির্ভূত হলো। এখন নয়াউপনিবেশবাদী বিশ্বব্যবস্থার আলোচনা না গিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থার আলোকে যদি প্রশ্ন করা হয় আমরা আসলে কী জনমানুষের মালিকানাধীন স্বাধীন রাষ্ট্র এখন? আমরা কী ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে এসে নতুন ধরনের শাসন ব্যবস্থার বিকাশ ঘটাতে পারলাম জনমানুষের কল্যাণে?
আসলে কাঠামোগত বা শাসনগত অন্য কোনো মৌলিক পার্থক্য না দেখা গেলেও এখন একটা পার্থক্য খুব স্পষ্ট আমাদের সবার কাছে। বিদেশী শাসকদের পরিবর্তে দেশীয় নাগরিককেই আমরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখছি।
তাই আগে উপনিবেশিক ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে বিদেশীরা সম্পদ/অর্থ পাচার করতো তাদের নিজ দেশে আর এই কালে দেশীয় ক্ষমতাসীন ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গ এবং সব ধরনের আমলাদের সবচাইতে প্রভাবশালী অংশ দুর্নীতির মাধ্যমে একই কাজ করে আসছে আর বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সম্পদ পাচার করেছে বা প্রতিনিয়ত করছে প্রাক্তন উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোতে। মোটা দাগে তাদের ছেলে-মেয়ে, পরিবার সেই পাচার করা সম্পদে ভর করে বসবাস করে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা বা অন্য কোনো পশ্চিমা দেশে। তারা তাদের নিজেদের শাসিত রাষ্ট্রকে বসবাস-উপযোগী “দেশ” মনে করেনা। আগে অন্যায়-অনাচার করে পার পেতো বিদেশীরা এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা আর এখন ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা। ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠী এগুলো জায়েজ করতো তাদের রাণীর নামে আর এখন আমরা করি নিজেদের অবিসংবাদিত নেতা বা নেতাদের নামে বা তাদের নামকে বাজারজাত করার মাধ্যমে! নেতা বা নেতাদের নামকে যত নগ্নভাবে বাজারজাত করা যায় দুর্নীতি তত নির্বিঘ্নে করা যায় এবং এতে নিজেদের সুরক্ষাও ততটাই নিশ্চিত হয়! উপনিবেশিক রাষ্ট্রের রাজা বা রাণীর মতই এই নেতা-নেত্রীরা অলঙ্ঘনীয় এবং তারা সকল প্রশ্ন এবং বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠা এক অবতার।
তাই জবাবদিহিবিহীন একক নেতৃত্ব নির্ভর প্রশাসনিক ও আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এখন আরও বেশী জনবিচ্ছিন্ন এবং শক্তিশালী যেহেতু দলীয় পরিচয়ের কারণে এই শাসন ও শোষণ ব্যবস্থাকে বিভিন্ন নামে সমর্থন বা বৈধতা দিতে সদা তৎপর থাকে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা পাওয়া একদল পেশাজীবী আর বুদ্ধিজীবীরা এবং তাদের তৃণমূল পর্যায়ের উগ্র সমর্থক-গোষ্ঠী। এতে ধারাবাহিকভাবে বিরাজমান উপনিবেশিক আইনি-কাঠামো-ভিত্তিক এই শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন নেতাদের যেমন রক্ষা করে আমলা, সেনা বা পুলিশসহ বিভিন্ন রকম বাহিনী, ঠিক তেমনি এই আইনীকাঠামো আমলা, সেনা বা পুলিশসহ বিভিন্ন রকম বাহিনীর জন্য একই রকম রক্ষাকবচ!
২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এই রকমই এক আইনি কাঠামোর সর্বশেষ সংযোজন! শাসকগোষ্ঠী ও তাদের আমলাতন্ত্র নিয়ে যতই বেশী সমালোচনা হবে, বিতর্ক হবে, জনমানুষ ততই অনিরাপদ হবে। হয় গ্রেফতার নয় গুম, হত্যা, ক্রসফায়ার, জেল-জুলুম।
সরকারি দলের কেউ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজস্ব পেশীনির্ভর, অগণতান্ত্রিক এবং অসুস্থ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে উপরের মহলের রোষানলে না পড়বে, ততক্ষণ পর্যন্ত সবকিছুতেই তার জন্য মুশকিল আসান – সেই খুন হোক বা অন্যের সম্পদ হরণ বা অন্যায় যে কোনো কিছু! জুলুমবাজ, অপরাধীদের জন্য সরকারি দল যেন আলাদীনের চেরাগ সব আমলে!
তাহলে সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে দেশের বিরাজমান অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় বর্তমান বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থাকে কোন ধারনা দিয়ে আসলে ব্যাখ্যা করা যাবে – উপনিবেশবাদ, নয়া-উপনিবেশবাদ নাকি অন্য কিছু?
উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট – প্রথম ধারনাটি প্রাসঙ্গিক নয়। কেননা উপনিবেশের অন্য বৈশিষ্ট্যগুলো বিরাজ করলেও, রাষ্ট্র ও সরকার এখন দৃশ্যত স্বাধীন। দ্বিতীয় ধারনাটিও প্রযোজ্য নয়। কেননা আমরা আমাদের শাসন ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটেও দেখছিনা। তাহলে কী হতে পারে?
আসলে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতায়, আমাদের শাসন ব্যবস্থা বুঝার জন্য নতুন ধারনা প্রচলন জরুরী। সেই ধারনাকে আমি নাম দিতে চাই – ব্যদুর্নিবেশ। এই ধারনাটিকে এভাবে প্রকাশ করা যায় যে, এটা হলো উপনিবেশোত্তরকালে ব্যক্তিস্বার্থে সব ধরনের দুর্নীতি আর অনাচারের জবাবদিহিবিহীন উপনিবেশিক ব্যবস্থার রাজনৈতিক অর্থনীতির চর্চা। অন্য কথায় ব্যাখ্যা করলে, এটা একটা জনমানুষবিমুখী জবাবদিহিবিহীন ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক একক নেতৃত্বনির্ভর দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন ব্যবস্থার রাজনৈতিক অর্থনীতির অনুশীলন। এই ব্যবস্থায় নিজ দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার চাইতে শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের প্রভাবশালী সমর্থকগোষ্ঠীর ব্যক্তি-স্বার্থে সম্পদ হরণ, পাচার এবং সবরকমের অন্যায়-অবিচার করাটাকে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করে। উপনিবেশিক রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী কুকাজ আর অপকাজগুলো করতো মোটাদাগে তাদের নিজেদের মাতৃভৃমির স্বার্থের হিসেব-নিকেশে আর একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী এগুলো করে এখন, একেবারে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের হিসেব-নিকেশ থেকে। সেজন্যই ব্যদুর্নিবেশের গাণিতিক সমীকরণ কথায় প্রকাশ করলে এরকম দাঁড়ায়:
ব্যদুর্নিবেশবাদ = ব্যক্তিস্বার্থ+ব্যক্তিগত হিসেব-নিকেশ+একক ব্যক্তির নেতৃত্ব এবং আধিপত্যে বিকশিত দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রে উপনিবেশিক রাজনৈতিক অর্থনীতির চর্চা।
আর ব্যদুর্নিবেশের প্রভাব রাষ্ট্রের অন্তর্গত সকল ধরণের সরকারি প্রতিষ্ঠানেই পড়ে – আদালত বা বিচারালয়, মন্ত্রণালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান – তা যাই হোক না কেন।
- মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান, সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়