উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ‘রাষ্ট্রচিন্তা’র বক্তব্যের সম্প্রসারিত (শেষ) অংশ

প্রিয় দেশবাসী ও বন্ধুগণ,

আমাদের সালাম ও শুভেচ্ছা জানবেন। গত ১১ই মে ২০২০ তারিখে রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। এতে অনেকের কাছে রাষ্ট্রচিন্তার অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে। তবে এ বক্তব্যে অনেক কথা বলা হলেও সুনির্দিষ্ট ঘটনাটি নিয়ে স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা হাজির করা হয়নি এবং ভবিষ্যতে রাষ্ট্রচিন্তা কি করতে চায় তার কোনো আভাস-ইঙ্গিতও দেয়া হয়নি। এ দিকটার প্রতি গুরুত্ব রেখেই আজ আমরা রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ থেকে এই বক্তব্য প্রদানের প্রয়োজন অনুভব করছি।

ঘটনার প্রেক্ষাপট :

আমরা আগেই বলেছি, দিদারুল ভুঁইয়াকে র‌্যাব পরিচয়ে সাদা পোশাকে তুলে নেওয়া এবং পরবর্তীতে তা অস্বীকার করার ঘটনায় আমরা ভীষণ উৎকণ্ঠায় ছিলাম। ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর দেশে-বিদেশে গণমাধ্যমকর্মী, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-গ্রুপ-ব্যক্তি, বিশেষত সকল শ্রেণীর মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানোর ফলে র্যাব ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। নির্বিশেষ মানুষের সম্মিলিত এ প্রতিবাদ আমাদের অভিভূত করেছে, ঋণী করেছে। দিদার এবং অন্যান্যদের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে ২০১৮ সালে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা নতুনভাবে জাগরুক হয়ে ওঠা আমাদের মতো দেশের কর্তৃত্ববাদ বিরোধী প্রতিটি নাগরিককে আশান্বিত করে তুলেছে। আমরা এ আন্দোলনকে অব্যাহত রাখা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকে আমাদের দায়িত্ব বিবেচনা করি এবং এ বিবেচনা থেকে ৮ই মে রাতে আমাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়েই ১০ই মে সারাদেশে প্রতিবাদী মানববন্ধন কর্মসূচী ঘোষণা করি। মাঝখানের একটি দিনে সারাদেশে আমাদের যে যোগাযোগ রয়েছে সেটা সমন্বয় করতে আমাদের যথেষ্ট ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।

ঘটনার শুরু যেভাবে :

৯ই মে রাতে পরের দিনের প্রস্তুতি নিয়ে আমরা যখন আলাপ করছিলাম তখন আমাদের এক তরুণ বন্ধুর প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে নিবর্তনমূলক আইনের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনকে সর্বজনীন এবং আরও বেগবান করার স্বার্থে বাম-প্রগতিশীল মহলের সাথে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনকে প্রতিবাদ সমাবেশে আমন্ত্রণের ব্যাপারে সম্মতি জানাই। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বিদ্যমান মতাদর্শিক পার্থক্য নির্বিশেষ সকলের উপর চেপে বসা নিবর্তনমূলক আইনের বিরোধিতাকেই বড় করে দেখা হয়। রাষ্ট্রচিন্তা এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনো ঘটনার প্রতিবাদে নানা মতের অ্যাকটিভিষ্টদের সাথে একত্রে দাঁড়ানোর বাইরে অন্যকোনো ধরণের ঐক্যবদ্ধ কাজে যুক্ত হতে পারেনি। কারণ, কাদের সাথে কোন রাজনৈতিক বিবেচনায় কোন ধরনের ঐক্য করা যাবে বা যাবে না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সাংগঠনিক অবস্থায় তারা এখনো পৌঁছেনি। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রচিন্তা কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে কোনো ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেয়নি।

প্রতিবাদী মানববন্ধনে অংশগ্রহণ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি :

১০ই মে আমরা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার পাশাপাশি ঢাকার ৪টি স্থানে প্রতিবাদী মানববন্ধনে অংশ নিই। এর মধ্যে ঢাকা প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ চলাকালে এক পর্যায়ে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন প্রতিনিধি অংশ নেন। মানববন্ধনে তাদের অংশগ্রহণের আগেই বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতিও সেখানে উপস্থিত হন এবং কর্মসূচী শেষে ই.শা-এর অংশগ্রহণের বিষয়ে তাঁর আপত্তি ও উদ্বিগ্নতার কথা জানিয়ে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি তাঁর সাংগঠনিক বিব্রতাবস্থার কথা উল্লেখ পূর্বক একটি বিবৃতি প্রদান করেন। এবং এর কিছুক্ষণ পরে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনও বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর বিব্রত হবার প্রেক্ষিতে সাংগঠনিকভাবে তাঁদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে।

বিবৃতি ও পাল্টা বিবৃতির মধ্যবর্তী নাতিদীর্ঘ এ সময়টিতে একটি মিডিয়া থেকে তাদের প্রকাশিত বিবৃতি প্রসঙ্গে রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিক্রিয়া জানতে রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য হাসনাত কাইয়ূমকে ফোন করা হয় এবং তাঁর সাথে অনেকক্ষণ আলাপ করেন। উদ্ভূত পরিস্থিতি ও রাষ্ট্রচিন্তার সাংগঠনিক তৎপরতা নিয়েও তার সাথে আলাপ হয় এবং স্বাভাবিকভাবেই উক্ত মিডিয়াকর্মী আলাপকে যেভাবে বুঝেছেন সেভাবেই পত্রিকায় প্রকাশ করেন। কিন্তু সংবাদ প্রকাশের পর আমরা দেখতে পাই সেখানে রাষ্ট্রচিন্তার বক্তব্য অনেকটা খণ্ডিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে, যা আমাদের দেয়া বক্তব্যের স্পিরিটকে যথাযথভাবে প্রকাশ করেনি, যার কারণে প্রকাশিত সংবাদ নিয়ে আরেক ধরণের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।

এ অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের সিদ্ধান্ত :

১। আমরা ভবিষ্যতের যেকোনো কর্মসূচীতে যাদের আহবান জানাবো তাদের সবার কাছে আর কাদেরকে আমরা আহ্বান করতে আগ্রহী তা অবশ্যই জানিয়ে দেবো।এতে পরস্পর-বিরোধী মতের মানুষের ক্ষেত্রে নিজ নিজ বিবেচনা কাজে লাগানোর সুযোগ থাকবে।

২। ভবিষ্যতে প্রেসকে দেওয়া লিখিত বক্তব্যের বাইরে রাষ্ট্রচিন্তার কোনো সদস্য ব্যক্তিগত মতামত দেয়া থেকে বিরত থাকবে। তাৎক্ষণিক কোনো মতামতও আমরা ইমেইল বা মেসেঞ্জারে দেবো। সেক্ষেত্রে সংবাদ পরিবেশন করা আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদের পক্ষেও সঠিক বক্তব্য তুলে ধরা সহজ হবে।

ঐক্য সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া :

আমরা সবাই জানি, রাজনীতিতে কয়েক ধরণের ঐক্য হয়। সবচাইতে দৃঢ় ঐক্য হলো আদর্শিক ঐক্য। এর পরের ধাপ হতে পারে কর্মসূচীগত ঐক্য। আদর্শিক মিল না থাকা সত্ত্বেও একটি সুনির্দিষ্ট বাস্তবতায় ভিন্ন ভিন্ন আদর্শের দলের মধ্যেও অনেক সময় ঐক্য হতে পারে। অনেক সময় আশু কোনো শর্তে দল-মত নির্বিশেষে সর্বদলীয় ঐক্যও হতে পারে।

এইসব ট্র্যাডিশনাল ধারার বাইরে আমাদের তরুণ অ্যাকটিভিষ্টরা কয়েক বছর যাবত অন্য একভাবে একসাথে কাজ করার রেওয়াজ গড়ে তুলেছেন, সেটা হলো কোনো একটি ইভেন্টে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। বাংলাদেশে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মী এবং দল নয় এমনসব গ্রুপ, সংগঠন, ব্যক্তি সাধারণভাবে সকলের দৃষ্টিতেই প্রতিবাদযোগ্য এমন বিভিন্ন ইস্যুতে এভাবে এখন দাঁড়ায়। রাষ্ট্রচিন্তার ইভেন্টে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী বা ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের অংশ নেওয়া এরকম অংশগ্রহণের অতিরিক্ত কিছু নয়।

বিষয়টাকে পরিপ্রেক্ষিতে রেখে বিবেচনা করলে আশা করি এ সংক্রান্ত সমস্যা কমে আসবে। পরিপ্রেক্ষিত বিবর্জিত ব্যাখ্যা, তা যতো গভীরভাবেই হাজির করা হোক না কেন, সেটা তাৎপর্যহীন, কারণ তা ঘটনাকে কেন্দ্রে রাখে না। রাষ্ট্রচিন্তা মনে করে, রাজনীতিতে অংশীজনদের মধ্যে ভিন্নমত বা বিরোধ সত্বেও আলাপ-আলোচনার পথ উন্মুক্ত থাকা দরকার। আপনি আপনার নীতিতে অটল থাকলে আপনি যেকারো সাথে যেকোনো পরিস্থিতিতেই আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। তাতে আপনার প্রাপ্তির বাইরে হারানোর কিছু নেই।

বিশ্লেষণের সামান্য পুনরাবৃত্তি ও শেষ কথা :

আমরা মনে করি, বাংলাদেশকে এ ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে বের করে এনে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করতে হলে রাষ্ট্রের বিদ্যমান ক্ষমতা-কাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে। এ সংস্কার বামপন্থী, ডানপন্থী, উদারপন্থী, মধ্যপন্থী, কট্টরপন্থী, ধর্মপন্থী সকলের জন্যই প্রয়োজন। মানুষকে নির্ভয়ে কথা বলতে দিতে পারা এবং তাদের রাজনৈতিক মতামত বিনা বাধায় প্রয়োগ করতে দিতে পারার পরিবেশ নিশ্চিত করার পরেই কেবল কোনো একটি দল তাদেরকে নিজেদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার পথে নিতে পারে, তার আগে নয়। রাষ্ট্রচিন্তা আপাতত সেই সংস্কার পর্যন্ত তার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রচিন্তা আবারও স্পষ্ট করে বলতে চায়, দেশের এই ভয়াবহ সংকটের সময়ে, নিদারুণ রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো ভয়াবহ আইনের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনত হরণ ও কণ্ঠরোধ করার সর্বমুখী অপচেষ্টার কালে পরস্পরের সাথে বিবাদে লিপ্ত হয়ে শক্তিক্ষয় না করে রাষ্ট্রের জবাবদিহিহীন গণবিরোধী ক্ষমতা কাঠামোকে জনগণের সম্মুখে উন্মোচন করা ও কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। অন্তত এই সময়ে উক্ত ঘটনাকে পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা বিতর্কের অবসান দরকার, এবং এটা অবসান করার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাই।

রাষ্ট্রচিন্তা বিনীতভাবে আরো বলতে চায়, এই বক্তব্যের মাধ্যমে সে কাউকে দোষারোপ করছে না, কেবল নিজের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করছে। আশা করা যায়, এই বক্তব্যের পরে সকল বিভ্রান্তি ও পরস্পরকে হেয়-প্রতিপন্ন করার প্রবণতার অবসান ঘটবে এবং যার যার মতো করে কিংবা সংঘবদ্ধভাবে নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং এহেন স্বৈরাচারী আইন বানানোর একব্যক্তিকেন্দ্রীক সাংবিধানিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বহাল লড়াই-সংগ্রামকে সবাই বেগবান করবে।

ভালোবাসা সকলের প্রতি।

১৩ই মে ২০২০
রাষ্ট্রচিন্তা, ১১ ইব্রাহীম ম্যানশন, পুরানা পল্টন, ঢাকা ১০০০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *