- সহুল আহমদ
‘(যে রাষ্ট্রকে সমাজের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সেই) রাষ্ট্রকে সমাজের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাই হলো মুক্তি’ – কার্ল মার্ক্স
বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ডের জনগণ হিসাবে আমরা অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটো রাষ্ট্রের জন্ম-প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত হলেও আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগত ও পরিমণ্ডলে রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাভাবনার অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। এমনকি, রাষ্ট্রনৈতিক যে হাজার রকমের চিন্তাভাবনা দুনিয়াজুড়ে চালু রয়েছে সেগুলো সম্পর্কেও আমাদের অদ্ভুত অনীহা রয়েছে। (হয়তোবা এর কোনো ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে, ইতিহাসের মধ্যে সেটার সন্ধান করাও জরুরি।) এই জন্যই বোধহয় এখনকার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডলে দেশ, রাষ্ট্র, সরকার ধারণাগুলো মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে; ব্যতিক্রম তো অবশ্যই আছে।
বাংলাদেশের বামপন্থী ও ডানপন্থী রাজনীতির সাথে যারা জড়িত তাদের কাছে মার্ক্স-লেনিন (স্বাভাবিকভাবেই) খুব পরিচিত ব্যক্তিত্ব হলেও, তাদের রাষ্ট্র-দর্শন নিয়ে এখানে খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না, অর্থাৎ, হালকা ওপর ঝাপসা (একেবারে মৌলিক) কিছু আলোচনা ছাড়া গভীরভাবে পর্যালোচনা করে দেখার কোনো তাগিদও তৈরি হয়নি। ফলস্বরূপ, লেনিনের ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ হাতে হাতে ঘুরলেও কীভাবে একে দেশের জমিন-উপযোগী করা যায় বা এর কোন অংশ আমাদের জন্য জরুরি, কোন অংশ আমাদের জন্য জরুরি না, তা একেবারেই আলোচিত হয়নি। এমনকি, মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিনের পর গ্রামসির হাত ধরে মার্ক্সবাদী রাষ্ট্রচিন্তা যে আরো এগিয়েছে, এবং গ্রামসির পর আলথুসেরের হাত ধরে আরো নতুন সংযোজন ঘটেছে তা আমাদের দেশীয় মার্ক্সবাদী (যারা নিজেদের দাবি করেন) মহলেও কিছুটা অপরিচিত রয়ে গিয়েছে। বামপন্থী বা যারা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা রাজনৈতিক অনুশীলনে যতটা মনোযোগ দিয়েছিলেন, রাষ্ট্র সম্পর্কিত চিন্তার বিকাশে ততটা মনোযোগ দেন নি বলে মনে হয়।
এসব কারণেই গবেষক আলতাফ পারভেজ যখন বছর দুয়েক পূর্বে ‘লেনিনের রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ নামক পর্যালোচনামূলক গ্রন্থ হাজির করলেন তখন আমাদের আনন্দিত হওয়াটা একটা যৌক্তিক ঘটনাই। এবার আলতাফ পারভেজ এর হাত ধরে মার্ক্সবাদী রাষ্ট্রচিন্তার জগতের আরেক দিকপাল লুই আলথুসের বাংলাভাষী পাঠকদের সামনে হাজির হয়েছেন, আকারে ছোট হলেও। আলথুসেরের ‘Ideology and Ideological State Apparatuses’ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ এর দিকে, এরপর থেকে বিভিন্ন কারণেই এর প্রভাব দুনিয়াতে এখন পর্যন্ত অটুট। আলতাফ পারভেজ এই প্রবন্ধের ভাবানুবাদ করার পাশাপাশি, মার্ক্স-লেনিন-গ্রামসি হয়ে আলথুসের পর্যন্ত মার্ক্সীয় রাষ্ট্রদর্শন বিকাশের একটা চিত্রও এঁকেছেন।
আলথুসের আলোচনা শুরু করেন মার্ক্সের বরাত দিয়েই। প্রথমত, সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার শর্তই হলো উৎপাদনের শর্তগুলোকে পুনরুৎপাদন করা; এই পুনরুৎপাদন ছাড়া সমাজ টিকে থাকতে পারে না। অবকাঠামোর উপর উপরিকাঠামোর দাঁড়িয়ে থাকা তত্ত্বের সাথেও আমাদের পরিচয় আছে। আলথুসের এই জায়গা থেকে বলার চেষ্টা করেন যে, এই স্তরায়নকে আরো ব্যাখ্যা করার দরকার, এবং ‘কীরূপে উপরিকাঠামো উৎপাদন সম্পর্কের পুনরুৎপাদনে ভূমিকা রাখে’ সেই বিষয়েও আরো চিন্তা করা দরকার। দ্বিতীয়ত, মার্ক্সীয় চিন্তা-ঐতিহ্যে রাষ্ট্রকে ‘নিপীড়নের হাতিয়ার’ হিসেবে দেখা হয়েছে, যা সবসময় শাসকশ্রেণির পক্ষেই কাজ করে। এক্ষত্রেও আলথুসের একইভাবে বলেন, ‘রাষ্ট্রসম্পর্কিত এই তত্তায়নের আরও বিকশিত করার দরকার’।
আলথুসেরের মতে, মার্ক্সবাদী ঐতিহ্যে রাষ্ট্রকে যেভাবে দেখা হয়েছে, সে তুলনায় রাষ্ট্র আরো একটু ‘জটিল’ বিষয়। এই জটিলতার কিছু হদিস কেবল গ্রামসির ‘হেজেমনি’র ধারণার মধ্যে পাওয়া যায়। লেনিনের রাষ্ট্রধারণায় ‘অবকাঠামো’ই প্রাধান্য পেয়েছে, তিনি রাষ্ট্রকে ‘দমনমূলক হাতিয়ার’ বা ‘এক শ্রেণি কর্তৃক অপর শ্রেণিকে পীড়ন করিবার যন্ত্র’ হিসেবে দেখেছেন; তাকে কেন্দ্র করেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও করণীয় নির্ধারণ করেছেন। আলথুসের লেনিনের এই তত্ত্বের সাথে একমত, কিন্তু তিনি এই চিন্তাকে আরো সম্প্রসারিত করেছেন। তাঁর কাছে রাষ্ট্রের হাতিয়ার দুই ধরণের: ‘নিপীড়নমূলক হাতিয়ার’ এবং ‘ভাবাদর্শিক হাতিয়ার’। লেনিন যা বলেছেন সেটাই হচ্ছে উল্লিখিত প্রথম হাতিয়ার বা নিপীড়নমূলক হাতিয়ার। দ্বিতীয় হাতিয়ার, মানে ‘ভাবাদর্শিক হাতিয়ার’ এর তত্ত্বই হচ্ছে আলথুসেরের সবচেয়ে বড়ো অবদান। তিনি ‘রাষ্ট্রকে দেখেন এই দুইরূপী হাতিয়ারের সমন্বিত ও পারষ্পরিক তৎপরতার ক্ষেত্র এবং তার ফল হিসেবে।’
এখনকার রাষ্ট্র কেবল দমনমূলক হাতিয়ার, উদাহরণস্বরূপ পুলিশ-সেনাবাহিনী ইত্যাদি, ব্যবহার করেই টিকে বা সক্রিয় থাকে না, তাঁর রয়েছে স্কুল-পরিবার- সাংস্কৃতিক সংগঠন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ট্রেড ইউনিয়ন, রাজনৈতিক দল, রেডিও-টিভি-পত্রিকায় ইত্যাদি। এই প্রতিষ্ঠানগুলোই হলো আলথুসের বর্ণিত ‘ভাবাদর্শিক হাতিয়ার’। তাঁর মতে, দমনমূলক হাতিয়ারগুলোকে যতটা আমরা সামাজিক জীবনে পাই, ভাবাদর্শিক হাতিয়ারগুলোকে ততটাই পাই ব্যক্তিগত জীবনে। অবশ্য, এখন প্রাইভেট-পাবলিক এর ফারাক খুব একটা তৈরি হয় না। এই ভাবাদর্শিক হাতিয়ারের ভাবাদর্শে বৈচিত্র্য থাকতে পারে, কিন্তু একটি সূতায় সব বৈচিত্র্য বাঁধা থাকে, সেই সূতা হচ্ছে শাসকশ্রেণির ভাবাদর্শ। এই হাতিয়ারগুলোর মাধ্যমে এই ভাবাদর্শ বিচিত্র উপায়ে কাজ করতে পারে।
দমনমূলক হাতিয়ার প্রধানত সহিংসতার মাধ্যমে কাজ করে, ভাবাদর্শিক হাতিয়ার কাজ করে ভাবাদর্শের মাধ্যমে। রাষ্ট্রের দমনমূলক হাতিয়ারগুলো সহিংসতার জন্য যে শক্তি জাহির করে, সেই শক্তির পুনরুৎপাদন এবং জায়েজিকরণ করে ভাবাদর্শিক হাতিয়ার। তাই, আলথুসেরের কাছে ভাবাদর্শিক হাতিয়ার শ্রেণিসংগ্রামেরও একটা ক্ষেত্র। কেউই দীর্ঘসময় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারবেন না যদি না তিনি ভাবাদর্শিক হাতিয়ার কাজে লাগাতে পারেন। শাসকশ্রেণির ভাবাদর্শ আসলে এই দুই হাতিয়ারের মাঝে একটা সমন্বয় করে টিকে থাকে, সঠিক সমন্বয় ছাড়া তা এগোতে পারে না। এই স্থলে আলথুসেরকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আলতাফ পারভেজ ২০১৮-১৯ এ বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থাকে মূলধারার শিক্ষা কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয়ের ঘটনাকে উদাহরণস্বরূপ হাজির করেন। তিনি বলেন, ‘… এটা ছিল বাংলাদেশে পুঁজিতন্ত্রের দিক থেকে একটা বড় ঘটনা।… এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ভাবাদর্শিক হাতিয়ারের পরিসর গ্রামে গ্রামে ব্যাপক বিস্তার লাভ করলো মাত্র।’ আলতাফ পারভেজ আফসোস করে বলছেন যে, তখন ‘কোনো তরফ থেকে এই ব্যাখ্যা আসেনি…’। উল্লেখ্য, আলথুসের যে সকল ভাবাদর্শিক হাতিয়ারের কথা উল্লেখ করেন তারমধ্যে বিদ্যাপীঠ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও পরিবার বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। শিক্ষা যে শুধুই বিশুদ্ধ একাডেমিক কোনো বিষয় নয়, বরঞ্চ স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রেরই সম্প্রসারিত রূপ- এটা দেখানো আলথুসেরের এই প্রবন্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক।
তাহলে ‘ভাবাদর্শ’টা আসলে কি? আলথুসের জানান, ভাবাদর্শের নিজের কোনো ইতিহাস নেই, কিন্তু তার ভেতরে ইতিহাস রয়েছে। এবং যে বাস্তবতায় ভাবাদর্শ নির্মিত হয়, সেই বাস্তবতাতেই ইতিহাস রয়েছে। ‘যদিও সকল ভাবাদর্শই মানুষের বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে একটা কল্পিত নির্মাণ- কিন্তু সেটা জন্মগতভাবেই বাস্তবের সঙ্গে যুক্তও বটে।’ তাঁর মতে, ভাবাদর্শ কোনো ‘ভাবের জগতে’ থাকে না, এটি বিরাজ করে বিবিধ প্রতিষ্ঠানে ও তাদের অনুশীলনে। ভাবাদর্শ আসলে রাষ্ট্রীয় বিবিধ প্রতিষ্ঠান ও চর্চার মধ্যেই বারেবারে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন হতে থাকে।
বাংলাদেশ তথা সাউথ-এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহের রাজনীতির হালচাল বোঝার জন্য ‘ভাবাদর্শ এবং রাষ্ট্রের ভাবাদর্শিক হাতিয়ার’ সংক্রান্ত ধারণা আমাদের সাহায্য করতে পারে। আলথুসারের এই বয়ানের দুর্দান্ত উদাহরণ বা চিত্রায়নের জন্য ভারতে বিদ্যমান পরিস্থিতির দিকে নজর দিলে উপকার হবে। বিজেপি যা কায়েম করতে চায়, তার সহযোগী বা ফুটসোলজার হচ্ছে আরএসএস। অন্যভাবে বলা চলে, আরএসএস যা চায়, তা-ই কায়েম হচ্ছে বিজেপির মাধ্যমে। বিজেপি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা আরএসএসেরই প্রাক্তন সদস্য। দিল্লীর রাষ্ট্রীয় সহিংসতায় কিশোরদের অংশগ্রহণ অনেককে অবাক করেছে। কিন্তু, এই তথ্য যদি জানেন যে, এদেরকে গত কয়েকবছর যাবত এইভাবেই তৈয়ার করা হচ্ছে তাহলে এতোটা অবাক হবেন না আশা রাখি। আরএসএস-এ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করেছে, যেখানে নিয়মমাফিক ট্রেনিং দেয়া হয়। সেখানে শিশু-কিশোর, ছেলে-মেয়ে সবার জন্যই আলাদা আলাদা ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। সেখানে প্রতিদিন লেকচার দেয়া হয় যে, মুসলমানরা খারাপ, ভয়াবহ টেররিস্ট, কেউ যদি ভারতবর্ষে থাকতে চায় তাকে আসলে হিন্দুত্ববাদীদের মতোই হতে হবে। গরু খাওয়া যাবে না। কেউ যদি গরু জবাই করে তাকে হয় দেশ ছাড়তে হবে, না হয় এখানেই মারা পড়তে হবে। মেয়েদেরকে বলা হয়, মুসলমানদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। মুসলমানরা বিয়ে করে পরে বউদের পিটিয়ে বের করে দেয়, বা বেঁচে দেয়। মুসলমান ও আইএসএস একই জিনিস। পাশাপাশি ‘আত্মরক্ষার’ জন্য ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সবাইকে অস্ত্র চালনা শেখানো হয়। কিছু কিছু স্থানে পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত ইতিহাস বদলানো হয়েছে, হিন্দুত্ববাদের জয়গান গাওয়া হচ্ছে। এমনকি, ইসরায়েলকে আদর্শ রাষ্ট্রের উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।১ অর্থাৎ, এই ক্যাম্প বা স্কুল হচ্ছে আলথুসের বর্ণিত ইডিওলজিক্যাল স্টেট এপারেটাস বা ভাবাদর্শিক হাতিয়ার। আরএসএস বা বিজেপি তার ভাবাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করছে ও ছড়িয়ে দিচ্ছে এই এপারেটাসগুলোর সাহায্যে, এর মাধ্যমে স্কুল-কলেজ-পরিবার-ধর্ম-প্রতিষ্ঠান সব মিলেমিশে যাবে।
দিল্লীতে যে সহিংস ঘটনা ঘটলো, বা এখনো আরো ভয়াবহ ঘটার মতো অবস্থা বিরাজ করছে সেটা আসলে অনেকদিনের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা। পুলিশ সহ শিশুকিশোরদের মধ্যে এই সহিংস কার্যাবলীতে সমভাবে অংশগ্রহণ সেটাও আসলে রাষ্ট্রীয় প্রস্তুতির অংশ। এখানে সহিংস প্রস্তুতি ও ভাবাদর্শিক প্রস্তুতি মিলেমিশে একাকার। এই মিলেমিশে একাকার হওয়াটা আসলে ‘আধুনিক রাষ্ট্রে’রই আলামত। এমন না যে, ভারত মধ্যযুগে ফিরে গিয়েছে, ধর্ম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, বা মুসলমান-হিন্দুরা আবারো মুখোমুখি হয়ে গিয়েছে। এটাকে তখনই হিন্দু বনাম মুসলমানের মামলা বলে মনে হবে যখন ‘রাষ্ট্রীয় কলকব্জা’কে আলোচনা থেকে হাওয়া করে দেয়া হবে।
রাষ্ট্রের ‘ভাবাদর্শের হাতিয়ার’ কীভাবে কাজ করে তার একটা বাংলাদেশী নমুনা হিসেবে র্যাব কর্তৃক নির্মিত ও প্রচারিত বিভিন্ন টিভি বিজ্ঞাপনে কথা বলা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে র্যাব মাদক-বিরোধী ও ‘গুজব’-বিরোধী কয়েকটি টিভি বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে এবং নিয়মিত প্রচার করা হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই র্যাবকে মহান-উদ্ধারকারীর ভূমিকায় নায়করূপে আবির্ভূত হতে দেখা যায়, কিন্তু ‘নায়ক’ ভাবমূর্তির আড়ালে চাপা পড়ে যায় ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে’র২ শিকার অজস্র মানবজীবন ও নাগরিকজীবন, এবং জায়েজ হয়ে যায় প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকা রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও কাঠামোগত দূর্ঘটনা। আলথুসের যেমন করে বলেছিলেন, দমনমূলক হাতিয়ার ও ভাবাদর্শিক হাতিয়ার উভয়ই সহিংসতা ও ভাবাদর্শকে মিলিয়ে কাজ হাসিল করে, ঠিক তেমনি র্যাব একটি দমনমূলক রাষ্ট্রযন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও, সে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রযন্ত্রেরও কাজ করছে। র্যাব তাদের বিজ্ঞাপন দিয়ে কেবল ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে’র পক্ষে সম্মতিই আদায় করছে না, বরঞ্চ, বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণির ভাবাদর্শকে পুনরুৎপাদনও করে চলছে।৩
আলতাফ পারভেজ মার্ক্স, লেনিন, গ্রামসি হয়ে আলথুসের পর্যন্ত মার্ক্সীয় চিন্তা ঐতিহ্যের একটা ধারাবাহিক চিত্র এঁকে দেখান, ধ্রুপদী মার্ক্সবাদে যে ‘অর্থনীতিবাদী ধারণা’ চালু আছে তা থেকে গ্রামসি ও আলথুসেরের আলাপ খানিকটা পৃথক, তবু লেনিন, গ্রামসি ও আলথুসের এর রাষ্ট্রদর্শন মূলত মার্ক্সীয় রাষ্ট্রচিন্তারই ক্রমসম্প্রসারণ। কার্যত মার্ক্সীয় অবকাঠামো-উপরিকাঠামো ধারণাকে আলথুসের নতুনভাবে ও নতুন ঢঙয়ে উপস্থাপন করে। আলথুসেরের বেলায় দেখি যে, উপরিকাঠামোও অবকাঠামোকে প্রভাবিত করছে।
বাংলাদেশে রাষ্ট্র নিয়ে যারা চিন্তা করেন ও ভাবেন তাদের জন্য মার্ক্সীয় চিন্তা ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হওয়া এবং তা পর্যালোচনামূলকভাবে পাঠ করা জরুরী। আলথুসের এই আগ্রহী পাঠকদেরকে চিন্তার অনেক খোরাক সরবরাহ করবেন নিঃসন্দেহে। এই জমানায় আমরা কি ধরণের রাষ্ট্র গঠন করতে চাই, এবং কীভাবে তা করতে চাই তা নিয়ে চলমান তর্কে-বিতর্কে-আড্ডায় আলথুসের আমাদের সহযোগী ও দরকারি বলে গণ্য হবেন।
বই সম্পর্কিত তথ্য
নাম: রাষ্ট্র ও ভাবাদর্শ
ধরণ: রাজনৈতিক দর্শন
লেখক: লুই আলথুসের
অনুবাদ: আলতাফ পারভেজ
প্রকাশ: একুশে বইমেলা ২০২০
প্রকাশক: সংহতি
ISBN: 9789849409618
নোট:
১) দেখা যেতে পারে ডকুমেন্টারি: Al Jazeera English, India’s Hindu Fundamentalists, People and Power (You Tube) Oct 8, 2015
২) বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে আদৌ কতটা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে অভিহিত করা যায় তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এর আইনি পাটাতনও খুঁজে পাওয়া সম্ভব বলে মনে করি। বিস্তারিত দেখতে পারেন, সহুল আহমদ ও সারোয়ার তুষার, ‘ক্রসফায়ারের আইনি ভিত্তি’, রাষ্ট্রচিন্তা, বর্ষ ৪ সংখ্যা ২, ফেব্রুয়ারি ২০২০। এর সংক্ষিপ্ত রূপ পড়া যেতে পারে অনলাইনে।
৩) বিস্তারিত পড়তে পারেন: পারভেজ আলম, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের বিজ্ঞাপন: জৈবক্ষমতার ভাষা ও মতাদর্শিক কারবার’, রাষ্ট্রচিন্তা, বর্ষ ৪ সংখ্যা ১, আগস্ট ২০১৯
[প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় শুদ্ধস্বর ব্লগে।]