আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাগলাগারদ ও জেলখানা: একটি ফুকোডিয়ান ব্যাখ্যা

  • জাহিদুল ইসলাম

ছোটবেলা থেকেই আমাদের দেশে শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করার জন্য পরিবারের লোকেরা অত্যন্ত উৎসুক থাকেন। কিন্তু শিশুদের নিকট এটি বিদ্যালয় নয় বরং শাসনালয়। বিদ্যালয়ের যে ধরাবাঁধা নিয়ম-কানুন সেটি শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক সময় অস্বস্তির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। পড়া না পারার ভয়ে অথবা দীর্ঘ সময় ক্লাসে মনোযোগ দেওয়ার অপারগতা থেকে, শৈশবে ক্লাস পালানোর ঘটনা অনেকের জীবনেই ঘটে থাকে। বিদ্যালয়ের রয়েছে নিজস্ব নিয়ম-কানুন। নিয়ম যখন লঙ্ঘন করা হয় তখন শিক্ষার্থীদের নিয়মের আওতায় নিয়ে আসা হয়। যখনই একটি শিশু তার বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে তখন থেকেই তার বিদ্যালয়ের জন্য সে সাবজেক্টে পরিণত হয়। ফুকোর মতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ এবং অবদমন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

নয়া উদারবাদের যুগে শাসন ব্যবস্থাও অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং কৌশলী। ফুকোর ব্যাখ্যায় এ শাসনব্যবস্থার দুটি মূল কাজ হচ্ছে (Discipline and Punish) শৃঙ্খলিত করা আর শাস্তি। শাস্তির মধ্য দিয়ে বিদ্যমান সমাজ কাঠামোর প্রতি আনুগত্যশীল করে তোলা হয়। এ শাস্তি আবার মধ্যযুগের শাসনব্যবস্থার মতো এত নিষ্ঠুর নয়, বরং সভ্য এবং মার্জিত।

শাস্তির লক্ষ্য পাগল বা অপরাধীর স্বভাবের পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদ্যমান সামাজিক নিয়মকানুনের প্রতি আনুগত্য আদায়। ফুকো তার Madness and Civilization: A History of Insanity in the Age of Reason বইতে পাগলামির প্রতি পশ্চিমা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফুকো তার লেখায় পাগলামির কারণ বা প্রতিকার নিয়ে নয় বরং পাগলামির প্রতি ইউরোপীয়দের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফুকোর মতে পাগলামির প্রতি ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন চারটি ধাপে সংঘটিত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ মধ্যযুগে মানসিক ব্যাধি বা পাগলামি বিষয়টিকে পবিত্র হিসেবে দেখা হতো। রেনেসাঁস পরবর্তী সময়ে পাগলদের জন্য নতুন নিয়ম তৈরি করা হয়। এ পর্যায়ে এসব পাগল বা মানসিক ব্যাধিগ্রস্তদের জাহাজের মাধ্যমে দূরের কোনো স্থানে প্রেরণ করা হতো। পরবর্তী সময়ে এদের দূরে কোথায় প্রেরণ না করে বরং সমাজের ভেতরেই রাখা হয়। যে স্থানে রাখা হতো সেটির নাম দেওয়া হয় পাগলা-গারদ। এ সময় ইউরোপের প্লেগের প্রকোপ কমতে শুরু করে, এবং পাগলদের এসব স্থানে রাখা শুরু হয়। তখন পর্যন্ত পাগলামিকে একটি মানসিক ব্যাধি হিসেবে দেখা হতো না। তাদেরকে নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে এসে মানসিক চিকিৎসার পরিবর্তে সামাজিকভাবে শৃঙ্খলিত করা হতো। অনেকে পাগলামিকে মানসিক সমস্যার পরিবর্তে শারিরীক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করতেন। পাগলদের জন্য চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর, যা কখনো রোগীকে শারিরীক নির্যাতনের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেত। ফুকো তার বইয়ে এসব নির্যাতনের বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছেন। ফুকো আমাদেরকে স্মরণ করে দিতে চান যখন মানসিক বিকারগ্রস্ত উপর এসব নির্যাতন চলছে তখন ইউরোপে পুরোদমে চলছে এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকায়নের যুগ। পরবর্তী সময়ে পাগলামি সমস্যাটিকে যখন মানসিক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তখনো তারা মুক্তি পায় না। তাদের জন্য দুটি পথ খোলা থাকে শৃঙ্খলিত হওয়া অথবা মৃত্যু। পাগলদের উপর তখন মনোচিকিৎসকদের চূড়ান্ত কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

ফুকোর জেলখানা সম্পর্কিত তত্ত্বচিন্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফুকোর মতে এলাইটেনমেন্ট বা আলোকায়নের যুগে জেলখানা সম্পর্কিত ধারণাটির বিকাশ ঘটে ইউরোপে। এর পূর্বে রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজার ছিল হরণমূলক ক্ষমতা। রাজা যখন ইচ্ছা প্রজার প্রাণ কেড়ে নিতে পারতেন। আইন ভঙ্গের জন্য তখন যে কোনো ব্যক্তিকে জনসম্মুখে শাস্তি প্রদান করা হতো। তখন রাজার চিন্তাভাবনা থেকে উৎসারিত আদেশই ছিল আইন। আর আইন ভঙ্গ করা ছিল রাজার সার্বভৌম ক্ষমতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া। যার শাস্তি হিসেবে মৃত্যু ছিল অনিবার্য। এ শাস্তির উদ্দেশ্য ছিল অপরাধীর দেহের উপর নিয়ন্ত্রণ।

পরবর্তীতে আলোকায়নের ফলে ইউরোপীয় সমাজে চিন্তা ভাবনার বিবর্তন ঘটে। আইন তখন শুধু রাজা বা রাজ্য রক্ষার জন্য নয়, এটি তখন সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আইনের লঙ্ঘন হচ্ছে সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলার লঙ্ঘন। তখন থেকে আইন ভঙ্গের শাস্তি অপরাধীর দেহ নয় বরং মন। কারণ শারীরিক শাস্তি রাজ্যবিরোধী বিপ্লবীদের সফলভাবে দমন করতে পারে না। অন্যদিকে প্রাকাশ্য শাস্তি জনমনে অপরাধীর প্রতি সহানুভূতি তৈরি করে। তখন অপরাধীর মনের উপর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণই হয়ে দাঁড়ায় শাস্তির লক্ষ্য। এ শাস্তিদানের জন্যই তৈরি করা হয় আধুনিক জেলখানা। জেলখানার মাধ্যমে অপরাধীকে নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা হয়, আর নজরাদির মাধ্যমে অপরাধীর আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ নজরদারির আওতায় শুধু জেলখানা নয় বরং বিদ্যালয়, হাসাপাতাল, পাগলাগারদ, সেনাবাহিনীর ব্যারাক সবকিছুকে নিয়ে আসা হয়। নজরাদারি ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান পরিণত হয় রাষ্ট্র ভাবাদর্শ বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমে।

ফুকো রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দুই ধরনের ক্ষমতার কথা বলেছেন। সার্বভৌম ক্ষমতা আর জৈবক্ষমতা বা বায়োপাওয়ার। সার্বভৌম ক্ষমতার রাষ্ট্র ছিল মধ্যযুগের রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। আর আধুনিক রাষ্ট্র হচ্ছে বায়োপাওয়ার বা জৈবক্ষমতার রাষ্ট্র। সার্বভৌম ক্ষমতা হচ্ছে হরণমূলক। এটি প্রজাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতার জন্ম দেয়। আধুনিক জৈবক্ষমতা হচ্ছে উৎপাদনমূলক। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণ গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তাদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা। শিক্ষা, চিকিৎসা সেবা, চাকরির সুবিধা এগুলোর মধ্যে অন্যতম। আধুনিক রাষ্ট্র যেসব নীতি-নৈতিকতা, ভাবাদর্শ নির্মাণ করে, সেসব বাস্তবায়ন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সর্বাধিক। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের উপর ক্ষমতা চর্চা করার জন্য একধরনের বৈধ উপায়ের প্রয়োজন। রাষ্ট্রের লক্ষ্য জনগণের শরীর নয় বরং মন। তাই এখানে ক্ষমতা চর্চার কৌশল অত্যন্ত সূক্ষ্ম। রাষ্ট্র জনগণের উপর যে ক্ষমতা চর্চা করে, তার বৈধতা আসে বিভিন্ন জ্ঞানকাণ্ড নির্মাণের মাধ্যমে। এজন্য ফুকো জ্ঞান-ক্ষমতা শব্দটির ব্যবহার করতেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রয়োগকে ন্যায়সঙ্গত করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন সময় দেখা যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন শিক্ষক, শিক্ষার্থী রাষ্ট্রের অন্যায়মূলক কাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এ বিদ্রোহ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যক্তির বিদ্রোহ। বিদ্রোহকে সফলতার পর্যায়ে নিয়ে যেতে ব্যক্তির একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপের প্রয়োজন। নতুবা বিদ্রোহের পরিণতি হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে আইনের দ্বারা নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা হয়। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শৃঙ্খলিত করা হয়। ফুকোর জৈবক্ষমতার মধ্যে জ্ঞান এবং ক্ষমতা একসাথে কাজ করে এবং একে অপরকে বৈধতা দেয়।

বোকার টি. ওয়াশিংটন ছিলেন ছিলেন আমেরিকার একজন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক। ছোটবেলা থেকেই তার পড়ালেখার শখ ছিল। তিনি যখন বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেন তখন আমেরিকায় কালোদের জন্য ছিল আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে সাদা কালোরা একসাথে পড়লেও পাঠদানের সময় তারা আলাদা বসতেন। ১৮৮২ সালে বোকার টি. ওয়াশিংটন শিক্ষার জন্য ভার্জিনিয়ার কৃষি ইন্সটিটিউটে বিদ্যা অর্জনের জন্য মনস্থির করেন এবং সেখানে গমন করেন। বিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার জন্য এবং প্রধান শিক্ষকের নজরে আসার জন্য তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। অবশেষে বিদ্যালয়ের একটি কক্ষ কয়েকবার পরিষ্কারের বিনিময়ে প্রধান শিক্ষকের সুনজরে আসেন এবং বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এটি ছিল তখনকার দিনে কৃষ্ণাঙ্গের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা। কালোদের জন্য আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে তখনকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শই বাস্তবায়ন করত। এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সামাজিক স্থিতাবস্থার প্রতীক। তখনকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাষ্ট্র বর্ণবাদ ব্যবস্থার সম্মতি উৎপাদন করত।

বর্তমানে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়েও ফুকোর জ্ঞান-ক্ষমতা সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের মাধ্যমে তার জনগণকে শৃঙ্খলিত করে। ফরাসি দার্শনিক লুই আলথুসার রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাসের কথা বলেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস। নয়া উদারনীতির যুগে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে যেসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তা হলো:
ক) প্রভাবশালী গোষ্ঠী /শ্রেণির মূল্যবোধগুলোকে পুনরুৎপাদন করে।
খ) কর্পোরেটিজমের ব্যাপক প্রসার ঘটায়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের আধিপত্যশীল ডিসকোর্স নির্মাণের মাধ্যমে উদারনৈতিক কর্পোরেট রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক কার্যাবলিকে বৈধতা প্রদান করে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকে সেটি হচ্ছে রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেওয়া। এটি ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে শুরু হয়। পশ্চিমা বিশ্বগুলো যখন ক্রমশ প্রাচ্যে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে, তখন ঔপনিবেশ শাসনকে জ্ঞান-তাত্ত্বিকভাবে বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়। এ কাজটির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাচ্যতত্ত্ববিদরা। তারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাচ্যচর্চা শুরু করেন। প্রাচ্যতত্ত্ববিদরা আদর্শগতভাবে ‘বিকৃত’ এবং ‘পক্ষপাতিত্বমূলক’ জ্ঞানচর্চা করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের প্রাচ্যচর্চার মূল উদ্দেশ্য প্রাচ্যকে বর্বর, অপর এবং প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করা। ডানকার্ন ম্যাকডোনাল্ড, হেমিল্টন গিব, বার্নার্ড লুইসের মতো বিখ্যাত প্রাচ্যতত্ত্ববিদরা আমেরিকান একাডেমিক জগতে প্রসিদ্ধ। তাদের প্রাচ্যচর্চার মূল উদ্দেশ্যই ছিল রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শের বাস্তবায়ন।

পশ্চিমা একাডেমিক জগতের পণ্ডিতরা রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শ বাস্তবায়নে ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য বিভিন্ন সময় বৈশ্বিক ডিসকোর্স তৈরি করে থাকেন। তাদের ডিসকোর্সগুলো শুধু পশ্চিমা বিশ্বেই নয় বরং প্রাচ্যেও প্রভাবশালী। এক্ষেত্রে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের ‘সভ্যতার সংঘাত’ ও অধ্যাপক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ নামক ডিসকোর্সগুলোর কথা বলা যায়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের পেছনে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে তাদের তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। হান্টিংটনের ইসলামসহ প্রাচ্যের বিভিন্ন ধর্মকে পশ্চিমাদের শত্রু হিসেবে উপস্থাপন এবং ফুকুয়ামার পশ্চিমাদের একমাত্র বিজয়ী হিসেবে ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’ ঘোষণা সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য তৈরির ক্ষেত্রে অবদান অপরিসীম। পাশ্চাত্যের অনেক অধ্যাপকই জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে তাদের রাষ্ট্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারা তাদের ডিসকোর্সগুলোর মাধ্যমে ছাত্রদের মনোগজতকে বিভিন্ন সময় নিয়ন্ত্রণ করেন। এজন্য ইরাক বা আফাগানিস্তানে যখন পশ্চিমা বিশ্ব হস্তক্ষেপ করে তখন তারা ভাবে গণতন্ত্র, নারী মুক্তি ইত্যাদির জন্যই হয়তো তাদের এ হস্তক্ষেপ।

মিশেল ফুকো

আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আধিপত্য স্পষ্টভাবে কাজে করে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এটিই শেখানো হয় আইনের চোখে সবাই সমান এবং সবার ন্যায়বিচারের সমান অধিকার রয়েছে। বাস্তবে যদিও এর অস্তিত্ব নেই। আমাদের দেশে আইন ব্যক্তির ক্ষমতা ও তার অর্থনৈতিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে বৈষম্যমূলক আচরণ করে থাকে। আইনি নির্যাতন এবং অবদমনের দিকটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক আলোচনা নেই। অথচ আমাদের দেশের অধিকাংশ আইনি নিয়ম-নীতি ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার। সাম্প্রতিক সময়ে “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮“ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে ২৯ নম্বর ধারা। এ ধারার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। সরকারের সমালোচনার জন্য সাংবাদিক কার্টুনিস্টসহ অনেককে জেলে প্রেরণ করা হয়েছে।

এ ধারার মূল ভিত্তিই হচ্ছে ১৮৬০ সালের পেলান কোড ৪৯৯। সিপাহী বিপ্লবের পর ব্রিটিশ শাসকরা স্থানীয়দের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু আইন প্রণয়ন করে। আর এ আইনটি ছিল তার মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশে আইনসহ রাষ্ট্র পরিচালনার সমস্ত নিয়মকানুনই ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার। আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে, ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছে কিন্তু রূপান্তর হয়নি। ফলে জনগণকে অবদমন ও নিয়ন্ত্রণ করার কাজ পর্যায়ক্রমে চালু আছে। বিশ্ববিদ্যালয় এ রূপান্তরের কাজটি করতে পারত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। বিপরীত দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ই এসব আইনের রক্ষক হয়ে দাঁড়িয়েছে, এসব আইনের লঙ্ঘন করে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ’ করা হচ্ছে। এখানে রাষ্ট্র এবং বিশ্ববিদ্যালয় একসাথে লীন হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য এখানে একই জনগণ বা ছাত্রের মনের উপর নিয়ন্ত্রণ। সে নিয়ন্ত্রণ হবে সভ্য উপায়ে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে।

এদেশে অনেক শিক্ষাবিদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধীতা করেছেন। আবার অনেকের বিরোধিতার অর্থ এই নয় যে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তারা স্বাধীনতা চান, তবে ‘শর্তযুক্ত’ স্বাধীনতা। অর্থাৎ তাদের চাহিদা নতুন একটি আইন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেহেতু সাধারণ জনগণ অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে, সেহেতু তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলিত করার প্রয়োজন।

আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যে ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, রাজনীতির শিক্ষা দেওয়া হয় ক্ষমতার সাপেক্ষ তা নিরীহ নয়। রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শের বাস্তবায়নই যেন তার উদ্দেশ্য, নীতি-নৈতিকার প্রশ্ন মুখ্য নয়। এজন্য সরকারের সমালোচনার জন্য ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। আবার শিক্ষকের নৈতিক পদস্খলনের ফলে শিক্ষকের বহিষ্কারের জন্য ছাত্রদের আন্দোলন করতে হয়।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কারণে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হলেও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যখন বিশ্বব্যাংকের মতো মুনাফালোভী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে তখন তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় না। ভাবমূর্তি রক্ষায় এখন বিভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। আনলাইন ক্লাস তার মধ্যে অন্যতম। অনলাইনে ক্লাস করতে অনেক শিক্ষার্থী তাদের অপরাগতা জানিয়েছে কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন অনলাইন ক্লাসের ব্যাপারে আগ্রহী। কারণ তারা এদেশের সামাজিক বাস্তবতা এড়িয়ে উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো অনলাইনে ক্লাস নিতে চান। বাস্তবিক আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ভাবমূর্তি সবচেয়ে বেশি ক্ষুণ্ণ হয় রাষ্ট্রীয় আচরণের মাধ্যমে। কারণ আমাদের রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সময় উপযোগী চিন্তাভাবনাকে আমলে নেয় না। অনেকক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চিন্তাভাবনা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়। রাষ্ট্র যে শিক্ষাবিদদের কথা তেমন একটা আমলে নেয় না বিভিন্ন সময় তার পরিচয় পাওয়া গেছে। সর্বশেষ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে শিক্ষাবিদরা পরিবেশ বিপর্যয়ের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু সে উদ্বেগ রাষ্ট্রের কাছে মুখ্য নয়। শিক্ষকদের কাছ থেকে রাষ্ট্র বিভিন্ন ইস্যুতে পরামর্শ নিবে, এটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম জ্ঞানভিত্তিক কাজ। আমাদের দেশে তার বিপরীত চিত্র দেখা যায়।

অনেকে আবার এ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগেন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রগতিশীলতার চর্চা হচ্ছে। তবে এই প্রগতিশীলতাও জ্ঞান-ক্ষমতা সম্পর্কিত। তারা প্রগতিশীলতা চর্চার বিপরীতে সাম্প্রদায়িকতা নামক ডিসকোর্সটি তৈরি করেছেন তা অত্যন্ত কৌশলী। ‘সাম্প্রদায়িকতা’ নামক ডিসকোর্সটি মূলত ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ড থেকেই পাওয়া। আমাদের দেশে সম্প্রদায়িকতা শব্দটি দ্বারা শুধুমাত্র হিন্দু মুসলিম বিদ্বেষকেই বোঝায়। আমাদের দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা এটিকে শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলিম সমস্যার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে থাকেন। এর ফলে আমাদের দেশের আদিবাসীদের সমস্যা ব্যাপকভাবে প্রান্তিকীকরণ করা হয়; বিশেষত আদিবাসীদের ভাষা এবং জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার দিকটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস এবং রাজনৈতিক জ্ঞানচর্চা রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত। এজন্য ইতিহাস চর্চায় নিম্নবর্গের অবস্থানকে অনেক সময়ই প্রান্তিকীকরণ করা হয়।

আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানচর্চা যদি রাষ্ট্রীয় আধিপত্যের পক্ষে না হয়ে সাধারণ জনগণের পক্ষে হতো তাহলে দেশে এত দুর্নীতি আর অনিয়ম থাকত না। এ শিক্ষাব্যবস্থায় শুধুমাত্র সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে। বাস্তবিকই তা সরকারি চাকরি, রাষ্ট্রীয় চাকরি হয়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সরকারি চাকরির আগ্রহ এবং প্রস্তুতির ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চ শিক্ষার যে প্রধান কাজ— নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, তা করতে পারে না। যে জ্ঞান তাদের সমাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সার্বিক অগ্রগতির কাজে ব্যবহার করা যেত। এজন্য সমাজে ক্রিটিক্যাল থিংকিং-এর বিকাশ না ঘটে হেজেমোনাইজড চিন্তা-ভাবনার বিকাশ ঘটে।

ছবি: ইন্টারনেট থেকে গৃহীত

এদেশে বিভিন্ন সময় সামরিক শাসকরা শাসন করেছেন। সামরিক বা রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ফুকোর জৈব ক্ষমতা কাজ করেনা, তখন কাজ করে সার্বভৌম ক্ষমতা। সামরিক শাসনামলে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে। এরশাদের শাসনামলে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ব্যাপকভাবে লঙ্গন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। পুলিশি ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে রাষ্ট্র কতৃক সরাসরি শৃঙ্খলিত করা হয়। ১/১১ এর সময়েও একই উদ্যোগ গ্রহণ করার পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। তখন ভিন্ন মত ও আদর্শকে প্রান্তিকীকরণের নামে বিভিন্ন শিক্ষক ও ছাত্রদের বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘আইন-শৃঙ্খলা বিনষ্টের’ অভিযোগ আনা হয়। সামরিক সরকার শাসনামলের পরিবর্তি সময়েও আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শ বাস্থবায়নের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। একইসাথে সাথে বিরোধী মত এবং চিন্তাভাবনাকে ব্যাপকভাবে প্রান্তিকীকরণ করা হয়।বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলিত করার একটি চিত্র পাওয়া যায় অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটনের লেখায়। তাঁর ভাষায়,

‘বিগত সরকারগুলোর শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের ওপর নির্বিচারে সরকারী কর্তৃত্ব কায়েম করা হয়েছিল রাজনৈতিক দলের ছাত্র-সংগঠনসহ নানান অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, দলীয় প্রশাসন-যন্ত্র, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে। এই রাষ্ট্রীয়-সরকারী কর্তৃত্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন, শিক্ষকদের প্রকৃত স্বাধীনতা এবং শিক্ষার উদার পরিবেশকে মারাত্মকভাবে কলুষিত করেছিল। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তৈরি হয়েছিল নীতিহীন, সুবিধাবাদী এবং সরকারী ও বিরোধীদলীয় শাসক-কর্তৃপক্ষের ‘কর্মচারীসুলভ’ তল্পীবাহক শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারী-দের একটি নির্লজ্জ গোষ্ঠী।’

বর্তমানে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফুকোর জৈব ক্ষমতা, একই সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সার্বভৌম ক্ষমতাও কাজ করে। উদাহরণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল ব্লক বা টর্চার সেলের কথা বলা যায়। এসব পলিটিক্যাল ব্লকের মাধ্যমে মূলত ভিন্ন মত বা চিন্তাকে খুব কঠোরভাবে প্রতিহত করা হয়। প্রতিহত করার একপর্যায়ে আবরারে মতো শিক্ষার্থীকে তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাণ দিতে হয়। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের পড়তে এসে লাশ হওয়ার ঘটনা অনেক সময়ই ঘটে থাকে। ছাত্র রাজনীতির মধ্যে ক্ষমতার চর্চা এমনভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে যে মানবিক সম্পর্কও এক্ষেত্রে কাজে আসছে না। চূড়ান্তপর্যায়ে দেখা যায় যে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো জেলখানা এবং পাগলগারদের মতোই কাজ করে: শৃঙ্খলিত করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা।

তথ্যসূত্র:
১) Michel Foucault, Discipline and Punish: The Birth of the Prison, 1975
২) Booker T. Washington, Up from slavery, page: 25-33
৩) Ken Udas, The University as Ideological State Apparatus: Educating to Defend the Corporate Status Quo? (Article  in  International Education Journal ·April 2019)
৪) Aayesha Rafiq, Orientalism and western Academia: An Introductory Study.
৫) মুহম্মদ জাফর ইকবাল, দিন দিন প্রতিদিন, bdnews24.com
৬) সেলিম রেজা নিউটন, মহামান্য ভয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা, অরাজ
৭) প্রাগুক্ত

  • লেখক: শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *