অজ্ঞতাও ক্ষমতার এক ধরন বটে: আশিল এমবেম্বে

ক্যামেরুনীয় তাত্ত্বিক আশিল এমবেম্বের এই সাক্ষাৎকারটি ৯ই নভেম্বর, ২০২০-এ Chilperic- এ প্রকাশিত হয়। সুইস সাংবাদিক Malka Gouzer-এর নেয়া এই সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন তাহমিদ আলম ফিহাদ। ফিহাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। অনুবাদটি প্রকাশিত হয় বোধিচিত্ত-এ।

তিনি বলতেই থাকেন আর বলতেই থাকেন, আপনি তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। তারপর আঁচমকা হঠাৎ যেন হাওয়া থেকে একটা শব্দ বা ধারণা এসে আপনার মুখে চপেটাঘাত করে। আপনি আবার শুনতে থাকেন। তিনি তাঁর আর্গুমেন্টে আরেকটা সহিংস মেটাফোর যোগ করেন এবং আপনি, মাত্রই যে সত্য তিনি উন্মোচন করেছেন তার হাতে নিরস্ত্র হয়ে পড়েন। আমি আন্দাজ করি ক্যামেরুনীয় ইতিহাসবিদ এবং দার্শনিক আশিল এমবেম্বের প্রতিভার কিছু অংশ উৎসরিত হয় সেই সকল প্রত্যয় প্রস্তাবের ক্ষেত্রে যা এখনো ঠিক নির্মিত হয়নি। সেগুলো উদ্ভাবন করার ক্ষমতা থেকে। এমন না যে আগে সেগুলোর অস্তিত্ব ছিল না, কিন্তু সঠিক শব্দগুলো শোনা যাচ্ছিল না সে ধারণাগুলোর মধ্যে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০০ সালে প্রকাশিত হওয়া তার De La Postcolonie নামক বইটি আফ্রিকা মহাদেশের উপর এবং তার অভ্যন্তরে আধিপত্যের ঔপনিবেশিক রূপটি এখনও কিভাবে কাজ করে যাচ্ছে তা প্রকাশ করার মাধ্যমে উত্তর-উপনিবেশিক পাঠে বিপুল আগ্রহ জাগ্রত করতে অবদান রেখেছে। তাঁর Critique de la raison negree নামক বইটি (যা প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালে) পশ্চিমা পরিচয় নির্মাণে “কালো” অবয়বের ভূমিকার উপর আলোকপাত করে। পরবর্তীতে তিনি নেক্রোপলিটিক্স/মারণ-রাজনীতি প্রত্যয়টি নির্মাণ করেন। হাল-আমলের বিদ্যায়তনিক জগতে অতিরিক্ত ও অযাচিত জনসংখ্যা উৎপাদন দেখাতে এই প্রত্যয় অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে । আরও সম্প্রতি তিনি নৃশংসতাবাদের প্রত্যয়টির পরিচয় ঘটান যা পুঁজিবাদের নিষ্কাশন এবং আবর্জনা তৈরির অবিরাম প্রক্রিয়াটি বর্ণণা করে। একটি প্রক্রিয়া যা প্রবৃদ্ধি উৎপাদন করেঃ দেয়াল, পরিষ্কার রাস্তা, নির্দেশিত ওষুধ, গাড়ি, ব্যাংকসমূহ- এবং আবর্জনা। মানুষ এবং মানুষ নয় এমন অবশিষ্টাংশ দ্বারা তৈরি আবর্জনা যা আমরা পুঁতে ফেলি, বাইরে পাঠাই বা কারাবন্দী করি। দহন, প্লাস্টিকের জন্য দ্বীপ অথবা “অভিবাসীরা” হচ্ছে এই দ্রুত “বর্জ্বে-রূপান্তরকরণ” উদাহরণ, যাদের কোন মূল্য আমাদের এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নেই। নৃশংসতাবাদের এই পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াকে এমবেম্বে কালোদের অবস্থার ইচ্ছাকৃত সার্বজনীনকরণ হিসেবেও ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি সম্প্রতি আমাকে বলেছেন “যে আচরণ আলাদাভাবে কালো মানুষদের প্রতি-ই করা হতো, তা এখন ভিন্ন রঙের মানুষগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে,”। “সংজ্ঞা অনুযায়ী কালো মানুষ হচ্ছেন তিনিই যাকে অপমান করা যায়, যার মর্যাদার স্বীকৃতি দেয়া হয় না, কোন প্রকার শাস্তি ছাড়াই যার (তার নিঃশ্বাস নেয়ার অধিকার সহ) অধিকার লঙ্ঘন করা যায়। সুতরাং সে অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তির পূর্ণ রূপটিকে চিত্রায়িত করে। ইদানীং এই অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তির সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলছে।”

আশিল এমবেম্বের যে ব্যাপারটা আমাকে বিরক্ত করে তা হচ্ছে যেভাবে তিনি আমার নিষ্পাপ পশ্চিমা সুবিধাগুলিকে কলুষিত করতে সমর্থ হয়েছেন। আগে আমি এর চেয়ে অনেক ভাল ছিলাম, কোন কারণ ছাড়াই সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, সেই সাথে জেট-ল্যাগ এর সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্য স্টিমুল্যান্ট এবং ট্র্যাংকুলাইজার নিচ্ছিলাম। আমি ব্যাংকারদের ন্যায়বান মানুষ হিসেবে দেখতাম যাদের বিয়ে করার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠবো এবং যে সকল বহিরাগতরা আমাদের আবর্জনা মুক্ত দেশ এবং স্কুলগুলোতে বানের জলের মত ঢুকছে, গোপনে তাদের প্রতি বিরক্ত ছিলাম। আমি আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এবং কিভাবে এই সব অনিশ্চয়তা এবং বিপদ তাদের নিজেদের পরিণত বয়সের ফুটপাতকে দূষিত করবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতাম। আমি এটা না “জেনেও” জানতাম যে বর্ণবাদ এবং পরিবেশের বিনাশ একই মুদ্রারই এপিঠ ওপিঠ, জানতাম যে একটার সাথে লড়াই না করে আরেকটার সাথে লড়াই করা যায় না; জানতাম যে আমরা যদি ক্রমাগত আফ্রিকার মাটিকে ধ্বংস না করতাম এবং ধ্বংস না করে যেতাম তাহলে তার বাসিন্দারা পালানোর চেষ্টা করতো না, জানতাম যে আমার প্রাপ্ত সুবিধাগুলি শুধুমাত্র ভাগ্যের ব্যাপার না, বরং অবিরাম শোষণের ফল যেখানে, আমার ভাল লাগুক বা না লাগুক, আমি নিজেও একজন সহযোগী। এসবের দ্বারা খুব একটা উদ্বিগ্ন না হয়েই এসব আমি জানতাম। এসব মর্মান্তিক ঘটনা যা বেশিরভাগ সময় ঘটে পৃথিবীর দূরবর্তী অংশে, যা সুইজারল্যান্ডে আমার বাসার দৃশ্য থেকে অনেক দূরে, সেগুলো থেকে নিজের দায়িত্ব সরিয়ে নেয়ার একটা আরামদায়ক পথ আমি খুঁজে নিয়েছিলাম। আমার মতে কেউই এটা মনে করিয়ে দিলে আনন্দিত হয় না যে তাঁদের সরলতার তলায় আছে আবর্জনার স্তুপ যা “অন্যের” দ্বারা নয়, বরং তাঁর নিজেরই তৈরি। কম কথায় বললেঃ আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় আমি আশিল এমবেম্বের সত্যের আঘাতের মুখোমুখি না হতাম। কারণ, যেমনটা তিনি তার সর্বশেষ বই Brutalism এ মন্তব্য করেছেন, “অজ্ঞতাও ক্ষমতার একটি রুপ”।

আমাদের দেখা হয় ২০২০ এর গ্রীষ্মের শেষে। আমি ফ্রান্সের ব্রিটানিতে ছিলাম, তিনি জোহান্সবার্গে তাঁর বাড়িতে শীত শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।


আপনি নিজেকে একজন উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তক হিসেবে চিহ্নায়িত করতে অস্বীকার করেন, কেন?

উত্তর-ঔপনিবেশিক বা বিউপনিবেশিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান নয়; কিন্তু না আমি উত্তর-ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক, না বিউপনিবেশায়নের তাত্ত্বিক। আমার গল্প হচ্ছে একটা অবিরাম নিত্য চলনের গল্প। আমার জন্ম হয়েছিল ক্যামেরুনে। আমি আমার টুয়েন্টিজ কাটাই প্যারিসে, আমার থার্টিজের শুরু এবং মাঝের সময়টা কাটাই নিউইয়র্ক, ফিলেডেলফিয়া এবং ওয়াশিংটনে।পরে আমি চলে যাই সেনেগালের ডাকারে এবং এখন আমি আছি দক্ষিণ আফ্রিকায়, জোহানেসবার্গে। একইভাবে, আমি একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হই, তারপর আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান অধ্যয়ন করি। একই সময়ে, আমি অনেক দর্শন এবং নৃতত্ত্ব পড়ি, সাহিত্য এবং মনোঃসমীক্ষণে নিমগ্ন হই। এই মুহূর্তে আমি লাইফ সায়েন্স, জলবায়ু এবং ভূ-বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হচ্ছি। সীমানার এই অবিরাম অতিক্রমণই আমার জীবন এবং কাজকে চিহ্নিত করে।

তাহলে আপনাকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা হবে?

আমি নিজেকে বরং penseur de la traverse (মিশ্র চিন্তাবিদ) হিসেবে চিহ্নিত করবো। এমন একজন যার কাছে সমালোচনা হচ্ছে যত্ন, নিরাময় এবং ক্ষতিপূরণের একটি রূপ। একটি সার্বজনীন পৃথিবীর ধারণা, কিভাবে একে অস্তিত্ব দেয়া যায়, কিভাবে গঠন করা যায়, কিভাবে একে মেরামত করা যায় এবং সবার সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া যায়- শেষ পর্যন্ত এটাই আমার আসল চিন্তা।

আপনার শেষ বই ব্রুটালিজম -এ পৃথিবীকে আবারো মোহনীয় করার জন্য এবং এই একটি পৃথিবী যা আমরা সবাই একসাথে ভাগাভাগি করে নেই, তার উপাদানসমূহ, যে উপাদানসমূহ এই পৃথিবীকে গঠন করে এবং এরই অন্তর্গত, সেগুলোর মধ্যে পুনরায় সংহতি সঞ্চার করার জন্য en-commune(in-common) রাজনীতির অনুরোধ করেছেন। আপনার en-commune ধারণাটির সাথে কি কমিউনিস্ট ধারণাসমূহের কোন সম্বন্ধ আছে?

না, রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে কমিউনিজমের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। এর সম্পর্ক প্রাণের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কাজের সাথে, এবং যেমনটা আমি বললাম, যত্ন, নিরাময় এবং ক্ষতিপূরণ-এর তত্ত্ব, ঐতিহাসিক ক্ষতির বাস্তবতা এবং পৃথিবীর বাসযোগ্যতা নিয়ে বিতর্কের সাথে এটি সম্পর্কিত। ইউরোপকেন্দ্রিকতা শেষ পর্যন্ত উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ এবং সাদা মানুষের শেষ্ঠত্ব লালন করে গেছে। উত্তর-উপনিবেশবাদ ভিন্নতা, পরিচয় এবং অন্যতা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আফ্রিকার চিন্তা পদ্ধতির প্রতি আমার গভীর আগ্রহের ফলে আমি সাধারণত্ব (Commonality) এবং বহুত্বের (multiplicity) আদর্শ দ্বারা, সকল মনুষ্য এবং মনুষ্য নয় এমন জীবন রূপের অন্তর্জাল দ্বারা এবং বস্তুর যে কম্যুনিটি তাঁরা গঠন করে তার দ্বারা কৌতূহলী হয়ে উঠি। আমার যোগ করা উচিত, এই সাধারণত্বকে সব সময় গঠন এবং পুনর্গঠন করতে হবে। অন্তহীন লড়াই এবং প্রায়শই, পরাজয় এবং নতুন আরম্ভ দ্বারা একে একসাথে জোড়া লাগাতে হবে।

© Stephanie Fuessenich/laif für die FAZ

ভিন্নতাই কি পরিচয় এর ভিত্তি না?

উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর সময় আমরা ভিন্নতা এবং পরিচয়, নিজ এবং অন্যের ব্যাপারে কথা বলা বন্ধ করিনি। বন্ধ করিনি কে আমাদের মত আর কে আমাদের মত না, কে আমাদের অন্তর্গত না আর কে না সে ব্যাপারে কথা বলা। যেভাবে সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, পৃথিবী পুড়ছে এবং বিকিরণের মাত্রা বাড়ছে এবং সূর্যের থেকে আসা প্লাজমা রশ্মির বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিরক্ষা কমছে আর কমছে এবং আমরা ভাইরাস দ্বারা পরিবেষ্টিত হচ্ছি, তাতে এখন এই ডিসকোর্স মানার সামর্থ্য আমাদের খুব সামান্যই আছে।

এর মানে কি হায়ারার্কি আরও বেশি সমান আনুভূমিক হওয়া উচিত?

সংজ্ঞা অনুযায়ী, সকল হায়ারার্কিকেই প্রতিযোগীতার সামনে দাঁড় করানো উচিৎ। আমি র‌্যাডিকাল সমতার পক্ষে। প্রথাগত সমতা অর্থহীন, যতদিন পর্যন্ত নির্দিষ্ট কিছু মানুষ (বেশিরভাগ সময় একই মানুষগুলি) অকাল মৃত্যুর মুখে আটকে থাকে। একবার যখন সমতা নিশ্চিত হয়, আমাদের কাজ করা প্রয়োজন প্রতিনিধিত্বের সবচে’ ভাল পদ্ধতি নিয়ে। কিন্তু যারা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করবে তাদেরকে কখনই শ্রেণীগতভাবে আমাদের সুপেরিয়র হিসেবে ধরে নেয়া যাবে না। বরং তাদের ডাকা হয়েছে সকলের তত্ত্বাবধানের জন্য সেবা প্রদান করতে। প্রতিনিধিত্ব শুধুমাত্র সম্মতির ফল হতে পারে এবং এমন সম্মতির অনুমোদন পাওয়ার জন্য যারা আমাদের প্রতিনিধিত্ব করে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে।

আপনার কি কোন মিশন আছে?

সবকিছু ইতিমধ্যে যতটা কুৎসিত, তার চেয়ে বেশি কুৎসিত আমি করতে চাইবো না। অন্য সকলের মতই আমি পৃথিবীতে আছি একটা সামান্য সময়ের জন্য। একটা মহাবিশ্বের মধ্যে একটা ছোট কণা যা অচিন্তনীয় শক্তি দ্বারা পরিচালিত। তাই আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে যা এখনও আসা বাকি তার প্রতি যতটা সম্ভব উন্মুক্ত হওয়া। এই মহাবিশ্বের শক্তিগুলোর বহুবিধ অনুরণন গ্রহণ করা ও আলিঙ্গন করা। আমার শেষ দিনে, আমার জীবনের গোধূলী লগ্নে, আমি এটা বলতে সক্ষম হতে চাই যে এই পৃথিবীর সীমাহীন দেহের গন্ধ আমি নিয়েছি এবং পরিপূর্ণ ভাবে এর নিশ্বাস আমি গ্রহণ করেছি।

লেখালেখি হচ্ছে আপনার মাধ্যম। এই অভ্যাস আপনার কিভাবে হলো?

আমি লাজুক প্রকৃতির ছিলাম। জনসম্মুখে কথা বলা, এমনকি কোন দলের মধ্যে কথা বলার চেয়ে লেখাটা আমার জন্য সহজ ছিল। যখন আমার বয়স ছিল ১২, আমি আমার বোর্ডিং স্কুলের কবিতার সংগঠনের সদস্য ছিলাম। এর সাথে আমি একটা ব্যাক্তিগত ডায়েরী রাখতাম যেখানে আমার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা যুক্ত করতাম। কিন্তু যখন আমার বয়স আঠারো বা ঊনিশ হল, তখনই মাত্র আমি লেখা শুরু করলাম। অর্থাৎ, জনসম্মুখে কথা বলতে শুরু করলাম।

লেখালেখির অর্থ কী আপনার কাছে?

এটা আমাকে নিজের কেন্দ্র খুঁজে বের করতে সক্ষম করে। একরকম বলা যায়, “আমি লেখি তাই আমি অস্তিত্বশীল”। এটা একটা আত্মপ্রশান্তির জায়গা, কিন্তু সময়ে সময়ে এটি আত্ম-বিভাজনের জায়গাও হতে পারে। ঘটনা যাই হোক, যা আমি লিখি তা আমার এবং কখনই আমার থেকে ছিনিয়ে নেয়া যাবে না।

Necro Politics, Achille Mbembe

আপনার কি লেখালেখির কোন রুটিন আছে?

লেখার জন্য আমার প্রয়োজন নীরবতা। কয়েকদিন না হলেও দীর্ঘ সময়ের জন্য আমাকে একা থাকতে দিতে হয়। নীরবতা হচ্ছে আমার জন্য আধ্যাত্মিক ঘনীভবনের(psychic condensation) গৌড়চন্দ্রিকা। যখন আমি আরও তরুণ ছিলাম, প্রায়ই আমি মধ্য রাতের পর ঘুটঘুটে অন্ধকারে লিখতাম। মধ্যরাতের পর লিখলে আমি আফ্রিকার সবচেয়ে গভীর স্পন্দন, এর শোক(tragedy) সেই সাথে এর রূপান্তরের সম্ভাবনা, পৃথিবীর প্রতি যে অঙ্গীকার সে প্রদর্শন করে, এসবের সাথে পুনরায় যুক্ত হতে পারি। এভাবেই আমি কঙ্গোলিজ শব্দ এবং ছন্দের মাঝে On the Postcolony লিখি।

আপনার স্ত্রী, সন্তান এবং কুকুরের সাথে বসবাস করে কিভাবে আপনি বিচ্ছিন্নতা এবং নীরবতার এই বুদ্বুদে পৌঁছান?

আমার স্ত্রী নিজেই একজন লেখক। কুকুরটা খুবই নির্ভেজাল সঙ্গী। এমনও হয় যে আমি আপনার সাথে এখন কথা বলছি সত্যিকার অর্থে এখানে না থেকেই। শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকাটা আমার মনকে সম্পূর্ণ অন্য কোথাও থাকা হতে বিরত রাখে না।

আপনার লিখা শুরু হয় কোথায় থেকে?

বেশির ভাগ সময় আমার মনের ভিতরে। মাঝে মাঝে আমি যা দেখি, যা শুনি, যা পড়ি তা থেকে। এটা শুরু হতে পারে যখন আমি গোসলে, যখন আমি রান্না করি বা যখন আমি বিছানায় ঘুমিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছি। আমি অনেক মাস কাটিয়ে দিতে পারি কিছু না লিখে। বিষয়গুলো প্রথমে সিদ্ধ হতে হয়। আমার নিজেকে এমন একটা অবস্থায় খুঁজে পেতে হয় যখন বাস্তবতা, বা কোন ঘটনা দ্বারা বা কোন কিছুর মুখোমুখি হওয়ার ফলে উত্থিত প্রশ্নকে আমি আর আটকে রাখতে পারি না।

আপনি কি নোট নেন?

না আসলে, বা সবসময় না। আমার নোটবই থাকতে পারে, কিন্তু আমি বার বার সেগুলো ভুল জায়গায় রাখি এবং বলতে গেলে সেগুলো আর কখনই কোন গঠনমূলক উপায়ে খুলে দেখি না। আমার লেখা সাধারণত শুরু হয় একটি শব্দ, একটি ধারণা, একটি দৃশ্য অথবা এমনকি একটি ঘটনা থেকে যা হঠাৎ আমার ভিতরে অনুরণন সৃষ্টি করে। আমার মনের দৃশ্যপট খুবই জীবন্ত। যে কারণে, লেখা হচ্ছে ছবিকে শব্দে রূপান্তর করার মত। বাস্তবেই আমার লেখা মনের অভ্যন্তরের ছবি দিয়ে ভর্তি, দৃষ্টি-সম্পর্কিত নয় এমন ছবি। কিন্তু কখনই আমি আগে থেকে বলতে পারি না এই ছবিগুলো আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে বা এই প্রক্রিয়ার শেষে আমি ছবিগুলোর আকর্ষণ না হারিয়েই সেগুলোকে যথাযথভাবে শব্দে রুপান্তর করতে পারবো কিনা। এটা বলা যায় একটা স্বজ্ঞাত প্রক্রিয়া। আমার ভূমিকা সবশেষে লেখার কারণও এটা, যেহেতু একবার যখন বইটা লেখা শেষ হয়, যখন সব ছবি সঠিকভাবে সংযোজিত হয়, শুধুমাত্র তখনই আমি বলতে পারি বইটা কি নিয়ে লেখা।

আপনি কি আপনার বাক্যগুলো পুনরায় লেখার পিছনে অনেক সময় দেন?

আমি প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্যাংশ, সেগুলো কিভাবে গঠিত হয়েছে, সেগুলোর ছন্দ এবং সংগীতময়তা(musicality), বিরামচিহ্ন এসবের প্রতি অত্যন্ত সতর্ক। একটা বই শক্তিশালী হওয়ার জন্য, অর্থাৎ যদি তা নিরাময় করতে চায়, তাকে পাঠকের যুক্তি এবং চিন্তা-চেতনার অন্তরজগৎকে স্পর্শ করতে হবে। তাই এটাকে নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে রচনা করতে হবে, সাজাতে হবে এবং উপস্থাপন(curated) করতে হবে। একবার যখন তা যথাযথ পরিমাণ যত্নের সাথে করা হয়ে যায়, আমি আর সেটায় ফিরে যাই না। আমি আসলে কখনই আমার বইগুলো পুনরায় পড়ে দেখি না।

কেন?

কারণ আমি সবসময়ই এই উপলব্ধির ভয়ে থাকি যে ছবিগুলোর শব্দের রূপান্তর ভিন্নরকমভাবে করা যেত এবং এখন বেশি দেরী হয়ে গেছে। এটা ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়ে গেছে এবং এখন তা অনেকটা জনসাধারণের অধিকারভুক্ত। লেখার ব্যাপারে আমার বলতে গেলে একটা অদ্ভুত বোঝাপড়া আছে। লেখা হচ্ছে একটি বিচার প্রক্রিয়ার মত যার বিচারকের সংখ্যা অনেক বেশি। কেউ যদি দন্ডপ্রাপ্ত না হতে চায়, তার লেখা উচিৎ না। কারণ একবার যখন তুমি লিখে তা প্রকাশ করে ফেলেছো, তা ওখানেই শেষ। দরজায় তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। লেখালেখি হচ্ছে নিজের উপর দন্ডাদেশ জারি করা মত।

আপনি ফুটবল খেলে এবং ফুটবল খেলা দেখে একটা উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করেন। এই খেলার মধ্যে কী আছে যা আপনি এতটা উপভোগ করেন?

পুরোটাই আকস্মিকতা এবং সৃষ্টির ব্যাপার, আকস্মিকতার মাঝে সৃষ্টি করা। শরীর গতির মধ্যে থাকা এবং মন একটা সতর্ক অবস্থায় থাকা এই দুইয়ের মাঝে একটা নির্দিষ্ট সম্পর্কের ব্যাপার এটা। ফুটবলের এই দিকটাই আমাকে সবচেয়ে আকৃষ্ট করে, যেভাবে ২২ জন মানুষ একটা জায়গাকে দখল করার চেষ্টা করে, যে জায়গাটা তারা ক্রমাগত বিন্যাসিত এবং পুনর্বিন্যাসিত করে, নির্মাণ করে এবং মুছে ফেলে, এবং সেই আদিম উল্লাসের বিস্ফোরণ যখন কারো দল গোল দেয় বা সেই আদিম চিৎকার যখন কারো দল হেরে যায়। এবং সত্যিকার অর্থেই, আমি যদি অতীতে ফিরে যেতে পারতাম, আমি প্রশ্নাতীতভাবে একজন পেশাদার ফুটবল খেলোয়ারের পেশা অনুসরণ করতাম। আমি আমার ত্রিশের দশকের শুরুর দিকে অবসর নিতাম এবং তারপর অন্যকিছু করতাম।

আপনি যদি একজন জনহিতকর কোটিপতি হতেন, কোন খাতে আপনি বিনিয়োগ করতেন?

টাকাকে আমি সবসময় একজনের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখেছি।

কেন?

আমি কারও বা কোন কিছুর দাস হতে চাই না। এমনকি আমার নিজের আবেগের দাসও হতে চাই না।

টাকাও কি এক ধরনের স্বাধীনতা দেয় না?

আমার যদি এক বিলিয়ন টাকা থাকে, আমি ক্যামেরুনে ফিরে যাব এবং আমার বাবার খামারটা পুনরায় শুরু করবো। সেখানেই আমি আমার তরুণ বয়স কাটিয়েছে, আমি সেখানে ফেরত যাব এবং খামারটিকে একটা সমবায়ে, নতুন ধরনের উৎপাদন ও জীবন-যাপনের জন্য একটা গবেষণাগারে পরিণত করবো। স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে কিভাবে পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করতে হয়, যার শুরু হবে বাতাস, পানি, উদ্ভিদ, খাবার ইত্যাদি দিয়ে, খামারটি তার একটা জীবন্ত বিকল্প। শৈল্পিক উদ্ভাবনের জন্যও খামারটি একটা প্রাণবন্ত স্থান হবে। যে সব লেখকরা এই মহাবিশ্বের সুবিশাল বিস্তীর্ণতার সাথে যোগাযোগ করতে অধীর আগ্রহী, তাদের লেখালেখির জন্য বাসস্থান দিবে এই খামার।

যদি পুনরায় আপনি জন্ম নিতে পারেন এবং একটি যুগ, দেশ, পেশা অথবা কিংবদন্তী বেছে নিতে পারেন, কী বা কাকে আপনি বেছে নিতে চাইবেন?

আমি ইবনে খালদুন হয়ে ফিরে আসতে চাইবো। খালদুন একজন আরব পন্ডিত ছিলেন যিনি প্রায়ই প্রথমদিককার সমাজতাত্ত্বিকদের একজন হিসেবে উল্লিখিত হন। ১৪শ শতকে তিনি মালির সাম্রাজ্য পরিদর্শন করেছিলেন। যদি ফিরে যাই, এই যুগটা আবিষ্কার করতে আমি কৌতূহলী হব। এমন একজন পন্ডিত হতে চাইবো যিনি পৃথিবী ভ্রমণ করে বেড়ান, ট্রায়াংগুলার ট্রেডের আগে আফ্রিকা আবিষ্কার করেন এবং আমরা কি হতে পারতাম তার আগাম আন্দাজ করেন।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *