- ফরিদুল হক
বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসের জঘন্যতম দিন হচ্ছে ৩০শে ডিসেম্বর। ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে যতগুলো জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, সেইসব নির্বাচনের একটি নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দলকে হারানো যায়নি। অন্যদিকে ওই একই সময়ের মধ্যে যতগুলো নির্বাচন নির্দলীয়, নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে; সেইসব নির্বাচনে আগেরবার ক্ষমতায় থাকা দল পুনরায় সরকার গঠন করতে পারেনি।
এগুলো নিছক কোনো কাকতালীয় ব্যাপার ছিলনা। বাংলাদেশের নির্বাচন কেমন হবে সেটা নির্বাচন কমিশনের উপর নির্ভর করেনা। অথচ এদেশের রাজপোষা বুদ্ধিজীবী, কালচারাল গোষ্ঠী ও মিডিয়ার কারণে নির্বাচন কমিশনের ‘নিরপেক্ষ ভূমিকা’ কথাটি বেশ জনপ্রিয়। বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচন কেমন হবে এবং সেই নির্বাচনে কমিশন ‘নিরপেক্ষ’ থাকবে কিনা সেটা পুরোপুরি নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর উপর।
১৯৯১ সালে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রউফ কমিশনের অধীনে আয়োজিত মোটামুটি সর্বমহলে স্বীকৃত ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল। সেই একই রউফ কমিশন পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের অধীনে মাগুরায় ন্যক্কারজনক উপ-নির্বাচন আয়োজন করে। বলা বাহুল্য আয়োজন করতে বাধ্য হয়। সেই মাগুরা উপ-নির্বাচন কুখ্যাতির কারণে বহুদিন ইলেকশন ম্যানিপুলেশনের ‘মাগুরা স্টাইল’ হিশেবে পরিচিত ছিলো।
১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে খালেদা জিয়ার সরকার পুনরায় ক্ষমতায় এসেছিল, কারণ নির্বাচন হয়েছিল তাঁর অধীনে। আবার ১৯৯৬ সালেরই জুন মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পুনরায় নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করেছিল। মাত্র চারমাসের ব্যবধানে দুইরকম ফলাফল। এতেই বোঝা যায়, রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ‘পবিত্র’ সংবিধান প্রদত্ত নিরঙ্কুশ জবাবদিহিতাহীন ক্ষমতা উপভোগ করায়, তিনিই মূলত নির্বাচনের ভাগ্য নির্ধারণ করেন।
সেটা কিভাবে? আরেকটু বিস্তারিত বোঝাপড়া করার চেষ্টা করি…
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার সহ অন্যান্য কমিশনারকে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি একমাত্র প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ বাদ দিলে, বাদবাকি সমস্ত কাজ করেন প্রধানমন্ত্রীর ‘পরামর্শক্রমে’। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই ‘পরামর্শ’ ওহি নাজিলের চেয়েও অমোঘ, নিঃশর্ত। এমনকি প্রধানমন্ত্রী কোন পরামর্শ কীভাবে দিলেন সেটা জানার এখতিয়ারও অসাংবিধানিক।
কারণ সংবিধানের [৪৮ (৩)] এ বলা আছে…
“…প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শদান করিয়াছেন কি না এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবেন না।”
সুতরাং, করদাতা নাগরিক হিসাবে আমাদের জানার সুযোগ নেই প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে কোন বিষয়ে কি পরামর্শ দিচ্ছেন। রাষ্ট্রপতি কি তাঁর সমস্ত দৃঢ়তা, সততা, নৈতিকতার বলে প্রধানমন্ত্রীর ‘পরামর্শ’ উপেক্ষা করে একটা ফেয়ার ইলেকশনের আয়োজনে উদ্যোগী হতে পারবেন?
তিনি সাংবিধানিকভাবেই সেটা করতে পারবেন না। যদি চেষ্টা করেন সেক্ষেত্রে তাঁকে হয় সিএমএইচে ভর্তি হয়ে গলফ খেলতে হবে অথবা সিঙ্গাপুরে যেতে হবে। তখন আমরা সরকারি দলের নেতাদের মুখে মিডিয়ার মাধ্যমে শুনতে থাকবো, “উনি সত্যি সত্যি অসুস্থ। এটা রাজনৈতিক অসুখ নয়।”
কারণ সংবিধানের [৫৩ (১)] এ বলা আছে…
“শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইতে পারিবে; ইহার জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে কথিত অসামর্থ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পীকারের নিকট প্রদান করিতে হইবে।”
সুতরাং, নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ এবং চাকরি সংবিধান অনুযায়ী নির্ভর করে প্রধানমন্ত্রীর সন্তুষ্টির উপরে। তাই কমিশন সাংবিধানিক এখতিয়ারের বাইরে কিছুই করেনা এবং কমিশনের ভূমিকা বরাবরই সম্পূর্ণ সাংবিধানিক। প্রধানমন্ত্রীকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে রেখে, এক-ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা-কাঠামোর অধীনস্থ কোন রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কোন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কাছেই কোন স্বাধীন বা নিরপেক্ষ ভূমিকা প্রত্যাশা করে লাভ নাই। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা সাংবিধানিকভাবেই প্রধান নির্বাহীর অধীন।
এজন্য, যতক্ষণ পর্যন্ত না রাষ্ট্রের এই ক্ষমতা-বিন্যাসে চেক এন্ড ব্যালেন্স আনা যাচ্ছে, সাংবিধানিক একচেটিয়া ক্ষমতার অবসান ঘটানো না যাচ্ছে; যিনিই প্রধানমন্ত্রী, তিনিই আইনসভার প্রধান, তিনিই সরকারি দলেরও প্রধান এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করা যাচ্ছে, আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের সেপারেশন ও পরস্পরের কাছে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে ;
ততক্ষণ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ৩০শে ডিসেম্বরের মতোই অবাধ হবে। সরকারি দল অবাধে ক্ষমতায় আসতে পারবে। সেই নির্বাচনকে ‘সুষ্ঠু’ মনে করে কেউ কেউ চাইলে নিজেদের সু-নাগরিকত্ব ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে পারে। পত্রিকায় পত্রিকায় হাজার হাজার শব্দের প্রবন্ধ লেখা হবে, টিভিতে টিভিতে গণ্ডায় গণ্ডায় টকশো হবে। সরকারি দল ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনকে ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ বলে উদযাপনও করবে কিন্তু কেউ বাধা দিবেনা।