ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা: ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও শহিদ মতিউর

আগে থেকেই চলা গণ-আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছিল জানুয়ারির বিশ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল ছাত্রসমাজ। সাথে যোগ দিল সর্বস্তরের মানুষ। মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে আন্দোলন যে আরো বেগবান হবে, তা তো জানা কথা। তাহলে ওই পুলিশ অফিসারটি ‘খুব কাছ থেকে রিভলবার উঁচিয়ে’ একজন ছাত্রের বুকে গুলি ছুড়ল কেন? এটা কি কোনো আকস্মিক ঘটনা বা অন্তর্ঘাতমূলক কাজ? গণ-আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে, এ ধরনের ঘটনা আকস্মিকভাবে ঘটে না। আন্দোলনের চাপই প্রতিপক্ষের হিসাব গুলিয়ে দেয়। তারা এমন উদ্যোগ নিতে বাধ্য হয় যা আখেরে আন্দোলনের পক্ষেই সঞ্চয় হিসাবে কাজ করে। যদি আন্দোলনে জনসমর্থন থাকে, যদি দশের আকাঙ্ক্ষা আর মতি আন্দোলনের সাথে একাকার হয়, তাহলে এরকমই ঘটার কথা। আসাদ ওই আন্দোলনের সক্রিয় ‘কর্তাপক্ষ’ ছিলেন। মৃত্যুর সম্ভাবনার মধ্যেই ছিলেন। যেমন ছিল আরো অনেকে। মৃত্যু তাঁকে পরিণত করল আন্দোলনের প্রতীকে। সহসা তিনি হয়ে উঠলেন বিশেষ। মৃত্যু তাঁকে আলাদা করে দিল।

মতিউরের বাবা সাক্ষ্য দিচ্ছেন, মতিউর বিশ জানুয়ারি ঘটনাস্থলে ছিলেন। দূর থেকে এ হত্যাকাণ্ড তিনি দেখেছেন। বাসায় গিয়ে ঘটনার বিবরণও দিয়েছেন। শহিদ আসাদের জানাজা আর মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। আর, তাঁর বাবার ভাষ্য-মোতাবেক, সেদিনই বইপুস্তক বেঁধে ড্রয়ারে তালাচাবি দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, লেখাপড়া আর নয়। এখন অন্য কাজের সময়। এ ধরনের ক্ষেত্রে অন্য বাবা-মা যা করেন, মতিউরের বাবা-মাও তা-ই করেছিলেন। ছেলেকে চোখে চোখে রাখছিলেন। কিন্তু যে নিজের কাজ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে আর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে তো আটকে রাখা সম্ভব নয়। চব্বিশ জানুয়ারি মতিউর ঠিকই যোগ দিয়েছে ক্রমশ অগ্নিকুণ্ড হয়ে ওঠা সেই মিছিলে। তারপর আর ফেরেনি।

তৎকালীন আজাদ পত্রিকায় গণঅভ্যুত্থান নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষ। (প্রাপ্তি: বিবিস বাংলা)

চব্বিশ জানুয়ারি ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকা হরতাল। পুরো ঢাকা শহর ছিল মিছিল আর বিক্ষোভের নগরী। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আন্দোলন চলছিল। কিন্তু যে কোনো গণ-আন্দোলন তুঙ্গ মুহূর্তে সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন কাঠামো ভেঙে পড়ে। নেতৃবৃন্দের নিয়ন্ত্রণ টুটে যায়। ওইদিনও তা-ই হয়েছিল। স্বতঃস্ফূর্ত জনতা মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন দিল। সরকার-দলীয় নেতাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিল। পুড়িয়ে ছাই করে দিল সরকারি বার্তাবাহক পত্রিকার অফিস। পুলিশও হয়ে উঠেছিল বেপরোয়া। যত্রতত্র গুলি চলছিল। সেই গুলিতেই নিহত হলেন মতিউর। মতিউরদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণেই গণ-আন্দোলন জোরদার হচ্ছিল। আর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সেই আন্দোলন রূপ নিল গণ-অভ্যুত্থানের। চব্বিশ জানুয়ারির সেই গণ-অভ্যুত্থানের প্রতীকী প্রতিনিধি হয়ে উঠলেন মতিউর।

কিন্তু মতিউর কেন? ইতিহাস বলছে, সেদিন মতিউর ছাড়াও নিহত হয়েছিলেন মকবুল, রুস্তমসহ আরো কেউ কেউ। রুস্তমের বাবা জানাচ্ছেন, তাঁকে খবর দেয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, গুরুতর আহত মতিউরকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তিনি সেখানে গিয়ে রুস্তম, মকবুল ও আলমগীরের লাশ দেখলেন। কিন্তু মতিউরকে পেলেন না। মতিউরের লাশ তখন পল্টন হয়ে শহিদ মিনার হয়ে চলে গেছে জহুরুল হক হলে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জিম্মায়। কেন কেবল মতিউরের লাশ আনা হল, তার তাৎক্ষণিক নানা কার্যকারণ থাকতে পারে। সেগুলো হয়ত ঠিকমতো আর কখনোই জানা যাবে না। কিন্তু কিছু অনুমান করা যেতে পারে, ইতিহাস-পাঠের দিক থেকে যেগুলোর হয়ত বিশেষ মূল্য আছে। কম বয়স সম্ভবত মূল কারণ নয়। কারণ, ওইদিন মৃত আরো কেউ কেউ কম বয়সী ছিলেন। তবে মতিউর যে ছাত্র ছিলেন, সে তথ্য সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ।

তখনকার বাংলাদেশে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর বিকাশের সেই অপরিণত অবস্থায়, ছাত্র বর্গটির বিশেষ মূল্য ছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ‘ছাত্রের মৃত্যু’ বর্গটি বিশেষভাবে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছিল। ঊনসত্তরেও ‘কিছুদিনের জন্য হলেও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। নবকুমার ইনস্টিটিউশনের ছাত্র হিসাবে মতিউর হয়ত বাড়তি মনোযোগ পেয়ে থাকবেন। এর মধ্যে অবশ্য এক ধরনের শ্রেণি-পক্ষপাতের ব্যাপার আছে। জাতীয়তাবাদী বয়ান শ্রেণিবৈশিষ্ট্যের ব্যাপারগুলো সাধারণত রেখে-ঢেকে রাখে। মতাদর্শিক আবেগের প্রাবল্যে শ্রেণি-পার্থক্যের দিকটা অংশত চাপা পড়ে যায়। কিন্তু পক্ষপাতের ব্যাপার যে জোরালোভাবে থাকেই, তার ঘোরতর প্রমাণ মেলে খোদ ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের বিবরণীতে। এ সংগ্রামে বিপুল পরিমাণ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই শ্রমিক ও গতরখাটা মানুষ। কিন্তু আমরা গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করি সাকুল্যে যে কয়জনের মৃত্যু, হয়ত কাকতালীয় নয়, তাঁদের সবাই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত স্তরের অংশ। ক্ষমতাসীনদের শ্রেণি-সহানুভূতি এর প্রধান কারণ। অন্য জোরালো কারণও আছে। কৃষক আর শ্রমিক শ্রেণি হিসাবে নিজের সন্তানদের ভবিষ্যৎ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতেই দেখতে পায়। ছাত্রত্বই মূলত এই দুই শ্রেণির সংযোগস্থল। তাই ছাত্রদের ব্যাপারে ওই শ্রেণির একটা সহমর্মিতা থাকাই স্বাভাবিক।   

শহিদ মতিউর রহমান (২৪ জানুয়ারি ১৯৫৩ – ২৪ জানুয়ারি, ১৯৬৯)

মতিউরের ক্ষেত্রে অবশ্য আক্ষরিক অর্থেই অন্য বাস্তবতা ছিল। তখনকার বহু মিছিলে মতিউর ছিলেন সামনের সারিতে। নেতৃবৃন্দের কারো কারো সাথে যে তাঁর অল্পবিস্তর জানাশোনা ছিল, তারও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এই বাস্তবতা যদি তাঁর মৃত্যুকে অধিকতর আবেগাকুল করে তুলে থাকে, অবাক হওয়ার কিছু নাই। এভাবেই হয়ত তিনি সেদিনের অবিশ্বাস্য অভ্যুত্থানের নায়ক হয়ে উঠেছিলেন। তাঁকে শেষ আনুকূল্য জুগিয়েছিলেন তাঁর বাবা। তৎকালীন ইকবাল হলে সমবেত হাজারো ছাত্রজনতার সামনে তিনি বলেছিলেন, ‘মতিউরের শাহাদাতবরণে আমি গর্বিত। গর্বিত এ-কারণে যে, সে এদেশের স্বাধিকার ও মুক্তির চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের অমূল্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে। আমি দেখতে পাচ্ছি হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আমার চোখের সামনে। এক মতিউরকে হারিয়ে আমি হাজার মতিউরকে পেয়েছি! সেইদিন বেশি দূরে নয় যখন এদেশের ছাত্রসমাজই এই দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবে।’ মতিউরের পিতা আজহার আলী মল্লিকের জন্য, অনুমান করা যায়, সময়টা বক্তৃতার উপযোগী ছিল না। ছাত্রনেতাদের কেউ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেও থাকতে পারেন। হয়ত তিনি কথাগুলো ঠিক এভাবে বলেননি। কিন্তু উপস্থিত শ্রোতাদের সাক্ষ্য থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, তিনি মোটের উপর এই কথাগুলোই বলেছেন। বলতেই হয়, সম্ভাব্য সবচেয়ে জরুরি কথাগুলো তিনি উচ্চারণ করেছিলেন। সময়ের প্রচ- চাপই তাঁকে দিয়ে কথাগুলো বলিয়ে নিয়েছিল। এই সময়ই গড়ে তুলেছিল একজন মতিউর রহমান মল্লিককে।

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে মতিউরের জীবনীগ্রন্থ কিশোর শহীদ মতিউর রহমান। আখতার হুসেন প্রণীত বইটি বেশ পরিকল্পিত। অন্য জীবনীগ্রন্থগুলোর সাথে এর একটা প্রকট পার্থক্য আছে। সাধারণভাবে জীবনীগ্রন্থে ব্যক্তির বিবৃতি যতটা প্রাধান্য পায়, এ বইতে ততটা নাই। একজন কিশোরের জীবনের কী তাৎপর্যের কথাই বা পাঠকের জানার আর লেখকের জানানোর থাকতে পারে? স্বভাবতই লেখক প্রাধান্য দিয়েছেন ওই সময়কে। আঁকতে চেয়েছেন মুহূর্তটিকে, যার মধ্যেই কেবল কিশোর মতিউর বিশেষভাবে মূর্ত হয়ে বসতে পারেন চালকের আসনে। লেখক ঠিক কাজটিই করেছেন। জীবনীগ্রন্থে ব্যক্তি অযাচিতভাবে প্রাধান্য পায়। ব্যক্তির কোনো বিশেষ মুহূর্তের কাজ বা অবদান বিচার করার সময় আমরা সাধারণত ব্যক্তিজীবনের পূর্ব-ইতিহাসের খবর নিই। বুঝতে চাই, কোন কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে ব্যক্তি ওই বিশেষ অবদান রাখতে পারল। এ ক্ষেত্রে অবজেক্টিভ কনডিশন বা পরিস্থিতিকে আমরা সাধারণত কম মূল্য দিই। ব্যক্তি সম্পর্কে এ এক প্রভাবশালী মিথ বা কুসংস্কার। ব্যক্তি সময়ের বিচিত্র প্রভাব আর চাহিদা থেকে অতটা মুক্ত কোনো অস্তিত্ব নয়। বলা যায়, তার কর্তাসত্তা আসলে সামষ্টিক কর্তাসত্তার অংশ হিসাবেই কাজ করে। ব্যক্তির মধ্যে কখনো কখনো ইতিহাসের চাহিদা বা দায় বিশেষভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। মতিউরের জীবনী এ সত্য আমাদের বিশেষভাবে বুঝতে দেয়। নিতান্ত কিশোর বয়সে মারা গিয়েছিলেন বলেই ব্যক্তিজীবন-ভজনার প্রচলিত রেওয়াজ থেকে তিনি অনেকটা মুক্ত থেকেছেন। আমাদের বুঝতে দিয়েছেন, অন্য জীবনীগুলোতেও সময়ের-সমষ্টির অংশ আসলে যতটা লেখা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি।

কিন্তু এ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে ব্যক্তি মতিউর হাওয়া হয়ে যান না। তাঁর নিজের প্রস্তুতিও উল্লেখ করার মতো। প্রস্তুতিটা তিনি নিয়েছিলেন সময়ের আহবানে সাড়া দিতে গিয়ে। সিদ্ধান্তটা নিজেকেই নিতে হয়েছিল। নিজেকে বদলাতে হয়েছিল। তাঁর পারিবারিক সূত্র বলছে, মতিউর মনোযোগী আর নিয়মিত ছাত্র ছিলেন। অকারণে বাসা থেকে বের হতেন না। মতিউরকে কিছুটা চিনতেন এমন একজন রাজনীতিক জানাচ্ছেন, পোস্টার লাগাতে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর অনীহা ছিল। প্রথম প্রথম মিছিলে যাওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি সংকোচ বোধ করতেন। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দ্রুত তাঁর সিদ্ধান্তের বদল হয়। তিনি হয়ে ওঠেন মিছিলের সামনের সারির লড়াকু সৈনিক।

গণঅভ্যুত্থান নিয়ে আজাদ পত্রিকার প্রতিবেদন। (প্রাপ্তি: বিবিসি বাংলা)

এ পরিবর্তনটাকে পুরোপুরি নাটকীয় পরিবর্তন বলা যাবে না। বেশ বোঝা যায়, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আর তৎপরতার সাথে তাঁর এক ধরনের সংযোগ ছিল। তা না হলে মিছিলে যাওয়া বা পোস্টার লাগানোর কথা উঠত না। এলাকায় রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল। বিশেষভাবে ছিল স্কুলে। তাঁর এক সহপাঠী জানাচ্ছেন, নবকুমার ইনস্টিটিউশনের ছাত্ররা তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে নিয়মিত যোগ দিতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রায়ই স্কুল-প্রাঙ্গণে উত্তপ্ত বক্তৃতা দিতেন, আর বক্তৃতার পর ছাত্ররা প্রায়ই ক্লাস বর্জন করে রাজপথে স্লোগান দিতে দিতে শহর পরিক্রমণ করতেন। মতিউর নিঃসন্দেহে এ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নিতে হয়েছে নিজেকেই। মৃত্যুর পর তাঁর পকেটে যে চিরকুট পাওয়া গেছে তাতে লেখা ছিল, ‘প্রত্যেক মানুষকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে। … আজ হোক কাল হোক একদিন যেতে হবে।’ অকুতোভয় কিশোরের এ এক বিস্ময়কর উপলব্ধি। যদি এ চিরকুট না-ও পাওয়া যেত, তবু আমাদের বুঝতে মোটেই অসুবিধা হত না যে, তিনি প্রয়োজনে জীবনদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তা না হলে কেউ ওরকম পরিস্থিতিতে মিছিলের অগ্রসৈনিক হিসাবে আবির্ভূত হয় না। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মতিউর নিজের স্বাধীন সিদ্ধান্ত আর সক্রিয় কর্তসত্তার ঘোষণা দিয়ে গেলেন চিরদিনের জন্য।

ইতিহাসের নায়ক হিসাবে মতিউর খোদ ইতিহাসপাঠেরই দিক-নির্দেশনা দেন। তিনি আমাদের গণ-আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান আর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ব্যাপারে সচেতন করেন। কোন পরিস্থিতি বিপুল মানুষের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে বড় পরিবর্তনকে সম্ভবপর করে তোলে, সে দিকে নজর ফেরাতে উৎসাহিত করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রভাবশালী বয়ানগুলোতে প্রায়ই লেখা হয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আপামর জনতার বিপুল অংশগ্রহণ ছিল। জাতীয়তাবাদী আবেগের ভিত্তিতেই সাধারণত এ বাস্তবতা ব্যাখ্যা করা হয়। এ ব্যাখ্যা সন্তোষজনকও নয়, পর্যাপ্তও নয়। মহাশ্বেতা দেবী একবার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাস পড়তে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ইলিয়াসের উপন্যাসে তিনি সেই আমজনতার সাক্ষাৎ পেয়েছেন, যাঁরা একাত্তরের বিজয়কে সম্ভবপর করেছিল। এ মন্তব্য নিগূঢ়ভাবে সারবান। রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই কেবল সাধারণ মানুষকে লড়াকু সৈনিকে বদলে দিতে পারে। ঊনসত্তরের বাংলাদেশ সেই সোনালি সময় উদযাপন করেছে। চেনা মানুষগুলো অচেনা হয়ে সম্ভবপর করেছে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সফল মুহূর্ত। কিশোর শহিদ মতিউর সেই প্রক্রিয়ারই ফসল, আবার একই সাথে সে প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান নির্মাতা।         

  • [প্রথম প্রকাশ: প্রথম আলো, ৪ নভেম্বর, ২০১৬। একাডেমিয়াতেও প্রবন্ধটির হদিস পাওয়া যাবে।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *