প্যালেস্টাইন প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথোপকথন

  • মার্টিন বুবার; অনুবাদ : অরিত্র আহমেদ

[অনুবাদকের ভূমিকা :

প্যালেস্টাইন প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান বিষয়ে বাঙলাদেশে এর আগেও অল্পবিস্তর আলোচনা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, করুণাময় গোস্বামীর ‘রবীন্দ্রনাথের প্যালেস্টাইন ভাবনা ও অন্যান্য’ এবং শফিকুর রহমান চৌধুরী ও মোহাম্মদ জমির কর্তৃক লিখিত ‘রবীন্দ্রনাথ ও প্যালেস্টাইন’ নামক দু’টি বইয়ের কথা বলা যায়। এরপরও অবশ্য রবীন্দ্রনাথ যে প্যালেস্টাইন, ইহুদি ও ইহুদিবাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়েছিলেন এবং বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়েই তিনি যে প্যালেস্টাইন প্রশ্নে অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন, তা অধিকাংশ বাঙালিরই অজানা। এর একটা কারণ হয়তো এই যে, প্যালেস্টাইন প্রশ্নের উপর রবীন্দ্রনাথ কোনো বই বা নিবন্ধ লিখে যাননি। তৎকালীন জায়োনিস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব এবং কতিপয় বরেণ্য ইহুদিকে লেখা তাঁর চিঠিপত্র, এবং বিশেষ করে, তাঁর কয়েকটি সাক্ষাৎকার থেকে আমরা প্যালেস্টাইন ও ইহুদিবাদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে তাঁর গভীর ভাবনার পরিচয় পাই।

এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত দলিলটি হচ্ছে ১৯৩০ সালে The Jewish Standard পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের একটি সাক্ষাৎকার। অনতিদীর্ঘ সেই সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন জায়োনিস্ট আন্দোলনের বিপথগামিতার ব্যাপারটি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন প্রশ্নটি যে চরম মারণ ও সংঘাতময় রূপ নিয়েছে, বিশ বা ত্রিশের দশকে অন্তত সেই ধরনের সর্বাত্মক সংঘাতের তেমন কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। তবু বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ এবং আদর্শিক মতবিরোধের সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন যে, যে রাজনৈতিক আপাত-সমাধানের জন্য জায়োনিস্ট নেতৃবৃন্দ ব্যকুল হয়ে পড়েছেন, সেই সমাধান আসলে কোনো সমাধানই নয়, বরং সেই সমাধানই ডেকে আনবে উত্তরোত্তর রক্তপাত ও অস্থিরতা, এবং তার ভুক্তভোগী হবে ইহুদি এবং আরব উভয় পক্ষই। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, রবীন্দ্রনাথ ইহুদিদের অস্তিত্বের সংকটের ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করেছিলেন। বিপরীতটাই বরং সত্য। বহু ইহুদি ব্যক্তিত্বের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সুসম্পর্ক ছিলো, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫), উইলিয়াম রটেনস্টাইন (১৮৭২-১৯৪৫), সিলভাইন লেভি (১৮৬৩-১৯৩৫), স্টেলা ক্রামরিচ (১৮৯৬-১৯৯৩), শ্লোমিৎ ফ্রিডা ফ্রাউম (১৮৯৩-১৯৬৩), অ্যালেক্স অ্যারনসন (১৯১২-১৯৯৫), মরিস উইন্টারনিৎস (১৮৬৩-১৯৩৭) প্রমুখ তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। আবার মহাত্মা গান্ধী কিংবা জওহরলাল নেহেরুর মতো নেতারা আরব ভূমিতে ইহুদিদের অভিবাসন প্রকল্পকে সমর্থন না করলেও রবীন্দ্রনাথ তা করেছিলেন। আলোচ্য সাক্ষাৎকার তো বটেই, এর বাইরেও প্যালেস্টাইনের ইহুদি নারী পর্যটক শ্লোমিৎ ফ্রাউম কিংবা সংস্কৃতের অধ্যাপক ড. ইমানুয়েল ওলসফ্যাঙ্গারকে বিভিন্ন সময়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র পড়লে ইহুদি জনগণের প্রতি তাঁর সম্মান ও মমতার ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হই। এমনকি একটি জায়োনিস্ট সংগঠনকে কিবুৎসকিমের (কৃষিভিত্তিক ইহুদি বসতি-প্রকল্প) অনুকরণে শ্রীনিকেতনে ছোটো ছোটো খামারবাড়ি গড়ে তোলার আমন্ত্রণ পর্যন্ত জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই তথ্যগুলো মাথায় রাখলে আমরা হয়তো তেমন অবাক হবো না, যখন শুনবো, রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিরক্ষার্থে তেলআবিবে একটি রাস্তাই রয়েছে ‘ট্যাগোর স্ট্রিট’ নামে।

রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন ইহুদিদের পুনর্বাসন এবং আরবদের সঙ্গে তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। কিন্তু সেটা যে ইসরায়েল নামক স্বতন্ত্র কোনো জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সম্ভব নয়, সে ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, আদি-জায়োনিস্টদের অনেকেই অহিংস ও মৈত্রীভিত্তিক একটি ইহুদি রাষ্ট্রের কথা ভাবতেন। মার্টিন বুবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথোপকথনেও আমরা সেটা দেখতে পাই। তাদের সেই ভাবনা সৎ ও আন্তরিক ছিলো কিনা, আজ এই একুশ শতকের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সেই প্রশ্ন করতেই পারি। তবে এখানে যেটা বিবেচ্য বিষয়, সেটা হচ্ছে, জায়োনিজম এবং জায়োনিস্টদের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সহানুভূতি ছিলো, এবং ইহুদি জাতির সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তিনি সম্মান করতেন। কিন্তু জায়োনিজম যখন থেকে পশ্চিমা জাতীয়তাবাদেরই একটা প্রকরণ হয়ে উঠতে থাকলো, তখনই রবীন্দ্রনাথ বাদ সাধলেন। রবীন্দ্রনাথ চাইতেন ইহুদিরা হবে যুগপৎ ইহুদি ও প্যালেস্টাইনের নাগরিক, এবং স্বপ্ন দেখতেন এক কমনওয়েলথ অফ প্যালেস্টাইনের, যেখানে ইহুদি এবং আরবরা একত্রে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। অন্ধ জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক চুক্তির দুর্বল ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কোনো বিচ্ছিন্ন ইহুদি রাষ্ট্র নয়, বরং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মৈত্রীর শক্ত ভিতের উপর দাঁড়ানো এক কমনওয়েলথই পারে আরবে ইহুদিদের স্থায়ী ও প্রকৃত পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে- এই ছিলো রবীন্দ্রনাথের ধারণা। জায়োনিস্টদের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিপরীতে তিনি কামনা করেছিলেন বিশ শতকের বিখ্যাততম ইহুদি আইনস্টাইনের উদার বিশ্বনাগরিকতা। The Jewish Standard পত্রিকায় প্রকাশিত সেই বিখ্যাত সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, If the Zionist leadership will insist on separating Jewish political and economic interests in Palestine from those of the Arabs, ugly eruptions will occur in the Holy Land. বলাই বাহুল্য, গত ষাট-সত্তর বছরের ইতিহাস এই ugly eruptions-এরই ইতিহাস। পশ্চিমা জাতীয়তাবাদ এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রের জোরে গড়ে ওঠা জায়োনিস্ট ইসরায়েল রাষ্ট্র এখন সন্ত্রাস ব্যতীত অন্য কোনো আদর্শের ধার ধারে না। ইসরায়েল এখন মধ্যপ্রাচ্যে ক্রিয়াশীল এক সশস্ত্র পশ্চিমা প্রকল্প ছাড়া কিছুই নয়, এবং ইহুদিদের প্রকৃত পুনর্বাসনের বদলে ইসরায়েল হয়ে উঠেছে বিশ্বজনীন ইহুদিবিদ্বেষের এক বড়ো কারণ। রবীন্দ্রনাথ এ যুগে বেঁচে থাকলে অবশ্য এ ব্যাপারেও মুখ খুলতেন। বিশ্বজুড়ে ইসরায়েল-বিরোধিতা যে আজ অনেক ক্ষেত্রেই অন্ধ ও অবান্তর ইহুদিবিদ্বেষে পরিণত হচ্ছে- এ-ও এক ঘোরতর বিপদেরই পূর্বাভাস মাত্র। উগ্র জায়োনিস্টরা আজ হলোকাস্টের দোহাই দিয়ে গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে। আমরা কামনা করবো, এমন দিন যেনো কখনো না আসে, যেদিন গাজার গণহত্যার দোহাই দিয়েই আবার পাইকারি হারে ইহুদি-নিধন শুরু হবে। কোনো গণহত্যাই উদযাপনীয় নয়, শ্রেয় নয়, নায্য নয়। সমাধান তো নয়ই। এক শভিনিজমের প্রতিকার কখনোই আরেক শভিনিজম দিয়ে করা যায় না।

এতক্ষণ যে সাক্ষাৎকারের কথা আমরা আলোচনা করলাম, সেটা ১৯৩০ সালের। বাঙলায় তার অনুবাদ হয়েছে, এবং বিভিন্ন সময়ে তা নিয়ে দেশে-বিদেশে বিস্তর আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু মার্টিন বুবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে কথোপকথনের অনুবাদ আমরা পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করতে যাচ্ছি, সেই কথোপকথন ঘটে আরো চার বছর আগে, ১৯২৬ সালে। আমরা এই ক্ষুদ্র কথোপকথনের সন্ধান পেয়েছি রুথ নান্ডা আনশেন কর্তৃক পরিকল্পিত ও সম্পাদিত, এবং ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত, A Believing Humanism: Gleanings of Martin Buber নামক পুস্তকে। তবে মূল লেখাটি প্রকাশিত হয় ১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসে,  Ein Gespräch mit Tagore শিরোনামে, India and Israel জার্নালে। বাঙলা ভাষাভাষীদের নিকট মার্টিন বুবার (১৮৭৮-১৯৬৫) সুপরিচিত কোনো নাম নন। জন্মসূত্রে অস্ট্রিয়ান, এবং পরবর্তীকালে ইসরায়েলের নাগরিক, এই ইহুদি দার্শনিকের মূল খ্যাতি বিশ শতকের অস্তিত্ববাদী দর্শনের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে। তাঁর বিখ্যাত রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, I and Thou, Between Man and Man, Tales of Hasidism, A Land of Two People, The Way of Man, প্রভৃতি। ছাত্রাবস্থা থেকেই বুবার জায়োনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন, এবং সেই সূত্রেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর এই কথোপকথন। গবেষক অভীক রায় একটি নিবন্ধে আমাদেরকে জানাচ্ছেন যে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বুবারের প্রথম দেখা হয় ১৯২১ সালে, জার্মানির ডার্মস্ট্যাট শহরে। রবীন্দ্রনাথের এক পাবলিক লেকচারে উপস্থিত হয়েছিলেন বুবার, এবং মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁর বক্তব্যে ও ব্যক্তিত্বে। এরপর আর মাত্র দু’বার, অর্থাৎ মোট তিন বার, দেখা হয় তাঁদের। জিউয়িশ টেলিগ্রাফিক এজেন্সি কর্তৃক ১৯২৬ সালের ২০ জুন প্রচারিত এক বুলেটিন থেকে  ১৯২৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ প্যালেস্টাইনে যেতে চেয়েছিলেন সেখানকার ইহুদি অভিবাসন প্রকল্প সরেজমিনে পরিদর্শন করার জন্য। ওই একই এজেন্সি থেকে ১৩ জুলাই, অর্থাৎ মাসখানেক পরে প্রচারিত এক বুলেটিনে আমরা দেখি স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভিয়েনায় পৌঁছেছেন, এবং হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন (শেষ পর্যন্ত কোনো অজানা কারণে রবীন্দ্রনাথ সেবার আর প্যালেস্টাইন যাননি, এবং আর কখনোই তাঁর প্যালেস্টাইনে যাওয়া হয়নি) । এরই মধ্যে জার্মানির ডুসেলডর্ফে মার্টিন বুবারের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। তার কিছুকাল পরে, ১৯২৬ সালেই, রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে মার্টিন বুবার প্রাগে পুনরায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, এবং পঁচিশ বছর পরে বুবার সেই সাক্ষাতে ঘটে যাওয়া কথোপকথনেরই স্মৃতিচারণ করেন তাঁর এই ক্ষুদ্র, স্বল্পখ্যাত রচনায়।

ভূমিকাটা বড়ো হয়ে গেলো। তবে এই কথোপকথন পড়ার আগে রবীন্দ্রনাথের প্যালেস্টাইন-ভাবনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলে অনেক পাঠকের পক্ষেই রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য সম্পর্কে অস্পষ্টতা রয়ে যাবে- এমন আশঙ্কা থেকেই এই প্রয়াস নেওয়া হলো। আজ এই ভূমিকা যখন লিখছি, ঠিক তখনই হয়তো প্যালেস্টাইনে অগণিত শিশু নিহত হচ্ছে ইসরায়েল রাষ্ট্রের হাতে। গত ক’ মাসে নিহতের সংখ্যা সাইত্রিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথকে মার্টিন বুবার বলেছিলেন যে ইহুদিরা হচ্ছে আধুনিক মানব-পরিস্থিতির নগ্নতম প্রকাশ। আজ ভিন্ন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে, ইহুদিদেরকে নয়, বরং প্যালেস্টাইনকেই আমরা বলতে চাই আধুনিক মানব-পরিস্থিতির নগ্নতম প্রকাশ। অবশ্য এটা এক দিনে হয়নি। জিল দেল্যুজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ইলিয়াস সানবার প্যালেস্টিনীয়দেরকে তুলনা করেছিলেন আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে, যাদের বিলুপ্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের আমেরিকা। তিনি আরো বলেছিলেন, ইসরায়েলের প্রধান রাজনীতি আসলে হত্যা ও নিপীড়ন নয়। সেই রাজনীতির শুরুই হয় প্যালেস্টাইনের জনগণের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করার মাধ্যমে। ইসরায়েল নিছক শোষণ করে না, সে একটা জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে মুছে ফেলে। বিস্ময়কর নয় যে, আমেরিকাই (অর্থাৎ, পশ্চিমা শক্তি) আজ ইসরায়েলের সবচেয়ে বড়ো মিত্র, যেহেতু উভয়ের জন্মের গল্প আসলে মোটা দাগে একই। আজ ভাবলে অবাক হতে হয় যে, ১৯৩০ সালে নয়, বরং তারও আগে, ১৯২৬ সালেই রবীন্দ্রনাথ ইহুদিবাদের এই পরিণতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এবং প্যালেস্টাইন-প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ যে অবস্থান নিয়েছিলেন, তার প্রাসঙ্গিকতা আজও, অর্থাৎ প্রায় একশো বছর পরও, ফুরিয়ে যায়নি।]

Jerusalem – pictured in 1870 – is one of the oldest cities of the world

মূল অনুবাদ : প্যালেস্টাইন প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথোপকথন

আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে প্যালেস্টাইনে ইহুদি অভিবাসন এবং জায়োনিজমের ব্যাপারে আলোচনার লক্ষ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎ ঘটেছিলো প্রাগে, সংস্কৃতের অধ্যাপক মরিস উইন্টারনিৎজের বাসায়।

সেদিন আমাদের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছিলো, তার কোনো নোট আমি রাখিনি। তবু স্মৃতির সাহায্য নিয়ে পঁচিশ বছর আগের সেই আলোচনার মূল বিষয়বস্তুর একটা রূপরেখা এখানে দেওয়া যেতে পারে।

ইহুদি জনগণ তাদের জাতীয় স্বাধীনতা ফিরে পেলে সেটা তাদের চরিত্রের উপর একটা অশুভ প্রভাব ফেলবে, রবীন্দ্রনাথ এমন আশঙ্কা প্রকাশ করলেন । ইহুদিদের সবচেয়ে সুন্দর গুণ যেটা, এবং মানবজাতির পক্ষে যার প্রয়োজনীয়তা অসীম, সেই আত্মিক শক্তির আরাধনা এবং বিশ্বজনীনতাকে  এই জাতীয় স্বাধীনতা ম্রিয়মাণ করে ফেলবে। ইহুদিরা এতো কাল বিভিন্ন মানবসম্প্রদায়ের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলো, কিন্তু পারিপার্শ্বিক প্রভাব তাদেরকে যতো বিপদাপন্নই করুক না কেনো, আদিকাল থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই আত্মিক শক্তির আরাধনা ও বিশ্বজনীনতার বিশেষ গুণই ইহুদিদেরকে সবসময় রক্ষা করে এসেছে। কিন্তু জাতীয় আত্মপ্রতিষ্ঠার ফাঁদে পা দেওয়ার ফলে এখন প্যালেস্টাইন নামক জটিলতম ভূরাজনৈতিক অবস্থানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে টিকে থাকার জন্য তারা পশ্চিমা জাতিগুলির সংকীর্ণচেতা জাতীয়তাবাদ এবং প্রাণহীন, সর্বাত্মক-প্রযুক্তিবাদেরই (pantechnicism) একনিষ্ঠ অংশীদার হয়ে উঠবে।

উত্তরে আমি বললাম যে, যে বিপদের আশঙ্কা তিনি করছেন, আসলেই তার অস্তিত্ব আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাওয়া আমাদের উচিত হবে না। ব্যক্তির জীবনে যেমনটা আমরা দেখে থাকি, তেমনি একটা সম্প্রদায়ের জীবনেও এমন একটা পর্যায় আসে, যখন সে কিছু দরকারি বিপদের সম্মুখীন হয়; দরকারি এই কারণে যে, সরাসরি আক্রমণ করার মাধ্যমে ওই বিপদগুলোকে জয় করে নিয়েই তখন ওই সম্প্রদায়কে এগিয়ে যেতে হয়। আর ওই অনিবার্য ঐতিহাসিক মুহূর্তে যদি কোনো সম্প্রদায় বিপদ দেখে পলায়ন করে, তো সে তার সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে, হয়ে পড়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, এবং এক পর্যায়ে, বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে যেটা আবশ্যক, সেটা হলো সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ওই বিপদের মোকাবেলা করা: কারণ, তখন ওই বিপদের হয় কোনো অস্তিত্বই থাকবে না, নয়তো আমরা আমাদের সর্ব শক্তি একত্র করে ওই বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাবো এবং একদিন তাকে জয় করে ছাড়বো।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বর্তমানে ইহুদি সম্প্রদায়ের করণীয় হচ্ছে দু’টি জিনিস: এক. বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত ঐশ্বর্য, অর্থাৎ আত্মিক শক্তির আরাধনা এবং বিশ্বজনীনতা দিয়ে জায়োনিজমকে পূর্ণ করে তোলা, এবং জায়োনিজমের অন্তর্গত বিপদগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ করে তোলা; এবং দুই. বিভিন্ন প্রাচ্য (Orient) সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমঝোতায় এসে, হ্যাঁ, তাদেরকে সঙ্গে নিয়েই, প্যালেস্টাইনে বসতি-স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করা, যেনো পারষ্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এমন একটা মহৎ, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো দাঁড় করানো যায়, যার মাধ্যমে তারা পশ্চিমা সভ্যতার অন্তর্গত বিশৃঙ্খলা এবং উদ্দেশ্যহীনতা থেকে মুক্ত থেকেও পশ্চিমের কাছ থেকে যা কিছু নেওয়ার মতো, অর্থাৎ বিভিন্ন ইতিবাচক লক্ষ্য ও উপায়ের শিক্ষা নিতে পারবে ও সেগুলো প্রয়োগ করতে পারবে।

এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকটা একমত হয়ে রবীন্দ্রনাথ মাথা নাড়লেন, কিন্তু পাল্টা যুক্তি দিলেন যে, দিনকে দিন তার অবক্ষয় স্পষ্ট হয়ে উঠলেও পশ্চিমা সভ্যতা এখনো এতোটাই শক্তিশালী যে একই সঙ্গে তাকে গ্রহণ করা এবং তার ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে মুক্ত থাকা আসলে অসম্ভব। আমাদের উচিত পশ্চিমের যান্ত্রিকতা ও অনুশাসনের বিপরীতে মানবীয় সত্তার প্রাচ্য মন্ত্র, অর্থাৎ বিশুদ্ধ ধ্যানকে আঁকড়ে ধরা। আমাদের উচিত পশ্চিমকে তার যাবতীয় ঠেলাঠেলি-হানাহানির নিরর্থকতা ও অন্তঃসারশূন্যতাটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, এবং পূর্বকে সঙ্গে নিয়েই, চিরন্তন সত্যের দর্শনে নিমগ্ন হতে বলা।

আমি প্রতিবাদ করলাম। তাঁকে বললাম যে তাঁর উচিত এমন একটা মানুষকে কল্পনা করা, যে তার পিঠে ভারী একটা পতাকা নিয়ে একটা পর্বতে আরোহণ করছে পর্বত-চূড়ায় পতাকাটি স্থাপন করার লক্ষ্যে। এমতাবস্থায় মাঝপথে কেউ লোকটাকে দেখতে পেলো এবং লোকটার নির্বুদ্ধিতা দেখে করুণায় মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তাকে ওই ভারী বোঝা ছুড়ে ফেলার পরামর্শ দিলো, কারণ তাতে করে তার উপরে ওঠাটা আরো সহজ হয়ে যাবে। ‘এ তো হতে পারে না,’ লোকটা বললো, ‘আমি তো উপরে উঠছিই কেবল এই পতাকাটা পাহাড়ের চূড়ায় পুঁতে দেওয়ার জন্য। আমি যেমন একে ধরে আছি, এ-ও তেমনি আমাকে ধরে আছে।‘ সবকিছু সত্ত্বেও, এটাই হলো মানবজাতির বর্তমান পরিস্থিতি। মানুষ তার সভ্যতার বোঝাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে না, কারণ ওই বোঝার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক উচ্চতর মূল্যবোধ, যেটা কেবল সেইদিনই আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, যেদিন মানবিক অন্তর্দ্বন্দ্বের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে সে অবগাহন করবে শান্তি ও ন্যায়ের পর্বতচূড়ার বিশুদ্ধ হাওয়ায়।

‘আর ইহুদিরা?’, রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন।

আমি উত্তর দিলাম, ‘ইহুদিরা হচ্ছে আধুনিক মানব-পরিস্থিতির নগ্নতম প্রকাশ। সভ্যতার বিপদ এবং সম্ভাবনা, উভয়ই একীভূত হয়েছে ইহুদিদের অস্তিত্বে; তাদের অস্তিত্ব নিজেই একটা পরীক্ষা। প্যালেস্টাইনে এই পরীক্ষাটা আরো তীব্রতাই লাভ করবে কেবল। তখন আমাদের উচিত হবে বিপদকে জয় করার মাধ্যমে সরাসরি তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। আর তার জন্য আমরা আপনার ভ্রাতৃসুলভ ভালোবাসা কামনা করছি।“

রবীন্দ্রনাথ আমার দিকে তাঁর হাত বাড়িয়ে দিলেন, এবং ঠিক সেই মুহূর্তে আমি যেটা অনুভব করছিলাম, তিনিও নিশ্চয়ই ঠিক সেটাই অনুভব করছিলেন- সেটা এই যে, ইতিহাসের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও একটা জিনিস চির অমলিন, অক্ষয় থেকে যায়: মানবিক ভ্রাতৃত্ববোধ।

The Dome of the Rock compound, known to the Muslims as al-Haram al-Sharif, or the Noble Sanctuary, and to the Jews as Temple Mount, in Jerusalem’s Old City. Photograph: Oded Balilty/Associated Press

তথ্যসূত্র :

  1. https://www.kedem-auctions.com/en/content/collection-letters-handwritten-and-signed-rabindranath-tagore-luareate-nobel-prize
  2. Abhik ROY (2016) Martin Buber and Rabindranath Tagore: A Meeting of Two Great Minds, Comparative Literature: East & West, 24:1, 30-42,
  3. https://www.scribd.com/document/690170862/Tagore-interview-with-the-Jewish-starndard-on-the-palestinian-problem
  4. https://enewsroom.in/rabindranath-tagore-on-palestine-gaza-genocide-israel/
  5. https://www.jta.org/archive/tagore-discusses-palestine-and-jewish-problem-prior-to-his-visit-to-country
  6. https://www.jta.org/archive/tagore-arrives-in-vienna-on-his-way-to-palestine
  7. https://www.jta.org/archive/tagore-raises-voice-in-protest-against-atrocities-of-nazi-reich
  8. https://www.versobooks.com/en-gb/blogs/news/1684-the-indians-of-palestine-an-interview-between-gilles-deleuze-and-elias-sanbar
  9. Giles DELEUZE (1998) The Grandeur of Yasser Arafat: Discourse, Vol. 20, No. 3
  10. https://www.jamhoor.org/read/2020/7/24/tagore-street-tel-aviv-against-normalizing-bangladeshiisraeli-relations  
  11. https://cafedissensus.com/2015/10/17/tagores-association-with-jews/

.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *