ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাস-রচনার কতিপয় দিক প্রসঙ্গে।। রণজিৎ গুহ

তর্জমা : ইয়ামিন রহমান ইস্ক্রা

সম্পাদকের ভূমিকা

প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ-র জন্ম তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বাকেরগঞ্জের সিদ্ধকাটি গ্রামে (বাকেরগঞ্জ উপজেলা বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় এবং সিদ্ধকাটি গ্রাম বর্তমান বাংলাদেশের ঝালকাঠি জেলার অন্তর্গত), ১৯২৩ সালের মে মাসে। তিনি এমন একজন ভারতীয় ইতিহাসবিদ যাঁর কাজের প্রভাব বিশ্বজুড়ে নানা শাস্ত্রে বহুল স্বীকৃত। ভারত এবং আরো বিস্তৃত পরিসরে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস রচনা ও চর্চার এমন এক পদ্ধতি তিনি শুরু করেছিলেন, যা বিদ্যাজগত ও ক্রিটিক্যাল রাজনৈতিক অঙ্গনে বিপুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ-ইতিহাস চর্চার গণ্ডি ছাড়িয়ে গুহ সূচিত সাবলটার্ন স্টাডিজ নিয়ে আলোচনা এখন বিশ্বের প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক ইতিহাস-রচনার ক্ষেত্রেই শুনতে পাওয়া যায়। লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঐতিহাসিক-সমাজবিজ্ঞানীরা অনেকেই স্বতন্ত্রভাবে তাঁদের নিজস্ব সাবলটার্ন স্টাডিজ গোষ্ঠী তৈরি করেছেন।

গত শতাব্দীর আশির দশকে সেই সময়ের বিচারে নিতান্তই অপরিচিত ও তরুণ গবেষকদের নিয়ে ‘সাবলটার্ন স্টাডিজ’ তথা ‘নিম্নবর্গের অধ্যয়ন’ নামে যে প্রকল্প তিনি শুরু করেছিলেন, বিশ্বজুড়ে আজ তা সমাদৃত এবং আলোচনা–সমালোচনা–বিতর্ক মিলিয়ে ইতিহাস পঠন-পাঠনের প্রতিষ্ঠিত এক পদ্ধতি। ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহকে আলোচিত নিম্নবর্গের ইতিহাস অধ্যয়ন অথবা সাবলটার্ন স্টাডিজ গ্রুপের ‘গুরু’ হিসেবে মান্য করেন খোদ এই গ্রুপে তাঁর সহ–ইতিহাসবিদেরা। সাবলটার্ন স্টাডিজ গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে অনেকেরই লেখাপত্র প্রথম প্রকাশিত হয় সাবলটার্ন স্টাডিজের কালেক্টিভ ভলিউমে।

প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবশালী ইতিহাস ও তাত্ত্বিক-ঘরানার বিরোধিতা করেই সাবলটার্ন স্টাডিজের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাস-চর্চার বিদ্যমান সমস্ত ঘরানাই উচ্চবর্গের প্রতি পক্ষপাতী— শুরুর দিকের এই দ্যর্থহীন ঘোষণা ছিল এই গ্রুপের অন্যতম প্রধান কৃতিত্ব ও অভিনবত্ব। আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গ এই দুই ধারায় দ্বিধাবিভক্ত এবং এই দুই ধারার মধ্যকার অস্থির-জটিল-বহুমাত্রিক সম্পর্ক বিদ্যমান সাবলটার্ন স্টাডিজের এই বক্তব্যও আজতক অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে আছে। আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রত্যেক অলিগলি যে নিম্নবর্গের স্বকীয়তা, স্বতন্ত্র চৈতন্য ও নিজস্ব উদ্যোগের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে ইতিহাস-রচনার উচ্চবর্গীয় ঝোঁক তা কখনো স্বীকার করেনি। কাজেই নিম্নবর্গের দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনা করার গুরুদায়িত্ব ইতিহাসবিদদের নিতে হবে গুহ যেন সেই অনিবার্য সত্যই মনে করিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য সাবলটার্ন স্টাডিজ তিন দশক ধরে গ্রুপ হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকার গোটা সময়জুড়ে নানা বাঁকবদল ও নতুন নতুন প্রকল্প হাজির করেছে। নিম্নবর্গের চৈতন্য ও স্বকীয়তার সুলুকসন্ধান থেকে শুরু হলেও এক পর্যায়ে উচ্চবর্গের রাজনীতিতে কীভাবে নিম্নবর্গের উপস্থাপন ও নির্মাণ হয়ে থাকে সেইদিকে এই গ্রুপকে অধিক মনোযোগ দিতে দেখা যায়।

বর্তমান রচনাটি গুহ-র বিখ্যাত প্রবন্ধ “On Some Aspects of the Historiography of Colonial India” শীর্ষক প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ। এই প্রবন্ধকে রণজিৎ গুহ-র অন্যতম সিগনেচার প্রবন্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ এই প্রবন্ধেই গুহ সর্বপ্রথম উচ্চবর্গের ইতিহাস-রচনার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এবং নিম্নবর্গের ইতিহাস-রচনার পদ্ধতির শিথিল রূপরেখা হাজির করেছেন। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে, সাবলটার্ন স্টাডিজ কালেক্টিভ ভলিউমের প্রথম খণ্ডে। নাতিদীর্ঘ এই রচনাটিকে পরবর্তীতে অনেকেই নিম্নবর্গের ইতিহাস-চর্চার ‘মেনিফেস্টো’ হিসেবে অভিহিত করেন। অন্তত দুটি কারণে এই প্রবন্ধ ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। একটির কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। আধুনিক ভারতের জাতীয়তাবাদ যে মূলত দুটি বিবদমান— ঔপনিবেশিক ও বুর্জোয়া-জাতীয়তাবাদী— উচ্চবর্গীয় গোষ্ঠীর ঝগড়া এই অমোঘ সত্য উচ্চারণের মাধ্যমে শুরু হয়েছে গুহ-র প্রবন্ধ। এ বিষয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:

“স্মরণ করা যেতে পারে, ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে দুটি বিবদমান গোষ্ঠীর ঝগড়া এই সময়ে তুঙ্গে। একদিকে কিছু ব্রিটিশ ও মার্কিন ঐতিহাসিক দেখাবার চেষ্টা করছিলেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আসলে মুষ্টিমেয় কিছু উচ্চবর্গের নীতিহীন আদর্শহীন ক্ষমতা দখলের কৌশল মাত্র। চিরাচরিত জাতি-ধর্ম-সাম্প্রদায়িক আনুগত্যের বন্ধনকে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সেখানে শুধু ব্যবহার করা হয়েছিল। অন্যদিকে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকেরা এর তুমুল প্রতিবাদ করে বলেছিলেন জাতীয়তাবাদী আদর্শের কথা, জাতীয়তাবাদী নেতাদের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের কথা, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ব্যাপক জনসাধারণের অংশগ্রহণের কথা। রণজিৎ গুহ-র প্রবন্ধে ঘোষণা করা হলো, এই দুটি ইতিহাস আসলে উচ্চবর্গীয় দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত, কারণ দুটি ইতিহাসই ধরে নিয়েছে যে জাতীয়তাবাদ হলো উচ্চবর্গের ক্রিয়াকলাপের ফসল। বিবাদ শুধু সেই ক্রিয়াকলাপের নৈতিক চরিত্র নিয়ে— তা সংকীর্ণ ব্যক্তি বা শ্রেণিস্বার্থের সাময়িক যোগফল, নাকি আদর্শ আর স্বার্থত্যাগের জাদুকাঠির স্পর্শে ব্যাপক জনসাধারণের চেতনার উন্মেষ। এই দুটি ইতিহাসের কোনোটাতেই জনগণের নিজস্ব রাজনীতির কোনো স্থান নেই।”

সুতরাং, সাম্রাজ্যবাদী আর জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের বিরোধিতার পথ ধরেই যে রণজিৎ গুহ তাঁর নেতৃত্বাধীন গ্রুপের ইতিহাস প্রকল্পের প্রথম কর্মসূচি নির্দিষ্ট করবেন এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। অন্যত্র গুহ বলছেন, সেই সময়ে তাঁর প্রধান নিশানা ছিল দক্ষিণ এশিয় ইতিহাসের উচ্চবর্গীয় দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা : “The critique of elitism in South Asian historiography was central to my concern at the time.”

উচ্চবর্গীয় ইতিহাস-রচনা পদ্ধতির সমালোচনা, বিরোধিতা ও পর্যালোচনা কেন জরুরি? কারণ দক্ষিণ এশিয়াসহ অপরাপর উপনিবেশিত অঞ্চলের নিজস্ব ইতিহাসকে আত্মসাৎ করা ব্যতীত ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা রীতিমতো অসম্ভব ছিল। কাজেই, গুহ-র এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় তাৎপর্য এই যে, দক্ষিণ এশিয়ার ঐতিহাসিক ও গবেষকদের তিনি দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব ইতিহাস-রচনায় হাত লাগাতে আহবান জানাচ্ছেন, সেই ইতিহাস নিশ্চিতভাবেই ব্যাপক সংখ্যক জনগণকে বিবেচনায় নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে তাদের অবদান ও ভূমিকাকে প্রাপ্য সম্মান বুঝিয়ে দেবে।

বিখ্যাত দার্শনিক ওয়াল্টার বেঞ্জামিন একদা বলেছিলেন “to brush history against the grain” তথা ইতিহাসের তুলিকে প্রতিষ্ঠিত প্রভাবশালী স্রোতের বিপরীতে টানা জনগণের পক্ষের ইতিহাসবিদের ওপর অর্পিত ঐতিহাসিক দায়িত্ব। সচেতন পাঠক মাত্রই এই প্রবন্ধসহ রণজিৎ গুহ-র তামাম ইতিহাস-প্রকল্প বেঞ্জামিনের সেই অমোঘ বাণীরই প্রতিধ্বনি টের পাবেন।

সাবলটার্ন স্টাডিজের ইতিহাস প্রকল্পে নানা বাঁকবদল লক্ষ করা যায়। তার মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আদিকল্পগত পরিবর্তন সংঘটিত হয় গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের বিখ্যাত প্রবন্ধ “Can the Subaltern speak?” প্রকাশিত হবার পর। স্পিভাক সাবলটার্ন স্টাডিজের বেশ কিছু অনুমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দীপেশ চক্রবর্তী, জ্ঞান প্রকাশসহ প্রায় সকল সাবলটার্ন ইতিহাসবিদ স্বীকার করেন যে স্পিভাকের  ইন্টারভেনশনের আগের সাবলটার্ন স্টাডিজ আর পরের সাবলটার্ন স্টাডিজ আর একই রকম থাকেনি। “ক্যান দ্যা সাবলটার্ন স্পিক?” প্রবন্ধটি লেখার আগেই গায়ত্রী স্পিভাক পশ্চিমের বিদ্যাজগতে রীতিমতো প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন। তাঁর নিজের ভাষায় তিনি ততদিনে ‘ইউরোপিয়ানিস্ট’ তথা ইউরোপ-বিশারদ। ফরাসি দার্শনিক দেরিদার Of Grammatology ইংরেজিতে অনুবাদ করে গোটা বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সেই সময়ে, অর্থাৎ সত্তুর দশকের শেষের দিকে এবং আশির দশকের শুরুর দিকে, ইংল্যান্ডের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রণজিৎ গুহ বাংলা ও দিল্লি অঞ্চলের কতিপয় তরুণ ইতিহাস গবেষকদের সাথে তাঁর আসন্ন ইতিহাস প্রকল্পের ছক কষছেন; আর অন্যদিকে, ‘ইউরোপিয়ানিস্ট’ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাঁর নিজের অঞ্চল, নিজের মানুষ, নিজের শ্রেণি, যেখান থেকে তিনি উঠে এসেছেন, সেই মানুষদের কাছে ফিরতে চাইছিলেন। আমরা দাবি করব, এই দুই ঘটনার প্রতিচ্ছেদেই “ক্যান দ্যা সাবলটার্ন স্পিক?” নামক কালজয়ী প্রবন্ধের জন্ম। প্রাথমিক পর্যায়ে ফুকো-দেল্যুজদের মতো প্রভাবশালী পশ্চিমা দার্শনিকদের সাথে নিজের দ্বিমত বিধৃত করার পরিকল্পনা থেকে রচিত “Power and Desire” (১৯৮৩) নামে প্রবন্ধটি যে পরবর্তীতে “ক্যান দ্যা সাবলটার্ন স্পিক?” শিরোনামে প্রকাশিত হলো তার একটি বড় কারণ রণজিৎ গুহ-র বর্তমান প্রবন্ধটি। স্পিভাকের জবানে:

“I mention this because when I gave “Power and Desire”, the first version of “Can the subaltern speak?” I had read Gramsci’s “Some Aspects of the Southern Question,” but I read Ranajit Guha’s “On Some Aspects of the Historiography of Colonial India”, only a year later. When I read Guha’s essay I was so overwhelmed by the work of the Subaltern Studies group, which he headed, that I pulled my piece, I pulled my act of private piety, that I had performed to get myself out of the prison house of just being a mere Europeanist, and pushed it into the subaltern enclave. I recoded the story. I learned to say that “the subaltern is in the space of difference,” following a wonderful passage in Guha.”

অর্থাৎ, স্পিভাকের বিখ্যাত প্রবন্ধটি সাবলটার্ন স্টাডিজের আদিকল্পগত বাঁকবদলে প্রভাব রেখেছে এ কথা যেমন সত্যি, পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, গুহ-র প্রবন্ধ পাঠের পরে খোদ স্পিভাক তাঁর গল্পটি আর আগের মতো রাখতে পারেননি। তাঁকে রিকোড করতে হয়েছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে, সাবলটার্নিটি তথা নিম্নবর্গত্ব ধারণাটি গুহ এবং স্পিভাকে দুই ধরনের নির্মাণের মধ্য দিয়ে গেছে। এই পরিসরে সেই আলোচনার সুযোগ নেই।

দুই

এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে রণজিৎ গুহ-র কহতব্য কী? যারা জনগণের পক্ষের রাজনীতি, বুদ্ধিজীবীতা ও ইতিহাসচর্চা করবেন, রণজিৎ গুহ মূলত তাঁদের জন্য এই প্রবন্ধে বেশ কিছু অন্তর্ভেদী দিকনির্দেশনা হাজির করেছেন। ঔপনিবেশিক ভারতীয় রাষ্ট্র এবং ঔপনিবেশিকতার ভাব-স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যযুক্ত বর্তমান রাষ্ট্র সম্পর্কে সম্যক বোঝাপড়া গড়ে তুলতে বেশ কিছু সূত্র এই প্রবন্ধ থেকে পাওয়া যাচ্ছে। তবে নিম্নবর্গ তথা জনগণের রাজনৈতিক চৈতন্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যে কোনো চূড়ান্ত কথা বলা যায় না রণজিৎ গুহ অবশ্যই সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন। এ কারণেই তিনি কোনো অলঙ্ঘনীয় ফতোয়া বা ফর্দ পেশ করেননি। পরিস্থিতি মোতাবেক যে নানা কিছুই বদলাতে পারে এবং সংশ্লিষ্টদের যে সে অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করতে হতে পারে, এ ব্যাপারে গুহ নিঃসংশয় ছিলেন। তথাপি, এই প্রবন্ধের গুরুত্ব এই যে, ঔপনিবেশিকতা সৃষ্ট আধুনিক ভারতীয় রাজনীতি ও ইতিহাসের প্রধান প্রধান প্রবণতা সম্পর্কে এখানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা আছে। যেমন ঔপনিবেশিক ও নব্য-ঔপনিবেশিক সমাজে যে নিছক অর্থনৈতিক সম্পর্ক বলে কিছু নেই, সব সম্পর্কই যে আদতে ক্ষমতাসম্পর্ক এবং আরো বিশদভাবে বললে এমনকি অর্থনীতির অন্তর্গত সম্পর্কও যে রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, মার্কসবাদী ঝোঁক থাকার পরেও গুহ সে সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল। বর্তমান সময়ে যারা জনগণের পক্ষের রাজনীতি ও ইতিহাস-রচনা করবেন, তাদের জন্য এই প্রবন্ধের নানান দূরদৃষ্টি, প্রস্তাব ও পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে কাজে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। ‘জনগণ’ সম্পর্কে কোনো অহেতুক ভাবালুতা কিংবা বর্ণবাদী ঘৃণা দুই-ই এড়াতে গেলে ‘জনগণ’ ধারণাটির নিবিড় বিশ্লেষণ প্রয়োজন। জনগণের বিপুল অংশকে তাদের হক সমেত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জায়গা করে দেয় এমন কোনো গণতন্ত্র কায়েম করতে গেলে; জনগণের চৈতন্য, তাদের ধর্মভাব, প্রতিরোধী মনন এবং নানা পারস্পরিক টানাপোড়েন, বৈপরীত্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকার কোনো বিকল্প নেই। গুহ-র বর্তমান প্রবন্ধটি এই অর্থে, গণক্ষমতা কায়েমের লক্ষ্যে জরুরি তাত্ত্বিকতা, তথ্য, পদ্ধতি ও কৌশলের চাহিদা মেটায়। 

বাংলা পরিভাষা সংক্রান্ত নোট

প্রবন্ধের শিরোনামের ‘India’ ও ‘Historiography’-র বাংলা পরিভাষা হিসেবে যথাক্রমে ‘ভারত’ ও ‘ইতিহাস-রচনা’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হয়েছে। ‘India’-র বাংলা পরিভাষা হিসেবে ‘ভারতবর্ষ’ ব্যবহার না করে ‘ভারত’ চয়ন করার কারণ ‘ভারতবর্ষ’ একটা ক্লাসিকাল সংস্কৃত ধারণা যা ঐতিহ্য বা সভ্যতা অর্থে ব্যবহার করা উচিত। অন্যদিকে, ‘হিস্টরিওগ্রাফি’-র বাংলা পরিভাষা ‘ইতিহাসবিদ্যা’ কিংবা ‘ইতিহাস চর্চা’ না হয়ে ‘ইতিহাস-রচনা’ হওয়া উচিত কারণ ‘গ্রাফি’-র অর্থ কোনো লিখিত বয়ান। রণজিৎ গুহ-র বিখ্যাত বাংলা প্রবন্ধ নিম্নবর্গের ইতিহাস-এ আমরা বারবার ‘ইতিহাসবিদ্যা’ শব্দটির ব্যবহার লক্ষ করি। ধারণা করা যায়, তিনি ‘হিস্টরিওগ্রাফি’ অর্থেই শব্দটির ব্যবহার করেছেন। তথাপি ‘ইতিহাসবিদ্যা’ ব্যবহার না করার কারণ ‘ইতিহাসবিদ্যা’ বলতে ইতিহাস ডিসিপ্লিন বোঝানো হয়; ‘ইতিহাস চর্চা’ও তাই। কিন্তু এই দুটো শব্দের আওতায় শুধু ইতিহাসের লিখিত বয়ান, অর্থাৎ বই, প্রবন্ধ ইত্যাদি নয়; তার আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকাশন সংস্থা, জার্নাল প্রভৃতি অনেক কিছু এসে পড়বে।

এছাড়াও, ‘Elite’, ‘Elitist’, ‘Elitism’ শব্দগুলোর বাংলা পরিভাষা করা হয়েছে পদভেদে ‘উচ্চবর্গ’, ‘উচ্চবর্গীয়’ ইত্যাদি। ‘অভিজাত’, ‘অভিজাততন্ত্র’ শব্দগুলো ব্যবহার করা যেত, কিন্তু এই প্রবন্ধে এবং অন্যত্রও, রণজিৎ গুহ-র একটা কেন্দ্রীয় তত্ত্বশব্দ হচ্ছে ‘নিম্নবর্গ’। রণজিৎ ‘জনগণ’ ও ‘নিম্নবর্গ’ বর্গ দুটি প্রায় অদলবদল করে এস্তেমাল করেন এবং এলিট রাজনীতি ও ইতিহাস-রচনা থেকে নিম্নবর্গের আপেক্ষিক স্বাতন্ত্র‍্য নিশ্চিত করতে চান। এই অর্থে ‘নিম্নবর্গের’ বিপরীতে এলিটিজমের বাংলা পরিভাষা হিসেবে ‘উচ্চবর্গ’ শব্দটিই অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। এখানে রণজিৎ গুহ-র উল্লেখিত বাংলা প্রবন্ধেও ‘উচ্চবর্গ’ শব্দটির বহুল ব্যবহার আমাদের নজর এড়ায় না। এছাড়া, সাবলটার্ন স্টাডিজ গ্রুপের আরেক প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র-র ইমান ও নিশান বইতে ‘এলিট’ ও ‘সাবলটার্ন’-এর বাংলা পরিভাষা করা হয়েছে যথাক্রমে ‘উচ্চকোটি’ ও ‘নিম্নকোটি’। তবে এ কথাও উল্লেখ্য, প্রাসঙ্গিক দুই-একটি জায়গায় অভিজাত/অভিজাততন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।

‘Class in itself’ আর ‘Class for itself’ কথা দুটির নানামাত্রিক ব্যবহার দেখা যায় হেগেলীয় ও মার্কসীয় চিন্তায়।  এদের কোনো পরিচিত অনুবাদ নেই, তাই করে নিতে হয়। এই প্রবন্ধে রণজিৎ গুহ ‘Class for itself’ ফ্রেজটি ব্যবহার করেছেন, এর বাংলা পরিভাষা করা হয়েছে ‘স্ব-শ্রেণি’। ‘Class in itself’ বলতে এমন এক ধরনের শ্রেণি অবস্থা এবং এমন একটা সম্পর্কজালের মধ্যে থাকা বোঝায় যা অন্যরা দেখতে পায়, কিন্তু যারা সেই শ্রেণির মধ্যে আছে তারা দেখতে পায় না। এমন একটা সম্পর্ক-সংস্থানের মধ্যে থাকা যেখানে প্রথমে যখন ক্লাস তৈরি হয় তখন যারা তার মধ্যে আছে তারা সেটাকে দেখতে পায় না— এই অর্থে ‘Class in itself’ কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির অবচেতন দশা, যেখানে শ্রেণিস্বার্থ ও শ্রেণি সচেতনতা থাকে না।

কিন্তু যখন কোনো ক্লাসের অন্তর্গত সম্পর্ক-সংস্থান এমন অবস্থা বা দশায় পৌঁছায় যে সেই শ্রেণির মানুষেরা নিজেরা সেটা দেখতে পায় তখন তাকে ‘Class for itself’ বলা যেতে পারে। অর্থাৎ এমনক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শ্রেণি তার নিজের সামাজিক সত্তা, স্তর ও অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকে। একটা শ্রেণি যখন নিজের জন্য নিজে ‘শ্রেণি’ হয়ে উঠছে, তখনই তা [অন্তত তাত্ত্বিকভাবে] ‘Class for itself’ — এহেন শ্রেণি নিজের শ্রেণিস্বার্থ ও চেতনা সম্পর্কে সচেতন থাকে। একইভাবে কোনো শ্রেণি যখন নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেনি এবং সেই অনুযায়ী তার শ্রেণি-চেতনা গড়ে ওঠেনি; কিন্তু অন্য শ্রেণি ও গোষ্ঠীসমূহ সেই শ্রেণিকে ‘শ্রেণি’ হিসেবে দেখতে পায়, এবং ‘শ্রেণি’ হিসেবে বিবেচনা করে, অন্যের কাছে যখন কোনো শ্রেণি মূর্ত হয়ে ওঠে, তখন তাকে ‘class for others’ বলা যেতে পারে।

মূল : ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাস-রচনার কতিপয় দিক প্রসঙ্গে

১. ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস-রচনায় দীর্ঘকাল ধরে ঔপনিবেশিক উচ্চবর্গ আর বুর্জোয়া-জাতীয়তাবাদী উচ্চবর্গের আধিপত্য চলে আসছে। দুটোই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভাবাদর্শজাত পণ্য হিসেবে উৎপত্তি লাভ করলেও ক্ষমতার পালাবদলের মাঝে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে এবং ব্রিটেনে নয়া-ঔপনিবেশিক এবং ভারতে নয়া-জাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সের মধ্যে মিশে গিয়েছে। উপনিবেশবাদী অথবা নয়া-উপনিবেশবাদী উচ্চবর্গীয় ইতিহাস-রচনার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন বিভিন্ন ব্রিটিশ লেখক এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ; তাছাড়া ভারত এবং অন্যান্য দেশগুলোতেও তাদের অসংখ্য অনুসারী রয়েছে। জাতীয়তাবাদী অথবা নয়া-জাতীয়তাবাদী উচ্চবর্গীয় ইতিহাস-রচনা মূলত ভারতীয় চর্চা হলেও ব্রিটেন এবং অন্যান্য অঞ্চলের উদারপন্থী ইতিহাসবিদদের বাদ দিয়ে তা কখনো চর্চিত হয়নি।

২. উচ্চবর্গের বিভিন্ন ধারাগুলো এই ধ্যান-ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যে, ভারত রাষ্ট্র গঠনে এবং তার সার্বিক চেতনা বিকাশে জাতীয়তাবাদের যে ভূমিকা, তা একচেটিয়াভাবে বা প্রধানত উচ্চবর্গের অর্জন। উপনিবেশবাদী ও নয়া-উপনিবেশবাদী ইতিহাস-রচনায় এই অর্জনগুলোর কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে ব্রিটিশ শাসক, প্রশাসক, শাসনপ্রণালী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতিকে; আর জাতীয়তাবাদী ও নয়া-জাতীয়তাবাদী লেখায়— ভারতীয় অভিজাত ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, কর্মকাণ্ড ও মতাদর্শকে।

৩. এই দুই ধরনের ইতিহাস-রচনার প্রথমটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে প্রাথমিকভাবে প্রেরণামূলক ও প্রতিক্রিয়াশীল প্রণালী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। একেবারেই সংকীর্ণ ব্যবহারবাদী ধারণার উপর ভিত্তি করে এটি জাতীয়তাবাদকে কিছু কর্মকাণ্ড ও ধারণার সমষ্টি হিসেবে উপস্থাপিত করে যেগুলোর প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় উচ্চবর্গ ঔপনিবেশিক শক্তির তৈরি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষাদীক্ষা ইত্যাদির প্রতি সাড়া দিয়েছিল। এই ধরনের ইতিহাস-রচনার একাধিক সংস্করণ রয়েছে, তবে যে মূলসূত্রটি তাদের মধ্যে বিদ্যমান তা হলো, ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে এক ধরনের ‌‌‘শিক্ষাপ্রণালী’ হিসেবে চিহ্নিত করা যার মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং শাসনের স্বার্থে ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রবর্তিত সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের সঙ্গে আপোষ করে দেশীয় উচ্চবর্গ রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় যেতে উচ্চবর্গকে যা বাধ্য করেছিল, ইতিহাস-রচনার এই ধারামতে তা, রাষ্ট্রের ভালোর জন্য কোনো মহৎ আদর্শ ছিল না; বরং তা ছিল নিতান্তই সম্পত্তি, ক্ষমতা এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মান-সম্মানের ভাগ বাটোয়ারার আকাঙ্ক্ষা; এবং এটি ছিল ওইসব পুরষ্কারের জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস এবং ক্ষমতাসীন ও দেশীয় অভিজাত এবং সেইসাথে তাদের আরও বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যকার প্রতিযোগিতা, আর এগুলোই নাকি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করেছিল।

৪. আরেক ধরনের উচ্চবর্গীয় ইতিহাস-রচনার সাধারণ প্রবণতা হলো ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে প্রাথমিকভাবে এক ধরনের নির্ভেজাল আদর্শবাদী প্রয়াস হিসেবে উপস্থাপন করা যার মূলকথা হলো পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতার পথে জনগণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্বদেশী উচ্চবর্গের ব্যক্তিগণ। এই ধরনের ইতিহাস-রচনার একাধিক সংস্করণ রয়েছে যেগুলো এই সমস্ত প্রয়াসের প্রেরণাশক্তি হিসেবে বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ অথবা অভিজাত সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের উপর গুরুত্বারোপের ভিত্তি করে পৃথক পৃথক ধারায় আলাদা হয়েছে। তবে, যে মূলসূত্রটি তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বিদ্যমান তা হলো, সহযোগিতার যতই নজির থাকুক, ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে গৌণ করে দেখিয়ে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে দেশীয় উচ্চবর্গের ইতিবাচক চাওয়ার অন্যতম প্রকাশ হিসেবে উপস্থাপন করা, রাজশক্তির সঙ্গে তাদের সহযোগিতার বিষয়টির তুলনায় বিরোধিতাকে বড় করে দেখানো, তাদের ভূমিকাকে শোষক ও নিপীড়ক হিসেবে না দেখিয়ে জনগণের ইচ্ছার প্রবর্তক হিসেবে তুলে ধরা। রাজদত্ত যৎসামান্য ক্ষমতা এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা হাসিল করার জন্য তাদের কাড়াকাড়ি-মারামারিকে ছাপিয়ে উচ্চবর্গের পরার্থপরতা এবং আত্মত্যাগকে তুলে ধরা। এভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের রচিত ইতিহাস হয়ে ওঠে ভারতীয় উচ্চবর্গের আধ্যাত্মিক জীবনবৃত্তান্ত।

৫. উচ্চবর্গের ইতিহাস-রচনা অবশ্যই উপযোগহীন নয়। এটি আমাদের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কাঠামো, নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তার বিভিন্ন সংগঠনের কার্যকলাপ বুঝতে সাহায্য করে। যেসব শ্রেণি একে টিকিয়ে রাখে তাদের যোগসাজশের প্রকৃতি; তৎকালীন সময়ের মুখ্য মতাদর্শ হিসেবে উচ্চবর্গের ভাবাদর্শের বিভিন্ন আঙ্গিক; দুই ধরনের উচ্চবর্গের মধ্যকার দ্বন্দ্ব-বৈপরীত্য এবং উভয়ের মধ্যকার পারস্পরিক সংঘাত ও সমঝোতার জটিল সমীকরণ; বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ ও  ভারতীয় ব্যক্তিত্ব এবং উচ্চবর্গের প্রতিষ্ঠানসমূহের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। সবচেয়ে বড় কথা এটি আমাদেরকে খোদ ওই ইতিহাস-রচনার পদ্ধতিটাকেই বুঝতে সাহায্য করে।

৬. তবে, এই ধরনের ইতিহাস-রচনা আমাদের হয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। কারণ ব্যাখ্যা করা তো দূরের কথা, উচ্চবর্গের কোনো প্রকার সহায়তা ছাড়াই সাধারণ জনগণ নিজস্ব উদ্যোগে জাতীয়তাবাদের নির্মাণ ও বিকাশের ক্ষেত্রে যে ভূমিকা রেখেছে সেটিকে এই ইতিহাস-রচনা স্বীকারই করে না। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততির দিকটার অনুধাবন ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এই ইতিহাস-রচনার দৈন্যতার বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে উন্মোচিত হয়। এই ইতিহাস-রচনা পদ্ধতি জাতীয়তাবাদে জনসম্পৃক্তির দিকটাকে কেবল, নেতিবাচকভাবে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এবং ইতিবাচকভাবে, বড়জোড়, কতিপয় উচ্চবর্গের নেতার কারিশমায় জনগণের সাড়া দেয়া অথবা হাল ফ্যাশনের ভাষায় বিবিধ গোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত খাড়াখাড়ি জনসমাবেশ (vertical mobilization) হিসেবে বুঝে থাকে। সুতরাং, শত শত, হাজার হাজার এমনকি সময়ে সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের জাতীয়তাবাদী কর্মকাণ্ড ও মতাদর্শে অংশগ্রহণকে তথাকথিত ‘আসল’ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বিচ্যুতি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রযন্ত্রের চাকা সচল রাখা এবং উচ্চবর্গের প্রতিষ্ঠানগুলোকে চালিয়ে নেয়ার কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছে উচ্চবর্গেরই নিজস্ব মতাদর্শের সফল আত্মস্থকরণের প্রভাব এবং উদ্যোগ হিসেবে। এই ইতিহাস-রচনার দেউলিয়াত্ব রীতিমতো উদাম হয়ে পড়ে, যখন একে উচ্চবর্গের অনুপস্থিতিতে অথবা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে তৈরি হওয়া অসংখ্য জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন— যেমন ১৯১৯ সালের রাওলাট বিদ্রোহ এবং ১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলনের মতো আন্দোলনগুলোকে— ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। এই ধরনের একপেশে এবং ঠুলি আঁটা ইতিহাস-রচনা কেমন করেই-বা উচ্চবর্গের রাজনীতির বাইরের আন্দোলন যেগুলো চৌরিচৌরা বা ১৯৪৬-এর নৌবিদ্রোহের সঙ্গে সংহতি জানাতে সংঘটিত সশস্ত্র মহড়ার মতো কর্মকাণ্ডগুলোকে বুঝতে সাহায্য করবে?

৭. উচ্চবর্গের ইতিহাস-রচনার এই অপর্যাপ্ততা এক ধরনের সংকীর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সরাসরি শ্রেণিগত প্রতিফলন। এই ধরনের সমস্ত লেখাতেই ভারতীয় রাজনীতির অধিক্ষেত্রগুলোকে অবধারিতভাবে শাসনের প্রয়োজনে ব্রিটিশদের তৈরি এবং তাদের প্রণীত প্রতিষ্ঠানাদির উপর ভিত্তি করে উদ্ভূত বিভিন্ন আইনকানুন, নীতিমালা, অভিব্যক্তি এবং অন্যান্য উপরকাঠামোর ওপর অবস্থিত বলে ধরে নেওয়া হয়েছে অথবা একচেটিয়াভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবধারিতভাবে, এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত ইতিহাস-রচনা রাজনীতিকে উচ্চবর্গের কর্মকাণ্ড ও ধ্যানধারণার যোগফল হিসেবে বুঝে থাকে– অর্থাৎ, শাসনের প্রয়োজনে সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানাদির সরাসরি নিয়ন্ত্রক ঔপনিবেশিক প্রভু এবং তাদের আজ্ঞাবহ সহচর দেশীয় সমাজের অধিপতি গোষ্ঠী। উল্লিখিত গোষ্ঠীসমূহ পারস্পরিক লেনদেনের মাধ্যমে যতটুকু নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা গেছে শুধুমাত্র ততটুকুই যেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সারবস্তু, বাকিটা ওই রাজনীতিরই কাকতালীয় ঘটনা। এইরকম উচ্চবর্গীয় কিছু কর্মকাণ্ড এবং ধারণার সমষ্টির বাইরে আলোচ্য ইতিহাস-রচনা রাজনীতিকে চিন্তাই করতে পারে না।

৮. এই অনৈতিহাসিক ইতিহাস-রচনাতে পরিষ্কারভাবে যে বিষয়টি বাদ পড়ে তা হলো জনগণের রাজনীতি। উচ্চবর্গের রাজনীতির সমান্তরালে ভারতীয় রাজনীততে পুরো ঔপনিবেশিক আমল জুড়ে আরও একটি ধারা ছিল যার মুখ্য চরিত্রে দেশীয় সমাজের কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী বা ঔপনিবেশিক প্রভুরা ছিল না; বরং তাতে ছিল শহর ও গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নিম্নবর্গের এবং খেটে খাওয়া মানুষের বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি, অর্থাৎ, জনগণ। এই ধারাটি ছিল স্বায়ত্তশাসিত, কারণ এটি উচ্চবর্গের রাজনীতি থেকে উদ্ভূত কোনো ধারা ছিল না বা সেই ধারার উপরে কোনোভাবে নির্ভরশীলও ছিল না। এই ধারার মূল উপাদানগুলো প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলে প্রোথিত কেবল এই অর্থেই একে সনাতনী বলা চলে, কিন্তু একে কোনোভাবেই অচল অর্থে সেকেলে ঠাওর করা যাবে না। প্রাক-ব্রিটিশ যুগের উচ্চবর্গীয় রাজনীতির মতো এটি ঔপনিবেশিক অবস্থার চাপে নষ্ট বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। বরং নতুন অবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এবং তারই মধ্যে চেতনা ও ব্যবহারের নানা দ্বন্দ্বের ফলে আকারে ও গুণে কিছু নতুনত্ব নিয়ে তা ঔপনিবেশিক আমলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিকাশ লাভ করেছে। দেশীয় উচ্চবর্গের রাজনীতির মতোই আধুনিক হলেও, সময় এবং কাঠামোর গভীরতার সাপেক্ষে নিম্নবর্গের রাজনীতির সনাক্তকারী স্বাতন্ত্র্য আলাদা করে চেনা যেত।

৯. উচ্চবর্গীয় ইতিহাস-রচনায় এই রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ এর সমাবেশের কায়দা ও চরিত্রের নানা দিক সম্পর্কে খুব সামান্যই ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। উচ্চবর্গের উদ্যোগজাত সমাবেশ যদি হয় খাড়াখাড়ি, তাহলে নিম্নবর্গের উদ্যোগজাত সমাবেশকে বলতে হয় আড়াআড়ি (horizontal। ঔপনিবেশিক শাসনের স্বার্থে ইংরেজরা এদেশে যেসব সংসদীয় প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা চালু করেছিল এবং প্রাক-ঔপনিবেশিক আধা-সামন্ত শাসনের যেসব সংস্থা তখনো অকেজো হয়ে যায়নি, সেগুলোর অভিযোজনের মাধ্যমেই প্রথম কায়দার খাড়াখাড়ি সমাবেশের গোড়াপত্তন ঘটেছিল। অন্যদিকে, দ্বিতীয় কায়দার সমাবেশের– অর্থাৎ আড়াআড়ি সমাবেশ— প্রধান অবলম্বন ছিল নিম্নবর্গের সমাজের চিরায়ত কুটুম্বিতা ও অঞ্চলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কিংবা সংশ্লিষ্ট মানুষদের চেতনার তারতম্যের উপর নির্ভরশীল শ্রেণিসংস্থা বা এই দুই-এর নানারকম সমন্বয়। উচ্চবর্গের জমায়েতের ঝোঁক ছিল অপেক্ষাকৃত আইনানুগ এবং সাংবিধানিক; আর সেই তুলনায় নিম্নবর্গের জমায়েতকে বেশ সহিংসই বলতে হবে। প্রথমটি ছিল মোটের ওপর বেশ সতর্ক ও নিয়ন্ত্রিত এবং পরেরটি স্বতঃস্ফূর্ত। ঔপনিবেশিক আমলে নিম্নবর্গের জমায়েতের সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ ও ব্যাপকতর চেহারা দেখা যায় সেই সময়কার কৃষক-বিদ্রোহগুলোতে। তবে, এমন অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার নজির আছে যেখানে শহুরে পাতি বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত, শ্রমিক ও অন্যান্য গরিব মেহনতি জনতার সমাবেশ ও জমায়েতেও কৃষক বিদ্রোহের আদিকল্পের (paradigm) লক্ষণগুলোর হুবুহু প্রতিফলন দেখা গেছে।

১০. এই অধিক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল মতবাদটি, বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই, তার সামাজিক গঠনের বৈচিত্র‍্যকে তুলে ধরার সাথে সাথে যে-কোনো বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে এর এক বা একাধিক উপাদান অন্য উপাদানগুলোর তুলনায় মুখ্য হয়ে উঠতে পারত। তবে, যত বৈচিত্র্যই থাকুক না কেন, যে বৈশিষ্ট্যটি কখনো পরিবর্তন হয়নি তা হলো উচ্চবর্গের কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রবণতা। বৈশিষ্ট্যটি এই অধিক্ষেত্রের আওতাভুক্ত যাবতীয় সামাজিক অঞ্চলসমূহের সাধারণ নিম্নবর্গত্ব (subalternity)  থেকে উৎসারিত এবং এটাই উচ্চবর্গের রাজনীতির সাথে এর তফাতকে স্পষ্ট করে গড়ে দিত। এই মতাদর্শিক উপাদানগুলো অবশ্যই সকলক্ষেত্রে গুণগতভাবে একাট্টা এবং ঘনত্বের দিক থেকে একইরকমের তীব্র ছিল না। বড়জোড় এটা নিম্নবর্গীয় রাজনৈতিক সক্রিয়তার জমাটবদ্ধতা, মনোযোগ ও উত্তেজনাকে সময় সময় বাড়িয়ে দিত। তবে, এমন ঘটনাও আছে যেখানে গোষ্ঠী স্বার্থের দিকে জোর দেওয়ার প্রবণতাটি জনপ্রিয় আন্দোলনগুলোর ভারসাম্য এমনভাবে নষ্ট করেছে যাতে সংকীর্ণ অর্থনীতিবাদী বিচ্যুতি এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পথ সৃষ্টি হয়েছে। ফলাফল হিসেবে আড়াআড়ি ঐক্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

১১. এছাড়া, শোষণের যেসব ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে নিম্নবর্গীয় শ্রেণিগুলো অবস্থান করত সেই পর্যায়, একইসাথে এর প্রধান চরিত্রের অধিকাংশ অর্থাৎ, শ্রমিক এবং কৃষকদের সঙ্গে উৎপাদনশীল শ্রমের সম্পর্ক এবং অনুৎপাদক শহুরে দরিদ্র শ্রেণি এবং পাতি বুর্জোয়াদের নিম্নতর অংশের যথাক্রমে কায়িক ও মানসিক শ্রম থেকেও এই রাজনীতির আরও একটি সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট্য মূর্ত হয়ে ওঠে। শোষণ এবং শ্রমের অভিজ্ঞতা এই রাজনীতিকে বহু নামে, ধাঁচে এবং মূল্যে ভূষিত করেছে যেগুলো একে উচ্চবর্গের রাজনীতি থেকে ভিন্ন ধারায় নিয়ে গেছে।

১২. উপরোক্ত তিনটি অনুচ্ছেদে বর্ণিত নিম্নবর্গের রাজনীতির এইসব বৈশিষ্ট্য ছাড়াও অন্যান্য সুস্পষ্ট যে-সকল বৈশিষ্ট্য রয়েছে কোনো তালিকাতেই তা সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয় এবং সবসময় এগুলোর শুদ্ধরূপে আবির্ভাবও ঘটে না। জীবনযাপনের নানা বৈপরীত্য এগুলোকে ইতিহাসে বাস্তব রূপ লাভে প্রভাবিত করে। তবে, যাপিত জীবনের নানা বৈপরীত্যের দরুন যতই পরিমার্জন ঘটুক না কেন, সেসব নিম্নবর্গের রাজনীতিকে উচ্চবর্গের রাজনীতি থেকে পৃথক করে চিনতে সাহায্য করেছে। এই দুই ধরনের অধিক্ষেত্র বা স্রোতের সহাবস্থান— যা ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় দিয়েও অনুমান করা যায় এবং বাহ্যিকভাবেও প্রমাণ করা যায়— এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সত্য উন্মোচন করে, সেটা হলো, জাতির স্বর হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভারতীয় বুর্জোয়াদের ব্যর্থতা। নিম্নবর্গের জীবনযাত্রা ও চৈতন্যের বিপুল অংশে কখনোই উচ্চবর্গের সর্বেশ্বরতা কায়েম হয়নি। এই কাঠামোগত থেকে উদ্ভুত কাঠামোগত দ্বিধাবিভক্তিই ঔপনিবেশিক আমলের ভারতের ইতিহাসের মর্মবস্তু; যিনিই এই ইতিহাস ব্যাখ্যা কর‍তে যাবেন, এই দ্বিবিভাজনের ইতিহাসকে অস্বীকার করে ভুলের ফাঁদ এড়াতে পারবেন না।

১৩. তবে, এই দ্বিবিভাজন আবার এটা বোঝায় না যে, এই দুটি ধারা একেবারে অভেদ্যভাবে পরস্পর থেকে এমনভাবে আলাদা হয়ে গিয়েছিল যে তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। বরং , দেশীয় উচ্চবর্গের অগ্রসর অংশের কোনো কোনো ধারা এই দুই ধরনের রাজনীতিকে উচ্চবর্গের উদ্যোগ ও নেতৃত্বে উভয়বর্গের একত্রিত সমাবেশে মেলাতে চেষ্টা করেছে। এই ধরনের প্রচেষ্টা যখন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী উদ্দেশ্যের সঙ্গে কম-বেশি জড়িয়ে গিয়েছিল এবং ধারাবাহিকভাবে চলেছিল তখন কিছুক্ষেত্রে দারুণ ফলাফল দেখা গিয়েছিল। তবে, সবক্ষেত্রেই যে উচ্চবর্গের এমন নিয়ত ছিল তা বলা যাবে না। বরং, উচ্চবর্গ তথা বুর্জোয়াদের আপোষকামী মনোভাব, গণ-আন্দোলনের তেজ সম্পর্কে উচ্চবর্গের চিরাচরিত ভীতি এবং নিম্নবর্গের চৈতন্যের নানা দুর্বলতা এসব আন্দোলনকে সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হতে দেয়নি কিংবা হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এমনক্ষেত্রে, উচ্চবর্গেরই নেতৃত্ব ও কারসাজিতে এমন যৌথ আন্দোলন কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং কুৎসিত গোষ্ঠীগত বিবাদের জন্ম দিয়েছিল। কাজেই ঔপনিবেশিক সরকারের সঙ্গে আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক বা অন্য কোনো ধরনের সমঝোতার মাধ্যমে পিছু হটা ও বিভাজনের রাজনীতির এই ইতিহাসকেও স্মরণে রাখতে হবে। তবে উভয় পরিণতির ক্ষেত্রেই যে বিষয়টি লক্ষ করার মতো তা হলো, যৌথ সমাবেশের উদ্দেশ্য প্রগতি কিংবা প্রতিক্রিয়া যার অনুকূলেই যাক না কেন, এই দুটি ধারা বা ক্ষেত্রের বেণীবন্ধন ব্যতিক্রমহীনভাবে বারবার বিস্ফারণের জন্ম দিয়েছে। এমনকি উচ্চবর্গের স্বার্থে একত্রিত হওয়া নিম্নবর্গও উচ্চবর্গের নিয়ন্ত্রণের জিঞ্জির ছিন্ন করতে সক্ষম হয়েছে এবং উচ্চবর্গের উদ্যোগজাত আন্দোলনের মধ্যেও নিম্নবর্গের রাজনীতি তার নানা খাসলত খোদাই করে দিয়েছে।

১৪. তবে, নিম্নবর্গের রাজনীতির তরফ থেকে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল সেগুলো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে রূপান্তরের জন্য যথেষ্ট ছিল না। শ্রমিক শ্রেণি তখনো তার সামাজিক সত্তার অভীষ্ট কর্তব্য পালনে যথেষ্ট পরিণত ছিল না এবং তাদের স্ব-শ্রেণি হিসেবে (class for itself) তাদের চৈতন্যে ঘাটতি ছিল। উপরন্তু, তারা কৃষক শ্রেণির সঙ্গেও শক্তভাবে একাত্ম হতে পারেনি। পরিণামে, বুর্জোয়ারা যেসব লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল শ্রমিক শ্রেণি সেগুলোকেই করায়ত্ত করা এবং লক্ষ্য অর্জন করার ক্ষেত্রে কিছুই করতে পারেনি। এই সবকিছুর ফলাফল হলো এই, সেই সময়ের অসংখ্য কৃষকবিদ্রোহ— যার কোনো কোনোটি আকারে অতিকায় এবং উপনিবেশ-বিরোধী চেতনায় সমৃদ্ধ— নিজেদেরকে আঞ্চলিকতার ঊর্ধে ওঠানোর নিমিত্তে খামোখা নেতৃত্বের অপেক্ষায় ছিল এবং নিজেদের স্বাতন্ত্র্যকে সর্ব-ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের সাথে গুলিয়ে ফেলেছিল। কালক্রমে, কৃষক, শ্রমিক এবং শহুরে পাতি-বুর্জোয়াদের শাখাবিভক্ত সংগ্রাম নিছক অর্থনীতিবাদের ঘেরাটোপে বা, যেসব ক্ষেত্রে এসব উদ্যোগে রাজনীতিকরণ ঘটেছিল সেসব ক্ষেত্রে, বৈপ্লবিক নেতৃত্বের অভাবে, অতিরিক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ হয়ে থাকায় জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মতো কার্যকর কোনো কিছুতে পরিণত হতে পারেনি।

১৫. এ হলো কোনো রাষ্ট্রের নিজ পায়ে দাঁড়াতে না পারার ঐতিহাসিক ব্যর্থতার পাঠ— বুর্জোয়া এবং শ্রমিক উভয় শ্রেণির ব্যর্থতা ও অপারগতার দরুন উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সুনিশ্চিত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বুর্জোয়া সর্বেশ্বরতার অধীনস্ত ঊনিশ-শতকীয় ধ্রুপদি কিসিমের  বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব অথবা অপেক্ষাকৃত আধুনিক কিসিমের কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির সর্বেশ্বরতার অধীনস্ত কোনো “নয়া-গণততান্ত্রিক বিপ্লব” সংঘটনের ব্যর্থতার ঐতিহাসিক পাঠ। এ হলো সেই ব্যর্থতার পাঠ যা ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাস-রচনার কেন্দ্রীয় সমস্যাটিকে মূর্ত করে। এই সমস্যা খতিয়ে দেখার কোনো একক যথাপ্রদত্ত রাস্তা নাই। কাজেই শত ফুল ফুটুক, এমনকি আগাছাতেও আমাদের আপত্তি নাই। এমনকি আমরা মনে করি যে ইতিহাস-রচনার এই চর্চায় নেতিবাচক উদাহরণের শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে উচ্চবর্গেরও একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু আমরা এটাও নিশ্চিত যে বিকল্প ডিসকোর্স নির্মাণ করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিয়ে উচ্চবর্গের কৃত্রিম ও অনৈতিহাসিক অদ্বৈতবাদী (monism) ধারণা তৈরি করা ইতিহাস-রচনাকে নাকচ করতে হবে এবং শক্তভাবে মোকাবেলা করতে হবে। উচ্চবর্গীয় ও নিম্নবর্গীয় রাজনীতির সহাবস্থান এবং মিথস্ক্রিয়ার ইতিহাসের স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করতে হবে।

১৬. আমরা নিশ্চিত যে ঔপনিবেশিক ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস-রচনার বর্তমান দশা এবং তা থেকে পরিত্রাণের রাস্তা সন্ধানের ক্ষেত্রে আমরা একা নই। আধুনিক ভারতীয় ইতিহাস-রচনা যে উচ্চবর্গের প্রতি পক্ষপাতে জর্জরিত এই তিক্ত বাস্তবতায় আমাদের মতো অনেক শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও লেখকেরা ক্ষুব্ধ। তাদের প্রত্যেকেই যে উপরে যেসব কথা যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে সেসবের সঙ্গে হুবুহু একমত তা নয়। তবে, আমাদের কোনো সন্দেহ নাই যে ইতাহাস-রচনার আর আর দৃষ্টিভঙ্গি ও চর্চার ধনুকও সেইদিকেই তাক করা যেদিকে আমাদেরও অভিমুখ। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণের উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির এ ধরনের মিলনকে আরও বেগবান করা। আমরা একটা ঝোঁক তৈরি করা এবং বাস্তবেও যে এটা চর্চা করা সম্ভব সেই আশা সঞ্চার করা ছাড়া আর কোনো দাবি রাখি না। অন্য যে আলাপই উঠুক না কেন, যারা আমাদের মতো করে চিন্তা করেন তাদের সাথে আমাদের ঐক্যমত্যের কাছ থেকে তো বটেই; এমনকি যারা আমাদের সাথে একমত নন, তাদের সমালোচনা, এই সবকিছু থেকেই আমরা বিপুল পরিমাণে শেখার প্রত্যাশা রাখি।

উপরে ব্যবহৃত ‘উচ্চবর্গ’, ‘জনগণ’ ‘নিম্নবর্গ’ ইত্যাদি পরিভাষা সংক্রান্ত টীকা:

এই প্রবন্ধে ‘উচ্চবর্গ’ শব্দটি—দেশি এবং বিদেশি— ইংরেজ শাসিত ভারতে প্রভুশক্তির অধিকারী সকল সম্প্রদায়কে বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। প্রভুস্থানীয় বিদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছেন সকল অ-ভারতীয়, অর্থাৎ, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের প্রধানত ব্রিটিশ কর্মচারীগণ এবং বেসরকারি হিসেবে গণ্য বিদেশি শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, খনির মালিক, ভূস্বামী, নীলকুঠী চা-বাগান, কফিক্ষেত বা ওই জাতীয় যে সব সম্পত্তি প্লানটেশন প্রণালীতে চাষ করা হয় তার মালিক ও কর্মচারী, খ্রিস্টান মিশনারি, যাজক, পরিব্রাজক ইত্যাদি।

অন্যদিকে, প্রভুগোষ্ঠীর দেশীয় অংশে শ্রেণি ও স্বার্থ হাসিলের পার্থক্য অনুযায়ী দুটি স্তর রয়েছে। সর্ব-ভারতীয় পর্যায়ে রয়েছেন বৃহত্তম সামন্ত প্রভুরা, শিল্পে ও বাণিজ্যে লিপ্ত সবচেয়ে শক্তিমান বুর্জোয়ারা এবং আমলাতন্ত্রে বা শাসনযন্ত্রের অন্যত্র যারা ছিল উচ্চপদের অধিকারী।

দেশি প্রভুগোষ্ঠীর আঞ্চলিক বা স্থানীয় প্রতিনিধিরাও আবার দু-রকমের। এক রকম হচ্ছে তারাই যারা আসলে সর্বভারতীয় প্রভুগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হওয়া স্বত্তেও বিশেষ বিশেষ অবস্থায় ক্ষমতাবিন্যাসের আঞ্চলিক বা স্থানীয় উপাদান হিসেবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর এক রকম হচ্ছে তারা যাদের প্রভুত্ব ষোল আনাই আঞ্চলিক বা স্থানীয়, কিংবা যারা অন্য সব অর্থে প্রভুগোষ্ঠীর মধ্যে গণ্য না হলেও আঞ্চলিক বা স্থানীয় অবস্থায় প্রভুগোষ্ঠীর স্বার্থ ও দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কাজ করে, নিজেদের সামাজিক সত্তার ধর্ম অনুযায়ী কাজ করে না।

মোটের ওপর এবং বিমূর্তভাবে ধরতে গেলে দেশীয় প্রভুগোষ্ঠীর এই সর্বশেষ শ্রেণিটি বিভিন্ন উপাদানে গঠিত এবং এর আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বিকাশ ও সামাজিক গড়নের সাংকর্যের চরিত্র স্থানভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। উপরোক্ত সংজ্ঞানুযায়ী, এই দ্বিবিধ অসমতার ফলেই যে-শ্রেণি বা সমূহ এক অঞ্চলে প্রভুস্থানীয় বলে গণ্য, তারাই আবার অন্যত্র আর এক প্রভুগোষ্ঠীর অধীন। একাধারে প্রভুত্ব ও অধীনতার প্রতীক বলেই তাদের মানসিকতা, রাজনৈতিক আদর্শ ও আচরণ, সখ্য ও শত্রুতার ঝোঁক বা তাৎপর্য সবক্ষেত্রেই এক নয়, বরং অর্থ ও উদ্দেশ্যের নানারকম স্ববিরোধিতায় তা প্রায়শই অস্পষ্ট ও জটিল হয়ে দেখা দেয়। ঔপনিবেশিক যুগে ভূস্বামীদের মধ্যে যারা নিঃস্ব হয়ে পড়ে, গ্রামভদ্রদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত ওপরের দিকে এবং ধনী কৃষকশ্রেণি— এরা সকলেই আমার সংজ্ঞার শুদ্ধ অর্থে নিম্নবর্গ তথা জনগণের অন্তর্গত হলেও বহুক্ষেত্রেই অবস্থার চাপে ও চৈতন্যের অন্তর্দ্বন্দ্বে উচ্চবর্গের সপক্ষে কাজ করে। আদর্শের বিশুদ্ধতা থেকে বাস্তবের এই বিচ্যুতি ও তারই পরিণামে যে ঐতিহাসিক জটিলতার সৃষ্টি হয় তার সন্ধান, বিশ্লেষণ ও বর্ণনাই গবেষণার দায়িত্ব।

‘জনগণ’ ও ‘নিম্নবর্গ’ শব্দ দুটিকে এই রচনায় সবসময় সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই সামাজিক  গোষ্ঠী এবং উপাদানসমূহ ভারতীয় জনগণ এবং যাদের আমরা ‘উচ্চবর্গ’ বলে পরিচয় দিয়েছি তাদের মধ্যকার জনতাত্ত্বিক পার্থক্যকে তুলে ধরে। ঔপনিবেশিক ভারতে যারা উপরোক্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী উচ্চবর্গের অন্তর্গত, সমগ্র জনসংখ্যা থেকে তাদের বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে তারাই ‘নিম্নবর্গ’। এর মধ্যে রয়েছে শহরের শ্রমিক ও গরিব, সর্বোচ্চ পদের আমলাদের বাদ দিয়ে মধ্যবিত্তের বাকি অংশ, ক্ষেতমজুর, গরিব চাষী ও প্রায়-গরিব মাঝারি নিম্নবর্গের মধ্যে গণ্য। তা ছাড়াও, নিঃস্ব হয়ে যাওয়া জমিদার, অপেক্ষাকৃত হীনবল গ্রামভদ্র, ধনী কৃষক এবং অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন মাঝারি কৃষক যারা, এই সংজ্ঞার একেবারে শুদ্ধ অর্থে ‘স্বাভাবিকভাবেই’ ‘জনগণ’ ও ‘নিম্নবর্গের’ কাতারে পড়ে, কিছুক্ষেত্রে তারা ‘উচ্চবর্গের’ পক্ষেও কাজ করতে পারে, এবং সেই কারণে কিছু কিছু স্থানীয় ও আঞ্চলিক ক্ষেত্রে তাদের সেভাবেই শ্রেণীকরণ করা যায়– প্রাপ্ত সাক্ষ্যপ্রমাণকে নিবিড় এবং বিচক্ষণ পর্যালোচনা করে এই অস্পষ্টতা সমাধানের ভার ঐতিহাসিকদের কাঁধে সমর্পিত হলো।

টীকানির্দেশ:

১. ১৯৯২ সালে যাত্রা শুরু করা লাতিন আমেরিকান সাবলটার্ন স্টাডিজ গ্রুপ তাদের ফাউন্ডিং স্টেটমেন্ট শুরু করেছে এভাবে: “The work of the Subaltern Studies Group, an interdisciplinary organization of South Asian scholars led by Ranajit Guha, has inspired us to found a similar project dedicated to studying the Subaltern in Latin America.”

২. Ranajit Guha, “On Some Aspects of the Historiography of Colonial India”, in Ranajit Guha, ed., Subaltern Studies I, Delhi: Oxford University Press, 1982), pp. 1-7। এছাড়াও প্রবন্ধটি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত রণজিৎ গুহ-র The Small Voice of History বইতেও সংকলিত আছে।

৩. পার্থ চট্টোপাধ্যায়, “নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার ইতিহাস”, প্রজা ও তন্ত্র, ২০০৫, অনুষ্টুপ, কলকাতা

৪. Ranajit Guha, “Introduction”, History at the Limit of World-History, 2002, Columbia University Press, New York

৫. Michael Lowy, Firm Alarm: Reading Walter Banjamin’s ‘On the Concept of History’, translated by Chris Turner, 2005, Verso, London। বেঞ্জামিনের বিখ্যাত প্রবন্ধ “On the Concept of History”-র একটি চিত্তাকর্ষক তর্জমা করেছেন পারভেজ আলম— “ইতিহাসের ধারণা প্রসঙ্গে” এই শিরোনামে। প্রকাশিত হয়েছে রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালের অষ্টম সংখ্যায় (বর্ষ ৬, সংখ্যা ২)

৬. Gayatri Chakravorty Spivak, “In Response: Looking Back, Looking Forward”, in Can the Subaltern Speak? Reflections on the History of an Idea, ed. Rosalind C. Morris (New York: Columbia University Press, 2010)

প্রথম প্রকাশ : রাষ্ট্রচিন্তা, নবম সংখ্যা, জুন ২০২২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *