রোহিঙ্গা: ভিকটিম থেকে ভিলেন

  • নাজমুল আহসান

শুক্রবার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর একটি চেষ্টা ফের ব্যর্থ হয়েছে। পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী প্রত্যাবসনের জন্য একজন রোহিঙ্গাও হাজির হননি। বেয়াড়া শরণার্থীদের এমন উদ্ধত্য দেখেই হয়তো পররাষ্ট্র মন্ত্রী হুমকি দিলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ‘আরাম-আয়েশ’ ছুটিয়ে দেওয়া হবে।

কাকতালীয় হতে পারে, তবে ওই হুমকির পর থেকে বাংলাদেশের মূল ধারার সংবাদ মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিয়ে উস্কানিমূলক ও অবমাননাকর প্রতিবেদন, নিবন্ধ ও মতামত কলাম বেশি বেশি ছাপা হতে দেখেছি। দেখে মনে হয় একেবারে যোগসাজশ করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

রোহিঙ্গা মহাসমাবেশ

দেশের বেশ পুরোনো ও উল্লেখযোগ্য প্রচারসংখ্যার একটি বাংলা দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপা হওয়া সাম্প্রতিক একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল: ‘রোহিঙ্গা শোডাউন : দেশ অস্থির করার ষড়যন্ত্র।’ এই নিবন্ধের (নিবন্ধ বলছি, কারণ একে সংবাদ প্রতিবেদন বলার কোনো সুযোগ নেই) আলোচ্য বিষয় ছিল ২৫শে আগস্ট ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত বিশাল রোহিঙ্গা গণসমাবেশ। গত বছরও একইদিনে রোহিঙ্গারা এই দিবস পালন করেছিল। কিন্তু এবার ওই প্রত্যাবর্তন চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরপর এই সমাবেশ আয়োজন করায়, এ নিয়ে বেশ বিতর্ক দেখা দিয়েছে।

এক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে ওই সমাবেশের একটি ভিডিও ক্লিপ দিলেন। আমি সেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র’ তো দেখিইনি, বরং বক্তাদের বাংলাদেশ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে দেখেছি। আরও দেখেছি যে, তাদের ওপর সংঘটিত নৃশংসতা নিয়ে আহাজারি করেছে। গানে গানে করুণ সুরে নিজেদের যন্ত্রণা ব্যাখ্যা করছে। মিয়ানমারের বিচার দাবি করেছে। নিজ ঘরে ফেরার আকুতি জানাচ্ছে।

মুহিব উল্লাহ যখন লক্ষ্যবস্তু

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহকে নিয়েও বিষেদাগার হয়েছে। তিনি ওই সমাবেশ আয়োজনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন। রোহিঙ্গা নেতাদের মধ্যে সম্ভবত মুহিব উল্লাহ ছাড়া এমন কেউ নেই যিনি একাধারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ব্যপকভাবে জনপ্রিয়, ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন, আবার এই সংকট অসহিংস কায়দায় সমাধানের পক্ষে। স্বাভাবিকভাবেই চরমপন্থী রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর কাছে তিনি চক্ষুশূল। এমনকি এ কারণে হত্যার হুমকিও তাকে পেতে হয়েছে।

অথচ, এই সমাবেশের পর বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে ভারতের অখ্যাত একটি সংবাদ সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হলো, মুহিব উল্লাহ পাকিস্তানের একটি সংগঠন থেকে অর্থ পেয়েছেন; যদিও এই অভিযোগের পক্ষে কোথাও কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।

মুহিব উল্লাহকে বিতর্কিত করতে হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সেই আলোচিত বৈঠকের প্রসঙ্গও উঠানো হলো। আপনারা নিশ্চয়ই স্মরণ করতে পারবেন, ‘প্রিয়া সাহা অধ্যায়ে’র কারণে ওই সভা বাংলাদেশে বেশ আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিল। ওই সভায় মূলত বিশ্বজুড়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পক্ষে সেখানে মুহিব উল্লাহ হাজির ছিলেন।

ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু অত্যাচার নিয়ে প্রিয়া সাহা নালিশ জানিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। ফলে অনেকে ধরে নেন যে, মহিব উল্লাহও সম্ভবত সেখানে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বলে এসেছে। কিন্তু আদতে বিষয়টি ছিল উলটো।

কোনো এক টিভিতে প্রশ্ন উঠানো হলো, মুহিব উল্লাহ যে যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন, তিনি পাসপোর্ট পেলেন কোথায়? রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের মান-ইজ্জত নষ্ট করে আসে, এমন পোক্ত ধারণা অনেকের মধ্যে কাজ করে। ফলে মুহিব উল্লাহও দুই নম্বরি করে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেছেন, এটাই আকারে ইঙ্গিতে বলা হলো।

এ ধরণের অদ্ভুত যুক্তি কী করে একজন সাংবাদিকের পক্ষে তোলা সম্ভব জানি না। অন্তত একজন সাংবাদিকের জানা থাকার কথা যে, পাসপোর্টই একমাত্র ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ নয়। পাসপোর্ট ছাড়াও রাষ্ট্রহীন মানুষরা অন্য দেশের সরবরাহকৃত ‘ট্রাভেল ডকুমেন্ট’ নিয়ে বিদেশে ভ্রমণ করতে পারেন। যেমন, এ ধরণের একটি ডকুমেন্ট হলো লেসে পাসে (laissez-passer)। নির্বাসিত সাংবাদিক তাসনিম খলিলের একটি পোস্টে এ ব্যাপারে আরও ব্যাখ্যা আছে।

যদি ওই সাংবাদিক ভদ্রলোক কোনো অকাট্য প্রমাণ হাজির করতেন যে, মুহিব উল্লাহ বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়েছেন, তাহলে আমার কোনো বক্তব্য থাকতো না। কিন্তু প্রমাণ যেহেতু নেই, সেহেতু এ ধরণের অনুমানভিত্তিক বক্তব্য দেওয়ার কী দরকার ছিল?

এই প্রতিবেদন পরবর্তীতে আরও বহু টিভি, পত্রিকা ও ডিজিটাল আউটলেটে প্রচারিত হয়েছে। কেবল একটি টিভির প্রতিবেদনই ফেসবুকে শেয়ার হয়েছে ৩৫ হাজারের মতো; মোট তাহলে কত হবে তা কল্পনাও করতে পারছি না।

বাংলাদেশের মানুষের একটি পোক্ত ধারণা যে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যায়; গিয়ে অপকর্ম করে, কলঙ্ক পড়ে বাংলাদেশের। এই ধারণা কিছুটা সত্য হলেও, পুরোটা নয়।

রোহিঙ্গাদের দোষ দিতে গিয়ে আমাদের কর্তৃপক্ষ ও পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেমের দুর্বলতা অনেকে অগ্রাহ্য করেন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, রোহিঙ্গারা আসার পর বাংলাদেশ সরকার তাদের বায়োমেট্রিক ডেটা সংগ্রহে রেখেছিল। পাসপোর্ট নেওয়ার ক্ষেত্রেও বায়োমেট্রিক ডেটা দিতে হয়। তাহলে রোহিঙ্গাদের ডেটা ক্রসচেক করলেই কিন্তু তাদের আবেদন বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তাহলে গলদ আসলে কোথায়?

বস্তুত, রোহিঙ্গাদের ওপর মানুষের বিদ্যমান ক্রোধকে উস্কে দিতে ওই প্রতিবেদনটি সফল হয়েছে।

মুহিব উল্লাহর ওই হোয়াইট হাউজ সভা নিয়ে আরও বিতর্ক তোলা হয়েছে এই ইঙ্গিত দিয়ে যে, প্রিয়া সাহা যেহেতু ওখানে গেছেন ‘ষড়যন্ত্র করতে’ আর দেশের নাম ডুবাতে, মুহিব উল্লাহও সে কারণেই সেখানে গিয়েছেন। কিন্তু সভার ভিডিও ক্লিপ যদি আপনি দেখে থাকেন, তাহলে দেখবেন, সেদিন মুহিব উল্লাহ বাংলাদেশ নিয়ে একটি কথাও বলেননি। বরং ট্রাম্পকে বলেছেন, “আমাদের নিজ বাসভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য সহায়তা করুন।” তাঁর এই বক্তব্য কিন্তু তাদের প্রতিও এক ধরণের চপেটাঘাত যারা কিনা মনে করেন, রোহিঙ্গারা নিজেদের বাড়িঘরের বদলে এই শরণার্থী শিবিরেই থেকে যেতে চায়।

এনজিও-নামা

রোহিঙ্গা সংকটের পর এনজিওদের ভূমিকা শতভাগ বিশুদ্ধ ছিল, এমন কথা আমি বলবো না। এই যুক্তির মধ্যেও কিছুটা সত্যতা আছে যে, এই সংকটকে এক ধরণের ‘ধান্ধা’য় পরিণত করেছে এনজিওগুলো।

ত্রাণের অপেক্ষায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ
ত্রাণের অপেক্ষায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ | ছবি: ডিএফআইডি/ফ্লিকার

কিন্তু এ কথাও মিথ্যে নয় যে, রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা, ধর্ষণ ও নৃশংসতার শিকার নারীদের স্বাস্থ্য, শরণার্থীদের খাদ্য সহায়তা ও সর্বোপরী বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সচেতনতা সৃষ্টিতে এই এনজিও ও মানবতাবাদী সংগঠনগুলোর ব্যাপক অবদান রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় গণমাধ্যমে এনজিওদের নিয়ে খুবই নোংরাভাবে আক্রমণ করা হয়েছে। এমন অভিযোগও করা হচ্ছে যে, এনজিওসমূহ নিজেদের স্বার্থেই সংকট দীর্ঘায়িত করছে।

কেউ কেউ আবার বাংলাদেশ-মিয়ানমারের প্রত্যাবর্তন উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের সম্মত না হওয়ার পেছনে এনজিওদের ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে। বিশেষ করে, রোহিঙ্গারা ইংরেজি প্ল্যাকার্ড ও পোস্টার ব্যবহার করে প্রতিবাদ করায় এই ধারণা পোক্ত হয়েছে।

এসবের পেছনে এনজিও ও মানবতাবাদী সংগঠনগুলোর ভূমিকা থাকা অসম্ভব নয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের না যেতে উদ্বুদ্ধ করার অর্থ যে সংকট দীর্ঘায়িত করতে চাওয়া, এমনটা না-ও হতে পারে।

‘রোহিঙ্গারা আরাম-আয়েশে আছে’

একদিকে এনজিওদের যেমন দায়ী করা হচ্ছে, তেমনি এমন কথাও বলা হচ্ছে যে, রোহিঙ্গারা আরাম-আয়েশ বেশি পেয়ে গেছে; এ কারণেই তারা ফিরতে চাচ্ছে না। এমন বক্তব্য বেশ নিষ্ঠুর ও অমানবিক।

পৃথিবীর কোনো শরণার্থী ক্যাম্প কারও নিজ গৃহ বা বাসস্থানের বিকল্প হতে পারে না; কক্সবাজারের এই জঘন্য শিবিরগুলো তো নয়ই। নিজেকে প্রশ্ন করুন: পৃথিবীতে এমন কেউ কি আছেন যিনি নিজের ঘরে ফেরত যাওয়ার সুযোগ পেলেও স্বেচ্ছায় প্রচণ্ড জনাকীর্ণ শিবিরে থেকে যেতে চাইবে? আপনি একবার ভাবুন, একজন মানুষ জাতিগত নিধন, নৃশংসতা ও ভয়াবহতা থেকে বেঁচে পালিয়ে আসার পর তিনি কি তার নির্যাতনকারীর ‘প্রতিশ্রুতি’র ভিত্তিতে ফিরেতে চাইবেন?

কেন রোহিঙ্গারা ফিরতে চায় না?

পৃথিবীর কোনো আন্তঃদেশীয় কিংবা বিশ্বাসযোগ্য মানবাধিকার সংস্থাই মনে করে না যে, মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছে। মুখে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা বললেও, দেশটির প্রস্তুতি খুবই সামান্য। আপনি অবাক হবেন জেনে, মিয়ানমার বাংলাদেশকে যেই শর্ত দিয়েছে, তাতে ১০ লাখ শরণার্থীর মধ্যে মাত্র কয়েক হাজার ফিরতে পারবেন। যেমন, শুক্রবারের ওই ব্যর্থ প্রত্যাবর্তনে মোটে সাড়ে ৩ হাজার শরণার্থীর ফেরত যাওয়ার কথা ছিল। আমি বলবো, মিয়ানমারের শর্ত মেনে নিয়ে বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্বল দর-কষাকষি ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে।

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে |
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে | ছবি: ভয়েস অব আমেরিকা/উইকিমিডিয়া

রাখাইনে সেখানকার সরকার মাত্র কয়েকশ’ ছোট ছোট ঘর বানিয়েছে বা বানাচ্ছে। এগুলো এই ১০ লাখ মানুষের জন্য যথেষ্ট তো নয়ই; বরং এসব শিবিরে ফিরে যাওয়ার অর্থ হলো, ফেলে আসা ঘর ও জমিতে রোহিঙ্গারা ফিরতে পারবে না। সংকটের পরপরই রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয় সেনাবাহিনী। সেখানে নতুন নতুন সরকারী স্থাপনা তৈরি হয়েছে

সবচেয়ে বড় কথা হলো, মিয়ানমার এই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি যে, রোহিঙ্গারা ফিরলে তাদের পূর্ণ অধিকার দেওয়া হবে; অথবা, অন্তত ফের এমন কিছু করা হবে না, যার কারণে তাদেরকে নিজ ভূমি ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। এছাড়া নৃশংসতায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করার অভিযোগ আজও মিয়ানমার প্রত্যাখ্যান করছে। তাহলে কোন ভরসায় রোহিঙ্গারা ফিরতে চাইবে?

এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গারা যদি ফিরতে না চায়, আর সেজন্য যদি কেউ রোহিঙ্গাদেরই দোষারোপ করে, তাহলে এই কথা বলা কি সমীচীন নয় যে, তারা ভুক্তভোগীদেরই দোষ দিচ্ছে এবং জেনে বা না জেনে মিয়ানমারেরই পক্ষালম্বন করছে?

‘রোহিঙ্গারা কী খায়?’

আগে যেমনটা বলেছি, আমাদের মিডিয়া এমন এক ইম্প্রেশন তৈরি করে রেখেছে যে, রোহিঙ্গারা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে জনাকীর্ণ শিবিরে খুব আরাম-আয়েশে আছে। সম্প্রতি, আমি একটি মোটামুটি নামকরা একটি সংবাদ আউটলেটে একটি প্রতিবেদন দেখেছি, যা দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। এই প্রতিবেদনের শিরোনাম: ‘রোহিঙ্গারা কী খায়?’

“কি কদর্য একটি প্রশ্ন! গণহত্যা থেকে বেঁচে আসা মানুষগুলি কী খাচ্ছে তার বিবরণও এখন পড়তে হচ্ছে, রোহিঙ্গারা কতো আয়েশী জীবনযাপন (!) করছে তার উদাহরণ হিসেবে। অবশ্য ঐ প্রতিবেদনেই জানা গেলো যে রোহিঙ্গা শরনার্থীরা পোলাও-কোর্মা নয় বরং নরম্যাল চাল-ডালই খাচ্ছে। আর সেটারও যোগান দিচ্ছে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো। এই প্রতিবেদনেই আবার রোহিঙ্গা শিশুদেরও একটি ছবি জুড়ে দেওয়া হয়েছে, হয়তো এরা খাওয়াদাওয়া করে কেমন তেল চকচকে হয়েছে সেটা দেখানোর জন্য,” লিখেছেন তাসনিম খলিল।

রোহিঙ্গাদের ‘পুষতে’ আমাদের খরচ

এ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে, আমাদের মতো দেশে রোহিঙ্গা সংকট মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে। এটাও আমি বুঝতে পারি যে, নাগরিক হিসেবে আমরা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু অনেক সংবাদে ভুতুড়ে সব খরচের অঙ্ক উল্লেখ করা হয়েছে, যার ফলে অনেকের যৌক্তিক উদ্বেগ অযৌক্তিক ক্রোধে রূপ নিয়েছে।

গত সপ্তাহেই যেমন প্রথম শ্রেণির একটি সংবাদ পোর্টালে অজ্ঞাতনামা কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হলো, এই দুই বছরে রোহিঙ্গাদের পেছনে সরকারের ৭২ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে!

এই দাবিকে ইংরেজিতে ব্যাখ্যা করতে বললে, আমি যে শব্দটি ব্যবহার করতাম, তা হলো: ‘বুলশিট!’ প্রথমত, রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণ বাবদ বিপুল বিদেশী অর্থ সহায়তা এসেছে, সেগুলো দিয়েই অনেকটা হয়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এ বছরেরটা জানা না থাকলেও, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের বাজেটে সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য মাত্র ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছিল। সেখান থেকে আরও খানিকটা বেশি খরচ হয়ে থাকতে পারে। যেমন, ভাসানচরে নতুন শিবির বানাতে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে। কিন্তু এ খরচ সরাসরি রোহিঙ্গা শিবিরে হয়নি। আবার বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গাদের জন্য অনুদান হিসেবে ১৪০০ কোটি টাকা দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার ওই নির্ধারিত বাজেটের চেয়ে যত বেশিই খরচ করুক, কোনো অবস্থাতে তার অঙ্ক ৭২ হাজার কোটি টাকার ধারে কাছেও হবে না।

এই অঙ্ক কতটা ভুতুড়ে, তা বুঝতে পারবেন এটার ব্যাখ্যা দিলে। দুই বছরে ৭২ হাজার মানে, এক বছরে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, প্রতি বছর মাথাপিছু রোহিঙ্গার জন্য খরচ হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

যদি বাংলাদেশ সরকার একজন রোহিঙ্গা দূরে থাক, বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের পেছনেও এত টাকা খরচ করতো, তাহলে সংখ্যাটা দাঁড়াবে ৫৫ লাখ কোটি টাকা, যা কিনা বাংলাদেশের বর্তমান বছরের বাজেটের ১৩-১৪ গুণ! সুতরাং, বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কতটা হাস্যকর! স্পষ্টতই, যারাই এই কাল্পনিক সংখ্যা বের করেছেন, তারা ঠিকঠাক অংক কষে দেখারও প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ওই প্রতিবেদন অসংখ্য মানুষ ফেসবুকে শেয়ার করেছেন; নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। ফলে এতটুকু বলতে পারি যে, মানুষকে আরও ক্ষুদ্ধ করে তুলতে প্রতিবেদনটি সফল হয়েছে।

Rohingya walk toward a refugee camp in Shah Porir Dwip on Sept. 14. Dar Yasin—AP

রোহিঙ্গা সংকটে আমাদের ‘লাভ’

শুনতে অদ্ভুত শোনালেও, এই সংকটের কারণে আমাদের অর্থনৈতিক লাভ হয়েছে অবিশ্বাস্য। প্রচুর মানুষের চাকরি ও কর্মসংস্থান তো হয়েছেই; অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে তা সহায়ক হয়েছে। সাংবাদিক মুশফিক ওয়াদুদ যেমন খুঁঁজে বের করেছেন ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন। এতে ট্যুরিস্ট পুলিশের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে ২০১৬ সালে যেখানে স্থানীয় পর্যটকের সংখ্যা ছিল সাকুল্যে ৯০ হাজার, ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখে! অর্থাৎ প্রায় ৪০০ গুণ বৃদ্ধি!

ঠিক তেমনি, ২০১৬ সালে মাত্র ১৬ হাজার বিদেশী পর্যটক এলেও, ২০১৭ সালে এসেছিল ১ লাখ ৬ হাজার; প্রায় ১০ গুণ বৃদ্ধি। শুধু তাই নয়, মুশফিক ওয়াদুদ লন্ডন-ভিত্তিক সিইআইসি’র উপাত্ত বের করে দেখিয়েছেন, ১৯৯৫ সালের পর বাংলাদেশে প‌র্য‌টন খাত থেকে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব এসেছে ২০১৭ সালে; ৩৪৪ মিলিয়ন মা‌র্কিন ডলার বা প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।

২০১৬ সালে যখন গুলশান হামলার কারণে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সংকটে, তখন ঠিক পরের বছর কী এমন হয়েছিল যার কারণে এত পর্যটক বাংলাদেশে ঘুরতে এল? একটা ঘটনাই এখানে উল্লেখযোগ্য, তা হলো ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা এসেছিল।

মুশফিক আরও লিখেছেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে ২০১৬-২০১৭ অ‌র্থবছরে বৈদেশিক সাহায্য ছিল ৩৫৬৩.৬ মিলিয়ন মা‌র্কিন ডলার । ২০১৮-২০১৯ অ‌র্থ বছরে বৈদেশিক সাহায্য আসছে ৬১২৫.৫ মিলিয়ন মা‌র্কিন ডলার। অর্থাৎ, প্রায় দ্বিগুন। এই দ্বিগুন এমন সময় হয়েছে যখন বিশ্বব্যাপী বিদেশী সাহায্যের খারাপ অবস্থা। আমরা দ্বিগুন যে টাকা-পয়সা পাচ্ছি সেটা রোহিঙ্গাদের কারণেই।”

রোহিঙ্গারা ‘অপরাধী’

রোহিঙ্গারা অপরাধী – এমন বক্তব্য, প্রতিবেদন ও মন্তব্যে ফেসবুক সয়লাব। এটি একটি খুবই প্রচলিত জেনোফোবিক বা বিদেশী-বিদ্বেষী বক্তব্য, বিশেষ করে শরণার্থী ও অভিবাসীদের ক্ষেত্রে। এমনকি তুলনামূলকভাবে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমগুলোও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শরণার্থী শিবিরের ‘আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি’ নিয়ে কথা না বলে পারে না।

ওইদিন আরেক সাংবাদিক বন্ধু, বার্তাসংস্থা এএফপি’র ব্যুরো চীফ শফিকুল আলম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিলেন। স্থানীয় পুলিশের বরাতে তিনি জানালেন যে, গত দুই বছরে রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে ৩৮টি ও বাইরের ৫টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ, বছরে ১০-১১ লাখ জনসংখ্যায় বা মিলিয়ন-প্রতি ২১-২২টি খুনের সঙ্গে রোহিঙ্গারা সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের মিলিয়ন-প্রতি খুনের হার এর চেয়ে বেশি, বৈ কম নয়।

নিউ এইজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পুলিশের অভ্যন্তরীন প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সম্পর্কিত ৩৫৩টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একজন বিশ্বস্ত সাংবাদিক বন্ধু একই প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, একই সময়ে স্থানীয়দের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার অভিযোগ দায়ের হয়েছে এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। (এ সম্পর্কিত আনুষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া মাত্রই এখানে হালনাগাদ করে দেওয়া হবে।)

রোহিঙ্গারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এটিও একটি বাড়িয়ে বলা হয়। সত্যি কথা বলতে কি, বাংলাদেশে মাদক নিয়ে আলোচনাটাই একটু একপেশে। রোহিঙ্গারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, এটা সত্য, যেমনটা বাংলাদেশীরাও জড়িত। তবে সরকারের বেশ কয়েকটি সংস্থা প্রভাবশালী মাদক ব্যবসায়ীদের যেসব তালিকা করেছে, সেখানে কক্সবাজারের স্থানীয়রাই বেশি।

এটিও স্বীকার করতে হবে, স্থানীয়দের মতো রোহিঙ্গারাও মাদক বহনকারী হিসেবে কাজ করে। কিন্তু দেশে ইয়াবার প্রসারের জন্য রোহিঙ্গাদের দায়ী করাটা কিছুটা অনায্য। তারা হলো একটি জটিল ও লম্বা চেইনের ছোট্ট একটি অংশ মাত্র। রোহিঙ্গাদের দায়ী করার মধ্য দিয়ে আরও গুরুতর ফ্যাক্টরগুলো অগ্রাহ্য করা হয়, যেমন: মিয়ানমারের সঙ্গে কক্সবাজারের ভৌগোলিক নৈকট্য, মাদকের চাহিদা, আইন শৃঙ্খলা ও সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর ব্যর্থতা, শরণার্থী শিবিরে কর্মসংস্থানের অভাব ও দেশজুড়ে নেটওয়ার্ক পরিচালনা করার মতো সক্ষম প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ততা।

সারাদেশে মাদক ব্যবসা করার মতো পুঁজি, নেটওয়ার্ক, প্রভাব — এর কোনোটিই রোহিঙ্গাদের নেই। তারা বড়জোর স্বল্প বেতনভোগী বাহক ও ক্ষেত্রবিশেষে ছোটখাটো ব্যবসায়ী, কিন্তু রাঘব বোয়াল কিন্তু আমরা বাংলাদেশীরাই।

Hanida Begum kisses her infant son_ Abdul Masood_who died when their boat capsized near shore in Shah Porir Dwip_ Bangladesh_ on Sept 14_ Dar Yasin—AP

আরও যেসব রোহিঙ্গা বিদ্বেষী বক্তব্য

অন্যান্য যেসব জেনোফোবিক বা বিদেশী-বিদ্বেষী বক্তব্য আমি দেখতে পেয়েছি, তার মধ্যে একটি হলো রোহিঙ্গারা বর্বর, অশিক্ষিত, আর সন্তান জন্ম দেয় একেবারে গরু-ছাগলের মতো। মিয়ানমার বাহিনীর হাতে ধর্ষণের শিকার অসংখ্য রোহিঙ্গা মায়ের জন্য এমন বক্তব্য ভীষণ নিষ্ঠুর ও অমানবিক।

এই বক্তব্য কিছুটা কৌতুককরও শোনালো আমার কাছে। রোহিঙ্গাদের ‘উচ্চ জন্মহার’ নিয়ে সমালোচনা করছে বাংলাদেশীরা, যারা কিনা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশের নাগরিক। কেউ আবার দাবি করেন রোহিঙ্গারা স্বাগতিক সম্প্রদায়ের প্রতি অকৃতজ্ঞ, তাদেরকে হটিয়ে নিজেরা কর্তৃত্ব নিতে চান, তাদেরকে খেদিয়ে বিদায় করতে চান। এটিও একটি সার্বজনীন জেনোফোবিক ধারণা। যেমন, একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদ আউটলেটে রোহিঙ্গাদের ‘বিষফোঁড়া’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যেটিকে ‘ধ্বংস’ করতে হবে। এভাবেই রোহিঙ্গাদের ‘ডিহিউম্যানাইজ’ বা অমানুষ হিসেবে উপস্থাপন করে বড় ধরণের অঘটনের প্রেক্ষাপট প্রস্তুত করা হচ্ছে।

দুঃখের বিষয় হলো এ ধরণের বিদ্বেষসূচক ভীতি-জাগানিয়া বক্তব্যের কারণে অনেকেই প্রভাবিত হচ্ছে। একসময় যেই মানুষজন রোহিঙ্গাদের উষ্ণভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, তারাই এখন তাদের প্রতি ক্ষুদ্ধ হচ্ছে। অথচ, এদের মধ্যে খুব কমই হয়তো শিবিরে দেখতে গেছে বা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিশেছে। মিডিয়া কীভাবে মানুষের মানবিক প্রবৃত্তিকে বিদ্বেষে পরিণত করতে পারে, তার উদাহরণ হয়ে থাকবে এসব ঘটনাবলী।

এ নিয়ে কারোই দ্বিমত নেই যে যত দ্রুত সম্ভব শরণার্থীদের প্রত্যাবসন করাতে হবে। খোদ রোহিঙ্গারাও এ নিয়ে একমত। কিন্তু বাস্তবতা হলো, পরিস্থিতির ওপর রোহিঙ্গাদের কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। সুতরাং, তাদেরকে দায়ী করা বা স্থানীয় জনগণকে তাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হলে কেবল ভয়ানক কোনো বিপদ ছাড়া ইতিবাচক কিছুই হবে না।

স্থানীয়দের উদ্বেগ

এটি অস্বীকার করার জো নেই যে, শরণার্থী শিবিরের আশেপাশের মানুষজন প্রকৃত অর্থেই হতাশ। তারা এখন সেখানে সংখ্যালঘু, ফলে তারা হুমকি বোধ করছেন। রোহিঙ্গারা যখন অল্প অল্প করে আসতে থাকলো, অনেক স্থানীয় লোকজন নিজেদের চাষের জমিতে তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। এখন এই অতিথিরা যেতে চাইছেন না বা পারছেন না।

এই সংকটের কারণে বহু এনজিও ও বেসরকারী সংস্থা কক্সবাজারে এসেছে। এসব সংগঠনে স্থানীয়রা চাকরি পান না বলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। এছাড়া, বিভিন্ন পণ্য, ভাড়া ও জীবনধারণের ব্যয় ব্যপকভাবে বেড়ে গেছে।

এই উদ্বেগ নিরসনের ভালো পন্থা হতে পারে, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায়, বিশেষ করে যেসব সিদ্ধান্তের কারণে স্থানীয়দের ভালোমন্দ নির্ভর করছে, সেসব ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা। সরকার ও এনজিওরা যথোপযুক্ত পদে স্থানীয়দের প্রাধিকার দেওয়ার নীতি প্রনয়ণ করতে পারে। স্থানীয় সূত্র থেকে জিনিসপত্র ক্রয়ের ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে। যেসব রোহিঙ্গা স্থানীয়দের জমিতে এখনও বসবাস করছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে শিবিরে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

আমরা যখন শরণার্থী ছিলাম

আমরা সবাই জানি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে অবস্থান করেছিলেন। মাত্র ৫-৬ মাসের মাথায় আমাদের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছিল।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাত সাংবাদিক সিডনি শনবার্গের লেখা তখনকার একটি প্রতিবেদন এখন অনেকে শেয়ার করেছেন। ‘Bengali Refugees Stirring Strife in India‘ (ভারতে অসন্তোষ জাগিয়ে তুলছেন বাঙালি শরণার্থীরা) শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে তখনকার বাঙালি শরণার্থীদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজ ওই প্রতিবেদন অনুবাদ করেছেন। আমি সকলকে বলবো এই প্রতিবেদন পড়ে দেখতে, যেন আমরা আমাদের পূর্বসুরিদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শরণার্থীদের মর্মবেদনা অনুধাবন করতে পারি।

চিন্তা করুন, ওই অবস্থায় যদি পাকিস্তানি জান্তা আমাদের ফেরত নিতে চাইতো, আর ভারত সেই অনুযায়ী আমাদের চাপ দিতো, তাহলে আমাদের কেমন লাগতো? আমরা কি পাকিস্তানি সামরিক গোষ্ঠীর কথায় আশ্বস্ত হতাম?

A Raghu Rai photo of a refugee camp during 1971.

উপসংহার

আমাকে যেই জিনিসটি সবচেয়ে কষ্ট দিয়েছে, তা হলো, আমরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ঠিক সেভাবেই আচরণ করছি, যা পশ্চিমের বর্ণবাদীরা আমাদের মতো অভিবাসীদের সঙ্গে করে থাকে।

যখন উগ্রডানপন্থী পশ্চিমা কোনো রাজনীতিক বা বিদ্বেষ-ছড়ানো সংবাদমাধ্যম আমাদের মতো অভিবাসী ও সংখ্যালঘুদের নিয়ে গালিগালাজ করে, তখন আমরা বিস্ময়ে হতবিহবল হয়ে যাই। যখন লিবিয়া বা থাইল্যান্ডে বা অন্য কোনো বিদেশী কারাগার বা বন্দীশিবিরে আমাদের মানুষজন পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়, কিংবা ভূমধ্যসাগর বা বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মারা যায়, আমরা শোকাহত হই। আমরা হলাম এমন এক দেশের নাগরিক, যেটির অর্থনীতিতে বড় জোগান দিয়ে আসছে লাখ লাখ অভিবাসী, যারা বিদেশ-বিভূইয়ে বৈধ-অবৈধভাবে টিকে আছেন।

কিন্তু আজ যখন নির্যাতিত মানুষজনকে আশ্রয় দিতে হচ্ছে আমাদের, তখন সেই আমরাই নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দ্বিধা করছি না। আমরা যেই মানবিক চেতনায় বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মানুষকে স্বাগত জানিয়ে অনুপম নজির সৃষ্টি করেছিলাম, আসুন আমরা সেই চেতনাকে বিনষ্ট না করি।

(এই নিবন্ধ নেয়া হয়েছে নাজমুল আহসানের ওয়েবসাইট থেকে। এই নিবন্ধের সংক্ষিপ্ততর একটি ইংরেজি সংস্করণ ডেইলি স্টার পত্রিকার উইকেন্ড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।)

  • নাজমুল আহসান, সাংবাদিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *