ইতিবাচকতার রাজনীতি

  • রাখাল রাহা

একটা দেশ বা তার জনগোষ্ঠীর সর্বনাশ করার অনেক অনেক পথ থাকে। তার মধ্যে সবচেয়ে যেটা সূক্ষ এবং কার্যকর তা হলো মহততার পথ। বাংলাদেশে এ সময়ে সকল সর্বনাশ করা হচ্ছে মহৎ পথ দেখিয়ে। সেই মহৎ পথ নির্মাণের ক্ষেত্রে যে রাজনীতিটা কাজ করছে তাকে আমরা বলতে পারি ইতিবাচকতার রাজনীতি। এই রাজনীতি নির্মাণ হচ্ছে ইতিবাচক প্রপঞ্চ থেকে। ইতিবাচক প্রপঞ্চ আসলে কি? একটা বিশেষ সময়ে মানুষ হিসাবে আমাদের যে কিছু আবশ্যকীয় চাহিদা থাকে, বিশেষ কিছুর প্রতি আগ্রহ বা ভালোলাগা তৈরী হয়, খেয়াল করলে দেখা যাবে, সেগুলোর ক্ষেত্রে একটা সাধারণ ঐক্যও তৈরী হয়। এরকম সাধারণ ঐক্য তৈরী হওয়া কোনো বস্তুগত বা অবস্তুগত চাহিদা কিংবা আকাঙ্ক্ষা বা ভালোলাগা নিয়ে যখন কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র তার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করে তখনই সেগুলো হয়ে ওঠে সেই বিশেষ সময়ের সেই সমাজ বা রাষ্ট্রের ইতিবাচক প্রপঞ্চ।


কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর ইতিবাচক প্রপঞ্চ যেমন বিশেষ রকম হতে পারে, আবার হতে পারে একটা বিশেষ সময়ে একটা প্রপঞ্চ, দেশ-জাতি নির্বিশেষে, প্রায় গোটা পৃথিবী জুড়েই সর্বজনীন। যেমন, সবাই এখন তার ছেলেমেয়েকে পড়ালেখা শেখাতে চায়, সবাই এখন নারীশিক্ষা বা নারীর কর্মসংস্থান বিষয়ে ভাবে, সবাই বিদ্যুৎ বা দ্রুত যোগাযোগ চায়, ইত্যাদি। এগুলো এখন একেবারে চায় না—এমন সমাজ বা জনগোষ্ঠী খুব একটা পাওয়া যাবে না। তাই এসব ইতিবাচক প্রপঞ্চের সাধারণ ঐক্যকে ভিত্তি করে একটা বিশেষ সময়ের সমাজপতি বা রাষ্ট্রপতিরা দেশে দেশে সেগুলো পূরণ-আয়োজনের জন্য নানা ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দেশ বা সমাজের অগ্রগতির স্বার্থে অনেকসময় তারা আবার নানা ধরণের ইতিবাচক প্রপঞ্চ নির্মাণেও বিভিন্ন রকম নীতিকৌশল প্রয়োগ করে থাকেন।


রাজনীতিটা শুরু হয় ঠিক এখান থেকেই। উল্লেখ্য, এই আলোচনায় রাজনীতি একটা নেতিবাচক প্রপঞ্চ। যেহেতু ইতিবাচক প্রপঞ্চগুলোর প্রতি একটা নির্দিষ্ট সমাজে সাধারণ ঐক্য থাকে, সে-কারণে এর বাস্তবায়ন-উদ্যোগগ্রহণকারীরা নিশ্চিত থাকেন যে, কিছু ছোটখাটো বাধার সম্মুখীন হলেও উদ্যোগগুলো এগিয়ে যাবেই। কিন্তু যেটা বিপজ্জনক তা হচ্ছে, সামাজিক এই নিশ্চয়তা নির্মাণের ধরণ বুঝে কোনো শক্তি বা সমাজপতি বা রাষ্ট্রপতি সেই প্রপঞ্চগুলো পূরণ-আয়োজনের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে দূরবর্তী রাজনৈতিক পরিকল্পনার সর্বনাশা ছক কষতে পারেন, হীনস্বার্থ চরিতার্থের ভয়াবহ হিসাব সাজাতে পারেন। উপরন্তু যদি কোনো প্রপঞ্চ এমন হয় যে, সমাজে তার ইতিবাচকতার কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থান প্রায় একচ্ছত্র, তবে সেটার প্রাপ্তি থেকে মানুষকে বঞ্চিত রেখে তাদের যতো ক্ষতি আর হীনস্বার্থ চরিতার্থের পরিকল্পনা করা যায়, উল্টো সেটাকে দেওয়ার আয়োজনের মাধ্যমে তার চেয়ে বহুগুণে বেশী ক্ষতিসাধন ও স্বার্থসিদ্ধির পরিকল্পনা শানানো যায়।


বর্তমান বিশ্ব-উন্নয়ন-রাজনীতির নিয়ন্ত্রক দেশসমূহ বাদে সকল অনুগামী দেশসমূহ, তাদের সরকার এবং এসব দেশের প্রায় সকল ধরণের প্রতিষ্ঠান মূলত এই ইতিবাচকতার রাজনীতি দ্বারা চালিত। এদের প্রায় সকল ধরণের উদ্যোগ-আয়োজনকেই এটা দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের মতো চরম অরাজক দেশগুলোর ক্ষেত্রে যেটা ঘটে, এর দুর্বৃত্ব শাসকশ্রেণী ইতিবাচক প্রপঞ্চ নির্মাণেও একচ্ছত্র ভ‚মিকা রাখতে পারে না। ফলে ধর্ম, গোত্র, জাতি, পেশা, অঞ্চল, লিঙ্গ ইত্যাদি ভিত্তিক সমাজের বহু বহু পক্ষ যার যার সুবিধা অনুযায়ী প্রপঞ্চ গ্রহণ করে, কিংবা নিজেদের মতো করে সমাজে ইতিবাচকতা নির্মাণ ক’রে কায়কারবার ক’রে চলে। এই সবাকার সম্মিলিত কারবারের সামষ্টিক ফলাফল হিসাবে এখানে মানুষের যা প্রাপ্তি ঘটে তা হচ্ছে, প্রাণান্ত আলোর মাতম করে করে ভোগান্তির অন্ধকারে ক্রমশ নিমজ্জিত হয়ে চলা। আমরা সেখানেই চলছি।


উদাহরণ হিসাবে একটা প্রপঞ্চ নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কথা বলা যাক। ধরা যাক শিক্ষা। নিঃসন্দেহে যে-কোনো সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য এটা একটা ইতিবাচক প্রপঞ্চ। কিন্তু শিক্ষার রাজনীতি এই শব্দগুচ্ছ শুনলে প্রথমে আমাদের যেটা মনে আসে তা হলো শাসনের সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থা সাজানো, যেটা ব্রিটিশ শাসকেরা এদেশে করেছিল : শিক্ষা নিয়ে আমরা যেন চেহারা-সুরতে বাঙালী থাকি, আর আচার-আচরণে ও মনে-মননে ব্রিটিশ হতে চাই এবং নিজের যা কিছু আছে সবটাকে খারাপ ভাবতে শিখি। দ্বিতীয় যেটা মনে আসে তা হলো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে এমনভাবে বিভাজন তৈরী করা, যাতে করে সেই বিভাজনের ফলাফল শাসনের সহায়ক হয় এবং শাসকের নিজের শ্রেণী তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, যেটা স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা হয়েছে : ইংরেজী মাধ্যম, বাংলা মাধ্যম, স্কুল মাধ্যম, কিণ্ডারগার্টেন মাধ্যম, কওমী মাধ্যম, এবতেদায়ী মাধ্যম বা সম্প্রতি চালু হওয়া ইংলিশ ভার্শন—এর প্রত্যেকটার মধ্যেই আবার অনেক রকম ভেদ-বিভেদ রাখার মাধ্যমে প্রজন্মের বেড়ে ওঠা, রুচিসংস্কৃতি ও চিন্তাপদ্ধতিকে এমনভাবে বিভাজিত করা যাতে করে এদের মধ্যে কখনো কোনো বিষয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা হতে না পারে।


শিক্ষার এই দুই ধরণের রাজনীতি নিয়ে অনেক লেখাজোকা ও গবেষণা পাওয়া যাবে এবং চারপাশে এগুলোর আলোচনাই হামেশা শোনা যায়। এই দুটো রাজনীতির বাইরের তৃতীয় আরেকটা রাজনীতি নিয়ে আমরা বলার চেষ্টা করছি।


যেটা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, চাহিদার বিষয় হিসাবে শিক্ষা যে-কোনো সমাজে অন্যতম কাক্সিক্ষত প্রপঞ্চ। এটা শুধু চাহিদা নয়, এর প্রতি মানব সমাজের রয়েছে দীর্ঘকালের শ্রদ্ধা ও ভক্তি। পাশাপাশি শিক্ষার শক্তি প্রচলিত মূল্যবোধে ধাক্কা দেয় বিধায় এর প্রতি সমাজের নানা স্তরে কমবেশী ভীতিও কাজ করে। কিন্তু সার্বিকভাবে এটা হলো সেই প্রপঞ্চ, যার প্রতি ভয় থেকে কেউ বিরোধীতা করলেও তাদের প্রতি সামাজিক-সামষ্টিক নেতিবাচক দৃষ্টি অজান্তে তাদেরকেই ভিতর থেকে দুর্বল করে তুলতে থাকে। ফলে অনেকসময় শিক্ষা বিস্তার হয়ে পড়ে সমাজের অন্য সকল ইতিবাচক প্রপঞ্চের বিস্তার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং এককভাবে কর্তৃত্বপরায়ণ। তখন ব্যাপারটা অনেকসময় এমন হয়ে দাঁড়ায় : কাজ নেই, তো শিক্ষা নাও! স্বাস্থ্য নেই, তো শিক্ষা নাও! এমনকি ভাত নেই, তাও শিক্ষা খাও! অর্থাৎ যা-কিছুই না থাক, যেখানে-যতো সমস্যাই থাক, শিক্ষা গিলে ফেলো, এতেই সব সমাধান! এ পর্যায়ে শিক্ষা হয়ে ওঠে তেমনই এক কর্তৃত্বপূর্ণ ইতিবাচক প্রপঞ্চ, যে বিষয়ে ইতিপূর্বে বলা হলো, এরকম ক্ষেত্রে তার প্রাপ্তির সুযোগ থেকে মানুষকে বঞ্চিত রেখে তাদের যতো ক্ষতি আর হীনস্বার্থ চরিতার্থের পরিকল্পনা করা যায়, উল্টো তাকে তা দেওয়ার উদ্যোগ-আয়োজনের মাধ্যমে তার চেয়ে বহুগুণে বেশী ক্ষতিসাধন ও স্বার্থসিদ্ধির পরিকল্পনা শানানো যায়।


কিভাবে সেটা করা যায়? একটা সমাজে শিক্ষা না থাকাটা একটা সমস্যা, কিন্তু যেনতেন শিক্ষা বিস্তার বহু বহু সমস্যার উৎস। তদুপরি এ ধরণের শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে যদি তার উপযোগী সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন না করা হয়, কিংবা যদি পরিকল্পিতভাবে উল্টোটা করে তোলা যায়, তবে পূর্বের অশিক্ষা থেকে সেই সমাজের যতখানি ক্ষতিসাধন করে স্বার্থ হাসিল করা যাচ্ছিল, পরের তথাকথিত শিক্ষা দিয়ে তার থেকে অনেক অনেক বেশী ক্ষতি যেমন সাধন করা যায়, তেমনি বহুগুণ বেশী স্বার্থসিদ্ধি লাভও সম্ভব হয়।

বর্তমান বাংলাদেশে শিক্ষাসহ, যোগাযোগ, প্রযুক্তি ইত্যাদি এমনই একচ্ছত্র সব ইতিবাচক প্রপঞ্চ। দীর্ঘদিন ধরে নার্সিং করে করে এগুলোকে গড়ে তোলা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই তাই এগুলোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের ভয়াবহ মানবিক ধ্বংসসাধন ও দানবীয় স্বার্থসিদ্ধির মচ্ছব চলেছে। আজ যদি সরকার বলে, আরেকটা পদ্মাসেতুর জন্য তার আরো অর্ধ-লক্ষ কোটি টাকা লাগবে, তবে এই প্রপঞ্চের কর্তৃত্বের কারণেই জনমনে পদ্মাসেতু যতো বড়ো, তার চেয়েও বিশাল এক প্রাপ্তির প্রতীক হয়ে আশু ভোগের সম্ভাবনায় সে উদ্বেলিত হয়ে উঠতে পারে। এটার ভিত্তি হিসাবেও কাজ করে কর্তৃত্বপূর্ণ প্রপঞ্চ শিক্ষার যেনতেন বিস্তার। এভাবেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল খাতের সকল প্রান্তই আজ ভয়াবহরকমভাবে এই ইতিবাচকতার রাজনীতি দ্বারা আক্রান্ত। রাষ্ট্রীয়-বিরাষ্ট্রীয়, পরিবার-গোষ্ঠী বহু অক্টোপাসের বহু বহু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এর ফায়দাভোগী।


এই যে ইতিবাচকতার রাজনীতি, এর মাষ্টার পরিকল্পক হিসাবে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও শক্তি বিভিন্ন নামে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজ করে। আমাদের মতো জংলী রাষ্ট্রের সরকার ও শাসকশ্রেণী, সে নির্বাচিত-অনির্বাচিত বা দখলদার যেটাই হোক, তাদের সেই মাষ্টার পরিকল্পনার বাইরে যাওয়ার সুযোগ যেমন সীমিত থাকে, তেমনি এর বাইরে গিয়ে অধিক ফায়দা লাভের সুযোগও কম হয়। তাই এরা এই রাজনীতির স্বতঃস্ফূর্ত কর্তৃত্বে ক্রমবর্ধমান হারে সৃষ্ট ফায়দা ধারাবাহিকভাবে ভোগ করতে সবসময় উন্মত্ত হয়ে মুখিয়ে থাকে। তাদের সেই উন্মত্ততার ধরণ এমনই যে, সে তার নিজের শ্রেণীর বিপক্ষকেও এর ন্যূনতম ভাগ দিতে রাজী থাকেন না, বাধ্য না হলে। আর অন্যদিকে সাধারণ মানুষের পক্ষে ইতিবাচক প্রপঞ্চের কর্তৃত্ব বোঝার বা প্রত্যাখ্যানের শক্তি যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে থাকে না, তাই সে তার আকাঙ্ক্ষার ভারে ভারে নিজেই ক্রমাগতভাবে দমবন্ধ অবস্থার দিকে নিমজ্জিত হতে হতে তলিয়ে যেতে থাকে।

বাংলাদেশ আজ এক দমবন্ধ অবস্থার মধ্যে। একটা অসুস্থ সমাজের অসুস্থতাগুলোরও একটা সাধারণ ভারসাম্য থাকে। অসুস্থতার সেই ভারসাম্য নিয়ে সেই সমাজটা ধুঁকে ধুঁকে হলেও একরকমভাবে চলতে থাকে। কিন্তু ইতিবাচকতার রাজনীতি আজ জন্মপ্রতিবন্ধী বাংলাদেশের সকল অসুস্থতার ভারসাম্যও ভেঙে ফেলেছে। এ এক অভাবনীয় কাল!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *