বাইবেলের এক্সোডাস প্রসঙ্গ এবং কুকুর সমাচার

  • কাজী তাফসিন

And The LORD spoke to Moses, “Go to Pharaoh and say to him, ‘Thus says the LORD: Let My people go, that they may serve me.
“But if you refuse to let them go, behold, I will smite your territory with frogs.

(Exodus 8:1-2, Holy Bible, New King James Version)

নৃবিজ্ঞানী ব্রুনো লাতুরকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো যে আপনি নিয়মিত চার্চে যান কেন; তখন তিনি এরকম একটা উত্তর দিয়েছিলেন যে, বাইবেলের সাথে পরিচয় থাকার কারণেই তার টেক্সটের অর্থ খোঁজার আগ্রহটা তৈরি হয়েছিলো। বাইবেলকে এভাবে একটা টেক্সট হিসেবে পড়ার ব্যাপারটা একেবারেই নতুন না। টেক্সট হিসেবে বাইবেলকে/ইহুদি বাইবেলকে না পড়লে আমরা হয়তো এক্যুইনাস, মাইমোনিদেস, লাইবনিজের মত লোকদের ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন বিষয়ক অনেক লেখাই পেতাম না। সাম্প্রতিক সময়ে বোধিচিত্তে নারীবাদী দার্শনিক জুডিথ বাটলারের একটা সাক্ষাৎকারের বাংলা অনুবাদ পড়ার সময় জানতে পারলাম বাটলার তার পরবর্তী বইটা বের করবেন মাইমনিদেসের কাজের সাথে নিজের সংযোগ তৈরি করার মাধ্যমে।

যাই হোক, অনুবাদটায় জুডিথ বাটলার করোনার এই ‘অসহায়’ পরিস্থিতিটাকে বাইবেলের বর্ণিত ‘Ninth Plague’ এর সাথে তুলনা করেছেন। যতদূর জানি, নাইন্থ প্লেগ বা নবম প্লেগ হলো বাইবেলে বর্ণিত দশটা অভিশাপ বা আযাবের মধ্যে নবম যে আযাবটা ছিলো সেটা। বাইবেল মতে, মিশরে [সম্ভবত দ্বিতীয়] ফারাও রাজার আমলে মোট দশটা আযাব ঈশ্বর পাঠিয়েছিলেন যেন মুসার নেতৃত্বে আটকে পড়া সহযোগী বিদ্রোহী দাসদেরকে তখনকার অত্যাচারী ফারাও রাজা মুক্ত করে দেন সেজন্যই। ফারাওয়ের কাছে প্রত্যেকটা আযাব আসার আগমুহূর্তে ঈশ্বর মুসার মাধ্যমে সতর্কবাণী পাঠাতেন। এর মধ্যে নবম আযাব বা নাইন্থ প্লেগ ছিলো এরকম যে তিন চারদিন যাবত সূর্য উঠবে না এবং চারদিক এতই ‘গাঢ় অন্ধকার’[thick darkness] থাকবে যে কেউই কাউকে দেখতে পাবে না। বাটলারের সাক্ষাতকারের অনুবাদক কৃপা নাঈমের ফুটনোট থেকে আরো একটা বিষয়ের খোঁজ পেলাম যে, বাইবেলের এই ‘অন্ধকার’ শব্দটাকে শুধুমাত্র শাব্দিকভাবে ‘অন্ধকার’ হিসেবে পাঠ করার চেয়ে বরং অন্ধকারকে ‘অসহায়ত্ব’ হিসেবে পাঠ করাটাই কাজের হবে রাজনৈতিক অর্থ তৈরি করার জন্য। এছাড়া অনেকে এটাও মনে করেন যে, নবম প্লেগের সময় কয়েকদিন যাবত হয়তো মিশরে অনেক ধূলিঝড় হয়েছিলো, যার কারণবশত অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিলো চারপাশ এবং প্রচুর ফসল নষ্ট হয়ে দুর্ভিক্ষ দেখা গিয়েছিলো- যেটাকে বাইবেলে মেটাফোরিকভাবে শুধুমাত্র ‘অন্ধকার’ হিসেবে একটামাত্র শব্দ দিয়েই প্রকাশ করা হচ্ছে। এটার ইঙ্গিত বাইবেলের আরো কয়েকটা ভার্সেও পাওয়া যায় এমনকি। বাটলার বলতে চাচ্ছিলেন যে, করোনায় এই কয়মাসের অবস্থাটাও একরকম অসহায়ত্বের মধ্যেই আমাদেরকে এনে ফেলেছে যেখানে মা তার করোনায় আক্রান্ত (কিংবা সুস্থ) সন্তানের সাথে চাইলেও দেখা করতে পারছে না, মনমতো। অর্থাৎ, দেখা করলেও একটা নূন্যতম দূরত্ব বজায় রাখতে হচ্ছে পরস্পরের মধ্যে। হয়তো অসুস্থ অবস্থায় তারা দেখা করলেও একরকম অসহায়ত্বের মধ্যে তাদেরকে বাস করতে হচ্ছে যেখানে কারো জন্য কোনো ‘সুনির্দিষ্ট চিকিৎসার’ বরাদ্দ নাই দেশব্যাপী এবং বিশ্বব্যাপী। সেই সঙ্গে দুর্ভিক্ষের কবলেও আমরা পড়েছি কিনা সেই আলাপে এখন আর না-ই গেলাম।

পিপল ফর অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন (পাউ ফাউন্ডেশন) এর দেয়ালচিত্র। ছবি কৃতজ্ঞতা: Jibon Ahmed ছবির কবি

বাইবেল আরো ঘেটে দেখলাম যে, এক্সোডাসের এই দশটা সতর্কবাণীর কোনো সতর্কবানীই ফারাও রাজা তেমন কানেই তুলতেন না(অনেকটা আমাদের স্থানীয় ফারাও রাজার মতন কিনা জানিনা)। এই দশটা আযাবের প্রত্যেকটাতেই কিন্তু নামানুষের(nonhuman) ভূমিকা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ আযাব বা আগাম সতর্কবাণী ছিলো এরকম যে, সারা রাজ্যজুড়ে ব্যাঙের উৎপাত হবে। অর্থাৎ, নীল নদ থেকে অজস্র ব্যাঙ এসে চারপাশ ঘিরে ধরবে। লেখার একেবারে শুরুতে আমি বাইবেলের এক্সোডাস ব্যাঙের উৎপাত যে দুটো বাক্যে আছে সেটাই উল্লেখ করেছি। এই আগাম সতর্কবাণী যদি আসলেই মুসা দিয়ে থাকেন তাহলে আমার ধারণা মুসা হয়তো ওইমুহূর্তে মিশরে জোরপূর্বক চাষবাসের ফলে যে নদী থেকে অতিরিক্ত পলি আর পানি উত্তোলন করার ফলে বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হচ্ছে- সেটা আঁচ করতে পারছিলেন সম্ভবত। ধর্মতত্ত্ব অনুযায়ী মুসা যদি ঈশ্বরের কাছ থেকেও আদেশ পেয়ে থাকেন তবুও বাস্তুসংস্থান নিয়ে এই আলাপটা কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যার জন্য মুসা ব্যাঙের উৎপাতের বিষয়টাকে সতর্কবাণী হিসেবে তুলে ধরেছিলেন রাজার সাথে তার নেগোসিয়েশন বা দেন-দরবারের সময়। তাই বাইবেলের এক্সোডাস অংশে বাস্তুসংস্থানের এই আলাপগুলো আর সেটার মেটাফোরিক পাঠের বিষয়টাকে কোনোভাবেই আমি বাদ দিতে চাই না, অন্তত রাজনীতি বোঝার জন্য হলেও।

যেমন এক্সোডাসের নবম চাপ্টারে আরেকটা অভিশাপের উদাহরণ দেখলে এটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এই বাইবেলের টেন্থ প্লেগের মেটাফোরগুলো তখনকার সময়ে সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার জন্য জোরপূর্বক (উন্নয়ন! অথবা) ফসল উৎপাদনের সাথে বাস্তুসংস্থানের সংযোগের বিষয়টাই ইঙ্গিত করছে সম্ভবত।

এখন আমি বাইবেলের আরেকটা আযাব নিয়ে বলবো যেটার ক্ষেত্রেও আযাব আসার আগে ফারাওকে বলা হয়েছিলো মুসার সহযোগী বিদ্রোহী দাসদেরকে যদি মুক্ত করা না হয় তাহলে ফারাওয়ের রাজ্যজুড়ে কোনো একটা ঝামেলা(বাইবেলে ‘change’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে) হবে। যথারীতি ফারাও রাজা এই আযাবের বিষয়টা কানে না নেয়ার পর বাইবেলে এই বাক্যটায় ঈশ্বর মুসাকে আযাব কায়েম করতে বলছেন যেটাকে এক্সোডাসের সপ্তম চাপ্টারে ইংরেজিতে বলা হচ্ছে এভাবে যে,

“And Moses and Aaron did so, just as the LORD commanded. So he lifted up the rod and struck the waters that were in the river, in the site of Pharaoh and in the sight of his servants. And all the waters that were in the river were turned to blood.”

(Exodus 7:20)

বাইবেলের এই বাক্যটার ভাবানুবাদ করলে এমনটা দাড়ায় যে, ঘটনার সূত্রানূযায়ী অভিশাপের সতর্কবাণী শোনার পরেও ফারাও রাজা যখন মুসার কথা শুনলো না- তখন ঈশ্বর মুসাকে বললেন তার লাঠি[rod] নীলনদের পানিতে রাখতে এবং রাখার সাথে সাথেই দেখা গেলো যে নীলনদের পানি রক্তে(!)পরিণত হয়েছে এবং নীলনদের সব মাছ মরে ভেসে উঠেছে। এখন নীলনদ এভাবে ‘রক্তে’ ভেসে যাওয়ার বিষয়টা মেটাফোরিকালি কিভাবে পাঠ করা সম্ভব? এটার নানা রকম ব্যাখ্যা থাকতে পারে। যেমন কিছু ইজিপ্টোলজিস্ট দাবি করেন যে তখনকার সময় হঠাৎ করেই নদীতে প্রচুর লাল রঙের শৈবালের জন্ম নেয়ায় এবং জোরপুর্বক ফসল চাষের স্বার্থে মাটিতে প্রচুর সার দিয়ে নদীর পানিতে বিষক্রিয়ার ফলে এমন কিছু একটা ঘটার সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে।

এই সবগুলো মেটাফোরের যে নিজস্ব ব্যাখ্যা আমি যোগ করছি তার সবগুলোই প্রায় আন্দাজে বা স্পেকুলেটিভ বলা যেতে পারে- যার জন্য গতানুগতিক পেশাজীবী ইতিহাসবিদদের সাথে আমার ব্যাখ্যার ধরণ নাও মিলতে পারে। এই চিন্তাগুলো মাথায় আসার আরেকটা কারণ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা শহরের কুকুর অপসারণের (কিংবা একরকম সিস্টেমেটিক উচ্ছেদ) বিষয়টা আমার চোখে পড়া। অনেকেই মনে করে যে আমরা ঢাকা নামের এর ইটকাঠের বানানো ‘যান্ত্রিক’ শহরে আছি যার মানে হয়তো এই যে, এই শহরের কোনো রাজনৈতিক বাস্তুসংস্থান নাই, বরং সবকিছুই এইখানে ঠুনকো আরবান ‘ব্যবস্থাপনা’র একেকটা ইস্যু মাত্র। কিন্তু আমি মোটেও এগুলোকে ঠুনকো আরবান ব্যবস্থাপনার ইস্যু বলে মনে করি না! কুকুর একটা নামানুষ(nonhuman) মানে কিন্তু এই না যে সে ঢাকার এই শহুরে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তায় কোনো নূন্যতম প্রভাবও রাখে না। কতটুকু প্রভাব রাখে সেটা আলোচনা সাপেক্ষ। কিন্তু কোনোভাবেই বলা যায় না যে শহুরে মানুষের সামাজিক নিরাপত্তায় কুকুরের নূন্যতম প্রভাবও নেই। কিংবা ঢাকার মত ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি একটা শহরে আবর্জনা খেয়ে এই কুকুর আমাদের কোনো নূন্যতম উপকার যে করছে না- সেটাও কিন্তু কোনোভাবেই বলা যায় না।

আরেকটা বিষয়ও প্রায় সময় মাথায় আসে না আমাদের অনেকেরই। প্রায়সময়ই আমাদের কর্তৃপক্ষ হুটহাট করে শহুরে জীবনকে ‘সুন্দর ও নিরাপদ’ রাখার বুলি শুনিয়ে অনেক মানুষ এবং নামানুষকে চোখের পলকে উচ্ছেদ করে দিতে সম্মতি আদায় করে নাগরিক ব্যবস্থাপনার নামে। কিন্তু তখন তাদের এবং আমাদের মাথায় আসে না যে, যেকোনো ‘অপ্রয়োজনীয়’ মানুষ কিংবা নামানুষকে উচ্ছেদ করলে আমাদের রাজনৈতিক বাস্তুসংস্থানে উপকারের বদলে উল্টো ক্ষতিই হতে পারে। যেমন কুকুরের মত একটা নামানুষ যা ময়লাভর্তি ঢাকা শহরের বাস্তুসংস্থানে একটা নির্দিষ্ট ভূমিকা রাখছে সেটা তো চাইলেই অন্য কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব না। এটাকে আপনি ঐ নামানুষের এজেন্সি হিসেবেও পাঠ করতে পারেন চাইলে। যেমন বর্ণর কাছ থেকে জানলাম যে, অনেকে ধারণা করেন ইউরোপে যখন প্লেগের মহামারি চেপে বসলো তখন অনেকগুলো শহরের মানুষজন তাদের ধর্মগুরুদের ইন্ধনে বিড়াল হত্যা করেছিলো এই ভেবে যে বিড়াল অশুভ প্রাণী এবং প্লেগ এর জন্য দায়ী। কিন্তু বিড়াল হত্যা করার ফলশ্রুতিতে যেটা হলো তা হচ্ছে, কিছুদিন পরেই শহরে প্রচুর ইঁদুরের উৎপাত শুরু হয়ে গেলো। আর এগুলো তো বললাম কুকুর থাকলে আমাদের কি লাভ, কিন্তু বাস্তুসংস্থানে কুকুর কিন্তু অন্যান্য অনেক নামানুষেরও অনেক রকম কাজে লাগে যে আলাপটা এখানে বাকি থাকলো।

পিপল ফর অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন (পাউ ফাউন্ডেশন) এর দেয়ালচিত্র। ছবি কৃতজ্ঞতা: Jibon Ahmed ছবির কবি

তবে যাই হোক, বাইবেল হাজির করে ইতিহাসকে এভাবে মেটাফোরিকালি পাঠ করে বর্তমান বোঝার চেষ্টা করার একটা ঝামেলাও আছে। কারণ সর্বোপরি আমাদের তো কোনো মেসিয়ানিক উদ্ধারকারীও এইমুহূর্তে হাজির নাই এইখানে- যে কিনা আমাদেরকে এই উন্নয়নের ফ্যাসীবাদ থেকে প্রাণে বাঁচাবে! তবে আমাদের এই সময়ে ফারাও রাজার মত কেউ উপস্থিত আছে কিনা সেটা নিশ্চিত নই!

হয়তো আছে, হয়তো নাই!

টীকা:

১. বাইবেলের ভার্সের লিংক
২. লাতুরের সাক্ষাতকারের লিংক
৩. বোধিচিত্তে বাটলারের সাক্ষাতকারের বাংলা অনুবাদের লিংক
৪. যদিও বলে রাখা দরকার যে সর্বশেষ আযাবে মানে দশম অভিশাপ বা টেন্থ প্লেগে আসলেই ‘কাজের কাজ’ হয়েছিলো এবং [দ্বিতীয়] ফারাও রাজা ভয় পেয়ে মুসা ও তার বিদ্রোহী (সম্ভাব্য-ইহুদি) দাসদের পুরো দলটাকেই মুক্ত করে দিয়েছিলো।
৫. নামানুষ বা nonhuman শব্দটি দার্শনিক ও নৃবিজ্ঞানী ব্রুনো লাতুর ব্যবহার করেন আধুনিকতা বিষয়ে আলোচনা করার সময়, যার কাছ থেকে আমি শব্দটি ধার করছি। সংক্ষেপে বললে, লাতুর মনে করেন রাজনীতির আলোচনায় সবরকম নামানুষের এজেন্সী আমলে আনা দরকারী। নামানুষের এজেন্সীর এই আলোচনা অধিকাংশ সময় বাদ পড়ে যায় মানুষকেন্দ্রিক রাজনীতিতে ‘আধুনিক’দের অতি আগ্রহী হবার কারণে। দেখুন We Have Never Been Modern(1991)।
৬. আমার আগ্রহের জায়গা দর্শন ও নৃবিজ্ঞান নিয়ে। কিন্তু বাইবেল বিষয়ে আমি অভিজ্ঞ কেউ নই। এছাড়া প্রচলিত ধর্মগ্রন্থগুলো সত্যি কি মিথ্যা- এই ধাঁচের আলোচনাগুলোয় আমার নূন্যতম আগ্রহ নেই। তাই এই বিষয়গুলো নিয়ে কেউ জিজ্ঞাসা করলে পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ব্যাপারে আমার অপারঙ্গম থাকার সম্ভাবনাই বেশি। একইসাথে লেখার প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে আমি ধর্ম বনাম সেক্যুলারিজম দ্বৈতর সমস্যাগুলোর ব্যাপারে সচেতন থাকার চেষ্টা করেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *