‘ক্রসফায়ার’ ও স্ট্রেইটফায়ারের দুর্গতি

ব্যাকগ্রাউণ্ডে ব্যবহৃত কার্টুন এঁকেছেন পিটে ক্রেইনার, কার্টুন মুভমেন্ট
  • সারোয়ার তুষার

সম্পাদকীয় মন্তব্য: ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ প্রকল্প শুরু হওয়ার দুইদিনের মাথায় এই নিবন্ধটি লিখিত হয়, প্রকাশিত হয়েছিল ‘নিয়ন আলো’ নামক পোর্টালে। মাদক ‘নির্মূল’ এর নামে নির্বিচারে মানুষ খুন করার সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধির ভাষিক কথকতার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের মধ্য দিয়ে ‘ক্রসফায়ার’ নামক রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড যে একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সেই বিষয়টি এই নিবন্ধে পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে। ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ প্রকল্পের আওতায় রাষ্ট্রীয় খুনখারাবির প্রাসঙ্গিক রেকর্ড ও গুরুত্ব বিবেচনায় লেখাটি হালকা সংশোধন করে রাষ্ট্রচিন্তা ব্লগে পুনঃপ্রকাশিত হলো।

টঙ্গির কথিত মাদক-ব্যবসায়ী রনিকে (এলাকাবাসীর তথ্য অনুযায়ী রনি পুলিশের সোর্স ছিল একসময়) প্রথমে ডিবি পুলিশ আটক করে। ডিবি’র কাছ থেকে তিনলাখ টাকা দিয়ে সাদা কাগজে দস্তখত করে রনিকে ছাড়িয়ে আনেন তার মা। এরপর রনিকে পুনরায় আটক করে পুলিশ। ছেলেকে যেন ছেড়ে দেয়, সেজন্য পুলিশকে পাঁচলাখ টাকা দেন রনির বাবা। পুলিশের তরফ থেকে ছেড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু পরদিন থানায় গিয়ে রনির বাবা-মা জানতে পারেন রনি “বন্দুকযুদ্ধে” নিহত হয়েছে। [তথ্যসূত্র: বাংলাট্রিবিউন]

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত দুইদিনের মাদকবিরোধী অভিযানগুলোকে “ক্রসফায়ার” বলতে নারাজ। তিনি বলছেন, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হয়ে পুলিশ/র‍্যাব “বাধ্য হয়ে” গুলি চালাচ্ছে, যাতে সন্ত্রাসীরা নিহত হচ্ছে।

ঘটনাগুলোকে ক্রসফায়ার বলে স্বীকার করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই অস্বস্তি তাৎপর্যপূর্ণ। তার মানে ক্রসফায়ারের স্ক্রিপ্টগুলো যে বানানো থাকে- পাবলিকের এই পারসেপশন সত্য। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবসময় দাবি করে থাকে ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলো নিতান্তই “বাধ্য হয়ে” ঘটে, সন্ত্রাসীদের সাথে গুলিবিনিময়ে কেবলমাত্র টার্গেটেড সন্ত্রাসীই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, গত দুইদিনের “স্ট্রেইটফায়ার” আর প্রচলিত “ক্রসফায়ার” দুটোই বাধ্যতামূলক ঘটনা, তথাপি চলমান অভিযানগুলোর “স্ট্রেইটফায়ার” জাস্টিফাই করতে গিয়ে মন্ত্রী এতদিনের ক্রসফায়ারের গুমর ফাঁস করে দিচ্ছেন আসলে।

অথচ রনি’র ক্ষেত্রে পুলিশ কিন্তু বলছে তাকে নিয়ে মাদক “উদ্ধার” অভিযানে যাওয়ার সময় রনি’র সহযোগীরা পুলিশের উপর গুলি চালায়, যে কারণে পুলিশকেও গুলি চালাতে হয় এবং তাতে রনি মারা যায়। মানে পুলিশ স্বীকার করছে এটা “ক্রসফায়ার” বা “এনকাউন্টার”। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তাহলে কে অভিযানগুলো সম্পর্কে ব্রিফ করছে? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর পুলিশের বক্তব্যে মিল নেই কেন?

এইসব গোঁজামিলের মধ্যেই চলছে মাদকের বিরুদ্ধে কথিত “যুদ্ধ”, যার জের ধরে গত দুইদিনে রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে আটত্রিশ জন। রাষ্ট্র খুব ভালো করেই জানে, সরকারি প্রেস নোটের “স্ট্রেইটফায়ার” কিংবা “ক্রসফায়ার” কোন গল্পই দেশের মানুষ বিশ্বাস করেনা। বিশ্বাস না করেও বহুসংখ্যক মানুষ এখনো এই ধরণের রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ডকে সমর্থন করে। সুতরাং, রাষ্ট্র বহাল তবিয়তে এই মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান বাণিজ্য ও হত্যাকান্ড চালাতে থাকবে। মাদক ব্যবসায়ী, ধর্ষক, সন্ত্রাসীদেরকে নির্বিচারে খুন হতে দিয়ে কোন বিপদ ডেকে আনছে দেশের অধিকাংশ মানুষ- এইটা তারা কবে বুঝবে?

কিলিং লাইফ, এলেক্স ফ্যালকো চ্যাঙ, কার্টুন মুভমেন্ট

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন মাদক ব্যবসা নিয়ে আলোচিত-সমালোচিত কক্সবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। তিনি বলেছেন, মাদকের সাথে জড়িতদের আরো আগেই ক্রসফায়ারে দেয়া উচিত ছিল। দেশের যুবসমাজকে বাঁচাতে মাদকব্যবসায়ীদের ক্রসফায়ারে দেয়াকে উনি সমর্থন করেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তো দাবি করে ক্রসফায়ার নিছকই অ্যাক্সিডেন্টাল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সন্ত্রাসীদের গুলিবিনিময়ের সময় দৈবক্রমে যাকে নিয়ে অস্ত্র/মাদক উদ্ধারে যাওয়া হয়- সেই সন্ত্রাসী নিহত হয়, এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোন হাত থাকেনা। তাহলে ক্রসফায়ারে “দেয়ার” প্রশ্ন আসছে কেন? এমপি বদি কি তাহলে “ক্রসফায়ার” রহস্য সম্পর্কে অবগত? তার বক্তব্যকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চ্যালেঞ্জ না করার অর্থ হবে উদ্ধার অভিযানে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আসামী মারা যাওয়ার ব্যাপারটা আসলে ছেলেভুলানো গল্পই; একজনকে ক্রসফায়ারে বুঝেশুনে “দেয়াই” হয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ।

গুম-খুন-ক্রসফায়ার-মাদক অভিযান বাণিজ্য বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা যদি রাষ্ট্রের নাগরিকরা এখনো অনুধাবন না করেন, তাহলে রাষ্ট্রীয় হিংস্রতা আরো নিরঙ্কুশ, আরো সর্বাত্মক হবে। বাংলাদেশ কি সেইদিনের অপেক্ষা করতে থাকবে?

ফিলিপাইনের সাম্প্রতিককালের ঘটনা প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উল্লেখ করছি। ফিলিপাইনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতের্তে ক্ষমতায় আসার পর “মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” ঘোষণা করেছেন। গত দুইবছরে এই কথিত যুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনী প্রায় চারহাজার মানুষকে হত্যা করেছে। কোন কোন আন্তর্জাতিক মাধ্যম মনে করে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ৮০০০-এরও বেশি হতে পারে।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) দুতের্তে সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে তদন্তের ঘোষণা দিয়েছে। যদিও দুতের্তে বলছেন তিনি আইসিসির তদন্তে ভীত নন, কিন্তু এই তদন্তের ফলে যে ফিলিপাইনের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজরে পড়বে এবং তা ফিলিপাইনের ভাবমূর্তির জন্য ভীষণ ক্ষতিকর হবে – এতে কোন সন্দেহ নেই।

বাংলাদেশেও ২০০১ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকান্ড ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সেনাবাহিনী নামিয়ে “অপারেশন ক্লিনহার্ট” এর নামে অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী, ব্যবসায়ী, সাধারণ নাগরিক ও সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছিল। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সেসময় বলা হতো- তাদের হেফাজতে থাকাকালীন “হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধ হয়ে” আটককৃত ব্যক্তি মারা গেছে। সেসময় প্রখ্যাত লেখক ও বুদ্ধিজীবী হুমায়ুন আজাদ কটাক্ষ করে বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর সেন্স অব হিউমারে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়না কারণ মানুষের মৃত্যু যেভাবেই হোক হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হতেই হবে। এমনকি তা সেনাবাহিনীর নির্যাতনের কারণে মৃত্যু হলেও।

কিলিং ট্রি, পিটি ক্রেইনার, কার্টুন মুভমেন্ট

পরবর্তীতে একই সরকার র‍্যাব গঠন করে, যার বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংস্থা সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকান্ডের বিস্তর অভিযোগ আনে। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামীলীগ র‍্যাবের ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকান্ডের ব্যাপারে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখালেও ২০০৮ সালে তারা ক্ষমতায় আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যাকান্ড কমেনি, বরং বেড়েছে।

যাদেরকে “ক্রসফায়ার” কিংবা “স্ট্রেইটফায়ার” এ হত্যা করে ফেলছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা মাদক-ব্যবসায়ী এবং তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে,তাদেরকে যদি সনাক্ত করতেই পারছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাহলে তাদের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে হত্যা করছে কেন? আর যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কিংবা মামলা না থাকে, তাহলে কেবলমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কোন নাগরিককে হত্যা করা সরাসরি রাষ্ট্রের আইন, বিচারব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো। এবং এই আইন লঙ্ঘনের প্রক্রিয়া যখন খোদ রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্তৃক প্রশ্রয় পায়, তখন তা গুরুতর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একটি লিখিত শাসনতন্ত্র আছে। সেখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এখতিয়ার এবং কর্মপ্রণালী কেমন হবে তা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে নাগরিকের জীবন ও রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করার সমস্ত পথ তৈরি করা আছে। অপরাধীকে সনাক্ত করে বিচারিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি না করে সরাসরি মেরে ফেলার মতো বর্বর রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল রেখে আমরা কেউ নিরাপদ থাকতে পারব না। সুতরাং, গুম-খুন-ক্রসফায়ার-তুলে নিয়ে যাওয়া-হয়রানিমূলক মামলায় আটক রাখার রাষ্ট্রপ্রণালীর বিরুদ্ধে প্রত্যেক নাগরিকের সোচ্চার হওয়া জরুরি।

  • সারোয়ার তুষার, লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *