- লেখক: সারোয়ার তুষার
করোনা যুগের বিশ্ব
গোটা বিশ্ব করোনা ভাইরাসের থাবায় পর্যুদস্ত। অদৃশ্য জীবাণু ইতোমধ্যেই কেড়ে নিয়েছে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে মানুষের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম। দিনের পর দিন ঘরে অবস্থান করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। কতদিন এভাবে ‘লকডাউন’ অবস্থায় থাকতে হবে তা নিশ্চিত করে কেউ জানে না। বিশ্বের বহু বিশ্লেষক-বুদ্ধিজীবী করোনা মহামারিকে ‘নজিরবিহীন’ হিশেবে আখ্যা দিয়েছেন। নিকট অতীতেও নানা রকম ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের বহু জনপদ। কিন্তু করোনা মহামারি এবং মহামারির প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের মানুষের জীবনযাপন, রাজনৈতিক দর্শন, ধর্মীয় চেতনা এবং শাসনপ্রণালীর এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এর সবটাই যে ব্যক্তি ও সমাজের অনুকূল হবে এমন নয়।
বলা হচ্ছে করোনা ভাইরাসের আগের পৃথিবী এবং পরের পৃথিবী একরকম হবে না। কী কী পরিবর্তন হবে? রাষ্ট্র এবং অর্থনীতির কোনদিকগুলো বদলে যাওয়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? ইতোমধ্যেই আমরা লক্ষ্য করছি, করোনা ভাইরাসের আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এলিটরা এমন সব নীতি গ্রহণ করতে শুরু করেছে, যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে গ্রহণ করতে গেলে নূন্যতম বিরোধিতা কিংবা সমালোচনার শিকার হতে হতো। কিন্তু এখন করোনার বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’, ‘জরুরি অবস্থা’ ইত্যাদি ছুতোয় রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আরো নিরঙ্কুশ করা হচ্ছে। ব্যক্তি ও সমাজের স্বাধীন উদ্যোগ, স্বাধীন তৎপরতার উপর খবরদারি-নজরদারি-দমন-পীড়ন এতদিন ছিল রাজনৈতিক লক্ষ্য কিংবা কৌশল, তা এখন মানুষের জীবন ও আচরণকে কড়া রাষ্ট্রীয় অনুশাসন নিগড়ে শৃঙ্খলিত করার মাধ্যমে নতুন মূল্যবোধ ও জরুরতের ডিসকোর্স হিশেবে হাজির করা হচ্ছে। এবং এটা করা হচ্ছে গণমানুষের মনোজগতে ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ উৎপাদনের জন্য, যথেষ্ট সময় অতিবাহিত হবার পর। ভাইরাস সহ যেকোন ‘অশুভ’ শক্তিকে দমন করতে হলে রাষ্ট্রের মহাকেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকেই জীবন ও মৃত্যুর একমাত্র অধীশ্বর হিশেবে ভাবানোর মত সম্মতি উৎপাদন ও পরিস্থিতি নির্মাণের পর, বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা এমন এক মুডে অবস্থান করছেন যেন সর্বব্যাপী নজরদারি-খবরদারি ও নিপীড়নই এখন জনআকাঙ্ক্ষা। মানুষই যখন নিজেদের ‘কল্যাণের’ উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের ছড়ি ঘোরানোকে অনিবার্য জ্ঞান করছে!
ফুকোর মতে ক্ষমতার একটি জৈবিক অস্তিত্ব রয়েছে। এটি হচ্ছে ক্ষমতার কিছু টেকনোলজি যা দিয়ে নাগরিক জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই জৈব ক্ষমতাকে ফুকো মনে করেন আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের কার্য সাধনের অন্যতম প্রধান একটি উপায়। বায়ো পাওয়ারের মাধ্যমে শাসনপ্রণালী নাগরিকের শরীরের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। মানুষের শরীর রাজনৈতিক কলাকৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। পুলিশ, আইন-আদালত, কারাগার, ক্লিনিক থেকে শুরু করে সব ধরণের বল প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রাষ্ট্র জৈব ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। শাসিত মানুষের শরীরের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য। (সারোয়ার তুষার, ২০১৯)
জৈব ক্ষমতার নানা প্রকরণ প্রকট হয়ে উঠছে। শাসনের অনুকূল ‘বশ্য শরীর’ থেকে ক্ষমতা বিচ্ছুরিত হচ্ছে সামাজিক সংবহনতন্ত্রে। ফলে শরীর মাত্রই সন্দেহভাজন, আচরণ মাত্রই ‘বিশেষ সতর্কতা’।
মহামারি ও শরীর
করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করে অভিনব সার্বভৌম ক্ষমতার পাটাতন তৈরি হচ্ছে। স্বাধীনতা, সাম্য, মৈত্রীর সংকল্প হিসেবে ধারাণায়িত সামাজিক চুক্তির রক্ষণাবেক্ষণের সার্বভৌম ক্ষমতা আর অধিকারের বাঁধনে আটকা নাই।
নতুন ধরনের সভেরিন পাওয়ার তৈরি হচ্ছে, যেটা ‘সচেতনতা’র উপর প্রতিষ্ঠিত।
‘সচেতনতা’ নিয়ন্ত্রণ কৃৎ-কৌশলের আরও আরও প্রকরণকে অবিসম্ভাবী করে তোলে। নজরদারি যা এতদিন ছিল একটা রাজনৈতিক লক্ষ্য তা এখন নিপাট জীবন ও আচরণকে নতুন মূল্যবোধে আটক করছে আর এটাই হয়ে উঠছে নিয়মিত!
সচেতনতাকে মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করে পুরো পাবলিক পরিসরই অ-সচেতনতাকে শুধু দোষারোপই করে না, অ-সচেতনতা হয়ে ওঠে সরাসরি সেনা- পুলিশ- রাষ্ট্রর চিরুনি অভিযানের লক্ষ্য। (আরিফ, ২০২০)
ক্ষমতা হাজির হয়েছে নতুন শর্ত নিয়ে। যেখানে ব্যক্তির সমর্পণ আর এমন নয় যে, প্রত্যেকের এবং সকলের স্বাধীনতা একবিন্দুতে মেলে। বরং সেই স্থান দখল করেছে নতুন যে শর্ত তার নাম: সতর্কতা তথা নিরাপত্তা। কোয়ারেন্টাইন হয়ে উঠেছে নতুন সামাজিক চুক্তি। একেই আমরা বলছি কোয়ারেন্টাইন স্টেট।
ফুকোর চিন্তায় এর ইশারা মেলে, আমার এই গবেষণা-প্রকল্প হবস্-এর ‘লেভিয়াথান’ সংক্রান্ত প্রকল্পের ঠিক বিপরীত। হবস্ যেখানে বুঝতে চাচ্ছেন কীভাবে অসংখ্য মানুষের বিভিন্ন ব্যক্তিগত ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা থেকে ক্রমশ ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’র স্পিরিটের উদয় হয়, আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে এর উল্টোটা দেখানো। কীভাবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার সামনে অসংখ্য মানুষ ক্রমশ পরাধীন-অধীনস্থ প্রজার অবস্থান স্বীকার করে নেয়, সেই শোচনীয় পরিণতিকে প্রত্যক্ষ করা। (ফুকো, ২০১৯)
মহামারিকে প্রতিরোধ করা নয়, বরং মহামারি ও সম্ভাব্য মহামারির আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে হাইপার-ইন্ডুভিজুয়ালিজমের অনুকূল কনশাসনেস তৈরি করার মাধ্যমে সমাজকে স্থায়ী কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো।
মহামারির কালে আগ্রাসী রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ইতিহাসে নতুন নয়। অতীতের প্রায় সমস্ত মহামারি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিস্তার ঘটানোর কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৩৪৮ সালে ইউরোপে প্লেগ মহামারি দেখা দিলে ভেনিসের কর্তৃপক্ষ তাদের সমুদ্র বন্দর সিলগালা করে দেয় যেন প্লেগ উপদ্রুত অঞ্চল থেকে অন্তত চল্লিশ দিনের জন্য কেউ ভেনিসে ঢুকতে না পারে। সেই থেকেই ‘কোয়ারেন্টাইন’ শব্দের উৎপত্তি। যার অনেকগুলো অর্থের মধ্যে একটি অর্থ হচ্ছে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক আইসোলেশন (isolation) নিশ্চিত করা। প্লেগ মহামারির কয়েক শতাব্দী পরে প্রথম রাণী এলিজাবেথের মুখ্যমন্ত্রী উইলিয়াম সেসিল এমন আইন প্রণয়ন করেন যার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ চাইলে যেকোন ‘অসুস্থ’ ব্যক্তিকে ছয় সপ্তাহের জন্য বন্দি করে রাখতে পারত।
বাংলাদেশেও ২০১৮ সালে যে ‘সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল’ আইন প্রণয়ন করা হয় তার মূল লক্ষ্য রোগের সংক্রমণ ঠেকানো নয়, বরং সংক্রমণ ঠেকানোর নামে পপুলেশন ম্যানেজমেন্ট। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা বছর এই আইনের আওতায় কাজ করবে। আইনে সংশ্লিষ্টদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করা হয়েছে। যে কাউকে পরীক্ষার জন্য বলপূর্বক ধড়পাকড়-অবরোধ-আইসোলেশনেরও বিধান আছে। কিন্তু আইন যারা প্রয়োগ করবেন, তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করলে কি হবে তার উল্লেখ নেই। বলপ্রয়োগের শর্ত কি হবে তারও স্পষ্ট উল্লেখ নেই। সকল দায়বদ্ধতা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের। ফলত এরকম একটা আইনের মাধ্যমে সংক্রমণ রোধ কিংবা আক্রান্তকে সারিয়ে তোলার চেয়েও যে ব্যাপারটি মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তা হলো, এমনকি জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিশেষ পরিস্থিতিও রাষ্ট্রের ‘জরুরি অবস্থা’র ডিসকোর্সকে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করেছে। এর সাথে যদি বাংলাদেশের একব্যক্তিকেন্দ্রীক নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকাঠামোর বিষয়টি মাথায় রাখা যায়, তাহলে যে কেউই বুঝতে পারবেন, আইন যদি হয় প্রশ্নাতীত, নিরঙ্কুশ তাহলে তার পক্ষে কেবল বলপ্রয়োগের অথরিটি ভিন্ন অন্য কিছু হওয়া সম্ভব নয়।
করোনা ভাইরাস কিংবা অন্য যে কোন মহামারির থ্রেট অত্যন্ত বাস্তব। কোন ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ দিয়ে ভাইরাসে মানুষের জীবনাবসান হওয়ার সম্ভাবনাকে তিল পরিমাণও খাটো করা এই লেখার অভিপ্রায় নয়। এই লেখায় বরং আমরা দেখাতে চাই, ভাইরাসে মানুষের প্রাণহানি হওয়ার মত শর্ত তৈরি হয় কোন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এবং কিভাবে মহামারির পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এলিটরা ক্ষমতা ও একচেটিয়া সিদ্ধান্তকে আরো কেন্দ্রীভূত করে সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করে। এই কারণেই আইনশৃঙ্খলা জনিত সমস্যা, নাগরিকের নিরাপত্তাহীনতা, ক্রমাগত সংকট উৎপাদন করা রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই যুগে ‘সংকট’ শাসনপ্রণালীর অনিবার্য ডিসকোর্সে পরিণত হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করতে নাগরিকের মনোজগতে সংকটকে স্থায়ী করে তোলা হয়েছে। সমাজে নিরাপত্তাহীনতা, ত্রাস ইনজেক্ট করা হচ্ছে পদ্ধতিগতভাবে। এরই লক্ষ্যে রাষ্ট্র মাত্রই পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। সর্বব্যাপী নজরদারির জাল বিস্তার করার মাধ্যমে নাগরিকের সমস্ত কর্মকান্ড রাষ্ট্রের নাগালের মধ্যে আনা হচ্ছে।
দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর এক প্রবন্ধে চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন, উন্নতি, প্রগতির পাশাপাশি ‘জনস্বাস্থ্য’ রক্ষা করার স্বনির্বাচিত প্রতিশ্রুতি রাষ্ট্রের মোক্ষম মতাদর্শিক হাতিয়ার। পরিবার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে মহামারি নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত সবকিছুই হয়ে ওঠে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ ‘শরীর’ গড়ে তোলার কারবার। ‘কৃষক ও আদিবাসী শরীরকে ভেঙ্গেচুড়ে, দুমড়ে-মুচড়ে, নতুন অভ্যাসের ফাঁদে ফেলে, নতুন রুটিনের ছাঁচে ফেলে তবে তো তৈরি হয় শ্রমিকের শরীর, বিপণন সমাজের অসংখ্য ভোগ্যবস্তুর ক্রেতার শরীর, ফ্যাশন-ম্যাগাজিনের, স্বাস্থ্য পত্রিকার শরীর।’ (দীপেশ, ২০১৬:৫২)
কিন্তু দীপেশ বলছেন, এই পরিবর্তন একদিনে সাধিত হয়না এবং এই পরিবর্তনের পথ সর্বদা মসৃণও না। এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের হাতে নানাধরণের নিপীড়নমূলক ও মতাদর্শিক হাতিয়ার থাকে। এরমধ্যে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান-ভিত্তিক ‘জনস্বাস্থ্য’ নীতি এক বড় অস্ত্র।
ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত জনস্বাস্থ্য নীতি, যা এখনো মোটাদাগে অপরিবর্তিত আছে, তার কেন্দ্রীয় লক্ষ্যই হলো বিপুল পরিমাণ মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ এবং এই জনস্বাস্থ্য নীতি সরাসরি রাষ্ট্রীয় শাসনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সুতরাং রাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য ও মহামারি নিয়ন্ত্রণ নীতিকে ইতিহাস-নিরপেক্ষ কিংবা প্রাকৃতিক মনে করার কোন সুযোগই নেই।
দুর্যোগ ও শক ডক্ট্রিন
নাওমি ক্লেইন দুর্যোগ পুঁজিবাদ ও শক ডক্ট্রিন নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন। সে সম্পর্কে অন্যত্র আমরা বিস্তারিত কথা বলেছি। আপাতত এই শক ডক্ট্রিনের প্রয়োগগুলো নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন করোনার অজুহাতে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দিচ্ছেন পাবলিক ফাণ্ড থেকে। অথচ করোনার মত মহামারির জন্য এই ধরনের ইন্ডাস্ট্রিগুলো যে দর্শন দ্বারা পরিচালিত হয় তা মূলত নিওলিবারাল পুঁজির দর্শন। এই নিওলিবারাল পুঁজির উদগ্র মুনাফার নেশার বলি বিশ্বজুড়ে প্রাণ-প্রকৃতি। ফলে এমন সব জৈবনিক উপাদান তথা বীজানু উন্মুক্ত হয়ে পড়ে যা ছিল সুপ্ত। কাঁচামালের যোগান ও শিল্পোৎদানের উদ্দেশ্যে প্রকৃতির উপর যে নির্মম উপনিবেশ গড়ে তোলে পুঁজিকেন্দ্রীক দর্শন যার ফলে বনের পর বন উজাড় হতে থাকে, জলাশয় বিনাশ হতে থাকে, কার্বণ নিঃসরণে বায়ু মন্ডলে প্রভাব পড়ে, ওজন স্তর ফুটো হয়ে যায়, মহাকাশে ক্ষতিকর রশ্মি ও সাগরের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। এমন সব শিল্প-কারখানাই ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে মহামারির সুযোগে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতগুলো আরো সংকুচিত হচ্ছে।
ফ্রান্স এবং ইতালিতে করোনার বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করা হয়েছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রীর আগ্রাসী ম্যাস্কুলিনিস্ট ভাষার কারণে আতংকিত মানুষ প্রধানমন্ত্রীকেই সর্বরোগের দাওয়াই ভাবছেন। প্রত্যেক ১০ ইতালীয় নাগরিকের মধ্যে ৭ জন এই মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রীর যেকোন পদক্ষেপকে সমর্থন জানাচ্ছেন। ইতালির মত দেশে, যেখানে কিনা রাজনীতিবিদদের অবিশ্বাস করার ঐতিহাসিক পরম্পরা আছে, সেখানে এই পরিস্থিতি অভিনবই বটে।
হাঙ্গেরির ভিক্টর ওর্বানের সরকারের কিছুদিন আগে সংসদে এমন আইন পাশ করেছেন যার ফলে তিনি নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারী ক্ষমতা উপভোগ করছেন। নির্বাচন, গণভোট তিনি চাইলেই বাতিল করতে পারবেন একক নির্বাহি ক্ষমতাবলে। ‘অস্থিরতা’, ‘উদ্রেক’ সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন কথা বলা, ‘মিথ্যা’ তথ্য পরিবেশন করা ‘অপরাধ’ হিশেবে গণ্য হবে এবং এরজন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। কিন্তু কোনটা ‘মিথ্যা’ তা কে ঠিক করবে সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোন উল্লেখ নেই। আইনের ভাষাকে এতটাই অস্পষ্ট রাখা হয়েছে যে সরকারের জনস্বাস্থ্য নীতির যেকোন সমালোচনাই এর অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। এত কঠোর আইনের ফলে কিন্তু বোঝার উপায় নেই যে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে করোনা মোকাবেলায় হাঙ্গেরির অবস্থা সবচাইতে শোচনীয়।
ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জরুরি ডিক্রি জারির মাধ্যমে
তাঁর বিরুদ্ধে চলমান ক্রিমিনাল ট্রায়াল বন্ধ ঘোষণা করেছেন এবং নতুন নির্বাচিত
সংসদকে কার্যকর হওয়া থেকে বিরত রেখেছেন। ইজরায়েলের স্বাধীন বিশেষজ্ঞ মহল একে বলছেন
‘করোনা ক্যু’।
কলোম্বিয়ার রাষ্ট্রীয় কিলিং স্কোয়াড ভিন্নমতাবলম্বী অ্যাক্টিভিস্ট-রাজনৈতিক কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হত্যা করছে এই করোনা লকডাউনের মধ্যেও।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি
এ তো গেল বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের নেয়া শক ডক্ট্রিন। বাংলাদেশের পরিস্থিতিটা কী?
বাংলাদেশে গত ১৬ মার্চ পর্যন্ত পরিস্থিতি চরম ‘স্বাভাবিক’। ১৭ মার্চে মুজিববর্ষকে কেন্দ্র করে আতশবাজি ফোটানোর মত নির্মম রসিকতা করা হলো এমন একটা অবস্থায় যখন কিনা করোনার আতংক ও রাষ্ট্রীয় হাত সাফাই এর ফলে মানুষ উদ্বিগ্ন, দিশেহারা এবং বিভ্রান্ত। ১৭ মার্চের পরে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবরাখবর মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষ জানতে শুরু করে। কিন্তু এমন একটা দুর্যোগের পরিস্থিতিতে কি করতে হবে তার সুস্পষ্ট কোন দিকনির্দেশনা নেই। প্রথম আলোতে প্রকাশিত পুলিশের রিপোর্টের খবর অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে ৬ লাখ প্রবাসী দেশে ফিরেছেন, কেবলমাত্র মার্চ মাসেই দেশে ফিরছেন ৩ লাখ প্রবাসী।
এদের শারিরীক পরীক্ষার সাধারণ নিয়মগুলোও অনুসরণ করা হয়নি। বিমানবন্দরে থার্মাল স্ক্যানারসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ছিল না। অথচ বলা হয়েছে ঠিকঠাক মত সব পরীক্ষা হচ্ছে।
শুরুর দিকে চীন থেকে আগতদের আশকোনা হজক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি সঠিকভাবে অনুসরণের পরিবেশ সেখানে ছিল না। পরবর্তীতে যারা এসেছেন তাদের জন্য কোন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা না করে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে। আদতে এই প্রবাসীরা দেশে ফিরে কি করবেন, কিভাবে নিজেদের পরিবার ও কমিউনিটির সাথে মিশবেন সে ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট স্বাস্থ্য নির্দেশনা ছিল না । করোনা আক্রান্ত দেশগুলোতে থেকে আগত প্রবাসীরা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। এখন পুলিশ এমনভাবে তাদের ‘ধরা দিতে’ বলছে যেন তারা হুলিয়াপ্রাপ্ত আসামী। অথচ শুরু থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এবং জরুরি স্বাস্থ্য নির্দেশনা থাকলে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই প্রবাসীরা দেশে এসে এমন অসম্মানজনক পরিস্থিতিতে পড়তেন না। দেশের মানুষদের মধ্যেও প্রবাসীভীতি ও জেনোফোবিয়া কাজ করত না। পুরো দেশকেও লকডাউন করে সমাজকে কোয়ারেন্টাইন করার প্রয়োজন পড়ত না।
এরই মধ্যে শাটডাউন/লকডাউনের আভাস পেতেই বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। সিন্ডকেট সৃষ্ট কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়েছে। আর সমাজের বিপুল বৈষম্য একে আরও উস্কে দিয়েছে। দীর্ঘ সময়ের জন্য পণ্য মজুদ করেছে উচ্চ আয়ের পরিবারগুলো। বিপরীত চিত্র নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোতে।
এছাড়াও করোনা গার্মেন্টস সেক্টরের শ্রমিকদের প্রতি মালিকদের চিরাচরিত অন্যায় আচরণের উছিলাও হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেতন ছাড়াই ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, আগের পাওনা বকেয়া পরিশোধ করা হচ্ছে না। কর্মি ছাঁটাই চলছে পুরোদমে। ২৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী ৫০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেও তার সুফল কতটা গার্মেন্টস কর্মিরা পাবেন তা নিয়ে সংশয় আছে। উপরন্তু যে টাকা মালিকের দেবার কথা তা, রাষ্ট্রকে দিয়ে পুরণ করার সহজ অর্থ হল, প্রণোদনার সুফল ভোগী আসলে মালিকই।
এরমধ্যেই আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ‘ছুটি’ ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থানের খাতিরে ঢাকায় থাকা মানুষ গ্রামে ছড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। একদিকে করোনা অন্য দিকে শাট ডাউন লক ডাউনের ভয়। একইসঙ্গে পণ্য সরবরাহ অনিশ্চয়তা। ফলে করোনাও সারাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
সমাজের নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত অংশকে বিশেষ প্রণদনা না দেয়া হলেও করোনার জন্য ভারত কর্তৃত্বাধীন সার্ক তহবিলে ১৫ লাখ ডলার দিচ্ছে রাষ্ট্র। একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী জুন পর্যন্ত কোনো ঋণগ্রহীতা ঋণ শোধ না করলেও ঋণের শ্রেণিমানে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। এর ফলে বর্তমানে কোনো ঋণগ্রহীতা যদি ৩০ জুন পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হন, তাহলে তাঁকে খেলাপি করা যাবে না। তবে যদি কোনো খেলাপি ঋণগ্রহীতা এই সময়ের মধ্যে ঋণ শোধ করেন, তাঁকে নিয়মিত ঋণগ্রহীতা হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে। এর সুফল পাবে প্রধানত ব্যাবসায়ীরা।
মোটের উপর এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্রের তরফ থেকে আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি তাকে চূড়ান্ত গণবিরোধী অবহেলা ছাড়া অন্য কিছু বলার কোন উপায় নাই। ডাক্তারদের নূন্যতম সুরক্ষা নাই, পিপিই নাই, টেস্ট কিট নাই, জ্বর-সর্দি-কাশি থেকে মৃত্যুর খবর পর্যন্ত আছে, আক্রান্তদের চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তাররা আক্রান্ত হচ্ছেন।
দেশের কোটি কোটি মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতা ও উদ্বেগের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তাদের জীবন-জীবিকা-ভবিষ্যত। আমাদের বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না যে এই অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতাকে বজায় রেখেই তথা সমাজকে কোয়ারেন্টাইন করার মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র প্রবল পরাক্রমে বিরাজ করতে চায়। একক প্রশ্নাতীত নিরঙ্কুশ ক্ষমতার পাটাতনকে পোক্ত করতে চায়।
জরুরি অবস্থা ও সেনা ফ্যাটিশিজম
করোনার কালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির নেতিবাচকতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অর্জিত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী-সরকার-আদালত-বিরোধিদলসমূহ আইন ও সুরক্ষা কাঠামোর সমগ্র রাষ্ট্রপ্রণালীই সামাজিক কোয়ারেন্টাইনকে উপর্যুপরি অনিবার্য করে তুলছে। সমাজকে গলাটিপে হত্যা করাই যেন এই আপাত পরস্পরবিরোধী বিবদমান পক্ষসমূহের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য। শরীর থেকে ব্যক্তি, ব্যক্তি থেকে পুরো সমাজকেই করা হচ্ছে কোয়ারেন্টাইন্ড। অনুশাসনের নামে। ‘বৃহত্তর কল্যাণের’ নামে।
‘জরুরি অবস্থা’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বহুল চর্চিত বিষয়। করোনা মহামারি থেকে তৈরি হওয়া সামাজিক উদ্বেগকে পুঁজি করে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল বেশ কদিন থেকেই। সরকারের বিরোধিতাকারী কোন কোন রাজনৈতিক পক্ষকেও ‘জরুরি অবস্থা’ জারির দাবি জানাতে দেখা গেল। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র এক অনন্ত ‘জরুরি অবস্থা’র মধ্যেই আছে। ঘোষিত জরুরি অবস্থার দাবি জানানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যে তার জনগণের উপর অঘোষিতভাবে জরুরি অবস্থা জারি করে রেখেছে তার তাৎপর্যকে লঘু করা হয়। এটা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এক নিদারুণ ব্যর্থতাই বটে। এই বিশ্লেষণ ও রাজনৈতিক বোঝাপড়া ‘জরুরি অবস্থা’কে কেবল সাংবিধানিক বন্দোবস্ত হিশেবে বুঝতে চায়, যেন ঘোষণা না দিলে ‘জরুরি অবস্থা’ বিরাজ করতে পারে না। এই রাষ্ট্রবাদী চিন্তাপদ্ধতি একব্যক্তির হাতে একছত্র রাজনৈতিক ক্ষমতা, আইনি প্রক্রিয়ায় ক্রসফায়ার সহ বিপুল জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রের নতুন দাসে পরিণত করার মধ্যে ‘জরুরি অবস্থা’ খুঁজে পায় না। অথচ জরুরি অবস্থাকে এসব প্রবণতার দিক থেকেই বোঝা দরকার।
করোনাকে কেন্দ্র করে জরুরি অবস্থা জারির দাবি জানানো ইতোমধ্যেই হাজির থাকা ‘স্বাভাবিক জরুরি অবস্থা’র ভয়াবহতাকে অস্বীকার, অন্তত লঘু করে। ইতোমধ্যেই বলবৎ থাকা অঘোষিত জরুরি অবস্থার উপরে যদি আবার ঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করা হয়, তাহলে তা মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে উঠবে বাংলাদেশের জন্য। যেটুকু পাবলিক স্পেস কোন না কোন ভাবে রক্ষা করা গেছে এতদিন, সেটুকুও ঝেটিয়ে বিদায় করা হবে।
নিপীড়িতের ইতিহাসের মাধ্যমে আমরা জানি, যে জরুরি অবস্থার মধ্যে আমরা আছি, তা নিয়মের ব্যতিক্রম নয়, তা-ই নিয়ম। ওয়াল্টার বেনিয়ামিনের এই উক্তি সহ ‘জরুরি অবস্থা’র তাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়ে কার্ল স্মিট, জর্জিও আগামবেন ও সলিমুল্লাহ খানের মত পর্যালোচনা করেছেন পারভেজ আলম তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশিত মদিনা বইয়ের ‘আসল জরুরি অবস্থা’ প্রবন্ধে। সার্বভৌম নিয়মের ‘ব্যতিক্রম’ যে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারে, সেটাই তার সার্বভৌমত্বের ভিত্তি বলে মনে করতেন কার্ল স্মিট। ফলে সার্বভৌম একইসাথে আইনের ভিতরে এবং বাইরে অবস্থান করে। ওয়াল্টান বেনিয়ামিন মনে করতেন, নিপীড়িতের অবস্থান থেকে বিবেচনা করলে এই জরুরি অবস্থা ‘ব্যতিক্রম’ নয়, বরং নিয়ম। বর্তমান রাষ্ট্রের শাসনপ্রণালীর দিক বিবেচনা করে আগামবেনের মত হল, সদা সর্বদা জরুরি অবস্থা অ্যাকসেপশন নয়, বরং রুল। পারভেজ আলম এই মতগুলোর সুদীর্ঘ পর্যালোচনা হাজির করেছেন এবং এই ‘স্বাভাবিক জরুরি অবস্থা’কে অকার্যকর করে মজলুম জনতা কোন প্রক্রিয়ায় ‘আসল জরুরি অবস্থা’ জারি করতে পারে তার প্রস্তাবনা হাজির করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দর্শন ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাচর্চায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন এই প্রবন্ধটি। তথাপি, এই প্রবন্ধের একটা বড় দুর্বলতা হলো, যে ‘স্বাভাবিক জরুরি অবস্থা’ বাংলাদেশে জারি আছে বলে বহু আগেই লিখেছেন সলিমুল্লাহ খান, সেই ‘জরুরি অবস্থা’কে সংবিধানে বর্ণিত ‘মৌলিক অধিকার’ এর সাথে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন পারভেজ আলম। বাংলাদেশের সংবিধান তার নাগরিকদের যে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সেই মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়ার মাধ্যমে এক প্যারাডক্স হাজির করেছে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি এবং এর মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ‘অসাংবিধানিক’ বলতে চেয়েছেন। আসলে, বাংলাদেশে যে ‘স্বাভাবিক জরুরি অবস্থা’ জারি আছে, তার একটা শক্ত সাংবিধানিক ভিত্তি আছে। যার ফলে সংবিধানে জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত কোন বিশেষ অনুচ্ছেদ এমনকি যদি নাও থাকে, গোটা সংবিধানের ক্ষমতাবিন্যাস এক ‘স্বাভাবিক জরুরি অবস্থা’ কায়েম করে। সংবিধানবর্হিভূত ক্ষমতাকে নিত্যদিনের চর্চায় পরিণত করার মাধ্যমে ‘ব্যতিক্রম’কে ‘নিয়মে’ পরিণত করার যে রাষ্ট্রদর্শন, তাকে সংবিধানসম্মত করার এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী। পারভেজ আলমের সাথে আমরা অন্তত এক্ষেত্রে একমত যে আওয়ামীলীগ সরকার এই ‘স্বাভাবিক জরুরি অবস্থা’র ধারাবাহিকতাই কেবল নয়, ‘প্রকটতম আত্মপ্রকাশ’ (পারভেজ, ২০২০: ২৫৩)। আমরা কেবল বলতে চাই, এই ‘স্বাভাবিক জরুরি অবস্থা’ সাংবিধানিকভাবেই জারি আছে।
এখানে সংবিধান সম্মতভাবেই সমস্ত ক্ষমতা প্রধান নির্বাহির হাতে ন্যস্ত। ফলে তিনি চাইলেই নিপীড়ন-নিবর্তনের এমন সীমানায় পৌঁছাতে পারেন, যা আসলে আপাতদৃষ্টে আইনের ‘ব্যতিক্রম’ মনে হতে পারে। কিন্তু সংবিধানই তাকে এই ক্ষমতা নিশ্চিত করেছে। তাহলে এই সীমাহীন ক্ষমতাকে ‘সাংবিধানিক’ না বলে কোন উপায় আছে? এমন ক্ষেত্রে ডিজিটাল আইন যদি প্রণীত হয় সেই একব্যক্তির ইচ্ছায়, তাকেও কি ‘অসাংবিধানিক’ বলা যায়? আবার বাংলাদেশের সংবিধান নাগরিকদের ‘মৌলিক অধিকার’ নিশ্চিত করেছে বলে মনে হলেও, যদি সংবিধানের ৩২ থেকে ৪৭ অনুচ্ছেদ গভীরভাবে পড়া যায় সেখানে উল্লেখিত ‘যদি’, ‘কিন্তু’, ‘সাপেক্ষে’, ‘আইনানুযায়ী’, ‘যৌক্তিক বাধা নিষেধ সাপেক্ষে’, তাহলে এটা স্পষ্ট হয় যে, আসলে সংবিধান একদিকে নাগরিকদের অনেক মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেছে বলে মনে হলেও, সমস্ত অধিকারই আসলে কেড়ে নিয়েছে। এই কেড়ে নেয়ার জন্য কোন ‘বিশেষ আইন’ এর দরকার পড়েনা। অনেক উদাহরণ দেয়া সম্ভব, আপাতত দুটো উদাহরণই যথেষ্ট মনে করছি। যেমন ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে ‘আইনানুযায়ী ব্যতিত কোন ব্যক্তিকে জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার হইতে বঞ্চিত করা যাইবেনা’, তার মানে কি ‘আইনানুযায়ী’ বঞ্চিত করা যাইবে? এই ‘আইনানুযায়ীর’ প্যারামিটার কে ঠিক করবে? আইন যদি হয় আনচ্যালেঞ্জড একব্যক্তির হাতে সোপর্দ তাহলে সেই আইন তো অথরিটি মাত্র!
৪৬ অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে ‘এই ভাগের পূর্ববর্ণিত বিধানাবলীতে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি বা অন্য কোন ব্যক্তি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজনে কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যে কোন অঞ্চলে শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কোন কার্য করিয়া থাকিলে সংসদ আইনের দ্বারা সেই ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করিতে পারিবেন কিংবা ঐ অঞ্চলে প্রদত্ত কোন দণ্ডাদেশ, দণ্ড বা বাজেয়াপ্তির আদেশকে কিংবা অন্য কোন কার্যকে বৈধ করিয়া লইতে পারিবেন।’
এই অনুচ্ছেদের ‘অন্য কোন ব্যক্তি’, ‘শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে’, ‘কোন কার্য’ শব্দবন্ধনীগুলো বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। এই শব্দবন্ধনীগুলো মারাত্মকভাবে অনির্দিষ্ট এবং অস্পষ্ট।
ফলে, আসলে, ‘স্বাভাবিক/অঘোষিত জরুরি অবস্থা’ জারি আছে ঠিকই, তা সংবিধানের ব্যত্যয় কিংবা ‘বেআইনি’ নয়, প্রবলভাবে সাংবিধানিক এবং এটা এই দেশের মানুষের সাথে চলমান সবচাইতে নির্মম ডার্ক হিউমার।
‘জরুরি অবস্থা’ সংক্রান্ত এই আলাপগুলো আপাত অর্থে মহামারি পরিস্থিতি কিংবা জনস্বাস্থ্যের সাথে সম্পর্কহীন মনে হতে পারে। কিন্তু এগুলো আসলে গভীরভাবে সম্পর্কিত। মহামারি সম্পর্কে জনতাকে সম্যক অবহিত না করে, সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না দিয়ে, মহামারি বিস্তারের আশংকার মধ্যে বিভ্রান্তিকর ‘ছুটি’ ঘোষণা করে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানোর খবর মিডিয়ায় প্রচার করে রাষ্ট্র একইসাথে তার গরীব জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রবল শ্রেণীঘৃণা ও অবহেলা জাহির করল। আবার ঔপনিবেশিক শিক্ষায় দীক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তের কাছে গ্রহণযোগ্যও হতে চাইল। এতে করে আরো প্রমাণিত হয়, রাষ্ট্রের কাছে মহামারি সামাজিক শক্তিকে রুদ্ধ করার এক মোক্ষম উপলক্ষ্যই বটে।
সেনা-পুলিশ-আইনরক্ষী দিয়ে কানধরে উঠবস করানো, মারধোর করা (কোন রকম জরুরি অবস্থা ঘোষণার দরকার পড়ছে না কিন্তু!) প্রমাণ করে মহামারি নিয়ন্ত্রণ নয়, বরং মহামারি যে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও সংকটকে উন্মোচন করছে, তার বিরুদ্ধে সামাজিক বিদ্রোহ যেন না হয় সেজন্যই সমাজকে কোয়ারেন্টাইন করার উদ্দেশ্যেই এইসব পদক্ষেপ।
মহামারি যেন শাসনের সঙ্গে শরীরের, রাষ্ট্রের সঙ্গে সমাজের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। দীপেশ যথার্থই বলেছেন, মহামারি, মড়ক বা দুর্ভিক্ষ বিষয়ক যেসকল ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা পাওয়া যায়, তা একটা সাধারণ সূত্রের নির্দেশ করে-তা হল রাষ্ট্র বনাম সমাজ বা গোষ্ঠীর সংঘর্ষের ইতিহাস। মহামারির ইতিহাস ঘাঁটলে একথাই মনে হয় যে ‘সমাজ’ এর চোখে রাষ্ট্র অনেকসময়ই একটি বাইরের অনুপ্রবেশকারী শক্তি। তাই জনমানসের মহামারি চিন্তায় একটি রাজনৈতিক বিষয় থাকে যার প্রকাশ অনায়াসেই রাষ্ট্রবিরোধিতা হতে পারে। দ্বিতীয়ত দেখা যায়, মহামারিকে ঘিরে ‘সমাজ’ এর আত্মসংবদ্ধ হবার প্রয়াস। (দীপেশ, ২০১৬: ৫৯)
বাংলাদেশেও আমরা দেখছি, করোনা মোকাবেলায় বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে। কমিউনিটি পর্যায়ে করোনা প্রতিরোধের সংকল্প। ব্যক্তি ও সামাজিক উদ্যোগে ভলান্টারি কার্যক্রম, উপদ্রুত ও সবচাইতে দরিদ্র শ্রেণির মানুষদের সহায়তা করা, পিপিই বানানো, রিলিফ কার্যক্রম পরিচালনার প্রস্তুতি, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক বানানো ও বিতরণ করা। নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রের জন্য এই সামাজিক শক্তি করোনার চাইতে বেশি আতংকের। কারণ করোনা পরবর্তী সময়ে এই সামাজিক যূথবদ্ধতা, যা দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় অনাচারে নিষ্পেষিত, তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে নিজে কোয়ারেন্টাইন্ড হওয়ার পরিবর্তে রাষ্ট্রকেই কোয়ারেন্টাইন করে ফেলতে পারে। (রাষ্ট্রের জন্য) সে বড় বিপদের কথা!
প্রয়োজন সামাজিক সংহতি
করোনা ভাইরাসই কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের সামনে হাজির হওয়া একমাত্র বিপদ নয়। বরং করোনাকে পুঁজি করে যে রাষ্ট্রশক্তি সমস্ত রকমের স্বাধীনতা-সৃজনশীলতা-সংহতির পথকে রুদ্ধ করতে চায়, সেই রাষ্ট্রশক্তি কিন্তু করোনার চাইতেও অধিকতর বিপদের। এরকম নিরঙ্কুশ গণবিরোধী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক সংহতির কোন বিকল্প নাই। করোনার কালে আমাদের দরকার সর্বোচ্চ সামাজিক সচেতনতা, শারীরিক দুরত্ব ও সামাজিক সংহতি।
চিরকালই পারস্পরিক সহমর্মিতা সমাজশক্তি বিকাশের পথ। স্বাধীনতাশীল সমাজ মানেই স্বয়ংক্রিয় সমাজ। এ ধরনের সমাজে স্ব-শাসনই হলো উৎকৃষ্ট ম্যানেজমেন্ট। একবার ভাবুন, নিদেনপক্ষে স্থানীয় সরকার বলতে যদি কিছু আমাদের দেশে থাকত (যা আছে সেগুলো মূলত সংসদ তথা প্রধানমন্ত্রীর অধীন কেন্দ্রীয় শাসনের স্থানীয় এক্সটেনশন মাত্র), তাহলে করোনার মত এরকম একটা সংকটে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারত তারা! কেন্দ্রীয় শাসনের খবরদারি মুক্ত স্থানীয় সরকার কিন্তু স্বায়ত্তশাসিত সামাজিক শক্তির একটা নিদর্শন। এরকম স্থানীয় সরকার সহ সামাজিক উদ্যোগ না থাকায় গোটা দেশ তাকিয়ে থেকেছে একব্যক্তির নির্দেশের অপেক্ষায়।
আমাদের দেশে সত্যিকারের স্বাধীন সংগঠন না থাকায় আমাদের সামাজিক সংহতি নেই বললেই চলে। অন্যান্য অনেক কিছুর মত করোনা সমাজ সংগঠন তৈরির কর্তব্যও হাজির করেছে।
সমাজের উত্থান মানে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজ সংগঠন ও সেল্ফ ম্যানেজমেন্ট। অন্যদিকে রাষ্ট্র যেখানে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী সেখানে তাকে মানুষের অধিকার বাস্তবায়নে বাধ্য করা এবং মানবমুক্তির পথকে সে আদলেই প্রসারিত করা। তাহলে করোনাকে মোকাবেলার পাশাপাশি আমরা সমাজকেও কোয়ারেন্টাইন মুক্ত করতে পারব এবং সেই কাজটা শুরু করতে হবে এখন থেকেই।
তথ্যপঞ্জি
আরিফ রেজা মাহমুদ, ২০২০, ‘করোনা, কোয়ারেন্টাইন, কর্তৃত্ববাদ’, অরাজ, ঢাকা।
দীপেশ চক্রবর্তী, ২০১৬, ‘শরীর, সমাজ ও রাষ্ট্র: ঔপনিবেশিক ভারতে মহামারি ও সংস্কৃতি’, ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ, আনন্দ পাবলিশার্স, তৃতীয় মুদ্রণ, কলকাতা
পারভেজ আলম, ২০২০, ‘আসল জরুরি অবস্থা’, মদিনা, আদর্শ, ২০২০, ঢাকা।
বিনায়ক সেন, ২০১৯, ‘ক্ষমতা প্রসঙ্গে মিশেল ফুকো’, কালের খেয়া, ঢাকা।
সারোয়ার তুষার, ২০১৯, ‘মিশেল ফুকো: শাসনপ্রণালী ও জৈবক্ষমতার কথকতা’, সময়ের ব্যবেচ্ছদ, গ্রন্থিক, ঢাকা।