- লেখক: ফরিদুল হক
করোনা ভাইরাস মহামারী আকারে সারা দুনিয়ায় ছেয়ে গেছে, দুই-আড়াই মাস সময় পাওয়ার পরেও সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেয়ায় এটা এখন বাংলাদেশের উপরে গজব আকারে নাজিল হওয়ার উপক্রম হইছে। এরই মধ্যে ডব্লিউএইচও নাকি ‘করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ঢাকা শহর আংশিক বা পুরোপুরি লকডাউন করার পরামর্শ দিয়েছে’ এমন খবর ছড়িয়ে পড়েছে কিছু মিডিয়ায়। সেটাকে কোনো কোনো মিডিয়ায় ‘জরুরী অবস্থা’ ঘোষণার পরামর্শ হিসেবেও প্রচার হয়েছে দেখলাম। আবার অন্য মিডিয়া দেখলাম দাবী করছে এরকম কোনো ‘পরামর্শ’ ডব্লিউএইচও থেকে নাকি দেয়াই হয়নি।
কেনো কি কারণে এইরকম কনফিউশন তৈরি হলো সেটা ১-২ দিনেই পরিষ্কার হবে আশাকরি। তবে সারা দুনিয়া এই পরিস্থিতি যেটাকে ‘জরুরী অবস্থা’ বলে বা মনে করে সেটা যে জরুরী স্বাস্থ্যগত দুর্যোগ কিংবা মহামারী সেটা কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বোঝা যায়। করোনার কারণে আমাদের দেশেও একটা বিরাট ‘জাতীয় দুর্যোগে’র মুখে পড়েছি আমরা। তাই আমাদের এই মুহূর্তে দরকার ‘জাতীয় দুর্যোগ’ ঘোষণা করা, ‘প্রক্লেমেশন অব ইমার্জেন্সী’ বা ‘জরুরী অবস্থা’ ঘোষণা নয়। আমাদের দেশে ‘জরুরী অবস্থা’ জনগণের জন্য একটা বিরাট গজব, আমরা আমাদের বিগত সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে দেখেছি জরুরী অবস্থা জারি হলে কিভাবে মানুষের ‘মৌলিক রাজনৈতিক অধিকার’ কেড়ে নেয়া হয়।
সেইসাথে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, ইউরোপ আমেরিকার উদাহরণ টেনে এখানে ‘জরুরি অবস্থা’ জারির দাবি জানানো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্র আসলে একটা ঔপনিবেশিক মডেলের রাষ্ট্র এবং এটা পরিচালিত হয় উপনিবেশের রেখে যাওয়া প্রশাসনিক আইনকানুন দ্বারা। তাই এখানে ‘জরুরি অবস্থা’ জারির উদ্দেশ্য কোনভাবেই মানুষের মঙ্গলকে মাথায় রেখে করা হয়না। বরং সরকারের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে সমস্ত রকমের প্রশ্ন, সমালোচনা বন্ধ করতেই জরুরী অবস্থা জারী করা হয়।
‘জাতীয় দুর্যোগ’ ঘোষণার মাধ্যমে এই মুহূর্তে সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে করোনা পরিস্থিতিকে মোকাবেলায় কাজে লাগাতে হবে। এবং দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোকে সহায়তা করতে অন্য সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতেও বাধ্য করতে হবে। সেইসাথে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় দুর্যোগ-ঝুঁকি যেন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে কিভাবে দ্রুততম সময়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা যায় সেই পরিকল্পনাও হাতে নিতে হবে। এবং এগুলোর প্রায় সবকিছুই করা সম্ভব ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন-২০১২’ এর আলোকে। এই আইনের মাধ্যমে কি কি কাজ করা যাবে তার কিছু উদাহরণ লেখক ও এক্টিভিস্ট কল্লোল মোস্তফা তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন। যেমন:
এই আইনের সংজ্ঞা অর্থাৎ ধারা (২) এর (১১) (ই) এ মহামারী সৃষ্টিকারী ব্যাধি, যেমন প্যান্ডেমিক ইনফ্লুয়েঞ্জা, বার্ডফ্লু, এনথ্রাক্স, ডায়রিয়া, কলেরা, ইত্যাদিকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ফলে এই ধারা অনুসারে করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিককে সহজেই জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করা যায়। ধারা ৪ এ প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিব, সকল সামরিক ও বেসামরিক বাহিনী প্রধান সহ “জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল” গঠন করার কথা বলা আছে। ধারা ১৪ অনুসারে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য মন্ত্রী সচিব সামরিক বেসামরিক বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য সহ প্রয়োজনীয় যেকোনো ব্যক্তি গোষ্ঠীর সমন্বয়ে “জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় গ্রুপ” গঠন করা যাবে।
ধারা ১৬ অনুসারে এই “জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় গ্রুপ” যেসব কাজ করতে পারবে তার মধ্যে রয়েছে-
-সম্পদ, সেবা, জরুরি আশ্রয়স্থল হিসাবে চিহ্নিত ভবন, যানবাহন বা অন্যান্য সুবিধাদি হুকুমদখল বা রিক্যুইজিশন এর বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা;(উপধারা ১৪)
-মারাত্মক ধরনের দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় বা মারাত্মক ধরনের দুর্যোগ ঘটিতে পারে এইরূপ অবস্থার অবনতির প্রেক্ষিতে সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতা গ্রহণে সরকারের নিকট সুপারিশ প্রেরণ(উপধারা ১৫);
দুর্যোগকালীন বা দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বা সম্পদের যোগান, সরবরাহ বা ব্যবহার নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রীসভা কমিটির নিকট হইতে একসঙ্গে এক বা একাধিক বৎসরের জন্য দুর্যোগ-পূর্ব সময়ে আগাম ক্রয়ের বিষয়ে সম্মতি গ্রহণের নিমিত্ত সুপারিশ করা(উপধারা ১৬)
ধারা ২৫(২) অনুসারে সরকার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে, যে কোন স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারিভাবে পরিচালিত এবং বেসরকারি সাহায্য সংস্থার (Non Government Organization) অধীনে পরিচালিত হাসপাতাল, ক্লিনিক বা চিকিৎসা কেন্দ্রের চিকিৎসাজনিত সুবিধাদি গ্রহণ করিতে পারিবে এবং উক্ত হাসপাতাল, ক্লিনিক বা কেন্দ্রে চাকুরীরত সকল চিকিৎসক, নার্স এবং অন্যান্য কর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মী দুর্যোগকালীন সময়ে সরকার বা স্থানীয় কমিটির চাহিদামতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা প্রদান করিতে বাধ্য থাকিবেন।
ধারা ২৬(১) অনুসারে, জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় গ্রুপ এর নির্দেশনার আলোকে জেলা প্রশাসক যে কোন কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তির নিকট হইতে সম্পদ, সেবা, জরুরি আশ্রয়স্থল হিসাবে চিহ্নিত ভবন, যানবাহন ও অন্যান্য সুবিধাদি হুকুমদখল বা রিকুইজিশন করিতে পারিবে।
ধারা ২৭ (১) অনুসারে, সরকার, বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে, দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত পুনর্বাসনের জন্য বা ঝুঁকি হ্রাসের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান কার্যক্রম গ্রহণ করিতে পারিবে
ধারা ৩০(১) অনুসারে, মারাত্মক ধরনের দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় অথবা মারাত্মক ধরনের দুর্যোগ ঘটিবার আশংকার প্রেক্ষিতে সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতা গ্রহণের আবশ্যকতা দেখা দিলে উক্ত ক্ষেত্রে জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় গ্রুপ সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতা গ্রহণের জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ পেশ করিতে পারিবে। ধারা ৩০(৫) অনুসারে ৩০ ধারার অধীন কোন নির্দেশনা বা, ক্ষেত্রমত, চাহিদাপত্র প্রাপ্ত হইলে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ বা ক্ষেত্রমত, স্থানীয় সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃপক্ষ অগ্রাধিকারভিত্তিতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করিবে।
এই পরিস্থিতিকে মোকাবেলার দায়িত্ব প্রধানত রাষ্ট্রের। আর রাষ্ট্রের পরিচালনায় যেহেতু একটা সরকার আছেন তা তারা যেভাবেই দায়িত্বে থাকুন না কেন, তাদেরকেই এই কাজের পুরো দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ এই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে প্রতিবছর আমরা তাদেরকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ট্যাক্স দেই। কিন্তু এই কাজ তারা কিভাবে কি করছেন সেটা যাতে মানুষ সর্বক্ষণ নজরদারী করতে পারে, সরকারের কাজকর্মের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে এবং সরকারের কাজের ঘাটতি নিয়ে আরো বেশি কথা বলতে পারে তার ব্যবস্থা থাকাও খুবই জরুরী।
‘জরুরী অবস্থা’ জারী হলে সাধারণভাবে সংবিধানের ৩৬-৪২ অনুচ্ছেদের মধ্যে ঘোষিত ‘মৌলিক অধিকার’ যেমন, মানুষের চলাফেরার, সমাবেশের, সংগঠনের, চিন্তা ও মতপ্রকাশের, পেশা বা বৃত্তি গ্রহণের এবং ধর্মপালনের স্বাধীনতা ইত্যাদি স্থগিত থাকে। অর্থাৎ নির্বাহী আদেশে এই মৌলিক অধিকার গুলি স্থগিত করা যায় আর এর বিরুদ্ধে কেউ চাইলেও রিট করতে পারে না। ‘জাতীয় দুর্যোগে’র বদলে ‘জরুরী অবস্থা’ জারী করে মানুষের যতটুকু বাক স্বাধীনতা আছে তাও কেড়ে নিলে, এ বিপর্যয় থেকে এখানকার মানুষদের রক্ষা করা যাবে না।
‘জরুরী অবস্থা’ জারী মানে নাগরিকের রাজনৈতিক ও মৌলিক অধিকার সংকুচিত করা আর ‘জাতীয় দুর্যোগ’ ঘোষণা মানে হচ্ছে সরকারকে এই অবস্থায় সর্বোচ্চ দায়িত্ব দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাধ্য করা।
আমরা কোনটা চাই?