গত (১০/০৪/২০২০) তারিখে রাষ্ট্রচিন্তার উদ্যোগে ‘সরকারি প্রণোদনা: কার তেল? কার মাথায়?’ শীর্ষক একটি ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত ভিডিও কনফারেন্সে অর্থনীতিবিদ, সমাজ-গবেষক, টেকসই উন্নয়ন গবেষকরা অংশ নেন। বক্তারা করোনা মহামারি সৃষ্ট বর্তমান বিপর্যয় ও আসন্ন সম্ভাব্য বিপর্যয়ের দিকগুলো সম্পর্কে সতর্ক করেন এবং জনগণকে সাথে নিয়ে এই বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারকে দ্রুত দৃশ্যমান, স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান। এছাড়াও দ্রুত এই নজিরবিহীন সংকট উত্তরণে কিছু করণীয় সুপারিশ করেন।
সেই প্রেক্ষিতে সরকারি প্রণোদনার প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রচিন্তা কয়েকদফা আশু দাবি জানিয়েছে। এগুলো গ্রহণের মাধ্যমে দেশকে ভয়াবহ এই সংকট থেকে পরিত্রাণের কোন বিকল্প নেই বলে মনে করে রাষ্ট্রচিন্তা।
উক্ত ভিডিও কনফারেন্সে অংশ নেন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক জিয়া হাসান, গবেষক মাহা মির্জা, গবেষক হাসিবউদ্দিন হুসাইন, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক রুশাদ ফরিদী, টেকশই উন্নয়ন গবেষক ফাইজ আহমেদ তাইয়েব, গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানী আলতাফ পারভেজ, শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ। রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ থেকে ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন হাসনাত কাইয়ুম।
করোনা দূর্যোগ মোকাবেলায় রাষ্ট্রচিন্তার ১০ দফা দাবী:
১। কর্মহীন ও দরিদ্র পরিবারপ্রতি এককালীন ২০ হাজার টাকা মোবাইলের মাধ্যমে সরাসরি পৌঁছে দিতে হবে। বিবিএস-এর খানা জরিপ অনুযায়ী এমন পরিবারের তালিকা তৈরী করতে হবে। সকল পর্যায়ে দুর্নীতি রোধ করতে হবে।
২। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত চিকিৎসা ব্যবস্থাকে দ্রুত সক্রিয় করতে হবে। সকল বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিককে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য আগামী ৬ মাস পর্যন্ত নাগরিক কমিটির অধীনে নিয়ে আসতে হবে। সকল ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য সাপ্তাহিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করতে হবে।
৩। বোরো ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য দেশীয় যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে অবিলম্বে স্বল্প সুদে প্রযোজনীয় ঋণ দিতে হবে, এসব যন্ত্রপাতী ভর্তুকি মূলে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের সরবরাহ করতে হবে এবং ছাত্র-তরুণ-যুবকদের সুরক্ষা প্রদান করে ধান কাটা ও মাড়াইয়ে উৎসাহিত করতে হবে। ধানকাটা শ্রমিকদের সুরক্ষা-ট্রেণিং এবং বিশেষ ব্যবস্থায় ধান কাটায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে । প্রয়োজনে এসব ক্ষেত্রে ‘লকডাউন’ শিথিল করতে হবে।
৪। চাল নয়, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কমপক্ষে ৩০ টাকা কেজি মূল্যে ধান কিনে গুদামজাত করতে হবে। গুদামে রক্ষিত চাল বিবিএস-এর খানা জরিপ অনুযায়ী গৃহহীন, ভূমিহীন ও কর্মহীন মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে সরবরাহ করতে হবে। রাস্তা, ষ্টেশন ও বস্তিতে বসবাসকারীদের প্রতিদিন বিনামূল্যে রান্না করা খাবার সরবরাহ করতে হবে। এর জন্য বন্ধ থাকা হোটেল বাবুর্চীদের কাজে লাগাতে হবে। যেকোন মূল্যে দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে হবে।
৫। সকলপ্রকার ফসল, মাছ-মাংস, দুধ, ডিম, ফলমূল, সবজিসহ সকল কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন ও বিতরণের সাপ্লাই-চেইন জরুরী ভিত্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর সরবরাহ ও বিক্রয় প্রক্রিয়া থেকে সকল প্রকারের হয়রানী সরিয়ে নিতে হবে এবং এর সাথে যুক্ত কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
৬। করোনা সংকট কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য সেবা খাত বিষয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে হবে। বর্তমান উন্নয়ন বাজেটের বাকী অর্থের সম্পূর্ণটা এবং আগামী অর্থবছরের সম্ভাব্য উন্নয়ন বাজেট অর্ধেক করে বাকী ৫০% অর্থ এগুলোতে বরাদ্দ দিতে হবে। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের থোক বরাদ্দ ও সুবিধাদি এবং ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের বেতন বহির্ভূত সুবিধাদি স্থগিত করতে হবে।
৭। সাংসদ, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থেকে উপসচিব বা তদুর্ধ্ব সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের আগামী ১ বছরের বেতনের ২৫% ত্রাণ তহবিলে দিতে হবে। এবং তাদের বেতন বহিঃর্ভুত সকল সুবিধা বন্ধ করতে হবে। ত্রাণ তহবিলের হিসাব জনগণের সামনে উন্মুক্ত রাখতে হবে।
৮। ত্রাণের চাল লুটপাট বন্ধ করতে হবে। লুটপাটকারীদের রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ করতে হবে।
৯। মানুষের মনুষত্ববোধ ও বিবেক জাগ্রত করতে প্রথমে তার মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান , হয়রানিমূলক গ্রেফতার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনি দ্বারা হত্যা করা বন্ধ করতে হবে। সকল মানুষের মৌলিক, মানবিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। সকল প্রয়োজনীয় তথ্য যথাসময়ে সঠিকভাবে সকল মানুষকে জানাতে হবে।
১০। সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে মিডিয়ার উপর এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় আরোপিত আইনি সেন্সরশিপ উঠিয়ে নিতে হবে। সকল ক্ষেত্রে তথ্য প্রবাহ অবাধ রাখতে হবে। কারণ অবাধ তথ্য প্রবাহ দুর্ভিক্ষ ঠেকানোর প্রাথমিক পদক্ষেপ।