সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু বাইনারি : রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসম্পর্ক

ছবি সমূহ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর সমস্যাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করলে খুব সমস্যা তৈরি হয়। কই আমার গ্রামের তো কোনো হিন্দু (বা সংখ্যালঘু) পরিবারকে কেউ কিচ্ছু বলে নাই, তাইলে এরা ভারতে চলে যেতে চায় কেন? কই আমার তো অনেক হিন্দু বন্ধু আছে, তাদের সাথে আমার সম্পর্ক তো খুবই ভালো, তবু তারা ভারতে যাওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকে। এই ধরণের আলাপ তখনই জন্ম নেয় যখন আপনি সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর ইস্যুটাকে ব্যক্তিগত সম্পর্কে পর্যবসিত করেন।

মূলত সংখ্যালঘুর সাথে সংখ্যাগুরুর সম্পর্ক একটা রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক। এটা নির্ভর করে রাষ্ট্রের ওপর। সংখ্যালঘু নিজেরে সিকিউর ভাবতে পারতেছে কি না এইটা একজন সংখ্যালঘু কমিউনিটির ব্যক্তির লগে আমার যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তার উপরে নির্ভর করে না। দেখার বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে পারছে কি না। এইখান থেকেই সে সিকিউর বোধ করতে পারছে কি পারছে না সে প্রসঙ্গে আসবে। বাস্তবে আমরা দেখি যে, কোনো সংখ্যালঘুকেই আমাদের রাষ্ট্র ধারণ করতে পারছে না। না হিন্দু কমিউনিটি, না আদিবাসী। বিভিন্ন জায়গায় মন্দির-মূর্তি ভাঙচুরের পর তার কোনো ধরণের বিচাররে ব্যবস্থা কি এই রাষ্ট্র করতে পেরেছে? বরং, পুলিশ কর্তৃক উল্টো সাঁওতালদের ঘর পুড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে।

সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ-হামলা যতটা না সাম্প্রদায়িকতা তার চেয়ে বেশি ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার।

কিন্তু, সমাজ এখনো সক্রিয় আছে। এই যে যে কোনো হামলার পর আপনি প্রতিবাদ করছেন, মানব-বন্ধন করছেন, রিলিফ পাঠাচ্ছেন, এইসব প্রমাণ করে সমাজ এখনো সক্রিয়। এই সমাজে সবাই অন্তর্ভুক্ত। তবে ধীরে ধীরে সমাজের ভেতরে রাষ্ট্রের শুঁড় যত ঢুকবে সমাজ ততই কিন্তু নিষ্ক্রিয় হবে। এইটা অবশ্য হবে আমাদের জন্য ঘোর অমানিশা।

মানুষ তো একটা আইডেন্টিটি ধারণ করে। যেমন দেখবেন, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে মুসলমানদের ওপর হামলা হলে আমাদের এখানকার মুসলমানরাও কষ্ট বোধ করেন। এই যে কষ্টের বোধ, এর কারণ কি? কারণ, ঐ যে একটা কমন আইডেন্টিটি! এখন, ধরেন বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তে সংখ্যালঘুর ওপর আক্রমণ হইলো, এবং দেখা গেলো রাষ্ট্র কোনো দায়ভার নিলো না, তখন আপনার গ্রামের সংখ্যালঘু যার সাথে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো বলে দাবি করছেন সেও অস্তিত্ব সংকটে ভুগবে।

এই সংকটের জন্ম ও বিস্তার রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত। রাষ্ট্রের নীতির সাথে সম্পর্কিত। এইখানে রাষ্ট্র বলতে শুধু সরকারী দলকেই বোঝানো হচ্ছে না। পুলিশ-আইন-আদালত সবাইকে বোঝানো হইতাছে।

এই সম্পর্ক তাই ক্ষমতার সম্পর্কও। ক্ষমতার প্রেক্ষিতে তৈরি হয় কেন্দ্র-প্রান্ত বিভাজন। এইখানে ক্ষমতা ধর্ম, লিঙ্গ, জাতি অনেকভাবেই তৈরি হয়। ধর্মের দিক থেকে প্রান্তিকে আছে হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধরা। আবার ইসলাম ধর্মের প্রান্তিকে অবস্থান করছে আহমাদিয়া, শিয়া, কাদিয়ানী। লিঙ্গের দিক থেকে প্রান্তিকে আছে নারী। আবার জাতিগত দিক থেকে প্রান্তে আছে আদিবাসীরা।

আবার এইসব কিছুর ঊর্ধ্ব আছে শ্রেণি। উপরোক্ত প্রান্তিক বর্গের অনেকেই আবার উঁচু শ্রেণিতে অবস্থান করেন। রাষ্ট্র যেহেতু উঁচুদের শ্রেণির প্রতিষ্ঠান, তাই রাষ্ট্রের সাথে তাদের সম্পর্ক মিষ্টি মধুর।

তাই, দেখা যায় উপরোক্ত প্রান্তিক বর্গের যারা উঁচু শ্রেণিতে আসীন তারা নিজেরাই নিজেদের কমিউনিটিকে শোষণ করেন, আবার মন-মর্জিমত ফায়দাও নেন। উঁচু শ্রেণির এইসব ব্যক্তিবর্গ ধর্ম-লিঙ্গ-জাতি এসবের প্রেক্ষিতে প্রান্তিক বর্গে অবস্থান করলেও তাদের যাতায়াত কিন্তু কেন্দ্রে। তাই, এদের কর্মকাণ্ড দিয়ে আসলেই যারা প্রান্তিক পর্যায়ে (শ্রেণিগত দিক থেকেও) অবস্থান করেন তাদের ফিজিক্যাল ও মেন্টাল অবস্থা নির্ধারণ করতে গেলে মুশকিলে পড়বেন। প্রিয়া সাহারা কিন্তু ক্ষমতাবান গোষ্ঠী। সুবিধাবাদী। এরা নিজেরা শোষণকারী। তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর সম্পর্ক বুঝতে গেলে বিপদ আছে। ভারতে তো এককালে রাষ্ট্রপতি হইছিলেন এপিজে আবুল কালাম, তাই বলে কি এটা বলা যায় যে, ভারতে সংখ্যালঘুরা খুব আরামে আছে?

তাই সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর সম্পর্ক সম্পূর্ণ ক্ষমতার সম্পর্ক, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। যদি ব্যক্তিগত সম্পর্কের আবেগ অনুভূতি অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করতে যান তাহলে শুধু অলিতে গলিতে হেটে বেড়াবো, সমাধানের হাই রোডে উঠতে পারবো না।

উপরোক্ত কথাগুলো আমার ব্যক্তিগত মতামত বা বোঝাপড়া বলতে পারেন। এইটা যে শতভাগ সঠিক মত তাও না। মতের বিপরীতে মত থাকবে। আকাশে যত তারা মতেরও তত ধারা … নানান মতেই বের হবে নানান পথ। .

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *