শ্বাস নেয়ার অধিকার

ব্যাকগ্রাউন্ডের ছবি: Palestinian-American artist Shirien Damra’s illustration paying tribute to George Floyd. Shirien.Creates / Instagram
  • লেখক: পারভেজ আলম

জর্জ ফ্লয়েড মারা গেলেন শ্বাস না নিতে পাইরা। এমন একটা সময়, যখন করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারনে শ্বাস কষ্টে মারা যাওয়া মানুষের খবর দেখি আমরা প্রতিদিন, যখন শ্বাস নিতে না পারার শঙ্কার মধ্যে দুনিয়ার প্রায় সবাইকেই বসবাস করতে হচ্ছে। যখন শ্বাসকষ্টে মরে যাওয়ার জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলেও আপনি ভেন্টিলেশনের সুবিধা পাবেন কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নাই, যখন প্রয়োজনে কৃত্রিমভাবে শ্বাস নেয়ার সুযোগ পাওয়াও একটা শ্রেণীগত ও ভৌগোলিক অবস্থান নির্ভর প্রিভিলেজের ব্যাপার হিসাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে। শ্বাস নিতে না পাইরা ফ্লয়েড মারা গেলেন এমন একটা সময়ে, যখন আশিল এমবেম্বে শ্বাস নিতে পারার অধিকারকে একটি সর্বজনীন অধিকার (universal right) বলে ঘোষণা করেছেন।

A mural depicts African-American man George Floyd, who died in Minneapolis police custody, at Mauerpark in Berlin, Germany on May 30, 2020 Reuters

কিন্তু ফ্লয়েড মরার সময় শ্বাস নেয়ার আকুতি জানাতে জানাতে আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন যে, আজকে আমরা সারা দুনিয়ার মানুষেরা যে জরুরি অবস্থার মধ্যে বসবাস করছি – আমেরিকার কালোদের জন্যে তা অনেক আগে থেকেই এক স্বাভাবিক অবস্থা। আজকে সারা দুনিয়ার মানুষ যেইসব অধিকার হারিয়ে ফেলেছে, আমেরিকার কালোদের সবসময়ই বসবাস করতে হয়েছে সেসব অধিকারহীনতার অবস্থার মধ্যেই। করোনা ভাইরাস এই দুনিয়ার মানুষের শ্বাসযন্ত্রের কাজে কোন ব্যাঘাত ঘটানোর অনেক আগে থেকেই তাদের গলার উপর চেপে ছিল জালিম রাষ্ট্রের হাঁটু। ফিলিস্তিনের মানুষের কথাও বলা যায়। আজকে আমরা কোয়রেন্টিনের জীবন মেনে নিয়েছি, কিন্তু আমেরিকার জেলখানাগুলোতো সবসময়ই কালো মানুষে ভর্তি। গাজার মানুষেরাতো কবে থেকেই বসবাস করছে দেয়াল ঘেরা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মধ্যে। এই দুনিয়া যে অনেক আগেই একটা জেলখানার সিস্টেমের মধ্যে প্রবেশ করেছে, তা বুঝতে এমনকি মিশেল ফুকোও পাঠ করা লাগে না। সিস্টেম অফ দি ডাউনের প্রিজন সং শুনলেও চলে। যুক্তরাষ্ট্র বলি বা ইসরায়েল, এবং দুনিয়ার আরো বহু রাষ্ট্র, এই গানের মূল কথার মতোই – দে আর ট্রায়িং টু বিল্ড এ প্রিজন – ফর ইউ এন্ড মি, ও বেবি ইউ এন্ড মি।

Thousands of people gathered to mourn the death of George Floyd during a march across downtown Houston, Texas. Photograph: Mark Felix/AFP/Getty Images

ফ্লয়েড আমাদেরকে মজলুমের সেই ঐতিহ্যের কথাই স্মরণ করায়া দিলেন, যা ওয়াল্টার বেনিয়ামিনের কথা মতো – আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে – যেই জরুরি অবস্থার মধ্যে আমরা বসবাস করছি, তা ব্যতিক্রম নয়, বরং স্বাভাবিক অবস্থা। ভুলে গেলে চলবে না যে, শ্বাস নেয়ার জন্যে হাঁসফাঁস করাটা আমাদের বাংলাদেশের মানুষের জন্যেও নতুন কিছু না। বিশ্ব পুঁজিবাদের ভাগাড়-সর্বস্ব ও দুনিয়ার সবচাইতে দুষিত বাতাসের ডিসটোপিয় নগরে পরিণত হওয়া ঢাকার নাগরিকেরা একটু শুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিতে পারেনা বহুবছর হয়ে গেছে। ঠিকমতো শ্বাস নিতে না পারাটাকেই, একটু একটু করে শ্বাসযন্ত্রের সক্ষমতা হারিয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত জীবন হিসাবে অস্তিত্ববান থাকাটাকেই তারা স্বাভাবিক হিসাবে মানতে শিখেছে। দূষিত বাতাসের কারনে ঢাকাসহ বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুহার বেশি হওয়ার আশংকা প্রথম থেকেই ছিল, এখন সেই আশংকা সত্য প্রমাণ হতে চলেছে। ঢাকার বাতাসের দূষণ মাথায় রাখলে, শ্বাস নিতে না পারা জনিত যে জরুরি অবস্থায় বর্তমান দুনিয়া প্রবেশ করেছে – তা অনেক আগে থেকেই আমাদের জন্যে জন্যে একটি স্বাভাবিক অবস্থা।

তবে শুধু মানুষের শ্বাস নেয়ার অধিকার নিয়েই কথা বলার সময় শেষ হয়েছে। সুপার সাইক্লোন আম্ফানের পর থেকেই বঙ্গোপসাগরের পানিতে দূষণের কারনে অক্সিজেন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে পরিবেশবাদীদের আশংকার কথা ভাবছিলাম। বঙ্গোপসাগরে কয়েক বছর আগে দুনিয়ার সবচাইতে বড় ডেডজোন (অক্সিজেন মিনিমাম জোন – ওএমজি) গুলির একটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। পরিবেশবাদীদের আশংকা, এই ডেডজোনটি ক্রমেই বড় হচ্ছে, মানুষের করা দূষণের কারনে বঙ্গোপসাগরের অক্সিজেন আরো কমে যাওয়ার বড় ধরণের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এক হিসাবে আমরা বলতে পারি যে, আমাদের বঙ্গোপসাগরটাও অনেকদিন যাবত শ্বাস নেয়ার জন্যে হাঁসফাঁস করছে। প্রাণীজগতে আমরা যাকে শ্বাস নেয়া বলি, রাসায়নিকভাবে তা মূলত রেডক্স রিয়েকশন – যা জীব ও জড় সবার ক্ষেত্রেই একটি সাধারণ রাসায়নিক প্রক্রিয়া। আমাদের মাটিতে, আমাদের সাগরের পানিতেও রেডক্স রিয়েকশন ঘটে। পার্থক্য হলো, সংজ্ঞা অনুযায়ী – জীবের রেডক্স রিয়েকশন স্বনিয়ন্ত্রিত, জড়ের ক্ষেত্রে তা না। কিন্তু পার্থক্য যাই থাকুক, উত্তপ্ত হয়ে উঠলে সাগরের নোনা পানিও যে তার স্বাভাবিক সীমানা ভেঙে মানুষের কৃষি জমি ও ঘর বাড়ি ভাসিয়ে দিতে পারে – তাতো একটা প্রমাণিত সত্য। ভারতের বিজ্ঞানীরা অনেক আগে থেকেই বলছেন যে বিগত কয়েক দশকে সাইক্লোনের সংখ্যা ও শক্তি দুইটাই বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে মানব ঘটিত গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর প্রভাব রয়েছে। আমফান যে একটি সাইক্লোন থেকে একটি সুপার সাইক্লোনে পরিণত হলো – তার একটি কারনও বঙ্গোপসাগরের উত্তপ্ত উপরিতল।

‘I can’t breathe’, Reuters

করোনা উত্তরকালের রাজনৈতিক লক্ষ্য – যদি এমবেম্বের ভাষা ধার করে বলি – এই দুনিয়ার ফুসফুস উদ্ধারের লড়াই। বঙ্গোপসাগরকেও তাই আজকে আমাদের মজলুম হিসাবে বিবেচনা করতে হবে, আমেরিকার কালোদের মতো, গাজাবাসী অথবা ঢাকাবাসীর মতো। এই সকল মজলুমই বিশ্ব পুঁজিবাদের শোষণ ও নিষ্কাশনের লক্ষ্যবস্তু – এর ভাগাড়, এর বন্দী। এবং আমেরিকার মজলুম বলি, বা বঙ্গোপসাগর -আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, যে শাসক শ্রেণীর অধীনে সর্বজনীন শ্বাস নেয়ার অধিকার নাই, তার তৈরি করা আইনি ব্যবস্থা, রাষ্ট্রকাঠামো, জেলখানা ও জাতীয়তাবাদী বর্ডারগুলো – ভেঙে ফেলতে হবে।

*পারভেজ আলম: লেখক ও রাজনৈতিক কর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *