শুধু নতুন প্রযুক্তি নয়, জলবায়ু-সংকট মোকাবেলায় দরকার নতুন ধরণের সংস্কৃতি এবং রাজনীতি

  • পিটার সুটোরিস।। ভাবানুবাদ: নিশাত জাহান নিশা

পরিবেশের প্রতি বিনীত মনোভাব ছাড়া এই গোলমেলে অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

আমরা একটি নতুন ভূতাত্ত্বিক যুগে রয়েছি, যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশকে আকার দেওয়ার মুখ্য ভূমিকাটি পালন করেছে মানুষ। বিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেছেন এনথ্রোপোসিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে অনেক বিজ্ঞানী আখ্যায়িত করেন “দুর্দান্ত প্রবৃদ্ধি” (great acceleration) হিসেবে। পৃথিবীর ওপর আমাদের এই কর্তৃত্ব বৃদ্ধির প্রভাব অনেক কিছুর উপরই পরেছে। যার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলঃ জলবায়ু পরিবর্তন বিপর্যের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে গেছে, গণবিলুপ্তি ঘটেছে, পৃথিবীর নাইট্রোজেনচক্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে এবং মহাসাগরগুলো হয়েছে অম্লীয়।

আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, প্রযুক্তির মাঝেই এসব সমস্যার সমাধান রয়েছে। আমরা ভাবছি, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, শক্তিকে কার্যকরভাবে ব্যবহারে সক্ষম (energy-efficient) এমন ভবন তৈরী, বিদ্যুৎচালিত যানবাহনের ব্যবহার এবং হাইড্রোজেনের মত জ্বালানি-র আবিষ্কার নির্গমন (emissions) হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। জলবায়ু-পরিবর্তন বিষয়ক বেশিরভাগ মূলধারার মডেলগুলো মনে করে, নির্গমনকে বড় পরিসরে ঋণাত্মক করতে পারে কার্বনকে ধরে রাখার প্রযুক্তি। কিন্তু বাস্তবতা হল, এই প্রযুক্তি এখনো বাস্তবায়ন করার মত অবস্থায় পৌছায় নি। তারা এও মনে করেন, এসমস্ত কিছু ব্যর্থ হলেও সব থেমে যাবে না কেননা আমরা পৃথিবীর ভূ-প্রকৌশল তো করতেই পারি।

এ ধরণের আলাপের মূল সমস্যা হল, পরিবেশ বিপর্যয়ের মূল কারণ না খুঁজে তার উপসর্গের দিকে এর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে। যেসব প্রযুক্তির ওপর ভর করে আমরা আমাদের ভবিষ্যতকে দেখছি এবং ভাবছি সেগুলো পরিবেশের জন্য অনুরূপ ক্ষতিকর হবে না; সেগুলো আর যাই হোক, আমাদের চিন্তাধারা তো বদলাতে পারবে না। আমাদের সংকট যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নয় বরং সংস্কৃতি ও রাজনীতির, এটা আমাদেরকে বুঝতে হবে। আমরা যদি বিশ্বাস করি, উদ্ভাবন করে এই গোলমেলে অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবো, তবে এনথ্রোপোসিনের মূল যে শিক্ষা – উগ্রতা নয় বরং নম্রতা দিয়ে পৃথিবীসমন্ধীয় প্রক্রিয়াগুলো বোঝাপড়া করতে হবে, তা অধরাই থেকে যাবে।


এক্সট্রাক্টিভিজম অর্থাৎ পৃথিবীটা যেহেতু আমাদের তাই একে শোষণ করার এবং একটি সীমিত জায়গায় সীমাহীন উৎপাদনের মত অযৌক্তিক ধারণার উপর ভর করে আমাদের সভ্যতা টিকে আছে। বৈষয়িক সম্পদকে সাফল্যের মাপকাঠি, ভোগের জন্য অধিক গ্রহণ এবং আমাদের কর্মের পরিণতি সম্পর্কে চোখ বুজে থাকা- এসমস্তকিছুই বৈশ্বিক পুঁজিবাদের সংকৃতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আদিবাসীরা আমাদের যা শেখায় এসবের মাঝে সেরকম সুস্পষ্ট কিছুই নেই।

অনেক আদিবাসীগোষ্ঠী তাদের পরিবেশকে নিবিড়ভাবে জানত এবং প্রতিকূল পরিবেশ সত্বেও সহস্রাব্দ ধরে তারা সেখানে বেঁচেও ছিল। আসলে প্রকৃতি থেকে আহরণের সীমারেখা তারা জানত এবং ঠিক নিজের যত্ন নেওয়ার মতই তারা প্রকৃতির যত্ন নিত। অতিরিক্ত মাছ ধরা এড়াতে প্রশান্ত দীপপুঞ্জের বাসিন্দারা সমুদ্রে কিছু এলাকা চিহ্নিত করত যেখানে মাছধরা নিষিদ্ধ থাকত, এমনকি আন্দিস পর্বতের সর্বোচ্চ শিখরে থাকা কৃষকেরা টেরেসের ওপর নির্ভর করত, যেটি তাদের ফসলের ক্ষয় অনেকাংশেই কমিয়েছিল। পৃথিবীতে টিকে যাওয়া জীববৈচিত্র্যের মাঝে ৮০ শতাংশ-ই যে আদিবাসীদের এলাকার মাঝে টিকে আছে, সেটি আসলে দৈবক্রমে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা নয়।

পৃথিবীর সাথে নতুন করে আমাদের সম্পর্ক গড়ার মানে কিন্তু এই নয় যে, এ সভ্যতার যা কিছু অর্জন তা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। পরিবেশে বহুমুখী যে সংকট তৈরী হয়েছে, সেগুলোর কিছু কিছু উপসর্গের নিরাময় করতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন আমাদের সাহায্য করতে পারে। তবে এ সমস্যার মূল কারণকে মোকাবেলা করতে হলে সীমাহীন প্রবৃদ্ধি, পরিবেশ এবং প্রজাতিবাদের যান্ত্রিকীকরণের মত ধারণা যার উপর ভর করে আমাদের সমাজ টিকে আছে বলে মনে করা হয়, তা অবশ্যই ছুঁড়ে ফেলতে হবে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে এটির প্রয়োগ কী করে হবে? একটি সভ্যতার সামগ্রিক মানসিকতার পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই তার মুল্যবোধের পরিবর্তন করতে হবে। এর অর্থ হল আমাদের সন্তানদেরকে শেখাতে হবে কি করে মিথ্যে অহমিকা এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের বদলে বিনয়ী হওয়া যায় এবং সংঘবদ্ধভাবে থাকা যায়। অর্থাৎ ভোগের ধারণা, বিজ্ঞাপনের মন্ত্রমুগদ্ধতা, চাহিদা এবং সম্মান সম্পর্কে উৎপাদিত ধারণাগুলো বদলাতে হবে। এর মানে রাজনীতিকে এমনভাবে সংগঠিত করতে হবে যেন এটি জাতিরাষ্ট্র এবং বর্তমান প্রজন্মের সীমারেখাকে ছাড়িয়ে ভাবতে পারে। ওয়েলসে ইতিমধ্যেই ভবিষ্যত প্রজন্মের মঙ্গলের স্বার্থে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে।

আমাদের সভ্যতা যে কতটা ভঙ্গুর এবং দূরদৃষ্টি বর্জিত কোভিড-১৯ মহামারী তা বুঝিয়ে দিয়েছে। ভ্যাকসিন তৈরীর মাধ্যমে মহামারীকে মোকাবেলা করতে প্রযুক্তি যেমন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, একই সাথে এটি এও বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদের সীমাবদ্ধতা কোথায়। এটি দেখিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি এতটাই শক্তিধর যে, আমাদের পুরো সমাজকে একেবারে অচল করে ফেলতে পারে। সংকট মোকাবেলায় আমাদের গোলমেলে ভূমিকা দেখিয়েছে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি দক্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকল্প হতে পারে না। সমস্ত অর্জন স্বত্বেও আমাদের সভ্যতা যে গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ সেই নির্মম বাস্তবতাটি আমাদেরকে মেনে নিতে হবে। সত্যিকারঅর্থেই সংকট মোকাবেলা করতে হলে আমাদেরকে নতুন করে নিজেদের পরিচয় নিয়ে ভাবতে হবে।


মূল লেখার লিংক: Peter Sutoris, The climate crisis requires a new culture and politics, not just new tech, Guardian, 24 May 2021

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *