রোজিনার বিরুদ্ধে মামলা : ইতিহাসের স্বার্থে বলে রাখা কিছু কথা

  • আলী রীয়াজ

বাংলাদেশে সাংবাদিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং সাংবাদিকতা বিষয়ে উৎসাহীরা নিঃসন্দেহে ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই সংবাদপত্রে প্রকাশিত ‘পেন্টাগন পেপারস’ বিষয়ে অবগত আছেন। আগে না জানলেও গত ২৪ ঘণ্টায় এই বিষয়ে অনেকটাই জেনেছেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিষয়ে মার্কিন সরকারের প্রতিরক্ষা দফতর একটি সমীক্ষা করে ১৯৬৭ সালে, সেই সমীক্ষা যারা করেন তাঁদের একজন ড্যানিয়েল এলসবার্গ, এই গোপন দলিলগুলো নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিকের হাতে তুলে দেন ১৯৭১ সালে কেননা তিনি সরকারী ভাষ্যের সঙ্গে একমত ছিলেন না। তাঁর বক্তব্য ছিলো এগুলো মার্কিন নাগরিক, যাদের অর্থে ভিয়েতনামে যুদ্ধ চালানো হচ্ছে, তাঁদের জানার অধিকার আছে। তিনি মনে করেছেন যে সরকার মিথ্যাচার করছে। একই সময় ওয়াশিংটন পোস্টের হাতেও এই দলিলগুলো পৌঁছে। দুই পত্রিকাই এগুলো ছাপার উদ্যোগ নেয়।

নিউইয়র্ক টাইমস ১৩ জুন থেকে ধারাবাহিকভাবে এই বিষয়ে প্রতিবেদন এবং দলিল ছাপতে শুরু করার পরে তিন দিনের মাথায় আইন মন্ত্রণালয় আদালতের কাছ থেকে সাময়িক রেস্ট্রেইনিং অর্ডার লাভ করে। এর আগে হোয়াইট হাউস এগুলো না ছাপতে অনুরোধ করেছিলো পরে হুমকি দিয়েছিলো যে তাঁদের রিপোর্টারদের হোয়াইট হাউসে প্রবেশাধিকার থাকবেনা। সরকারের বক্তব্য ছিলো এগুলো প্রকাশিত হলে ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ বিঘ্নিত হবে। নিউইয়র্ক টাইমস এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে উপস্থিত হয়।

সেই সময়ে নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে যোগ দেয় ওয়াশিংটন পোস্ট; দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদপত্র একত্রে সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছিলো এ কথা বলে যে নাগরিকের জানার অধিকার রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট ৬-৩ ভোটে রায় দিয়েছিলো যে, সরকার এটা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে যে কেনো এইসব দলিল প্রকাশের ফলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। এরপরে বোস্টন গ্লোব এবং অন্যান্য কাগজেও এইসব গোপন দলিল প্রকাশিত হয়। এক পর্যায়ে এসে সিনেটের এক সাব-কমিটির শুনানিতে সিনেটর মাইক গ্রাভেল এই সব দলিলের অংশবিশেষ জোরে জোরে পড়ে শুনিয়েছিলেন যাতে করে এই দলিলগুলো প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। পরে নিক্সন প্রশাসন এলসবার্গ আর তাঁর সহযোগী এন্থনিও রুশোর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, গোয়েন্দাবৃত্তি এবং সরকারী সম্পত্তি চুরির মামলা করেছিলো, সেই মামলায়ও সরকার পরাজিত হয়েছিলো।

সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্ট ১৯২৩ এর আওতায় আনা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এই ঘটনাগুলো আবার স্মরণ করলাম; কারণ একটি — তা হচ্ছে কি করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদপত্রগুলো একত্রিত হয়েছিলো। (যারা এই সময়ে ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক, পরিচালক এবং সম্পাদক কিভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা দেখতে উৎসাহী তাঁরা স্টিভেন স্পিলবার্গের তৈরি করা ছায়াছবি দ্য ‘পোস্ট’ দেখতে পারেন)। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জন্যে এই রকম মুহূর্ত তৈরি হয়েছে বলেই আমার ধারণা। রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে আনা মামলার মেরিট ইত্যাদি নিয়ে আইনজীবীরা ইতিমধ্যেই বলেছেন, তাঁরা রোজিনা ইসলাম বা তাঁর পক্ষ থেকে কীভাবে মামলা করা যায় সেই বিষয়েও পরামর্শ দিয়েছেন।

কিন্তু এই মামলার মর্মবস্ত কেবল তাঁর বিরুদ্ধে আনা কোনও ব্যক্তিগত মামলা বলে বিবেচিত হতে পারেনা। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের জন্যে যে আইন ব্যবহৃত হয়েছে সেটা নিয়েই প্রশ্ন তোলা দরকার। আশা করি আগামীকাল বা পরশু রোজিনা উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভ করবেন, হয়তো এই মামলা এক সময় হিমাগারে গিয়ে উপস্থিত হবে। কিন্তু এই মামলার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে এই আইনের প্রয়োগের সূচনা হল। সেটার কারণেই এখন এই কথাগুলো বলা দরকার। ফলে কেবল রোজিনা ইসলামের জামিনের মধ্যেই যেন সন্তুষ্টি না খুঁজি। জামিন হলেই যেন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ দিয়ে আনন্দের বন্যা না বইয়ে দেই। জামিন প্রাপ্তি নাগরিক হিসেবে তাঁর অধিকার। তিনি বা তাঁর পক্ষে মামলা করা হবে কিনা সেটাও আলাদা বিষয়। যা বিবেচনার তা হচ্ছে অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্টের ব্যবহার।

আমি জানি বাংলাদেশের সংবাদপত্রের মালিকানার ধরণ, গণমাধ্যমের দলীয় সংশ্লিষ্টতা এবং দেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কারণে আমার এই প্রত্যাশাকে অনেকে নির্বোধসুলভ মনে করতে পারেন, আমি তাঁদের সঙ্গে ভিন্নমত প্রকাশ করবোনা। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহের কারণে এই কথাগুলো ইতিহাসের স্বার্থে হলেও বলে রাখা কর্তব্য মনে করে লিখে রাখলাম। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের এবং সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্তরা ভেবে দেখতে পারেন।

  • লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো

ফেসবুক পোস্ট, ১৯ মে ২০২১

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *