সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার, পাট থেকে পরিবেশবান্ধব বা পচনশীল প্লাস্টিক-পলিথিন; এমনকি সাইকেলের ফ্রেম, ঢেউটিন ইত্যাদির মতো আবিষ্কারে বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের অনন্য অবদান বিশ্বজুড়ে প্রশংসা অর্জন করেছে। সেই সাথে প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি ক্রমবর্ধমান সচেতনতার জাগরণে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ-বান্ধব পাটপণ্যের উত্তরোত্তর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে এমনকি পৃথিবীব্যাপী যখন ভয়াবহ করোনা মহামারি চলছে, যখন অর্থনৈতিক মহামন্দার কবলে গোটা বিশ্ব এবং বাংলাদেশের সমস্ত রপ্তানীপণ্যের বাজার ভয়ানকভাবে সঙ্কুচিত হয়ে গেছে তখন আমাদের পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার চাইতেও ১৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। তৈরী-পোশাকের পরেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দিক দিয়ে এটা ২য় অবস্থানে উঠে এসেছে। আর কাঁচামাল আমদানীর খরচকে বিবেচনায় নিলে গার্মেণ্টের চেয়ে এখনও পাট থেকেই বাংলাদেশ অধিক বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। অথচ আমরা দেখছি,
বাংলাদেশ শুধু নয়, গোটা পৃথিবীর মানুষ-প্রাণ-প্রকৃতিকে রক্ষার উপযোগী এই অনন্য শিল্প যাতে ধ্বংস হয়ে যায় সেজন্য রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
কী অভিযোগ পাটশিল্পের বিপক্ষে? অভিযোগ হচ্ছে এই শিল্প লাভজনক নয় এবং এক বাঁচাতে রাষ্ট্রকে ভর্তুকি দিতে হয়। কিন্তু আমরা জানি, যেকোন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বা সেবাখাতকে বেসরকারিকরণের সাধারণ কৌশল হিসেবে এই যুক্তিকে কাজে লাগানো হয়। এই যুক্তি যারা দেয়, তারাই ধারাবাহিকভাবে বহু ধরণের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর প্রেক্ষাপট তৈরী করে। এই চক্রটি পাটশিল্পের জন্য লাভজনক নীতিমালা প্রণয়ন, আধুনিক উপযোগ সৃষ্টি ও প্রাযুক্তিক সুবিধা প্রয়োগে সবসময় স্বেচ্ছাকৃত উদাসীনতা দেখিয়ে থাকে।
আমরা জানি, পাটশিল্পের বিদ্যমান সংকট ও তা উত্তরণের উপায় নিয়ে এ যাবত অজস্র গবেষণা হয়েছে, কিন্তু সে গবেষণার ফলাফল বা গবেষণালব্ধ সুপারিশগুলো আমলে নিয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বরং বিজেএমসি ও তার নিয়ন্ত্রিত পাটকলগুলোতে ইচ্ছেকৃত অব্যবস্থাপনা, অর্থ তছরুপের উদ্দেশ্যে কাঁচা পাট ক্রয়ে বিতর্কিত ব্যবস্থা এবং স্বার্থপর সিন্ডিকেট দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন পরিচালনাসহ সকল ক্ষেত্রে সরকার অনুমোদিত দুর্নীতিবাজদের নেতৃত্ব বজায় রেখে সম্ভাবনাময় পাটশিল্পকে লোকসানী করে ফেলা হয়েছে। আর এখন সেই লোকসান বা ভর্তুকিকে অজুহাত বানিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে সরকার ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিদের হাতে ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হচ্ছে। এমনকি এজন্যে ৫ হাজার কোটি টাকা সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে বিদায় করার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর যন্ত্রপাতি নবায়ন, আধুনিক প্রযুক্তির সংস্থাপন, পণ্য বৈচিত্র্যকরণ ও কার্যকর পাট গবেষণার মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী এই খাতকে লাভজনক করে তুলতে এর চাইতেও অনেক কম টাকার দরকার হবে। কিন্তু না, রাষ্ট্রীয় কোষাগার, কৃষক, শ্রমিক তথা সমস্ত দেশের স্বার্থের চাইতে সরকারের কাছে সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট এবং ঋণদাতা সংস্থাগুলোর অদৃশ্য স্বার্থ সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পারস্পরিক স্বার্থ সুরক্ষার প্রশ্নে তারা এখন সর্বগ্রাসী করোনা সংকটের সময় বাংলাদেশের অজস্র শ্রমিক ও কৃষকের জন্যে আরও ভয়াবহ সংকট অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। লক্ষাধিক মানুষের যাপিত জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়ার পাশাপাশি পাটশিল্পে বাংলাদেশের নিশ্চিত সম্ভাবনাকে শেষ করে ফেলার চক্রান্ত করছে।
এদেশের মানুষ-প্রাণ-প্রকৃতি তথা সারা বিশ্বের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার স্বার্থে আমরা এই ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার বিরোধিতা জানাই। আমাদের প্রস্তাব:
১. অবিলম্বে রাষ্ট্রায়ত্ত সকল পাটকল চালু করতে হবে।
২. পাটখাতকে লোকসানী করার পেছনের চক্র উৎখাত করতে হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
৩. পাটকলগুলোর আধুনিকায়নে সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৪. সারা দুনিয়ায় পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে তাকে কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৩০ জুন ২০২০