গত ২২/০৪/২০২০ তারিখে রাষ্ট্রচিন্তার আয়োজনে ‘করোনাকালে সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংকট: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় অংশ নেন নৃবিজ্ঞানী হেলাল মহিউদ্দিন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী রীয়াজ এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ হাসনাত কাইয়ূম। রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষ থেকে ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করে রাখাল রাহা। উল্লেখ্য, এই আলোচনায় সাংবাদিক নুরুল কবীরের অংশগ্রহণের কথা থাকলেও বিশেষ অসুবিধার কারণে তিনি যোগ দিতে পারেন নি।
আলোচকবৃন্দ করোনাসৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যে সঙ্কটগুলো দেখা যাচ্ছে তার সুলুকসন্ধান করেছেন, পাশপাশি আসন্ন অর্থনৈতিক ক্রাইসিসকে মোকাবিলা করার উপর জোর দিয়েছেন। তারা বলছেন, কেবল ত্রান দিয়েই এই সংকটকে মোকাবিলা করা যাবে না, ত্রান কার্যক্রমের পাশাপাশি পরিত্রানের উপায়ও খুঁজতে হবে। করোনা পরবর্তী রাষ্ট্রের চরিত্র যেন ইনক্লুসিভ হয় সেদিকে নজর রেখে দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রম ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণে আহ্বান জানিয়েছেন। আলোচনা দুইভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে তিনজন আলোচক তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন, ‘সম্পূরক অংশে’ তারা তাদের বক্তব্যের সাথে আরো চিন্তা যুক্ত করেছেন।
হেলাল মহিউদ্দিন
আমি একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করতে চাচ্ছি। গত উনিশ তারিখের ঘটনা, যেটা ইতালিতে ঘটলো। ডিসেম্বরে যখন চিনে করোনা ধরা পড়লো, তখন থেকেই ইউরোপ বেশ সতর্ক ছিল। সতর্ক হয়ে সকল ব্যবস্থা নেয়ার পরেও উনিশে ফেব্রুয়ারি আটলান্টা-ভ্যালেন্সিয়া লীগের খেলা ছিল। লীগের সাথে বাজার ব্যবস্থা ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যেমন বিজ্ঞাপন, দর্শক ইত্যাদি। ফলে ইতালি সেটা বাদ দেয় নি, এবং সেখানে চল্লিশ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিল, এর মধ্যে ফ্রান্সের লোক ছিল, স্পেনের লোক ছিল। ২৩ তারিখ ইতালিতে ধরা পড়লো, স্পেনে ধরা পড়লো, এর পর কি হলো তা তো আমরা জানিই। এটা বলার উদ্দেশ্য হলো এই যে বাজারের উপর এতো জোর দেয়া হলো, বাজারকে মূখ্য করে তোলা হলো তার জন্য ইতালি সাফার করছে এখন পর্যন্ত। তারা সেটা স্বীকার করেছে। একেবারে অকপটে স্বীকার করেছে। তারা ইউরোপের অন্যান্য দেশেও জানিয়েছে যে, আমরা একটা বড়ো ধরনের ভুল করেছি, এবং এখন কন্টাক্ট ট্রেসিং-এ যাচ্ছি। প্রথম বিষয়টা এই, দ্বিতীয়ত, তাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তারাও কোনো ধরণের সমস্যার মধ্যে পড়েনি। তাদের জন্য অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। ফলে নতুন এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো সামর্থ্য বিভিন্ন কারণেই ইতালির সে সময় ছিল না। আমরা জানি ইতালি অনেক দিন ধরেই একধরণের সঙ্কট ছিল, বিভিন্ন উপায়ে প্রণোদনার উপর ছিল। এরপর, ইতালি খুব সম্ভব ইউরোপের সবচেয়ে বেশি বয়স্কদের দেশ, অনেক বয়স্ক মানুষ এখানে রয়েছেন, সেকারনে মৃত্যুর হারও সেখানে বেশি ছিল। এই বিষয়গুলো আমরা জানি কারণ তারা বলেছে, তারা স্বীকার করেছে। ফ্রন্ট লাইন সার্ভিস প্রোভাইডার যারা আছেন, যেমন চিকিৎসক, নার্স, ক্লিনার, সবাইকে বলেছে, তোমাদের যা কিছু না, যা যা দরকার, একেবারে অকপটে বলো, সকাল-বিকালের রিপোর্টটা দাও। কো-অর্ডিনেশনের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা এই জায়গায় এরা একেবারে কোনো কম্প্রোমাইজ করেনি।
আমরা প্রায়ই শুনি বলা হয় বাংলাদেশক ইতালির সাথে তুলনা করা যাবে না, এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না। বিষয়টা আসলে সেরকম না। একটু ফিলোসফির কথা বলতে চাই। আসলে রাষ্ট্র কি? রাষ্ট্র একটা সোশাল কন্ট্রাক্ট, আমাদের সাথে রাষ্ট্রের একটা চুক্তি হয়েছে। এটা আজকের ব্যপার না, ইউনিভার্সেল ব্যাপার, সেই হবস, লক, মন্টেস্ক্যু থেকে এই আধুনিক সময় পর্যন্ত যে এবসুলিউট রিয়েলিটি সেটা হচ্ছে রাষ্ট্র একটা সোশাল কনট্রাক্ট। আগের প্রাক-আধুনিক সময়ে কনসেন্সটা ছিল একটা বড় বিষয়। এরপর রেনেসা, ফরাসী বিপ্লবের পর অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার মডার্ন স্টেট, তা যে আকারেই থাকুক, তা সে সমাজতন্ত্রী হোক, পুঁজিবাদী হোক, সোশাল কনট্রাক্ট তো আছেই; এটাকে কিন্তু বাদ দিতে পারবো না। আগে যেটা ছিল কনসেন্ট, ওটা আমরা প্রগ্রেস করে গেলাম আমরা এগ্রিমেন্টে, সেই এগ্রিমেন্ট থেকে জাতিসঙ্ঘ হলো, আমরা হিউম্যান রাইটস করে ফেললাম যে, রাষ্ট্র আমার অন্ন বস্ত্র বাসংস্থানের যোগান দিবে। আমি যখন বিপদে পড়বো তার ফান্ড থাকবে। এখন এই যে এগ্রিমেন্টের কথা বললাম সেটা কিন্তু রাষ্ট্র মানতে বাধ্য, রাষ্ট্রের একটা প্রস্তুতি থাকতে হবে।
আমরা যারা রাষ্ট্রচরিত্র নিয়ে আলাপ আলোচনা করছি, তারা এটা নিয়ে খুব একটা প্রশ্ন করছিনা যে, রাষ্ট্রের সাথে যে চুক্তি হয়েছে তার কতটা সে মানছে। এই যে গতকাল ভিআইপিদের জন্য আলাদা চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা উঠলো, হয়তোবা সেটা হবে না, সবাই যেহেতু সমালোচনা করছেন জোরেশোরেই, কিন্তু চিন্তাটা যে তাদের মাথায় এসেছে সেটা কি কারো কাছ থেকে কোনোধরণের সম্মতি নেয়া হয়েছে? আমি ভিআইপির কথাটা বাদই দিলাম। আমরা যদি খানিকটা পিছনে ফিরে যাই, ৬৪ জন সচিবকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, ৬৪টি জেলায় তারা কো-অর্ডিনেট করবে। এখন আমরা জানি আমলাতন্ত্র ও নির্বাহী বিভাগের ধরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা সমাজবিজ্ঞানে বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পাই, হামজা আলভী থেকে শুরু করে অনেকেই বলেছেন, আমলাতন্ত্র সবকিছু ছাড়িয়ে চলে যায়, এর পাওয়ারটা জেনেরিক, খর্ব করার কিছু নাই। আমাদের আমলাতন্ত্র কিন্তু সেরকম অবস্থায় নেই। আমাদের এখানে যে পলিটিক্যাল ইউনিটি আছে এর কাছে সেটা অনেকটাই আটকা। তাদের নিজস্ব ক্ষমতা বলতে আমি তেমন কিছু দেখি না, আমি বলবো যেটা রাষ্ট্রপক্ষ চাইবেন তারা সেটা মানতেই বাধ্য থাকেন। এর বাইরে গিয়ে নিজস্ব শক্তি হিসেবে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ পায় না।
রাষ্ট্রের সঙ্কট নিয়ে যেহেতু কথা হচ্ছে, আমি অন্তত চারটা জায়গায় নিয়ে কথা বলবো। প্রথম সঙ্কট হচ্ছে প্রচণ্ড রকম আস্থার সংকট। শুরুতে রাজনৈতিক দলের সাথে যারা জড়িত, তাদের কথা চিন্তা করা হয়েছি, কিন্তু তাদের উপর কেউই আস্থা রাখতে পারেনি, জনগণ যেমন পারেনি, তেমনি তার নিজের দলও পারেনি। সেই আস্থা সঙ্কটের জায়গাটা থেকে আবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ৬৪ জেলার আমলাদের। তারা আসলে সেখানে গিয়ে কতটা কমফোর্ট ফিল করবেন সেটা আমি প্রচণ্ড রকম সন্দিহান। তাদের কমফোর্ট ফিল করার কথাও নয়। এই কাজগুলো তারা করতে পারবেন না, যে বিষয়গুলো একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা মেম্বার জানবেন, একটা ওয়ার্ডে কতজন আছে, কার কি লাগবে, কে আসলে ত্রান পাওয়ার যোগ্য, কে যোগ্য না, সেটা কিন্তু এই সচিবরা জানবেন না। তারা যারা বাইরে থেকে যাবেন, তাদের কথা কেনো তৃণমূল পর্যায়ে রাজনীতি করা মানুষরা শুনতে যাবে? এই প্রশ্নগুলো আমার মাথায় আসছে, আস্থার সঙ্কট, বিশ্বাসবোধের সংকট এটা আমাদের একটা বড় সঙ্কট। সরকার যা যা বলছেন, এতজন আক্রান্ত, এতজন মারা যাচ্ছেন, এসব কোনো তথ্যের উপর জনগণ কিন্তু আস্থা রাখতে পারছেন না, বিশ্বাস করতে পারছেন না। সেই বিশ্বাসের জায়গাটা আমাদের রাষ্ট্র কিন্তু নষ্টও করে ফেলেছে।
এই কারণে মানুষজন ঠিক সরকারী নির্দেশও মানতে চাচ্ছে না। ফলে, এই যে বিভিন্ন জায়গায় আমরা লোক সমাবেশ দেখছি, সেখানে আরো কিছু চিন্তার জায়গা আছে। লকডাউনের যে কনসেপ্টটা, এটার সাথে লোকজন কিন্তু কোনভাবেই নিজেকে একাত্ম করতে পারছেন না, পারার কথাও নয়। না পারার কারণও হচ্ছে মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পের মতো, আমরা আসলে অনেক মিথ্যা কথা শুনেছি। তথ্য গোপনের একটা বড়ো ধরণের চক্রের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এবং এই অবস্থা থেকে নিস্তার আমি দেখিনি কত কিছু সময় ধরে, ফলে একটা অনাস্থার জায়গা তৈরি হচ্ছে। এটা খুব বড় সঙ্কট, রাষ্ট্র যদি এই সঙ্কটে বেশিদিন পড়ে যায় তাহলে কীভাবে বিপদে পড়বে তা আলোচনাতেই বোঝা যাবে। আফটার ম্যাথ বা ফলাফল নিয়ে এখনি চিন্তা করতে হবে। সবকিছু যখন স্বাভাবিক হবে তখন অবস্থা কী দাঁড়াবে সেটা নিয়ে এখনি ভাবতে হবে। রাষ্ট্র আবার নিজের মতো করে ফাংশন করতে পারবে কি? চিন্তা করেন, আমাদের যে মিলিটারি বা পুলিশ ফোর্স আছে যাদেরকে এখন আমরা ব্যবহার করছি, তাদের মধ্যে এক্সোশান আসবে, এটা আসার পর তখন কীভাবে সেটা মোকাবিলা করবেন? এমন পরিস্থিতির পরে অপরাধের এক ধরণের বড়ো ঢেউ দেখা দিবে তখন কি হবে? এসব নিয়ে কিন্তু রাষ্ট্রের প্রস্তুতি দেখতে পাচ্ছি না। এটা কিন্তু চিন্তার জায়গা থেকে খুব বড়ো সঙ্কট।
অনেকেই জানেন যে, চীনে ভাইরাসটা শনাক্ত করার পর who যখন জানালো কোয়রেন্টাইন বা আইসোলেশনের কথা, ঠিক সেই সময় চল্লিশ জন বিখ্যাত সাইকোলজিস্টরা একটা গবেষণায় নেমেছেন, একধরণের একশন রিসার্চ, প্রতিদিন কি হচ্ছে সেটা তারা কম্পাইল করে দেখছেন। সেখানে তারা দুটো কথা পরিষ্কার করে বলেছেন যে, লকডাউনের বিষয়টা নিয়ে রাষ্ট্রকে নতুন করে চিন্তা করতে হবে। লোকজনকে ঘরে বসিয়ে রাখা খুবই ডিফিক্যাল্ট। বাজারও অনেককে বাইরে নিয়ে আসছে। আমরা দেখেছি, আমেরিকায় কি হচ্ছে, অধিকাংশই ডানপন্থী ঘরণার লোক, হয়তোবা তাদের দলের, ট্রাম্পের উষ্কানিও আছে। বাজারের প্রভাব আছে। তো, সেই একশন রিসার্চে, তারা বলছেন যে, দুই উপায়ে মানুষকে রাখা যেতে পারে, একটা হচ্ছে তাদেরকে ইন্সট্যান্টলি রিওয়ার্ড দিতে হবে, তাদেরকে পুরস্কার দিতে হবে, তারা যেন নিজেদের পুরষ্কৃত বোধ করে। আরেকটা হচ্ছে, বলা যায়, অপটিমিজম বায়াস। করোনা ভালোয় ভালোয় শেষ হয়ে গেলে, যদি ভালো কিছু হয়, তখন আমরা ভালো কিছু পাবো, তখন রিওয়ার্ড দেয়া হবে: অন্যরকম কিছু পাবো, অন্যরকম সমাজ পাবো, জব সিকিউরিটি বাড়বে। এই দুটো বোধ যদি তৈরি করা যায় তখন এটা কাজ করবে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় যে অবস্থা দেখতে পাচ্ছি তাতে বোঝা যাচ্ছে লকডাউন কাজ করছে না। বাংলাদেশেও লকডাউন যে কাজ করছে না তা নিয়ে আক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই, এই ইনফরমেশনগুলো রাষ্ট্রের সবসময় জানার দরকার ছিল। একটা শক্ত কো-অর্ডিনেশন দরকার ছিল। একটা সেন্ট্রাল সেল থাকার দরকার ছিল, যারা প্রতিদিন একশন রিসার্চ মাধ্যমে তথ্যগুলোকে বিশ্লেষন করবে। আমরা কিছুদিন আগেই দেখলাম যে, এখানে যে তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে তা কতটা কাঁচা হাতে করা হচ্ছে। আমাদের অনেক এক্সপার্ট আছে, এমনকি ভার্সিটির শিক্ষার্থীরাও এগুলোতে দক্ষ। যদি তাদের কাজে লাগানো যেত তাহলে অসঙ্গতিগুলো থাকতো না। এটা হচ্ছে রাষ্ট্রের স্ট্রাকচারাল ক্রাইসিস, বা কাঠামোগত সঙ্কট।
তৃতীয়ত আমরা বড়ো ধরণের রাষ্ট্রনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। আমরা দেখছি আমরা বারেবারে কল্পিত শত্রু আবিষ্কার করি, ষড়যন্ত্র তত্ত্বের দিকে যাই। অন্য কারো ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়ার যে প্রবণতা সেটা আসলে প্রমাণ করে আমাদের আত্মবিশ্বাস নেই। করোনার কারণে যে ফেইলারটা এখানে আসবে তার ফলেও দেখা যাবে একে ওকে ব্লেইম করা শুরু হবে। ব্লেইম গেইম যখন শুরু হয় তখন আমরা বুঝে ফেলি রাষ্ট্র ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড দুর্বল। এর অনেক নমুনা আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি। বড়ো ধরণের সমস্যা হয়ে যেতে পারে, এগুলো কন্ট্রোল করার বিশেষ কোনো মেকানিজম আমাদের হাতে নেই।
যে মেকানিজমগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে পক্ষপাত দেখতে পাচ্ছি, সেগুলো খুব অনেস্টলি, বা ট্রান্সপারেন্টলি হ্যান্ডল করা হচ্ছে না।
চতুর্থ বিষয় হচ্ছে যোগাযোগের সঙ্কট, একটা বড়ো ধরণের সঙ্কট। উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। উনষত্ত্বরের গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে একাত্তরের সবগুলো সময়ে ডাকসুর একটা বড়ো প্রভাব ছিল। গ্রামে তখন আজকের মতো সেলফোন ছিল না, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কিছুই ছিল না। লোকজন তখন অপেক্ষা করতো ডাকসু কি বলে? ডাকসু যা বলছে সেটা কিন্ত গ্রামে পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। উনষত্ত নিয়ে কাজ করতে দেখেছি, ডাকসুর প্রভাব সেই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়তো। ডাকসুর মতো একটা পাওয়ারফুল ফোর্স, তার অনেক পরে যা পেলাম, অনেকদিন কিন্তু সেটা ছিল না। পলিটিক্স তো একটা ইম্পর্টেন্ট ইনস্টিটিউশন, স্টুডেন্ট পলিটিক্সের ধরণটা ন্যাশনাল পলিটিক্স বা পাওয়ার পলিটিক্সের চেয়ে আলাদা। এটা কিন্তু এখন একেবারেই ইনেক্টিভ। এই যে বিশাল ফোর্স সেটাকে কিন্তু পোস্ট-করোনার পিরিয়ডে, বা এখনো একটা বড়ো ভলেন্টিয়ার গ্রুপ হিসেবে ব্যবহার করতে পারতাম।
এখন এই সঙ্কটটাকে কীভাবে উত্তরণ করা যায়? এটা একটা বড়ো পয়েন্ট। এখন যদি পলিটিক্যাল ফোর্সটাকে মবিলাইজ করা যায়, যদি কোনো পজিটিভ চেঞ্জ আনা যায়, যেটা আমাদের খুব নেগেটিভ দিকে চলে গেছে, তাহলে একটা সুযোগ আছে। দ্বিতীয়ত, আমরা যখন গণতন্ত্রের কথা বলছি, একটা বিরোধী দল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি সেটা ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের জন্যই। আপনি কানাডায় দেখেন, আমি কিছুদিন সেখানে রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম। সেখানে বিরোধী দলকে টিকিয়ে রাখার জন্য তো এলাউন্স দেয়া হয়। তারা জানে যে এই বিরোধী দল আরেকটা শক্তি যেটা খুব দরকার। বিরোধী দল তো আমাদের এখানে নেই, এবং ভয়ঙ্কর দুর্বল। এখন যদি আমরা সৎভাবেই সঙ্কট থেকে উত্তরণ চাই, তাহলে একটা বিরোধী দলকে আনতেই হবে। আমাদেরকে যেকোনো ভাবেই হোক ইনক্লুসিভ হতেই হবে। এক্সক্লুসিভ হতে গিয়ে আমাদের এখানে আরেকটা বিষয় হয়েছে, একধরণের উগ্র জাতীয়তাবাদ কিন্তু এখানে বেড়ে যাচ্ছে। আপনারা যারা সমাজের পরিবর্তন খুব ক্লোজলি খেয়াল করছেন তারা এটা সহজেই টের পাবেন। আপনারা দেখবেন, আমরা খুব সহজেই ডিভাইডেড হয়ে যাচ্ছি।
আলী রীয়াজ
হেলাল মহিউদ্দিন কতোগুলো গূরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন, তো এখন সেখানে থেকেই আলোচনাটা শুরু করা যেতে পারে। আমরা সেই জায়গা থেকে আলোচনা অব্যাহত রাখতে পারি কিন্তু আমি আবার অন্য জায়গা থেকেও আলোচনাটা করার পক্ষপাতি। যেমন ধরুন আপনি রাষ্ট্র এবং সরকারের সংকটের কথা তো বলছিলেন, ধরেন আমরা ধরে নিচ্ছি সেটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংকট, বাংলাদেশে এখন যে সরকার আছে এবং যে শাসন ব্যবস্থা আছে সেগুলোকে মাথায় রেখে, সেগুলোকে সামনে রেখে আলোচনাটা, তাইতো? কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র তো বৈশ্বিক যে কাঠামো তাঁর বাইরে তো নয়? এবং ঘটনা যেহেতু এমন একটা মহামারি যেটা সর্বব্যপ্ত হয়েছে তাইনা? তো এখন সেই সর্বব্যপ্ত হলে যেগুলোকে আমরা ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড বলি সেগুলো ব্যর্থ হয়েছে আরো অনেক কতোগুলি ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, বৈশ্বিকভাবেই ঘটে যাচ্ছে। যেমন ধরুন, বলা হচ্ছে চীন একধরণের সাফল্য অর্জন করেছে এই করোনা মোকাবিলায়। কিন্তু বৈশ্বিকভাবে যে রাষ্ট্র কাঠামোর কতগুলি পরিবর্তন কিন্তু হতে থাকবে আপনি এটাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রের সইংকটটা আগামীতে বুঝা যাবেনা। এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখতে পাচ্ছি সেটা হচ্ছে অতীত যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যেমন ছিলো, তাঁর কতগুলি সমস্যা ছিলো সেই কাঠামোগত সমস্যাগুলো আমরা দেখছি ।
হেলাল মহিউদ্দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা যেটা বলেছেন সেটা হচ্ছে যে আমাদের সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট নাই, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই সোশ্যাল কন্ট্র্যাক্টটা কিন্তু থাকার কথা ছিলো, আসলে ছিলো। আমাদের যদি আপনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দেখেন তাহলে ঐখানে একটা স্পষ্ট সোশ্যাল কন্ট্রাক্টের কথা আছে, যে রাষ্ট্র কি দেবে আপনাকে, তাইনা? মানবিক মর্যাদা দেবে, সামাজিক ন্যায়বিচার দেবে, সাম্য দেবে, এইগুলি হচ্ছে চুক্তি, সে চুক্তিগুলি মানা হয়নি। তো , আমি সেটাতে পরে আসি। বৈশ্বিক রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো ঘটবে বলে আমার ধারণা, যার প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে এবং তাঁর আলোকেই কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্টড়ে একটা পরিবর্তন আমি পাই, সেটা কি? সেটা হচ্ছে, একবারে বাইনারি হিসসাবে না হলেও , একেবারে পরস্পর বিরোধী না হলেও এখানে দুটো প্রবণতা, দুই ধরণের রাষ্ট্রের একটা বোঝাপড়া হবেই। একটা হচ্ছে, ইঙ্কলুসিভ স্টেট আরেকটা হচ্ছে এক্সক্লুশনারি স্টেট। এই যে এক্সক্লুশনারি স্টেট তাঁর একটা ফল, একটা আকার হচ্ছে আপনার অথেরিটেরিয়ান সরকার। কেবল মাত্র সরকার যে অথেরিটিয়ান তা না কিন্তু, স্টেটটা খুব এক্সক্লুশনারি। যেমন ধরেন , চীনের কথা বলেন, নর্থ কোরিয়ার কথা বলেন এরকম আপনি ইরানের কথা বলেন। এখন করোনা সংকটে এই এক্সক্লুশনারি স্টেট তৈরির জন্য যে স্টেট আসলে তাঁর একাউন্টেবিলিটির জায়গা তাঁর ট্রান্সপারেন্সির জায়গাগুলিকে যতোটা পারে কমিয়ে আনে। কমিয়ে আনাটাই হচ্ছে তাঁর কাজ, কারণ ঐ এবসেন্স অফ ট্রান্সপারেন্সি হচ্ছে তাঁর রক্ষাকর্তা। তথ্য না দেয়াটা হচ্ছে তাঁর রক্ষাকর্তা, কিছু লোককে সার্ভ করাটা হচ্ছে তাঁর রক্ষাকর্তা। এগুলো হচ্ছে এক্সক্লুশনারি স্টেট। এখন যদি এক্সক্লুশনারি স্টেট তৈরি হয় তাঁর গভার্নেন্স যদি হয় অথেরিটেরিয়ান , তাহলে আপনি, বৈশ্বিকভাবে এই বিজয়ডংকা যদি বাজতে থাকে এবং এই বিরোধের মধ্যে আপনি থাকেন, তাহলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা কিরকম হবে যে রাষ্ট্রটা তাঁর সোশ্যাল কন্ট্র্যাক্টটা ভেঙ্গে ফেলেছে?
এবার মহিউদ্দিনকে ধার করে বলি, আস্থার জায়গাটা নেই, মোরাল লেজিটিমিটি কুয়েশ্চেনেবল হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের মোরাল লেজিটিমিটি কুয়েশ্চেনেবল হয়ে গেছে। কারণ কি জানেন? আমি গত তিন সপ্তাহে তাই দেখতে পাই, যে রাষ্ট্র দাবী করেছে ৮ শতাংশের মতো সে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে সে দুই সপ্তাহ লোকজনকে খেতে দিতে পারছেনা, চৌদ্দ শতাংশ মানুষের হাতে খাবার নেই , প্রথম সপ্তাহ, দুই সপ্তাহের মধ্যে। আপনি বলতে পারেন যুক্তরাষ্ট্রেও তো ফুড এর জন্য লাইন দিচ্ছে, তাইনা? কিন্তু দিচ্ছে। লাইন দিচ্ছে, পাচ্ছে। সেটা কি পার্ফেক্ট? অফকোর্স , পারফেক্ট না। এই যে, আজকেও আমরা যখন কথা বলছি, গতকাল রাতে মানে ভোরের দিকে ওয়াশিংটনে যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে যে সেকেন্ড স্টিমুলাশ বিলটা পাশ হয়েছে ছোটা ব্যাবসায়ীদের জন্য। কারণটা কি? কারণ ফার্স্ট স্টিমিউলাশ বিলের মধ্যে যতটুকু ছিলো তাতে যথেষ্ট নয়, এখন হচ্ছে যে, আপনি ব্যক্তিগতভাবে, হ্য , আমার সবচেয়ে অপছন্দের ঘটনা ঘটেছে, মানে অপছন্দের ঘটনা হচ্ছে , চেকের মধ্যে, ব্যক্তিগতভাবে যেসব চেক পাবে আমেরিকায় তাতে টট্রাম্পের সাক্ষর লাগবে, সেটা আগে অতীতে হয়নি। কিন্তু, এই যে রাষ্ট্র কাঠামো, বৈশ্বিক রাষ্ট্র কাঠামোর এই লড়াই , বৈশ্বিক রাষ্ট্রকাঠামোর এইসব ইঙ্কক্লুসিভ- এক্সক্লুশনারি স্টেট তঈরির যে লড়াই তাঁর মধ্যে বাংলাদেশ কোথায়? বাংলাদেশ কোথায় যাবে? এখন পর্যন্ত লক্ষণগুলো ভালো না, কারণ হচ্ছে, আপনি ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ঐরকম একটি রাষ্ট্রকাঠামৈ তঈরী করেছেন, যার লিনিংটা হচ্ছে এক্সক্লুশনারি স্টেট। এবং এক্সক্লুশনারি স্টেটের যে লক্ষণগুলো এটা তাঁর স্টেট কেবল সুপার ইম্পজড নয়, এটা তাঁর সমাজের ভেতর থেকে উঠে তো, এটা বাংলাদেশের সমাজের মধ্যেই এক্সক্লুশনারি ন্যাচার টা কোথায়? এক্সক্লুশনারি ন্যাচারটা হচ্ছে, হেলাল মহিউদ্দিন বলেছেন যে জাতীয়তাবাদে। আপনি দেখেন, ভালো করে তাকালেই আপনারা সবাই বুঝতে পারবেন যে, হ্যা এটা সবসময়ই ছিলো, এটাকে ফেনিং আউট করা হয়েছে, বড় করা হয়েছে।
এখন যখন আবার সংকট হবে, ঐ যে ষড়যন্ত্রের নামে, এইটার নামে, ঐটার নামে আপনি দেখবেন এক্সক্লুসিভ স্টেটের মধ্যে, ইতোমধ্যে, যেহেতু আমি তো বাংলাদেশকে হাইব্রিড রেজিম বলি, তো হাইব্রিড রেজিমের মুখটা ক্রমাগতভাবে যেহেতু অথেরিটেরিয়ান রেজিমের দিকে, এক্সক্লুশনারি স্টেটের দিকে, সেহেতু যখন গ্লোবালি এই চেঞ্জটা হতে থাকবে তখন সে এক্সক্লুশনারি স্তটেটের দিকে যাবে। আমি আমার একটা লেখায় ও বলেছি, বলার চেষ্টাও করেছি বিভিন্ন জায়গায় যেটা সেটা হচ্চছে যে আমড়া একটা ক্রসরোডের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। এইযে দেখছেন যে মিস্টার ট্রাম্প বলছেন খুলে দাও খুলে দাও, কারণটা কি? একেবারে বাণিজ্য। একেবারে নেহাত বাণিজ্য আর কিছুই না। মানুষ মরলো কিনা সেটা বিবেচনায় নেই কারণ ওইরকম রাষ্ট্রই যুক্তরাষ্ট্র, বিভিন্নভাবেই তৈরি হয়েছে এবং, এখন যেটা দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে ট্রাম্পের শাসন আসার পরেই যে এটাকে একেবারে খুব ক্রুডলি ঐজায়গায় নেয়া হচ্ছে । এমন একটা ওষুধের পরামর্শ দিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যেটাতে গবেষকরা বলছেন যে এটাতে লোক বেশী মারা যায়, তারপরও বলেন তাও সেটা ব্যবহার করুক, কারণ কি? আমরা একটা কিছু করছি এটা দেখাতে পারলে বাণিজ্য অন্যদিকে চলে যায়। আপনি বাংলাদেশেও তাই দেখবেন ইতিমধ্যে যে কথাগুলো হচ্ছে, হ্যা বাংলাদেশের ক্রাইসিস্টা কোথায়, লাইফ এবং লাইভলিহুডের ক্রাইসিসের মধ্যে আমরা পড়ে গেছি তো, যে জীবন বাচাবো না বেঁচে থাকব মানে খাবার দাবার যোগাড় করবো। যদি জীবন বাঁচাতে চাই তারও কোনো ব্যবস্থা হয়নি, লাইভলিহুডেরও ব্যবস্থা হয়নি।
আসুন, আমরা একটু গ্লোবাল কন্টেক্সে বিবেচনা করি, যে এই জায়গায় আপনি শেষ পর্যন্ত এক্সক্লুশানরি স্টেট তৈরি হচ্ছে কি হচ্ছেনা , বাংলাদেশের মোড়টা সেদিকে দেবো। ডমেস্টিক্যালি এবার আসুন, ডমেস্টিক্যাল্লি যে ক্রাইসিসগুলো, এটা কেবল সরকার এর ক্রাইসিস নয়, সরকারের ক্রাইসিস নিয়ে আমরা আলোচনা করবো, বাংলাদেশে একয়াট ঘটনা যেটা ঘটেছেবাংলাদেশের রাষ্ট্র, সরকার , দল একাকার হয়ে গেছে , বিপদজনক, ভয়াবহ বিপদজনক। এটা হলে কি হয়? এটা ইনক্লুশনারি স্টেটে কখনোই এই ধরণের অবস্থা হতে পারেনা বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি ডেসিনেটেড হয়েছে, ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, যদি আপনি এক্সক্লুশনারি স্টেট করেন যা অথোরিটেরিয়ান গভর্নেন্সর মাঝেই চলে যান, চীনে দেখুন, চীনে পার্টি, সরকার এবং রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থকু কোথায়? কোথাও নেই। ভিয়েতনামে দেখুন, কম্বোডিয়াতে সেটা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কেবল মাত্র যে সোশ্যলিস্ট প্ল্যাটফর্ম থেকে করা হয়, কমিউনিস্ট আদর্শ এর নামে করা তা তো নয়, আপনি ইজিপ্টে দেখুন, তুরস্কে দেখুন, তাহলে কি হয়? এই ধরণের রাষ্ট্র করে কি, সে রাষ্ট্র সরকার এবং দলকে একাকার করে ফেলে। এই যে একাকার করা, এই প্রবণতাটাও বাংলাদেশে আছে, ডমেস্টিক্যালি আমি এখন যদি দেখি, তাহলে সরকারের সংকট আর রাষ্ট্রের সংকট আপনি আলাদা করতে পারবেন না।
এই যে ত্রাণ বন্টন নিয়ে শেষ পর্যন্ত সচিবদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে, তাঁর মানে কি? সচিবরা কি করবেন আমাকে বলুন? ত্রাণ বন্টন তাহলে জনপ্রতিনিধি বলে যারা দাবি করেন, যাদের অনেকেরই নির্বাচিত হওয়ার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমি জানি, আপনি জানেন, সবাই জানি আমরা, তাদের প্রতি আস্থা নেই, আস্থা থাকবে কি করে? আপনই তো একাউন্টেবল নন, আপনি নির্বাচিত হয়েছেন আন-একাউন্টেবল প্রসেসের মধ্য দিতে, তাই তো? তাহলে আপনার একাউন্টেবিলিটি কোথায়? কোথাও নেই। আপনাকে যখন আপনার পার্টিও বলে দিচ্ছে যে আপনাকে আমি আর আস্থা রাখিনা,আপনাকে আমি আর আস্থায় রাখিনা, আপনি যে বলবেন না আস্থা রাখেন, সেটা বলতে পারছেন না। পার্লামেন্টের বৈঠক বসছে সেখানে লোকজন উপস্থিত আছে, পার্লামেন্টের লোকজনেরা, কিন্তু, ত্রাণ বন্টনের ক্ষেত্রে তাদের কোনরকম দায়িত্ব না দিয়ে রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করাচ্ছি, আমি তো বুরোক্রেসিকে রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে মনে করি, কারণ ঐদিন একটা প্রশ্ন তুলেছেন, রিলেটিভ অটোনমি, কোথাও আসলে বুরোক্রেসি কাজ করতে পারে, তাইনা? যেটা গবেষকরা বলেছেন যে, রিলেটিভলি অটোনোমাস তারা করতে পারে, এটা কোরিয়াতে আমরা দেখতে পেয়েছি, আবার এটার খুব ভয়াবহ জিনিস আমরা চিলিতে দেখতে পেয়েছি, বুরোক্রেটিক অথোরিটি …ভালো ও হয়, খারাপ ও হয়। রিলেটিভ অটোনোমিইকোনোমিক গ্রোথ ডেলিভার করতে পারে, কিন্তু এটা একাউন্টেবল হয়না। বুরোক্রেসি রিলেটিভ্লি অটোনোমাস হলে সেটা একাউন্টেবল হয়না, আপনাকে গ্রোথ ডেলিভার করতে পারবে অফকোর্স, চিলির মতো। কিন্তু একাউন্টেবল হবেনা।
তাইলে আপনি একটা আন একাউন্টেবল স্টেট, তাদের আন একাউন্টেবল হওয়ার কারণ হচ্ছে যে বুরোক্রেসি তাঁর আসলে স্টেটের অংশ, রাষ্ট্র একাউন্টেবল হবে থ্রু তাঁর ইলেক্টেড লেজিসলেটিভ বডি’র মাধ্যমে। কোথায় সেটা? আপনার লেজিসলেটিভ বডি নাই। দশ বছর ধরে আপনি দেখেন, ২০১৪ সাল থেকে কমপ্লিটলি এবসেন্ট একটা লেজিসলেটিভ বডি। পার্লামেন্ট বসলেই তো আর পার্লামেন্ট বলা যাবেনা। তাঁর কোনো বিরোধী দল নেই, তার কনো মানে সে কাউকে প্রশ্ন করেনা, প্রশ্ন করতে চায়না, করার দরকার নেই, তাহলে, এই যে সচিবদের দায়িত্ব দেয়া হলো, ত্রাণ বন্টনে কি সাফল্য আসবে? আস্তে পারে, আমি জানিনা, কিন্তু তাঁর লং টাইম কন্সিকুয়েন্সটা বলুন, যে দায়িত্ব ছিলোয় আসলে ইলেক্টেড রিপ্রেজেন্টেটিভদের, নির্বাচিতদের, যে রাষ্ট্রের ছিলো দ্বিকন্দ্রীভূত প্রশাসনের, সেটাকে আপনি সেন্ট্রালাইজড করে দিলেন, কেউ শক্তিধর হলেই তা ডিসেন্ট্রালাইজড হয়না, আপনি সেমিটারিয়েত নিয়ে দেখিয়েছেন, তাই তো? এটাকে আমলাতন্ত্র শব্দটা লোকে নেগেটিভলী বলে, কিন্তু আমলাতন্ত্রের তো নেসেসিটি আছে, একশো………আমরা তো বুঝতে পারি এর নেসেসিটি আছে, কিন্তু আপনি সেন্ট্রালাইজড করলেন তো, রাষ্ট্র কি এই সেন্ট্রালাইজড স্টেট? আপনি এবার বুঝুন, এক্সক্লুসনারি স্টেটের প্যাটার্ণ তৈরি হচ্ছে তাঁর সঙ্গে এখন আপনি সেন্ট্রালাইজড করছেন, এম্নিতেই বাংলাদেশে ক্ষমতা অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত। ডিসিশান ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী না নির্দেশ দিলে কিছুই হয়না, হয়না এটা আবার তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, যে প্রধানম্নত্রীর নির্দেশেই করা হয়েছে, এটা বলেন, সবাই বলেন, এমনকি কিছু হলেই সবাই বলেন যে প্রধানমত্রীর হস্থক্ষেপ চাই।
তো এমনিতেই আপনি এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে আছেন, তারমধ্যে আরো আপনি আমাকে ত্রাণ বন্টনটা সেন্ট্রালাইজড করেছেন, এইযে প্যাটার্ণ গুলো, এগুলো হচ্ছে সংকট। এই সংকটগুলো আপনি মোকাবিলা করবেন কীভাবে? এই সংকটগুলা মোকাবিলার জন্য একয়াট হচ্ছে বৈশ্বিক পর্যায়ে যেটা হবে এই ব্যাটিলটা হবেই। আমরা একটা ক্রসরোডের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি এই ব্যাটলটা আপনি এভয়েড করতে পারবেন না। এই ব্যাতলটা উঠবে কোথা থেকে জানেন? আমার ধারণা, আমি ভুল হতে পারি। কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত দেখতে পারি চীনের দায় দায়িত্ব নেয়া নিয়ে যে প্রশ্ন সেটাই হচ্ছে মূল প্রশ্ন। বেটার হবে। আমি ট্রাম্পদের ভাষায় কথা বলছিনা, please don’t get me wrong, আমি কোনো অবস্থাতেই ট্রাম্পের এই যে WHO’র ডিফান্ডিং, টাকা না দেয়া ,WHO কে কেন্দ্র করে চীনের উপর চড়াও হুয়ার চেষ্টা, এগুলো আমি মোটেই সঠিক মনে করিনা, আমি মনে করি এগুলো হচ্ছে তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এখন তাঁর যে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ সেটা থেকে ডিফ্লেক্ট করার চেষ্টা করছেন উনি। কিন্তু দ্যাট রিমেইন্স, এটা তো থেকেই গেলো যে চীন কি আসলেই ট্রান্সপারেন্ট ছিলো? এটা কেবল চীনের করোনাভাইরাসে ট্রান্সপারেন্সীর প্রশ্ন নয়, এখন যে গ্লোবাল শিফটটা হবে সেই শিফটে আপনি যেহেতু চীন একটা মডেল অফার করার চেষ্টা করছে সেহেতু এটা প্রশ্ন হচ্ছে, এক্সক্লুশনারি স্টেট ভার্সেস ইনক্লুশনারি স্টেট। একাউন্টেবল স্টেট ভার্সেস আন একাউন্টেবল স্টেট। আপনি বলেন সেখানে বাংলাদেশের স্টেটকে আপনি কোথায় দেখতে পান? আজকের বিবেচনায় বলুন, আমার বলার দরকার নেই। তাইনা? আমি আপনার কাছে ছেড়ে দেই। তাঁর মধ্যে আপনি ইন্টার্নাল রিডমেস্টিক্যালি যেটা করছেন সেন্ট্রালাইজড করছেন পাওয়ার। অলরেডি সেন্ট্রালাইজড একটা পাওয়ার সিস্টেমের মধ্যে আছেন, এমনকি ত্রানের চাল বিষয়টি ঢাকার থেকে ৬৪জন সচিবকে দিয়ে করতে হয় আপনার। এগুলোই হচ্ছে সংকটের জায়গা।
বের হবেন কি করে? একটা বড় চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য সোসাইটির চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের সোসাইটি একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো সেটা আমরা খুব লো-কোহেসিভ সোসাইটির মাঝে আছি। আমাদের বাংলাদেশের সোসাইটি, কোহেশনটা কিন্তু দূর্বল। হেলাল মহিউদ্দিন সমাজবিজ্ঞানী আমার চেয়ে হয়তো আরো ভাল ব্যখ্যা করতে পারবেন কিন্তু আমি যেভাবে দেখি, লো-কোহেশন টা কোথায় জানেন? লো-কোহেশনটা হচ্ছে এই জায়গায় আপনি দেখুন যে আমরা মানে সামাজিক সংঘঠনের সাথে যুক্ত হইনা, আমাদের বাইন্ডিং এর জায়গা হচ্ছে রেলিজিওন একমাত্র অথবা ন্যাশনালিজম। তাইনা? এর বাইরে আমিও দেখিনা সোসাইটির কোহেশনটা কোথায়? আমি দেখিনা, ভুল হলে বলুন আমাকে যে রিয়াজ আপনি ভুল করছেন, আপনি বুঝেনা নাই, আমি সেটা মানবো। কিন্তু এই লো-কোহেসিভ সোসাইটি তৈরি হয়েছে কেনো? কারন আপনি এমন একটা ইকোনোমিক পলিসি পারসিউ করেছেন, নিউ লিবারেল ইকোনোমির সবচেয়ে ওরস্ট পসিবল ওয়েটা আপনি নিয়েছেন। নাই ইটশেলফ, নিউ লিবারেল পলিসি একধরণের ডিস্ক্রিমিনেশন ডিস্পারিটি তৈরি করে।আপনি তাঁর থেকেও ভয়াবহ ডিস্পারিটি তৈরী করে ফেলেছেন বাংলাদেশে। ইকোনোমিস্টদের সাথে কথা বলুন। আপনি যিনি সহগ যেটা, কোয়েফিসিয়েন্ট, আপনি দেখুন সেটা বাংলাদেশের অবস্থা, তো সেই কারণে এম্নিতেই যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে কোহেশনের জায়গাটা দূর্বল। তাঁর মধ্যে যদি এতোবড় সংকট তৈরী হয় সমাজের যা কিছু আছে সেগুলো ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হবে। এবং কতোটুকু, ডিস্পারিটিটা কতোটুকু স্বাভাবিক হয়ে গেছে আপনি বলুন যে মানে হাসপাতালে, এই বিপদের মাঝে হাসপাতালে ব্যবস্থা করা হয়েছে, ভিয়াইয়াপি হলে আপনি এক হাসপাতালে যাবেন। আপনার রাষ্ট্র তো তাহলে আপনাকে সমান ভাবলোনা। একি ভয়াবহ সংকট! আপনি রাষ্ট্রকে সব দিলেন, নাগরিক হিসেবে সব দিলেন, চুক্তির আওতায়। কিন্তু রাষ্ট্র আপনাকে বললো, আপনি আইন মানবেন, ট্যাক্স দিবেন,রাস্তায় বেরুলে আপনাকে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং এর কথা বলবে, আপনি মানুন কিংবা না মানুন আপনাকে সেটা মানতে বাধ্য করার চেষ্টা করানো হবে, করার অধিকার দেয়া হয়েছে। অধিকার তো দিয়েছেন নাগরিক হিসেবে, তাইনা? সেই জায়গায় রাষ্ট্র আপনাকে তারপরে কি বলেছে? রাষ্ট্র আপনাকে বলেছে হাসপাতালের জন্য তুমি সুবিধা পাবা না, এটা তোমার জন্য অন্য জিনিস। এই যে, এক্সক্লুশনারি মুড, সোসাইটির মাঝে এই যে ডিস্পারিটি, এই যে আপনার কোহেসিভনেস এর অভাব, মানুষ মানুষের সাথে দাড়াতে পারছেনা, এই সংকটগুলো আপনাকে মোকাবিলা করতে হবে। মোকাবিলার একটাই উপায়। রাখাল, আমি শেষ বাক্যটা বলি, আমি আলোচনা আরো করবো সেটা হচ্ছে ইনক্লুসিটি নিয়ে, এখন ইনক্লুসিটি আপনি কোথায় দেখবেন? ইকোনোমিতে ইনক্লুসিটি দরকার। পলিটিক্সে ইনক্লুসিটি দরকার।
বাংলাদেশের পলিটিক্সটাই তো নাই। এবসেন্স অফ পলিটিক্স টা ভাবুন, আমি বিরোধীদল নিয়ে খুব কম চিন্তিত। বিরোধীদল তৈরী হবে, আপনি পলিটিক্স রাখুন না হলে যারা আছে তারা শক্তিশালী হবে আর যদি না হতে পারে এটা তাদের দূর্ভাগ্য, তাদের ব্যপার। কিন্তু পলিটিক্স তো নাই। পলিটিক্স যে নাই তাঁর সবচেয়ে লাউড এন্ড ক্লিয়ার মেসেজ কেইম ফ্রম প্রাইম মিনিস্টার, উইথ ডিউ রেস্পেক্ট টু হার, বাস্তবতাঁর কারণে উনি কথাটা বলেছেন, বাট ফ্যাক্ট রিমেন্স, দিজ ইজ লাউড এন্ড ক্লিয়ার, যে আপনার ত্রাণ বন্টনের সমন্বয়য়ের জন্য সচিবদেরকাছে যেতে হয়েছে। আপনার না পেরেছে বিতর্কিত শাসন, না পেরেছে দল, না পেরেছে স্থানীয় প্রশাসন।
হাসনাত কাইয়ূম
আমরা তো একাত্তর সালে একটা দেশ স্বাধীন করলাম। যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানকে আমরা বললাম, এই পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাল আমার দেশ, এটা বাংলাদেশ। এখন এই ভূখন্ডকে আমরা যে আলাদা করলাম, আলাদা করার সময় আমাদের একটা চুক্তি হয়েছিল, যেমনটা হেলাল মহিউদ্দিন ও আলী রীয়াজ বলছিলেন। সেটা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মধ্যেই পাবেন, আমরা একটা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের রাষ্ট্র গঠন করতে চাই। স্বাধীন হওয়ার পর, মানে ১৯৭১ এর ১৬ ই ডিসেম্বরের পর, আমরা এক বছরের মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটা সংবিধান প্রণয়ন করলাম। মানে, সংবিধানের মাধ্যমে আমরা চুক্তিটাকে আরো একটু এলাবোরেট করলাম। এই এলাবোরেশনের জায়গায় যে ঘটনা ঘটলো সেটা হচ্ছে, আমরা যাবতীয় ক্ষমতাকে এক পদে কেন্দ্রীভূত করলাম। রাষ্ট্রের আইনবিভাগ, বিচার বিভাগ, এবং নির্বাহী বিভাগ এই তিনটা বিভাগের ক্ষমতাকে এক পদে কেন্দ্রীভূত করলাম। এরপর, রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে আর কোনো পার্থক্য রাখা হলো না। রাষ্ট্র ও সরকারে মধ্যে যখন পার্থক্য থাকে না তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যে দল যায় সে দলের সাথে রাষ্ট্রের কোনো ফারাক থাকে না। ফলে দল, সরকার, এবং রাষ্ট্র যখন একটা ক্ষমতার কেন্দ্রে আসে, তখন এই ক্ষমতাটা দলের একজন প্রধানের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়।ক্ষমতার জায়গাটা আপনি এভাবে বন্ঠন করলেন।
রাষ্ট্র পরিচালনার যে আইনগুলো ব্রিটিশরা এখানে চালু করছিল, যেটাকে ব্যবহার করে পাকিস্তান আসলে তার নিপীড়ন ও শোষণ চালিয়েছিল, ব্রিটিশরা এখানকার সম্পদকে তার দেশে পাচার করার জন্য যে ইকনোমিক স্টাইলটা চালু করছিল, সময়ে সময়ে আমরা সেটা নাম বদলালেও একই রেখেছি। এখানে একইভাবে আপনি রাষ্ট্র পরিচালনার আইনকানুন, প্রশাসনিক আইন কনুন, অর্থনৈতিক আইনকানুন এডপ্ট করলাম। আমরা যখন আইন কানুন বিষয়ে কথা বলি তখন আসলে দেওয়ানি ও ফৌজদারী আইনের মধ্যে আমাদের আলাপটাকে রাখি। কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালনার আইন, রাষ্ট্র যে অর্থটা আমার কাছ থেকে তুলে নেয়, রাষ্ট্র যে অর্থটা বন্টন ও ব্যায় করে, সে যে মোবাইল কোর্ট ব্যবহার করে আমার কাছ থেকে টাকাটা তুলে নিতে পারে, এই যে প্রশাসনিক আইন বা ক্ষমতাকাঠামো, কিংবা যে বিচারবিভাগকে সমস্ত কিছুর কেন্দ্রে নেয়া হয় সেই বিভাগ যে আইনে চলে, অর্থ্যাৎ, এই বিচারবিভাগ, আইনবিভাগ, শাসনবিভাগ, এই সবকিছু ব্রিটিশ আমলে ও পাকিস্তান আমলে যে আইনে হতো, সেগুলোকে আপনি বাহাত্তর সালে বৈধতা দিলেন। সংবিধানের ১৪৯ নং আর্টিকেলে একটু চোখ বুলিয়ে দেখবেন। (এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে সকল প্রচলিত আইনের কার্যকরতা অব্যাহত থাকিবে, তবে অনুরূপ আইন এই সংবিধানের অধীন প্রণীত আইনের দ্বারা সংশোধিত বা রহিত হইতে পারিবে।) তার মানে, আপনার পুলিশ আইন একইরকম রইলো, আপনার মেজিস্ট্রেসি ঐরকম রইলো। আপনার রাজনৈতিক দলের ব্যাপার একইরকম রইলো। রাষ্ট্রক্ষমতার সবকিছু একই রকম থাকলো। একটা পাকিস্তান মডেল তৈরি করলেন, পাকিস্তান মডেল চলতো ব্রিটিশ মডেলে। সেই মডেলটা কি? ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি। বাংলাদেশেও আপনি একই ঘটনা ঘটালেন। বাংলাদেশে সংবিধানে সকল ক্ষমতাকে যে কেন্দ্রীভূত করা হলো, সেই ক্ষমতাকে যেন কোনো জবাবদিহিতা করতে না হয় সে জন্য ৭০ ধারা যুক্ত করা হলো। (কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরুপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি-(ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা
(খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।) তারপর কারা নির্বাচিত হবে কীভাবে নির্বাচিত হবে সেটা আপনি ধারা ১২৩(৩) যদি দেখেন তাহলে দেখবেন যে পথে ক্ষমতাটা চর্চা হয়, যে পথে নির্বাচনটা হয়, সেই পথটা হচ্ছে এই রকম যে, নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো শান্তিপূর্ণ উপায়ে আপনি ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবেন না। তারমানে, এই যে প্রচণ্ড কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সেখান থেকে সরানোর উপায় কি? হয় আপনাকে ষড়যন্ত্র করতে হবে, চক্রান্ত করতে হবে, খুন করতে হবে, অথবা একদল মাস্তানদের রাখতে হবে যারা তাকে টেনে ক্ষমতা থেকে নামাতে পারবে। এর বাইরে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে দল বদল করবেন সে উপায় সংবিধানে রাখা হয়নি। না রাখার কারণে দেখা গেলো, বাহাত্তর থেকে যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে শুরু করলাম, পচাত্তরে যে নির্মম ঘটনা ঘটলো তার ফলে বাংলাদেশ বিভক্তের রাজনীতি খুব স্পষ্ট হয়ে উঠলো। যে বিভাজন আজ পর্যন্ত মিটানো সম্ভব হয় নি। ফলে রাজনীতি হয়ে দাঁড়ানো কোন না কোনো ভাবে ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, বল প্রয়োগ, বেআইনি পন্থায় শক্তি সমাবেশ করা, জিঘাংসা মনোবৃত্তি নিয়ে রাজনীতি করা। হেলাল মহিউদ্দিন কানাডার যে উদাহরণ দিলেন, সেটা তো সম্ভবই না। কারণ, এখানে ক্ষমতায় যাওয়া হয় দেশ চালানোর জন্য না, অন্যকে শায়েস্তা করার জন্য। ফলে এখানে আসলে কোনো রাজনীতি নেই, এখানে যা তৈরি হয়েছে সেটা হচ্ছে, যারা ক্ষমতায় যেতে চায়, বা যিনি ক্ষমতায় যেতে চান তার একটা প্রাইভেট বাহিনী। এই প্রাইভেট বাহিনী আসলে ক্ষমতা চর্চার জন্য, বা অন্যের ক্ষমতা চর্চা থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য, বা, ক্ষমতা চর্চার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কিছু সমমনা ব্যক্তি রাজনৈতিক দলের মুখোশে ঐক্যবদ্ধ হয়। এটার সাথে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, দেশের কোনো সম্পর্ক নেই, দেশের কল্যানের কোনো সম্পর্ক নেই। এবং এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের সাংবিধানিক এরেঞ্জমেন্ট। ফলে করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক পরিস্থিতি ইনক্লুসিভ হলেও, যদি আমাদের মেইনস্ট্রিম রাজনীতি এই সাংবিধানিক ধারায় চলে, তাহলে তাকে এক্সক্লুসিভ ও সহিংস হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। দেখা যায়, এখন যারা ক্ষমতায় আছে, তারা তাদের আগের টার্মে আরো লিবারেল ছিল, এর আগের টার্মে আরো লিবারেল ছিল। অর্থ্যাত, যতদিন দিন যাচ্ছে সে ততই সহিংস হয়ে উঠে। কোনো ভাবে সে ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হলে, তার নিজের তার পরিবারের নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমাদের ক্ষমতাসীন দলের সেক্রেটারী জেনারেল যখন বলেন, আগামী নির্বাচনে হয় তোমাদের জিততে হবে, নাহয় পালাতে হবে, এবং এটা যখন পাবলিকলি বলে, তখন তো আসলে রাজনৈতি সংস্কৃতি নিয়ে আলাদা করে আলাপ করার আর দরকার নেই।
আমি যে সঙ্কটের কথা বলছি, আমরা যে চুক্তিটা করেছিলাম সেটা থেকে বাহাত্তরেই সরে গিয়েছি, এরপর কখনো এগিয়েছি, কখনো পিছিয়েছি, গণ আন্দোলনের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে ভোট দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করছি, সেই ক্ষমতা আদালতকে ব্যবহার করে শাসক শ্রেণি কেড়ে নিয়েছে, এরকম আগে-পিছের মাধ্যমে এখানে শাসক শ্রেণি তাদের শাসন সবল করেছে। চল্লিশ-ষাট -সত্তর দশকের যে ভ্যালুজ তা প্রচলিত আইনের কাছে মার খেয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি রাজনৈতিক আইনের নিপীড়নের মধ্য পড়ে, আপনি সংস্কৃতি দিয়ে তো আর রাজনৈতিক আইনকে আটকাতে পারবেন না। আমাদের এখানে মনে করা হয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলালে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বদলাবে, কিন্তু ঘটনাটা আসলে উল্টো। এখানে যেহেতু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একজন সিংহপুরুষ লাগে, সে নারী হোক বা পুরুষ হোক, তার এবসলিউট ক্ষমতা চর্চা করার দক্ষতা থাকা লাগবে। এই দক্ষতার জন্য দলের উপর নিয়ন্ত্রণ লাগে, কাউন্সিল করে সব ঠিক করে দিবেন। দল যদি গণতান্ত্রিক হয় তাহলে গণতান্ত্রিক একজন নেতার পক্ষে এমন স্বৈরতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্ভব না। দল যদি সৈরতান্ত্রিক বা ব্যক্তিতান্ত্রিক হয়, তাহলে রাষ্ট্র পরিচালনা স্বৈরতান্ত্রিক হতে বাধ্য।
এখন করোনাকালে এসে কি হয়েছে? মধ্যবিত্ত এতদিন বুঝতেই পারেনি যে, তার একজন ডাক্তার মারা যাবে এবং একজন মাস্ক ব্যবসায়ী বলবে এটা আমার ভুলে চলে গেছে। আমরা যে সংকটের কথা বলছি, যা বাহাত্তর থেকে কেবল ঘনিভূত হয়েছে, তা আসলে এই সাংবিধানিক সঙ্কট, এটা কেবল দল পরিবর্তন, সরকার পরিবর্তন দিয়ে সম্ভব না। যারা আমাদের এখানে বলে যে, বাহাত্তর সংবিধান লাগবে তারা আমার মনে হয় বাহাত্তর সংবিধানের মূলনীতি অংশটা কেবল পড়ে দেখে। আপনি সংবিধানে কোনো মূলনীতির জন্য আপনি আদালতে যেতে পারবেন না, আপনার গনতন্ত্র থাকবে কি থাকবে না সেটা নিয়ে আদালতে যেতে পারবেন না। সংবিধানের ৮(২) ধারায় বলা আছে, মূলনীতি অনুযায়ী রাষ্ট্র চলবে এটাই হচ্ছে কথা। কিন্তু যদি আপনার মনে হয় যে এটা মূলনীতি অনুযায়ী চলছে না, তাহলে তাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তো আদালতে যেতে পারবেন না। অর্থ্যাৎ, রাষ্ট্র গণতন্ত্রে যাবে, না ব্যক্তিতন্ত্রে যাবে এইসব আসলে বাহাত্তর থেকেই আমাদের রাষ্ট্রের সংবিধানেই ইনহেরেন্ট আছে। পঞ্চাশ বছর ধরে এটা নিয়েই চলছি। করোনার সময়ে এসে আসলে কি হয়েছে? করোনার সময়ে দেখা গেলো যে সে আসলে শঙ্খিনী সাপের মতো, নিজের লেজ নিজে খাওয়া শুরু করছে। ও ওর মধ্যবিত্ত, জনপ্রতিনিধি, দল সব খেয়ে ফেলতেছে। সে নিজেকে না খেয়ে আর বাঁচতে পারতেছে না। সরকারের ঘনিষ্ট লোকদের হিসেবে এখানে প্রতিবছর একলক্ষ কোটি টাকা পাচার হয়। পাকিস্তানের মতো একটা ভঙ্গুর রাষ্ট্র যেখানে তার জনগণের জন্য এমন প্রণোদনা দিচ্ছে যা আপনি ভাবতেও পারছেন না, প্রণোদনার নামে আপনি স্রেফ ফাঁকিবাজি করেছেন, প্রণোদনা যখন দিলেন সব চাপিয়ে দিলেন ব্যাংকের গাঢ়ে, তিন/ছয় মাস পর এগুলো কার্যকর হবে। আপনার গোডাউনে যে চাল আছে, সেই চালটা বিতরণ করার মতো আপনার হাতে কোনো সাংগঠনিক ক্ষমতা নেই, রাষ্ট্রের নেই, তার সরকারের নাই, তার দলেরও নাই। একটা সরকার ১০ বছর যাবত ক্ষমতায় আছে, বাংলাদেশে ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলে কি কি করা সম্ভব তা এখানে আলোচনা করছি না, কিন্তু তাদের হাত থেকে আপনি ত্রানের চালটা পর্যন্ত রক্ষা করতে পারছেন না। সে চাল, তেল লুকিয়ে ফেলছে, এটাই আসলে শাসকশ্রেণির কালচার।এটা জনগণের কালচার না। এটা হচ্ছে ঔপনিবেশিক কালচার। ব্রিটিশরা এখানে এসেছিল ব্যবসা করতে, সে তাই সবার প্রথমে নিয়েছিল খাজনা দায়ের অধিকার। সে পরে দেখেছিল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলে খাজনা আদায় সহজ হবে। রাষ্ট্র ক্ষমতার জন্য রাজনীতি চালু করেছিল সে বাণিজ্য করার জন্য, পাকিস্তান ষাটের দশকে সেটা করেছে, আমরা টু নেশন থিওরি দিয়ে সেটা দেখিয়েছি। আজকেও একই কাঠামো দিয়ে যখন শাসন করা হচ্ছে তখন তাকে আর জবাবদিহিতা করা লাগছে না। আগে জমি থেকে টাকা নিতো, এখন আমাদের ছেলেরা বিদেশে কামলা খেটে যে টাকা পাঠাচ্ছে সেটা বিভিন্ন কসরতের মাধ্যমে আবার বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। আপনি এমন মাত্রায় পাচার করেন যে, আপনার লোকদের মাত্র পনেরদিন আপনি খাওয়াতে পারেন না। গত ৪৮ বছরে আপনি যত ঋণ করেছিলেন, পনেরদিনেই সেটা করে ফেলেন। একাত্তর সালে ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমরা যে রক্তাক্ত চুক্তি করেছিলাম, সেই চুক্তি থেকে যে সরে যাওয়া হচ্ছে, সেটার দিকে ফোকাস না করে, সেটা নিয়ে কোনো আলাপ না করে অন্য বিষয় নিয়ে যখন আলাপ করেন, বলেন যে এর-ওর মাধ্যমে একে-ওকে ক্ষমতা থেকে সরানো উচিৎ, তখন আসলে আপনি সেই সরে যাওয়াটাকেই সহায়তা করেন। আপনি রাষ্ট্রকাঠামো, রাষ্ট্র পরিচালনার আইন নিয়ে আলোচনা না করে আপনি বাংলাদেশকে ইনক্লুসিভ ধারায় নিতে পারবেন না। আপনাকে কয়েকদিন পরে লকডাউন তুলতে হবে, লকডাউন তুলা মানে তো আর করোনা ক্রাইসিস থেকে বের হওয়া না। এরপর আপনি অর্থনৈতিক ক্রাইসিসে পড়বেন। আপনি কি তখন এই ৬৪ জন আমলাকে দিয়ে সঙ্কট মোকাবিলা করবেন? যে দল ক্রমাগত ত্রানের চাল চুরি করছে, তাদের দিয়ে মোকাবিলা করবেন? আপনাকে তো ১৮ কোটি মানুষের কথা ভাবতে হবে। যে চুক্তি থেকে আমরা সরে এসেছি, সেগুলোতে ফিরে আসতে হবেই। সংবিধানের যে মূলনীতি আছে সে অনুয়ায়ী যেন রাষ্ট্র চলে, যদি না চলে তাহলে যেন জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকে, ক্ষমতা কাঠামো যেন এই মূল নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে, পঞ্চাশ বছর পূর্তি সামনে রেখে এগুলো আমাদের ভাবতে হবে। এটা একটা বড়ো কাজ। এটা না করে আপনি অন্য কাজে হাত দিতে পারবেন না। পারবেন না যে তার একটা উদাহরণ দেই। ধরেন, বাংলাদেশে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন আছে। সেখানে দুর্যোগ, ত্রান, সবকিছু নিয়ে আলোচনা আছে। যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কারণে দূর্যোগ দেখা দেয় তখন কি হবে তাও বলা আছে, কিন্তু যদি খোদ সরকার বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কারণেই দুর্যোগ দেখা দেয় তখন কি আপনারা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারব? সেটা কিন্ত বলা হয়নি। আমাদের এখানে বলা হয় আইন প্রয়োগের সমস্যা, প্রয়োগের সমস্যা আসলে এইটা যে, সরকারকে বাধ্য করার মতো, জবাবদিহিতার জায়গা আনার মতো, কোনো ধরণের লিগ্যাল এপারেটাস বা ইনস্টিটিউশন বা ব্যবস্থা আমাদের নেই। এখন বলতে পারেন, লিগ্যাল সিস্টেম ঠিক করলেই কি দেশ ঠিক হয়ে যাবে? না। কিন্তু সংবিধান কেন বানানো হয়েছে? একটা গাইডলাইনের জন্যেই, রাষ্ট্র চালাতে হলে কিছু জিনিস লাগবে। কিন্তু সেখানেই যদি গলদ থাকে! এই জিনিস নিয়ে কথা বলা, সংস্কারের চেষ্টা করা এই সময়ের কাজ। এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে যদি আপনি ঠিক করতে চান, তাহলে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কি কি ভুল ভ্রান্ত আছে, এই ভুলভ্রান্তিগুলো কেনো হয়, এটা কি ব্যক্তিগত নাকি ব্যবস্থাগত ত্রুটি, সেটা নিয়ে আলাপ করাই এসময়ের অন্যতম রাজনৈতিক আলাপ। এটার পক্ষে জনমত তৈরি করাই হচ্ছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করা। এক ব্যক্তিকেন্দ্রিকের বিপরীতে আপনি যখন গণক্ষমতাকেন্দ্রিক দল করেন, তখনই আসলে আপনি রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক কাজ করেন।
সম্পূরক অংশ
হেলাল মহিউদ্দীন
সবকিছু যে অভার সেন্ট্রালাইজ হয়ে গিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমাদের হওয়ার কথা ছিল ডিসেন্ট্রালাইজড। হই নি। আমাদের রাষ্ট্র হয়ে গেছে এক্সক্লুশনারি স্টেট। হাসনাত কাইয়ূম যেটা বলছিলেন, আমাদের রাষ্ট্রের মূল ইনস্ট্রুমিন্টে গলদ রয়ে গেছে। এর একটা একটা গ্লোবাল পরিপ্রেক্ষিত আছে, ওয়েলফার স্টেটগুলো দেখেন সেখানে সোশাল কন্ট্রাক্ট মেইন্টেন করা হয়, সেখানকার শ্রেণী বিন্যাস, সামাজিক কাঠামো কীরকম! আমাদের সোশাল কন্ট্রাক্ট একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছে। আমাদের সামাজিক কাঠাবো পিরামিড শেপড, একেবারে উপরে ধনিক শ্রেণি, খুব সামান্য। এখন হয়তবা খানিকটা বেড়েছে, তবু সামান্য। মধ্যবিত্তের একটা বিস্তৃতি ঘটেছে, কিন্তু একটা বড়ো অংশ এখনো গরীব শ্রেণি। হ্যাঁ, বিভিন্ন কারণেই এখানে মিডল ক্লাস এক্সপাড করেছে, যেমন, গ্লোবালাইজেশন, ফড়িয়া ব্যবসা, গার্মেন্টস, যদিও গার্মেন্টস এখানে কোনো ইন্ডাস্ট্রি হতে পারেনি, এটা কেবল একটা দর্জি হাউস। তবু এখনো গরীব মানুষের সংখ্যা অনেক। আমাদের প্ল্যানিং আসলে পুওর সেন্ট্রিক হওয়া দরকার। করোনার পরবর্তী সময়ে সামাজিক কাঠামোতে একটা শিফট আসবে, মিডল ক্লাস আবার সংকুচিত হবে। উপরের শ্রেণির হয়তোবা খুব একটা পরিবর্তন আসবে না, তারা নিজেদের মবিলাইজ করে ফেলতে পারবে। আমি আসলে শিউর না এখন আমাদের কোন দিকটা নিয়ে কাজ করা দরকারর আমাদের সংবিধানও চেঞ্জ করা দরকার, কিন্তু সেটা এখন সম্ভব না, বিচার বিভাগ যে আমব্রেলা হয়ে ছিল সেটাও উড়ে চলে গিয়েছে। একটা সোশ্যাল ডিসঅর্ডারের আশংকা রয়েছে। আমি আবারো ট্রাস্টের জায়গাতেই ফিরে যাচ্ছি। করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের এই ওভার-সেন্ট্রাইলাইজড ব্যবস্থার দিকেই নজর দিতে হবে। এখন যদিও ৬৪ জন আমলাকে দিয়ে করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু এটা কাজ করবে না, আন্দাজ করাই যাচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন নিয়ে কথা বলতে হবে, এখানে জবাবদিহিতার বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক্সপার্টদের সমন্বয়ে একটা ন্যশনাল কমিটি করতে হবে, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে, কিন্তু অভার-সেন্ট্রালাইজড সরকারি ব্যবস্থার কারণে খুব একটা আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। আর অলটারনেটিভ লিডারশিপের বিষয়টা তো আছেই।
আলী রীয়াজ
তিনটা বিষয়ে বলি। প্রথমেই আশু করণীয় কাজ হচ্ছে, মানুষকে বাঁচানো। খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্রের কাছে এই দাবি করতেই হবে, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেন। এর পাশাপাশি, করোনাকালে অন্য বিষয়ে ভাবতে হবে। করোনার পরে আপনি বিপদেও পড়ে যেতে পারেন, আবার বিপদমুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। বাজেট কীরকম হবে, সেটা এখন থেকে আলোচনা শুরু করতে হবে। বাৎসরিক বাজেট হবে, নাকি দুই বছর মেয়াদি বাজেট হবে সেটা অর্থনীতিবিদরা ভালো বলতে পারবেন। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। অন্য দেশগুলো হয়তোবা ৬ মাসেই উতরে যাবে, কিন্তু আমরা কি আদৌ এই সঙ্কট থেকে ৬ মাসে বের হতে পারবো সেটা সন্দিহান। তৃতীয় বিষয়ে, এই যে রাষ্ট্রের এত কিছু আলোচনা করছি, এই বিবেচনায় যে রাষ্ট্রের সঙ্কট আছে, এটা এভয়েড করতে পারবেন না। দীর্ঘমেয়াদি বা মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে, অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। রাষ্ট্রকে এই আলোচনায় আনতে হবে যে, গত ৫০ বছরে এখানে রাষ্ট্রের ননইনক্লুসিভ যে রূপ দেখেছি তা থেকে বের হওয়ার বা উত্তরণের উপায় কি সেটা বিবেচনা করতে হবে।
হাসনাত কাইয়ূম
প্রথম কথা হচ্ছে, খাবার। বাংলাদেশের মানুষ খাবারের অভাবে মারা যাবে এটা আসলে বাংলাদেশে হতে দেয়া যাবে না। রাজনীতিবিদদের একেবারে প্রথম কাজ হচ্ছে মানুষের খাদ্যের নিরাপত্তা তৈরি করা। এই আপদকালীন অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্যই তো তার কাছে ফান্ড থাকে, খাদ্য মজুদ থাকে। সেই খাদ্য মানুষের জন্য সঠিক ভাবে বরাদ্দ করা, পরিমাণমত বরাদ্দ হচ্ছে কি না সেটার নজরদারি রাখা, এবং সঠিকভাবে বিতরণ হচ্ছে কি না তা লক্ষ্য রাখতে হবে। এটা একেবারে প্রাথমিক কাজ। আমাদের কাছে যা আছে তা দিয়েই এটা ব্যবস্থা করা যাবে। আমি অর্মত্য সেনকে স্মরণ করছি, তিনি বলছিলেন, দূর্ভিক্ষে বেশিরভাগ মানুষ মারা গিয়েছিল খাবার নেই এই কারণে নয়, বরং মারা গিয়েছিল খাবারটা তার কাছে পৌছায় নি বলে। এই পৌঁছানোর নিশ্চয়তা দিতে হবে বা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মতো দেশ যারা ব্রিটিশ কলোনিতে ছিল তাদের সমস্যাটা অন্যদের চেয়ে আলাদা। এই বিপর্যয়ে এখানকার সকল কাঠামোর এক্সপোজড হয়ে গিয়েছে এটা যেমন দুঃখজনক ঘটনা, তেমনি এই কাঠামোর বাইরে গিয়ে, এই ব্রিটিশ কাঠামোর বাইরে গিয়ে, একেবারে আমাদের মতো করে একটা কাঠামো গড়ে তুলতে হবে, এই পরিস্থিতিতে এই কাজগুলোর মাধ্যমেই ভাবতে হবে। একেবারে ত্রান না দিলে যেমন আমাদের মুক্তি নেই, তেমনি কেবল ত্রান দিলেও মুক্তি নেই। ত্রানের পাশাপাশি পরিত্রানের জন্য বাংলাদেশের যে সম্ভাবনা আছে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে, হেলাল মহিউদ্দীন যেমন বলছিলেন, আমাদের মধ্যবিত্তকে সামনে আসতে হবে। এখানে পিরামিডের উপর মানুষের সংখ্যা খুবই অল্প। পাকিস্তান আমলে ছিল ২২ পরিবার, এখন বাংলাদেশে মোটিভেটেড কায়দায় যারা চুরি করে তাদের সংখ্যা ২২০০ এর বেশি হবে না। আঠারো কোটির মানুষের বিপরীতে এই ২২০০ মানুষের শাসন ও নিপীড়ন, সেটাকে মোকাবিলা করতেই হবে।