‘বিনা বিচারে হত্যা’ এই শিরোনামে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে কোনো আইন বা আইনের কোনো ধারা নেই। কিন্তু এই রাষ্ট্রে ৭২ সাল থেকে আইন হিসাবে যা প্রচলিত আছে তা ব্যবহার করেই প্রয়োজন মতো রাষ্ট্র যে কাউকে বিনা বিচারে হত্যা করতে পারে এবং হত্যাকারীদের বিচারের আওতা থেকে রেহাই দিতে পারে।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের যাত্রার প্রাক্কালে এর নাগরিকদের খুন করার অধিকার রাষ্ট্রের হাতে থাকবে কিনা তা নিয়ে কোনো আলাপ-আলোচনা হয়নি। ব্রিটিশ কলোনিয়াল রাষ্ট্র কিংবা পাকিস্তান রাষ্ট্র যেভাবে নাগরিককে খুন করার অধিকার ধারণ করতো স্বাধীন বাংলাদেশও রাষ্ট্র হিসাবে উত্তরাধিকারসূত্রে এ অধিকারটুকু সাথে নিয়েই যাত্রা শুরু করে।
৭২ সালের সংবিধানে নাগরিকদের যে কিছু মৌলিক অধিকারের বিবরণ দেয়া হয়েছে তার মধ্যে ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘জীবন ও স্বাধীনতার’ অধিকারটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কি সেটা?
আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
তার মানে কাউকে জীবনের অধিকার হইতেও বঞ্চিত করা যাইবে, তবে তা হতে হবে আইনানুযায়ী।
কিন্তু অনুচ্ছেদ ৪৬-এ আবার তাও কেড়ে নেয়া হয়েছে এভাবে :
এই ভাগের পূর্ববর্ণিত বিধানাবলীতে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি বা অন্য কোন ব্যক্তি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজনে কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যে কোন অঞ্চলে শৃঙ্খলা-রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কোন কার্য করিয়া থাকিলে সংসদ আইনের দ্বারা সেই ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করিতে পারিবেন কিংবা ঐ অঞ্চলে প্রদত্ত কোন দণ্ডাদেশ, দণ্ড বা বাজেয়াপ্তির আদেশকে কিংবা অন্য কোন কার্যকে বৈধ করিয়া লইতে পারিবেন।
এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘অন্য কোন ব্যক্তি’ এবং ‘কোন কার্য ’ শব্দবন্ধ দুইটি ভয়াবহভাবে অনির্দিষ্ট, যার মাধ্যমে রাষ্ট্র যাকে-ইচ্ছা-তাকে ব্যবহার করে যা-ইচ্ছা-তাই করতে পারে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের নামে।
অনেকেরই ধারণা জজ সাহেবের নির্দেশে জল্লাদ যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে তা বৈধ হলেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে পুলিশ বা র্যাব বা অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা যেসব মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে তা আইনের পরিপন্থী। এই ভাবনার ভ্রান্তি বোঝার জন্য আমাদের ‘পবিত্র’ সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদের আইনের সংজ্ঞাটি পড়ে নেওয়া প্রয়োজন :
‘আইন’ অর্থ কোন আইন, অধ্যাদেশ, আদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যে কোন প্রথা বা রীতি।” তার মানে হত্যা আইনানুযায়ী হতে হলে কি অনুযায়ী হলে চলবে তার একটা ধারণা এ সংজ্ঞা থেকে স্পষ্ট হচ্ছে।
এই সংজ্ঞা এবং সংবিধানের ১৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পুলিশ রেগুলেশন অ্যাক্ট, পুলিশ আইন, পেনাল কোড বা দণ্ডবিধি, ফৌজদারী কার্যবিধি ইত্যাদি সবই আইন। ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৬ ধারা হচ্ছে পুলিশের আসামী গ্রেফতারের বিধান সম্পর্কিত একটি ধারা। পুলিশ আসামীর গ্রেফতার নিশ্চিত করার জন্য কি পারবে আর কি পারবে না এ ধারায় তার বিবরণ আছে। এই ধারার ৩ নং উপধারায় বলা আছে :
এই ধারার কোন কিছুই কোন মানুষকে হত্যার অধিকার দেয়না যদিনা সে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে এমন কোন মামলার অভিযুক্ত না হয়।
তার মানে পুলিশ মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে এমন মামলার আসামীর গ্রেফতার নিশ্চিত করার জন্য তার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
পুলিশের কথিত ক্রসফায়ারের পর মৃতব্যক্তির পরিচয়ের সাথে যে ডজন খানেক মামলার বিবরণ দেয়া হয় তার মাজেজাটা আইনের এ ধারার সাথে যুক্ত। এই আইনের সাথে যদি দণ্ডবিধির ‘জেনারেল এক্সসেপশনস’ সংক্রান্ত ধারাগুলি মিলিয়ে পড়া যায় তবে দেখা যাবে এ অধিকার কতো অবারিত!
আমাদের দণ্ডবিধিটি তৈরী করেছিলো ব্রিটিশেরা সেই ১৮৬০ সালে। এর ৪র্থ অধ্যায়ে কোন কোন অপরাধ অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে না তার একটি তালিকা আছে, যার শিরোনাম হলো ‘সাধারণ ব্যতিক্রম’। এর প্রথমেই ৭৬ ধারায় বলা আছে:
কেউ যদি এমন কিছু করে যা করার জন্য সে আইনত বাধ্য অথবা সে ভুলবশত সরলমনে বিশ্বাস করে যে এটা করা তার দায়িত্ব তবে তা করা কোন অপরাধ হবেনা।
এ ধারার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর ব্যাখ্যা অংশটি। প্রথম ব্যাখ্যাতেই বলা হচ্ছে :
একজন সৈন্য যদি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আইনানুগ নির্দেশে একটি জনসমাবেশে গুলি চালায়, তবে তা সৈন্যটির অপরাধ হবে না।
এই ব্যাখ্যাতেই জনগণকে খুন করার প্রস্তুতি এবং খুনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রক্ষায় রাষ্ট্রের আইনী আয়োজনটি খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এ অধ্যায়ে এমন আরো অনেক ধারা ৭৬ থেকে ১০৬-এর মধ্যে ছড়ানো-ছিটানো আছে। তার মধ্যে ১০০ ধারা অনুযায়ী আত্মরক্ষার জন্য খুনের অধিকারের অপব্যবহারের অবাধ অধিকার তো আছেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে গ্রেফতার নিশ্চিত করার জন্য মৃত্যুঘটানো, নাকি আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করতে যেয়ে খুন; সরলমনে ভুলবশত খুন, নাকি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে খুন: নাকি কারো ব্যক্তিগত ক্ষোভ মেটাতে পুলিশকে ভাড়া করে খুন? এগুলো নির্ধারিত হয় কোন পদ্ধতিতে? আইনানুযায়ী পদ্ধতিটি সরকারী বাহিনীর জন্য খুব সহজ। পুলিশের খুন পুলিশই তদন্ত করবে, তার ঊর্ধ্বতন কর্তারা তদন্ত করবে, বড়োজোর একজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট তদন্ত রিপোর্টটি অনুমোদন করবেন। তদন্তে যদি দেখা যায় পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিল কিংবা খুন করতে বাধ্য হয়েছিল, তাহলে তো এটাই প্রমাণ হয় যে খুন করাটাই তার কর্তব্য ছিল। ভয়াবহ বিষয় হলো এ তদন্তের ক্ষমতাটি তাদের একচ্ছত্র, যাদের মারা হয়েছে তাদের পক্ষের কারোর এ তদন্তে অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি আমাদের যে ‘স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন’টি রয়েছে, এ ক্ষেত্রে তাদেরও নাক গলানোর কোনো সুযোগ নেই।
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, বিনা বিচারে হত্যা এবং হত্যাকারীদের রেহাই দেওয়ার আইনী বিধান এই রাষ্ট্রের রয়েছে। তাহলে আমরা যারা এসব ভয়াবহ অমানবিক খুন-খারাবী নিয়ে সত্যিসত্যিই উদ্বিগ্ন, যারা অন্তত পুলিশ বা ইত্যাকার বাহিনীগুলির হাতে বিনা বিচারে মানুষ হত্যাটা মেনে নিতে পারছি না, যারা এটা বন্ধ করতে চাই, তাদের করণীয় কি? করণীয় ন্যূনপক্ষে ৪টি :
১। পুলিশ বা কোনো বাহিনী খুন করলে তার তদন্ত পুলিশ বা সেই বাহিনী করতে পারবে না।
২। প্রত্যেকটা মৃত্যুর স্বাধীন তদন্তের আইন করতে হবে।
৩। কোনো হত্যাকাণ্ডকে বৈধ করতে রাষ্ট্র কোনো ইনডেমনিটির আইন করতে পারবে না।
৪। আদালতের দেওয়া শাস্তির রায় কোনো নির্বাহী আদেশ দিয়ে বাতিল করা যাবে না।
এর পাশাপাশি রাষ্ট্রের খুনী চরিত্র পরিবর্তনের জন্য উপনিবেশিক প্রশাসনিক আইন এবং এসব আইনের বৈধতা আসে সংবিধানের যেসব অংশ থেকে তা সংশোধনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া।
এ যদি আমরা না করতে পারি তবে সারের দাবীতে আন্দোলনকারীদের গুলি করে যেমন মারা হয়েছে, বিদ্যুতের দাবীতে আন্দোলন কারীদের যেমন গুলি করে মারা হয়েছে, গণতন্ত্রের দাবীতে আন্দোলনকারীদের যেমন গুলি করে মারা হয়, মাদক নির্মূল বা অস্ত্র উদ্ধার বা জঙ্গি দমনের নামে যেমন খুনের উৎসব করা হয় তেমনি একই কায়দায়, একই আইনকে ‘ব্যবহার এবং অপব্যবহার’ করে যখন যাকে ইচ্ছা তাকেই রাষ্ট্র নিশ্চিহ্ন করে ফেলার ভয়াবহ-নৃশংস কাজটি অব্যাহতভাবে করে যেতে থাকবে। আর এই নৃশংসতা এবং হিংস্রতাকে সমাজে এমনভাবে ছড়িয়ে দেবে যাতে সাধারণ মানুষ সর্বদা আতঙ্কগ্রস্ত ও সন্ত্রস্ত থাকে এবং রাষ্ট্র-সরকারের কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস সমাজে আর অবশিষ্ট না থাকে।
বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই এ পরিস্থিতি তৈরি করতে রাষ্ট্র অনেকাংশে সফল হয়েছে। কিন্তু এমন পরিণতির দিকে দেশের যাত্রায় এখনো যাদের কষ্ট হয়, চোখের সামনে অন্যায় দেখলে এখনো যাদের ঘুম হয় না, এখনো যারা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেন না তাদের আজ অন্তত এটুকু ভাবা জরুরী যে, এমন আইন চাই কিনা, এমন আইনের শাসন চাই কিনা! নাকি অন্যরকম আইন চাই, অন্যরকম আইনীব্যবস্থা চাই, নাকি আরো অন্য কিছু!