বাংলাদেশ ক্যাম্প ও আমাদের জাতিগত অস্তিত্ব

ব্যাকগ্রাউন্ডের ছবি কার্টুন মুভমেন্ট ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত
  • লেখক: পারভেজ আলম

নাজি জার্মানিতে ইহুদিদেরকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেতো হুট করে পাঠাইতে পারে নাই। পাঠানোর আগে ন্যুরেমবার্গ আইনে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল। কাল্পনিক শুদ্ধ জাতীয়তার ধারণা তৈরি করে নানান অজুহাতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া, এবং তাদেরকে নিধন বা নির্বাসিত করার রাস্তা তৈরি করা আধুনিক বর্ণবাদের সবচাইতে ভয়াবহ কাজগুলার অন্তর্ভুক্ত। তিন নম্বর আরেকটা কাজ নাজিবাদীরা করতো, তাহলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ঢোকানো। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলা ছোটখাটো এলাকামাত্র ছিলনা, বড় ক্যাম্পগুলা ছিল একেকটা নগর। নাগরিক অধিকারহীনদের নগর। যেখানে তারা অমানবিক জীবন যাপন করতো, শ্রম দিতে দিতে ধীরে ধীরে মারা যাইতো। শ্রম দিতে অনুপযুক্ত হয়ে গেলে গ্যাসের চুলায়া ঢুকায়া মারা হইতো। মৃত্যুর আগে এদের অনেকে এতোটাই দুর্বল হয়ে পড়তো যে সোজা দাঁড়াইতে পারতোনা। নামাযে রুকু দেয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া থাকতো বলে তাদের ডাকনাম দেয়া হইছিল – দার মুসলমান।

আমি আপনাদেরকে গত কয়েক বছর ধরে বলে আসছি যে বাংলাদেশকে একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হিসাবে চিনতে শিখেন। এই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প কোন রূপকমাত্র না। এইটা একটা বাস্তবতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর খাতাকলমে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প না থাকলেও কনসেন্ট্রেশন  ক্যাম্পের নামুস হাজির আছে এমন অনেক জায়গা আছে। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা তার মধ্যে একটা। দুনিয়ার সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা গাজা। এখানকার মানুষের জীবন কাঁটাতারের ভেতর আবদ্ধ। যেই ইসরায়েলি রাষ্ট্র তাদের নাগরিক অধিকার মানে না, সেই ইসরায়েলই তাদের জীবনের উপর সার্বভৌম ক্ষমতা রাখে। সেই ইসরায়েলের হাতেই নির্বাসিত হয়ে ফিলিস্তিনিরা এই ছোট্ট এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে, প্রায়ই তাদের হাতে নিহতও হয়। গাজার পরেই পৃথিবীর সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হইল বাংলাদেশ, যদি ভুল না করে থাকি। ভারত আমাদের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। পশ্চিম বাঙলায় যাইতে গেলেও আমরা গুলি খেয়ে মরে সেই তারে ঝুলে থাকি। আর এখন ভারতের উগ্র জাতীয়তাবাদী বর্ণবাদী সরকার আসামে মিলিয়ন বাঙালির নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদেরকে বেয়ার লাইফ আর বাংলাদেশকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানানোর পায়তারায় আছে।

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিয়ে যা করেছে, ভারতও তা করতে চায় আমাদের সাথে। আপনি নিজে কোন উগ্র জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ বা ঘৃণার রাজনীতি করে কখনোই এদের বিরুদ্ধে জিততে পারবেননা। যদি সেইধরণের পালটা প্রতিক্রিয়াশীলতাই বাংলাদেশে জয় লাভ করে, তাহলে কনসেন্ট্রেশন  ক্যাম্প হিসাবে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ রূপান্তর ঠেকানোর কোন উপায় থাকবেনা। আপনার মান্ধাতা আমলের জাতীয়তাবাদী ও প্রভিন্সিয়াল ধরণের রাজনীতি ত্যাগ করুন। ঐ রাজনীতি আপনাকে বাঁচাতে পারবেনা। ভারতের মোদি একটা হিটলার, বিজেপি একটা নাজি পার্টি; এই সত্যটি আমরা বিশ্বের বুকে তুলে ধরতে পারছিনা। দুনিয়ার মানুষের সামনে সেই ভাষায় কথা বলাই আমরা শিখি নাই, প্রচারতো দূরের কথা।

বাংলাদেশের মানুষ যদি এখনো তাদের নৃতাত্ত্বিক , ভাষিক বা সাংস্কৃতিক ধাত বা এসেন্স দিয়ে নিজেদেরকে বোঝার চেষ্টা এখনো করতে থাকে, কোন লাভ হবেনা। সময় হয়েছে আমাদের খোদ অস্তিত্ব দিয়ে নিজেদেরকে  বোঝার। অস্তিত্বের দিক থেকে আমরা বাংলাদেশীরা, ভারতের বাঙালিরা এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বর্তমান দক্ষিণ এশিয়ার ইহুদি জাতিতে পরিণত হয়েছি। বাংলাদেশ নামক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ‘দার মুসলমানে’ পরিণত হওয়াই এখন আমাদের নিয়তি। অস্তিত্বের দিক থেকে আমরা সবাই এখন এক; আমাদের ধর্ম, দেশ বা সাংস্কৃতিক নানান ফারাক থাকলেও।

এই অস্তিত্ব আমাদের একাত্তরের অস্তিত্বের মতোই। নাগরিক অধিকার বঞ্চিত, গণহত্যার মুখোমুখি হওয়া এবং কোটিখানেক নির্বাসিত মানুষের জাতি ছিলাম আমরা। এই জাতিকে তার ভাষা বা ধর্ম দিয়া আমরা বুঝতে গেলাম তারপরে। তার অস্তিত্বটাই পাত্তা দিলাম না। আজকে সেই অস্তিত্বটিকেই আমাদের পাত্তা দিতে হবে। বর্তমান বিপদ থেকে বাঁচতে যেই রাজনীতি প্রয়োজন, তারজন্যে এই অনুধাবনের কোন বিকল্প নাই।

তা করতে পারলে আমরা শুধু এই প্রবল শত্রুর বিরুদ্ধে শক্তিশালী রাজনীতিই গড়ে তুলতে পারবোনা, হয়তো একাত্তরের অসমাপ্ত বিপ্লবেরও সমাপ্তি ঘটাতে পারবো। দক্ষিণ এশিয়ার সকল ভাষা ও ধর্মের মানুষ অবশেষে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার পাবে। আমাদের আসন্ন লড়াইটা শুধু বাংলাদেশে না। এই লড়াই করতে হবে বাংলাদেশ, ভারত এবং সারা দুনিয়াতেই। তা না করলে জিততে পারবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *