বাংলাদেশের অর্থবিল বা বাজেট আইন আলোচনায় জিডিপি আর বরাদ্দ বিশ্লেষণ পদ্ধতি কতটা যুক্তিযুক্ত?

  • ফরিদুল হক

১.

বাজেট এলেই দেখা যায় এদেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বিভিন্নভাবে এর বিশ্লেষণ ও আলাপ করছেন। সেখানে মূলত জিডিপি-প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি ধরণের কঠিন কঠিন টার্মের আলোচনা থাকে, যেগুলো অধিকাংশ মানুষেরই মাথার উপর দিয়ে যায়। আর এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শোনা যায় বরাদ্দের আলাপ। আমরা সাধারণ নাগরিক হিসাবে কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি এগুলা কি শুধুই সংখ্যার খেলা, নাকি সত্যিই এর মধ্যে কিছু আছে?

আমরা সাধারণ মানুষ অর্থনীতি বুঝিনা কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান ও সাধারণ চোখ দিয়ে মোটাদাগে কয়েকটা জিনিস বোঝার চেষ্টা করি। আমাদের চোখে বাজেট হচ্ছে রাষ্ট্রের সারাবছরের খরচের ও আদায়ের একটা সম্ভাব্য চিত্র, যেটা তৈরি করে রাষ্ট্র যারা চালান সেই কর্তৃপক্ষ, যাদেরকে আমরা সরকার বলে জানি। বাজেটেই ঠিক করে দেয়া হয় রাষ্ট্র-সরকারের পরিচালন কাজে যে যেখানে জড়িত আছেন তার/তাদের কে কতটাকা বেতন-ভাতা পাবেন, উন্নয়ন কাজের জন্য কত টাকা সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হচ্ছে, পূর্ববর্তী ঋণের সুদ দেয়া হবে কত টাকা, সেইসাথে এইসব টাকার জোগান আসবে কোথা থেকে, ইত্যাদিও ঠিক করে দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, কোন পণ্যে কত ভ্যাট এবং কত আয় করলে কত ট্যাক্স দিতে হবে সবই ঠিক করে দেয়া হয়। পাশাপাশি ‘ঘাটতি’ মেটাতে কত টাকা নতুন ঋণ কোথা থেকে নেয়া হবে সেটাও।

ছবি কৃতজ্ঞতা: ডেইলি স্টার

২.

সরকার যে এইগুলা করে সেটা কিসের বলে করে? নাকি জোর করেই আমাদের ঘাড়ে এইগুলা চাপায়ে দেয়?

বাজেট উত্থাপিত হয় জাতীয় সংসদে। আর প্রথমে সেটা উত্থাপন করা হয় সংসদীয় ভাষায় ‘বিল’ আকারে। পরে কয়েকটা ধাপ পেরিয়ে সেটা ‘আইন’ হিসেবে পাশ করা হয়। আর আইন হিসেবে পাশ হয়ে যাওয়ার পরে নাগরিকদের সেটা পালন করা ছাড়া আর কোনো কিছু করার আছে কিনা সেটাও জানা-বোঝা দরকার। মনে রাখা দরকার বাজেট আসলে ‘অর্থবিল’ আকারে উত্থাপিত হয়ে ‘অর্থআইন’ আকারেই পাশ হয়।

বাংলাদেশের সংবিধানে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রতিটি আইন সংসদে ‘বিল’ আকারে উত্থাপিত হবে এবং সংসদ কর্তৃক (৭০ অনুচ্ছেদবলে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়) পাস হলে তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য প্রেরিত হবে এবং ‘অর্থবিল’ ছাড়া অন্য কোনো বিলের ক্ষেত্রে তিনি তা পুনর্বিবেচনা কিংবা কোন সংশোধনী বিবেচনার জন্য সংসদের পাঠাতে পারবেন। সংসদ এক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে বিবেচনাসহ বা ছাড়া বিলটি পুনরায় পাস করে রাষ্ট্রপতির নিকটে প্রেরণ করলে তিনি স্বাক্ষর করুন বা না করুন নির্দিষ্ট সময় পরে বিলটি ‘আইনে’ পরিণত হবে।

সংবিধানে এই অর্থবিলের দায়মুক্তি দেয়া আছে এভাবে: “রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য তাঁহার নিকট পেশ করিবার সময়ে প্রত্যেক অর্থবিলে স্পীকারের স্বাক্ষরে এই মর্মে একটি সার্টিফিকেটে থাকিবে যে, তাহা একটি অর্থবিল, এবং অনুরূপ সার্টিফিকেট সকল বিষয়ে চূড়ান্ত হইবে এবং সেই সম্পর্কে কোন আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।”

তার মানে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই পুরো বাজেট প্রক্রিয়ায় অর্থবিল থেকে শুরু করে আইন বানানো পর্যন্ত কোনো সুপারিশ বা বিবেচনা আমরা নাগরিকরা তো দূরে থাকুক স্বয়ং রাষ্ট্রপতিও দিতে পারেন না। আবার নাগরিকদের কোনো অংশেরই এই ‘অর্থবিল’ সম্পর্কে কোনো আদালতেই প্রশ্ন করার অধিকার সংবিধান রাখেনি।

ছবি কৃতজ্ঞতা: প্রথম আলো

৩.

আচ্ছা ঠিক আছে নাগরিকরা নাহয় সুপারিশ, বিবেচনা ও প্রশ্ন তুলতে পারলো না, কিন্তু রাষ্ট্রেরই অন্য কোনো অংশ বা প্রতিষ্ঠানের কি সেই সুযোগ আছে?

বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যতগুলো সাংবিধানিক পদ/প্রতিষ্ঠান আছে তাঁর মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সবচাইতে কম আলোচিত ও পরিচিত পদ হচ্ছে ‘মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক’। রাষ্ট্রের সরকারি হিসাব, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীর সরকারি আয়-ব্যয় এর নিরীক্ষা ও রিপোর্ট প্রদান করা সংবিধান অনুযায়ী তাঁর দায়িত্ব।

প্রায় সারা দুনিয়ায় এই পদে নিয়োগ দেয়া হয় বিরোধীদল থেকে, আর আমাদের এখানে সংবিধান অনুযায়ী এই পদের নিয়োগের ক্ষমতা যেহেতু রাষ্ট্রপতির আর উনি যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সবকিছু করেন তাই এখানে নিয়োগ দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর পছন্দসই ব্যক্তিকেই। সেই সাথে প্রায় সারা দুনিয়ায় মহা হিসাব-নিরীক্ষক তাঁর নিরীক্ষা রিপোর্ট পেশ করেন সংসদের কাছে, আর আমাদের এখানে রাষ্ট্রপতির নিকটে। যদিও আমাদের এখানে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৭০ আর ৪৮(৩) থাকলে দুইটা একই কথা।

তার মানে বাজেট, অর্থবিল, আয়-ব্যয়ের হিসেব, কোনোটাতেই সুপারিশ বিবেচনা ও প্রশ্ন করার সুযোগ নাগরিক ও রাষ্ট্রপতির সাথে সাথে মহা হিসাব-নিরীক্ষকেরও নেই, যদিনা প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছাপোষণ করেন। অবশ্য সরকারি হিসাব সংক্রান্ত একটা ‘সংসদীয় স্থায়ী কমিটি’ করার বিধান আছে। তবে সংসদীয় ‘কার্যপ্রণালী বিধি’ অনুযায়ী তাঁর ক্ষমতা হচ্ছে কেবল হিসাবে ত্রুটি-বিচ্যুতি-অনিয়ম দূর করার ‘সুপারিশের’, ত্রুটি-বিচ্যুতি-অনিয়মকারীদের শাস্তি দেয়াতো দূরের কথা, এদের শাস্তির সুপারিশ করার ক্ষমতাও ওই কমিটির নেই।

তারমানে দাঁড়ায় সংবিধানসম্মত পদ্ধতিতে আইন করেই ঠিক করে দেয়া হয় রাষ্ট্র-সরকারের পরিচালনা কাজের সকল আয়-ব্যয়ের পথ ও পদ্ধতি। সেই সাথে এটাও নিশ্চিত করা হয় এই আয়-ব্যয়ের যোকোনোটা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কেউ যদি চুরি-লুটপাট করে তাহলে তাকে ধরার ব্যবস্থা নাগরিক, রাষ্ট্রপতি, হিসাব নিরীক্ষক ও সংসদীয় কমিটি কারও হাতেই নেই, যদি না সরকার-প্রধান এটা চান। আর নাগরিক হিসেবে কর (ট্যাক্স-ভ্যাট) দিতে বাধ্য থাকা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।

এইরকম ব্যবস্থা যখন চালু থাকে তখন রাষ্ট্রের বাজেট যতবড়ো হয় ততোবেশি চুরি-লুটপাটের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সেজন্যই বিগত ১০-১২ বছরে স্বাস্থ্যখাতে লক্ষাধিক কোটি টাকা বরাদ্দ থাকা স্বত্বেও দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা কেমন সেটা আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। তাই ‘বরাদ্দ বাড়ানো’ টাইপ আলাপের ধরণ বদলাতে হবে। চুরি-লুটপাটের অবারিত সুযোগ ঠিক রেখে বরাদ্দ যতো বাড়বে চুরি-লুটপাটও ততো বাড়বে।

আমাদের বরং আলাপ করতে হবে বাজেটের টাকা কোথা থেকে কিভাবে আদায় হবে, কোথায় কিভাবে বরাদ্দ ও খরচ হবে, আদায় ও খরচে চুরি-লুটপাট করলে তার শাস্তি কিভাবে নিশ্চিত হবে, সেগুলোর ক্ষমতা মানুষের হাতে কিভাবে আসবে—এগুলো বিষয়ে। যতদিন পর্যন্ত মানুষের হাতে এইসব আদায় ও খরচের পথ-পদ্ধতির সিদ্ধান্ত নেয়া, সেই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন করার ধাপে ধাপে নজরদারির ব্যবস্থা এবং বাস্তবায়নে ঘাপলা করলে শাস্তির ব্যবস্থা করার ক্ষমতা না আসতেছে ততদিন বরাদ্দ বাড়ানোর আলাপ করা মানে আরও বেশি চুরি-লুটপাটের সুযোগ তৈরি করে দেয়া।

ছবি কৃতজ্ঞতা: ডেইলি স্টার

৪.

যারা মনে করেন ‘আইনের শাসন’ লাগবে তাদের মনে করিয়ে দেয়া যেতে পারে, এই চুরি-লুটপাটের পুরো ব্যবস্থাটা কিন্তু চলছে ‘আইনি’ পথেই। বাংলাদেশের মানুষ যেদিন এই রাষ্ট্রের চোখে চোখ রেখে এদের চালু করা এই আইনের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করবে, প্রয়োজনে এইসব আইনকে উপেক্ষা করে বলবে এইগুলা বদলাও নয়তো ট্যাক্স-ভ্যাট বন্ধ করে দেবো, সেদিনই ফ্যাসিবাদ নড়েচড়ে বসবে। নাহলে শুধু ফ্যাসিবাদ-ফ্যাসিবাদ করলে তা সাধারণ মানুষের কাছে কোনোই অর্থ বহন করে না। আর এটা ফ্যাসিবাদী সরকার খুব ভালো করে বোঝে বলেই এগুলোতে খুব একটা গা করে না। আমাদের বুঝতে হবে, কোনো আইন যদি ন্যায্যতার সীমা লঙ্ঘন করে তবে মানুষের কাজ হচ্ছে প্রথমে সেই আইন উপড়ে ফেলা। বাংলাদেশের অর্থবিল বিশ্লেষণের পুরাতন পদ্ধতি, জিডিপি-জিডিপি আর বরাদ্দ-বরাদ্দ, এগুলো বাতিল করে ন্যায্যতার দৃষ্টিতে বিশ্লেষণের এখনই সময়।

  • লেখক: সদস্য, রাষ্ট্রচিন্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *