বব মার্লে ও আমাদের অসমাপ্ত ‘যুদ্ধ’


  • লেখক: খোইরোম রুধির

কর্পোরেট মিডিয়া ও পুঁজিবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে বব মার্লেকে কোথায় কোথায় ব্যবহার করা হচ্ছে? কীভাবে হাজির করা হচ্ছে আমাদের সামনে পুঁজিবাদী আগ্রাসনের এই যুগে?

বব মার্লে ও তাঁর সৃষ্টিকে তাঁর বিপ্লবী দর্শন থেকে বিচ্যুতি ঘটিয়ে তার সাথে রোমান্টিসিজম মিশিয়ে শুধুমাত্র রোমান্টিক আবহে হাজির করছে কর্পোরেট হাউজগুলো। তাঁকে হাজির করা হচ্ছে টিশার্টের ডিজাইন হিসেবে। মুনাফাখোর কর্পোরেশনগুলো মার্লে কে পণ্যায়িত করেছে। মার্লের নাম ও মার্লের ছবি আঁকা টিশার্ট বিক্রি করে, মার্লের ছবি সম্বলিত পোস্টার বিক্রি করে মুনাফা লুটছে। ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে মার্লের বিপ্লবী দর্শনকে, মার্লের আমৃত্যু প্রতিবাদী কন্ঠকে, মার্লের নিরন্তর ‘যুদ্ধ’কে।

বব মার্লে কে এখন কোথায় পাওয়া যাবে? ‘এই মুহূর্তেই হয়তো বার্লিন-আমস্টারডাম-ব্রিসবেন-হারারে-ভ্যানকুভার-কিংস্টন কিংবা অন্য কোথাও ড্যান্স ক্লাবের বোকা-নাচের আসরকে, হয়তো ঢাকাতেই কোন ডিজে পার্টি বা কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদিগের কর্পোরেট কেরানীরা চাকুরি বা অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ানোর আগ মুহূর্তটাকে একটু Wild করার তাগিদে আয়োজিত সমাপনী উৎসবকে মাতিয়ে তুলছে মার্লির Exodus’ (বিল্লাহ ২০১২)। মার্লে কে সেইখানে হয়তো নিছক বিনোদন হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। ‘Entertainment ছাড়াও Relaxation এর তরেও হয়তো কেউ শরণাপন্ন হচ্ছেন মার্লির’ আবার ‘হয়তো কারো ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের ব্যক্তিগততায় আটকে আছেন মার্লি, হয়তো দায়িত্ব পালন করছেন কারো ঘুম পাড়ানী মাসি পিসির’(বিল্লাহ ২০১২)।

কিন্তু মার্লেরা কিসের জন্য লড়েছেন? কাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন? কাদেরকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছেন? মার্লেরা লড়েছেন নষ্ট-ভ্রষ্ট সিস্টেমের বিরুদ্ধে, মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে, ধ্বংস করে ফেলতে চেয়েছেন শোষণ-শাসনের এই কর্তৃত্ববাদী সিস্টেমকে। ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছেন দাসত্বের শৃঙ্খলকে। বারংবার যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন উপনিবেশিক শক্তির বিপক্ষে, উপড়ে ফেলতে চেয়েছেন ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলকে। কারো গোলাম, দাস না থেকে মুক্ত সমাজ, মুক্ত মানুষের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন বজ্র কন্ঠে। আর সেই যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র ছিল মার্লের ‘বিদ্রোহী সঙ্গীত’। বিদ্রোহী মার্লের বিদ্রোহী সঙ্গীত গর্জে উঠেছে বারংবার, হয়ে উঠেছে শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর, প্রতিবাদের ভাষা, ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে উপনিবেশিতের হুঁশিয়ার বাণী।  

বব মার্লে

Rastaman Vibration(১৯৭৬) অ্যালবামের War শিরোনামের গানে মার্লে সর্বত্র যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন সকল জাতি বিদ্বেষ আর বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে। গাইছেন যতক্ষণ পর্যন্ত প্রথম শ্রেণি আর দ্বিতীয় শ্রেণি বলে নাগরিক বিভেদ থাকবে, জাতি কিংবা বর্ণ নিরপেক্ষ হয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত সকল নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ জারি থাকবে। মার্লে গাইছেন যতদিন পর্যন্ত তাঁর আফ্রিকান ভাই-বোনরা শান্তির মানে বুঝতে না পারছে ততদিন পর্যন্ত্ যুদ্ধ চলবে এবং এই যুদ্ধে তাদের জয় অনিবার্য। শুভ ও অশুভ শক্তির এই লড়াইয়ে শুভ শক্তির জয় নিশ্চিত।

একই অ্যালবামের Crazy Baldheads-এ উল্লেখিত ন্যাড়া মাথার উন্মাদরা কারা? কেন তাদেরকে শহর থেকে খেদাতে চাচ্ছেন মার্লেরা? এই ন্যাড়া মাথার উন্মাদরা আর কেউ নন। সেই উপনিবেশিক শক্তির এজেন্ট যারা ‘কালো মানুষ’দের দাস বানিয়ে শোষণ করেছে ‘শ্রেষ্ঠত্বের দোহাই’ দিয়ে। ‘কালো মানুষের’ ফলানো শস্য লুট করে যারা নিজেদের উপনিবেশ গড়েছে। ‘কালো’দের গড়া স্কুল-কলেজের কর্তৃত্ব নিয়ে যারা ‘কালো’দের মগজধোলাই করার শিক্ষা দিচ্ছে, যারা মার্লেদের ভালোবাসার বিনিময়ে শুধু ঘৃণাই দিয়েছে প্রতিদান হিসেবে, তাদেরকে শহরছাড়া করতে চাচ্ছেন মার্লেরা।

১৪৯৪ সালে কলম্বাসের দ্বিতীয় যাত্রায় ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জে যে গণহত্যার সূত্রপাত হয়েছিল তারপর থেকেই এই দাসত্বেরও সূত্রপাত। ‘১৫১৭ সালে জ্যামাইকায় আফ্রিকা থেকে দাস আনা শুরু করে স্প্যানিয়াডরা’। তারপর আসল বৃটিশরা। তারাও লুটে নিল ‘কালো মানুষ’দের সর্বস্ব। সাথে নিয়ে গেল ‘কালো মানুষ’দের দাস বানিয়ে সওদাগরী জাহাজে। বব মার্লের সহযোদ্ধা ও রেগে শিল্পী পিটার টশ তাই কলম্বাসকে ডাকতেন ‘Come-rob-us’ নামে। মার্লে Redemption Song [Legend 1984]-এ গাইছেন-

‘আমাদের লুটেছিল প্রাচীন লুটেরা,
বেচেছিল সদাগরী জাহাজের কাছে।’

[অনুবাদ: কাজী মুনতাসির বিল্লাহ]

এই দাসবাহী জাহাজগুলোতে অমানবিকভাবে নেয়া হতো ‘কালো মানুষ’দের। কেমন জায়গা বরাদ্দ ছিল তাদের জন্য? কাজী মুনতাসির বিল্লাহ তার বইয়ে লিখছেন- ‘মহানুভব বৃটিশ শাসকগোষ্ঠী মানবতা দেখিয়ে ঠিক করে দিয়েছিল এক জাহাজে সর্বোচ্চ কতজন দাস ঢুকানো যাবে তার সীমারেখা। সেই আইন অনুসারে ব্রুক্স নামের ৩২০ টনী জাহাজে ৪৫৪ জন দাস নেয়াটা বৈধ ছিল। সেই মানবিক আইন অনুযায়ী একজন ভাগ্যবান দাসের জুটবে ছয় ফিট লম্বা, দুই ফিট প্রশস্ত ও দুই ফিট উচ্চতার জায়গা। দাস ব্যবসায়ীরা এই নিয়ম মানতো না। ব্রুক্স-এ নেয়া হত ৬০০ জন’(বিল্লাহ ২০১২)। এই দাসদের কাজকর্ম তদারকি করার জন্য নিয়োজিত ছিল একদল চাবুকধারী ‘Slave Driver’। তাদের নির্মম অত্যাচারের ছবি ফুটে উঠেছে Slave Driver [Catch a Fire, 1973] গানে। মার্লে গাইছেন-

‘যতবার মনে পড়ে চাবুকের শব্দ,
হিম হয়ে আসে রক্ত,
মনে পড়ে যায়, দাসবাহী সেই জাহাজগুলোয়
নির্মমভাবে পিষে মেরেছিল আমাদের আত্মাকে।’

[অনুবাদঃ কাজী মুনতাসির বিল্লাহ]

আফ্রিকার ‘কালো মানুষ’দের উপর আরোপিত দাসত্বকে বৈধতা দিতে ধর্মের দোহাইও দেয়া হয়েছিল। চার্চের মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বৈধতা দিয়েছিল ‘কালো মানুষ’দের এই দাসত্বকে, সাদা প্রভুদের দাস-ব্যবসাকে। এই দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির নিমিত্তে, প্রতিরোধ গড়ে তোলার তাগিদে, চার্চ কেন্দ্রিক ধর্মীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রতিরোধ হিসেবে হাজির করেছিল ‘রাস্তাফারাই’ ধর্মকে। রাস্তাফারাই কি ‘ধর্ম’ নাকি ‘জীবন দর্শন’ সেইট নিয়ে বিতর্ক আছে। Talkin’ Blues [Natty Dread, 1974] গানে মার্লেরা চার্চের এই জাতি বিদ্বেষী, বর্ণ বিদ্বেষী মনোভাবকে কটাক্ষ করেছেন, ‘বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন চার্চকে কারণ এটির প্রচারকরা সত্য নয় মিথ্যা প্রচার করে’। 

Edward Seaga, right, clasping hands with Michael Manley, left, and Bob Marley during the One Love concert at the national stadium in Kingston, Jamaica, on 22 April 1978. Photograph: Adrian Boot/Camera Press

আমরা দু’শ বছর আগে বৃটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েছি। কিন্তু সেই শৃঙ্খল মুক্তির দু’শ বছর পরও আমরা কি সেই ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পেরেছি? উপনিবেশের ভূত তো এখনো আমাদের কাঁধের উপর বসে আছে। ঔপনিবেশিক আইন-কানুন, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামো, ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা, ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে এখনো। ঔপনিবেশিক প্রভুরা আমাদের এমন মগজধোলাই দিয়েছে যে আমরা এখনো ভাবি যে উপনিবেশ আমাদেরকে অনেক দিকেই সমৃদ্ধ করেছিল, উন্নত করেছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ড কীভাবে আমাদেরকে মূল বিচ্যুত করেছে সেই দিকে আমাদের নজর নেই। আমাদের নিজস্ব কোনো বিউপনিবেশায়ন ভাবনা সেইরকমভাবে গড়ে উঠেনি। অনেকেই এখনো উপনিবেশিক মদের নেশা কাটিয়ে উঠতে পারেনি, বয়ে বেড়াচ্ছে ‘উপনিবেশিক উত্তরাধিকার’। সেই ন্যাড়া মাথার উন্মাদরা আমাদেরকে পরোক্ষভাবে শোষণ করে যাচ্ছে এখনো।

মার্লেরা জাতি বিদ্বেষের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। সেই যুদ্ধ কি শেষ হয়ে গেছে? আমরা কি বাঙালি জাতীয়তাবাদের কবল থেকে ‘অপর’ জাতিগোষ্ঠীদের মুক্তি দিতে পেরেছি? তাদেরকে ‘আদিবাসী’, ‘উপজাতি’, ‘সংখ্যালঘু’, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ইত্যাদি বর্গ থেকে বের করে মানুষ হিসেবে দেখতে সক্ষম হয়েছি? আমাদের সরকার বাহাদুর তো ‘আদিবাসী’ অভিধাই স্বীকার করতে চায় না, সমতা আর ন্যায্যতা তো পরের কথা। আমরা কি সকল নাগরিকের জন্য মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছি? আমরা কি রামু সহিংসতার কথা ভুলে যেতে পারব? আমরা কি অস্বীকার করতে পারব গাইবান্ধায় সাঁওতাল পল্লিতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক আগুন দেয়ার ঘটনা? আমরা কি অস্বীকার করতে পারব সেটেলার বাঙালি ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যেকার বৈরিতা? আমরা কি অস্বীকার করতে পারব পাহাড়ে চলা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ন? আমরা কি দাবি করতে পারব যে এই স্বাধীন দেশে সবাই স্বাধীনতার স্বাদ নিতে পারছে? আমরা কি দাবি করতে পারব যে অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর উপর কোনো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বাংলাদেশে হয় না? আমরা কি নিশ্চিতভাবে বলতে পারব এই স্বাধীন দেশে সবার সাথে মুখে মুখেই কথা হয়, মুখের সাথে বন্দুকের নল কথা বলে না? ‘শ্রেষ্ঠত্বের অসুখে’ ভুগছি আমরা, ভুগছে সারা বিশ্ব। আলতাফ পারভেজের বরাত দিয়ে বলতে হচ্ছে-

‘শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা মানুষের প্রাত্যহিক আর্থসামাজিক নাজুকতাকে ‘প্রাইভেট’ বিষয় বানিয়ে দেয়। ‘অপর’কে দমনই তখন কেবল ‘পাবলিক’ বিষয় থাকে। এইটাই শ্রেষ্ঠত্বের অক্সিজেন। যুদ্ধের ভঙ্গিতেই কেবল শ্রেষ্ঠত্বের উদযাপন।

এ কারণেই শ্রেষ্ঠত্বের অসুখের দায় ভোগ করতে হয় বরাবরই ‘অন্য’দের। ধর্ম, জাতি বা রাজনৈতিক ‘সংখ্যালঘু’দের। জার্মানিতে অর্ধকোটি ইহুদিকে মরতে হয়েছে। ৭০ বছর এই নিন্দা ও শোকের পর ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে দেশছাড়া করে বামারা জানিয়ে দিল শ্রেষ্ঠত্বের অসুস্থতা চিরায়ত’ (পারভেজ ২০১৯) ।

মানুষ সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে মার্লের বিশ্ববীক্ষা কেমন ছিল? মার্লে বলছেন- আপনি সাদা হোন কিংবা কালো হোন, আপনি অন্যায় করেছেন মানে আপনাকে বলতে হবে অন্যায় করেছেন। শুধুমাত্র গাত্র বর্ণের কারণে আপনার ভুল শুদ্ধ হয়ে যাবে না। মানুষের বড় পরিচয় সে মানুষ। সাদা, কালো, নীল, গোলাপী, সবুজ রঙভেদে ঐশ্বরিক কোনো বিধি-বিধান নেই। আমাদের সমাজই এইসব বিধি-বিধান তৈরি করেছে, যেখানে আমরা পচে মরছি। সে জন্যেই আমাদের এখন প্রয়োজন ‘মুক্তি আর মুক্তি’। মার্লে মনে করতেন না তিনি তৃতীয় বিশ্বের মানুষ। তিনি বলতেন- ‘আমি প্রথম বিশ্বের মানুষ কেন না আমি মানুষের মধ্যে শ্রেণি বিভাজন করতে পারি না’ (Farley 2007)।

মার্লেরা চেয়েছিলেন সকল নাগরিকের সমানাধিকার। তাঁরা চেয়েছিলেন প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণি বলে নাগরিক বিভাজন না থাকুক। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকরা কি সবাই সমান? এই স্বাধীন দেশে তো ভিআইপিদের জয়জয়কার চলে। ভিআইপিরা যখন রাস্তায় আসা যাওয়া করেন তখন সাধারণ নাগরিকদের ট্রাফিকে আটকে থাকতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা। আর সেই ট্রাফিকে আটকে পড়ে অ্যাম্বুলেন্সের মধ্যেই প্রাণ হারান সাধারণ নাগরিকরা। মাদারীপুরের স্কুল ছাত্র তিতাস ঘোষের (১১) কথা কি আমরা ভুলে যাব? এক ভিআইপি’র কল্যাণে যে দৈনিক পত্রিকার পাতায় স্থান পেয়েছিল ‘ভিআইপির অপেক্ষায় ছাড়েনি ফেরি, অ্যাম্বুলেন্সেই প্রাণ গেল স্কুলছাত্রের’ শিরোনামে। এইটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সাধারণ নাগরিক হবার কারণে কত শত শত মানুষ হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে থাকে, চিকিৎসা পায় না তা আমাদের অজানা নয়। ভিআইপিতন্ত্রের কবলে পড়েছে দেশ। জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান তারা জনগণকে ভাবেন ‘প্রজা’ আর উনারা ‘রাজা-উজির’। আরেক ভিআইপি সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর সেই বিখ্যাত মন্তব্য ‘প্রজাদের সুখেই শেখ হাসিনার সুখ’ আমরা স্মরণ করতে পারি।

গত ১৬ আগস্ট, ২০১৯-এ মিরপুর ৭ নম্বর সেক্টরে ঝিলপাড় বস্তি জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। হাজার হাজার ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেল, হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়ে গেল। অনেকের মাত্র গুছিয়ে উঠা স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। এমন কি প্রথমবার ঘটল? এই ঘটনার এক বছর আগে ২০১৮ সালের ১২ মার্চ মিরপুর ১২ নম্বর সেক্টরে ইলিয়াস মোল্লাহ বস্তি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল একইভাবে। এইসব অগ্নিকাণ্ড কোনো দুর্ঘটনা নয়। জমি দখলের জন্য পরিকল্পিতভাবে আগুন দেয়া হয়েছিল। জমি দখলের সবচেয়ে প্রাচীন ও কার্যকর পন্থা এই অগ্নিকাণ্ড। এই বস্তিগুলোতে যারা বাস করত তাদের দোষ কী? তাদের দোষ হচ্ছে তারা দরিদ্র মানুষ। বিশাল বিশাল অট্টালিকার ভিড়ে কি টিন শেডের ঘর শোভা পায়? তাই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে তাদের বস্তি। সেখানে এখন মাথা তুলে দাঁড়াবে উন্নয়নের চিহ্নওয়ালা বিশাল বিশাল অট্টালিকা। তাদের স্বপ্ন, তাদের কান্নার শব্দ ঐ বস্তিতেই দাফন হয়ে গেছে।

মেগা প্রকল্পে হারিয়ে যাওয়া মানুষের ‘মেগা দুঃখ-উপাখ্যান’ শোনাচ্ছেন মাহা মির্জা- ‘পায়রা বন্দর আর বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে এখন পর্যন্ত সাড়ে সাত হাজার একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে উচ্ছেদ হবে ২০ হাজার মানুষ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কৃষকের পাকা ধানের খেতে বালু ভরাট করে শত শত মণ ধান নষ্ট করে জমি কেড়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে এলএনজি টার্মিনাল, সমুদ্রবন্দর, আর দুটি কয়লা প্রকল্প মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার একর কৃষিজমি হারিয়েছে কৃষক। দুই প্রকল্পের মাঝখানে আটকে পড়া ৭০ থেকে ৮০ হাজার মানুষও উচ্ছেদ-আতঙ্কে আছে। রামপাল কয়লা প্ল্যান্টের কারণে প্রায় তিন হাজার সংখ্যালঘু পরিবার জমি হারিয়ে কে কোথায় হারিয়ে গেছে, সেই খবর কে রাখে। এসব এলাকার স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলাপ করলেই বোঝা যায়, ক্ষতিপূরণের নামে কী অদ্ভুত প্রহসন চলে এই দেশে। তার ওপর কায়েম হয়েছে ভয় ও ত্রাসের রাজত্ব। রামপাল, পায়রা, মাতারবাড়ী সবখানেই’(মির্জা ২০১৯)। সুতরাং সমানাধিকার, ন্যায্যতা ও সমতার ‘যুদ্ধ’ এখনো অসমাপ্ত।

দ্য নিউ মুন-১, ফারহানা ইয়াসমিন, সূত্র: ফেসবুক

সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়/পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। পৃথিবীতে যত শস্য উৎপাদন হয় তার সিংহভাগ চলে যায় ক্ষমতাশালী, সুবিধাপ্রাপ্ত লুটেরাদের হাতে। যারা উৎপাদন করে তাদের ভাগ্যে ঠিকঠাক জুটে না তিনবেলা খাবার। ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় টাঙ্গাইলের এক কৃষকের ধানক্ষেতে আগুন দেয়ার ঘটনা আমরা ভুলে যাইনি নিশ্চয়ই। উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ এই রাষ্ট্র তার কৃষক-শ্রমিকদেরই ন্যায্য মূল্য দিতে পারছে না কেন? ‘বাংলাদেশের কৃষক ভর্তুকি চান না। ৩৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ মওকুফও চান না। চান শুধু ন্যায্য দাম। ফড়িয়াদের উৎপাত আর চালকলের মালিকদের প্রতারণা থেকে মুক্তি। সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে গিয়ে ভালো দামে ধান বেচতে পারার গ্যারান্টি। এবার দুই কোটি টন বোরো উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা, অথচ সরকার কিনবে মাত্র ১২.৫ লাখ টন। তা-ও সরকারি কৃষকের ধান নয়, ১১ লাখ টনই কিনবে মিলের চাল। কৃষকের ধানের বদলে মিলের চাল কিনলে কার লাভ?’(মির্জা ২০১৯[১])। লাভ যে মধ্যসত্ত্বভোগী লুটেরাদের তা কারো অজানা নয়। মার্লেরা গেয়েছেন ‘তাদের পেট পূর্ণ কিন্তু আমরা ক্ষুধার্ত’[Them Belly Full(But We Hungry); Natty Dread, 1974]। আর এই ‘ক্ষুধার্ত জনতা’ হয়ে উঠে ‘ক্ষুব্ধ জনতা’। ‘জ্বী হুকুম’ কর্পোরেট মিডিয়াগুলোতে তুমুল প্রচার চলে ‘আমাদের দেশে কোনো ভিক্ষুক নাই’ কিন্তু রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় বাস্তবতা আসলে কী। মহামান্যগণ হয়তো ভিক্ষার পাত্র কেড়ে নিতে পারেন কিন্তু ‘ক্ষুধার্ত পেট’র আগুন তো নিভাতে পারবেন না। তিনবেলা ভর পেট খাবারের এই ‘যুদ্ধ’ তাই এখনো অসমাপ্ত। ফিলাদেলফিয়া ভ্রমণকালে (১৯৭৯) মার্লে একবার বলছেন ‘আমি একজন নিগ্রো যে প্রতিনিয়ত কষ্ট ভোগ করছে। আমার অবস্থার বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন হয়নি। গুটি কয়েক মানুষের এই বিত্ত-বৈভবশালী জীবনকে আমি জীবন বলি না। তাদের এই জীবন সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই’(Farley 2007)। পিটার টশ ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন যে ‘নরক অতি দূরের কোনো স্থান নয়, এটি আসলে ঠিক মানুষের ভিড়েই বিরাজমান’। নরক আসলে গুটি কয়েক মানুষেরই তৈরি। ক্ষমতাবান শাসক ও তার দোসররা এই পৃথিবীটাকেই নরক বানিয়ে রেখেছে।

Johnny was [Rastaman Vibration, 1976] গানে মার্লে এক মহিলার কথা বলছেন যার ছেলেকে একটু আগে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। মহিলা মাথা চাপড়িয়ে কাঁদছেন আর চিৎকার করছেন ‘Johnny was a good man’। তার নিষ্পাপ সন্তান ‘যে কখনো কোনো ভুল কাজ করেনি’ তাকে মেরে ফেলা হয়েছে ‘শুধুমাত্র সিস্টেমের জন্য’। ভেবে দেখুন তো এই আর্ত-চিৎকার কি থেমে গেছে? কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের কথা মনে পড়ে? একরামুল যখন বন্দুকের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যাচ্ছিল তখন ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা একরামুলের স্ত্রীর আর্ত-চিৎকার ‘আমার জামাই কিচ্ছু করে নাই…’ আর তার মেয়ের কান্না জড়ানো কন্ঠে সেই প্রশ্ন ‘আব্বা তুমি কান্না করতেছো যে?’২৩ বছর আগে অপহৃত কল্পনা চাকমা থেকে শুরু করে সম্প্রতি নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মাইকেল চাকমার কথাই ধরুন। মাইকেল চাকমার খোঁজে আসা তার বোনের হাতে ধরা পোস্টারটার কথাই ভাবুন। সেখানে লেখা ছিল ‘জীবনে কখনো ঢাকায় আসিনি, নিখোঁজ ভাই মাইকেলকে খুঁজতে এসেছি’। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেব অনুযায়ী ২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাসেই ২০৪ জন ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ শিকার হয়েছেন।১০ সিস্টেমের ব্ল্যাকহোলেই তো হারিয়ে গেছে তারা। তারা কেবল এখন সংখ্যা হয়ে গেছে, আর এই সংখ্যাটা কমছে না প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সন্তানহারা এই মায়েদেরকেও ‘হাজার চুরাশির মা’র মতো করে ডাকা হবে ‘দু’শ চারের মা, দু’শ পাঁচের মা…’ বলে। সিস্টেমের ব্ল্যাকহোলে পড়ে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না, হয়ে যায় শুধু সংখ্যা।

মার্লেরা গলা ছেড়ে চিৎকার করে গেয়েছেন ‘মেয়ে, তুমি কেঁদো না’ [No, Woman, No, Cry; Natty Dread, 1974]। কিন্তু আজো সেই কান্না থামেনি। পুলিশের ভ্যান থেকে ছুঁড়ে ফেলা দিনাজপুরের ইয়াসমিনের ক্ষত-বিক্ষত লাশ, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের পাশে পড়ে থাকা তনু, নোয়াখলির সুবর্ণচরে গণধর্ষণের শিকার চার সন্তানের মা, ফেনীর অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত, পাহাড়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক নিপীড়ন-নির্যাতন-ধর্ষণের শিকার নারীদের কথা আমরা ভুলে যাই কীভাবে? মার্লেরা গেয়েছিলেন ‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে’ কিন্তু দিন যায়, রাত যায়, পৃথিবীর বয়সও বাড়ে কিন্তু সবকিছু ঠিক হয়ে যায় না। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা পুরুষতন্ত্রকে মদত দিয়েছে, পরিপুষ্ট করেছে। আর পুরুষতন্ত্রের প্রধান শিকার হয়েছে নারীরা। আসক জানাচ্ছে চলতি বছরে (২০১৯) প্রথম ৬ মাসে ৬৩০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন।১১ কিন্তু যাদের কান্না আমাদের কানে আসেনি, যাদের খবর সংবাদপত্রের পাতায় স্থান পায়নি তাদের সংখ্যাও তো নিখাদ কম নয়। তাদের কান্না শোনার কেউ নেই।  

পোস্টার

Rebel Music (3 O’Clock roadblock) [Natty Dread, 1974]-এ মার্লেরা প্রশ্ন তুলেছেন ‘স্বাধীন দেশে আমরা স্বাধীনভাবে ঘুরাঘুরি করতে পারি না কেন? আমরা যা হতে চাই তা হতে পারি না কেন?’ মার্লেরা মুক্ত হতে চান, স্বাধীনতার স্বাদ নিতে চান। স্বাধীন দেশে কারফিউ এর মতো পরিস্থিতি চায় কে? আমাদের স্বাধীন দেশেও তো নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছে আজকাল। পার্কে ঘুরাঘুরি করা যাবে না, বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডাবাজি চলবে না, পার্কে বসে প্রেম করা যাবে না, রাত করে বাইরে থাকা যাবে না ইত্যাকার সমন জারি করা হচ্ছে, যেন দেশ কোনো জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে!১২ আমি কোথায় বসব, কার সাথে বসব, কার সাথে ঘুরব, কার সাথে প্রেম করব, কখন কোথায় থাকব তাও নিয়ন্ত্রণ করে ফেলতে চায় ‘মাননীয়’রা। সর্বাত্মক নজরদারি-খবরদারির মধ্যে রেখে আমাদের যাবতীয় স্বাধীনতা-সৃজনশীলতা খর্ব করে দিতে চায়, তাদের হাতের পুতুল বানিয়ে রাখতে চায়। বনসাই বানিয়ে রাখতে চায় আমাদেরকে। শুধু কি তাই? আমি কী পরব, কীভাবে চুল কাটব, কোন স্টাইলে চুল কাটব সব হতে হবে ‘মাননীয়’দের মর্জি মতো।১৩ অন্যথায় শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে আপনাকে। এইসব মোরাল পুলিশিং এর দায়িত্ব ‘মাননীয়’দের কে দিয়েছে? আমার ‘আমি’ হয়ে উঠায় সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই ‘মাননীয়’রা। যেখানে স্বাধীনতার নামগন্ধ নেই সেইখানে সৃজনশীলতার স্বপ্ন দেখা একপ্রকার দুরাশাই। সেলিম রেজা নিউটনের জবান ধার করে বলতে হয়- ‘সত্য হলোঃ স্বাধীনতা যাবতীয় সৃজনশীলতার ধাত্রী। স্বাধীনতা মানুষের রচিত কোনো আইন না। কর্তৃত্ব-তন্ত্রই বরং গুটিকয়েক মানুষের তৈরি মনুষ্যস্বভাববিরোধী আইনী প্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতা হচ্ছে প্রকৃতির আইন। কোন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের জন্য সে অপেক্ষা করে না। বরঞ্চ যাবতীয় কর্তা-কর্তৃপক্ষ-কর্তৃত্ব-তন্ত্রকে যতটা অস্বীকার করতে পারে, মানুষ ঠিক ততটাই স্বাধীনতার চর্চা করতে পারে, ততটাই সে সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারে, এবং অবশ্যই ভুল করতে করতে’(নিউটন ২০১৩)।

মার্লেরা মনে করে এইসব থেকে নিষ্কৃতির জন্য ‘বিপ্লব প্রয়োজন’। Revolution [Natty Dread, 1974] শিরোনামের গানে হুঁশিয়ারি করছেন ‘রাজনীতিবিদদের হস্তক্ষেপ’ থেকে দূরে থাকার কারণ তারা চায় আমাদেরকে ‘সর্বদা নিয়ন্ত্রণে রাখতে’। রাজনীতির নামে চলে কূটনীতি। পিটার টশ Politics কে বলতেন Politricks আর Politician কে বলতেন Politrickster। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিন্তা করুন। রাজনীতিবিদদেরক সাধারণ জনগণ এক চুল পরিমাণও বিশ্বাস করে না। তারা জানে তাদের প্রয়োজন শুধুমাত্র ভোটের মৌসুমে। রাজনীতিবিদদের মতো মিথ্যে স্বপ্ন আর কে দেখাতে পারে? জনগণকে মূর্খ, অবুঝ ভাবার কোনো কারণ নেই। সলিমুল্লাহ খানের ভাষ্যমতে ‘মানুষকে বোকা মনে করার চেয়ে বোকামি পৃথিবীতে আর কিছু নাই’। মার্লেরা বুঝে কারা তাদেরকে শোষণ-শাসন করছে, কারা লুটে নিচ্ছে তাদের সর্বস্ব, কারা তাদের বানানো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদেরই মগজধোলাই করছে শিক্ষার নামে। মার্লেরা তাই এই মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তি চায়, মুক্তি চায় সকল কর্তৃত্বের হাত থেকে। মার্লেরা মুক্তির নামে ভুখা-নাঙ্গা পৃথিবী চায় না। মার্লেদের Redemption Song আদতে ‘কালো মানুষ’দের সকল শৃঙ্খল থেকে ‘মুক্তির গান’। শোষক-নিপীড়ক ‘বটবৃক্ষ’দের আর ভয় পায় না মার্লেরা। মার্লেরা নিজেদেরকে বলছেন ‘কড়া শাণ দেয়া ছোট্ট কুঠার’, তারা প্রস্তুত শোষক-নিপীড়ক ‘বটবৃক্ষ’দের ভূপাতিত করতে[Small Axe; Burnin’, 1973]। তাদেরকে রুখতে পারবে না বন্দুকের গুলি। তারা ভিক্ষা চাইবে না কোনো কিছুর জন্য, মাথা নতও করবে না কারো কাছে। তারা ক্রয় কিংবা বিক্রয় যোগ্য কোনো পণ্য নয়। তাদের জীবন তাদের কাছে সোনার চেয়েও দামি। তাই তারা নিজেদের অধিকার নিজেরাই সংহত করবে, কেড়ে নিবে শাসকদের চাবুক[Jammin’; Legend, 1984]।

মার্লেরা শুধু বিদ্রোহের গানই গাননি, গেয়েছেন ভালোবাসা, শান্তি, সংহতি ও ঐকতানের গান। আহ্বান জানিয়েছেন নিজেদের মধ্যে ‘হৈ চৈ ও মারামারি’তে ব্যস্ত না থাকার। কারণ এই বিভাজনের সুযোগ নিয়েই লুটেরারা চালায় দমন-নিপীড়ন, অন্যায়-অবিচার। বব ডিলান ফার্লে কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন- ‘মার্লের গান রাজনৈতিক নয়, তাঁর গান হচ্ছে সার্বজনীন’। মার্লে মৃত নয়, হারিয়ে যায়নি তাঁর গানও। বরঞ্চ আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন আমাদের এই সময়েও। মার্লের সহযোদ্ধা ও এক সময়কার জীবনসঙ্গী রিটা মার্লের বরাত দিয়ে বলতে হয়- ‘মার্লে তাঁর জীবন, মন, প্রাণ সব সমর্পণ করেছিল তাঁর গানের কাছে তাই তাঁর সুযোগ ও সামর্থ্য আছে মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকার’(Farley 2007)।

আদতে নির্যাতিত ‘কালো মানুষ’দের লড়াই-সংগ্রাম-মুক্তির কথা বললেও বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে মার্লেদের কন্ঠস্বর দুনিয়ার সকল বঞ্চিত, শোষিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করে। তাই মার্লেরা আহ্বান জানিয়েছেন একত্রিত হবার, একত্রিত হয়ে সকল শোষক-নিপীড়কের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। মার্লেরা বার বার মনে করিয়ে দেয় আমাদের ‘যুদ্ধ’ এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে। তাই মার্লে আর টশরা গাইছে-

‘Get up, stand up: stand up for your rights!
Get up, stand up: stand up for your rights!
Get up, stand up: stand up for your rights!
Get up, stand up: don’t give up the fight!’

[Get up, Stand up; Live!, 1975]

টীকা

    ভিআইপির অপেক্ষায় ছাড়েনি ফেরি, অ্যাম্বুলেন্সেই প্রাণ গেল স্কুলছাত্রের, প্রথম আলো, জুলাই ২৮, ২০১৯।   ‘প্রজাদের সুখেই শেখ হাসিনার সুখ’, বাংলানিউজ২৪, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৮।
   Mirpur slum fire: 3,000 families affected, probe body formed, August 17, 2019.
   ‘Hundreds’ of shanties gutted in fire at Mirpur, The Daily Star, March 12, 2018.
   জমি দখল করতেই বস্তিতে আগুন, আলাউদ্দিন আরিফ, দেশ রূপান্তর, আগস্ট ১৮, ২০১৯।
  ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ঝিলপাড় বস্তি, প্রথম আলো, আগস্ট ১৮, ২০১৯।
   টাঙ্গাইলে ফের ধানে আগুন দিয়ে কৃষকের প্রতিবাদ, সমকাল, মে ১৪, ২০১৯।
   একরামুলকে ‘ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে’, দ্য ডেইলি স্টার, জুন ০১, ২০১৮।
   অপহৃত মাইকেল চাকমার নিরাপদ প্রত্যাবর্তন চাই, সমকাল, মে ১৬, ২০১৯।
১০ মাসে বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার ২০৪ জন:আসক, দ্য ডেইলি স্টার, জুলাই ০১, ২০১৯।
১১ ৬ মাসে ৬০০ নারী ধর্ষণের শিকার:আসক, প্রথম আলো, জুলাই ০১, ২০১৯।
১২ নোয়াখালীর পার্কে এমপির নৈতিক খবরদারিঃ অধিকারের আওতা কতটুকু, নাগিব বাহার, বিবিসি বাংলা, জুলাই ১৮, ২০১৯।
১৩ চুলের ‘বখাটে কাট’বন্ধে প্রচারে পুলিশ, বিডিনিউজ, আগস্ট ২১, ২০১৯।

দোহাই

আলতাফ পারভেজ, শ্রেষ্ঠত্বের অসুখ, প্রথম আলো, আগস্ট ২২, ২০১৯।
কাজী মুনতাসির বিল্লাহ, রাস্তাফারাই, রেগে ও বব মার্লি, সংহতি প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি, ২০১২।
মাহা মির্জা, বড় অর্থনীতি, মেগা প্রকল্প ও হারিয়ে যাওয়া মানুষ, প্রথম আলো, জানুয়ারি ২৪, ২০১৯।
মাহা মির্জা, কৃষকের ধান ও ‘রোল মডেল’ রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা, প্রথম আলো, মে ২৬, ২০১৯[১] ।
সেলিম রেজা নিউটন, নয়া মানবতাবাদ ও নৈরাজ্যঃ এম. এন. রায়ের মুক্তিপরায়ণতা প্রসঙ্গে, আগামী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩।
Christopher John Farley, Before the Legend: The Rise of Bob Marley, Amistad, May, 2007.
অ্যালবাম ও গানের লিরিক্সের হদিসঃ http://bobmarleyweb.yaia.com/lyrics.html

  • খোইরোম রুধির: লেখক ও অনুবাদক
  • প্রবন্ধের প্রথম প্রকাশ: শিকড়ের ম্যাগাজিন ‘অরণী’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *