পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন খাতে নিরাপত্তাকরণ প্রক্রিয়া

  • মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান; ভাষান্তর: ডালিয়া চাকমা

সম্পাদকীয় মন্তব্য: মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খানের এই প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের ১২ জুনে নিউ এজ পত্রিকায় Securitisation of tourism in CHT শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিবেচনায় গত ১৯ নভেম্বর প্রবন্ধটি রাষ্ট্রচিন্তা ব্লগে প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির অনুবাদ করেছেন ডালিয়া চাকমা। এই প্রবন্ধের আরেকটি অনুবাদ ২০১৫ সালের আগস্টে সর্বজনকথায় প্রকাশিত হয়েছিল।


২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারী ও একই বছর মার্চের ২২ তারিখ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রমণ বিষয়ক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি দেশী বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। পাশাপাশি পর্যটকদের ‘নিরাপত্তা’ নিশ্চিতকরণের জন্য সেখানে কিছু পদক্ষেপের প্রস্তাব করা হয়, যেমন, পর্যটকদের ভ্রমণের অনুমতির প্রয়োজনীয়তা, তাদের ভ্রমণের সময়সূচী ও রুট সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বরাবর পেশ করা, বিদেশী পর্যটকদের সম্পর্কে নিরাপত্তা বাহিনীর তথ্য সংগ্রহ করা, চেক পোস্ট ও মাঠ পর্যায়ে মনিটরিং আরও জোরালো করা ইত্যাদি। নিউ এইজ পত্রিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এই বিজ্ঞপ্তির ব্যাপারে ড. তানজীমুদ্দীন খানের কাছে তাঁর মতামত জানতে চায়। [তিনি তখন এই বিজ্ঞপ্তির বিষয়বস্তু ও সম্ভাব্য তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেন।]   

মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান

এই পদক্ষেপগুলো স্পষ্টতই পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যটনের নিরাপত্তাকরণের প্রকল্পকেই নির্দেশ করছে, তবে প্রক্রিয়াটিকে বৈশ্বিক প্রবনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা উচিত হবে না। যা ঘটছে তা প্রাসঙ্গিকভাবে বুঝতে গেলে অবশ্যই দুটো খাতের সাম্প্রতিক উদীয়মান বৈশ্বিক প্রবণতাকে আমলে নিতে হবে: ‘পর্যটন শিল্প’ এবং ‘বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ’।

পর্যটনকে নিরাপত্তাকরণের প্রথম প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় ২০০২ সালে কেনিয়ার মোম্বাসা ও ইন্দোনেসিয়ার বালির জনপ্রিয় পর্যটন স্পটগুলিতে সন্ত্রাসবাদী বোমা হামলার ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। এই দুটি ঘটনার পাশাপাশি মনে রাখতে হবে যে, ২০০১ সালে ৯/১১ এ নিউইয়র্কে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী হামলার স্মৃতি সারা পৃথিবীর লোকের মনে এখনো সতেজ। বর্তমানে যে বৈশ্বিক নিরাপত্তাকরণ প্রক্রিয়া চলছে তার পেছনে এই আক্রমণগুলির একটি বড় ভূমিকা আছে। ‘ঝুঁকি পর্যালোচনা’, ‘ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা’, এবং ‘বিপদ’- ধারনাগুলো এই নিরাপত্তাকরণ প্রক্রিয়ারই অন্তর্গত। এই ধারণাগুলো সন্ত্রাসবাদ বিরোধী গৃহীত পদক্ষেপের বিকাশ ও সেসবের বৈধতাকরণে সহায়তা করেছে। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচী এবং সরকার, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রকল্পগুলোর সাথে পর্যটন শিল্পের যৌথ ও সমন্বিত উদ্যোগ।

নিরাপত্তাকরণের দ্বিতীয় প্রবণতাটি পরিলক্ষিত হয় বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে; এটি মূলত দুটি কারনে ঘটেছে। প্রথম কারণটি উদ্ভূত হয়েছে বন সংরক্ষণের বিভিন্ন কর্মসূচী যেমন, REDD+ (Reducing Emissions from Deforestation), FCPF (Forest Carbon Partnership Facility) প্রভৃতি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র কর্তৃক ‘প্রকৃতিকে নয়াউদারনীতিকরণ’-এর মাধ্যমে। উদারনীতিবাদিরা মনে করেন REDD+ কাজ করবে, এর জন্য দরকার কেবল আরো প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, আরো কিছু স্টেকহোল্ডার, এবং জনসাধারণের আরও অংশগ্রহণ। কিন্তু এই প্রত্যশা করতে গিয়ে তাঁরা এই সত্যটি উপেক্ষা করতে চান যে আসলে REDD+ ‘অর্থনৈতিক লাভের জন্য প্রকৃতির উপর মানুষের আধিপত্যকে সমর্থন করে’।১  যার মানে দাঁড়ায় কার্বণ বাণিজ্য, অর্থনৈতিক মান নির্ধারণ এবং বন ও ভূ-উপরস্থ ভূ-গর্ভস্থ প্রাকৃতিক সম্পদ সমূহকে পণ্যায়নে তাঁদের সমর্থন আছে।

দ্বিতীয় কারণটি বোঝা যায় বনজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্য নানান জায়গার বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ যেমন সোমালিয়ার আল শাবাব কিংবা আফ্রিকার উগান্ডার লর্ডস রেজিস্ট্যান্স আর্মির সাথে পার্টনারশীপে বিভিন্ন ক্রিমিনাল সিন্ডিকেটের যৌথ কার্যকলাপগুলোর মাধ্যমে। ইউএনইপি (United Nations Environment Programme) ও ইন্টারপোল এর যৌথ প্রতিবেদন অনুসারে, অবৈধ কাঠকয়লার দালালি ব্যবসার মাধ্যমে আল শাবাবের বাৎসরিক ইনকাম প্রায় $56 মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। গবেষণা থেকে দেখা যায়, বিভিন্ন বিশ্ব সংস্থার আইন প্রয়োগের তীব্রতার কারণে জাতি-রাষ্ট্রগুলো তার সম্পত্তির অধিকার, সম্পদে প্রবেশাধিকার সীমিত করার প্রক্রিয়া আরো জোরদার করছে। সংক্ষেপে বলা চলে ভূমি ও সীমানার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক হিসাবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পুনরুত্থান ঘটেছে।

ফটোগ্রাফার: ডেনিম চাকমা

বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রকল্পকে সামরিকীকরণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক হবার অথবা সীমানার অধিকারিত্বের প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ হচ্ছে ইন্টারপোল এবং ইউএনইপি এর যৌথ সমন্বয়ে নেয়া LEAF (Law Enforcement Assistance for Forest) নামক জলবায়ু বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংঘ, যা NORAD (Norwegian Agency for Development Cooperation) এর আর্থিক সহায়তায় গৃহীত হয়। লিফ প্রকল্পের লক্ষ্য হচ্ছে অবৈধভাবে গাছ কাটা এবং এর ফলে জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংসে দায়ী অপরাধীদের ধরা। কারণ তাদের এরূপ কার্যকলাপ বনের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের জীবিকা হুমকির মুখে ঠেলে দেয়, সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে একটি দেশকে অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন করে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই চুক্তিতে ‘অবৈধতা’র সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায়ন না থাকায় তা কেবল প্রথাগত ভূমি অধিকারকে উপেক্ষাই করেন না, বরঞ্চ এর ফলে রাষ্ট্রের সহযোগীতায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে আরো প্রান্তিক করে তুলে।ইউএসএআইডি এর অর্থায়নে বর্তমানে বাংলাদেশ প্রায় সকল সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও হাওর অঞ্চলে CREL (Climate-Resilient Ecosystems and Livelihoods) নামক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার পূর্বনাম ছিলো নিসর্গ বা Integrated Protected Areas Conservation। প্রকল্পটির আওতায় বন, বন্যপ্রাণী সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য ১৮ সদস্য বিশিষ্ট একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। মজার বিষয় হলো, এই টাস্কফোর্স গঠনের কাঠামো প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর অঞ্চলের নিরাপত্তাকরণের বৈশ্বিক প্রবণতাকেই ফুটিয়ে তুলে। কারণ এই টাস্কফোর্সের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, পুলিশ মহাপরিদর্শক, বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী অর্থাৎ বিজিবির মহাপরিচালক, কোস্ট গার্ডস, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী বা আনসার ভিডিপি এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা সংক্ষেপে ডিজিএফআই।

এই পরিপ্রেক্ষিতে, মানে ৯/১১ পরবর্তী সময়ে পর্যটন শিল্প ও বনাঞ্চল নিরাপত্তাকরণের বৈশ্বিক প্রবনতার পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের প্রবেশ ও চলাচলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা জারি একটি আশংকাজনক ব্যাপার বৈ কি। কিন্তু এই বিষয়ে আরও বিশদ আলোচনার আগে আমি অন্যান্য কতকগুলো ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।

১) মায়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা জনগণকে বাংলাদেশের ‘নিরাপত্তায় হুমকি’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

২) ২০০৭ সালে প্রণীত ‘রাইটস অফ ইন্ডিজেনাস পিপল’ সম্পর্কিত জাতিসংঘের সনদটি গ্রহণ থেকে বাংলাদেশ নিজেকে বিরত রেখেছে। কেননা, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এরকম ভয় আছে যে, এর মাধ্যমে সেখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে এবং ‘জাতি-রাষ্ট্র’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। ৭ জানুয়ারির বিজ্ঞপ্তিতে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘অন্যান্য অনেক বিষয়ে মতভেদ থাকলেও এ ব্যাপারে স্থানীয় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীসমূহ পুরোপুরি এক।’

৩) সরকার ১৯৯৭ সালে গৃহীত পার্বত্য শান্তিচুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে; বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তাকরণ কৌশলের প্রসার জোরদার করেছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে যে বাধ্যতামূলক পরামর্শ হওয়ার কথা তা ব্যতিরেকেই নানান প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে (যেমন আদিবাসীদের অধিকাংশের বিরোধীতা সত্ত্বেও রাঙামাটিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়েছে)। ভূমি বিরোধের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশাল কাজটি এখনো শুরুই হয়নি, সেটি না করেই রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ভূমির অধিকরণ হচ্ছে (২০১৪ সালে ৩,৯১১ একর জমি দখল করা হয়েছে, তৎপরবর্তী আরও ৮৪,৬৪৭ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে)। বন বিভাগ ৮৪,৫৪২ একর জমি দখল করে সেগুলোকে সংরক্ষিত ও সুরক্ষিত বনাঞ্চল বলে ঘোষনা দিয়েছে। আবার, আদিবাসীদের প্রথাগত আইনে পাওয়া হাজার হাজার একর জমি অ-আদিবাসীদের কাছে ইজারা দেয়া হচ্ছে রাবার বাগান করার জন্য। আদিবাসী পরিবারগুলোকে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। নিরাপত্তাবাহিনী ও বাঙালি সেটলারদের দ্বারা জুম্ম জনগণদেরকে খুন, ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ এসব ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে উপরোক্ত সমস্ত ঘটনা ও কার্যকলাপে সরকারের তরফ থেকে এক ধরণের দায়মুক্তির ব্যাপার আছে।

৪) তিন পার্বত্য জেলায় ‘উন্নয়ন’ ও পর্যটন প্রকল্পগুলোতে নিরাপত্তাবাহিনীর সম্পৃক্ততা দিনকেদিন বাড়ানো হচ্ছে। যেমন, বান্দরবানের নীলগিরি রিসোর্ট (আর্মি), রাঙামাটিতে আছে কাপ্তাইয়ের লেক প্যারাডাইজ (নেভী), জীবতলী রিসোর্ট (আর্মি), বাঘাইছড়ির এগত্তর (বিজিবি) এবং খাগড়াছড়িতে চেঙ্গী ব্রিজের হেরিটেজ পার্ক (আনসার ও ভিডিপি)। আঞ্চলিক পর্যটন খাতকে উন্নয়ন, জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও রক্ষনাবেক্ষণের কাজে সশস্ত্র বাহিনীর সরাসরি সম্পৃক্ততা ও অংশগ্রহণ কেবল বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়কে তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখেনি, সেই সাথে স্থানীয় প্রশাসনকেও অকার্যকর করে রেখেছে। এটি একদিকে যেমন তথাকথিত নিরাপত্তার নামে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সামরিকায়িত করার লক্ষণ, তেমনি একাত্তর পূর্বে এদেশে পাকিস্তানীরা যে প্রক্রিয়ায় ‘মিলবাস’ (মিলিটারি ইন বিজনেস) চালিয়েছিলো সেটিকেও প্রতিফলিত করে।

ছবি: অনলাইন

এখন বাহ্যিকভাবে সরকারের বিজ্ঞপ্তি মূলত বিদেশী নাগরিক ও বাংলাদেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পার্বত্য অঞ্চল পরিদর্শন, স্থান পরিদর্শন ও জুম্মদের সাথে কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। আর দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তিটি সকল দিক দিয়ে প্রথমটির বিবর্ধিত সংস্করণ মাত্র। প্রথমটিতে বলা হয়েছে, যে সকল বিদেশী নাগরিক পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিদর্শনে আগ্রহী তাদেরকে অবশ্যই এক মাস পূর্বে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় বরাবর আবেদন করতে হবে। দ্বিতীয়টিতে আবার পর্যটকদেরকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে, ১. যারা ট্যুর অপারেটরদের মাধ্যমে ভ্রমণ করবেন (অর্থাৎ কিনা তাদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করা অপেক্ষাকৃত সহজ হচ্ছে); ২. যারা কূটনীতিক অথবা জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন এজেন্সি কিংবা সম মর্যাদায় বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত; ৩. যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থিত বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় কর্মরত; এবং ৪. যারা ভ্রমণ অথবা গবেষণার উদ্দেশ্যে সেখানে যেতে চান। শেষ বর্গের পর্যটকদেরকে ভ্রমণের দশদিন পূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় বরাবর আবেদন করতে হবে যা কিনা প্রথম প্রজ্ঞাপনে দেখানো সময়ের এক তৃতীয়াংশে কমিয়ে আনা হয়েছে। প্রথম ও তৃতীয় বর্গের পর্যটকদেরকে জেলা কমিশনার এবং দ্বিতীয় বর্গের লোক অর্থাৎ কূটনীতিক ঘরানার পর্যটকদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর আবেদন করতে হবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে যে, ৭ জানুয়ারির বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো পর্যটকদের ‘অসুবিধা’র মুখে ফেলছে এবং স্থানীয় অর্থনীতির ক্ষতি করছে (স্থানীয়দের ‘আয়ের উৎস’); কেননা পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটকদের উপস্থিতি বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ‘প্রসার’ ঘটিয়েছিল। বিজ্ঞপ্তিতে সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছ: পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবশ্যই ‘স্থিতিশীল’ রাখতে হবে, তবে খেয়াল রাখতে হবে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বিদেশী পর্যটকদের যেন ‘নিরুৎসাহিত’ না করে।

কিন্তু মূল প্রশ্ন হচ্ছে কার কাছ থেকে নিরাপত্তা চাওয়া হচ্ছে? কে বা কী পর্যটকদের নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে?

জানুয়ারীর বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, স্থানীয় বিভিন্ন সংগঠন চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যাকাণ্ড এসবের সাথে জড়িত। সেখানে তাদেরকে ‘শান্তি চুক্তির বিরোধীতাকারী’ হিসেবে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে ‘স্থানীয়’ হিসেবে স্পষ্টত জুম্মদেরকেই নির্দেশ করা হয়েছে, বাঙালি সেটলারদেরকে নয়। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হইয়েছে যে কিছু স্থানীয় সংগঠনের কাছে ‘প্রচুর পরিমাণে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে’; তবে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে দুইটি জুম্ম সংগঠন জন সংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর জাতিগত পরিচয় চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, ‘সশস্ত্র দলগুলো দুর্গম এলাকায় সক্রিয়’ এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ ‘ভারত ও মায়ানমার থেকে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের সাথে যুক্ত’, কিন্তু সেখানে তাদের কোনো জাতিগত পরিচয়ের কথা বলা হয়নি। এর কারণ কী তারা বাঙালি বলে?

পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির মধ্যে এক ধরণের প্যারাডক্স রয়েছে। একদিকে এখানে জুম্ম জনগণকে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য তো বটেই সেই সাথে পর্যটকদের জন্যও হুমকি হিসেবে দেখানো হচ্ছে, আবার একইসাথে ‘বিদেশী’ পর্যটকদের নিয়ে একধরণের স্পষ্ট অস্বস্তি কাজ করছে। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বিদেশী পর্যটক ও জুম্মদের মধ্যে যোগাযোগ সেই অস্বস্তি তৈরী করছে।

তথ্যসূত্র:

১) Joanna Cabello and Tamra Gilbertson, “A colonial mechanism to enclose lands: A critical review of two REDD+-focused special issues,” ephemera 12(1/2): 162-180.

২) Joseph Cavanagh Connor, Pål Olav Vedeld, Leif Tore Trædal, “Securitizing REDD+? Problematizing the emerging illegal timber trade and forest carbon interface in East Africa,” Geoforum 60 (2015) 72–82.

৩) Ibid.

৪) “Violence and land grabbing forced 210 indigenous families to flee the country in 2014,”Dhaka Tribune, February 28, 2015.

৫) Ayesha Siddiqa, Pakistan Military Inc.: Inside Pakistan’s Military Economy, Karachi: Oxford University Press, 2007.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *