- লেখক: অনুপম সৈকত শান্ত
বিডিনিউজ২৪ এর মতামত পেজে প্রকাশিত জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত নাদিম মাহমুদের “গণস্বাস্থ্যের করোনাভাইরাস শনাক্তকারী কিট নিয়ে সংশয় কেন?” শীর্ষক লেখাটি আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। লেখার মাঝে অসংখ্য ভুল তথ্য উপস্থাপন যেমন করা হয়েছে, অনেকগুলো বিষয়ে লেখক তার অজ্ঞতা যেমন প্রকাশ করেছেন, তেমনি কিছুক্ষেত্রে মিথ্যাচারও করেছেন। আলোচ্য প্রবন্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এই লেখাটি লেখছি।
লেখক ভূমিকা বক্তব্যে বলেছেনঃ “বিজ্ঞানে আবেগের কোনও স্থান নেই, নেই কোনও রাজনীতির মহারথিদের অবস্থান। বিজ্ঞান চায় শুধু প্রমাণ ও যৌক্তিক আলোচনা। আমাদের এই আবেগীয় আলোচনা শুরুর আগে কিছু মৌলিক আলোচনার প্রয়োজন আছে। এরপর না হয় আলোচনা করা যাবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট নিয়ে।” বিজ্ঞানের আলোচনায় প্রমাণ ও যুক্তিকেই যে অবলম্বন করতে হয়, এ ব্যাপারে আমি একমত। এখানে আবেগের চাইতেও প্রিকনসেপশন, রাজনৈতিক বায়াসনেস ক্ষতিকর। যুক্তির ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা ও সততাও কাম্য। অথচ, লেখক তার লেখায় বিজ্ঞানের আলোচনা নামে কিভাবে রাজনৈতিক এজেণ্ডা বাস্তবায়নে লিপ্ত হয়েছেন, সেটিই আমরা দেখবো। লেখাটির দুটো পার্ট। এর মূল পার্ট হচ্ছে “গণস্বাস্থ্যের কিট নিয়ে কেন এত বিতর্ক”, কিন্তু এই কিট নিয়ে নানারকম সন্দেহ তৈরি করতে, তথা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই উদ্ভাবনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরুর “মৌলিক” আলোচনার নামে সাধারণভাবে এন্টিবডি টেস্টকেই কাঠগড়ায় তুলতে চেয়েছেন! যেহেতু একটি নির্দিষ্ট এজেণ্ডা বা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই অংশের আলোচনাটি করেছেন, ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই আলোচনায় তিনি বস্তুনিষ্ঠ থাকতে পারেননি! যাহোক, ভূমিকা রেখে মূল আলোচনাতে যাওয়া যাক। এখানে লেখকের বিভিন্ন বক্তব্য ধরে ধরে আলোচনা করছি, ফলে এই প্রতিক্রিয়াটি দৈর্ঘ্যে কিছুটা বড় হবে।
লেখক এন্টিবডি টেস্ট সম্পর্ক কিছু সাধারণ জ্ঞান দিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন:
“প্রশ্ন হলো, এই চিহ্নিত অ্যান্টিবডি শুধু কি SARS-CoV-2 বিপরীতে তৈরি হয়েছে নাকি অন্য কোনও প্যাথোজেন থেকে তৈরি হয়েছে, তা কেউ নিশ্চিত হতে পারবে না। কারণ, যেকোনও বর্হি অ্যান্টিজেন শরীরে প্রবেশ করলে আমাদের এই প্রতিরোধ ব্যবস্থায় এই IgM/ IgG তৈরি হয়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি কোভিড-১৯ দ্বারা সংক্রমিত নাকি ইনফ্লুয়েঞ্জা দ্বারা সংক্রমিত তা কোনও অবস্থায় আমরা বলতে পারি না। শুধু তাই নয়, অ্যান্টিবডি কতদিন আগে তৈরি হয়েছে অথাৎ আপনি অন্য কোন প্যাথোজেন দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর আপনার শরীরে এই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা তাও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হয় না। যে কারণে, এই সেরোলজিক্যাল টেস্টগুলোর ফলস পজিটিভ হওয়ার হার অনেক বেশি। (সূত্র-৪)”
এখানে লেখক দাবি করেছেন যে, RAPID DIAGNOSTIV TEST (RDT) তথা সেরোলজিক্যাল টেস্টের মাধ্যমে এন্টিবডি টেস্টিং করা হলে, সে কোন সুনির্দিষ্ট এন্টিবডিকে (যা সার্স-কোভ-২ এর বিপরীতে তৈরি) শনাক্ত না করে যেকোন এন্টিবডিকেই শনাক্ত করে ফেলবে, যেহেতু এই টেস্ট নাকি আলাদা করে কোন প্যাথোজেনের এন্টিবডি তা ডিটেক্ট করতে পারে না! এই যুক্তি যদি সঠিক হয় আমাদের দেশে অন্যসব প্যাথোজেন ডিটেকশনের যেসব সেরোলজিকাল টেস্টিং আছে, সেগুলো দিয়ে কোভিড-১৯ পেশেন্টকে টেস্ট করলে পজিটিভ কি পাওয়া যাবে? এই যুক্তি যদি সঠিক হতো, তাহলে এইসব এন্টবডি টেস্টিং কিট দিয়ে কোন টেস্টেই নেগেটিভ পাওয়া সম্ভব হতো না, সবই পজিটিভ আসতো! কেননা কোন না কোন প্যাথোজেনের বিপরীতে তৈরি হওয়া এন্টিবডি গিয়ে সেই টেস্টে পজিটিভ দেখাতো! কিন্তু সেরকমটা কি পাই?
লেখক এখানে যে তথ্যসূত্র দিয়েছেন, সেই রিসার্চ আর্টিকেলেও স্পেসিফিসিটি পাওয়া গিয়েছে ৯১%। মানে, ফলস পজিটিভের হার ৯%। সেই স্টাডিতে পিসিআর টেস্টে নেগেটিভ পাওয়া ৮৯ জনকে এন্টিবডি টেস্ট করার পরে ৮১ জনকে নেগেটিভ পেয়েছে, আর ৮ জনকে পজিটিভ পেয়েছে। ঐ আর্টিকেলটা যদি ভালো করে পড়া হয়, সেখানে পিসিআর টেস্টের ফলস নেগেটিভের সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলা হয়েছে; ২০০৩ এর সার্স-১ এর উপরে একটা স্টাডিতে পিসিআর এর সেন্সিটিভিটি ৫০ – ৭৫% পাওয়া গিয়েছে- সেটা বলা আছে। পিসিআর পরীক্ষার ফলস নেগেটিভের সম্ভাবনা মাথায় নিলে ঐ ৮ জনের আসলে কয়জন সত্যি সত্যি পজিটিভ আর সত্যি সত্যি নেগেটিভ বলা মুশকিল। যাই হোক, স্বীকৃত পদ্ধতি পিসিআরকে প্রামান্য ধরেই মানা গেল- তথ্যসূত্রের স্টাডিতে স্পেসিফিসিটি ৯১%। কিন্তু, লেখকের মূল যুক্তি অনুযায়ী তো এটা ০% হওয়া উচিৎ ছিল! যদি রক্তে থাকা যেকোন এন্টিবডিই পজিটিভ দেখায়, কিটগুলো যদি সার্স-কোভ-২ এন্টিবডিকে যদি আলাদাভাবে ডিটেক্ট করতে না পারে, তাহলে কি এত হাই স্পেসিফিসিটি (৯০% এর উপরে) পাওয়া যেত? বস্তুত লেখক যে তথ্যসূত্র এখানে উল্লেখ করেছেন, সেটি তার এই উদ্ভট দাবির পক্ষে কোন প্রমানই হাজির করতে পারেনি।
আসলে, এই এন্টিবডি টেস্ট কিভাবে কাজ করে তা বুঝতে গেলে তা বুঝতে চাইলে এবং সে ব্যাপারে কথা বলতে গেলে, আমাদের শরীরের ইম্যুউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে- সে ব্যাপারে আগে একটু জ্ঞানের পরিধি বাড়ানো দরকার। এ বিষয়ে একদম বেসিক জ্ঞান ছাড়াই এভাবে লেখালেখি করতে যাওয়া, মানুষকে ভুলভাল জ্ঞান বিতরণ করা পাপের পর্যায়ে পড়ে। যাহোক, খুব সহজ ভাষায় ব্যাপারটি বলার চেস্টা করছি।
সাধারণভাবে বললে বলা যায় ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া তথা ক্ষতিকর রোগজীবাণু বা প্যাথোজেন কিংবা ফুলের পরাগ রেনু থেকে শুরু করে মাছের কাটা যাই শারীরে ঢুকে তাকে ফরেন ম্যাটেরিয়াল বা এন্টিজেন বলে। এই এন্টিজেনগুলোকে আমাদের শরীরের ভিতরের সেল বা কোষ গুলো সাধারণত আগে থেকে চিনে না, জানে না, ফলে শরীরের জন্য হুমকি মনে করে এবং আমাদের শরীরের ইম্যুউন সেলগুলো সক্রিয় হয়ে যায়। আমাদের এডাপ্টিভ বা একোয়ার্ড ইম্যুউন সিস্টেমে অংশ নেয়া শ্বেত কনিকা (WBC) গুলোকে বলা হয় লিম্ফোসাইট। এই লিম্ফোসাইটগুলো সারা শরীরে ( সার্কেলুটরি-সিস্টেম, লিম্ফেটিক-সিস্টেম, এবং ইন্টারস্টিশিয়াল- ফ্লুইড সবজায়গাতেই) ঘুরে ঘুরে টহল দিয়ে বেড়ায় এবং শরীরে প্যাথোজেন ঢুকে পড়লে এই টহলরত লিম্ফোসাইটের শরীরের সাথে আটকে যায়! এই আটকে যাওয়ার ব্যাপারটা খুব ভালো করে বুঝা দরকার, এটি খুবই সুনির্দিষ্ট। প্যাথোজেনগুলোর শরীরের আবরণে (মেমব্রেনে) কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে, এগুলোকে বায়োলজিকাল চিহ্ন বলয়া যেতে পারে। এই বায়োলজিকাল চিহ্নগুলো আসলে হচ্ছে প্যাথোজেনগুলোর শরীরের বাইরের আবরণ বা মেমব্রেনে থাকা বিভিন্ন প্রোটিন অণু, যা দেখে বাইরে থেকেই সেই প্যাথোজেনকে চিনতে পারা যায়। বায়োলজিক্যাল- চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত এই প্রোটিন অণুই হচ্ছে আসলে এন্টিজেন (Antigen)। একটি প্যাথোজেনের মেমব্রেনে একাধিক এন্টিজেন থাকতে পারে, তাই একাধিক এন্টিজেন দিয়ে একটি প্যাথোজেনকে শনাক্ত করা যায়। আর, লিম্ফোসাইটদের আবরণে থাকে এন্টিজেন-রিসেপ্টর (Antigen-receptor), যা ঐ এন্টিজেনকে আটকে ফেলে। এখানে একটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার, একটি লিম্ফোসাইটের পর্দায় কেবল একধরণের এন্টিজেন-রিসেপ্টর থাকে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, একটি লিম্ফোসাইট মাত্র একটি এন্টিজেনের সাথেই আটকাতে পারে এবং ওই লিম্ফোসাইটটি শুধু ওই এন্টিজেনযুক্ত প্যাথোজেনদের শনাক্ত করতে পারে।
আমাদের শরীরে দুইরকম লিম্ফোসাইট আছে: বি সেল ও টি সেল। আমাদের শরীরে কোন এক সময়ে যে পরিমাণ বি সেল থাকে, তা দিয়ে বিলিয়নের উপরে প্যাথোজেন শনাক্ত করা সম্ভব। অর্থাৎ শরীরে বিলিয়নের উপরে আলাদা আলাদা এন্টিজেন-রিসেপ্টর থাকতে পারে (এত সংখ্যক এন্টিজেন-রিসেপ্টরের স্থান সংকুলানের জন্যে জিনোমে জেনেটিক রিকম্বিনেশন দরকার হয়, সেই জটিল আলোচনা এখানে স্কিপ করা যায়)। এই এন্টিজেন-রিসেপ্টর গুলো হচ্ছে বস্তুত এক বিশেষ রকমের প্রোটিন ইমিউনোগ্লবিউলিন (Immunoglobulin) বা সংক্ষেপে Ig। এন্টিবডিও এই একই প্রোটিন এবং এন্টিবডিগুলোকে Ig দিয়ে লেখা হয়, কিন্তু এন্টিবডি আর এই এন্টিজেন-রিসেপ্টরের একটা পার্থক্য আছে। এন্টিবডি হচ্ছে আসলে লিম্ফোসাইটের মেমব্রেনে থাকা এই এন্টিজেন-রিসেপ্টরের রেপ্লিকা বা ক্লোন ছাড়া কিছুই না। শরীরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট এন্টিজেনের সাথে আটকাতে সক্ষম এমন বি-সেলের পরিমাণ একেবারেই কম। তাই এই বি-সেল যখন কোনো এন্টিজেন শনাক্ত করে তখন এরা অতিদ্রুত বিভাজিত হয়ে নিজেদের ক্লোন (Clone) তৈরি করা শুরু করে। এই ক্লোন দুই ধরণের হয়। ইফেক্টর-বি-সেল (Effector-cell) বা প্লাসমা-সেল, এবং মেমরি-সেল (Memory cell)। অগণিত বি-সেলগুলোর মধ্যে শুধু তারাই ক্লোন তৈরি করতে পারে যারা ঐ সুনির্দিষ্ট এন্টিজেনকে শনাক্ত করে। প্লাসমা-সেলের কাজ হলো এন্টিবডি (Antibody), মানে সেই এন্টিজেন-রিসেপ্টরের ক্লোন তৈরি করে রক্তে ছেড়ে দেয়া। এন্টিবডিরা স্বাধীনভাবে রক্তে ভেসে বেড়ায় এবং উপযুক্ত এন্টিজেনযুক্ত প্যাথোজেনের সাথে আটকে যায়। এই এন্টিবডি একবার প্যাথোজেনের সাথে আটকে গেলে সেই প্যাথোজেন যেখানেই যাক সাথে করে ওই এন্টিবডিকে বায়োলজিক্যাল-চিহ্নের মতো বহন করে বেড়ায়, যার ফলে আমাদের ইম্যুউন সিস্টেমের অন্যরা খুব সহজেই সেই প্যাথোজেনকে চিনতে পারে এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। আর মেমরি সেলটা ইম্যুউনোলজিকাল মেমোরি বহন করে, যা পরবর্তীতে একই রকম প্যাথোজেনকে দ্রুত শনাক্ত করে অতি দ্রুত এন্টিবডি নিঃসরণ করতে থাকে, যাতে দ্রুতই ঐ প্যাথোজেনদের ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হয়।
এই হচ্ছে, মোটাদাগে আমাদের এডাপ্টিভ ইম্যুউন সিস্টেম। এখানে এন্টিজেন আর এন্টিবডির বাইণ্ডিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু লিম্ফোসাইটের এন্টিজেন-রিসেপ্টরগুলো এন্টিজেন স্পেসিফিক, মানে একেকটা এন্টিজেন-রিসেপ্টর একটা নির্দিষ্ট ধরণের এন্টিজেনকেই শনাক্ত করতে পারে, সেহেতু এন্টিজেন-রিসেপ্টরের ক্লোনগুলো, মানে এন্টিবডিগুলোও ওই প্যাথোজেন/ এন্টিজেন স্পেসিফিক, মানে এগুলো সুনির্দিষ্ট প্যাথোজেনের এন্টিজেনকের সাথে বাইণ্ড করে বা আটকে ধরে। অর্থাৎ হেপাটিটিস বি ভাইরাসকে চেনার জন্য এক ধরণের এন্টিবডি তৈর হবে, তো হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের জন্য আর এক ধরনের। কারণ আর কিছু না, প্যাথোজেন ভিন্ন হওয়াতে প্যাথোজেনের রিকগনিশন সাইট বা সেই বায়োলজিকাল চিহ্নগুলোও ভিন্ন হবে আর সেসব রিকোগনিশান সাইটের সম্পুরক এন্টিজেন-রিসেপ্টর তথা এন্টিবডিও তাই ভিন্ন হবে। এন্টিবডির এই এন্টিজেনকে আটকে ধরা বা এই বাইণ্ডিং, এটাকে এন্টিজেন-এন্টিবডি বাইণ্ডিং রিয়াকশন বলা যেতে পারে। এই রিয়াকশনটাও খুবই স্পেসিফিক! এই যে এন্টিজেন-এন্টিবডি স্পেসিফিক রিয়াকশান, সেটাকে কাজে লাগিয়েই বিভিন্ন ধরণের ইম্যুউনোএসসে বা সেরোলজিকাল এসসে ডেভেলোপ করা হয়। এই ধরণের ইম্যুউনোএসসে ডেভলপ করতে হলে এন্টিজেন- এন্টিবডি রিয়াকশান সম্পর্কে ভালো ধারনা থাকতে হয়, স্পেসিফিক প্যাথোজেন ও এন্টিবডির স্ট্রাকচার জেনে সেই অনুযায়ী কিট ডিজাইন করতে হয়। কোন নতুন ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই কাজগুলো জটিল ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। সে যাই হোক, এন্টিবডি টেস্ট কিট বলি আর এন্টিজেন টেস্ট কিট, দুটোর ক্ষেত্রেই মূল বিষয় হচ্ছে সেই এন্টিজেন-এন্টিবডি বাইণ্ডিং রিয়াকশন। এন্টিবডি টেস্টিং কিটে এন্টিজেন প্রোটিন রাখা হয়, এরপরে সেখানে সেই এন্টিজেন শনাক্তে সক্ষম এন্টিবডি সম্বলিত নমুনা দেয়া হলেই কেবল বাইণ্ডিং সম্পন্ন হয়, তখন একরকম ফ্লুরোসেন্ট ম্যাটেরিয়ালের মাধ্যমে দাগ তৈরি হয়, কিংবা ডট ব্লট পদ্ধতির ক্ষেত্রে একরকম জমাটবদ্ধ ডট তৈরি হয়। এন্টিজেন টেস্টিং এর ক্ষেত্রে উল্টাটা ঘটে, মানে কিটে এন্টিজেনের বদলে সুনির্দিষ্ট এন্টিবডি রাখা হয়ে, সেখানে সুনির্দিষ্ট এন্টিজেন সংস্পর্শে এলেই কেবল সেই বাইন্ডিং ঘটবে।
তার মানে হচ্ছে, এই যে এন্টিবডি টেস্টিং কিট সেখানে থাকে সুনির্দিষ্ট প্যাথোজেনের এন্টিজেন, ডেঙ্গু শনাক্তের কিট হলে ডেঙ্গুর ভাইরাস থেকে নেয়া এন্টিজেন, সার্স-কোভ-২ ভাইরাস শনাক্ত করার জন্যে সার্স-কোভ-২ ভাইরাস থেকে নেয়া এন্টিজেন। ডঃ বিজন শীলরা যে দেশের বাইরে থেকে রি-এজেন্ট নিয়ে এসেছেন, সেটা হচ্ছে কোভিড-১৯ পজিটিভের স্পেসিমেন থেকে পাওয়া এন্টিজেন! সেই এন্টিজেনের সাথে যেকোন এন্টিবডি বণ্ডিং করবে না, কেবল যেসব এন্টিবডি এই এন্টিজেনকে চিনতে পারবে কেবল তারাই এর সাথে বণ্ডিং করবে। যেমনঃ বায়োমেডোমিকস এর যে কিট সেখানে যে COVID-19 recombinant antigen ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি হচ্ছেঃ MK201027 (সূত্রঃ Development and Clinical Application of A Rapid IgM-IgG Combined Antibody Test for SARS-CoV-2 Infection Diagnosis, Zhengtu Li et al, 2020), এই এন্টিজেনকে এন্টি সার্স-কোভ-২ এন্টিবডি নিশ্চিতভাবেই বাইণ্ড করবে। কিন্তু অন্য যেকোন প্যাথোজেনের বিপরীতে তৈরি হওয়া এন্টিবডিও কি বাইণ্ড করতে পারবে? মোটেও না! অধিকাংশ প্যাথোজেনের বিপরীতে তৈরি হওয়া এন্টিবডি এই এন্টিজেনকে চিনতেই পারবে না।
এক্ষেত্রে তো, ফলস পজিটিভের হার তো শুন্য হওয়ার কথা ছিল! কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে এন্টিবডি টেস্টিং কিটগুলোর স্পেসিফিসিটি দেখা যাচ্ছে ৮০% থেকে ৯৫%। তারমানে প্রায় ৫% -২০% ফলস পজিটিভ পাওয়া যেতে পারে। এর কারণ হচ্ছে প্রধানত অন্য করোনাভাইরাসগুলোর সাথে cross-reactivity। কেননা অন্যান্য করোনাভাইরাসের সাথে সার্স-কোভ-২ এর জেনেটিক মিল অনেক বেশি, ফলে কিটে যদি এমন এন্টিজেন রাখা হয় যা অন্য করোনাভাইরাসেও কমনলি আছে, তাহলে সেই করোনাভাইরাসের বিপরীতে তৈরি হওয়া এন্টিবডিও এটাকে চিনতে পারবে ও বাইণ্ডিং তৈরি করে ফেলবে। এটা দূর করা সম্ভব, টার্গেটেড এন্টিজেন-এন্টিবডি রিয়াকশনটা ভালোভাবে স্টাডি করে। যতবেশি ইউনিক এন্টিজেন ব্যবহার করা সম্ভব, তত বেশি অন্য করোনাভাইরাসের এই ক্রস রিয়াক্টিভিটির সম্ভাবনা এলিমিনেট করা সম্ভব! এখানে দরকার গবেষণা। চীনে এরই মধ্যে একটি গবেষণায় ৫ রকমের এন্টিজেন দিয়ে এন্টিবডি কিট তৈরি করে পারফর্মেন্স পরীক্ষা করা হয়েছে। দেখা গিয়েছে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের স্পাইকের প্রোটিন থেকে এন্টিজেন নেয়া হলে একুরেসি বেড়েছে। সেজন্যেই প্রতিটা টেস্ট কিটের জন্যে আলাদা আলাদা ট্রায়াল করা দরকার, একটার রেজাল্ট দেখে অন্যটিকে মূল্যায়ন করা যায় না! এক দেশের ফল দেখে আরেক দেশে কিছুই বলা যায় না!
লেখক ‘অন্যদেশগুলো যা বলছে’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে বলেছেন:
“ভারতের কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্স (আইসিএমআর) গত ২৩ মার্চ এক বিবৃতিতে বলছে, কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের জন্য আইসিএমআর সরকারি ও বেসরকারি ল্যাবরেটরিতে দুই ধরনের আরটি-পিসিআর কিটের অনুমোদন দিয়েছে। এইগুলো ১০০% ট্রু-পজিটিভ ও ট্রু-নেগেটিভ ফলাফল দিয়েছে। (সূত্র-৫)”
এটা ঠিক যে, এখন পর্যন্ত পিসিআর টেস্টই সবচাইতে নির্ভরযোগ্য। বিশেষ করে একটিভ রোগী শনাক্তে পিসিআর টেস্টের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু এন্টিবডি টেস্টের প্রয়োজনীয়তা অন্য ক্ষেত্রে, ব্যাপকভাবে মাস টেস্টিং পিসিআর পদ্ধতিতে করা সম্ভব নয়, কেননা এটি সময় সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল, এর জন্য বিশেষ ল্যাব দরকার, পিসিআর মেশিন দরকার, দক্ষ জনবল দরকার। ৮ মার্চ থেকে দেড় মাস পার হওয়ার পরেও আমাদের দেশে দৈনিক ৩৫০০ টেস্ট করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অথচ, র্যাপিড টেস্ট পদ্ধতিতে দিনে ৬০-৭০ হাজার এমনকি লাখের উপরেও টেস্ট করা সম্ভব। এছাড়া, পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা সংগ্রহ, পরিবহন, সংরক্ষণের সমস্যার কারণে ফলস নেগেটিভের হার বেড়ে যেতে পারে, আমাদের মত দেশে- তাই ফলস নেগেটিভের হারটা তাই অনেক বেশি হওয়ার কথা। সে কারণে, একাধিক টেস্টের মাধ্যমে ক্রসচেক করার অপশনটাও যুক্ত করা যায়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, আজকের এই লকডাউন পরিস্থিতি থেকে এক্সিট রুটের উপায় হিসেবেও জনপুঞ্জের ইম্যুউনিটি ডাটাবেজের প্রয়োজন, যা এন্টিবডি টেস্টিং ছাড়া পাওয়া সম্ভব না। এরকম নানা কারণেই এন্টিবডি টেস্ট দরকার, এমনকি ফলস নেগেটিভ ও ফলস পজিটিভের সম্ভাবনা মাথায় রেখেই এই টেস্টিং দরকার। নানারকম গবেষণার কাজেও এই টেস্ট দরকার। অথচ, আলোচ্য প্রবন্ধে এভাবে পিসিআর বনাম এন্টিবডি টেস্টিং মুখোমুখি দাঁড় করানোটাই মিসলিডিং। বুঝতে হবে, পিসিআর টেস্টের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কারণেই এই এন্টিবডি টেস্টের প্রয়োজনীয়তা। চাইলেও বিশাল সংখ্যক মানুষকে পিসিআর টেস্ট করা সম্ভব না, অল্প বা বিনা লক্ষণ দেখিয়ে যারা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে গিয়েছে- তারা কখনো আক্রান্ত হয়েছিলো কি না- সেটি পিসিআর টেস্ট দিয়ে কখনো জানা সম্ভব না! এরকম ক্ষেত্রে এন্টিবডি টেস্টই একমাত্র ভরসা; সেরকম জায়গায় পিসিআর টেস্টের ১০০% সেন্সিটিভিটি আর ১০০% স্পেসিফিসিটি’র উদাহরণ দেয়ার কোন মানে নেই।
এই ব্যাপারটা জানিয়ে রেখেই- লেখকের দেয়া তথ্যসূত্রের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আইসিএমআর এর যে রিপোর্টটি এখানে সূত্র হিসেবে দেয়া হয়েছে, সেটি যদি দেখা যায়, তাহলে একটা ব্যাপার পরিস্কার বুঝা যাবে। সেখানে পুরো সিদ্ধান্তের শেষ লাইনটি সুচতুরভাবে লেখক উল্লেখ করেছেন। আমি পুরোটি কপি করছিঃ “ICMR has established a fast-track mechanism for validation of non-US FDA EUA/CE IVD approved kits at ICMR NIV Pune. ICMR NIV Pune has completed evaluation of 09 non-US FDA EUA/CE IVD kits. Only test kits with 100% concordance among true positive and true negative samples have been recommended for commercial use in India.” অর্থাৎ এই রিপোর্টে বস্তুত আইসিএমআর US FDA EUA/CE IVD এর বাইরের যে পিসিআর কিট আছে, সেগুলোকে মূল্যায়ন করেছে, মোটেও এনিবডি টেস্টিং কিটকে নয়। সেখানে US FDA EUA/CE IVD এর পিসিআর কিটগুলোতে ট্রু পজিটিভ ও ট্রু নেগেটিভের হার ১০০% পাওয়া গেলেও, অন্য পিসিআর কিটগুলোতে ট্রু নেগেটিভের হার ১০০% এর অনেক কম পেয়েছে। যেমনঃ BGI এর Real Time detecting 2019-nCoV এর ক্ষেত্রে এই হার ৯০%, একইভাবে Krishgen Bio System এর SARS-CoV-2 (RT-qPCR) এর হার ৮০%, ABI এর TaqMan 2019-nCoV Control Kit এর হার ৯০%, HIMEDIA এর Hi-PCR Corona Virus (CoViD-19) Probe PCR এর ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ৫%, অন্য তিনটা পিসিআর কিটেরও ট্রু নেগেটিভের হার ৪০%, ১০% ও ৭৫%।
(সূত্রঃ Fast Track Approval for Indian COVID-19 testing kits for commercial use)
ফলে, বুঝতেই পারছেন, লেখক এই পরিচ্ছেদে এন্টিবডি টেস্ট সম্পর্কে বিভিন্ন দেশে নেয়া পদক্ষেপ দেখাতে আলোচনা করতে গিয়ে যে তথ্য সূত্র উল্লেখ করেছে, মূলত সেখানে পিসিআর টেস্ট কিটেরও রিলায়িবিলিটির সমস্যাটা চোখের সামনে চলে আসছে। এখানে একই সাথে উল্লেখ করা দরকার যে, বাংলাদেশের কিটগুলোর বেশিরভাগই চীন থেকে আসা। বাংলাদেশে আনা US FDA EUA/CE IVD এর বাইরের কিটগুলোর এরকম রিলায়িবিলিটি টেস্ট করাটা কত জরুরী সেটাই এই তথ্যসূত্র থেকে বুঝতে পারা যাচ্ছে !
লেখক এরপরে বলেছেন,
“যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, নেদারল্যান্ডও এই ধরনের অ্যান্টিবডি টেস্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এর মান সঠিক নয় বলে সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে বেশ আলোচনা হচ্ছে। (সূত্র-১৬) “
যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও নেদারল্যাণ্ড এই এন্টিবডি টেস্টিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, এই কথাটা ভুল। সায়েন্সম্যাগাজিনে যে আর্টিকেলটি তিনি সূত্রে উল্লেখ করেছেন সেটি থেকে লেখক সম্পূর্ণ ভুল ইন্টারপ্রেট করেছেন। ঐ আর্টিকেলে বলা হয়েছে, জার্মানি, নেদারল্যাণ্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় চালানো সার্ভে প্রোগ্রামে যে ফল পাওয়া গেছে, সেটার সাথে অফিসিয়াল ডাটার অসামঞ্জস্য নিয়ে কথা উঠেছে। এই সার্ভেগুলোতে ২% থেকে ৩০% পর্যন্ত নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মাঝে পজিটিভ পাওয়া গিয়েছে। এই হারটা অনেক বেশি হওয়াতে বিজ্ঞানী কমিউনিটি কিছুটা স্কেপটিকাল, বিশেষ করে এন্টিবডি টেস্টিং এর স্পেসিফিসিটি নিয়ে তারা নিশ্চিত নন। বিশেষ করে জার্মানির সার্ভের ব্যাপারে এন্টিবডি টেস্ট কিট নিয়ে অভিযোগ আছে। একটি কোম্পানির দাবি করা ৯৯% স্পেসিফিসিটির কিট নিয়ে নেদারল্যাণ্ড গবেষণা করে ৮৫% স্পেসিফিসিটি পেয়েছে। এসব কারণে বিজ্ঞানীদের মাঝে এসব কিট, বিশেষ করে বিভিন্ন কোম্পানির দাবির ব্যপারে প্রশ্ন আছে, ঠিকই। কিন্তু, মোটেও এন্টিবডি টেস্টিং এর বিপরীতে এই বিজ্ঞানী কমিউনিটি অবস্থান নেন নাই, বরং এরকম স্টাডিগুলোর ক্ষেত্রে আরো রিলায়েবল টেস্টিং কিট ব্যবহার করা, এই এন্টিবডি টেস্টিং কিটের আরো ইম্প্রুভমেন্টের কথাই বলা হয়েছে। অন্যদিকে, এইসব সার্ভেকে দেখিয়ে ন্যাচার সহ বেশ কিছু আর্টিকেলে অন্যভাবেও আলাপটা করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে যে ডাটা আমাদের সামনে রয়েছে, যতটুকু জনগোষ্ঠীকে টেস্ট করা সম্ভব হয়েছে তার ভিত্তিতে, সেই ডাটার চাইতেও আক্রান্তের হার অনেক বেশি, ক্ষেত্রবিশেষ ৫০ গুনের বেশিও হতে পারে; ফলে- এই কোভিড-১৯ এর মৃত্যু হার আরো অনেক কম- এভাবেও অনেক বিজ্ঞানী ইন্টারপ্রেট করছেন!
আর, এইসব দেশ প্রশ্ন তুলেছে – কথাটা ভুল। এখনো নেদারল্যাণ্ডে একটা স্টাডি চলছে হার্ড ইম্যুনিটি নিয়ে তারা এই সার্ভেটি করছে! একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসিও এই র্যাপিড টেস্ট কিট দিয়ে তিনটি কার্যক্রম চালাছেঃ ১/ বিভিন্ন হটস্পটগুলোতে যাদের এখনও কোন টেস্ট করা হয়নি তাদের ঢালাওভাবে টেস্ট, ২/ বিভিন্ন স্টেটের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিনিধিত্বমূলক মানুষের টেস্ট করে একরকম সার্ভে প্রোগ্রাম, ৩/ সরাসরি পাবলিক ইন্টারেকশন হওয়া দায়িত্বে যারা আছেন তাদের সবাইকে টেস্ট (যেমন সমস্ত হেলথ ওয়ার্কারদের)! এরকম আরো অনেক দেশেই অনেক প্রোগ্রাম চালানো হচ্ছে। ভিয়েতনাম নিজস্ব পিসিআর কিট তৈরি করার পরেও ২ লাখ র্যাপিড কিট কোরিয়া থেকে এনেছে। মাস লেভেল র্যাপিড টেস্টিং আর হাসপাতালে অসুস্থ, লক্ষণ দেখা যাওয়া ও কন্টাক্ট ট্রেসিং এ সন্দেহভাজনদের পিসিআর টেস্টিং- দুইটাই প্যারালালি চালাচ্ছে। করোনা মোকাবেলায় ভিয়েতনাম অন্যতম সফল একটা দেশ। আমিরাতেও র্যাপিড টেস্টিং চলছে, তারা ফ্লাইট চালু রেখেছে- সমস্ত প্যাসেঞ্জারকে ফ্লাইটে তোলার আগে র্যাপিড টেস্ট বাধ্যতামূলক করেছে, যে বিষয়টিকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ভবিষ্যতের জন্যে একটা নোশন হিসেবে দেখিয়েছে! এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে! এই ফলস পজিটিভ আর ফলস নেগেটিভের সম্ভাবনা মাথাতে রেখেই- আরো বেশি সংখ্যক মানুষকে টেস্টের আওতায় নেয়ার জন্যেই এরকম সহজ, সস্তা টেস্টিংকে কাজে লাগানো যায়! ফলে, বিভ্রান্তি তৈরির লক্ষে এমন উদাহরণ ভুলভাবে টানা ঠিক না।
লেখক “বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যা বলছে” পরিচ্ছেদে বলেছেন:
“পয়েন্ট অব কেয়ার (পিওসি) ডায়াগনস্টিক নিয়ে ডব্লিউিএইচও সরাসরি বলছে, গবেষণার জন্য কেবল ইমিউনু ডায়াগনোস্টিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে। তবে কোনভাবে ক্লিনিক্যাল ব্যবহারে উচিত হবে না, যতক্ষণ না বিস্তারিত নির্দেশনা না পাওয়া যায়। গত ৮ এপ্রিল ওই বিবৃতিতে সংস্থাটি কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের অ্যান্টিজেন টেস্টের বিষয়ে বলে, “WHO does not currently recommend the use of antigen-detecting rapid diagnostic tests for patient care, although research into their performance and potential diagnostic utility is highly encouraged।” অথাৎ ডব্লিউএইচও রোগীদের জন্য অ্যান্টিজেন শনাক্তের অতিদ্রুত ডায়াগনোস্টিক পরীক্ষা করার সুপারিশ করবে না। তবে এর মান বাড়ানোর জন্য আরো ভাল গবেষণা করার জন্য উৎসাহ দিচ্ছে। (সূত্র-৮) কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি টেস্টের জন্য যেসব প্রচলিত সেরোলজিক্যাল কিট বা পদ্ধতি চালু হয়েছে, সেইগুলোর যথেষ্ট সমালোচনা উঠে এসেছে ডব্লিউএইচও প্রতিবেদনে। তারা বলছে, “WHO does not recommend the use of antibody-detecting rapid diagnostic tests for patient care।” সুতরাং এই কথা স্পষ্ট যে, ডব্লিউএইচও সেরোলজিক্যাল টেস্টগুলোকে এখনো অনুমতি দেয়নি। তার কারণ, এই টেস্টগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন বরাবরই থাকছে।”
খুব দুঃখের সাথে জানাতে হচ্ছে যে, লেখক আগের মতো এখানেও WHO এর পুরা গাইডলাইন থেকে ইচ্ছেমত অংশ তুলে নিয়ে এসে, নিজের মত করে ইন্টারপ্রেট করেছেন, কোথাও ভুল কথা জানিয়েছেন; এবং সেখান থেকে যে কনক্লুশনটা টেনেছেন- WHO এর কনক্লুশন থেকে সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কনক্লুশন হয়ে দাঁড়িয়েছ। লেখক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে এন্টিবডি ও এন্টিজেন টেস্ট সংক্রান্ত দুটো রিকমেন্ডেশন উল্লেখ করেছেনঃ “WHO does not currently recommend the use of antigen-detecting rapid diagnostic tests for patient care” “WHO does not recommend the use of antibody-detecting rapid diagnostic tests for patient care”! অর্থাৎ পেশেন্ট কেয়ারে এই এন্টিবডি, এন্টিজেন টেস্টিং ব্যবহার করা যাবে না। ব্যাপারটার মানে কি? WHO এর ঐ এডভাইসেই আছে- clinical decision-making এ এই টেস্ট রিকমেন্ড করা হচ্ছে না। এর মানে আসলে কি? যে অসুস্থ, কোভিড-১৯ এর লক্ষণ আছে, তাকে এন্টিবডি/ এন্টিজেন টেস্ট করে যদি নেগেটিভ আসে, তাহলে তাকে নন-কোভিড-১৯ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না! এইটুকুই তো, নয়কি? বিভিন্ন দেশে দেশে যারা এই এন্টিবডি কিট ইউজ করছে, তারাও বস্তুত নন-পেশেন্ট, সামান্য লক্ষণ দেখানোদের – মাস টেস্টিং এর আওতায় র্যাপিড টেস্ট করছে, আর যাদের লক্ষণ প্রকট, যারা অসুস্থ- তাদের ক্ষেত্রে পিসিআর। কিংবা পিসিআর এর সাথে সাথে ডাবল টেস্টিং অপশন হিসেবে র্যাপিড টেস্টিং ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে, পেশেন্ট কেয়ার বা ক্লিনিকাল ডিসিশন মেকিং-ই তো এর একমাত্র কাজ না, যে সেটির জন্যে রিকমেণ্ডে না বলা হলেই বলা যাবে যে, এই Rapid Diagnostic Test এর কোন উপযোগিতাই নেই। আর, এই এন্টিবডি টেস্টিং এর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ, সেই ইম্যুউনোডায়গনিস্টিক টেস্ট, সেটার ব্যাপারে কিন্তু অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তাছাড়া, এই অনুমোদন না দেয়ার প্যারাটির শুরুতে বলা হয়েছে, এই কিটগুলো অনুমোদন দেয়ার আগে যথাযথ ভেলিডেশন দরকার। ফলে, WHO কারেন্ট এভিডেন্সের উপরে ভিত্তি করে পেশেন্ট কেয়ারে অনুমোদন না দিলেও, সেই প্রথম বাক্য অনুসারে কিন্তু কোন দেশে এই কিটের ভেলিডেশনে এক্সিলেন্ট আউটকাম পেলে কিন্তু অনুমোদন দিতেও পারবে।
তবে, আমার মতে- ক্লিনিকাল ডিসিশন মেকিং এ কেবল র্যাপিড টেস্টই নয়, পিসিআর টেস্টকেও সন্দেহ করা দরকার। যেহেতু কোভিড-১৯ পেশেন্টদের জন্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেবল লক্ষণ দেখে দেখে লক্ষণের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে, ফলে একজন সিভিয়ার বা ক্রিটিকাল পেশেন্টের যতই টেস্ট নেগেটিভ আসুক তার লক্ষণ দেখেই চিকিৎসাটা কন্টিনিউ করা দরকার! আমাদের দেশে সেটি হচ্ছে না! পিসিআর এ ফলস নেগেটিভ আসায় চিকিৎসা পায়নি, এমনকি টেস্ট রেজাল্ট আসতে দেরি হওয়ায় আইসিইউতে ভর্তি করতে চায়নি (পরে মারা যাওয়ার পরে টেস্ট পজিটিভ পাওয়া গেছে)- এমন ঘটনাও আছে।
লেখক “অ্যান্টিবডি টেস্ট নিয়ে এফডিএ কী বলছে?” শিরোনামে লিখেছেন:
“১৭ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ঔষধ অধিদপ্তর (এফডিএ) সেরোলজিক্যাল টেস্টের বিশদ আলোচনা করেছে। তারা সরাসরি বলছে যে অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমে SARS-CoV-2 সংক্রমণ নির্ণয় করা সম্ভব তার কোন বৈধতা দেয়া সম্ভব নয়। এছাড়া সংস্থাটি কখনই তা আশাও করে না। (সূত্র-৯-১০) তবে সংস্থাটির emergency use authorization (EUA) আওতায় যারা করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণের কিট জমা দিতে আগ্রহীদের তাদের জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরেছে। বিক্রির উদ্দেশ্যে সেরোলজিক্যাল টেস্ট কখনোই ব্যবহার করা উচিত নয়। বাজারে প্রাপ্ত এইসব সেরোলজিক্যাল টেস্ট এফডিএ অনুমোদিত নয় বলেও তারা উল্লেখ করেছেন।”
বস্তুত, এখানে এফডিএ’র নামে যেসব বলা হয়েছে, তার অধিকাংশই বানোয়াট, কিংবা লেখক তার উল্লেখ করা সূত্রের পেজ দুটি পড়ে বুঝতে ভুল করেছেন। বস্তুত এফডিএ কখনোই এই কথাগুলো বলেনিঃ “অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমে SARS-CoV-2 সংক্রমণ নির্ণয় করা সম্ভব তার কোন বৈধতা দেয়া সম্ভব নয়”, “বিক্রির উদ্দেশ্যে সেরোলজিক্যাল টেস্ট কখনোই ব্যবহার করা উচিত নয়”, “বাজারে প্রাপ্ত এইসব সেরোলজিক্যাল টেস্ট এফডিএ অনুমোদিত নয়”! আসলে, এফডিএ এই পয়েন্ট অব কেয়ার (POC) টেস্ট কিটগুলোর হোম ইউজের অনুমোদন দেয়নি, মাস পিপল বাসায় বসে এন্টিবডি টেস্ট করার উদ্দেশ্য এই কিট কিনতে পারবে না! কিন্তু বাজারের প্রাপ্ত সেরোলজিকাল টেস্ট এফডিএ অনুমোদিত নয়, এটা একদমই ভুল কথা। এই লিংকে গেলে ৪৯ টা ম্যানুফেচারের কিটের অনুমোদনের কথা দেখা যাবে (সবই EUA এর আণ্ডারে), যার মধ্যে ৮ টি হচ্ছে সেরোলজিক্যাল এন্টিবডি টেস্টিং কিট। এই অনুমোদনের বাইরে বস্তুত কোন কিট যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যাওয়ার কথাও না, আর এই ৪৯ কিটকে বাজারে মাস পাবলিকের হোম ইউজের (প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট এর মত) জন্যে বিক্রি অনুমতি দেয়া হয়নি। এই অনুমোদনের ক্ষেত্রে তিনরকম ক্রাইটেরিয়া আছেঃ
H – authorized for use in certified Laboratories to perform high complexity tests.
M – authorized for use in certified laboratories to perform high complexity and moderate complexity tests.
W – authorized for use in certified laboratories to perform high complexity and moderate complexity tests, and deemed to be CLIA waived for use in patient care settings operating under a CLIA Certificate of Waiver, Certificate of Compliance.
সুতরাং, সেরোলজিক্যাল কিংবা মলিকুলার সবই সার্টিফায়েড ল্যাবরেটরিতেই ব্যবহার করতে হবে। অথচ, লেখক এমনভাবে লিখেছেন যে, এই এন্টিবডি টেস্ট কিটগুলোকে অনুমোদনই দেয়া হচ্ছে না বা হয় নাই, অনুমোদন দেয়া সম্ভব না … ইত্যাদি। তিনি নিজে যে লিংক দুটো শেয়ার করেছেন, সেগুলো একটু ভালো করে পড়লেই বুঝতে পারতেন যে, এই এন্টিবডি টেস্টিংকে এফডিএ এখন কি পরিমাণ গুরুত্ব দিচ্ছে! আমি কিছু লাইন সেখান থেকে কপি করছি।
প্রথম লিংকের প্রথম লাইনেই আছে: ‘The U.S. Food and Drug Administration (FDA) recommends that health care providers continue to use serological tests intended to detect antibodies to SARS-CoV-2 to help identify people who may have been exposed to the SARS-CoV-2 virus or have recovered from the COVID-19 infection.’ – অর্থাৎ হেলথ ওয়ার্কারদের জন্যে এই এন্টিবডি টেস্টিং হচ্ছে রিকমেন্ডেড। তাহলে, আমাদের লেখক এভাবে লিখেছেন কেন? তিনি কোন জায়গাটিতে বুঝতে ভুল করেছেন?
এফডিএ হেলথ ওয়ার্কারদের জন্যে এই এন্টিবডি টেস্ট রিকমেন্ডেড বলার পরে তাদেরকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, এই টেস্টের কিছু লিমিটেশন আছে এবং একে কোভিড-১৯ রোগী শনাক্তের একমাত্র উপায় হিসেবে ধরা হলে সেটা প্যাশেন্টদের জন্যে খুব রিস্কি হয়ে যাবে। সেই জায়গাটা ব্যাখ্যা দিয়ে এফডিএ জানাচ্ছে, এন্টিবডি টেস্টিং সার্স-২ ইনফেকশন শনাক্তের জন্যে ব্যবহার হচ্ছে বলে তাদের জানা নাই এবং তারা আশাও করে না যে, এই এন্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে একজনকে কোভিড-১৯ রোগী হিসেবে শনাক্ত বা শনাক্ত না বলা যাবে। এটা হচ্ছে- এই এন্টিবডি টেস্টিং এর একদম বেসিক বিষয়। এন্টিবডি টেস্ট পজিটিভ মানেই হচ্ছে, সেই ব্যক্তি সার্স-২ ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলো, কিন্তু এখনো সে আক্রান্ত কিনা সেটা কখনোই কেবল এন্টিবডি টেস্ট করে বলার বা বুঝার উপায় নাই। অন্যদিকে, কেউ টেস্ট নেগেটিভ পাওয়া মানেও নিশ্চিত করে বলা যাবে না, এই মুহুর্তে তার শরীরে সার্স-২ নাই, কেননা এন্টিবডি তৈরিতে কিছুদিন সময় নেয়!
এই আহবানটা আসলে এফডিএ’র পক্ষ থেকে হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছে। যেখানে- সমস্ত হেলথ ওয়ার্কারদের বাধ্যতামূলক এই এন্টিবডি টেস্টিং প্রোগ্রামের নেয়ার কথা বলা হয়েছে! অথচ, সেই আহবানকেই কি মানে করে ফেলেছেন আমাদের বিজ্ঞ লেখক মহোদয়।
দ্বিতীয় লিংকটির আলাপ পড়ে আমি আরো অবাক হয়েছি! সেখানে বস্তুত এন্টিবডি টেস্টিং এর ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে এফডিএ তার অনুমোদন প্রকৃয়াই অনেক শিথিল করে ফেলেছে। এই এন্টিবডি টেস্ট কেন অপরিহার্য সে ব্যাপারে সেখানে বলা হয়েছে:
“As the country starts to see positive signs that the mitigation efforts, like stay-at-home orders and social distancing, are working in our fight against the COVID-19 pandemic, the question of when we can return to work and resume our normal activities is one of the most critical issues facing our nation. Antibody tests – also known as serological tests – may have the potential to play a role in this complex calculation. Results from these tests can help identify who has been infected and developed antibodies that may protect from future infection as well as identify those still at risk. Results can also help inform who may qualify to donate blood that can be used to manufacture convalescent plasma, an investigational product for use with those who are seriously ill from COVID-19.”
এরকম প্রেক্ষাপটেই এফডিএ বস্তুত এখানে তাদের ভেলিডেশন, অনুমোদন- এসব প্রকৃয়াকে অনেক ফ্লেক্সিবল করেছে, যার উদ্দেশ্য হচ্ছেঃ “FDA Approach to Expanding Access to Serology Tests”। অনেক কিছুর বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে সেগুলোকে ম্যানুফেকচারের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। একইসাথে একটা সাবধানবানী রাখা হয়েছে, যেহেতু এই প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে স্কেল এণ্ড স্পিড আপ করার লক্ষে অনুমোদন প্রকৃয়া অনেক ফ্লেক্সিবল করা হয়েছে, তাই এই এন্টিবডি টেস্টিং কিট যাতে একটিভ পেশেন্টদের ব্যাপারে ক্লিনিকাল সিদ্ধান্ত নিতে ব্যবহৃত না হয়। অথচ, সেই লিংক পড়ে আলোচ্য প্রবন্ধে লেখকের মনে হয়েছে, এই কিটের কোন অনুমোদনই দেয়া হবে না, এই কিটের ব্যাপারে এফডিএ কিছু আশা করে না, ইত্যাদ! এই হচ্ছে একটি সায়েন্টিফিক আলোচনার ধরণ!
এবারে আসা যাক, লেখকের মূল আগ্রহের বিষয়ে। ‘গণস্বাস্থ্যের কিট নিয়ে কেন বিতর্ক?’ শিরোনামে তিনি কি কি বিতর্ক উত্থাপন করেছেন সেই আলোচনাতেই লেখকের মূল ইন্টেনশন আরো খোলাশা হয়ে যাবে! অবশ্য গণস্বাস্থ্যের কিট প্রসঙ্গটিতে আসার আগেই এন্টিবডি টেস্ট এর ব্যাপারে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে তিনি যেসব বিষয়ের অবতারণা করেছেন, তাতেই লেখকের ইন্টেনশন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তারপরেও, একেবারে শুরুর ভূমিকাতে যেহেতু তিনি জানিয়েছিলেন- আবেগ সরিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনায় তিনি যুক্তি ও প্রমাণের উপরে ভর করতে চান, সেই জায়গা থেকেই আগ্রহী ছিলাম যে, গণস্বাস্থ্যের কিট নিয়ে তিনি কি যুক্তি ও প্রমাণ হাজির করেছেন এই বিতর্কে! আসুন সেই বিজ্ঞানভিত্তিক “প্রমাণ” ও “যুক্তি”গুলোর দিকেই আগানো যাক!
যুক্তি ১: # গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রথমে অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণের জন্য ‘র্যাপিড ডট ব্লট’ পদ্ধতিটির আবেদন করেছিল। কিন্তু হন্তান্তরের সময় ঘোষণা দেয় যে, তারা অ্যান্টিজেন সনাক্তকরণের জন্য কিটও তৈরি করেছে। তারা বলছে, অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির মধ্যে যে ফাঁকটি থাকে তা থেকে বের হওয়ার জন্য তারা এই দুই পদ্ধতি আবিস্কার করেছে। তারা বলছে, একটি প্লাস্টিক ডিভাইসের মধ্যে দুই ফোঁটা বাফার (buffet) বা বিশেষ দ্রবণ দেয়ার পর স্যাম্পলের সিরাম যোগ করা হয়। এরপর এই সিরামে থাকা অ্যান্টিজেন বা অ্যান্টিবডি দেখার জন্য গোল্ড কনজুগেট সলিউশন দেয়ার পর ব্লট পেপারে দুইটি দাগ পাওয়া যায়। এই দাগটি কি অ্যান্টিজেনের না অ্যান্টিবডি- তার কোনও উত্তর ছিল না।
খণ্ডন: হ্যাঁ, শুরুতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র র্যাপিড ডট ব্লট পদ্ধতিতে কেবল এন্টিবডি টেস্টিং কিট তৈরির কথা বলেছিলো। সেটি কিন্তু তারা তৈরিো করেছেন। এর সাথে তারা আরেকটি কিট, একই র্যাপিড ডট ব্লট পদ্ধতির (এন্টিজেন কিট) তৈরি করেছেন। যাতে, ভাইরাসের আক্রমণের শুরুর দিকেও আক্রান্তকে শনাক্ত করা যায়। অর্থাৎ ওনারা দুটো আলাদা আলাদা কিট তৈরি করেছেন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন কোন জায়গায়? একটি অনুমোদন নিয়ে আরেকটি কেন তৈরি করলো? এটি কি কোন প্রশ্ন হতে পারে? বিজ্ঞান তো সবসময় অগ্রসরমান, এক উদ্ভাবন থেকে আরেক উদ্ভাবন, আগের উদ্ভাবনকে আরো বিকশিত করা- এগুলোই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য। পরের কিটের জন্যে অনুমোদন নেয়া না হয়ে থাকলে অনুমোদন নেয়া তো কঠিন কিছু না, এখনো তো ট্রায়াল ফেজই শুরু হয়নি! তারা একটির জন্যে অনুমোদন নিয়ে অন্যটি বাজারজাত করেছেন- এমন কোন ঘটনাও ঘটেনি, ফলে এরকম প্রশ্নই অবান্তর। বরং, এই দুই কিটের সমন্বয়ে টেস্ট করলে, একজন আক্রান্তের শনাক্তকরণের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাচ্ছে, এটাকেই তো ইতিবাচক হিসেবে নেয়া দরকার। এবং আমরা বাংলাদেশে একসাথে এন্টবডি ও এন্টিজেন উভয় কিটই পাচ্ছি, এই খবরে তো খুশি হওয়া দরকার।
আর, হস্তান্তর অনুষ্ঠানে লেখক নিজে উপস্থিত যেহেতু থাকেননি, অনেক কিছু তার কাছে পরিস্কার নাই হতে পারে, কিন্তু তাই বলে সেই অজ্ঞতা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করতে পারেন কি? সেই হস্তান্তর অনুষ্ঠানের ভিডিওটি একটু মন দিয়ে দেখলেই তিনি বুঝতে পারতেন, দুই রকম প্লাস্টিক ডিভাইস আছে- একটি এন্টিজেন শনাক্ত করার জন্যে, আরেকটি এন্টিবডি শনাক্ত করার জন্যে। এন্টিজেন শনাক্তের প্লাস্টিক ডিভাইসে যদি দুটো ডট পাওয়া যায়, তাহলে এন্টিজেন পজিটিভ আর এন্টিবডি শনাক্তের প্লাস্টিক ডিভাইসে (সবকিছু এড করার পরে) দুটো ডট পাওয়া গেলে- সেখানে এন্টিবডি পজিটিভ। ফলে, “এই দাগটি কি অ্যান্টিজেনের না অ্যান্টিবডি- তার কোনও উত্তর ছিল না”, এই উত্তর অবশ্যই সেখানে ছিল, কিন্তু লেখক যদি তা ধরতে ব্যর্থ হন- সেটি ওনার সীমাবদ্ধতা, সেটি কিভাবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই কিটের ব্যাপারে বিতর্কের বিষয় হতে পারে? কি অসাধারণ বিজ্ঞান ভিত্তিক বিতর্কই না এই লেখক এখানে করেছেন!
যুক্তি ২: “গণস্বাস্থ্যের দাবি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পরই দেহে অ্যান্টিজেন পাওয়া যায়। অ্যান্টিজেন পাওয়ার ৫-৭ দিন পর অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ায় মৃদু উপসর্গকারীদের র্যাপিড ডট ব্লট অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে কিছু রোগী মিস হচ্ছে। আর সেই কারণে তারা অ্যান্টিজেন টেস্ট করার মাধ্যমে প্রাথমিক ফেইজের রোগীদেরও চিহ্নিত করতে পারবেন। (সূত্র-১)
গণস্বাস্থ্য বারবার বলছে, তারা তাদের কিটের কার্যকারিতা দেখার জন্য ৫টি কভিড-১৯ নমুনা পেয়েছে (সূত্র-১ এবং ১১)। আর এই নমুনাগুলো থেকে তাদের অ্যান্টিজেন টেস্ট শতকরা ৬৮ ভাগ সফলভাবে ফল পেয়েছেন। তার মানে এই গবেষক দল ৫টি নমুনার মধ্যে ৩ দশমিক ৪টি নমুনায় অ্যান্টিজেন পেয়েছে। বাকী ১ দশমিক ৬ জন রোগী ধরা পড়েনি । আবার তারা এটাও দাবি করেছে, তারা ৯৩ শতাংশ সফলভাবে অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণ করেছে। তার মানে ওই একই ৫ টি নমুনায় তারা ৪ দশমিক ৬ রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি দেখতে পেয়েছেন। কেবল দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন।
বিষয়টি সত্যি হাস্যকর ও লজ্জাকর। ৫টি স্যাম্পল টেস্টের মধ্যে ৩ দশমিক ৪ টিতে অ্যান্টিজেন + ৪.৬ টি অ্যান্টিবডি পাওয়া গেছে। তার মানে হচ্ছে মোট স্যাম্পল হচ্ছে ৮টি। তারা কি মনে করছে, এইসব স্যাম্পলে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি উভয় পাওয়া গেছে? সেটা সম্ভব নয়। অ্যান্টিবডি যদি তৈরি হয় তাহলে সেখানে অ্যান্টিজেন পাওয়ার সম্ভবনা ক্ষীণ। তাই তাদের এই কিটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থাকা অমূলক হবে না।
খণ্ডন: প্রথম প্যারাটি নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। কেননা, এন্টিজেন ও এন্টিবডি দুটো টেস্ট করার ফলে লাভ হচ্ছে- আক্রান্তের আর্লি স্টেজ ও সেই স্টেজ পার হওয়া পরে- উভয়ক্ষেত্রেই শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। এতে শনাক্ত করার সম্ভাবনা বাড়ছে, মানে দুটোর সেন্সিটিভিটি যুক্ত হচ্ছে (যদি সবক্ষেত্রেই দুটো টেস্ট করা হয়, যদিও আমার মতে এর দরকার নেই)। এটা অবশ্যই একটা পজিটিভ খবর।
এর পরে আলোচ্য প্রবন্ধের লেখক যে বিতর্ক উত্থাপন করেছেন, তা সম্পূর্ণ বায়বীয় ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে! এটা ঠিক যে, গণস্বাস্থ্যের গবেষকরা নিজেদের ল্যাবে যে ট্রায়াল চালিয়েছেন, তা খুব অল্প সংখ্যক নমুনার উপরে ভিত্তি করে করা। IEDCR আর কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে যে কটি নমুনা সরবরাহ করা হয়েছে, সে কটিই তারা পরীক্ষা করেছেন। ফলে, কেন এত অল্প নমুনা, এই প্রশ্নটি গণস্বাস্থ্যকে না করে নমুনা যারা দিয়েছেন, তাদের করা দরকার।
তবে, লেখক কোথা থেকে ৫ সংখ্যাটি বের করলেন, সেটি কেউ জানি না। এই এক ৫ টি নমুনার রেফারেন্স হিসেবে তিনি দুইটি নিউজের লিংক দিয়েছেন (দুটোই বিডিনিউজ২৪ এর)। যার একটি হচ্ছে সেই ১৮ মার্চের, যেখানে কেবলমাত্র উদ্ভাবনের কথা মিডিয়ায় এসেছে। আর গণস্বাস্থ্যকে নমুনা দেয়ার ঘটনা অনেক পরের। দ্বিতীয় নিউজটি অবশ্য ২৫ এপ্রিলের, কিট হস্তান্তর অনুষ্ঠানের পরে। কিন্তু সেখানেও তন্ন তন্ন করে খুঁজে এই ৫টি নমুনার কথা পেলাম না। পুরো হস্তান্তর অনুষ্ঠানটাও ভালো করে শুনে দেখলাম, সেখানে একবারের জন্যেও বলা হয়নি- কয়টি নমুনা তারা পেয়েছেন! ফেসবুকে একজনের আলাপে দেখলাম, মাত্র ২৫ টা নমুনা নাকি গণস্বাস্থ্য পেয়েছিলো- কিন্তু সেখানেও কোন রেফারেন্স পাইনি। তাহলে এই লেখক ৫ সংখ্যাটি কোথায় পেলেন? আর সেই বায়বীয় সংখ্যার উপরে এমন সব ছেলেমানুষি ক্যালকুলেশন করে তিনি লজ্জার ও হাস্যকর বিষয়ও আবিস্কার করে ফেলেছেন এবং পার্সেন্টেজ থেকে হিসাব করে তিনি বিশাল ভুলও বের করে ফেলেছেন, ৮ টি নমুনা আর ৫ টি নমুনার মধ্যে একটা মহা সন্দেহও তৈরি করে দিয়েছেন- সবকিছুই বরং হাস্যকরভাবেই উদ্ভট! ডাটা, তথ্য, উপাত্ত ছাড়া এমন হিসাব বের করা কোন কিসিমের বিজ্ঞান ভিত্তিক যুক্তি- সেটি বুঝতে পারা ভুল। অথচ, এরকম এজাম্পটিভ আলাপ থেকেই তিনি “তাদের এই কিটের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন” তুলে ফেলেছেন! কোন বিজ্ঞানে এরকম প্রশ্ন তোলা যায়, জানতে চাইছিলাম।
যুক্তি ৩: আগেই বলেছি সেরোলজিক্যাল টেস্টগুলোতে ফলস নেগেটিভ বা ফলস পজিটিভ হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি। এই ক্ষেত্রে মাত্র ৫টি স্যাম্পল টেস্ট করে আপনি কিছুতেই দাবি করতে পারেন না যে আপনার কিটের ফলস নেগেটিভ বা ফলস পজিটিভ নেই। সেটার পাসেন্টেস কতটুকু তা আপনারা সাংবাদিকদের প্রশ্নে উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। শুধু ব্যর্থই নয়, বরং গণস্বাস্থ্য বলার চেষ্টা করেছে যে, সেনসিটিভিটি নিয়ে প্রশ্ন করা অপ্রয়োজনীয় বরং কিট করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ করতে পারছে কিনা সেটাই মুখ্য বিষয়।
খণ্ডন: সেরোলজিক্যাল টেস্ট গুলোতে ফলস পজিটিভ আর ফলস নেগেটিভ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি, এই সংক্রান্ত আগের আলাপটা যে একেবারে অযৌক্তিক ও অজ্ঞতা প্রসূত ছিল, সেটি আগেই বলা হয়েছে। আর, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দুটো টেস্ট (এন্টিবডি ও এন্টিজেন টেস্ট) একত্রিত করে ফলস নেগেটিভের হার কিভাবে কমানো সম্ভব সেটি সহজেই বুঝার কথা। ৫ টি টেস্টের কথাটার কোন সোর্স নাই।
ছোট নমুনার উপরে চালানো ট্রায়ালে যে ফল পাবেন, সেটি তারা অবশ্যই বলতে পারেন। ওনারা মোটেও দাবি করেন নাই যে, ওনারা অসংখ্য নমুনার উপরে এই ট্রায়াল চালিয়েছেন, ওনারা এমন দাবিও করেননি যে, এই ট্রায়ালই শেষ কথা, আর কোন ট্রায়ালের দরকার নেই। ফলে, এটা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। আর, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে ব্যর্থ হওয়ার দাবিটা (“সেটার পার্সেন্টেজ কতটুকু তা আপনারা সাংবাদিকদের প্রশ্নে উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছেন”) সম্পূর্ণই মিথ্যাচার! এই জবাব যদি তারা না দিয়ে থাকতেন, তাহলে এর আগের যুক্তিতে এই লেখক ৯৩% আর ৬৮% সেন্সিটিভিটি ধরে হিসাবটা দাঁড় করালেন কোত্থেকে? নাকি, এই লেখক সেন্সিটিভিটি আর স্পেসিফিসিটির মানে জানেন না? না জানলে ওনাকে জানিয়ে রাখছি, ৯৩% সেন্সিটিভিটি মানেই হচ্ছে ফলস নেগেটিভের হার ৭%। আর ৯৭% স্পেসিফিসিটি মানেই হচ্ছে ফলস পজিটিভের হার হচ্ছে ৩%।
তাছাড়া সেই অনুষ্ঠানের বক্তব্যে এটাও পরিস্কারভাবে এসেছে যে, এই সেন্সিটিভিটি ওনারা যেটা বলেছেন- সেটা দুটো কিটের আলাদা আলাদা সেন্সিটিভিটি। দুটোর একসাথে সেন্সিটিভিটি হচ্ছে ১০০%। তার মানেই হচ্ছে, ফলস নেগেটিভের হার ০%। আর, এখানে যেহেতু শুধু কনফার্মড কোভিড-১৯ রোগীর স্যাম্পলের উপরে ট্রায়াল চলেছে, ফলে ফলস পজিটিভ পাওয়ার কোন স্কোপ ছিল না!
যুক্তি ৪: বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেরোলজিক্যাল কিট তৈরি করছে। কেউ কেউ আবার আইজিএম ও আইজিজি অ্যান্টিবডি টেস্ট কিট ৯৫.১ শতাংশ সফল বলেও দাবি করেছে। (সূত্র-৪)। তারা অন্তত শতাধিক রোগীর স্যাম্পল নিয়ে পরীক্ষার পরই তারা এই দাবি করেছে। কিন্তু গণস্বাস্থ্য মাত্র ৫টি টেস্টকে আমলে নিয়ে যে শতাংশ করার চেষ্টা করেছেন, তা সায়েন্টিফিক্যালি অনৈতিক। কিটের গ্রহণযোগ্যতা আনতে সংস্থাটির আরও বেশি টেস্ট আমলে নেয়া উচিত।
এইক্ষেত্রে অবশ্য তারা দাবি করতে পারেন, সরকার তাদের অসহযোগিতা করছে। অথচ তাদের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে, এই কিট উদ্ভাবনে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আনার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তা, ঔষধ প্রশাসন এবং করোনাভাইরাস পজেটিভ রোগীর রক্তের নমুনা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ভূমিকার প্রশংসনীয়।
তাহলে, কেন তারা আরো বেশি টেস্ট করলো না? কেন তারা ফলস নেগেটিভ বা ফলস পজিটিভের তথ্য জানালেন না? কেন তারা বারবার গণমাধ্যমে আপনাদের কিটের সফলতার হার শতভাগ বলে দবি করেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর জানা জরুরি। একজন গবেষক হিসেবে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ আমার কাছে বেমানান। তবে গবেষণার মৌলিক দিক এই কিট উদ্ভাবনে মার খেয়েছে।
খণ্ডন: একই আলোচনার পুনরাবৃত্তি হয়ে যাচ্ছে। সেই বায়বীয় ৫টি নমুনার ঢোল বারে বারে পিটিয়ে যাচ্ছেন এই লেখক, ফলে তার জবাব দিচ্ছি না, ফলস নেগেটিভ, ফলস পজিটিভের তথ্য জানালেন না কেন- এটাও মিথ্যা কিংবা অজ্ঞতা প্রসূত, কারণটা আগের যুক্তির খণ্ডনেই বলেছি। এখানে কেন শতভাগ সফলতার দাবি করলেন- এই ব্যাপারে লেখকের মহা আপত্তির বিষয়ে আলোকপাত করছি!
প্রথমত, তারদেরকে যেকটি নমুনা দেয়া হয়েছে, সেখানে তারা শতভাগ সফলতা পেয়েছেন এবং সেটাই তারা দাবি করেছেন। খুব সিম্পল। যেকোন রিসার্চার, যেকোন প্রোডাক্টের উদ্ভাবক, তার ল্যাবে বা পাইলটে যে আউটকাম পায়, সেটাই তারা প্রাথমিক পর্যায়ে ডিক্লেয়ার করেন। কোনদিন কেউ এসে প্রশ্ন করে না, এখনো তো ফাইনাল প্রজেক্ট রান হলো না, বা থার্ড পার্টি ট্রায়াল হলো না বা এই সেই হলো না- কেন তোমার আউটকাম ডিক্লেয়ার করছো! ঐ প্রশ্নই ইনভ্যালিড, কেননা ওনারা যেই সফলতার কথা বলছেন সেটা ওনাদের ল্যাব প্রাপ্ত নমুনার উপরে চালানো ট্রায়ালের সফলতা, এভাবেই সকলকে ধরতে হবে। এটায় মোটেও গবেষণার মৌলিক দিক মার খায় না!
তাছাড়া, এরকম শতভাগ সেন্সিটিভিটি পাওয়ার আরেকটা থিওরিটিকাল দিকও আছে! যেই জিনিসটা ওনারা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বুঝানোর চেস্টা করেছেন। সাধারণ পাবলিকের পক্ষে ধরাটা একটু কঠিন, কিন্তু লেখকের মত বিজ্ঞান নিয়ে প্রমাণ ও যুক্তি সহকারে কথা বলতে আসা কারোর এটা ধরতে পারার কথা ছিল! যাই হোক, এই কিটের গবেষকদের পয়েন্ট অব ভিউটা নিজের ভাষায় বলার চেস্টা করছি।
একজন ব্যক্তি যে সার্স-২ এ আক্রান্ত, শুরুর কয়েকটা দিন তার রক্তে এন্টিবডি পাওয়া যাবে না, কিন্তু ঐ সময়ে তার শরীরে প্যাথোজেন তথা এন্টিজেন থাকবে। এর পরে তার শরীরে এন্টিবডি তৈরি হবে। কিন্তু এন্টিজেন নাই হয়ে যাবে। তাহলে শুধু এন্টিবডি টেস্ট করলে, ভালো সম্ভাবনা হচ্ছে আর্লি স্টেজে এন্টিবডি পাওয়া যাবে না, মানে টেস্ট নেগেটিভ পাওয়া যাবে। তাহলে বিভিন্ন কোম্পানি যে সেন্সিটিভিটি ৯৫%, এমনকি ৯৮% ও বলে- সেটা নিশ্চয়ই আর্লি স্টেজে নমুনা না নিয়েই করেছে, কেননা তাদের ট্রায়াল যদি আক্রান্ত হওয়ার শুরুর ৩-৫ দিনের মধ্যে ট্রায়াল চালাতো সেন্সিটিভিটি ৫% এর নীচে চলে আসতো। সাধারণত ৫-৭ দিন পরে নমুনা নেয়ার কথা এন্টিবডি টেস্টে। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে এন্টিবডি তৈরি হতে আরো কিছুদিন দেরি হতে পারে। এখন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র দুটো টেস্ট পাশাপাশি করার মাধ্যমে বলছে, কেউ যদি আক্রান্ত হয়, তাহলে হয় এন্টিজেন থাকবে, অথবা এন্টিবডি পাওয়া যাবে। ফলে, দুটো টেস্টের কোন না কোন কিটে পজিটিভ আসবেই। সেখান থেকেই, থিওরিটিকালি দুই কিট মিলে প্রায় ১০০% সেন্সিটিভিটি পাওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত দুনিয়ায় IgG ও IgM কিটে ৯৮.৫% পর্যন্ত সেন্সিটিভিটি পাওয়া গিয়েছে, ডঃ বিজন তার কিটে ঐ দুই এন্টিবডির পাশাপাশি তৃতীয় আরেকটি এন্টিবডি শনাক্তের ব্যবস্থা করেছেন। ফলে, কিছু ক্ষেত্র পাওয়া যেতে পারে, যেটায় IgG IgM কোনটি শনাক্ত না হলেও ৩য় এন্টিবডি শনাক্ত হতে পারে। ফলে, এর মাধ্যমে ফলস নেগেটিভ পাওয়ার সম্ভাবনা আরো কমছে বা সেন্সিটিভিটি বাড়ছে; তার সাথে এন্টিজেন পর্যায়েও একজনকে (যাদের শরীরে এন্টিবডি তৈরি হতে দেরি হবে) এন্টিজেন টেস্ট কিটে পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। সবমিলেই তারা থিওরিটিকালি দাবি করছেন, মিলিত সেন্সিটিভিটি ১০০% হবে। এরকম ক্লেইমও একটা বিজ্ঞান। গায়ের জোরে নিজেদের কিটকে কেন শতভাগ সফল বলছেন- এমন প্রশ্নই বরং অপবিজ্ঞান!
আমি অবশ্য একটি ব্যাপারে সন্দিহান, সেটি হচ্ছে এন্টিজেন টেস্ট যদি রক্ত দিয়ে হয়, আর্লি স্টেজে রক্তে এন্টিজেন পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক সময়ে কমে যেতে পারে। দুনিয়ায় এন্টিজেন টেস্টের জন্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই respiratory tract থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গণস্বাস্থ্যের কিটে যদি রক্ত স্যাম্পল ব্যবহার হয় এন্টিজেন টেস্টের সেন্সিটিভিটি কিছুটা কমতে পারে। সেটিকে শতভাগ সাফল্য পেতে বড় বাঁধা মনে হয়েছে। তবে, শতভাগ সেন্সিটিভিটি এই মুহুর্তে অপরিহার্য নয়। দুটো কিট মিলে এমনকি ৯০% সেন্সিটিভিটি, স্পেসিফিসিটি পাওয়া গেলেও এই কিট নিয়ে মাস টেস্টিং শুরু করে দরকার বলে মনে করি। সে কারণে, এই শতভাগ সাফল্য নিয়ে মাথা ঘামানোর কোন দরকার আছে বলে মনে করি না।
যুক্তি ৫: ধরা যাক, গণস্বাস্থ্যের এই কিটে কোভিড-১৯ আক্রান্ত শতকরা ৬৮ জনকে প্রাথমিক অবস্থায় অ্যান্টিজেন শনাক্তকরণের মাধ্যমে চিহ্নিত করা গেল। বাকী ৩২ জনকে ধরতে ব্যর্থ হলো। আর ৩২ জন যদি পজিটিভ হয়, তাহলে এদের দ্বারা যে অন্যরা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর যদি মনে করা হয়, এই ৩২ জনের সবাইকে তারা অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে নির্ণয় করবেন, সেখানেও কিন্তু প্রশ্ন থাকবে। তা হলো- এই ৩২ জনের অ্যান্টিবডি সফলভাবে পাওয়া যাবে না।
যারা এই কিটের ব্যবহার নিয়ে অতি উৎসাহী তারা একবার ভাবুন, আপনি কিংবা আপনার পরিবার কেউ আক্রান্ত হওয়ার পর যদি এই ৩২ জনের মত এই কিটের মাধ্যমে শনাক্ত না হোন, তাহলে আপনি খুশি থাকতে পারবেন? শঙ্কার মধ্যে পড়বেন না?
বরং আপনার সময় ক্ষেপন হবে। আপনাকে সেই আরটিপিসিআর প্রতি ধরনা দিতে হবে। এছাড়া কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার বেশ কয়েকদিন পর উপসর্গ দেখা দেয়। ভাইরাসটি যখন অ্যান্টিজেনের প্রতিলিপি তৈরি করে, তখন সেটি কোষের অভ্যন্তরে ঘটে। প্রাথমিক অবস্থায় রক্তে কিভাবে অ্যান্টিজেন পাবেন? আর পেলেও সেটার ঘনত্ব কতটুকু? গণস্বাস্থ্যের কিটের অ্যান্টিজেনের ঘনত্বের সংবেদনশীলতা কতটুকু তা কি নির্ণয় করা হয়েছে?
গণমাধ্যমে যে চিত্র সংস্থাটির পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয়েছে তা কেবল অ্যান্টিবডি টেস্ট। অ্যান্টিজেন টেস্টের বিস্তারিত তথ্য সংস্থাটি কোথাও দিয়েছে কিনা চোখে পড়েনি।
শুধু তাই নয়, এই অ্যান্টিজেন যে শুধু করোনাভাইরাসের তা কিন্তু হলপ বলা যায় না। সাধারণ সর্দি-কাশি-জ্বরের অ্যান্টিজেনও থাকতে পারে। তাই এই পদ্ধতিটি ত্রুটিযুক্ত হতে পারে।
খণ্ডন: এই বিজ্ঞান ভিত্তিক “যুক্তি”, “প্রমাণ” “আলোচনা”টুকু পড়ে হাসবো, নাকি কাঁদবো বুঝতে পারছি না! যাহোক, ধৈর্য ধরে- বুঝানোর চেস্টা করা যাক।
এন্টিজেন পরীক্ষায় ১০০ জনের মধ্যে ৬৮ জন শনাক্ত হলো, কিন্তু ৩২ জনকে শনাক্ত করা গেল না। এই শনাক্ত করতে না পারার কারণ কি হতে পারে? এক) রক্তে অলরেডি এন্টিবডি তৈরি হয়ে গিয়েছে, দুই) রক্তে এখনো এন্টিবডি তৈরি হয়নি, কিন্তু এমনই আর্লি স্টেজ যে- রক্তে এখনো এন্টিজেনও যায়নি। প্রথম সম্ভাবনাটি এই ৩২ জনের মধ্যে ৩০-৩১ জনের ক্ষেত্রেই ঘটার কথা। ফলে, এই ডাবল টেস্টের এটাই সুবিধা যে, একটি কিটে অশনাক্ত না হলে অন্য কিটে শনাক্ত হবেই। এখন দ্বিতীয় যে সম্ভাবনা, সেটা নির্মূল করার উপায় কি? যেহেতু এন্টিজেন কিটের চাইতে এন্টিবডি কিটের সেন্সিটিভিটি ভালো, সে কারণে লক্ষণ দেয়া লোকদের টেস্টের ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখা দেওয়ার ৩-৫ দিন পরে টেস্ট করা গেলে ঐ সম্ভাবনাটাও অনেক কমে যাবে। এখন, এরপরেও যদি ২-৩ জনের ফলস-নেগেটিভ যদি আসে, এতে অসুবিধা কোথায়? কেননা, র্যাপিড টেস্ট তাদেরই করা হচ্ছে, যাদের পিসিআর টেস্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে, এরকম টেস্ট না করা হলে, উল্লেখিত ১০০ জন পজিটিভের সকলেই টেস্ট বাদেই ঘুরে বেড়াতো, টেস্টে করা হলে সেখান থেকে মাত্র ২-৩ জন নিজেদের নেগেটিভ জেনে ঘুরে বেড়াবে!
এখানে লেখক সেই অনুষ্ঠানে কতটুকু দেখানো হয়েছে, কতটুকু দেখানো হয়নি- এ ব্যাপারে অভিযোগ তুলেছেন। এটা কোনদিন যে অভিযোগের বিষয় হতে পারে, সেটিই বুঝতে পারছি না। তদুপরি, গণস্বাস্থ্যের অনুষ্ঠানটিতে ডঃ বিজন শীল এন্টিজেন ও এন্টিবডি উভয় কিটের কার্যপদ্ধতি বিষদ ব্যাখ্যা করেছেন। অথচ, তিনি সেটি দেখেননি, কিংবা বুঝতে পারেননি, সেখান থেকে তিনি এন্টিজেন টেস্ট সম্পর্ক কিছু জানেন না- এই মর্মে অভিযোগ দায়ের করেছেন! অভিযোগ দায়ের করা, বিতর্ক তৈরি করাই যখন মূল উদ্দেশ্য, তখন নিজের অজ্ঞতা, ব্যর্থতাও আরেকজনের প্রতি অভিযোগ আকারে উত্থাপত হতে পারে দেখছি! অবাক ব্যাপার!
আর এই যুক্তিটির শেষে লাইনে এন্টিজেন পদ্ধতির ত্রুটির কথা যেভাবে বলেছেন- সেখানেই বুঝা যাচ্ছে, এই এন্টিবডি- এন্টিজেন টেস্টের ব্যাপারে তিনি কত কম জানেন! না জেনেই এভাবে যে বিডিনিউজে আর্টিকেল লেখ যায় আর বিডিনিউজ যে সেটা ছাপায়ও, খুবই অবাক হওয়ার মত বিষয়ই বটে।
সেই অনুষ্ঠানে দাবি করা হয়েছে- এই এন্টিজেন কিটের স্পেসিফিসিটি হচ্ছে ১০০%, মানে সে ফলস পজিটিভ দিবে না। তার মানেই হচ্ছে এন্টিজেন টেস্টে অন্য প্যাথোজেন, সাধারণ সর্দি-কাশি-জ্বরের এন্টিজেন থাকলেও সেটিকে ভুলভাবে শনাক্ত করবে না! বিস্তারিত ব্যাখ্যা আগেও করেছি, এখানে তার পুনরাবৃত্তি করছি না। কেবল এতটুকু উল্লেখ করা যায়- এন্টিবডি টেস্টের চাইতে এন্টিজেন টেস্টে ফলস পজিটিভ হওয়ার সম্ভাবনা কম। কেন? আসলে এই র্যাপিড টেস্ট দুটোরই মূল এন্টিবডি-এন্টিজেন বাইণ্ডিং। এন্টিবডি টেস্ট কিটে থাকে এন্টিজেন, সে রক্তের সুনির্দিষ্ট এন্টিবডি পেলেই বণ্ডিং তৈরি করে, আর বণ্ডিং তৈরি হলেই ডট ব্লট তৈরি হয়। অন্যদিকে, এন্টিজেন্ট টেস্ট কিটে থাকে এন্টিবডি। এই এন্টিবডি কালেক্ট করা হয় একজন কোভিড-১৯ পজিটিভ ব্যক্তির স্যাম্পল থেকে। সেই সুনির্দিষ্ট এন্টিবডি যেহেতু সার্স-২ কে প্রতিরোধ করতে তৈরি হয়েছে, সে কেবল সার্স-২ কেই চিনতে পারে। ফলে, সাধারণ সর্দি জ্বর বা অন্য করোনাভাইরাসকে এই এন্টিবডি চিনতেই পারবে না, বন্ডিংও তৈরি হবে না। অন্যদিকে, এন্টিবডি কিটে এন্টিজেন প্রোটিন রাখলে সুনির্দিষ্ট এন্টিবডি তাকে চিনতে পারে ঠিকই, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে- এন্টিজেনের যে প্রোটিন রাখা হবে (সাধারণত স্পাইক থেকে রাখা হয়)- সেটা যদি ইউনিক না হয়, তাহলে অন্য প্যাথোজেনের (সাধারণত একই ফ্যামিলির জেনেটিক মিল থাকা) রেসপন্সে তৈরি হওয়া এন্টিবডিও কিটের সেই এন্টিজেনের সাথে বণ্ডিং করে ফেলতে পারে, ফলে ফলস পজিটিভ পাওয়া যেতে পারে। যেহেতু করোনাভাইরাস একই গ্রুপের এবং এদের জিনের মধ্যে ব্যাপক মিল আছে, সেহেতু যেটুকু প্রোটিন রাখা হচ্ছে- সেটা কোন কোন করোনাভাইরাসের সাথে মিলেও যেতে পারে- ফলে সেই এন্টিজেনকে উভয় ভাইরাস প্রতিরোধে তৈরি এন্টিবডিই গিয়ে বণ্ড তৈরি করতে চাইবে। সেজন্যেই এন্টিবডি ভিত্তিক টেস্টে ফলস পজিটিভ পাওয়ার হারটা একটু বেশি। এটা দূর করার উপায় হচ্ছে- ভাইরাসটা সম্পর্কে ভালোরকম স্টাডি। এই স্টাডির মধ্য দিয়েই আসলে একটা সুইটেবল ও ইউনিক এন্টিজেন প্রোটিন খুঁজে পেতে হয়। অন্যদিকে এন্টিজেন টেস্টের কিটের জন্যে কেবল আক্রান্তের রক্তের মাঝে সুনির্দিষ্ট এন্টিবডি খুঁজে পেলেই চলছে!
যুক্তি ৬: ঠিক একই প্রশ্নের জন্ম নেবে অ্যান্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে। নন-স্পেসিফিক প্যাথোজেনের অ্যান্টিবডি আর কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার অ্যান্টিবডির মধ্যে তফাৎ করার সাধ্য আপাতত এইসব সেরোলজিক্যাল টেস্টে নেই। তাই, এই টেস্টের মাধ্যমে আপনি কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারবেন না, আপনি কভিড-১৯ আক্রান্ত নন। তবে আশার কথা হলো, অ্যান্টিবডি টেস্ট যখন করা হয়, তখন রোগী সেরে উঠার পর্যায়ে থাকে।
খণ্ডন: এন্টিবডি টেস্ট কিভাবে কাজ করে, শরীরের ইম্যুউন সিস্টেম কিভাবে কাজ করে, এন্টিবডি-এন্টিজেন কিভাবে বাইণ্ডিং তৈরি করে- এগুলো না জেনেই এখানে লেখক কথা বলেছেন এবং ভুলভাল তথ্য উপাস্থাপন করেছেন। এ বিষয়ে আগেই বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
যুক্তি ৭: স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ওষুধ বা ডিভাইস তৈরি হলে, এর কিছু প্রটোকল মানতে হয়। যা গণস্বাস্থ্য মেনেছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। সায়েন্টিফিক্যালি গণস্বাস্থ্যের উৎপাদিত কিট ইনভিট্রো টেস্টের ডেভেলপমেন্ট স্ট্রেজে রয়েছে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল পাওয়ার পর তা সংশ্লিষ্ট দপ্তর যেমন ঔষধ প্রশাসনের ২০১৫ সালের মেডিকেল ডিভাইস নিবন্ধন নির্দেশনায় বলা হচ্ছে, ক্লিনিক্যাল Evaluation, Evidence, Investigation, Performance, Safety এইসব বিষয়ে উত্তীন্ন হওয়ার পর তা জমা দিতে হয়।
৯ পৃষ্ঠায় স্পষ্ট বলা হচ্ছে, Notified Body is a third-party, accredited body which will be approved by DGDA for the purpose of verification, testing and certification of the manufacturer of medical devices in Bangladesh for the purpose of registration with DGDA. (সূত্র-১৪)
ঠিক এই ধাপগুলো সম্পন্ন না করে, কিভাবে একটি কোম্পানি দাবি করতে পারে যে তারা কিট উৎপাদন করছে? ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে উত্তীর্ন না হয়ে চিকিৎসাবিদ্যার কোন ঔষধ বা ডিভাইস অনুমোদনের কোন রেওয়াজ বিশ্বে নেই। তাই গণস্বাস্থ্যের এই দাবি যথার্থ অনৈতিক আবদার ছিল।
গণমাধ্যমে তারা বারবার বলছেন, যে সরকারের কেউ এই কিট নিতে আসেনি। বিষয়টি আসলে, প্রচলিত গাইডলাইন অনুযায়ী যায় না। আপনার আবিস্কার মূল্যায়নের জন্য ঔষধ প্রশাসন আপনার ঘরে যাবে না বরং আপনাকে কিটের প্রটোকল, ডেটা, প্রকাশনা জমা দিয়ে অনুমোদনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
খণ্ডন: এসব প্রোটোকলের হাইকোর্ট দেখানোটা এরকম মহা দুর্যোগকালে খুবই হাস্যকর ও খেলো! অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত তাদের কিট বাজারে যাবে না, সেটা সবাই জানে, খোদ গণস্বাস্থ্যের বিজ্ঞানীরাও জানেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রোটোকল মেনেই ওষুধ অধিদপ্তরে পরদিন গেছে, সেখান থেকে তাদের থার্ড পার্টি দেখিয়ে দেবে, ট্রায়াল হবে, ট্রায়ালের ফলের পরেই তাদের উৎপাদিত কিট অনুমোদন পাবে বা রিজেক্ট হবে। এগুলো সবাই জানে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বা এই কিটের পক্ষে যারা, তারা কেউই বলছে না যে, ট্রায়াল বাদেই এটাকে অনুমোদন দিতে হবে! তাহলে অনৈতিক আবদারটা কোথায় কে করলো? আর, অনুমোদন বাদে কিট উৎপাদন করা যাবে না কে বললো? ট্রায়াল রান করার জন্যেও তো অনেক কিট লাগবে, সেগুলো উৎপাদন করতে পারবে না? ধরলাম, বাংলাদেশে অনুমোদন মিললো না, কিন্তু বাইরের কোন এক দেশ এই কিট নিতে আগ্রহী হলো। তাহলেও কি তারা উৎপাদন করে রপ্তানী করতে পারবে না? ফলে, অনুমোদন ছাড়া কেন উৎপাদনের কথা বলছে- এই প্রশ্নও অবান্তর। আর গাইডলাইন অনুযায়ী, কোথাও বলা নাই- ওষুধ প্রশাসন কারো ঘরে যেতেই পারবে না! গাইডলাইন অনুযায়ী, সেই বাধ্যবাধকতা তাদের উপরে দেয়া নাই, কিন্তু কারো ঘরে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞাও নাই। ফলে, ওষুধ প্রশাসন যদি সেই অনুষ্ঠানে থার্ড পার্টিকে সাথে করে নিয়ে যেত এবং থার্ড পার্টির সাথে আলাপ করে- সেখানেই বাজেট দেয়া, প্লান পরিকল্পনা করা- এসব করা যেত, তাহলে কাজটা অনেক দ্রুত হতো, কিন্তু গাইডলাইনের বরখেলাপও হতো না! কিন্তু, এতে সরকারের আগ্রহ, এইসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর তথা সরকারের সদিচ্ছা – এসব প্রকাশ পেত। আজ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই কিটের মাস উৎপাদনের যাবতীয় আগ্রহ, প্রয়োজন, ইচ্ছে এবং দায় যেনবা কেবলমাত্র এর উৎপাদক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রেরই! ঠিক এই জায়গাতেই বিরোধিতা করি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই কিটের অনুমোদন, উৎপাদন, বাজারজাত করণ তাদের চাইতে যতখানি না জরুরী- তার চাইতেও বহুগুণ জরুরী এ দেশের মানুষের, এই জায়গাটা বুঝতে পারলেই- এরকম অপ্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলো সামনে নিয়ে আসা হতো না!
আমি একজন নাগরিক হিসেবে – কি আকাঙ্খা পোষণ করি? কার কাছে আকাঙ্খা পোষণ করি? এই সময়ে ঐ কিট আমাদের দরকার। দেশের জনগণের দরকার। গণস্বাস্থ্য যদি প্রোটোকল না মানে, গণস্বাস্থ্য যদি রাজনীতি করে- এইসব নিয়ে হাজারো সমালোচনা গালিগালাজ করে লাইনের পর লাইন লেখা যাবে, তাতে লাভের লাভ কি হবে? সে কারণে আমি সরকারকেই দেখতে চাই। সরকার যদি আন্তরিক হতো, সরকার যদি সিরিয়াস হতো, সরকার যদি এই কিটের অপরিহার্যতা বুঝতে পারতো, সরকার যদি দায়বদ্ধ হতো- তাহলে একটা কিট ট্রায়াল হতে হতে এতগুলো দিন পার হতো না, এক মাসেরও উপরে চলে গিয়েছে- এরকম সংকট মুহুর্তে কিটের ট্রায়ালটাই করা যায়নি! এটাই বাস্তবতা! এই লজ্জাজনক ব্যর্থতা গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের না, বরং বেশি সরকারের বলে মনে করি।
যুক্তি ৮: বিজন কুমার শীলরা যে কিট তৈরি করেছেন, তার মূল্য ৩০০/৩৫০ টাকার মধ্যে বলে দাবি করছেন। শনিবারের সংবাদ সম্মেলনে তিনি নিজেই বলেছেন তাদের ১ মিলিলিটার গোল্ড কনজুগেটে সলিউশনের দাম ৪৮০ ডলার বা ৪০ হাজার টাকা। এই রি-জেন্ট দুইফোঁটা করে লাগে। প্রতি ফোঁটায় যদি ১০ মাইক্রোলিটার করে লাগে তাহলে দুইফোঁটায় লাগবে ২০মাইক্রো মিলিলিটার মত রি-জেন্ট। প্রশ্ন হলো ১০০০ মাইক্রোলিটার (১ মিলি) দাম ৪০০০০ হাজার হলে তাহলে প্রতি টেস্টে (২০ মাইক্রোলিটার) খরচ পড়বে ৮০০ টাকা। এছাড়া তো আনুসঙ্গিক খরচ তো আছে। এখন প্রশ্নটা আপনাদের কাছে থাকলো, আপনারা যদি এই কিটকে সফলভাবে প্রয়োগই করতে চান তাহলে ভর্তুকি দেবেন কিনা! যদিও বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক, তবে কিটের ব্যবহারকে রংচং- এ করতে গণস্বাস্থ্যের কম মূল্যের কিট সরবরাহের দাবি মিথ্যানির্ভর বিজ্ঞাপন নয়তো?
খণ্ডন: এরকম প্রশ্নের আস্পর্ধা দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! বিডিনিউজ২৪ কিভাবে এমন অসংলগ্ন প্রলাপ, দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী, যারা এরকম ক্রাইসিস মোমেন্টে মানুষের উপকারে দেশে তৈরি কিট নিয়ে এসেছেন, তাদের প্রতি এমন ‘মিথ্যানির্ভর বিজ্ঞাপন’ এর মিথ্যা, বানোয়াট ও কল্পনাপ্রসূত অভিযোগ প্রকাশ করতে পারে? তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
এই বিজ্ঞানের ধ্বজাধারী লেখক, বিজ্ঞানের নাম ধরে এখানে আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই কুৎসা রটানোর কাজটি করেছেন। চরম অসততার সাথে দিনেদুপুরে মিথ্যাচার করেছেন। ডঃ বিজন শীলের মুখের কথাকে টুইস্ট করে নিজের মত ক,- প্রলাপ সাজিয়ে ওনাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করা চেস্টা করেছেন! ডঃ বিজন শীল সেই অনুষ্ঠানে অবশ্যই বলেছেন, “এই গোল্ড কনজুগেটের দাম খুব বেশি, এটা অসম্ভব দুষ্প্রাপ্য। প্রতি মিলিলিটার এর দাম ৪৮০ ডলার”। কিন্তুমোটেও বলেননি যে, সেটি ওনারা ৪৮০ ডলার দামে কিনে এনে ব্যবহার করছেন! তিনি সেখানে স্পষ্টভাবেই বলেছেন, সেই গোল্ড কনজুগেট (এবং প্লাস্টিকের ক্যাসেটটা) ওনারা দেশেই বানাতে পেরেছেন বলেই, এত কমদামে এই কিট দেয়া সম্ভব হচ্ছে! অথচ এই জ্ঞানপাপী লেখক, সম্পূর্ণ মিথ্যাচার করে সেই ৪৮০ ডলার থেকে এক দুই ফোটার দাম বের করে, ডঃ শীলকে মিথ্যাবাদী দাবি করলেন! এহেন নীচ ও নোংরা আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানাই।
পরিশেষে, আবারো বলছি- এরকম এন্টিজেন-এন্টিবডি টেস্ট মোটেও আরটি পিসিআর ভিত্তিক মলিকুলার টেস্টের বিকল্প নয়। রোগীদের ডায়াগনস্টিকে সেই আরটি পিসিআর টেস্ট আমাদের লাগবে, এই এন্টিবডি – এন্টিজেন টেস্ট অনুমোদন পাক বা না পাক, সেই পিসিআর টেস্টকে একদম জেলায় জেলায় নিয়ে যেতে হবে, সেই টেস্টের সংখ্যা, ক্যাপাসিটি অনেক বাড়াতে হবে। ফলে, এখন এই এন্টিবডি/ এন্টিজেন টেস্ট নিয়ে এত হইচইয়ের কারণে যদি এটাকে অনুমোদন দিয়ে পিসিআর টেস্টের বিকল্প হিসেবে একে চালানো হয়, সেটি হবে আত্মঘাতী! সেদিকটিতেও আমাদের সচেতন থাকতে হবে বৈকি।
(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে সে ব্যাপারে বাংলায় দারুণ একটি প্রবন্ধ হচ্ছে “দেহের রণকৌশল: ইমিউনিটি-সিস্টেম”। এই প্রবন্ধের ও প্রবন্ধের নীচে উল্লেখ করা “The Great Courses” থেকে প্রকাশিত “Stephen Nowicki” এর “Biology: The Science of Life” এর সহায়তা নিয়েছি। এছাড়া আমার মাইক্রোবায়োলজিস্ট বড় ভাই, বন্ধু ও এক ছোট ভাইয়ের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছি, তারা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেল, রিসার্চ পেপার দিয়ে সহযোগিতা করেছেন)
লেখক: প্রকৌশলী ও গবেষক