সম্পাদকীয় মন্তব্য: হল্যান্ড-ভিত্তিক ইতিহাসবিদ ও লেখক রুটগার ব্রেগম্যান ইউরোপের অন্যতম তরুণ চিন্তকদের একজন। মানুষকে স্বভাবত স্বার্থপর ও খারাপ ভাবার যে প্রবণতা চালু আছে তার বিরুদ্ধে তার নতুন বই Humankind– এ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। মানুষ আদতে ভালো এতে বিশ্বাস করা যে বাস্তবসম্মত এবং উপকারী, পাল্টা যুক্তিতে তিনি তা ব্যাখ্যা করেছেন। বর্তমান করোনাক্রান্ত জমানাতে দাঁড়িয়ে তার বই ও ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করেছেন ‘টাইম’ এ প্রকাশিত ‘Acts of Kindness Are Really Contagious.’ Historian Rutger Bregman Argues for a New Way of Thinking About Humanity শীর্ষক সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালের ২২ মে। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন নিশাত জাহান নিশা, তিনি শাবিপ্রবির শিক্ষার্থী। সম্পাদনা করেছেন কাফি মোহাম্মদ তামিম, তিনি বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
সাহিত্যে যেভাবে মানুষকে স্বার্থপর হিসেবে দেখানো হয়, বাস্তবিক মানুষ ততটা স্বার্থপর নয় বলে আপনার নতুন বইতে (Human kind: A Hopeful History) আপনি লিখেছেন। যে সময় আপনি এটা লিখলেন, ঠিক তখনই করোনা ভাইরাস মহামারী সবকিছু বদলে দিয়েছে। আপনি কি এখনো আপনার মতকে ঠিক মনে করেন?
অবশ্যই, আমি এটা ঠিক মনে করি! সেকেলে ‘বাস্তববাদী’ অবস্থান থেকে যারা সভ্যতাকে দেখেন, তারা ভাবেন এটা একটা সূক্ষ আবরণ ছাড়া কিছু নয় এবং সংকটকালীন সময় আসলেই সে আবরণ খসে আমাদের প্রকৃত স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে এবং আমরা সবাই স্বার্থপর প্রাণী হয়ে যাই। প্রচলিত এই আখ্যানকে ঘুরিয়ে এই বইয়ে আমি এটা দেখাতে চেষ্টা করেছি যে, সহস্রাব্দ ধরে বন্ধুভাবাপন্ন হয়েই মানুষ বিবর্তিত হয়েছে।
স্বার্থপর ব্যবহার সবসময়ই আছে। মানুষজন মজুদ করে রাখছে এরকমও অসংখ্য উদাহরণ আছে। কিন্তু এই মহামারীতে আমরা দেখেছি বেশিরভাগ সাধারণ নাগরিক স্বভাবতই পুরোদস্তুর সামাজিক। প্রতিবেশীদেরকে সাহায্য করতে তারা উদগ্রীব। মোটা দাগে এখন আমরা এটাই দেখতে পাচ্ছি।
আপনার কি মনে হয় এরকম চিন্তার জন্য এটা সঠিক সময়?
আমার বিশ্বাস, আমার বইয়ের বার্তাটি এসময়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। কেননা শুধুমাত্র ভাইরাস-ই সংক্রামক নয়, আমাদের ব্যবহারও তাই। যদি আমরা ধরে নিই, বেশিরভাগ মানুষ প্রকৃত অর্থেই স্বার্থপর এবং এর ভিত্তিতে এই ভাইরাসকে মোকাবেলা করতে চাই, তবে মানুষের মাঝেও আমরা এটার প্রকাশ দেখতে পাবো। কিন্তু যদি আমরা ভাবি, বেশিরভাগ মানুষ একে অপরের পাশে দাঁড়াতে চায় এবং তারা অন্যকে সাহায্য করতে চায়, কেবল তখনই আমরা মানুষকে উৎসাহিত করতে পারব। এটা কিছুটা চটকদার শোনালেও দয়া বা পরোপকারিতা যে আসলেই সংক্রামক সে ব্যাপারে বহু মনস্তাত্ত্বিক প্রমাণাদি আছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এগুলো ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি আপনি যাদেরকে চেনেন না, কখনো দেখেননি তাদেরকেও অনুপ্রাণিত করে।
নির্দিষ্ট কিছু পেশার ওপর আমরা কিভাবে নির্ভরশীল, এই সংকটকালীন সময় সেই ভিন্ন বিষয় পরিষ্কারভাবে আমাদের দেখাচ্ছে। পুরো পৃথিবী জুড়ে সরকারগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পেশার তালিকা তৈরি করছেন। এবং আপনি সেখানে কোন hedge fund এর পরিচালক অথবা বিপণনকারী কিংবা সেরকম কাউকে খুঁজে পাবেন না। আর যাদেরকে আমরা খুব ভালো পারিশ্রমিক দিই না, যেমন আবর্জনা সংগ্রহকারী, শিক্ষক এবং নার্স, তাদেরকে আপনি এই তালিকায় পাবেন। কেননা তাদের ছাড়া আমরা চলতে পারি না, এমন মানুষে পরিণত হয়েছে। তাহলেই ভাবুন, দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব ঠিক কি হবে। এর কারণ একটা পুরো প্রজন্মের বেড়ে ওঠার ওপর এই মহামারীর প্রভাব থাকবে। ২০২০ কে একটি ঐতিহাসিক বছর হিসেবে আমরা মনে রাখব। এবং যুগ যুগ ধরে মানুষ বলবে, ২০২০ কে স্মরণ করো। স্মরণ করো, যখন সবকিছু আসলেই কঠিন ছিল। তখন আমরা কার ওপর নির্ভর করেছি? আমার মনে হয়, এর প্রভাব একটা পুরো প্রজন্মের ওপর থাকবে।
মানুষের প্রকৃতি নিয়ে আমাদের ধারণা এত জরুরি কেন? এক্ষেত্রে কোন বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ?
আমার মনে হয়, মানব-প্রকৃতি নিয়ে আমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেখানেই সবকিছুর সূত্রপাত। কেননা বেশিরভাগক্ষেত্রে আপনি মানুষকে ঠিক সেভাবে পাবেন, যেভাবে আপনি তাদের ভাবেন। তো, আমরা যদি ধরে নিই, বেশিরভাগ মানুষ প্রকৃতঅর্থেই স্বার্থপর এবং বিশ্বাসের যোগ্য না, তাহলে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ঐ ধারণার ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে। এবং সেখান থেকে আপনি ঠিক আপনার পূর্ব ধারণামত মানুষ তৈরি করবেন।
সাধারণত যারা মানুষকে স্বার্থপর মনে করে, তাদেরকে বাস্তববাদী আর যারা মানুষকে বিশ্বাস করেন তাদেরকে আদর্শবাদী বলা হয়। আপনি কি এ ধরণের তকমা দেয়াকে ন্যায্য মনে করেন?
বাস্তববাদী অবস্থানকে আমি নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করছি। পুরো বইয়ে আমি এটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি এবং দেখিয়েছি যে আসলে, সংকটকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি পরোপকারের জোয়ার দেখা যায়। পুরো বিশ্বের প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে আমরা পাঁচশেরও বেশী কেস স্টাডি পেয়েছি। যেখানে সমাজবিজ্ঞানী এবং নৃবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, প্রতিটা সময়ে আপনি যেন মানুষের মাথায় রিসেট বোতাম চাপেন এবং তারা তাদের ভাল সত্ত্বায় ফিরে যায়। তারা একে অন্যকে সাহায্য করতে শুরু করছে। বহু দশক ধরে, এমনকি কয়েক শতাব্দী ধরে পশিমা সংস্কৃতিতে আমাদের যা বলা হয়েছে এবং প্রতিদিন খবরে যা বলা হচ্ছে, এটি তার পুরো বিপরীত চিত্র।
মুক্ত বাজারকে অর্থনীতি সচল রাখার সবেচেয়ে ভাল পন্থা আর মানুষকে প্রকৃতই স্বার্থপর ভাবার ধারণাদুটিকে যদি একসাথে দেখি, আপনি কি এদের মাঝে কোনো যোগসূত্র খুঁজে পান?
হ্যাঁ, পাই। তবে পুঁজিবাদ বনাম কমিউনিজম অথবা বাজার বনাম রাষ্ট্র যে সময়কার বিতর্ক, আমি ঠিক সেই স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার প্রজন্ম না। আমি এরকম কোনো বাইনারী দুনিয়ায় বাস করি না। কিছুক্ষেত্রে বাজারব্যবস্থা সবচেয়ে ভাল কাজ করে তো কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কাছে সবচেয়ে উপযুক্ত সমাধান থাকে। আলোকায়নের যুগের অনেক বুদ্ধিমান চিন্তকরা মনে করতেন, অধিকাংশ মানুষকে স্বার্থপর হিসেবে ধরে নিয়ে বাজার তৈরি করলে, অধিকাংশক্ষেত্রে তা সবার জন্য ভাল হতে পারে। আমি শুধু ভাবি, বেশিরভাগক্ষেত্রে এটা অনেকদূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তবে বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদেরাই হয়ত ভুলে গিয়েছিলেন, মানবতা নিয়ে এরকম দৃষ্টিভঙ্গি, মানে তথা-কথিত ‘homo economicus’, আত্মস্বার্থ রক্ষার দৈববাণী হয়ে উঠতে পারে।
আপনার বই পড়ে মানুষ যদি তাদের মত বদলায়, তবে আপনি কি ধরণের পৃথিবী দেখবেন বলে আশা করেন? কি ধরণের পৃথিবী তৈরী হওয়া সম্ভব?
আপনি প্রায় সবকিছুই ভিন্ন আঙ্গিকে করতে পারবেন। সম্ভবত, আমার বইয়ের সবচেয়ে র্যাডিকেল উদাহরণগুলির একটি হল, আমি দেখিয়েছি নরওয়ের কারাব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে। মূলত কারাবন্দীদের তারা নিজেদের মত চলার স্বাধীনতা দেয়। এমনকি প্রায়ই তাদের কাছে নিজের কারাকক্ষের চাবিও থাকে। জেলগুলোতে সিনেমা এবং লাইব্রেরীও আছে যেখানে তারা প্রহরীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সময় কাটাতে পারে। আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, এদেরকে আপনার পুরোপুরি পাগল মনে হবে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আপনি অপরাধপ্রবণতার হার দেখবেন, তাই তো? যে একবার অপরাধ করেছে, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর, তার আবার অপরাধ করার সম্ভাবনা থাকে। আচ্ছা, যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধপ্রবণতার হার অনেক বেশি এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ দেশগুলোর মাঝে একটি। কিন্তু নরওয়েতে এ হার সর্বনিম্ন। নরওয়ের জেল-ই আসলে এক্ষেত্রে ‘বাস্তবিক’ জেল, নরওয়েতে যেখানে বন্দীদের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, আমেরিকান জেলে সেখানে বন্দীদেরকে প্রাণী, এমনকি পশু হিসেবে দেখা হয়। এবং বর্তমানে করদাতাদের অর্থ থেকে পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠান মানুষকে আসলে আরও অপরাধপ্রবণ হওয়ার শিক্ষা দেয়। মূলত এটাই তারা।
আদর্শ হিসেবে জাতীয়তাবাদের ক্ষমতাকে আপনি কিভাবে ব্যখা করবেন? একটা জাতির ধারণা গড়ে তুলতে অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোকে চিন্তা থেকে বাদ দিতে হয়। এবং সংযুক্তি হিসেবে, তাদের প্রাপ্য সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত করতে হয়। যেমন প্রায়শই এটার সাথে জুলুম জড়িত থাকে। মানুষের সহজাত শোভন আচরণের সাথে এটি কি করে যায়?
আচ্ছা, আমার পুরো বইয়ে এই জরুরি প্রশ্নটা জুড়ে আছে। আমরা এমন সব ভয়ংকর কাজ করি যেটা প্রাণীজগতের আর কোন প্রাণী করে না। এমন কোন পেঙ্গুইন নেই, যে কি না অন্য পেঙ্গুইনদের আটকে রেখে ধ্বংস করতে চাইবে। এরকম অপরাধ শুধু মানুষই করতে পারে। জীববিজ্ঞানের ‘self-domestication’ তত্ত্ব থেকে আমরা এর উত্তর খুঁজতে পারি, যেখানে বলা হয়েছে বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে-ই মানুষ বিবর্তিত হয়েছে। এবং কিছু কিছু জীববিজ্ঞানীর মতে এর কিছু খারাপ দিক রয়েছে। কারণ বন্ধুভাবাপন্নতা, একটি গোষ্ঠীতে ফিট হতে চাওয়া কখনো সখনো সত্য ও ন্যায়ের পথে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। আমাদের সামাজিক গোষ্ঠীগুলোতে অন্তর্ভূক্ত না হওয়াটা, স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে যাওয়া খুব কঠিন। এমনকি শিশুদের মাঝেও এটি দেখা যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৩ থেকে ৬ মাসের শিশুরাও ভাল এবং খারাপের মাঝে তফাৎ করতে পারে এবং তারা ভালটি বেছে নিতে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করে। তবে তাদেরও xenophobic (ভিন্নতার প্রতি ভয়) প্রবণতা আছে। অপরিচিত শব্দ কিংবা মুখ তারা পচ্ছন্দ করে না। তো এই আদিম প্রবৃত্তিটি (a tribal button) আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব।
কিন্তু প্রচুর পরিমাণে হলিউড এবং নেটফ্লিক্স সিরিজ দেখলে আপনার মনে হতে পারে, মানুষ সহজেই একে অন্যের সাথে সহিংস আচরণ করতে পারে। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা এবং যুদ্ধের ইতিহাস থেকে আমরা জানি, মানুষের জন্য এটা করা সত্যিই খুব বেশি কঠিন। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আনুমানিক মাত্র ১৫-২০ শতাংশ সৈনিক গুলি করতে পেরেছিল। শত্রুর চোখের দিকে তাকিয়ে ট্রিগার টানতে বেশিরভাগই পারেননি। কিন্তু তার মানে এই নয়, আপনি মানুষকে দিয়ে এটা করানোর মত অবস্থা তৈরি করতে পারবেন না, অথবা আপনি এমন কোন কামান (an artillery device) তৈরী করতে পারবেন না যার ট্রিগার মানুষ টানতে পারে অথবা দূর থেকে মানুষকে হত্যা করতে পারে। এর মানে হল মানুষকে দিয়ে সহিংসতা করানোর সমস্ত রকম প্রযুক্তিগত এবং মনস্তাত্ত্বিক ব্যবস্থাই আছে। তবে এটাই আমাদের মূল প্রবৃত্তি নয়। বেশিরভাগ মানুষের জন্য এটা সত্যিই খুব কঠিন।
আরেকটি দুর্দান্ত ব্যাপার হল মানুষের উৎফুল্ল হওয়ার মত অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে। এই যে অবচেতনভাবে আমরা আমাদের গভীরতম অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি, আপনি ভাবতে পারেন এটা কি করে বিবর্তনের সুবিধা হতে পারে? এটি আসলে দেখায় যে আমরা সহযোগীতা করতে বিবর্তিত হয়েছি। এটি ছোট পরিসরে ভাল কাজ করে। ১০,০০০ বছর আগে আমরা যখন প্রথম বসতি গড়ে তুললাম, গ্রাম ও শহরে বাস করা শুরু করলাম, কৃষিকাজ শুরু করলাম, আক্ষরিক অর্থে তখনই আমরা একে অন্যের দৃষ্টির নাগালের বাইরে চলে গেলাম। এবং এর ফলে যেসব কারণে আমাদের বিবর্তন হয়েছিল, সেগুলো আর কাজ করল না। এসময়ে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথমবারের মত যুদ্ধ শুরু হওয়া আসলে কোন কাকতালীয় ব্যাপার নয়। এর কারণ আসলে মানুষের মাঝে দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল।
তো বর্ণবাদ অথবা কুসংস্কার অথবা মানব-প্রকৃতির আদিম প্রবৃত্তিগুলোর বিপরীতে কিছু করার সহজ এবং একমাত্র সমাধান হল যোগাযোগ। মানুষকে একে অন্যের সাথে মিশতে হবে।
আমার মনে হয় এমন একটি বৃটিশ উদাহরণ আছে – যেসব নির্বাচনী এলাকায় অভিবাসনের হার সবচেয়ে কম ছিল, সেগুলোতেই ব্রেক্সিটের পক্ষে (অভিবাসনের বিরুদ্ধে) সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছিল।
এটা তো দারুণ একটা উদাহরণ। বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিবেশীদের মাঝে থাকা বেশিরভাগ মানুষই ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাঝে থাকতে চায়। ২০১৬ সালের ট্রাম্প নির্বাচনেও ঠিক এটাই হয়েছিল। যারা খুব কম বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রতিবেশীদের মাঝে ছিল, তারাই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিল। স্কুলের মত প্রতিষ্ঠান বানানোর ক্ষেত্রে এটা সবসময় মনে রাখা উচিত। এটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন ধরণের মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া দরকার কেননা জীবনে তো আসলে তাই হয়।
গত বছর দাভোসে টাইম আয়োজিত সম্মেলনে আপনি ছিলেন। সেখানে আপনি ধনাঢ্য (billionaires) ব্যক্তিদেরকে দয়াদাক্ষিণ্যের কথা ছেড়ে তাদের কর প্রদানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ভিডিওটি ভাইরালও হয়েছিল। এর প্রায় ১ বছর পার হয়ে গেছে। আপনি কি এক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি লক্ষ্য করেছেন?
আমি আসলে আশাবাদী। সত্য বলতে আমার মনে হয়, আমরা একটা দারুণ সময় পার করছি। আমাদের চোখের সামনে যুগের চিন্তাধারা বদলে যাচ্ছে। এমনকি আপনি দেখেন, জো বাইডেনের জলবায়ু পরিকল্পনা বার্নি স্যান্ডাসের ২০১৬ এর জলবায়ু পরিকল্পনার চেয়ে অনেক উচ্চাভিলাষী। এমকি বাইডেনও ধনীদের কাছ থেকে বেশি কর রাখতে চান। এটিই এখন নতুন-স্বাভাবিক অবস্থা হয়ে গেছে। আমি আসলেই মনে করি ওভারটোন উইণ্ডোটি (মানুষের দ্বারা স্বীকৃত রাজনৈতিক পলিসি) চলতে শুরু করেছে। করের ক্ষেত্রেও আপনি এটা দেখবেন। তো ১০-১৫ বছর আগে যখন আমরা এটা নিয়ে কথাও বলতাম না, তখন আসলে সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল।
এখন করোনা ভাইরাস আসলেই সবকিছু বদলে দিচ্ছে। এটি ‘নব্য-বাস্তববাদী’ আন্দোলনের মত একটি বড় আন্দোলনের শুরু হতে পারে যেখানে মানুষকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটিও হবে আধুনিক। ১৯৭০ এর দশক থেকে পশ্চিমে টিকে থাকা নয়াউদারনীতির (neoliberalism) মত অবিশ্বাস্যভাবে শক্তিশালী ধারণারও শেষ হবে এখানে। এর মূল কথাটি ছিল অধিকাংশ মানুষ আসলে স্বার্থপর। কিন্তু অধিকাংশ মানুষকে স্বার্থপর ভাবার ধারণাটি মহামারীর সময়ে একেবারেই কাজ করে না। এখান থেকে হয়ত আমরা নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারব। এটি হবেই এমন ধারণা আমি করছি না। এটি একটি আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, এই মহামারীতে হয়তোবা এটি ত্বরান্বিত হবে।
মহামারীর সাথে মানবজাতির জন্য আরেকটি বড় চিন্তার বিষয় জুড়ে আছে : জলবায়ু পরিবর্তন। এক্ষেত্রে যে কথাটি আমরা সবসময় শুনছি – এই সংকট মোকাবেলায়, মানবজাতির মঙ্গলের জন্য কাঠামোগত পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে, যেমন বিলাসবহুল জীবনযাপন হয়ত ছেড়ে দিতে হবে। মানবতাব্যাপী এসব সংযমের পরেও এই লক্ষ্যে পৌঁছান খুব কঠিন। মানুষ প্রকৃতই ভাল– আপনার এই যুক্তির সাথে এটাকে কিভাবে মেলাবেন?
আমার বইয়ে আসলে মানবজাতির সমন্বিত শক্তির কথা বলা হয়েছে। এককভাবে আমরা খুব বেশি কিছু অর্জন করতে পারি না। কেননা আমরা খুব বেশি বুদ্ধিমান বা শক্তিধর না। শুধুমাত্র বড় পরিসরেই মানুষের শক্তি প্রকাশ পায়। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও ঠিক এ কথাই খাটে। আমাদের একক সিদ্ধান্ত কখনই জলবায়ু সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। আমি বলছি না যে, এর কোন ভূমিকা নেই। আমি বলতে চাচ্ছি, বিষয়টি রাজনৈতিক। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন যে সামাজিকভাবে, আমাদের সবাইকে একটা বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। শান্তিরকালের আগে আমরা কখনোই যা করিনি, তা এবার আমাদের করতে হবে। ২০৩০ এর মাঝে নির্গমনকে অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে এবং ২০৫০ এর মাঝে তা শুন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে হবে। আমূল পরিবর্তন আসলে এ সময়ের নব্য বাস্তবতা। গ্রেটা থানবার্গের অবস্থান এ বিষয়ে পুরোপুরি ঠিক। পৃথিবী এমন একটা অবস্থায় যাচ্ছে, যেখানে উষ্ণতা ৩ ডিগ্রি বেড়ে যাবে। এবং এটা একটা গড়পড়তা ধারণা। তবে এর চেয়ে খারাপ কিছুও হতে পারে। আমি এখন নেদারল্যাণ্ডে আছি এবং এখনকার একটা বড় অংশ সমুদ্রতল থেকে কয়েক মিটার নিচে। আমি সেখানকার বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তারা আসলে সন্ধিহান যে, তাদের নাতি-নাতনিরা ২২ শতকেও এখানে থাকতে পারবে। আমরা দেশটিকে বাঁচাতে পারব এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। এবং অবিশ্বাস্যভাবেই দায়টা তাই খুব বেশি। তবে প্রযুক্তিগতভাবে এটি সম্ভব। অতীতেও আমরা এরকম কাজ করেছি। তার মানে এটি অসম্ভব কিছু নয়। তবে পরিবর্তনের এই ধারাটা আরো বেগবান করতে হবে।